অন্য আলো
কামাল রাহমান
৩
অসংখ্য রাত কাটিয়েছি এমন এক প্রত্যুষের স্বপ্ন নিয়ে যা হয়তো মানুষের জীবনে কখনো আসেই না! ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পারি একটা ভুল স্বপ্নের জগতে ছিলাম, এমনকি ঘুমিয়েও ছিলাম ভুল জায়গায়। বিছানা, বালিশ, পরিবেশ সবই অন্য, তাড়াতাড়ি উঠে বসতে যেয়ে দেখি পুরো শরীর উদোম, এভাবে তো কখনো ঘুমাই না আমি! সারা শরীরে ব্যথা, মাথা তুলে রাখতে পারি না, প্রচণ্ড হ্যাঙওভার হয়েছে, আবার শুয়ে পড়ি, একটু একটু করে গত সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে। কাত হয়ে শুই, দেখি পাশের টেবিলে ভাঁজ করে রাখা আমার কাপড়-চোপড়, একটা দুবে দু ভাঁজ করে মেঝেতে বিছিয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে এলিনা, গায়ের দুবেটা কোমর পর্যন্ত নামানো, পাতলা একটা শেমিজ গায়ে, ভেতরে কোনো অন্তর্বাস নেই, মহাবিপজ্জনক এক দৃশ্য! এভাবে এখানে আমাকে টেনে আনার অর্থ কি! ফাঁদে পড়া একটা ইঁদুরের মতো মনে হয় নিজেকে, নিঃশব্দে উঠে পোশাক পরে নেই, টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন খুব, মনে হয় ওটা এড়িয়ে যাওয়া ভালো, ওর ঘুম ভাঙার আগেই বেরিয়ে যেতে চাই, আস্তে আস্তে দরোজা খুলে বেরিয়ে আসি, মুক্ত বাতাসে এসে বুঝতে চেষ্টা করি, কি ঘটেছে!
লাইব্রেরি-ওয়ার্কস করছিলাম বিকেলে, এলিনা এসে হাজির –
একটু সাহায্য করতে পারবে দাউদ? ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে বোঝাতে চাই এটা লাইব্রেরি। এবার ফিসফিসিয়ে বলেÑ
প্লীজ দাউদ, একটু সাহায্য করো, আমার এসাইনমেন্ট শেষ করতে পারছি না।
আমারটাই শেষ হয় নি এখনো।
তোমারটা শেষ করেই না হয়, প্লীজ দাউদ, ইউ আর এ জেন্টলম্যান।
কি করবো বুঝতে পারি না। ওভারকোট খুলে চেয়ারের গায়ে পরিয়ে দেয়। বসে পড়ে সামনের চেয়ারে। কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করি। একটু পরে হ্যান্ডব্যাগ খুলে আয়না বের করে ঠোঁটের লিপস্টিক ঠিক করে, এভাবে ঠোঁট চাপে ও বাঁকায়, স্নায়ু বিকল করে দেয়ার অবস্থা, পড়াশোনায় মন দেই কি করে, শার্টের বোতাম দুটো খোলা রাখায় সূর্য উঁকি দেয়। বুঝতে পারি এসাইনমেন্ট এখন অসম্ভব। ওকে আগে বিদায় দেয়ার কথা ভাবি, বলি –
ঠিক আছে, তোমার এসাইনমেন্ট বের করো, বলো কি সমস্যা।
তোমারটা শেষ?
না।
তোমারটা শেষ করো আগে। অসুবিধা নেই, আমি বসতে পারবো।
এখানে বসে থাকলে আমার কনসেন্ট্রেশান অন্য দিকে ঘুরে যায়।
কোন দিকে?
তুমি কিন্তু প্ররোচিত করছো আমাকে এলিনা!
কী যে বলো, এতো শীতল রক্ত তোমার।
হজম করে যাই খোঁচাটা, জড়াতে চাই না ওর সঙ্গে, কোনোভাবে।
রোমান দেবীর মতো অসাধারণ সুন্দরী এলিনা, ভাবতেই পারি না কেন আমার দিকে ঝুঁকেছে সে! রেডিওলোজি নিয়ে এক সঙ্গে পড়াশোনা করি, বেশ কিছু ক্লাশ রয়েছে কমন, গ্রুপ-ওয়ার্কসও করতে হয় প্রায়ই, ক্লাশমেইটের চেয়ে বেশি আকর্ষণ কখনো অনুভব করি নি, হয়তো এক ধরনের ভীতিও কাজ করে, কেন জানি না পাকিদেরকে ভয়ও করে, ঘৃণা থেকে কিনা বুঝতে পারি না। দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চেষ্টা করেছি, অথচ ঘনিষ্ট হওয়ার জন্য উদ্বাহু এগিয়ে এসেছে সে। হয়তো কখনো যাচ্ছি ক্লাশের দিকে, পিছন থেকে পিঠে বুক ঠেকিয়ে কাঁধে হাত রেখে হেঁটে এসেছে এক সঙ্গে কথা বলতে বলতে। প্রায়ই এক সঙ্গে খেতে আসে কেন্টিনে, কোনো কোনো দিন বাইরে খাওয়ার আহ্বান জানায়, যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলি ভদ্রতা বজায় রেখে, অনেক সময় না যেয়ে পারি না, যে-কারণে, আমাকেও ফেরত-আমন্ত্রণ জানাতে হয় মাঝে মাঝে। বুঝতে পারি, প্রবলভাবে চাইছে সে আমাকে, কিন্তু এগোতে পারি না কোনোভাবে। নিজেই অবাক হই কখনো কখনো, এমন অসাধারণ এক রূপসীর আমন্ত্রণ এড়িয়ে চলেছি কীভাবে? ওর সঙ্গে পরিচয় ইউনিভার্সিটির ইন্ডাকশানের দিন, একই দেশের দু অংশের নাগরিক হিসাবে সাধারণ সৌজন্য বিনিময় হয়েছে। ওদের জাতীয় রক্ষণশীলতার জন্যই হয়তো খুব বেশি ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে মেলামেশা ছিল না ওর, করিডোরে বা অন্য কোথাও দেখলে এগিয়ে আসতো। ক্লাশের ফাঁকে কখনো কেন্টিনে গেলে সামনাসামনি এসে বসতো, এড়িয়ে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না আমার, ক্লাশমেইট হিসাবে কথাবার্তা চালিয়ে যেতাম। ধীরে ধীরে এক ধরনের নির্ভরতা যেনো খুঁজে পায় আমার ভেতর। ভাবে, ওর অনেক কিছু শেয়ার করা যায় আমার সঙ্গে, অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার অনেকটা, ক্লাশের অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গেও ওর তেমন ভাব ছিল না, অমিশুকই বলা যায় ওকে।
ওদের গ্রাম ও পরিবারের কথা এতোভাবে বলেছে যে ওসবের একটা চিত্র এরি মধ্যে আমার মনে তৈরি হয়ে গেছে। ইসলামাবাদের খুব কাছে এক পাহাড়ের চূড়ায় ওদের গ্রাম চাকলান। ওটাকে নাকি মনে হয় পৃথিবীর শেষ গ্রাম, যেখানে শেষ হয়েছে ওটা, সেখান থেকে খাড়া ঢাল এতো নেমে গেছে যে নিচে কিছুই দেখা যায় না, অনেক দূর দিগন্ত ছাড়িয়ে শুধু পাহাড়ের পর পাহাড়, সবুজের চিহ্ণ মাত্র নেই, অথচ ওদের গ্রামটা চিরসবুজ, হাজার হাজার বছর আগে কোনো ভূকম্পনের ফলে হয়তো ওদিকটা দেবে নিচে নেমে গেছে, বৃষ্টিপাত তেমন না হওয়ায় ও প্রকৃতি পাথুরে থাকায় গাছপালা আর জন্মাতে পারে নি। গ্রামের পাশেই একটা প্রাকৃতিক ঝরনা থাকায় পানির অভাব হয় না তেমন, ফসল ফলানো ও ফলের বাগান গড়ে তোলা যায়। গ্রামটার প্রতিরক্ষা খুব দৃঢ়, তিন দিকেই এরকম খাড়া ঢাল থাকায় শুধু মাত্র সামনের দিক দিয়ে শত্রু আক্রমণ করতে পারে। আমি বলি – এটা বিপদজ্জনকও বটে। কোনো কারণে পালাতে হলে, পথ নেই। ও বলে – পালানোর কথা কখনো ভাবি না আমরা। জানজুয়া পরিবারের নাম শুনেছো নিশ্চয়। পুরো গ্রামটাই জানজুয়াদের, দেশের সেনাবাহিনীতে প্রথম সারির অনেক কর্মকর্তা আছে আমাদের গ্রামের। প্রায় সব পরিবারেই সৈনিক পেশায় রয়েছে কেউ না কেউ, শারীরিকভাবে দুর্বল অথবা অন্য কোনো কারণে যারা সেনাবাহিনীতে যেতে পারে না, ওরা চাষবাস করে। আমাদের পরিবারের অধিকাংশ পুরুষ সদস্যই সৈনিক।
ভালোই তো, তোমাদের পরিবারের লোকজন জানে কীভাবে নরহত্যা করতে হয়, লুটতরাজ করতে হয়।
ওভাবে দেখা ঠিক না, সামরিক বাহিনীর প্রধান কাজ দেশ রক্ষা, নিজেদের রক্ষা করা।
অবশ্যই, সব দেশের সেনাবাহিনী একই কাজ করে, কেউই আক্রমণ করে না। কিছু মনে করো না, ছোট্ট কৌতুক একটা।
এবার হোয়াইট ক্রিসমাস এসেছে বিলেতে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, রেসিডেন্সের প্রায় সবাই গেছে ছুটি কাটাতে। অনেক দিন থেকে এলিনাদের বসবাস এই অক্সফোর্ড শহরে, ওর দাদা এদেশে এসেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, ফিরে যায় নি আর। ওদের পরিবারের মালিকানায় কর্ণার-সপ আছে কয়েকটা, বেশ ভালোই চলে ব্যবসা। দু বোন ওরা, ছোট বোন চিনতির স্কুল ছুটি থাকায় বাবা-মায়ের সঙ্গে দেশে গেছে। ক্রিসমাস-ইভে পুরো অক্সফোর্ড উৎসবমুখর, ঘরে বসে আছি একা একা, ক্রিসমাস পার্টির নিমন্ত্রণ ছিল অনেক ক’টা, সবগুলোই এড়িয়ে গেছি এ বছর, কেন জানি না। স্পেইনিশ পেড্রো ডোমেকের বোতল খুলে টিভির সামনে বসেছি। দরোজায় কড়ানাড়া, একটু অবাক হই, দরোজা খুলে পুরোপুরি তাজ্জব! বাইরে তখনো অবিরাম তুষার ঝরছে, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত বরফে ঢাকা রাস্তাঘাট, সব কিছু সাদা, পুরোপুরি সাদা। সামনে দাঁড়িয়ে এলিনা, গায়ে জড়ানো টুকটুকে লাল জ্যাকেট। বাইরের হিম ঠাণ্ডায় শাব্দিক অর্থেই বরফের মতো সাদা ওর মুখ, ঠোঁট দুটো শুধু জ্যাকেটের মতো উজ্জ্বল লাল, প্রায়-বোকা অন্তরঙ্গ এক হাসি মিশে আছে সেখানে। যেন, আরে, কী করে ফেললাম এটা! বাতাসের ধাক্কায় কিছু তুষারও ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতর, তাড়াতাড়ি ওকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেই।
ভাবতেই পারি না এলিনা।
আমিও পারি নি এক মুহূর্ত আগে। চলে যাবো?
না, এসেছো যখন, আর যাবে কেন, বসো।
ওভারকোটটা খুলতে সাহায্য করি, বৃটিশ এ ভদ্রতাটা এরি মধ্যে শিখে নিয়েছি, তুষার ঝেড়ে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখি, নিঃসন্দেহে কোনো দামি সৌরভ ব্যবহার করেছে, পুরো করিডোরে ফুলের হালকা সুগন্ধি ভেসে বেড়ায়, চট করে গুছিয়ে নেই অগোছালো জিনিসপত্র, এয়ারফ্রেশনার ছড়িয়ে দেই। এসব করি আমার আপাত নার্ভাসনেস কাটাতে। ও বুঝতে পেরেছে কিনা বুঝি না।
অস্থির হচ্ছো কেন, সবই তো ঠিক আছে। আমি নিশ্চয় আশা করি না যে খুব গোছানো কোথাও এসে পড়েছি।
তা না, তুমি তো অতিথি, অবশ্যই।
ওভাবে দেখার দরকার নেই।
ঠিক আছে, বলো কি খাবে, চা কফি, অথবা জ্যুস ড্রিঙ্কস?
বসি একটু, ভেবে দেখি?
ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা নেই।
একটা কমেডি সিরিয়াল চলছে টিভিতে, ওটার হাসিতে মনে হয় ঘরের ভেতর অনেক মানুষ একসঙ্গে হাসছে, চ্যানেল পাল্টাতে থাকি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে এসে থেমে যাই, বলিভিয়ার একটা গ্রামের ছবি, পুরো আমেরিকায় এই একটা দেশ যেখানে জনসংখ্যার বেশির ভাগ এখনো রেড ইন্ডিয়ান! পাশ্চাত্যের ক্যামেরা সাধারণত যা দেখায়, ওদের অনুন্নয়ন বা দারিদ্র, কুঁড়েঘর, হালকা পোশাকের মানুষজন, আদুল গায়ে খেলাধুলায় মেতে থাকা শিশুরা, ওদের কথিত উন্নয়ন যেখানে দাঁত ফোটাতে পারে নি। আকাশচুম্বী শেয়াল-চোখ ভবন নেই, শপিংমল, ফার্স্টফুড নেই, চওড়া রাস্তা আর ঝকঝকে গাড়ি নেই, আছে এখনো নির্মল প্রকৃতি।
ঘরের পেছন দিকের জানালার পর্দা সরিয়ে ছড়িয়ে যেতে দেই দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা। বাইরে, স্ট্রিটলাইটের আলোর গোল বৃত্ত জুড়ে ঝরে পড়া তুষার দারুণ সুন্দর দেখায়, গাছপালায় কোনো পাতা না থাকায় শহরের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়, অসংখ্য জোনাকির মতো ছোটো ছোটো আলোর বৃত্ত ঘিরে থাকা তুষারের শত শত ফুল ফুটে রয়েছে, এমন নিবিড় নির্জন রাত শ্রাবণের বর্ষারাতের মতো অন্তর আকুল করে দেয়।
উঠে এসে এলিনাও দেখে তুষারপাত। জিজ্ঞেস করি –
গাড়ি পার্ক করেছো কোথায়?
কাছেই ফাঁকা জায়গা পেয়েছি, ভাগ্য ভালো।
যেভাবে তুষার পড়ছে, গাড়ি বের করতে পারবে তো আবার?
তাই তো।
মনে হয় প্রকৃত অর্থেই হোয়াইট ক্রিসমাস।
হ্যাঁ, রেইনডিয়ার নিয়ে শান্তা আসছে তোমার কাছে।
আমি খ্রিস্টান নই।
আমিও না। তাতে কি, খ্রিস্টানদের দেশে বাস তো করছি। ওদের প্রথাই তো চলবে এখানে।
এভাবেই দেখো?
কেন নয়!
আমি ভেবেছি অনেকটা কট্টর তোমরা।
হ্যাঁ, কট্টর আমার পরিবার, দেশের মানুষ, কিন্তু এখন তো আমি অন্য কোথাও।
তুমি অবশ্যই ঠিক। বলো এখন কি খাবে?
না, বরং যাই।
যাবে?
হ্যাঁ, সত্যিই জানি না কেন এসেছিলাম, অন্য কিছু ভেবো না দয়া করে।
না না, ভাববো না। বসো তুমি। মনে হয় একাকীত্বের চাপ এসে পড়েছিল তোমার উপর। বলো, কি ড্রিঙ্কস দেবো?
তুমি তো এলকোহোল নিচ্ছো।
সে জন্যই তো জিজ্ঞেস করছি, ওটা তোমার চলবে না।
চেখে দেখতে দোষ কি?
ওটা নিষিদ্ধ তোমার জন্য।
নিষিদ্ধ তো অনেক কিছুই, এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি, এটাও তো নিষিদ্ধ। ভাবতে পারো আমার পরিবারের কেউ জানতে পারলে পরিণতি কি হবে আমার?
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, খুব বড় ঝুঁকি নিয়েছো।
এবং আমি জানি, কোনো কারণ ছাড়াই এটা করেছি।
হয়তো অবচেতন মনের এক ধরনের বিদ্রোহ তোমার।
হতেই পারে।
সত্যিই কি এলকোহোলিক ড্রিঙ্কস নেবে?
নিতে পারি একটু। শেকল যখন কেটেছি, খোলা আকাশে একটু পাখা মেলতে দোষ কি?
দু মিনিট সময় দাও, প্লীজ।
চট করে শীতের পুরু পোশাক পরে বেরিয়ে আসি। তুষার ঝরা বন্ধ হয়েছে আপাতত, হয়তো কিছুক্ষণের জন্য। এত কনকনে ঠাণ্ডা এখন বোঝা যায় না, চারদিক একেবারে সাদা, গোড়ালি পর্যন্ত পা দেবে যায় রাস্তায় জমে থাকা তুষারে, এ রকম তুষারে পা পিছলানোর ভয় নেই তেমন। ক্রিসমাস ইভে আনন্দমুখর পুরো দেশ, প্রতিটা ঘরে আলো জ্বলে, অনেকে যায় গির্জায়, বিশেষ করে একটু বয়স্করা, তরুণতরুণীরা প্রায় সবাই পাবে ও বিভিন্ন পার্টিতে। নগরীকে এক অসাধারণ রূপ দিয়েছে ক্রিসমাসের বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জা, ঐসব আলোর প্রতিফলন বরফের উপর অবর্ণনীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। হাঁটতে হাঁটতে এসব দেখি মুগ্ধ চোখে, রক্তে এলকোহোল থাকায় শীত অনুভূত হয় না তেমন, বেরিয়ে এসে বেশ ভালোই লাগে, সঙ্গে কেউ থাকলে আরো ভালো জমতো, এলিনাকে বলা যায় না। একটু ভেতরের দিকে একটা অফ-লাইসেন্স দোকানে ঢুকে এক বোতল ম্যালিবু, স্পার্কলিং এপল, ক্রেইনবারি ও অরেঞ্জ জ্যুস নেই, সঙ্গে বেশ ক’রকম ক্রিস্প। ইচ্ছে হয় একটু ধূমপান করি, এত স্নিগ্ধ পবিত্র বাতাসটাকে কলুষিত করবো? থাক। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় মনে হয় নি, কাঁধের ব্যাগটা আনা উচিত ছিল। সপিং ব্যাগ ঝোলাতে যেয়ে পকেটের বাইরে রাখতে হয় একটা হাত, এক মিনিটের ভেতর জমে বরফ, হাত পাল্টাতে হয় বারবার, গ্লাভসও আনি নি। ভেবেছিলাম, একটু ঘুরে পার্কের পাশ দিয়ে যাবো, তা আর হয় না। ঘরে ফিরে আসি খুব তাড়াতাড়ি।
এক কাপ কফি নিয়ে আরেকটু সহজ হয়ে বসেছে এলিনা।
ঠিক আছো?
হ্যাঁ, আমি তো ভেবেছি, তুমি পালিয়েছো।
কী যে বলো!
কিছুটা সময় একা থেকে মাথায় এলো যে ঝোঁকের মাথায় একটা বাজে কাজ করে ফেলেছি।
কি ওটা?
এই যে, হুট করে চলে এলাম তোমার এখানে।
এ নিয়ে আর ভেবো না, আমি কিছু মনে করি নি, কোনো অন্যায় করো নি।
বিষয়টাকে মনে রেখো না তাহলে।
অবশ্যই না।
আমি বরং যাই এখন।
যাবে? ড্রিঙ্কসটা নিয়ে যাও। এটা শুধু তোমার জন্য। খ্রিস্টের উদ্দেশ্যে।
হো হো হো, ঠিক আছে দাও।
কোনটার সঙ্গে মেশাবো। জ্যুস ড্রিঙ্কসগুলো দেখাই।
ক্রেইনবারির সঙ্গে দিতে পারো।
বরফ মিশিয়ে পরিবেশন করি। ভয়ে ভয়ে এক চুমুক দিয়ে বলে –
বাহ্, ভালোই তো। অন্য রকম কিছু মনে হচ্ছে না!
তা হবে কেন, চালিয়ে যাও।
আবার হালকা তুষার ঝরতে শুরু করেছে বাইরে, পাতা ঝরে যাওয়া গাছের নগ্ন শরীরে তুলোর মতো ঝুলে আছে তুষার। খাটো, কিছু চিরসবুজ ঝোপে তুষার জমে পুরোপুরি সাদা হয়ে রয়েছে, গাছের অস্তিত্ব প্রায় বোঝাই যায় না। গত কয়েক বছর ধরে সিনেমা হলগুলোয় হাউসফুল থাকা চলচ্চিত্র ‘অ্যা ম্যান ফর অল সিজনস’ দেখানো শুরু করেছে টেলিভিশনে। গ্লাসে ড্রিঙ্কস নিয়ে বসি টিভির সামনে, সিনেমায় মন বসানোর চেষ্টা করি। পল ও ওয়েন্ডি যুগলের অসাধারণ অভিনয় সত্যি মুগ্ধ করে।
এলিনার গ্লাসের ড্রিঙ্কস শেষ হয়ে যাওয়ায় আর এক গ্লাস বানিয়ে দেই আপেল জ্যুস মিশিয়ে। চুমুক দিয়ে বলে ‘ওয়াও’। বুঝতে পারি একটু একটু করে এনজয় করা শুরু করেছে। একটু পরে বলে –
আর একটা ভুল করে ফেললাম ডাউ!
কি?
এখন তো ইচ্ছে করলেও যেতে পারবো না। ড্রিঙ্ক-ড্রাইভ করবো কীভাবে?
যেতে বলছি না তো।
তা কি কেউ বলে? আমারই তো যাওয়া উচিত। ঠিক আছে, ট্যাক্সি ডেকে চলে যাবো, কাল এসে গাড়ি নিয়ে যাবো।
এতো কিছু ভাবার দরকার নেই, সময়ই নিয়ে যাবে, কোথাও না কোথাও।
তাহলে সময়ের হাতেই ছেড়ে দিলাম আমাকে।
ভাগ্য ভালো তোমার, আমার হাতে ছাড়ো নি, হো হো!
হো হো হো, ভালোই বলেছো, তবে তোমাকে বোধ হয় ভরসা করা যায়।
খুব বেশি না।
ঘুম পাচ্ছে। হাই তোলে এলিনা।
বিছানায় যেয়ে শুয়ে পরতে পারো।
তুমি শোবে কোথায়?
ভেবো না, সিনেমা দেখতে দেখতে অনেক রাত সেটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, আজও তাই হবে।
পরনের কার্ডিগান খুলে হালকা হয়ে টয়লেটে যায়, এই ফাঁকে বিছানা পরিপাটি করে রাখি, এক মিনিটের জন্য জানালা খুলে ঘরের গুমোট বের করে এয়ারফ্রেশনার স্প্রে করে দেই। টয়লেট থেকে বেরিয়ে সোজা যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, এলকোহোলে অভিজ্ঞতা না থাকায় দু পেগেই কাজ হয়ে গেছে। রাত জেগে টিভি দেখি, মনের মধ্যে দুর্ভাবনা উঁকি দেয়, কোনো কিছুতে জড়িয়ে যাচ্ছি না তো! এদের বিশ্বাস করি না কোনোভাবে, সাপের মতো বিষাক্ত ছোবল দিতে পারে যে-কোনো সময়। পরদিন ঘুম ভাঙ্গে প্রায়-দুপুরে, জানালার পর্দা খোলা থাকায় কিছুটা আলো এসেছে ঘরের ভেতর, খুব আলসেমি লাগে, এক মিনিটের জন্য দরজা খুলে বিশুদ্ধ বাতাস ঢোকাই, জানালা খোলা রাখি একটু সময়ের জন্য। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে আবার গা এলিয়ে দেই সেটিতে, এলিনা ওঠে নি এখনো, টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দেই, শব্দে কাজ হয়, শোবার ঘর থেকে নেমে আসে, অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে চোখের নিচের দিকটা ফুলিয়ে তুলেছে, ঘুমের রেশ নিয়ে দুলতে দুলতে কাছে আসে। এমনিতেই অপূর্ব সুন্দরী এলিনা, এখন দেখায় অপরূপ! মাথা ঘুরে ওঠে, সামলে নেই, বলি –
সুপ্রভাত।
সুপ্রভাত ডাউ।
ঘুম হয়েছে?
ঘুম কিনা জানি না, অসাধারণ এই অভিজ্ঞতা, এটা থেকে মানুষকে কেন বঞ্চিত করা?
কারণ নিশ্চয় আছে, এবং তা খুবই যুক্তিসঙ্গত। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে যদি পারো, তাহলে তোমাকে বাধা দিচ্ছে কে! হুম… ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক আগে, কোথায় আছি সেটা বুঝতেই অনেক সময় লেগেছে, তারপর তোমার সারা-শব্দ শুনছিলাম। কেমন একটা আবেশের ভেতর ছিলাম, নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, আমিই এসব করছি কিনা! এটা তো কোনো কৌতুক না, জানো তো, আমার জন্মও হয়েছে এদেশে, আমার কাছে এসব অজানা কিছু না। সহপাঠী বন্ধুদের দেখেছি আঠারো পেরোনোর পরই ডেইটিং করে আসছে, তাও তো করছি না, এসব কি করছি আমি, পাগলামো! কেনই বা?
সহজভাবে নাও না কেন, এক ধরনের এ্যাডভেঞ্চার।
অথবা বলতে পারো এক ধরনের জেদ, তোমাকে বোঝার চেষ্টা করা, অদ্ভুত মনে হয় তোমাকে, ওসব সম্পর্কে আমার ধারণা হওয়ার আগে থেকে এপ্রোচ পাওয়ার অভিজ্ঞতা পেয়ে আসছি, একেবারে স্কুল-বয়স থেকে, বিশেষ করে আমাদের কমিউনিটির ছেলেদের কাছ থেকে, এতো নোংরাভাবে এপ্রোচ করে ওরা, একেবারে সরাসরি, সেসব ক্ষেত্রে ইংরেজরা অনেক ভদ্র, অনেক ধাপ না পেরিয়ে কখনোই তোমাকে এপ্রোচ করে না। প্রথমে হ্যালো হাই দিয়ে শুরু, দিনের পর দিন একটু একটু করে কথা বলার মাত্রা বাড়ায়, তারপর হয়তো একসঙ্গে চা-কফি খেতে ডাকবে, তারপর ডিনার, লং ড্রাইভ, আউটিং, তারপর হয়তো একসঙ্গে কোনো হলিডেতে যেতে চাও কিনা জানতে চাইবে।
যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তোমার, এলিনা!
হ্যাঁ ডাউ, তবে যথেষ্ট নয়, একটা অভিজ্ঞতাই হয়েছিল। কলেজে পড়াকালীন সময়ে ইংরেজ এক ছেলের সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল। একেবারে শেষে, হলিডেতে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়ার পর না বলাতে বুঝতে পেরেছে, ওর সঙ্গে আর এগোবো না, এখনো ভালো বন্ধুত্ব বজায় রয়েছে ওর সঙ্গে। গার্লফ্রেইন্ড নিয়ে এসেক্সে থাকে এখন, ভালোই আছে, সত্যিই ভালো ছিল সে।
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, নিশ্চয় ভালো ছিল সে।
ঈর্ষা হচ্ছে? তবে তোমার চেয়ে ভালো নয়, মনে হয়।
কীভাবে বুঝলে?
তোমাকে বিশ্বাস করা যায়।
পুরুষমানুষকে কোনো মেয়ে বিশ্বাস করে এটা আবার আমি বিশ্বাস করি না। তাছাড়া তোমাকে এপ্রোচ করি নি বলে অন্য কাউকেও করি নি এটা ভাবলে কীভাবে? আমি তো সাধুপুরুষ না, ব্রহ্মচারী ব্রতধারীও না।
ওটা আবার কি?
ঐ, সেইন্টেরই রকমফের, রাখো ওসব।
হ্যাঁ, কথায় কথায় খামোকা পেঁচিয়ে তোলা অর্থহীন।
ক্ষুধা পেয়েছে মনে হয়।
হাতমুখ ধুয়ে আসো, কি খাবে বলো?
টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে বলে –
আগামী বছরের আগে তো ইউনি যেতে হচ্ছে না, চলো বাইরে কোথাও, লাঞ্চ ব্রেকফাস্ট একসঙ্গে হয়ে যাবে।
মন্দ হয় না।
কফি ও বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়ি।
বরফ পরিষ্কার করে গাড়ি বের করতে যেয়ে নাস্তানাবুদ। রাস্তায় বেরিয়ে বলে –
চলো ব্রিজ পেরিয়ে কাউলিতে যাই কোথাও, অক্সফোর্ডে চেনাজানা কার-না-কার চোখের সামনে পড়ে যাই, বোঝোই তো কোথায় আমাদের সমাজের অবস্থা।
কাউলিতেই বা চোখে পড়বে না ভাবছো কেন?
তাহলে চলো আর একটু এগিয়ে চিপিং নর্টন যাই। ভালো একটা লেবানিজ রেস্টুরেন্ট আছে ওখানে।
দুপুরে খোলা থাকবে ওটা?
হ্যাঁ, বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত খোলা থাকে, যদ্দূর জানি।
ঠিক আছে, যাও।
শহর ছাড়িয়ে আসার পরই শীতের অবাধ প্রকৃতি, শুভ্র সৌন্দর্য, গাড়ির ভেতর চমৎকার উষ্ণতা ও সুন্দরী রমণী। গতিশীল সময় ও প্রকৃতি, সব কিছু মিলেমিশে মুগ্ধ হওয়ার মতো এক অনন্য সুন্দর পরিবেশ। পাহাড়গুলোর গায়ে কোথাও কোথাও জমে আছে সাদা তুষার, ঢালু জমিগুলোয় গত ফসলের কাটা গাছের গুঁড়িতে ঝুলে আছে বরফ, অসংখ্য গাছের গুঁড়ির উপর জমে থাকা বরফে মনে হয় লক্ষ লক্ষ সাদা কোনো ফুল ফুটে রয়েছে, মাঝে মাঝে চিরসবুজ গাছের সারি, বিশাল ফসলখেতের বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতি গড়ে তুলেছে প্রকৃতির অনন্য ও একান্ত ক্যানভাস।
চিপিং নর্টনের লেবানিজ রেস্টুরেন্টটা ছোটো, কিন্তু বেশ সাজানো-গোছানো। পরিবেশনকারী সব সাদা আরব, খাবারের স্বাদ বেশ ভালো। আমরা নিয়েছি স্ক্যুড-ল্যাম্ব-মিট, বাবা-ঘানৌস, হামুস, কিবেত-ব্যাতাতা ও মেঘলি। ইওগার্ট দিয়ে বানানো আয়রান পানীয়টা সত্যি চমৎকার। ওদের তো আর দাদা বলা যায় না, খাওয়ার পর না হয় বলতাম পেট পুরে খেলুম দাদা, অগত্যা ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে আসি। তখনো তিনটে বাজে নি। মাথায় বোধ হয় বায়ু চড়েছে এলিনার, বলে – এখন ঘরে ফিরে আর কি হবে, কারোই তো কাজকর্ম নেই, চলো বার্মিংহ্যাম যাই, মাত্র ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ, ওখানে ডিনার সেরে ঘরে ফিরবো। ওকে বলি, আমিই বরং এখন নিজেকে ছেড়ে দিলাম সময়ের হাতে! সময়ের হাতে, না আমার হাতে, বলে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। মনে হয় এক প্রকৃত পাগলিনীর হাতেই পড়েছি।
গাড়িতে বসে একটা কুর্দি গান ছেড়ে দেয়, অসাধারণ! গানের বাণী না বুঝলেও সুর সত্যিই উষ্ণ করে তোলে। মাঝে মাঝে উর্দুতে কথা বলার চেষ্টা এখনো ছাড়ে নি ও, সরাসরি একদিন বলেছিলাম যে ঐ ভাষাটির প্রতি কোনো আগ্রহ নেই আমার। কথার ফাঁকে দু একটা বাক্য উর্দুতে বলে ফেলে যখন দেখে চুপ করে আছি, বুঝতে পেরে বলে, দুঃখিত ভুলে উর্দু এসে গেছে। গানের কথাগুলো বোঝে কিনা জিজ্ঞেস করি। না, সেও বোঝে না, ওর এক কুর্দি বান্ধবী ক্যাসেটটা উপহার দিয়েছে, কুর্দি গানের জগতে ঐ গায়িকা এখন সবার সেরা, এটা একটা উদ্দীপনামূলক গান। মনে মনে হাসি, কুর্দিরা কি আর জাগবে কোনো দিন! যে-কোনো জাতির শত শত বছর লাগে একজন সালাদিনের জন্ম দিতে। নিজেরা খুনোখুনি করে মরছে এখন, আর ভাবছে আকাশ থেকে পাখির ঝাঁক পাথর ছুঁড়ে ওদের বিপক্ষ সৈন্যদের নিশ্চিহ্ণ করে দেবে! কোভেন্ট্রির কাছাকাছি এসে শহরে গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়, বলেÑ চা খাবো এখানে। জিজ্ঞেস করি –
ঠিক আছো তো এলি?
বহুত, খুব।
এখন আমার বিশ্বাস হতে থাকে যে মেয়েটার মাথায় সত্যিই ছিট আছে। যা খুশি করুক, হাতে তো কোনো কাজ নেই তেমন। তাছাড়া, সত্যি বলতে কি, এই পাগলামোটা ভালোই লাগছে, মুক্ত জীবন, মন যা বলে তাই করা, এটার ভেতর এক ধরনের আনন্দ আছে, এলিনা এখন যেভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে অবাধে, একা অথবা অন্য কারো সঙ্গে হয়তো এটা পারতো না, একজন নির্ভরযোগ্য সঙ্গী পেয়েছে, নিজের মন ও শরীর, দুটোই মুক্ত করে দিয়েছে।
কোভেন্ট্রি শহরটা বেশ বড়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমার আঘাত থেকে পুরোনো কেথেড্র্যালটাও রক্ষা পায় নি, শহরটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল জার্মানরা, আবার নতুনভাবে গড়ে তুলেছে সব, শহরের অনেক অংশ বেশ ঝলমলে, আধুনিকতার ছোঁয়া সবকিছুতে, বিশেষ করে নতুন কেথেড্র্যাল ভবনটা অনন্য সুন্দর। দেয়ালের ট্যাপেস্ট্রি, কাচ ও ব্রোঞ্জের কারুকাজ অসাধারণ। কিছুটা সময় বের করে নেই শহরটা এক নজর ঘুরে দেখার জন্য, এ কাজটা না করে কেন জানি কোনো জায়গা ছেড়ে আসতে পারি না।
চা খাওয়ার পর মনে হয় এক কাপ চায়ের প্রয়োজন ছিল আমারও, শরীরের চাহিদা বোঝা যায় না অনেক সময়, বেশ চাঙা হয়ে ওঠি। বার্মিংহ্যামের বুলরিঙে ঢুকে বেশ রমরমা লাগে, ক্রিসমাসের পর বক্সিং ডেতে প্রায় সবকিছুই সেইলে বিক্রি হচ্ছে, প্রচুর কেনাকাটা করছে মানুষ, এ সময়টার অপেক্ষায় থাকে অনেকে। আমাকে একটা জ্যাকেট কিনে দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে এলিনা। আমি বলি, তোমাকেই তো আমার কিনে দেয়া উচিত, সেখানে আমার জন্য তুমি নেবে, এটা হয় না। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হই একটা জ্যাকেট নিতে, দোকান থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি একটা বেঞ্চে বসে বলে, গায়েরটা পাল্টাও, তাও করি। দুটো লিপস্টিক গছাতে সমর্থ হই ওকে, ঘুরে ফিরে অনেক কিছু কিনে এলিনা, অক্সফোর্ড থেকে অনেক বেশি সস্তা মনে হয় সবকিছু। এতো মানুষের ভিড়ে ঘুরে ঘুরে বেশ মজাই লাগে, শরীরের জড়তা কেটে যায় অনেকটা। নিঃসঙ্গতা, নিস্তব্ধতা যেমন ভালো লাগে, তেমনি হৈ-হুল্লোড় ও প্রচুর সমাগম, বিচিত্র মানুষজন কখনো কখনো খুব আকর্ষণ করে আমাকে! স্টারবাক্স থেকে দু কাপ কফি ও স্যান্ডউইচ খেয়ে আরো চাঙ্গা হয়ে ওঠি। উলওয়ার্থে ঢুকে আবার এলিনা, নিজের জন্য অনেক কাপড় কেনে, আমাকে বলে পছন্দ করে দিতে, আমি বলি মেয়েদের পোশাক গায়ে চড়ানোর পর সুন্দর, আর সুন্দরীরা সব পোশাকেই সুন্দরী, যে-কোনোটা নিতে পারো তুমি। একগাদা কাপড় কিনে বেরোয়, এবার মনে হয় তেষ্টা পেয়েছে আমার, ওকে বলি, এক পাইন্ট বিয়ার নিতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। ঠিক আছে, কিনে নেবো, গাড়িতে যেতে যেতে পান করো, ফেরার পথে কোথাও থামবো না আর। সেইন্সবারিতে ঢুকে চারটা স্পেশাল ব্র“য়িং কার্লসবার্গ নেই। এক বোতল ব্র্যান্ডি নিতে বলে ও, জিজ্ঞেস করি, কেন? বলে, নেওই না। পচাত্তর সিএলের একটা কনিয়াক নেই, সঙ্গে মেশানোর জন্য সিরাজ পোর্ট ও লেমনেড নেই, প্রচুর খাবার-দাবার কিনে বেরিয়ে আসি, সবকিছুতে পুরোপুরি ভরে গেছে বিশাল ট্রলি। গাড়িতে বসেই বড় এক ঢোক বিয়ার গলায় ঢেলে দেই। এলিনা বলে, সাবধানে পান করো, সামনের সিটে বসে এলকোহোল নেয়া বৈধ না, মোড়কে জড়িয়ে নেই বীয়ারের ক্যান। বেশ দ্রুত চালিয়ে ঘরে ফিরে আসে এলিনা, ওর ঘরে। একটু অপ্রস্তুত হই, গাড়ি থেকে মালামাল সব নামিয়ে রেখে বলি –
যাই। ও বলে –
যাচ্ছো না, ড্রিঙ্কস কিনলাম কেন?
বলো কি! না না, এটা ঠিক হবে না। আমি যাই।
বলেছি না বাসায় কেউ নেই, একদম একা আমি।
সে জন্যই তো থাকা ঠিক হবে না।
হবে, বলে হাত ধরে টেনে সোফায় বসায়।
আমি চাই না, কোনো বিপদে পড়ো তুমি।
ওটুকু কাণ্ডজ্ঞান আছে আমার, তেমন কোনো সম্ভাবনা থাকলে তোমাকে আনতাম না এখানে। আর বিপদ নেই কীসে? জীবনে টিকে থাকাটাই তো বিভিন্ন ধরনের বিপদের মধ্যে থাকা। চুপ করে বসো একটু, ফ্রেস হয়ে আসি।
কাপড়-চোপড় পাল্টে টয়লেট থেকে বেরিয়ে আসে অন্য এক এলিনা, উপমহাদেশীয় পোশাক, লাল টুকটুকে সালোয়ারের উপর সোনালি কাজ করা বাদামী রঙের কামিজ, উজ্জ্বল লাল রঙের ফিনফিনে উড়নি, চোখে হালকা কাজল ছুঁইয়েছে, অপরূপ লাগছে ওকে, ও যদি বাঙালি হতো, দিব্যি, শত সহস্র দিব্যি রেখে বলি, জীবন সঁপে দিতাম ওর হাতে। কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়ি, ভয়ও লাগে, এরকম অভিজ্ঞতা আমার তো নেইই, এমনকি শুনিও নি। কোনো ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছি, না এরিমধ্যে ধরা পড়ে গেছি, বুঝতে পারি না। ঘরে ঢোকার আগে কেএফসির স্পাইসি চিকেন ও ফ্রাই কিনে এনেছিল এলিনা, টেবিলে পরিবেশন করে, কনিয়াকের সঙ্গে অন্যান্য ড্রিঙ্কস মিশিয়ে দু গ্লাস তৈরি করে টেবিলে রাখি। টস করে চুমুক দেই দু জনে, একটু অবাক হই, কোনো রকম উত্তেজনা বা চোখমুখের আদল না পাল্টে দিব্যি ঢোক গেলে এলিনা। জিজ্ঞেস করি, আগে কখনো এলকোহোল নিয়েছো? খুব নিশ্চিত ভঙ্গিতে বলে, নাহ্। আমার সংশয় আরো ঘনীভূত হয়, কখনো ওকে সত্যিই সরল মনে হয়, আবার কখনো খুব বেশি ঘোড়েল, সন্দেহপূর্ণ। যেভাবেই হোক ওর হাত থেকে নি®কৃতি পেতে হবে, মনে মনে পণ করি, কোনোভাবেই ওর হাতে ছেড়ে দেবো না নিজেকে।
তুমি কি একটু হালকা পোশাক নেবে? একদম নতুন ট্রাউজার আছে, লিনেনের, তোমার হতে পারে।
একদু ঘণ্টা পর ফিরে যাবো, কি দরকার।
মনে হয় না যাচ্ছো।
তোমার এখানে থাকবো কি করে?
আমি থেকেছি কীভাবে কাল?
না এলি, ফিরে যাবো।
দেখা যাক।
স্পাইসি চিকেনগুলো বেশ মজার, কেএফসির এই আইটেমটা বরাবরই পছন্দ আমার, ঘরে বানানো একটা আচার দিয়েছে এর সঙ্গে, বেশ ভালো লাগে, কথার ফাঁকে ফাঁকে উঠে যেয়ে কাবাব ভেজে আনে, ব্ল্যাক ওলিভ, আঙুলের সমান ছোটো আকারের শসার পিকল্স, টর্টিলা, পাপাডাম, নিমকপারা, একটার পর একটা টেবিলে আনতে থাকে, ড্রিঙ্কসের সঙ্গে সব উধাও হয়ে যায়, মনে হয় একটা দৈত্য ঢুকে পড়েছে শরীরের ভেতর। আসার পথে দু ক্যান স্ট্রং বিয়ার নিয়েছি, সব মিলিয়ে কখন যে মাতাল হয়ে পড়েছি বুঝতে পারি নি। মনে হয় পরিকল্পনা করেই মাতাল করেছে আমাকে এলিনা। ভুল ভাঙ্গে যখন টেবিলে ওর গ্লাস রাখতে যেয়ে এক ফুট উঁচুতে ওটা ছেড়ে দেয়। পানীয় গড়িয়ে টেবিলক্লথ, কার্পেট ভিজে যায়। জড়ানো গলায় বলে, টেবিলটা এতো নিচু হলো কখন? ওকে জড়িয়ে ধরে সোফায় বসাই, টেবিল নিচু হয় নি সোনা, তুমিই উপরে ভেসে উঠেছো। টেবিলক্লথ গুটিয়ে ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে দেই, মোছার কাপড় দিয়ে কার্পেট ভালো করে মুছে এয়ারফ্রেশনার ছড়িয়ে দেই। টেবিলের সবকিছু গুছিয়ে ওর পাশে এসে বসি। দেখি, ঘুমিয়ে প্রায় এলিয়ে পড়েছে। জিজ্ঞেস করি, ঘুমোও কোথায়? হাত তুলে বলে, দোতলায়। বলি, থাক যেতে হবে না ওখানে। সোফাতেই শুয়ে পড়ো। এটুকুই মনে আছে। পরদিন ঘুম ভাঙলে দেখি জড়াজড়ি করে কার্পেটে শুয়ে আছি দু জনে। ওরও ঘুম ভাঙ্গে, এই প্রথম, ছোট্টো করে একটা চুমো দেই ঠোঁটে, কয়েক হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। ছিটকে উঠি, অনেক হয়েছে, তাড়াতাড়ি কাপড়-চোপড়, চুলটুল ঠিক করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি, মনে মনে বলি, বিদায় এলিনা!
প্রকৃতপক্ষে ঘটে না। কিশোরকালের একটা ঘটনা মনে পড়ে। স্কুলের বাৎসরিক বন্ধ থাকার সময় আমাদের আরবি শেখানোর ব্যবস্থা করতেন বাবা, পাড়ার মক্তবের হুজুর ছিলেন আমার আরবি শিক্ষক। কি এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন, মেয়েরা হচ্ছে আগুন আর পুরুষ মোম, ওদের কাছাকাছি যাওয়া থেকে দূরে থাকিস বাবা। বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। আমার অবস্থা দেখে হুজুর বলেছিলেন, এখন বুঝবি না, পরে বুঝবি, বয়স হলে। হুজুরের ঐ কথাটা পুরোপুরি বুঝতে শুরু করেছি এখন। আমার ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে এলিনা, মোমের মতো গলতে শুরু করেছি।
বাসায় এসে দীর্ঘ সময় নিয়ে বাথ নেই, ঘরে রান্না করার চেষ্টা করি, বন্ধু আবীরকে ডাকবো কিনা ভাবছি, ভয় হচ্ছে এলিনা যদি আবার এসে ওঠে, শেষ পর্যন্ত একা থাকারই সিদ্ধান্ত নেই, বই পড়ায় মন বসে না। গ্যারি কূপার ও অড্রে হেপবার্নের ‘লাভ ইন দ্য আফটারনূন’ সিনেমা শুরু হয়েছে টিভিতে, ওটা দেখায় মন বসাই। ভালোই হয়েছে, কেউ আসে না, এলিনার বোধ হয় হ্যাঙওভার হয়েছে, অথবা বোধোদয়। নিউ ইয়ার্স ইভে একটা পার্টিতে নিমন্ত্রণ আছে, ওটায় যাবো, সেলুন থেকে চুল কেটে আসি, শেভ করে চেহারাটা চকচকে করে তুলি। খুব ভালো ঘুম হয় রাতে। সকালে ফ্রেশ হয়ে মনে মনে পরিকল্পনা করি নিউ ইয়ার্সের আগের এই কটা দিন পড়াশোনা করি। কিছু পেপারওয়ার্কস করে রাখি, এসাইনমেন্টগুলো এগিয়ে রাখি।
এগারোটার দিকে দরোজায় টোকা, বুক কেঁপে ওঠে, অন্য কেউ তো হতেই পারে না, ঘরে ঢুকেই বলে –
চটপট তৈরি হয়ে নাও, গ্লাসগও যাবো।
হঠাৎ মেজাজ চটে ওঠে, বাইরে প্রকাশ করি না, ভেবেছে কি, ওর ইচ্ছার দাস হয়ে পড়েছি, ভদ্রতা অনেক করেছি, কটু কথা না বলে ফেলি সেই ভয়ে চুপ করে থাকি।
বুঝতে পারছো ডাউ?
আমি যাচ্ছি না এলিনা… আমাকে বাধ্য করছো কেন?
না ডাউ, বাধ্য করছি না তোমাকে। অনুরোধ জানাচ্ছি, একটা মাসের জন্য মুক্তিতে আছি, মুক্তির আনন্দ তুমি জানো না, যা খুশি করতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার, যা খুশি, কোনো কিছুই আটকাচ্ছে না। জানি না এই অবাধ স্বাধীনতা জীবনে আর আসবে কিনা, অথবা আমিই আনবো কি না, ঠিক আছে, তুমি যেতে না চাইলে থাক।
পোষা একটা বাজপাখির মতো বশীভূত হয়ে পড়ি, আমার আদিগন্ত আকাশটা ছেড়ে ওর ছোট্ট কাঁধে এসে বসি। এভাবে ভেবে দেখি নি ওর বিষয়টা। ক্ষণিকের এই আনন্দ যাপন থেকে কোনোভাবে বঞ্চিত করতে চাই না ওকে। ওর চিবুকে হাত রাখি, ছলোছলো চোখে অসীম আকাশ, দু হাতে মুখ তুলে ধরি, ঠোঁটজোড়া স্বর্গের তোরণের মতো স্বাগত জানায়, নিজেকে নামিয়ে দেই ওখানে, অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যাই যেখানে টেনে নিয়ে যায় জীবনের সুগভীর রহস্য! ভালোবাসি ওকে পূর্ণ আবেগে, পরিপূর্ণ প্রেমে!
ক্লান্তিতে অবসন্ন দু জনেই, একটু পরে ঘরে ফিরে যায় ও। বুঝতে চেষ্টা করি কি করে ফেলেছি, শেষ পর্যন্ত পরাজিত হলাম ওর কাছে! ধীরে ধীরে ধাতস্থ হই, মেনে নেই পরাজয়, যা ঘটেছে, তা যেনো অবশ্যম্ভাবী, কোনো হাত নেই এসবের পেছনে আমার, বা কারোই, অপ্রতিরোধ্যভাবে ঘটে চলেছে এসব, যেনো নিয়তি-নির্ধারিত, হাল ছেড়ে দেয়া ছাড়া করার কিছুই নেই, কিই বা করতে পারতাম, জীবনের এসব অনুষঙ্গের সঙ্গে পরিচয় ছিল না, অপরিকল্পিতভাবে কোনো কিছু করার কথা ভাবি না, কিন্তু প্রবল ঝড়, সাইক্লোনের মতো তেড়ে আসে যখন, মানুষের ছোট্টো দু হাতে কি তা ফেরানো যায়? সমর্পণের বাইরে কিছুই করার থাকে না, নিজেকে ছেড়ে দেই প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মের কাছে।
বিকেলে ওর দরোজায় টোকা দেই, দরোজা খুলেই অবাক, এবার আমার ভেতরের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে অকস্মাৎ, ওখানেই জড়িয়ে ধরি, ওভাবেই সোফা পর্যন্ত হেঁটে যাই কোনোভাবে, তারপর উন্মাদ হয়ে যাই দু জনেই। দীর্ঘ সময় পর উঠে যাই, গুছিয়ে টেবিলে বসি, চা খাই, প্রথম কথা বলিÑ
বেরোবে কখন? আমি ব্যাগ গুছিয়ে এসেছি।
গ্লাসগও আট দশ ঘণ্টার ড্রাইভ, এমনিতেও ব্রেক জার্নি না নিয়ে যেতাম না, যেটুকু সময় আছে ম্যানচেস্টার পর্যন্ত যাওয়া যাবে, রাস্তায় প্রচুর গাড়ি থাকবে।
বছরের এ সময়ে হোটেল পাওয়া যাবে ম্যানচেস্টারে?
কোনো না কোনো তো পাওয়া যাবেই।
তাহলে ওঠো, দেরি করো না।
আধ ঘণ্টা সময় দাও, বোঝো তো মেয়েদের প্রস্তুতি।
বুঝতে শুরু করেছি।
হো হো হো!
ঠিক আধ ঘণ্টার মধ্যেই সেজেগুজে বেরিয়ে আসে। আমার স্যূটকেইস নিতে আসি, যদিও বলেছি গুছিয়ে এসেছি, আসলে তো না, দশ মিনিটের মধ্যে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি প্রায় ছ’টা। শীতের রাত দু ঘণ্টা পেরিয়েছে প্রায়, যদিও একটু একটু করে বড় হতে শুরু করেছে দিন, তুষারপাত থেমে গেছে, প্রকৃতি কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল, ঝড়ো বাতাস ও সামান্য বৃষ্টি, এমন দুর্যোগের দিনে বাংলাদেশের মানুষেরা কল্পনাও করতে পারে না রাস্তায় বেরোবে। ধীরে-সুস্থে গাড়ি চালিয়ে রাত দশটার দিকে ম্যানচেস্টার পৌঁছি। হোটেল পেতে বেগ পেতে হয় নি, গাড়ি পার্ক করে মালামাল রুমে রেখে রাতের খাবার খেতে বেরোই। ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের জন্য ম্যানচেস্টারের বিখ্যাত কারি-মাইলের একটা হোটেলে খেয়ে নেই। রুমে ফিরে পুরোপুরি পাগল হয়ে যাই, জীবনের এতো মধু কোথায় ছিল কে জানে, দু জনে উজাড় করে দেই দু জনকে, শেষরাতের দিকে ওকে বলি, তোমাকে তো ড্রাইভ করতে হবে কাল, হ্যাঁ, বলেই ঘুমিয়ে পড়ে। আমার ছোট্টো টেবিল ঘড়িটা সঙ্গে এনেছিলাম, এগারোটায় এলার্ম সেট করে ঘুমিয়ে পড়ি, গভীর ঘুম। ঘড়িটা যখন ঘণ্টি পেটাতে থাকে মনে হয় অনেক দূরের কোনো এক দেশে স্কুল ছুটি হয়েছে! অবশেষে চোখ মেলে তাকাই, দেখি সেজেগুজে একদম রেডি হয়ে আছে এলিনা! অবাক হই, তাড়াতাড়ি উঠে একটা কুইক শাওয়ার নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়ি, নিচে নেমে ডাইনিং হল থেকে হোটেলের ফ্রি ব্রেকফাস্ট নিয়েনি, চেক-আউট করে বারোটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ি।
বিকেল তিনটের দিকে নিউক্যাসেলে পৌঁছে বলে –
আজ রাত এখানে কাটাই, কাল খুব সকালে এডিনব্রা যাবো, এডিনব্রা ক্যাসেল ঘুরে সন্ধ্যায় গ্লাসগও যাত্রা করবো।
হ্যাঁ, কাল সন্ধ্যায় বলবে, আজ রাত এডিনব্রাতেই কাটাই, কাল খুব সকালে গ্লাসগও যাবো।
কোনো কিছুই তো নির্ধারিত নেই ডাউ, ক্ষতি কি?
না, কোনো ক্ষতি নেই।
টাইন নদীর তীরে চমৎকার একটা হোটেল পেয়ে যাই। আমার মানিব্যাগে হাত দিতে দেয় না। বলে, প্রচুর অর্থ আছে আমার বাবার, আর এসবের উত্তরাধিকার আমরা দু বোন, টাকাপয়সার বিষয়টা ভাবতে হবে না তোমাকে। দু হাতে খরচ করে চলেছে এলিনা। স্কলারশীপের হাতেগোনা টাকায় যাপিত জীবনে এসব অনেক বেশি মনে হয় আমার কাছে।
হোটেল থেকে দ্রুত বেরিয়ে পড়ি, আলো থাকতে থাকতে রোমানদের গড়া হা’ড্রিয়ান ওয়ালটা দেখে নেই। তুষার নেই, কিন্তু হাড়-কাঁপানো শীত, উত্তরের এই শীতে অনভিজ্ঞ মানুষেরা, এমনকি স্থানীয় অনেকেও, স্পেইন, বেলজিয়াম, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশের উপকূলীয় উষ্ণতায় পাড়ি জমায়, আর আমরা এসেছি এখানে বেড়াতে, খেপা মানুষের সবই সয়!
সিটি সেন্টারে একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্ট দেখে জিজ্ঞেস করি, রাতের খাবার সেরে নেবে নাকি এখানে? রাজি হওয়ায় ঢুকে পড়ি, এখানের চায়নিজের স্বাদ বাংলাদেশের ধারে-কাছেও না। তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে শুয়ে পড়ি, যথারীতি সারারাত জেগে। ভোরে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে গ্লাসগওর পথে নামি, পুরোটা পথ পাহাড়ি চড়াই-উৎড়াই, রাস্তার দু ধারে বরফ জমে সাদা হয়ে আছে, খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়, এলিনা বেশ ভালো গাড়ি চালায়, ইউরোপের ছেলেমেয়েদের দুটো পায়ের মতোই চারটে চাকা, অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ। হোটেল খোঁজার আগে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই, ও দেখি আমার মতোই, খাবারের স্বাদ ও রুচির প্রতিই প্রাধান্য দেয়, অনুমোদিত অথবা নিষিদ্ধের ধার ধারে না, যে-কোনো রেস্টুরেন্টে খাবার পছন্দ করতে সমস্যা হয় না।
রাতের গ্লাসগও সত্যিই সুন্দর, এবং শীতের গ্লাসগওর এক অন্যরকম বিশেষত্ব রয়েছে। পরদিন আর গাড়ি নিয়ে বেড়োই না, একটা সিটি ট্যূর কিনে নেই, শহরটা ঘুরে দেখি, মাঝখানে খাবারের বিরতিতে দু ঘণ্টায় টুকটাক শপিং করে নেয় ও। ফিরে এসে ক্লান্তি বোধ করি, অথচ ওকে দেখে মনেই হয় না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ড্রাইভ করছে! অফুরন্ত প্রাণশক্তি। রাতে যখন বলে নিউ ইয়ার্স ইভ লন্ডনে কাটাবে, আমার মাথায় বাজ। বলি, আগামীবছর। ও বলে, হ্যাঁ, আগামীবছরই তো। শুধরে বলি, না, তার পরের বছর। গোঁ ধরে, অক্সফোর্ডে ফিরে সারাদিন রেস্ট নেবো। সন্ধ্যায় বাসে যাবো, টেমস নদীর তীরে নিউ ইয়ার সেলিব্রেইট করে রাতেই ফিরে আসবো, তারপর আবার দীর্ঘ ঘুম! হেসে বলি, তোমার ঘুম মানে তো ঘুম নয়। বলে, ঠিক আছে, শোবো!
লন্ডনে নববর্ষ উদযাপনটা সত্যি স্মরণীয় হয়ে রয়েছে, অসাধারণ ঐ রাতের অভিজ্ঞতা, এমন অফুরান আনন্দ জীবনে কমই এসেছে এর পর! ওখান থেকে ফেরার পথে কিছুটা আত্ম-উপলব্ধি আসতে শুরু করে। কি করছি এসব? এলিনার দিকে দৃষ্টি রেখে ভাবছি যখন, চোখ ঠেরে জিজ্ঞেস করে –
কি?
হঠাৎ করে ভেবে পাই না কি বলবো, বলি –
অনেক বেশি সুন্দর তুমি এলিনা, কল্পনার মতো।
তোমার দৃষ্টির স্বচ্ছতা হবে হয়তো।
আমি পরাস্ত, এলিনা।
না, তুমি জয়ী।
জানি না, এলিনা, সত্যিই জানি না।
জানো, তুমি জানো, ডাউ।
এসব যেনো স্বপ্ন হয়, এলিনা।
এসব সত্যি, ডাউ।
জীবন এক রহস্য।
এসব রহস্যের জন্যই বেঁচে থাকা, না হয় জীবন অর্থহীন।
দু জনেই এতো ক্লান্ত ও অবসন্ন যে ঘরে ঢুকেই ঘুমিয়ে পড়ি, গভীর ঘুমের পর জেগে উঠি প্রায় একসঙ্গে, অথবা আমাকে জাগিয়ে তোলে ও, ঘুম থেকে উঠেই আবার! কিন্তু এই উদ্দামতার অবসান হতে হবে তো! জানুয়ারির দু তারিখে ওর বাসা ছেড়ে চলে আসি, পড়াশোনায় মন দিতে হবে, আমার কৃষক পিতা নিজের জীবন অর্পণ করে বিলেতে পাঠিয়েছে আমাকে। বিকেলে আসার পর ওকে বুঝিয়ে বলি, বিষয়টা বুঝতে পেরেছে এজন্য মনে মনে খুশি হই। রাতে শুয়ে শুয়ে গেল হপ্তাটা কল্পনা করি, এরকম একটা ঘোরলাগা সময় জীবনে কখনো আসে নি, আসবেও না আর, নিশ্চিত জানি, এতো আনন্দ, এতো উচ্ছল আবেগ, এতো অবাধ স্বাধীনতা, উচ্ছ্বাস, উদ্দাম, সবকিছুই কল্পনাতীত!
ওর পরিবার না আসা পর্যন্ত প্রায় এক মাস প্রতিরাতই ওর ওখানে কাটিয়েছি, দিনগুলো আমাকে নিস্কৃতি দিয়েছে পড়াশোনার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে, ওরও যেতে হয় ক্লাশে, বিষয়টা নিয়মিত হয়ে যায়। আচ্ছন্ন এক জীবন কাটাতে থাকি কিছুদিন!