অন্য আলো
কামাল রাহমান
১
মহাকালের অনির্ধারিত কোনো দিনবদলের দুর্লভ এক মুহূর্তে গাইডবুকের চকচকে মলাটের উপর দারুণ সুন্দর এক যুদ্ধবাজ কালো ঘোড়ার মতো মাথা উঁচিয়ে থাকা মানচিত্রের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুকের ভেতর রঙিন স্বপ্নের একটা বীজ বোনা হয়ে যায়। পৃথিবীর এই আশ্চর্য দ্বীপদেশের কঠিন মাটির অনেক গভীরে পাতালছোঁয়া শেকড় ছড়িয়ে দেবে ঐ বীজ থেকে জন্মানো, এখনো অস্পষ্ট ও অনেকটা অজানা এক স্বপ্ন, কল্পনা ও রহস্যের মিশেলে বেড়ে ওঠা ঐ গাছ। তাহলে এই আমার দ্বিতীয় দেশ, একটা ঘোড়ার মাথা! আর ক ঘণ্টা পর পা রাখতে যাচ্ছি ওখানে, ত্রিশ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে ঘণ্টায় সাড়ে পাঁচশ মাইল বেগে বিমান এগিয়ে চলেছে এখন ঐ দেশটার দিকে। অজানা এই উত্তেজনার সঙ্গে বুকের অনেক ভেতরে মিশে থাকা একটা দীর্ঘশ্বাসও আটকে থাকে ফেলে আসা গাঙ্গেয় ঐ বদ্বীপটার জন্য। ছোট্ট এ জীবনের যাপিত, প্রাণস্পর্শী ছোট্ট অংশটার জন্য, বিচিত্র প্রকৃতি ও আশ্চর্য মানুষজনের জন্য। জীবনের এই রহস্য অন্য খাতে বয়ে নিয়ে যায় যে-সব দিন, সেগুলোর একটা এখন মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে উঁচু আকাশে, এবং অবচেতনের কোনো এক ইচ্ছের অদৃশ্য সুতো ধরে বিলেতে আমার প্রথম পা রাখার এই তারিখটা পারিবারিক এক ইতিহাসও সৃষ্টি করে। দেড়শ বছর পর আমার নাতির ঘরের পুতি, পুতির ঘরের লাই, যার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আমার নাকি নাই, পরিবারের ইতিহাস খুঁড়ে শেকড় খোঁজার জন্য যাবে বাংলাদেশে, যখন দেশের অনেকটাই নেই!
পায়ের নিচে সমুদ্র দেখার বিস্ময় ও ঘোর কেটেছে একটু আগে, নীল রঙে আঁকা একটা ছবির মতো রহস্যঘেরা ঐ সমুদ্রটা এখন আঁকাবাকা রেখায় লেপ্টে আছে সবুজের পাশে। ঢেউয়ের অবিরাম দাপাদাপি নেই ওখানে, অশান্ত উত্তাল গর্জন নেই, পড়ে রয়েছে অনেকটা সাদামাটা ও বিশাল এক মানচিত্রের মতো নিশ্চুপ। বুকের গভীরে দোলা লাগে, এই তবে শুরু আমাদের সাগর পাড়ি দেয়া, আরব হুন ইংরেজ দিনেমার এরা এই নীলের সাগর পাড়ি দিয়ে এসেছে এতোকাল। এবার উল্টোরথ, অন্য জীবন!
তারিখটা সতেরোশ সাতান্নোয়, আমাদের ভূখণ্ড হতে ইংরেজদের ভারতবর্ষে উপনিবেশীকরণের শুরু থেকে আঠারোশ সাতান্নোয় উপনিবেশরোধী বাহাদুর শাহর শেষ প্রচেষ্টা ভারতবাসী কর্তৃক নস্যাৎ করে দেয়া, উনিশশ সাতচল্লিশে লুটের রাজ্য নিজেদের কর্তৃত্বে রাখার জন্য ভারতবর্ষ বিভাজন, এবং ঐ বিভাজনে আমাদের স্বার্থ রক্ষায় নেতাদের ক্ষমাহীন অযোগ্যতা, অদূরদর্শীতা ও চরম ব্যর্থতা। কাকতালীয়ভাবে প্রতিটা সংখ্যার পেছনে রয়েছে সাত সংখ্যাটি, আর একাত্তরের শুরুই তো সাত দিয়ে, আমারও এখানে আসা উনিশ শ সাতষট্টিতে, তারিখটাও আবার সাতই জুন, সিরাজের পতনদিন! বিমানে বসে মনে হয়েছে সিরাজের যে জুতোজোড়া ওকে ধরিয়ে দিয়েছিল, ওটার একটা রেপ্লিকা সঙ্গে নিয়ে এলে মজা হতো। হাস্যকরভাবে অবশ্য প্রায় ওরকম একটা কাজই করেছিল পরে আফ্রিকার স্বৈররাজা ইদি আমিন, অতিকায় জুতো পড়ে বিলেতে বিচরণ করে!
বিমানের জানালায় চোখ থাকায় এমন একটা দৃশ্য চোখে পড়ে যা অতীতে দেখা হয় নি কখনো এবং ভবিষ্যতেও হবে না আর। যারা অনেক বেশি আকাশ ভ্রমণ করে তাদেরও দেখা হয় না এটা। আরেকটা বিমান অতিক্রম করে যায় আমাদের বিমানটাকে, এত অল্প সময়ের জন্য যে সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়েও ওটার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। সাধারণত একই উচ্চতায় দুটো বিমান অতিক্রম করে না, ফলে এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। মনের ভেতর আরো একটা বিষয় স্থায়ী হয়ে যায় ঐ মুহূর্তে। পৃথিবীর উপরিভাগের কোনো এক বিন্দুতে অতিক্রম করে যায় পরস্পর বিপরীতমুখী দুটো ভিন্ন সংস্কৃতি, এখানেও কাকতালীয়ভাবে দুটো মিশ্র সংস্কৃতি। ইংরেজরা যেমন হাজার হাজার বছর ধরে দ্বীপের বাইরের মানুষ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, শাসিত হয়েছে, এবং গড়ে ওঠেছে, গাঙ্গেয় বদ্বীপের মানুষেরাও তাই। কিছুটা দূর পূর্বপুরুষ আমার, বারো ভূঁইয়ার এক ভূঁইয়া ঈশা খাঁর রক্তবীজ, জিন বয়ে চলেছি শরীরে, ইতিহাসের ভাবনাটা তাই সবকিছুতেই জড়িয়ে যেতে চায়।
মুহূর্ত আগে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বিমানটা ভীষণ নিঃসঙ্গ করে দেয়, যে দুটো সংস্কৃতি ক্রস করেছে ঐ মুহূর্তে, ধরে নেই, পেছনে চলে যাওয়া বিমানটি আমার ছোট্ট সংস্কৃতি, ওটার বাইরে থেকেও আজীবনের জন্য থেকে যাবো ওটার ভেতর। আর এই বিমানের ভেতরে থেকেও এটার সংস্কৃতি আমার নয়, এটার খাবার-দাবার, কথা বলা, ভাষা, ভঙ্গি, পোশাক-আশাক, কোনোটাই মেলে না পেছনে ফেলে আসা আমার সংস্কৃতির সঙ্গে। অথচ এটাই ধরে রাখতে হবে অবশিষ্ট জীবন।
ডানদিকে, আমার জানালার বাইরে শুধুই আকাশ, নরম মেঘ ছুঁয়ে যায় বিমানের ধাতব শরীর, প্রাণীর অনুভূতি পেলে আরো নিচে নেমে আসতো বিমানটা, যেখান থেকে পৃথিবীর রূপ কিছুটা হলেও দেখা যায়। হাত রাখি কাচের উপর, পেতে চাই মেঘের শীতল অনুভব, ত্বক ও পালকের দূরত্ব যত কমই হোক, আছে একটু হলেও। ভেতরের আঁটসাঁট পরিবেশ ও বাইরের একই রকম আকাশে ক্লান্ত হয়ে পড়ে চোখ। জানালার আকৃতি এইমাত্র আকর্ষণ করে অখণ্ড মনোযোগ। চৌকো নয়, কোন চারটে গোলাকার, গোল নয়, সরল বাহু রয়েছে চারটে, ডিম্বাকারও না, জ্যামিতি কি বলে, আয়তও না এমন একটা সমতলের ক্ষেত্রফল কীভাবে বের করা যায়? সবচেয়ে খারাপ উপপাদ্য, মাথার ভেতর অকারণে এতো চঞ্চল হয়ে ওঠে অন্যের সাহায্য নেয়ার কথা মনে হয়। বিমানবালাকে ডেকে জিজ্ঞেস করা যায় জানালাগুলোর ক্ষেত্রফল সম্পর্কে ওর ধারণা আছে কি না! বোতাম টেপার আগে বোঝা যায় নি ভুলটা, দূর থেকে ওর আকর্ষণীয় হাঁটা, শরীরের ছন্দ, মুখের লাবণ্য চোখে পড়ে। কাছে এলে অসাধারণ এক হাসি, চোখ মুখ ছাড়িয়ে ওর দাঁতের সৌন্দর্য! ওখানে চোখ রেখে নির্দ্বিধায় বলা যায়, এক গ্লাস জল পেতে পারি, প্লিজ? নিশ্চয়! দাঁতের উপরের পাটিতে লেগে থাকা লিপস্টিকের ছোট্ট একটা দাগ তখনো আকাশে এক ঝলক বিদ্যুতের মতো আমার চোখ ঝলসে রেখেছে। জল নিয়ে ফিরে আসে যখন পপি ফুলের রং ঠোঁট দুটিতে মিশে আছে একই হাসি, দাঁতের প্রান্ত ঘেষে লিপস্টিকের মোহন ঐ দাগটুকু নেই শুধু! জোর দিয়ে বলা যায়, খেয়ে ফেলে নি, ওটা মুছে এসেছে। এতো নির্ভুলভাবে পুরুষের বিভিন্ন দৃষ্টি ধরতে পারে মেয়েরা, যা প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতা একটা, নিঃসন্দেহে! ঐ মুহূর্তে পানের জন্য জল চাওয়ার বাইরে আর কিছু ছিল না মাথায়, এখন কত শত পানীয় প্রতিদিন! ছেলেবেলার কথা মনে করতে পারি, পানি ছাড়া অন্য তরল যা পান করা যেতো, তার তালিকা অনেক ছোট! প্রতিদিন পান করতে হতো দুধ, গ্রীষ্মে কেবল কোনো উপলক্ষে চিনিগোলা লেবু সরবত, কখনো বেলের, আরো বেশি পাওয়া যেতো আখের গুড়ে তেঁতুলগোলা ঠাণ্ডা পানি, শীতে খেজুরের রস, নানার বাড়ি ফরিদপুরের পাংশায় কখনো তালফুলের রস। তালিকা আর বাড়াতে কষ্ট হয়। অতিথি এলে, অথবা রোজার মাসে আরেকটা বিদঘুটে পানীয়, ওহ্, মনে হলে এখনো ওগলে ওঠে, গাঢ় গোলাপি রঙের রুহ আফজা, ওয়া ওয়া!
গতিময় পৃথিবীতে মানুষও চির-পরিবর্তনশীল, এক সময় যাদের শত্র“ ভেবে আক্রমণ করে তাড়িয়ে দিতে চায়, অন্য সময় তাদের আশ্রয়ে যেয়ে ওঠে স্বেচ্ছায়। মাত্র দু যুগ আগে আমার পূর্ব-প্রজন্ম এই ইংরেজ জাতটাকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার জন্য সংগ্রাম করেছে, এখন ইংরেজদের ঘরে আশ্রয় পাওয়ার জন্য দেশান্তরী হতে হয় আমাদের। মনের ভেতর একটা ভুল স্বপ্নের বীজ শোষক ও শোষিতের শেকলটা ভেঙ্গে দেয়। ভারতবর্ষ থেকে আসা মানুষের প্রায় শতভাগই দেশান্তরী হয়ে এখানে এসেছে কায়িক শ্রম বিক্রি করার জন্য, এই শ্রম বিক্রিটাই আসল। বিলেতের ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে আমাকেও বিক্রি করতে হবে শ্রম। হাত দুটোর মতো মস্তিষ্কটাও দেহের অংশ, তুলনামূলক ভালো অংশ। ইংরেজরা এটার ব্যবহার শিখেছে অনেক আগে, ঠেকে ও ঠকে। ভারতবর্ষে ওরা গিয়েছিল শ্রম বিক্রি করতে। উপনিবেশ, রাজ্য জয়, দেশ শাসন এসব কেতাবী কথা। যে-সকল অংশ থেকে ওদের করে খাওয়ার রসদ পেয়েছে, তা গায়ের জোরে হলেও দখল করেছে, যেখানে ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই সেখানে যায় নি। আফগান, নেপাল, এসব জায়গা থেকে পাওয়ার আশা কিছু ছিল না, নেয় নি। শাসনদণ্ড হাতে থাকলে করে খাওয়ার সুবিধে, তাই ওটা নিয়েছে।
অক্সফোর্ডে যাওয়ার আগে একটা হপ্তা কাটাতে হয় লন্ডনে, বিদেশী ছাত্রদের জন্য বিলেতি কেতা শেখার একটা কৌর্স করতে হয় ব্রিটিশ কাউন্সিলে। শব্দের অশেষ শক্তি বুঝতে পারি আরো ভালোভাবে, খুব বড় একটা অন্যায়ের পর ‘দুঃখিত’ বলে এটাকে হালকা করে ফেলা যায়, এমনকি ক্ষমাও পেয়ে যাওয়া যায় কখনো কখনো। মনে পড়ে না, দেশে কোনো ভুল করার পর বলেছি দুঃখিত, অথচ এরা একটা মানুষ মেরে ফেলার সময়ও বলে দুঃখিত, আমি কেবল কর্তব্য পালন করছি!
এক বিকেলে ঐ ফলিং ডাউন লন্ডন ব্রিজটা দেখে আসি। ঘোলাজলের নদী টেমস দেখে আমাদের কাকচক্ষুজল নদীগুলোর কথা মনে পড়ে, তখনো রঙিন পালের নৌকো ভাসতো অসংখ্য নদীতে। গুনটানা মাঝিদের তির্যক হাঁটার ভঙ্গি বিবর্ণ হতে হতে এখনো বেঁচে আছে জয়নুলের ক্যানভাসে, ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে অবহেলার ধূসর গ্যালারিতে! কালো, বাষ্পীয় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, নোংরা, দুর্গন্ধ, এ রকম অনেক বদ-বিশেষণের কালি লেগে আছে টেমসের ইতিহাসে। এমনকি রোমানদের সময়েও বিভিন্ন ভবনের বর্জ্য ভূমিতলের কাঠের পাইপ গড়িয়ে টেমসের জলে এসে মিশেছে। লন্ডন ব্রিজের একটা পয়ঃনিষ্কাশন পাইপ সরাসরি নেমে এসেছে টেমসে। শত শত বছর ধরে টেমস বর্জ্যবাহী নদী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, এবং এখনও! অবিশ্বাস্য যে বিষাক্ত জলের ছোট্ট, মাত্র পনেরো মাইল দীর্ঘ এই নদীটা বিশ্বের ইতিহাসে বিখ্যাত সব নদী, আমাদের গঙ্গা যমুনা, মিশরের নীল নদ, মধ্যপ্রাচ্যের টাইগ্রীস ইউফ্রেটিস, আমেরিকার আমাজন মিসিসিপি প্রভৃতির মতোই অতিবিখ্যাত!
টেমস নদীর নিচ দিয়ে বানানো সুরঙ্গে ঢোকার জন্য পাতালরেলে চড়ে মনে হয় না নদীর তলা অথবা সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা! গ্রামের কুপি-জ্বালা মানুষের চোখে দেখা ছোট্ট রেল-জংশন লাকসামকেই মনে হয়, ওরে বাবা, কত লাকসাম কত বাত্তি! বড় একটা গ্রামের মতো শহর ঢাকার পর রাতের লন্ডনকেও আমার মনে হয় আলোয় সাজানো মহানগর। লন্ডনের সাতটা দিন খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়, অনেক সাত শ দিনের স্মৃতির ভেতরও থাকে না অনেক কিছু, অথচ ঐ সাত দিনের স্মৃতিতে গেঁথে আছে কত শত কিছু!
বিলেতবাসের তৃতীয় দিন, নয় জুন, রাতের খাবার খেতে বসি আটটায়, সূর্য ডোবে সে-সময় দশটার পর, জেটল্যাগ তখনো কাটে নি পুরোপুরি। বাংলাদেশে এখন গভীর রাত। এতো ঝকঝকে প্রকৃতি বাইরে, ঘরে ফিরতে চায় না মানুষ। বিশেষ করে শনিবার আজ, এদের স্যাটারডে নাইটস ফিভারটা দেখার ইচ্ছেয় আমার হাউসমেট কেনিয়ার টাঙ্গাকে নিয়ে বেরোই, দু পাইন্ট বিয়ার টেনেছে সে, হালকা আমেজে আছে, প্রকৃতিগতভাবে মনে হয় কালোরা বেশ ফুর্তিবাজ! এলকোহোলে অভ্যস্ত হই নি তখনো, পানি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। যাবার সময় টাঙ্গা যখন বলে গুডনাইট, একটু অবাক হই, প্রত্যুত্তরে যদিও বলি ‘গুডনাইট, বাই’, দিনের আলোয় সংশয়ে পড়ি খানিকটে। কিছুদিন পরে বুঝি, রাত বারোটার পরই এদের সকাল, আলো ফুটুক বা না ফুটুক। আর বিকেল ছ’টার পর রাত, আলো ও অন্ধকারের সঙ্গে এদের দিন ও রাতের সম্পর্ক নেই। সংস্কৃতির পার্থক্যটা বুঝতে শুরু করি এখান থেকেই।
বিলেতের প্রথম দিনগুলো, মাত্রই তো ক’টা দিন, জীবনের এক দীর্ঘ অধ্যায়, প্রতিটা মুহূর্ত হৃদয়ে গেঁথে আছে, শেকড় ওপড়ানো একটা গাছ, যা জন্মেছে পাললিক নরম শীলায়, বেড়ে ওঠেছে আর্দ্র মৌসুমি জলহাওয়ায়, কঠিন পাথুরে মাটিতে তার শেকড় জল খুঁজে পায় না, শীতল বাতাসে পাতা পায় না আলো হাওয়া! বর্ণনা-অযোগ্য এক অবস্থার ভেতর কাটতে থাকে সন্ধিকালের ঐ তরল সময়, ওগুলোকে দুঃখের দিন বলবো না কখনো, ভালো লাগতো, যদি বলা যেতো কিছুটা আনন্দের, অথচ অনেক বেশি মনে হয় একটা বড় রকম পরিবর্তনের, জীবনের সঙ্গে একটা খণ্ডযুদ্ধের, অথবা সংগ্রামের!
ঘরে ফেরার পথে আমার হাউসমেট তিনজনের কথা ভাবি, চমৎকার মানবমিশ্রণ! বাঙালি, পাকি, ভারতীয় ও আফ্রিকান! দু দিনে অনেক বেশি কাছাকাছি এসেছে আফ্রিকার টাঙ্গা, ভারতীয় অভিন্দা যেন জানেই না যে পড়াশোনা ছাড়াও জীবনে আরো অনেক কিছু করার আছে। দেশ থেকে ইংরেজি শেখার দু একটা বই এনেছে, আরো কি কি! সব সময় দেখি ওগুলোর ভেতরই ডুবে আছে। পাকিটাকে মনে হয় না পড়াশোনা করতে এসেছে, প্রথমদিনেই অনেক পাকি ইয়ার জুটিয়েছে, ওদের সঙ্গে নিয়ে সাদা চামড়া মেয়েমানুষের উপর হামলে পড়েছে কুকুরের মতো। আসছে বুধবার লন্ডন ছেড়ে যেতে হবে, অক্সফোর্ডে হয় তো আর দেখাও হবে না এভাবে, আমি এসেছি বিজ্ঞান পড়তে, পাকি ও টাঙ্গা এসেছে আইন পড়তে, আর অভিন্দা সাহিত্য!
বিকেলের ঐ চমৎকার আবেশ জড়ানো পরিবেশ পাল্টে যায় হঠাৎ, ঘরে ফেরার পর মেজাজ বিগড়ে যায়। গভীর রাত পর্যন্ত পাবে কাটাবে টাঙ্গা। আমার পাশের রুমে থাকে বাইরে ধোপদুরস্ত অন্তরে সেফটিট্যাঙ্ক এক পাঞ্জাবি কুকুরের ছাও, তখনো ডাইনিং টেবিলে বসে কদুর তেলে ভেরেণ্ডা ভাজছে। চোখ মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে –
কিঁউ ভাই, ইতনি রাত? শব্দ ক’টা মাথার ভেতর পেরেক ঠোকে। জুতো পিটিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়েছি এই নোংরা ভাষাটা, আর বিলেতে এসে আবার এটা শুনতে হবে! জবাবে বলি –
বাংলা ক হউরের পুত, জানোস যদি।
ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে, ও ভেবেছে আমার অন্য বাঙালি ভাইদের মতো গদগদ হয়ে ওর সঙ্গে উর্দুতে কথা বলবো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও মনোযোগ আকর্ষণ করে সে, ওর ভেতরটাও দেখতে পাই কিছুটা পরিষ্কারভাবে। মানুষের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকা সৌজন্য নয়, অথচ ডুবে রয়েছি এক ধরনের বিস্মৃতির ভেতর। ও হয়তো ভাবছে, বন্ধুতা চাইছি ওর। বিষয়টা যে মোটেও তা না, কোনোদিনও বুঝবে না সে। পৃথিবীর সেরা একটা বিদ্যাপীঠে পড়াশোনার জন্য পাঠিয়েছে ওর পরিবার, অথচ সে ধারণ করে আছে ঐ কৃষ্টি, যা মানুষকে মর্যাদা দেয়া শেখায় না। ওর আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থান ভাবতে শেখায় যে মানুষের মধ্যে সব চেয়ে সেরা ওরা, এই অহংবোধ কাজ করে অন্যদের ছোট করে দেখতে। ওর সম্প্রদায়টিকে সামগ্রিকভাবে দোষ দেয়া যায় না, কারণ ওদেরকে বিশ্ব-দেখা শেখানো হয় একটা চোঙের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সে তো নিশ্চয় কিছুটা মেধা নিয়ে জন্মেছে, অক্সফোর্ডে যে পড়াশোনা করতে এসেছে, ওর ভিতটাকে এতো হালকা ভাবতে ইচ্ছে হয় না। ওর সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে ক্ষুব্ধ করে, পাকি হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে দেখতে ইচ্ছে করেছি ওকে, কিন্তু নিজেই পাকি করে তুলেছে নিজেকে। অনেক কিছুই লোক দেখানো ওদের, অন্তরের ব্যবহার কম জানে ওরা। এমন কি, যে ধর্মীয় সংস্কৃতি ওদের, তাও কত বেশি লোক দেখানো! মহানবীর দৌহিত্রের মৃত্যুদিনে ওদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে যেয়ে রাস্তায় মিছিল করে, ছুরি দিয়ে বুক পিঠে আঘাত করে নিজেদের রক্তাক্ত করে। প্রভুকে স্মরণ করতে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে এক সময় অজ্ঞান হয়ে যায়, জিকির করতে করতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে অচেতন হয়ে পড়ে। চোখ মুদে প্রভুকে স্মরণ করতে পারে না ওরা, অন্তর নেই ওদের। ইচ্ছে হয় ওকে একটা শিক্ষা দেই, সিদ্ধান্ত নেই, এমন একটা আচরণ করি ওর সঙ্গে, যা আমার স্বভাবের বাইরে, ওটাই হয়তো পছন্দ করবে সে!
সকালে নাস্তা খাওয়ার জন্য সাবওয়ে থেকে এক প্যাকেট চিপস ও ফ্রায়েড চিকেন এনেছি। জিজ্ঞেস করে ওগুলো কি, বলি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানেরা কি হারাম খায়? সঙ্গে সঙ্গে মাথায় রক্ত চড়ে যায় আমার, চাঁদির চুল ব্রহ্মতালুর উপর দাঁড়িয়ে যায় হেজার কাঁটার মতো। ওর সঙ্গে ঝগড়ায় নামার কোনো ইচ্ছে নেই, নাক ঝাড়ার মতো ঝেড়ে ফেলি ওর কথাগুলো। টেবিলের এক কোনায় প্যাকেটটা রেখে উপরে ওঠার জন্য পা বাড়াই, পেছন থেকে যখন আবার বলে, ইয়ে তো হালাল নেহি, আর থাকতে পারি না। বলি, মি. চুতমারানি, ডু ইউ নো ইংলিশ? এবার বোধ হয় টনক নড়ে। ছ ফুটের উপর আরো আধা ইঞ্চি লম্বা শরীর আমার, গয়ালের মতো কাঁধ নিয়ে যখন ঘুরে দাঁড়াই, বোধ হয় ভয় পায় মনে মনে, গলার স্বর নামিয়ে বলেÑ
আই সেইড, ইট ইজ নট হালাল, আফটার অল উই অল আর মুসলিম। এনি ওয়ে, মাই নেইম ইজ জিন্না, নট হোয়াট ইউ সেইড।
এবার পথে এসেছো হালার পো! আমিও আসল রূপে ফিরে যাই।
সরি, মি. জাউরা, টু মি হিউমিনিটি ইজ এবাভ এভরি থিং!
মাই নেইম ইজ জিন্না, জীন্না।
সরি ফর মাই এক্সেন্ট, টু মি ইটস সেইম, মি. জ্বেনা।
ইফ ইউ ওয়ান্ট আই মে গিভ ইউ সাম হালাল ফুড।
আবার ঐ হালাল! তুমি কি আমার শালার পুত, না শ্বশুরের পুত, বুঝতে পারছি না। ব্যক্তিগত বিষয়গুলো এড়িয়ে চলি সব সময়, তবু ওকে না বলে পারি নাÑ
লাস্ট নাইট ইউ স্লেপ্ট উইথ এ ব্লন্ড হেয়ার গার্ল, হোয়াট কাইন্ডা হালাল দ্যাট ওয়াজ, মি. জ্বেনা?
কাঁচা আনারসের রস মেশানো এক বালতি চুনের পানি যেনো ওর মুখে ছুঁড়ে দিল কেউ। মনে আছে, ছোটো থাকতে আমার মা গুঁড়ো ক্রিমির প্রতিষেধক হিসেবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিস্বাদ, সর্বপ্রকারে অসহ্য ঐ পানীয়টা নাক টিপে আমার গলায় ঢেলে দিতো। আমার চেহারার অবস্থা যা হতো তার প্রতিক্রিয়ায় মায়ের অসাধারণ সুন্দর মুখটাও ঠোঁট উল্টে কেমন বিকৃত হয়ে উঠতো! ঐ হারামজাদার চেহারাটা তার থেকেও ভয়ানক করুণ হয়ে ওঠে। আর কিছু না বলে দোতলায় উঠে যাই। যাওয়ার সময় বলি, মনে হয় স্বপ্নেও সে আশা করতে পারে নি, এক বাঙালি, যাদেরকে সব সময় কাঁচুমাচু হয়ে কথা বলতে দেখেছে ওদের সামনে, সে এমন প্রতাপের সঙ্গে কথা বলতে পারে –
আই এম সরি টু সে মি. জ্বেনা, ইফ ইউ ইন্টারফেয়ার এনি মোর টু মাই পার্সোনাল ম্যাটার্স, দ্যান আই স্যাল কিক অন ইয়োর আস নেক্সট টাইম, এন্ড থ্রো ইউ আউট ফ্রম দ্য হাউস।
বীরত্ব দেখানোর জন্য কথা ক’টা বলি নি, বলেছি ঘৃণায়, দু বছর আগে করাচি যেয়ে বাঙালিদের প্রতি ওদের যে তাচ্ছিল্যের প্রকাশ দেখে এসেছি, তা ভুলতে পারবো না আজীবন। জানি না বাংলাদেশী কুলাঙ্গারগুলো এখনো পাকি বলতে কীভাবে পোঁদের কাপড় তুলে দেয়! এমন কি আমার ছোট কাকাও খুব প্রভাবিত করেছে আমাকে ওদের প্রতি বিতৃষ্ণ হতে। পয়ষট্টির যুদ্ধে কাকার বাঙালি ব্যাটেলিয়ান জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করে ওদের দেশটাকে রক্ষা করেছে, অথচ যে-সব পাঞ্জাবি শেয়ালেরা দু পায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল ভারতীয়দের প্যাঁদানী খেয়ে, যুদ্ধ শেষে ওরা সব তকমাইপাকি, সিতারাইহেলাল, বালস্ববাল প্রভৃতি খেতাবগুলো পেয়ে যায়, অথচ বাঙালিরা সামান্য একটা প্রমোশনও পায় নি। চাকরির মেয়াদ আঠারো বছর হওয়ায় ক্যাপ্টেন হিসাবে অবসর গ্রহণ করে পরের বছর দেশে ফিরে আসে কাকা। অনেক সময় দুঃখ করে বলতো, জানিস দাউদ, পাকিদের ঐ বদখত কুর্তাজামা, যা এখন অনেক পাকিবাঙ্গিরাও পরে বেড়ায়, পৃথিবীর সব চেয়ে নোংরা ও বিচ্ছিরি ঐ পোশাকটা পরে সেনাবাহিনীর অফিসার্স মেসে যাওয়া যেতো, অথচ এত সুন্দর পাজামাপাঞ্জাবী এলাউড ছিল না, মাংস দেয়া হতো প্রতিবেলা, কিন্তু মাছ কখনোই না, এসব অনাচারের আরো কত গল্প! বয়সের খুব পার্থক্য না থাকায় খুব মেশামেশি ছিল কাকার সাথে, জীবনের কত অম্লমধুর গল্প কাকার কণ্ঠে শোনা! পরে, উনিশ শ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে পঙ্গু হয়ে যায় কাকা, এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে দুঃসহ ঐ জীবনের বোঝা!
কাপড় না পাল্টেই কিছুক্ষণের জন্য বিছানায় ছুঁড়ে দেই ক্লান্ত, অবসন্ন ও বিধ্বস্ত শরীরটা। বিলেতে আসার পর এই প্রথম মেজাজ খারাপ হল। একটা কুইক শাওয়ার নিয়ে ঘুমোতে যাই ফ্রেস হয়ে, ঘুম আসে না, মাথা থেকে রাগের চাপটা নামাতে পারিনে কোনোভাবে! শালা আমাকে হালাল চেনায়! ঝট করে উঠে পোশাক পরে বেরিয়ে যাই। সময়টা যদি আজকালের হতো তাহলে মোবাইলে ধরে ফেলতাম টাঙ্গাকে, অগত্যা অফ-লাইসেন্স সপ থেকে একটা কার্লসবার্গ নিয়ে ঘরে ফিরি। ঐ শালা তখনো টেবিলে বসে, ইচ্ছে করেই লিভিং রুমের সেটিতে বসি, বীয়ারের ক্যান খুলি ফস করে, গলায় ঢালি এক ঢোক, বিস্বাদ তেতো ঐ পানীয়ের স্বাদ আগে কখনো নেই নি, এটা যে এত পঁচা-স্বাদের, জানা ছিল না, চেহারায় কিছুই প্রকাশ করি না, যেন দীর্ঘদিন থেকে এটায় অভ্যস্ত আমি। সেটিতে শরীর কিছুটা এলিয়ে দেই, ক্লান্তির ভাব দেখাই। ভেজা বেড়ালের মতো চুপচাপ উঠে যায় ধাড়ি কুকুরছানা, একটু পরে আমিও উঠে পড়ি, বাকি বিয়ারটুকু বেসিনে ঢেলে দেই, মনের খেদ অনেকটা কমেছে, ঘুমোতে যাই, ঘুমিয়ে পড়ি।
রোববারে সবাই দেরিতে ওঠে ঘুম থেকে, আমার হয় না কোনোদিনই। দুলে দুলে নিচে নামে টাঙ্গা, ব্রেকফাস্ট শেষ করে তখনো বসে আছি টেবিলে, কফি শেষ হওয়ার আগেই বিলেতের প্রভাতপত্রিকা পড়া শেষ হয়ে যায়, হয়তো এসব কোনো খবরই আকর্ষণীয় নয় আমার কাছে। ইংরেজদের পত্রিকা পড়া দেখে প্রথমে খুব অবাক হয়েছি, সকালটা সবাই পত্রিকার ভাঁজে নাক ডুবিয়ে কাটায়। অবাক হয়ে ভেবেছি, ভীষণ কিছু ঘটে গেছে নাকি কোথাও, এতো মন দিয়ে পড়ছে সবাই! পরে বুঝেছি, নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার ইংরেজি কায়দা একটা, এতো বেশি আড়ালে রাখে নিজেদের, কোনো কিছুই শেয়ার করতে চায় না ওরা। বিপরীতে, বাঙালির আড্ডা-দেয়া স্বভাব আমার, কয়লার ময়লার মতো লেগে আছে সবখানে। কালোদেরকে ফুর্তিবাজ মনে হলেও আড্ডাবাজ মনে হয় নি। আসলে পুকুরঘাট, নুনদেয়া চিনেবাদাম, আর শহর আধা-শহরের রক তো বাংলার বাইরে অন্য কোথাও নেই, নেই শ্রাবণ আষাঢ় মাস দুটোও, বেচারারা!
কালোদের মধ্যে যেমন বদকালো আছে, তেমনি আছে ওন্নেকভালোকালো, টাঙ্গা দ্বিতীয় গোত্রের। দাঁতগুলো কুন্টাকিন্তির দাঁতের মতো ঝকঝকে সাদা, হাসিও সাদা অন্তরের, কোনো কথা গোপন রাখতে পারে না, নাইরোবিতে অনেক পুরোনো বনেদী পরিবার ওদের, বিত্তবান। পরিবারের ইচ্ছে, ছেলে অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে রাজনীতি করবে, কিন্তু ওর দেখি রাজনীতি থেকে নারীদেহনীতিতে অনেক বেশি আগ্রহ। কালোরা দুটো জিনিস দিয়ে ইউরোপীয়দের মুগ্ধ করে রেখেছে, প্রথমটা হচ্ছে সংগীত, যতটা না গলার, তার চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রের ও শরীরের। দ্বিতীয়টা পুরোপুরি শরীরের সংগীত, সাদা মেয়েরা কালোদের বেতের মতো শরীরের পেশল পেষণ যে দারুণ উপভোগ করে, মেয়ে না হয়েও তা বুঝতে পারি। টাঙ্গা যে একটা অসাধারণ কৃষ্ণ-জীবন যাপন করবে, শুরুতেই বোঝা যায়। এদিক দিয়ে বিধাতা কেন যে বামাস্বভাব দিয়ে বাজারে ছেড়েছে আমাকে, বুঝি না। ভালোভাবে এপ্রোচটাই করতে পারি না, মাঝে মাঝে বরং মনে হয়, কোন কুলের আমি!
লন্ডনে থাকার জায়গা পেয়েছি টেমস নদীর ওপারে, কুখ্যাত লন্ডন হোয়ার্ফ এর কয়েক ব্লক পেছনে, দ্বিতল এক টেরাসের পুব দিকের অংশে। লন্ডন হোয়ার্ফে রাখা হতো আফ্রিকা থেকে আনা ক্রীতদাসদের, এখনো এখানের বাতাসে কান পেতে শোনা যায় মানুষের নির্মমতার ইতিহাস। লন্ডন আই তখনো লন্ডনের আকাশরেখায় চোখ মেলে নি, লন্ডনের বিশেষ আইকন বোমা বিল্ডিং, আদর করে ওরা বলে ‘দ্য ঘেরকিন’ আকাশে মাথা উঁচু করে নি, ক্যানারি হোয়ার্ফের ওয়ান কানাডা স্কোয়ার নেই। বাইশ বছর কেটেছে দ্বিতীয় যুদ্ধের পর, লন্ডনের ক্ষত শুকোয় নি, পুনর্নির্মাণের যজ্ঞ শেষ হয় নি তখনো। একটু বয়স্কদের স্মৃতিতে সবকিছু দগদগে, আমাদের টেরাসেরই একটা অংশে থাকে বাড়িওয়ালি, ক্লেয়ার সিম্পসন। বিল্ডিংএর অর্ধেকটাই নাকি বোমার আঘাতে ভেঙ্গে পড়েছিল, পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে আবার, দেয়ালের পাথর থেকে বোঝা যায় না কোন অংশটা নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে। নতুন ঘরবাড়ি এখন আর কাঠ পাথরে বানানো হয় না, কঙ্ক্রিট ব্লক ও মেটাল ফ্রেমে বিশাল এক বিল্ডিং বানিয়ে ফেলে তিন মাসে, আমাদের দেশে ওরকম একটা বিল্ডিং বানাতে লাগে তিন বছর। যুদ্ধের কথা বলতে পুরোনো ব্রিটিশদের খুব ভালো লাগে, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধটা জিতেছিল কিনা! জার্মানদের মার খাওয়া থেকে কালোরা, রাশানরা যে কীভাবে শেষ রক্ষা করেছিল, তা কখনো বলে না। সুযোগ পেলেই যুদ্ধের আলাপ জুড়ে দেয় ক্লেয়ার। ইংরেজদের বীরত্বের অসাধারণ কাহিনীটা মিথ্যে নয়, মেনে নিতে অসুবিধে নেই ইংরেজদের বাহাদুরী। অনেকাংশে সত্যিও ওটা, কিন্তু সঙ্গে তো আরো কিছু আছে, ওগুলোকে সামনে আনে না, এ জন্য বিশ্বের সেরা অকৃতজ্ঞ জাতি মনে হয় ওদের। অবশ্য, আমরাও বা কি! স্বাধীনতাযুদ্ধে রাশানদের অবদানের কথাটা কেউ কি বলি! ভারত যা করেছে, ভারতের স্বার্থে, ওটা অন্য হিসাব। কিন্তু ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা যা করেছে, অন্তরের টানে, জাতভাই হিসেবে, ওটাই কি স্বীকার করি!
সদা ব্যস্ত শহর লন্ডনও রোববারে অলস হয়ে যায়, কালো ট্যাক্সিক্যাবগুলো বেড়ালের মতো ছোটাছুটি করে না যখন তখন, দু একটা হুসহাস দৌড়ে যায় এদিক সেদিক, জাপানি ট্যাক্সি ইংল্যান্ডের বাজার দখল করতে পারে নি তখনো, কালো লেইল্যান্ড ও মরিস মাইনরের রাজত্ব রাস্তা জুড়ে। ঝকঝকে রোদের দিনে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি কোথা থেকে আসে বোঝা যায় না, রাস্তাঘাট ও গাছপালা আরো চকচকে দেখায়। দীর্ঘ পথ হেঁটে, লন্ডন ব্রিজ পেরিয়ে, টাওয়ার হিলের পাশ দিয়ে বাকিংহ্যাম প্যালেসে রানিমাকে নমস্কার জানিয়ে এসে বসি হাইড পার্কে। তখন ঘাস ও গাছ, সবই শুকিয়ে ঝরঝরে আবার। কারুকাজ করা লোহার কালো রঙের চকচকে বেঞ্চগুলো বৃটিশ ঐতিহ্য, সবখানেই এদের দেখা মেলে, এমন কি রাস্তার ধারেও। সবুজ রঙেরও কিছু রয়েছে কোথাও কোথাও, খুব কম এদের সংখ্যা, মনে হয় ভিনদেশী। একটা বেঞ্চে শুয়ে মেঘমুক্ত খোলা আকাশ দেখি, কোনো পার্থক্য নেই পাংশার তীব্র নীল উজ্জ্বল আকাশের সঙ্গে, যা কিছু পার্থক্য সব, আমাদের এই ধরাতলে!
লন্ডন শহরের যে ছবি মনের মধ্যে আঁকা ছিল, এখন ওটার বাস্তবতার ভেতর ঢুকে তা ধূসর হয়ে যেতে থাকে। এতো স্বপ্নীল মনে হয় না সব কিছু। অনেক কিছুই অবাক হওয়ার মতো, কিন্তু কোনো অসাধ্য সাধন করে এসব করা হয়েছে মনে হয় না। কোনো কোনো ভবন যদিও পর্বতের মতো গম্ভীর, ওগুলোর বিশাল চওড়া দেয়ালে গাঁথা পাথরের অসাধারণ সব মর্মরমূর্তি দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করে অনেক সময় নিয়ে। কিছুটা আক্ষেপ হয় নিজেদেরই প্রতি, বাইরের বিশ্ব থেকে নেয়া অর্থে এসব গড়েছে এরা, যার কিছুটা আমাদের ওখান থেকেও এসেছে। অথচ আমাদের অর্থ, সম্পদ আমরা ব্যবহার করতে পারি না, জাতি হিসেবে এটা আমাদের ব্যর্থতা। এখন পাকিরা লুটে নিচ্ছে আমাদের সম্পদ, যতটা না ওদের দোষ, তার চেয়ে অনেক বেশি সহায়তা দিচ্ছে আমাদের পোষা জানোয়ারেরা। অবশ্য মহামানবদেরই যেখানে লুটতরাজে আপত্তি নেই, সেখানে সাধারণ মানুষ পিছিয়ে থাকবে কেন? অন্য সম্প্রদায়ের সম্পদ ও নারী লুট করায় কোনো সমস্যা নেই সধর্মীদের!
নামের সামনে আমার কোচোয়ানের মতো বসে আছে শেখ, তখনো আরবের সব শেখ মহান শেখ হয়ে ওঠে নি, কিন্তু কিছু শেখ তো অবশ্যই ছিল, যারা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে, ধর্মের বাণিজ্য করে, আরব সাগরের তুঁতনীল জলে ভাসমান বজরায় পাল তুলে হারেমের বিলাসিতা করতে পারতো পুরোদস্তুর! নামের এই কোচোয়ান অংশটাই অনেক সময় তির্যকভাবে বেশ সমীহ আদায় করে দিতো আমাকে। মিথ্যাও মিথ্যার মতো লাগতো না বলতে যে দেশের অনেক বড় ধনী আমার পরিবার, যদিও বিলেতে এসেছি দাঁত-উঁচু, কালো, ছোট্ট, এক রত্তি এক চাচাতো বোনের কাছে ভবিষ্যৎ দাম্পত্য বন্ধক রেখে। বাবা আমার নিতান্তই গরীব মানুষ। এমনকি, ময়মনসিং জেলা স্কুলের হোস্টেলে রেখে পড়াশোনা করানোর খরচ চালানোর ক্ষমতাও তাঁর ছিল না। ব্রহ্মপুত্রে তখন ব্রিজ ছিল না, খেয়া পার হয়ে ওপারের স্কুলে যাওয়ার ঝক্কি থেকে বাঁচাতে চেয়ে লজিং মাস্টার হিসেবে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের আশ্রয়ে উঠিয়ে দেয় আমাকে। সেখানেও তখন ল্যাঠা, ভবিষ্যতে বিয়ে দেয়া যেতে পারে এমন লজিং মাস্টারদেরই ছিল প্রথম চাহিদা। লজিং-দেয়া ঐ পরিবারের কন্যাটির হাত থেকে উদ্ধার করে চাচা আমার, নিজ কন্যার সঙ্গে সম্পর্কটা পাকাপাকি করার ব্যবস্থা করে ফেলে বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে, কড়াই থেকে সরাসরি উনুন! ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমাকে বিকিয়ে দেয়া ছাড়া বাবার কিই বা করার ছিল আর, এ জন্য মনে কোনো খেদ ছিল না তাঁর। আমার দিক থেকে যদি বলি, আগের কন্যাটি এখনো মনে ধরে আছে, ও ছিল সত্যিই সুন্দরী, অসাধারণ মেধাবী, কোনো অংক দু বার বুঝিয়ে দিতে হয় নি আমাকে, এবং মনে হয় না আমার প্রতি কোনো আসক্তি ছিল ওর। আর কিছু দিন ওখানে থাকলে ওর প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা ছিল খুব জোরালো। এখনো বুঝতে পারি না, হয়তো প্রেমেই পড়েছিলাম ওর, কিন্তু বিষয়টা পরিকল্পিত হওয়ায় তীব্র আকর্ষণ জাগে নি হয়তো!
ভবিষ্যৎ আমার কতোটা উজ্জ্বল হবে জানি না, তবে পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে বিলেতে অন্তত পৌঁছাতে পেরেছি, ধারণা করি, এতেই বাবার হাতে চাঁদ এসেছে!
নামের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশ, দুটোই দু হাজার বছর আগে স্বর্গের মসৃণ পথে হাঁটা দু জন নবীর! ভাবতে অবাক লাগে, বাবাকে এ নামটা জুগিয়েছিলেন যিনি, কী আশা করেছিলেন আমার জীবনে! মাঝখানের নামটাই চালু ছিল দেশে, এখানে এসে ঐ দাউদ এখন হয়ে গেছে ডেয়ুড, কোথাও লিখতে বলার সময় ওটা দরকার পড়ে, মিডল নেইম কেউ ব্যবহার করে না এ দেশে। দাউদকে ওরা বলে ডেভিড, ডাকে ডেইভ বলে! কেন যে নবীদের যুগ শেষ হয়ে গেল, মানুষকে ভালো পথে চলার উপদেশ দেয়ার জন্য এখনই তাঁদের প্রয়োজন আরো বেশি। যত সব ঝামেলা গ্যালিলিও, আইনস্টাইনরা বাঁধিয়ে রেখে গেছে, ওদের ছাইপাঁশ পড়াশোনার জন্য এত কষ্ট করতে হয়! অযথা সব লেখালেখি লাইব্রেরিতে ডাঁই করে রেখেছে! ওগুলো জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য মহাত্মাদের আগমন আর ঘটছে না কেন! সত্যি বলছি, পড়াশোনা করতে আমারও ভালো লাগে না, অন্তত যেগুলো পড়ে পাশ-টাশ করে ডিগ্রি পেতে হয়, সেগুলো তো অবশ্যই না, অথচ যেতে হবে অক্সফোর্ডে!
পাণ্ডববর্জিত হবে ঐ জায়গাটা, ধারণা করি। ওখানে যাওয়ার আগে লন্ডনের দিন ক’টা উপভোগ করে নেই। হাঁটতে হাঁটতে এক দিন গৌল্ডার্স গ্রীনে পৌঁছে যাই, ওখানের বেশির ভাগ মানুষজন দেখে কিছুটা অবাক হই। বাংলাদেশে তখনো গেরুয়া বসন একতারা বাজানো প্রকৃত বাউল ছিল। ইয়া লম্বা দাড়ি এক বাউলের জন্য এতো কাল পরেও মন অস্থির হয়, ওর গাওয়া নাক ডেঙা ডেং নাক ডেঙা ডেং গানটা এখনো স্মৃতিকাতর করে। এ ছাড়া ছিল লম্বা দাড়ি তাবলিগের দল। প্রথমে মনে হয়েছে এটা বোধ হয় বিলেতের কোনো মুসলমান প্রধান এলাকা, আকর্ষণ বোধ করি। হাঁটু পর্যন্ত ঝোলানো জোব্বা পড়া পুরুষদের অনেকেরই লম্বা দাড়ির সঙ্গে কানের দু পাশে ঝুলে থাকা লম্বা দু গাছি চুল, মাথার বাকি চুল ছোট করে ছাঁটা, চাঁদির উপরে ছোট্ট একটা টুপি, পড়ে জেনেছি ওটা স্কালক্যাপ আর ওরা ইহুদি! ওদের তো বেঁচে থাকার কথা না, অথবা অন্যদের! ওদের ধর্মগ্রন্থে আদেশ দেয়া হয়েছে অন্যদের ধ্বংস করে ফেলার জন্য। পরবর্তী গ্রন্থগুলোও তাই করেছে। অসহনশীলতার সূত্রপাত এখান থেকেই, যদিও এখন অনেকে বাহ্যিকভাবে হলেও কিছুটা সহনশীলতার চর্চা করে।
লন্ডন শহরের প্রায় সব জায়গায় ইহুদিদের জুয়েলারির দোকান আছে। তৈরি পোশাক শিল্প বিস্তার লাভ করে নি তখনো, অসংখ্য টেইলরিং সপ রয়েছে ওদের। আমেরিকা পাড়ি দিচ্ছে তখন ওসবের মালিকেরা, সিলেটিরা সেসব দোকান কিনে রাখে ভালো দামে।
ক্লান্ত পায়ে হাঁটার সময় একটা খাবারের দোকানের কাচে ø্যাক্স লেখা দেখে অবাক হই, ইংরেজরা অথবা ইহুদিরা সাপও খায় নাকি! বানানটা তখনো মাথায় কাজ করে নি, কিছুক্ষণ পর আরেকটা দোকানেও একই লেখা দেখে ভুলটা নিজেই ধরতে পারি, ওটা ø্যাইক্স না। কিছু একটা খাওয়ার জন্য ঢুকে পড়ি, ভাজা মাংসের মজার গন্ধে রসনা জাগিয়ে দেয়। ভাগ্য ভালো তখন বেশি কাস্টমার ছিল না। খাবারগুলো সম্পর্কে টুকটাক জিজ্ঞেস করি কাউন্টারে দাঁড়িয়ে, সরলভাবে বলে ফেলি, আমি নতুন এসেছি, এসব খাবার-দাবার সম্পর্কে ধারণা নেই। কানের পাশের লম্বা চুল দুলিয়ে বলে তা আর বলতে হবে না, বুঝেছি, কিন্তু তুমি কি মুসলমান? হ্যাঁ বলাতে একটু পরিবর্তন লক্ষ্য করি, আমাদের মাংস তো তুমি খেতে পারবে না, কেইক বা অন্য কিছু খাও, কফি খাও। বিষয়টা বুঝতে পারি, বলি, না গরুর মাংস দিয়ে ঐ বার্গার একটা বানিয়ে দাও, আমার দায়িত্ব আমারই, তুমি কিছু ভেবো না। মুখ কিছুটা কালো করে বার্গারের মাংসটা বৈদ্যুতিক তাওয়ায় দেয়। ট্রে নিয়ে এক কোনায় যেয়ে খেতে বসি। কী দারুণ স্বাদ! এত মজার বার্গার এর পরেও আর খাই নি কখনো। ইহুদি একটা খাবার দোকান এখনো আছে মাদাম তুসোর পাশে, কাউকে মাদাম তুসো দেখাতে নিয়ে গেলে ওটার বার্গার খাইয়ে আনি, অবশ্যই। আর যে খেতে চায় না, ওর জন্য মাদাম তুসোর টিকিট আমি কাটি না কখনো!
তখনো, পৃথিবীর এক ব্যস্ততম শহর লন্ডন, দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা কাটায় নির্ঘুম। তবুও হেঁটে রাস্তা পেরোনো যেতো ক্রসিঙের সিগন্যাল পর্যন্ত না যেয়ে। টিউবরেইল ধরে একদিন চলে আসি দক্ষিণ লন্ডনে, বন্দরের কাছাকাছি, কিছুটা শহুরে গ্রামের ছবি, আস্তাবল আছে, ভেড়ার পাল চড়ে বেড়ানোর মতো ছোট্ট চারণভূমি আছে এমন একটা খামারের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় পুরোনো খড়ের গন্ধ মেশানো বাতাসে তীব্র আর একটা গন্ধ পাই, অনেকটা পঁচাইয়ের, কাছে যেয়ে বুঝি, একটা পারিবারিক ব্র“য়ারি। নিজেদের বিয়ার অনেক খামার মালিকই তৈরি করে নিতো তখন। খামারের এক কোনায় ছোট্ট একটা সেলিং কর্ণার আছে। সবজি, ডিম, পাউরুটি, এসব কেনার ফাঁকে বসে পান করা যায় দু এক পাইন্ট বিয়ার। সঙ্গ পাওয়া যায় খামার মালিকের খনখনে স্ত্রীর ও সোনালি চুলের দু-বেণী ঝোলানো এক কিশোরী বালিকার। ইচ্ছে হয় বসি একটু, যদিও কেনার কিছু নেই আমার। এক পাইন্ট বিয়ার চাইলে বলে উনিশ পেন্স, তার মানে আগে পয়সা, বাংলাদেশের মোড়ের চায়ের দোকানের মতো উঠে যাওয়ার সময় পয়সা দেয়া নয়। কুড়ি পেন্সের একটা মুদ্রা রাখি কাউন্টারে, কাঠের জালায় লাগানো ট্যাপকল ঘুরিয়ে ফেনায়িত একটা গ্লাস রাখে কাউন্টারের উপর, সঙ্গে এক পেনির চকচকে একটা মুদ্রা, ও সেলসগার্ল হাসি। ধন্যবাদ বলে বাইরের বেঞ্চে যেয়ে বসি আয়েস করে। এইলের রঙটা একটু গাঢ়, স্বাদ একটু বেশি তেতো, কিন্তু কয়েক ঢোক পানের পর একটা প্রশান্তি ভাব আসে, হাঁটার ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
এমন এক শহর লন্ডন, যা মানুষকে ক্লান্ত হতে দেয় না, স্যামুয়েল জনসন বলেছিলেন, কেউ যদি লন্ডনে ক্লান্ত হয়ে ওঠে, তাহলে বুঝতে হবে, সে জীবনের উপরই ক্লান্ত! পুরো একটা জীবন কাটানোর জন্য সব কিছুই রয়েছে লন্ডনে। পৃথিবীর সব সংস্কৃতির দেখা পাওয়া যায় লন্ডনের রাস্তা ঘাটে, কত বিচিত্র সেসব। কিন্তু খোদ ইংরেজরা মনে হয় অনেক বিষয়ে একই রকম, ছোট বাচ্চাদেরও দেখি খুব রিজার্ভ, কৌতূহল আছে, আড়চোখে তাকায়, কিন্তু কথা বলে না। বয়স্ক কেউ হয়তো আবহাওয়া নিয়ে স্বগতোক্তির মতো বলে, খুব গরম পড়েছে আজ, অপেক্ষা করে শ্রোতা কোনো প্রতিক্রিয়া জানায় কিনা। হ্যাঁ তাই, বললে হয়তো এক আধটা কথাও বলে। অনেকটা সময় ঘুরে বেড়ানোর পর বাসায় ফেরার পথে ক্লান্তি লাগায় সিটি-সার্ভিস বাসে উঠি, একেবারে ফাঁকা বাস। এক ইংরেজ ভদ্রলোকের পাশে বসি, আমার বাঙালি কৌতূহল, যেমনটা করেছি দেশে, জিজ্ঞেস করি, কি নাম ভাই আপনার? ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। বলি, আমার নাম দাউদ। ও ‘আচ্ছা’ জাতীয় একটা শব্দ বের করে মুখ থেকে, ভাঁজ করা পেপারটা খুলে ধরে চোখের সামনে। ভাবি, দেখি ব্যাটা কতক্ষণ কথা না বলে থাকে, আবার বলি, আমি যাচ্ছি ওয়াটারলু স্টেশনে, অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করতে এসেছি, বাংলাদেশ থেকে। আবার ও আচ্ছা বলে ওর নাম বলে এবার, কীথ। ভালোই হলো তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে, লন্ডনে কাউকে চিনি না, তোমার সঙ্গে প্রথম পরিচয়, নামটা লিখে রাখি। ভয় পেলো, না কি উৎপাত এড়াতে, সীট থেকে উঠে পড়ে। বলে, নেক্সট স্টপে নেমে যাবো আমি, বাই। মনে হয় পরের বাস ধরবে, বাস স্টপ ছেড়ে যেতে দেখি না ওকে। ঐ স্টপ থেকে কয়েকজন যাত্রী ওঠে, ইচ্ছে হয় না আর কারো সঙ্গে কথা বলি। ঠোঁট চুলকানো অভ্যেসটা ঝেড়ে ফেলতে আরো কয়েক মাস লাগে আমার!
কলেজ জীবন ঢাকার নটরডামে কাটানোয় কিছু কিছু বিলেতি কেতা সম্পর্কে ধারণা হয়েছিল। খাবার কখনো কাঁটাচামচে খেতে হয় নি বলে একটা ঝামেলা মনে হয় এখন, মনের দিক থেকেও কিছুটা ব্যবধান বোধ করি। নেহেরুর ঐ কৌতুকটা মনে পড়ে, ‘কাঁটাচামচে খাওয়া আর রোধক পরে ওটা করায় তৃপ্তির পার্থক্য কাছাকাছি!’
উত্তর মেরুর বিস্তৃত হিমরাজ্যের একটা গ্রিজলি ভালুকের মতো খাবার সংগ্রহ, আশ্রয় নির্মাণ, বরফে শরীর ডুবিয়ে দিনের পর রাত, রাতের পর দিনের নিদ্রা, বছরের একটা সময় ভালুকিকে সঙ্গ দিতে ক’টা দিন বা কিছু সময় ওদের সঙ্গে থাকা, এমন একাকীত্বও কি যাপনযোগ্য! ইংরেজরা, অথবা ইউরোপীয়রা, এ রকম একাকী, স্বতন্ত্র জীবনে হয়তো আনন্দ পায়, এ সমাজে এসে অন্যদেরও প্রভাবিত হতে হয়, এর ভালো দিকগুলো ভালো লাগতে শুরু করে।
রুমে ফিরে ক্লান্তি বোধ করি, একটা বাথ নেয়ার ইচ্ছে হয়, এন্ড-টেরাসের নিচের একটা রুমে বাথ, ওয়াশিং, এক পাশে ক্লেয়ারের একটা লিভিং রুম, যা দেখায় অনেকটা অফিসের মতো। বাথ নিতে নিচে নামি, দেখি দরোজা বন্ধ, ভাবি ভেতরে কেউ আছে, অনেকক্ষণ পরও কেউ বেরিয়ে না আসায় দরোজায় নক করবো কিনা ভাবছি। এমন সময় ক্লেয়ার নেমে আসে উপর থেকে।
তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছো শেখ?
না, বাথরুমে যাবো, ওটা বন্ধ দেখছি।
হ্যাঁ, ওটা তালা দেয়া, তুমি কি ব্যবহার করতে চাও?
হ্যাঁ।
ছয় শিলিং।
জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকাই। বুঝতে পেরে বলেÑ
এখানে থাকার লিফলেটটা সম্ভবত পড়ো নি তুমি, আমারই পড়ে দেয়া উচিত ছিল, মাপ করো। ওখানে লেখা আছে দেখো, সপ্তাহে এক দিন ফ্রী বাথ ইউজ করতে পারো, এর বেশি চাইলে প্রতিবারে ছয় শিলিং করে দিতে হয়।
ও আচ্ছা।
ইচ্ছে করলে যাওয়ার সময় একবারে বিল দিতে পারো।
ঠিক আছে।
খুলে দেবো?
দাও, বলি আস্তে করে।
ইচ্ছে হয় না বাথটাবের উষ্ণ জল ছেড়ে আসি, প্রায় ঘুম এসে যায়। এর পরের দিন আর একটু হেঁটে øান করতে যাই একটা বাথহাউসে, ঘণ্টায় চার শিলিং, বাবলবাথ নেই, খুব আরাম!
আজ এতো বছর পর লন্ডনের ঐ দিনগুলোকে মনে হয় স্বপ্নের ঘোরে কেটে যাওয়া ক’টা মুহূর্ত, নতুন বিশ্ব পাওয়ার আনন্দ, ফেলে আসা দেশের দুঃখ, আত্মীয় পরিজনের জন্য বিচ্ছেদকাতরতা, বিপরীতে নতুন সব ভালো ও মন্দ মানুষের সাক্ষাৎ ও সঙ্গ লাভ, এসবের মিশ্রণ পরের দিনগুলোর জন্য অসাধারণ একটা ভিত গড়ে দেয়। মানবিক বিশেষ অসম্পূর্ণতাগুলোর অনেক কিছুই অতিক্রম করে উঠতে পারি, এবং এখন মনে হয়, দেশে থেকে অর্ধমানব হয়ে জীবন কাটানো থেকে এটা শ্রেয়তর।
দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস বা বদভ্যাস রপ্ত করতে আরো কয়েক মাস লেগে যায়। রোববার সকালে তো লন্ডন শহরেরই ঘুম ভাঙ্গে না, এর অধিবাসীদের ঘুম থেকে জেগে ওঠার প্রশ্নই আসে না। অনেক দিনের অভ্যেস আমার, বলা যায় পিতৃ-আদেশ পালন করতে যেয়ে ঘুমোতে হতো রাত দশটার আগে, এবং উঠতে হতো ভোর পাঁচটায়। প্রাতঃভ্রমণের পর সাঁতরে গোছল করা ছিল নিত্য অভ্যাস। ঘুম ভাঙতেই ইচ্ছে হয় আজ গোছল করে নেব সকালেই, ছয় শিলিং দিয়ে হলেও।
নিচে নেমে একটু অবাক হই, ইংরেজদের ব্যক্তিগত আবেগের প্রকাশ করতে দেখি নি এ ক’দিনে। জানালার ধারে বসে একা একা কাঁদছে ক্লেয়ার, ফিরে যাবো কিনা ভাবছি, চোখ মুছে ঘাড় ফেরায় –
আসো, আসো শেখ, কোনো দরকার আছে?
না হয় পরে আসি, তোমার বোধ হয় মন ভালো নেই।
অসুবিধে নেই, বলো কেন এসেছো?
বাথ নেবো। একটু অবাক হয়।
কাল রাতেই না নিলে! ঠিক আছে, আসো।
সিঁড়ির ধাপ কয়টা নেমে আসি।
একটু বসবো তোমার সঙ্গে?
নিশ্চয়, কোনো অসুবিধা নেই, ভালো ঘুম হয়েছে তো? বড্ড গরম পড়েছে, তাই না?
হ্যাঁ, গরম, তবে তোমাদের কাছে, আমাদের পুরোপুরি শীত।
যা বলেছো!
কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ও, হয়তো ভাবছে চেপে রাখা দুঃখের ভার কিছুটা হালকা করা যায় কিনা আমার কাছে। এখনো সুন্দরী ক্লেয়ার, স্লীভলেস সাদা একটা শার্ট পড়নে, হাত ও বুকের কাছে ফ্রিল করা, মোকা রঙের মাঝারি ঝুলের গাউন ঝুলছে মেদহীন কটি থেকে, টিপিক্যাল ইংলিশ ভদ্রমহিলার সাজ, নির্দোষচিত্ত মানুষের প্রোটোটাইপ। পোশাক পরিচ্ছদে অত্যন্ত পরিপাটি ইংরেজরা, এই এক হপ্তায়ই বুঝে গেছি এটা ভালোভাবে। ওরা বলে, ড্রেস টু ইমপ্রেস, কথাটা সত্যি মনে হয় ওদের দেখে।
একটু মন খারাপ হয়েছিল শেখ, কিছু মনে করো না।
কোনো অসুবিধা নেই, ইচ্ছে হলে শেয়ার করতে পারো।
তাই? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে –
আমার মেয়ে আসবে ন’টায়, গির্জায় যাবো দশটায়। আমার স্বামীর মৃত্যুদিবস আজ। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুকে ক্রস আঁকে।
দুঃখিত ক্লেয়ার।
ঠিক আছে শেখ, একটু থেমে, অতীত থেকে উঠে এসে বলে, জানো, বিশ্বযুদ্ধের পুরো সময়টা রণাঙ্গনে কাটিয়েছে সে, ফিরে আসে বীরের বেশে, পুরো শরীরটা নিয়ে, অনেকগুলো মেডেল বুকে ঝুলিয়ে। ওকে পেয়ে মনে হয়েছে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। এই যে বোর্ডিং হাউসটা দেখছো, এর অর্ধেকটাই বোমার আঘাতে ধ্বসে গেছিল। অনেক সস্তায় এটা কিনে নেয় ও, তারপর দু বছর লাগিয়ে নিজে নিজেই মেরামত করে। আর্মিতে ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কাজ করতো। বাড়িটার কাজ সব শেষ করে যখন একটু গুছিয়ে বসেছি, বলা নেই, কওয়া নেই, টুক করে হার্টফেল করলো মানুষটা! ডোরার বয়স তখন মাত্র তিন, যুদ্ধের সময় জন্ম মেয়েটার, আর ইচ্ছে হয় নি বিয়ে করি। ওর কথা একদিন বলবো না হয় তোমাকে। সাউদাম্পটন থেকে জাহাজে চড়েছি মায়ের সঙ্গে জার্মানি যাবো বলে, আমার ঠাকুর্মা ছিলেন জার্মানির কোলোন শহরের, ঐ যে ইউ ডি কোলোন বানায়! জাহাজের ডেকে দেখা ওর সঙ্গে, এর দু মাসের মাথায় পরিণয়, কেমন ছিল সেই সব দিন! এই দেখো আবার চোখে জল আসতে চায়, তুমি বাথে যাও শেখ, আরেক দিন কথা হবে।
জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ক্লেয়ার, বাইরে দুরন্ত সবুজ নিসর্গ, কত রঙের ফুল যে ফুটেছে, গাছে ও ঘাসে! রাস্তার ওপাশে বিশাল চত্বর, হোলি ট্রীর ঝোপোলো বেড়া দেয়া, গাঢ় সবুজ কণ্টকময় নিচু গাছগুলোয় লাল বলের মত ছোট ছোট ফল ধরে, খুব সুন্দর দেখায় তখন, ক্রুশবিদ্ধ করার আগে যিশুকে কাঁটার মুকুট পড়ানো হয় এই গাছের লতাজাতীয় শাখায়, বড়দিনে এরা ঘর সাজায় এর শাখা-লতায়।
মনে মনে অবাক হই, আমাদের ওখানে বাবা মা অথবা অন্য কোনো আপনজনের মৃত্যুদিনে মিলাদ পড়ানো, কাঙালিভোজ, যেয়াফত, কত কিছুই না করে যাদের সামর্থ আছে, অথচ এরা? মেয়ে আসলে গির্জায় যেয়ে প্রার্থনা করবে কিছু সময়ের জন্য, ব্যস, এটুকুই। আপনজন অনেকে মিলে একত্রে বসে একটু স্মরণ-টরন করা, বয়স্কদের দোয়া-দরূদ পড়া, এসব কিছু নেই। অবশ্য আমাদের ওখানেও দরিদ্রদের মধ্যে এসব আনুষ্ঠানিকতার বালাই নেই, বাবামায়ের মৃত্যুদিনটাই হয় তো হিসেবে থাকে না ওদের। সামাজিক ও ধর্মীয় আচার পালন করে শুধু নিু ও মধ্যবিত্তের মানুষেরা। ঈদের নামাজের সময় দেখা যায় সমর্থজনেরা ঈদগাহে যায় নামাজ পড়তে, আর দরিদ্ররা সারি বেঁধে প্রবেশ পথে বসে থাকে ভিক্ষের জন্য, অথচ ধর্মটা নাকি সাম্যের! এখানে ধনী দরিদ্র সবাই প্রায় একই রকম পোশাকে গির্জায় যায়, দামী কাপড়ে সেজে, চোখে সুরমা এঁকে, একটা পার্থক্য সৃষ্টি করে না।
বিভিন্ন সমাজের মধ্যে মিশে থাকা বিভেদগুলো বিলেতে আসার পর ভালোভাবে বুঝতে শুরু করি। এগুলোর কারণ খুঁজতে থাকি, গোড়ায় যেয়ে এদের উৎপত্তিস্থল খুঁজে দেখে বিস্মিত হই। সেমেটিক এসব ধর্ম পৃথিবীর একটা অংশেই জন্ম নিয়েছিল। ভিন্ন হয়ে গেছে সমাজগুলোর ভিন্নতার কারণে। অপেক্ষাকৃত বেশি মানবিক বৈশিষ্টসম্পন্ন মানুষেরা এগুলোকেও অনেকটা মানবিক করে নিয়েছে, নিষ্ঠুরতাগুলো অনেকটা ঝেড়ে ফেলেছে। অথচ আমাদের এখানে এখনো ফতোয়ার নামে বর্বরতা, মুতা বিয়ের নামে নারীদের প্রতি চরম নির্মমতা ঘটে চলেছে অহরহ, এসব কোনো অপরাধই নয় সমাজের চোখে। এমন কি রাষ্ট্রশক্তিও কিছু করতে পারে না এদের বিপক্ষে, বরং অনেক ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়ে যায় নিজেদের কায়েমী স্বার্থ টিকিয়ে রাখার জন্য!
উঠে যেয়ে বাথের দরোজা খুলে দেয় ক্লেয়ার। বাথরুমে রাখা ক্যামেলিয়া সুগন্ধির হালকা আবেশ ফুরফুরে করে দেয় মনের গুমোট। গরম পানিতে এক মুঠো বাথ সল্ট মেশালে হালকা পান্না নীল হয়ে ওঠে টাবের পানি, নেমে পড়ি ওখানে, কী আরাম! ইচ্ছে হয় সাঁতার কাটি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি পোশাক পাল্টে গির্জায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে ক্লেয়ার। জিজ্ঞেস করি –
তোমাদের সঙ্গে গির্জায় যেতে পারি, ক্লেয়ার?
নিশ্চয় পারো, কিন্তু তোমাদের ধর্মে কি এটা অনুমোদন করে?
ওটা নিয়ে ভাবি না, তুমি চাইলে তোমাদের সঙ্গে যেয়ে বসতে পারি, যদি কোনো অসুবিধে না থাকে।
তুমি চাইলে যেতে পারো, আমার কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু আমি তো ক্যাথোলিক। তোমার জানা আছে কিনা জানি না, ক্যাথোলিক গির্জাগুলোয় বসার আসনের সামনে অনেকটা জায়গা খালি থাকে নিলডাউনের জন্য, প্রার্থনার সময় আমরা কয়েকবার নিলডাউন হই, সে-সময় বেঞ্চে বসে থাকা হয়তো স্বস্তি দেবে না তোমাকে।
তা অবশ্য ঠিক বলেছো, ক্লেয়ার।
খুব যদি যেতে চাও আমার সঙ্গে, গির্জা পর্যন্ত যেতে পারো। গির্জার উল্টোদিকে একটা সপিং সেন্টার আছে, ওখানে বসে কফি খেতে পারো, রোদের সঙ্গে।
একটু হালকা করতে বলি, ওরা কি রোদের জন্যও পয়সা নেয়?
ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ের মতো খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ক্লেয়ার। আমাদের কাছ থেকে তো নেয় না, কি জানি, তোমার কাছ থেকে হয়তো নিতেও পারে।
সঙ্গে সঙ্গে ভালো হয়ে ওঠে মনটা আমারও। বলি, কেন, আমি কালো বলে?
না না, তুমি অনেক সুদর্শন, তোমার কাছ থেকে হয়তো নেবে রোদের অপচয় হবে বলে। তোমার তো ওটার প্রয়োজন নেই।
যা বলেছো, ঠিক আছে, যাবো তোমার সঙ্গে।
আমার মেয়ে আসবে ঠিক ন’টায়, ন’টা পঞ্চাশে বেরোবো।
ঠিক আছে, বলে ঢুকে পড়ি আমার আপাত প্রিয়, স্বপ্নের ঘোরে!
1 Comments
Pingback: বই-তথ্য | Bangladeshi Novels