কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
বারো.
খালেক বেপারির জবানবন্দি মোতাবেক পুলিশ ঘটনা সম্পর্কে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে এসে ভক্তদাসকে গ্রেপ্তার করলেও তদন্ত কিন্তু থামিয়ে দিল না। দস্যু-ডাকাতের কথা কি আর পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায়। রিমান্ডে পেঁদানির ভয়ে চোর-ডাকাতরা মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে গল্প ফাঁদার নজির তো ভুরি ভুরি। পেঁদানির ভয়ে কেশব মাস্টারকে নিয়ে খালেক বেপারি গল্প ফাঁদেনি তার কী নিশ্চয়তা?
তা ছাড়া এত বড় কাণ্ড ঘটে গেল হরিনগরে। খসরু চেয়ারম্যান হস্তক্ষেপ না করলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারত। হিন্দুরা এখনো বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না ভয়ে। শুধু গরানপুর-হরিনগর কেন, তামাম মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মুসলমানরা কেউটের মতো ফণা ধরে ফুঁসছে। অনেক গ্রামের হিন্দুরা বাড়িছাড়া। কখন কোথায় দাঙ্গা বেঁধে যায় তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই।
তার ওপর ঘটনার অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজির দপ্তর থেকে কড়া নির্দেশ এসেছে হুকুমের আসামিকে অবিলম্বে খুঁজে বের করতে হবে। ঘটনার সঙ্গে ভক্তদাসের সংশ্লিষ্টতা আদৌ আছে কিনা ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে। কোনোভাবেই যেন নির্দেষ ব্যক্তি হয়রানির শিকার না হয়।
ডিআইজির সঙ্গে চারুবালার বোনাই অতুলচন্দ্রের খাতির ভালো। মাস্টারের নিখোঁজ সংবাদ শুনে সে তো আর ডিআইজির সঙ্গে দেখা না করে চুপচাপ বসে থাকেনি। প্রতিদিনই ডিআইজির দপ্তর থেকে এসপির দপ্তরে টেলিফোন আসছে। খোদ ডিআইজি তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাচ্ছেন। তার ঠেলা সামলাতে থানার ওসি তো ওসি, জেলার এসপির পর্যন্ত ঘুম হারাম। এসপির ঠেলা খেয়ে ওসির মাথা গরম, ওসির ঠেলা খেয়ে ইনক্যুয়ারি অফিসার নাজমুল দারোগার মাথা গরম। দুজনের দৌড়ঝাঁপে পুরো থানা অস্থির। নাজমুল দারোগা ফাইলপত্র নিয়ে নীলডুমুর রাইফেলস্ ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে ছুটলেন। সীমান্তে তো হরহামেশাই বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি আটকের ঘটনা ঘটে। বিএসএফের কোনো কোনো সেপাই এমন খতরনাক, মাঝেমধ্যে সীমানা ডিঙিয়েও বাংলাদেশিদের ধরে নিয়ে যায়। তখন সীমান্তজুড়ে রেডঅ্যালার্ট জারি হয়। শুরু হয় বিডিআর-বিএসএফের চিঠি চালাচালি, পতাকা বৈঠক। কেউ ছাড়া পায়, কেউ বছরের পর বছর জেলের ঘানি টানে। কেশব মাস্টার তো প্রায়ই চোরাইপথে সন্দেশখালী তার বড়দির বাড়ি বেড়াতে যান। বিএসএফ তাকে আটক করল কি না তাও খতিয়ে দেখতে চান নাজমুল দারোগা।
নাজমুল দারোগার আর্জি মোতাবেক বারাসতের হিঙ্গলগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে চিঠি পাঠানোর জন্য মুন্সিগঞ্জ বিডিআর ক্যাম্পের সুবেদারকে নির্দেশ দিলেন নিলডুমুর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক। সুবেদার চিঠি পাঠালেন, কালিন্দীর চরে গিয়ে পতাকা বৈঠকও করলেন, অথচ কেশব মাস্টারের কোনো সন্ধান দিতে পারল না বিএসএফ। গত ছ’মাসের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি তাদের হাতে আটক হয়নি, জানাল তারা।
নাজমুল দারোগার তদন্ত থামে না। তিনি যথেষ্ঠ তৎপর। আন্তরিকও। এই রহস্যপূর্ণ ঘটনার একটা কিনারা করতে পারলে তার প্রমোশন নিশ্চিত। প্রমোশন না হোক, বদলিটা অন্তত ত্বরান্বিত হবে। বাড়ি তার কুমিল্লায়। ছুটিছাটায় যাতায়াতে দারুণ ঝক্কি-ঝামেলা। কুমিল্লা না হোক, অন্তত নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বা চাঁদপুরের কোথাও বদলির জন্য কতবার এসপির ধন্না ধরেছেন, এসপি অথচ কানেই তুললেন না।
খালেক বেপারির জবানবন্দির হাতে লেখা কাগজটায় বারবার চোখ বুলান নাজমুল দারোগা : কেশব মাস্টারকে খুন না করে মুক্তি দিতে বলেছে মোছলেম ডাকু, গোলাপ গাজী সেদিন ভোরে মাস্টারকে নিয়ে গরানপুরের উদ্দেশে যাত্রাও করে, পরদিন মোছলেম ডাকু নিজ হাতে গোলাপ গাজীকে খুন করে―পুরো ঘটনাটার মধ্যে একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন তিনি। কাগজটায় চোখ বুলাতে বুলাতে রহস্য খানিকটা উদ্ঘাটনও করতে পারেন : হতে পারে মাস্টারকে খুনের ঠিকা নিয়েছিল গোলাপ গাজী, কিন্তু টাকার লোভ সামলাতে না পেরে সর্দারের হুকুম অমান্য করে সে মাস্টারকে খুন করেছে। নইলে তার ওপর খেপবে কেন মোছলেম ডাকু? কেন এই বিশ্বস্ত সঙ্গীকে খুন করবে?
অথবা এও হতে পারে, সেদিন ভোরে পুষ্পকাটির জঙ্গল থেকে গরানপুর নেয়ার পথে মাস্টারকে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছে গোলাপ গাজী। দস্যুরা মৌয়াল-বাওয়ালিদের ধরে নিয়ে মুক্তিপণ না পেয়ে মাঝেমধ্যে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেয়। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। খাল-জঙ্গল ডিঙিয়ে কেউ বাড়ি ফিরতে পারে, কেউ বাঘ সাপ কামোট কুমিরের শিকারে পরিণত হয়। গেল বছর সিংহড়তলির এক বাওয়ালিকে অপহরণ করে দশ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে দস্যুরা। মুক্তিপণ দেয়া হলো, তবু লোকটাকে ঠিকঠাক মতো বাড়ি পৌঁছে না দিয়ে মাথাভাঙা খালের উজানে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দিল। নাওয়া-খাওয়া ছাড়া দুদিন জঙ্গলে পড়ে থাকল বেচারা। বাওয়ালিরা উদ্ধার না করলে কোনোদিন হয়ত সে বাড়ি ফিরতে পারত না। মাস্টারও এত দিনে হয় জন্তু-জানোয়ারের শিকার হয়েছেন, নয় বাড়ি ফেরার আশায় জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
একটা ঘোরের মধ্যে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে হাজতখানার সামনে এসে দাঁড়ালেন নাজমুল দারোগা। খালেক বেপারি দু-হাঁটু জোড় করে তার ওপর মাথা রেখে হাজতের দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছে।
: খালেক মিয়া!
: জে স্যার। খালেক বেপারি ভাঙা গলায় সাঁয় দেয়।
: শোনো।
: জে স্যার। গারদের শিক ধরে দাঁড়ায় বেপারি।
দারোগা বললেন, ‘আমি মোছলেম ডাকুর সাথে দেখা করতে চাই।
ঝিমুনির রেশটা কেটে যায় বেপারির। বিস্ময়ের সুরে বলে, ‘এডা কেরাম কুরে সম্ভব ছার! তালুকদার কি পুলিশির সাতে দ্যাখা দ্যাবে?’
: আমি যে পুলিশ সে কথা সে জানবে কেমন করে?
কথার আগামাথা কিছু বুঝতে না পেরে হাঁদারামের মতো দারোগার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বেপারি। তারপর মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘না ছার, এডা হয় না।’
: কেন হয় না?
: তালুকদার যদি আম্নার পরিচয় জানতি চায়?
: আমি পরিচয় দেব না, ব্যস।
: দিতিই হবে ছার, নালি সে আম্নারে মাইরে ফ্যালাবে। তালুকদার মানুষ না, জানোয়ার ছার জানোয়ার।
খিক্ করে হেসে দিলেন দারোগা। প্যান্টের পকেট থেকে সেনরগোল্ড সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট মুখে নিলেন। পকেটে হাত দিয়ে দেশলাই খুঁজলেন, কিন্তু পেলেন না। সিগারেটটা ডান হাতের আঙুলের চিপায় ধরে ধীর পায়ে তার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। হাতের ইশারায় বারান্দায় ডিউটিরত কনস্টেবলকে ডাকলেন।
: স্যার।
: হাজতখানা থেকে মুত্তালিবরে বাইর কইরা আনেন তো।
খালেক বেপারির সঙ্গে আটক দুজনের একজন মোতালেব। বাড়ি দাঁতিনাখালী। পেশায় মৌয়াল। মানে ডাকাত হওয়ার আগে মৌয়াল ছিল। মোছলেমের গ্যাংয়ে ভিড়েছে বেশি দিন হয়নি, বড়জোর বছরখানেক। পুরনো ফাইলপত্র ঘেঁটে পুলিশ তার নামে কোনো মামলা খুঁজে পায়নি।
হাত দুটো জোড় করে নাজমুল দারোগার টেবিলের সামনে দাঁড়ায় মোতালেব। দারোগা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে আয়েশে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘মুত্তালিব মিয়া!’
: জে ছার? আমার নাম ছার মোতালেব।
: ও আচ্ছা। তা মোতালেব, তুমি তো মানুষ ভালো। মোছলেম ডাকুর সাথে ভিড়লা ক্যান?
: জে ছার? প্যাটের জ্বালায় ছার। কদ্দিন উপোস থাকা যায়?
আত্মপক্ষ সমর্থনের উপযুক্ত একটা যুক্তি খুঁজে পেয়েই বুঝি মোতালেব হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। নাকের বাঁ-ফুটো দিয়ে খানিক সিকনি বেরিয়ে গোঁফের ওপর পড়ল। নাক কুঁচকে কষে ধমক লাগালেন দারোগা, ‘চুপ কর! আবালের লাহান কান্দো ক্যান? নাক মোছ মিয়া।’
মোতালেব নাক মোছে। কব্জির পিঠে চোখ দুটোও মুছে নেয়। কিন্তু কান্না থামাতে পারে না। মরার চোখে এত জল, যত মোছে তত ঝরে। কাঠের চেয়ারটায় হেলান দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে দারোগা কু-লী পাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, ‘শোনো মোতালেব।’
: জে ছার।
: একটা শর্তে আমি তোমার জামিনের ব্যবস্থা করতে পারি।
মোতালেবের তো চোখ উল্টে মূর্ছা খেয়ে পড়ে যাবার জোগাড়। কান্না কি আর ঠেকিয়ে রাখতে পারে সে? পারলে তো এবার মেয়েলোকের মতো বিলাপ শুরু করে দেয়। চট করে দারোগার পা-দুটো জড়িয়ে ধরল, ‘আম্নি আমার বাপ স্যার, আম্নার সব শর্ত আমি মানতি রাজি। আমার চাট্টে ছাইলেপিলে। আমি জেলে থাকলি তারা না খাইয়ে মুরে যাবে ছার।’
ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দারোগা মুণ্ডু দোলান, ‘সাংসারিক জ্ঞান তো ভালোই আছে দেখতাছি, ডাকাতি করতে গেলা ক্যান?’
মোতালেব মুখ নামিয়ে চুপ করে থাকে।
: শোনো মিয়া।
: জে ছার।
: পরশুদিন তোমাদের মামলাটা কোর্টে উঠবে, উকিলের সাথে আমি কথা বইলা রাখবো, আশা করি তোমার জামিনটা হয়ে যাবে। জামিন পেয়ে তুমি কিন্তু বাড়ি যেতে পারবা না। মোছলেম ডাকু কোথায় আছে খোঁজ নিয়া সোজা তার কাছে চলে যাবা। তাকে বলবা আমি দেখা করতে করতে চাই তার সাথে। খবরদার, আবার তার দলে ভিড়বা না কিন্তু। যদি ভিড়, ধরা তো একদিন খাবাই। তখন এই পিস্তল দিয়া কিন্তু গুলি কইরা মারব।
মোতালেব হাত জোড় করে বলল, ‘খোদার কসম ছার, জীবনে আর ডাকাতি কইরব না।’
: সে যদি রাজি হয় তবে শিগগির আমি তার সাথে দেখা করতে চাই। তুমি ছাড়া আমার সাথে আর কেউ থাকবে না। পুলিশ তার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না। আমি শুধু তার মুখ থেকে শুনতে চাই মাস্টারকে আসলেই গোলাপ গাজী অপহরণ করেছিল কি না।
কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেলল মোতালেব। যুগপৎ আনন্দ ও বিস্ময়ে সে অস্থির হয়ে উঠল। মানুষ শুধু নাজমুল দারোগার বদনাম করে। বদমেজাজি, ঘুষখোর, মেয়েলোক দেখলে আজেবাজে কথা বলে – আরো কত বদনাম তার। অথচ তার মতো মানুষই হয় না।
: কিন্তু ছার আমার তো মনে হচ্ছে না তালুকদার আম্নার সাতে দ্যাখা কত্তি রাজি হবে।
: তুমি চেষ্টা করে তো দেখতে পার, নাকি?
: জে ছার, তা পারি।
কথা রাখল বটে মোতালেব, জামিন পেয়ে বাড়ি না গিয়ে সোজা থানায় হাজির হলো। এক মাঝিসহ একটা শ্যালো নৌকা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন নাজমুল দারোগা। সেদিনই পুষ্পকাটির জঙ্গলের উদ্দেশে রওনা করল মোতালেব।
মোতালেব তার কাজ করুক, এই ফাঁকে কেশব মাস্টারকে জঙ্গলে খুঁজে দেখতে চান নাজমুল দারোগা। চকিদার পাঠিয়ে পচাব্দী গাজীকে তিনি থানায় ডেকে আনলেন। মাস্টারের সন্ধানে তিনি পচাব্দী গাজীকেই জঙ্গলে পাঠাতে চান। তল্লাটে পচাব্দী গাজীর মতো এমন শিকারপটু মানুষ আর কোথায়? তার দাদা শিকারি, বাপ শিকারি, চাচারাও একেকটা ঝানু শিকারি। মাত্র আঠারো বছর বয়সে বাপ-চাচার সঙ্গে গোলাখালির জঙ্গলে বাঘের মুখোমুখি হয় পচাব্দী। সেই কতদিন আগের কথা, ইংরেজি ঊনিশ শ ছাপ্পান্ন কি সাতান্ন সাল হবে বুঝি, আদমখোর একটা বাঘ তখন গোলাখালির জঙ্গল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তার দাপটে মৌয়াল-বাওয়ালিরা বেজায় অতীষ্ঠ, কেউ বাদায় ঢুকতে সাহস পায় না। বনবিবির থানে পুজো দিয়ে দক্ষিণরায়ের নাম জপতে জপতে সাহস করে কেউ ঢুকলেও জ্যন্ত আর ফিরতে পারে না। বাঘটার কাছে যেন বনের দেবতারাও কাবু! কী করে মৌয়াল-বাওয়ালিরা? বাঘটাকে খতম না করলে তো থালা হাতে পথে পথে ঘোরা ছাড়া গতি থাকবে না। কিন্তু কে মুখোমুখি হবে এই ভয়ংকর নরখাদকের!
পচাব্দী গাজীর বাপ মেহের গাজী নামকরা শিকারি। সুন্দরবনের অন্তত পঞ্চাশটা বাঘ তার গাদা বন্দুকের গুলিতে খতম হয়েছে। সে বলল, ‘আমি। আমি বাঘটারে শিকার কত্তি চাই।’
বড় ভাইয়ের সাহস দেখে ছোট ভাই নিজামদি গাজীর রক্ত শিকারের নেশায় টগবগিয়ে উঠল। বড় ভাই শিকারে যাবে, গাজীর বংশধর হয়ে সে কি মেয়েলোকের মতো বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকতে পারে? পচাব্দীর নাকের নিচে সবে লাল গোঁফ গজিয়েছে। সে বলল, ‘আমিও যাব।’ বাপ তার আপত্তি করল না, শিকারের প্রতি ছেলের উৎসাহ দেখে বরং খুশিই হলো।
শিকার যাত্রার প্রথম দিন কোথাও তারা বাঘটার দেখা পেল না। পরদিন ভোরে, সূর্য ওঠার আগে দুই ভাই সন্তর্পণে গোলাখালির জঙ্গলে ঢুকল। দুজনের হাতে দুটি গাদা বন্দুক। পচাব্দীকে জঙ্গলে উঠতে দেয়নি। বনপ্রহরীর মতো ছাঁচাচোলা একটা বাঁশের লাঠি নিয়ে সে নৌকায় বসে বাপ-চাচার অপেক্ষায় থাকল।
পুবের সূর্য উজাতে উজাতে মাথার ওপর উঠল, ভাটা পড়ে খালের দুই তীরে বিশাল চর জাগল। সূর্যের দাপটে খালের জল ফুটতে লাগল। হাত দিলে যেন চামড়া খসে পড়বে। গরমের চোটে পচাব্দীর চাতি ফাটার জোগাড়। চারদিক সুনসান। যত দূর চোখ যায় শুধু বন আর বন, কোথাও জনমানুষের দেখা নেই। ভয়ে পচাব্দীর গায়ে কাঁটা দেয়। ভয় তাড়াতে সে গলা ছেড়ে গান ধরে –
তোর নামেতে বন্দ করি বনের যত বাঘ
জলে বন্দ কামেটা কুমোর গাছে বন্দ বাঘ।
আচমকা পুবের বাদায় বাঘের গর্জন শুনে গান থেমে গেল তার। ভয়ে কেঁপে উঠল সে। আরেকটু হলে ধপাস করে খালে গিয়ে পড়ত। ঝটপট লাঠিটা হাতে নিয়ে গলুইতে গিয়ে দাঁড়াল। বাঘের তাড়া খেয়ে মেহের গাজী ও নিজামদি গাজী ভাটাপড়া খালের চর ধরে রুদ্ধশ্বাসে দক্ষিণে ছুটছে। গোলপাতার ঝাড় থেকে একটা ডোরাকাটা বাঘ বেরিয়ে তাদের পিছে ছুটছে। পচাব্দীর পিলে চমকে যায়। হাঁ মুখ হাঁ হয়ে থাকে। চোখের পলকে বাঘটা থাবা বসাল নিজামদির পিঠে। থাবাটা পিঠে না লেগে লাগল তার ডান হাতে। বন্দুকটা ছিটকে পড়ল চরের চোকায়। ঝাটকা মেরে হাতটা ছাড়িয়ে ফের দৌড় লাগাল নিজামদি। বুভুক্ষু বাঘ কী বুঝে তাকে ছেড়ে মেহের গাজীর পিছু ছুটল। শূলোর সঙ্গে উষ্ঠা খেয়ে মেহের গাজী থিকথিকে চোকায় উপুড় হয়ে পড়ে গেল। সেই সুযোগে বাঘটা হিংস্র থাবা বসিয়ে দিল তার ঘাড়ে। নখের আচড়ে মাথার বাঁ তালু থেকে কপাল, কান আর চোয়ালের মাংসপেশি আলগা হয়ে কাঁধের ওপর ঝুলতে লাগল। মাড়ির দাঁতগুলো বেরিয়ে গেল। মেহের গাজীকে আর মানুষের মতো লাগে না, যেন বাদার রক্তপিপাসু কোনো রাক্ষস।
তার এই বীভৎস চেহারা দেখে বাঘটাও বুঝি ভয় পায়, দূরে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ায় আর হালুম হালুম ডাকে। গলুইর ওপর দাঁড়িয়ে পচাব্দী বাপ বাপ বলে টানা চিৎকার করে, আর আহত নিজামদি চরের বালিতে শুয়ে কাতরায়। ডান হাতটা থেঁতলে গেছে তার। কাতরাতে কাতরাতে তার চোখ যায় ভাইয়ের দিকে। আহা ভাই, অন্ধের মতো ভাই তার বন্দুকটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। দক্ষিণরায়ের নাম স্মরণ করে নিজামদি। ভক্তের ডাকে বুঝি সাড়া দিলেন বাঘের দেবতা। নইলে রুস্তম পালোয়ানের মতো নিজামদির গায়ে হঠাৎ এত শক্তি এলো কোথা থেকে। হামাগুড়ি দিতে দিতে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। থেঁতলে যাওয়া হাতটার কথা তখন আর খেয়ালে থাকে না, এক দৌড়ে কাদামাখা বন্দুকটা হাতে তুলে নিল। বাঘটা তখনো ভুড়ি নাচিয়ে গর্জন করছে। পেছন থেকে তার ভুঁড়িটা নিশানা করে ট্রিগার চাপল নিজামদি। বাঘের দেবতা দক্ষিণরায়, পালাপোষা জীবটার ওপর বুঝি তার দয়া হলো, নইলে গুলিটা লক্ষ্যচ্যুত হবে কেন?
গুলির শব্দে খালের জলে একটা কুমির কি ঘড়িয়াল লাফিয়ে উঠল, জঙ্গলজুড়ে হুলুস্থুল কাণ্ড শুরু হলো। একঝাঁক শঙ্খচিল উড়াল দিল আকাশে। ভয় পেল বুঝি বাঘটা, নাকি দক্ষিণরায়ের হুকুমে কে জানে, নরমাংসের লোভ সামাল দিয়ে লেজ নাড়াতে নাড়াতে দ্রুত গোলপাতার ঝাড়ে ঢুকে পড়ল। নইলে সে-যাত্রায় মেহের তো বটেই, নিজামদি গাজীরও রেহাই ছিল না। আহত বাপ-চাচাকে নৌকায় তুলে জোর হাতে বৈঠা চালাল পচাব্দী।
মেহের গাজীর হাল দেখে কি আর গাজী বাড়ির গাজী-পালোয়ানরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? বাঘের রক্তে গোসল করার শপথ করে মেহেরের চাচা ইসমাইল, চাচাতো ভাই আতাব্দী ও মাদার গাজী এবার জঙ্গলে রওনা হলো। আহা ইসমাইল, বাঘটার হাতেই বুঝি মৃত্যু লেখা ছিল তার, বাঘের রক্তে নাইতে গিয়ে বেঘোরে মারা পড়ল তার ভয়ংকর থাবায়।
ইসমাইলের থেঁতলানো মাথাটা বুকে চেপে ধরে মেহের গাজী আহত যোদ্ধার মতো মোচড় দিয়ে উঠে এই প্রথম পচাব্দীর হাতে গাদা বন্দুকটা তুলে দিল, ‘যা বাপ, তুই গাজী বাড়ির ছাবাল। হার্মাদটারে খতম না কুরে তুই বাড়ি ফিরবি না।’
বাপের কথা রাখল বটে পচাব্দী। গোলাখালির জঙ্গল দাপিয়ে বেড়ানো দুর্ধর্ষ বাঘটাকে মেরে তার চামড়া বনদপ্তরে জমা দিয়ে নগদ তিন শ টাকা পুরস্কার জিতে বাপের হাতে তুলে দিল। আনন্দে বাপ তার চোখের পানি মোছে। পচাব্দীর নামে জয়জয়কার পড়ে গেল চারদিকে। তার নামটা আর মানুষের মুখ থেকে পড়ে না। একটা পর একটা বাঘ মারতে থাকলে পড়েই-বা কেমন করে? উত্তরের বাদা থেকে দক্ষিণের বাদা, পুবের বাদা থেকে পশ্চিমের বাদায় সে শিকারের নেশায় ছুটে বেড়ায়। যখনই খবর পায় জঙ্গলে মৌয়াল-বাওয়ালিদের ওপর বাঘ হামলা করেছে, অমনি গাদা বন্দুকটা নিয়ে ছুট লাগায়। তার বাপ মেরেছিল পঞ্চাশটা বাঘ, সে বাপকেও ছাড়িয়ে গেল – সাতান্নটা বাঘ মেরে সে চারদিকে হৈচৈ ফেলে দিল। আর দেশ-বিদেশের কত শিকারির শিকারসঙ্গী হয়েছে তার তো শুমার নেই। নেপালের রাজা এলেন সুন্দরবনে বাঘ শিকার করতে। কে হবে তার শিকারসঙ্গী? এই তল্লাটে পচাব্দী গাজী ছাড়া বাঘের সঙ্গে লড়তে পারে এমন কে আছে আর?
একবার প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও গভর্নর মোনায়েম খান শিকারে এলেন। ডাক পড়ল তার। পূর্ব পাকিস্তানের নালায়েক বাঙালির বীরত্ব দেখে তো আইয়ুব খান তাজ্জব, ‘তুম তো ইনসান নেহি পচাব্দী, তুম রয়্যাল বেঙ্গল কি তরাহ আওর এক রয়্যাল বেঙ্গল। হ্যাঁ হ্যাঁ, আলবৎ রয়্যাল বেঙ্গল।’
ব্যস, কপাল খুলে গেল পচাব্দী গাজীর। আইয়ুব খান তাকে বন বিভাগের বোটম্যানের চাকরি দিলেন। শুধু কি চাকরি? ‘সনদ-ই-খিদমত’ সনদসহ গাবুরায় দশ বিঘা জমিও দিলেন পুরস্কার হিসেবে।
জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে সারা জীবন বাঘের শিকার কত মৌয়াল-বাওয়ালির লাশ উদ্ধার করল পচাব্দী গাজী, নিখোঁজ কেশব মাস্টারকে খুঁজে বের করতে এই জঙ্গলের দেশে সে ছাড়া আর লোক কোথায়? জঙ্গলের আতিপাতি তার মতো কে আর অত ভালো চেনে?
দারোগার কথা ফেলল না পচাব্দী, পরদিনই সে বনযাত্রা করল। সঙ্গী হলেন নাজমুল দারোগা এবং সাদা পোশাকের তিন কনস্টেবল। গরানপুর ঘাট থেকে মহব্বত সাজুনি ও মোহনকে নিয়ে যোগ দিল জাবেদ খানও। দারোগা আপত্তি করলেন না। বিপদের তো হাত-পা নেই। জঙ্গলে পায়ে পায়ে বিপদ, কখন কার ঘাড়ে সওয়ার হয় বলা তো যায় না। লোক বেশি থাকলে বরং সুবিধা।
কেশব মাস্টারকে খুঁজতে খুঁজতে খোলপেটুয়া নদী হয়ে তারা সে-রাতে দোবেকি গরানকূপের ডোরায় বোট নোঙর করল। ডোরায় তখন বাওয়ালিদের চার-পাঁচটা নৌকাও নোঙর করা। এদিকটায় যারা কাঠ কাটতে, গোলপাতা বা মধু সংগ্রহে আসে, সবাই এ ডোরায় নোঙর ফেলে। বন বিভাগের বোটও টহল দেয় মাঝেমধ্যে। আশপাশের জঙ্গলে বাঘের উৎপাত থাকলেও ডোরাটা মোটামুটি নিরাপদ। হরহামেশা মানুষের আনাগোনা থাকে বলে বাঘ হামলা করার সাহস পায় না।
গরানকূপের ডোরায় মোতালেবকে অপেক্ষা করতে বলে দিয়েছিলেন নাজমুল দারোগা। মোছলেম ডাকুর সঙ্গে দেখা সে করেছিল কিনা কে জানে, পরদিন ভোরে দুই মাঝিসহ হাজির।
: বড়বাবুর দ্যাখা তো পালাম না ছার।
: বড়বাবু?
: মানে ছার মোছলেম তালুকদার। কত চেষ্টা কল্লাম। নি। কোন জাগায় যে গ্যালো!
মোতালেবের চোখে চোখ রাখলেন দারোগা, ‘সত্যি বলছো তো?’
: খোদার কসম ছার, আমি বিরাট চেষ্টা করিচি, তারে সারা জাগায় দেকিচি, বিশ্বাস করেন ছার।
কে জানে, মোছলেমের দেখা হয়ত পেয়েছে মোতালেব, দারোগার সঙ্গে সে মিথ্যা বলছে। হয়ত নতুন কোনো ফন্দি আঁটছে। আঁটতেই পারে। একবার যাকে ডাকাতির নেশায় পেয়ে বসে কোনোদিন কি আর ছাড়তে পারে? নগদ টাকা, ভরি ভরি সোনা-গয়না। ঝুঁকি তো মাত্র দু-এক ঘণ্টার, তারপর সারা মাস অথবা সারা বছর শুয়ে বসে আরাম করা। মিথ্যা তো বলবেই, ফন্দি তো আঁটবেই।
অথবা দেখা হয়ত সত্যি সত্যি সে পায়নি। পাওয়ার কথাও তো নয়। দস্যু-ডাকাতরা কি আর বেশি দিন এক জায়গায় থাকে? তাদের তো ঘর-গেরস্তি নেই। তারা যাযাবর―পাখির মতো অথবা পশুর মতো। সীমানাহীন দিকচিহ্নহীন এই বিশাল সুন্দরবন তাদের জমিদারি। যখন যেখানে ইচ্ছা দলবল নিয়ে চলে যাবে। কে তাদের বাধা দেবে? কে তাদের কোথায় খুঁজে পাবে? দক্ষিণে মাদারবাড়িয়ার চরে ঢুকে পড়লে তো আর কথা নেই, মাসের পর মাস খুঁজেও কেউ তাদের হদিস পাবে না।
বিকেলে মোতালেব তার সঙ্গী মাঝিকে নিয়ে চলে গেল। রাত তখন দশটা হবে বুঝি। আকাশে শুক্লপক্ষের আধা চাঁদ। নিঝুম নিরালা বন, নদীতে ভাটার টান। মাঝেমধ্যে বনের ভেতর শোঁ-শোঁ আওয়াজ তুলছে দখিনা বাতাস, ভালো করে কান পাতলে আওয়াজটা টের পাওয়া যায়। দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশে মেঘ জমছে। গাছগাছালির কারণে দেখা যাচ্ছে না। বাতাসের গতি দেখে পচাব্দী গাজী বুঝতে পারে ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা প্রবল। চাল-ডালের খিচুড়ি রান্না হয়েছে, খেয়েই শুয়ে পড়েছেন নাজমুল দারোগা। সারাদিন খালে-জঙ্গলে ঘুরে শরীরে বেজায় ক্লান্তি, শোয়ামাত্র চোখ লেগে এলো। খোলের জল সেঁচছে মাঝি। বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে জাবেদ খানের সঙ্গে গল্প করছে পচাব্দী গাজী। মহব্বত সাজুনি জনা তিন বাওয়ালিকে নিয়ে লুডু খেলতে বসেছে। ওদিকে এক বাওয়ালি মনের সুখে গান ধরেছে –
তন্ত্রমন্ত্র নাহি জানি
ভরসা তোর চরণ দুখানি
তোর নামের বাওয়ালি আমি
আমারে তুই রাখিস মনে॥
হঠাৎ গুলির শব্দে দিগন্ত কেঁপে উঠল। পাখিদের ডানা ঝাপটানি শুরু হলো, বানরের দল ডেকে উঠল সমস্বরে। মাঝিমাল্লারা হৈচৈ শুরু করল। ডাকাত ডাকাত…মাগো বাবাগো বলে হাঁক দিতে লাগল বাওয়ালিরা। একটা মাত্র গুলির শব্দ গভীর বনের নৈঃশব্দটাকে কাঁচের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল।
দ্বিতীয়বার গুলির শব্দ হতেই ঘুম টুটে গেল নাজমুল দারোগার। হুড়মুড়িয়ে তিনি উঠে বসলেন। অভিজ্ঞ পচাব্দী গাজী সতর্ক হয়ে উঠল। তার বুঝতে অসুবিধা হয় না ডাকাতের কবলে পড়তে যাচ্ছে তারা। ভয়ার্ত গলায় হাঁক দিল, ‘ডাকাত পুড়েচে দারোগা শায়েপ, আম্নার লোকদের রেডি রাখেন।’
সিথানে রাখা পিস্তলটা হাতে নিয়ে গলুইর কাছে এসে দাঁড়ালেন দারোগা, কনস্টেবল তিনজন তার পেছনে। তাদের চোখেমুখে সীমাহীন আতঙ্ক। ‘সাবধান, গুলি ছোড়া যাবে না’―হুঁশিয়ার করলেন দারোগা। কিন্তু তার আগেই বুড়ো কনস্টেবল তার গাদা বন্দুকটা উঁচিয়ে একটা ফাঁকা গুলি ছুড়ে দিল। আর সেটাই হলো কাল, সঙ্গে সঙ্গে বোট লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি ছুড়ল দস্যুরা। গুলিটা বুড়ো কনস্টেবলের কানের লতি ছিঁড়ে দারোগার বালিশটা ছেঁদা করে বেরিয়ে গেল। কানে হাত দিয়ে ‘মাগো বাবাগো’ বলে পাটায় বসে পড়ল বুড়ো। পরিস্থিতি বুঝে পচাব্দী গাজী তার বন্দুকটা শুকনো একটা খালে ছুড়ে দিয়ে জাবেদ খান ও মোহনকে নিয়ে পাটার নিচে ঢুকে পড়ল।
মুহূর্তে দস্যুদের বড় বড় তিনটা নৌকা তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলল বোটটা। এক দস্যু ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, ‘অস্ত্র¿পাতি যা আচে সব ডাঙায় ফিলে দ্যাও তাড়াতাড়ি। নালি কিন্তু কারো রেহাই নি।’
নিরস্ত্র হওয়া ছাড়া আর উপায় দেখলেন না দারোগা। এই ঘোর জঙ্গলে কতক্ষণ তিনি লড়বেন? এতগুলো ডাকাতের সঙ্গে লড়ে তো পেরেও উঠবেন না। তবু বাঁচার কোনো পথ আছে কিনা ভেবে দেখলেন খানিকক্ষণ।
: দেরি কল্লি কিন্তু কপালে দুক্ষু আচে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে আবার বলল দস্যুটা।
দারোগা আর দেরি করলেন না, পিস্তলটা চটজলদি ফুটো বালিশটার খোলে গুঁজে গলুইতে দাঁড়িয়ে বন্দুকগুলো একটা একটা করে ডাঙার দিকে ছুড়ে দিতে লাগলেন।
দস্যুদের একটা নৌকা এসে বোটের গায়ে ঠেকল। দারোগা টর্চের আলো ফেলে দেখলেন খাকি হাফপ্যান্ট হাফশার্ট ও গালপাট্টা পরা দশ-বারোজন দস্যু বন্দুক হাতে লাঠি হাতে ডেগার হাতে লাফিয়ে লাফিয়ে বোটে উঠছে। চোখ দুটো ছাড়া আর কিছু নজরে আসছে না। যেন মানুষ নয়, আদিযুগের মানুষখেকো জন্তু-জানোয়ার।
: এই নাড়ের ছাবাল, লাইট বন্দ কর। খেঁকিয়ে উঠল এক দস্যু।
টর্চ বন্ধ করার ফুরসত পেলেন না দারোগা, গালপাট্টা পরা মোটাসোঁটা এক দস্যু তার গালে একটা চড় কষিয়ে দিল, ‘লাইট মাল্লি ক্যান্ শোরের বাচ্চা?’ বলেই বাঁ গালে মারল আরেকটা চড়। দু-গালে এলোপাথাড়ি আশীসিক্কা ওজনের চড় কষতে লাগল। বেচারা দারোগা বাধা দেন না, বাধা দিতে পারেন না, ব্যথায় একবার কঁকানও না – নীরবে প্রতিটি চড় হজম করতে লাগলেন।
একটা মানুষকে কতক্ষণ আর থাপড়ানো যায়! দস্যুটাও বুঝি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ক্ষ্যান্ত দিয়ে সে অন্যদিকে পা বাড়াল। দারোগা হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। মাথাটা ঝিঁঝিঁ করছে। জন্মের পর এমন মার খাননি কখনো। চড় তো নয়, যেন তক্তার বাড়ি। দাঁতের মাড়িসুদ্ধ নড়ে গেছে যেন। ইচ্ছে করছে বালিশের খোল থেকে পিস্তলটা বের করে হার্মাদটার খুলি উড়িয়ে দিতে। অন্য সময় হলে নিশ্চিত তাই করতেন। কিন্তু এখন তো তিনি অসহায়, বাঘের পালে একলা হরিণের মতো। টু শব্দটি করেছেন তো মরেছেন।
খানিকের মধ্যে বোটে যা কিছু ছিল সব লুটেপুটে নিল দস্যুরা। বাওয়ালিদের ঘটি বাটি হাঁড়িকুড়ি কিছুই বাদ রাখল না। যার যার গামছা পরিয়ে পরনের লুঙ্গিটা পর্যন্ত খুলে নিল। তিন কনস্টেবলের পরনে সুতোটি পর্যন্ত রাখল না। গলুইর কাছে তারা হাঁটু মুড়ে বানরের মতো বসে আছে। নাজমুল দারোগার পরনেও সেই একই গামছা। কিন্তু তিনি বসে নেই, হঠাৎ হঠাৎ জ্বলে ওঠা টর্চের আলোয় মোছলেম ডাকুকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার চোখ। এরা নিশ্চয়ই মোছলেমের লোক―মন সাক্ষী দিচ্ছে তার। মোছলেম ডাকু ছাড়া এমন দুর্ধর্ষ ডাকাতি আর কে করবে! রাজু, হারেছ বা ইলিয়াস বাহিনীর তো এত অস্ত্রশস্ত্র নেই। কদিন আগে থানার বারান্দার নোটিশ বোর্ডে মোছলেমের একটা সাদাকালো ছবি সাঁটানো হয়েছে। এখন তাকে দেখলেই তিনি চিনতে পারবেন। কিন্তু গালপাট্টার কারণে কারো চেহারাই ঠাওর করতে পারছেন না।
সড়কিধারী এক দস্যুকে বললেন, ‘ভাই, আমি কি মোছলেম তালুকদারের সাথে একটু কথা বলতে পারি?’
দস্যুটা ঘুরে দাঁড়াল। সড়কিটা কাঁধে ফেলে সে জেরা শুরু করে দিল – নাম কী? বাড়ি কোনে? থাকো কোনে? মোছলেম তালুকদারের নাম জানো কী কুরে? তার সাতে তোমার কের কথা? দরকারডা কী?
উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন দারোগা, অমনি বাঁয়ের নৌকা থেকে আরেক দস্যু ধমকে উঠল, ‘এত কতা কিসের? শালার মুণ্ডুটা ফিলে দে।’
মুণ্ডু কাটতে ডেগার আনার জন্যই বুঝি দস্যুটা চরাটের দিকে পা বাড়াল। দারুণ বিপন্ন বোধ করলেন দারোগা। বাঁচার বুঝি আর পথ নেই! বুকের ধুকফুকানি বাড়তে লাগল। স্ত্রী-সন্তানের চেহারা ভেসে উঠল চোখে। বাঁচার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে ওঠে তার। ঝটপট বালিশের খোল থেকে পিস্তলটা বের করে দস্যুটার দিকে তাক করে ধরল, ‘খবরদার। আমি তোমাদের খারাপ কিছু বলি নাই। নৌকায় যা আছে সব নিয়া যাও। এই পিস্তলটাও আমি দিয়া দিচ্ছি, তবু একবার মোছলেমের সাথে কথা বলতে দাও। তার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।’
হঠাৎ তার মুখের ওপর টর্চের আলো এসে পড়ল। তীব্র আলোয় দৃষ্টি ঝলসে গেল তার। পাশের নৌকা থেকে এক দস্যু লাফিয়ে এসে তার পিঠে প্রচ- বেগে ডেগারের কোপ মারল। পিস্তলটা ছিটকে পড়ল সামনে দাঁড়ানো দস্যুটার পায়ের কাছে। সেটা কুড়িয়ে দারোগাকে লক্ষ্য করে দস্যুটা দুবার ট্রিগার টানল।
যে পথে এসেছিল ডাকাতদল সে পথে চলে গেল। পচাব্দী গাজী পাটার নিচ থেকে উঠে দেখে নাজমুল দারোগা রক্তে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। নাক বরাবর গুলি ঢুকে দাঁত চুরমার করে খুলির পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এই বীভৎস দৃশ্য দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠল মোহন। সারা শরীর কাঁপতে লাগল তার। জাবেদ খান তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। তার গায়েও বুঝি কাঁপুনি উঠছে ধীরে ধীরে।
বনের ভেতর বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজটা ক্রমেই বাড়ছে। গাছবিরিক্ষি নুয়ে পড়ছে বাওড়ের তোড়ে। নদীর জলে বড় বড় ঢেউ উঠছে। আকাশের কোথাও তারা খুঁজে পায় না পচাব্দী গাজী। গাঢ় মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে সমস্ত আকাশ। দ্রুত সে নোঙর তুলতে বলল মাঝিদের।
ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে বোট ছুটে চলে গরানপুরের দিকে।