কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
তেরো.
আমরা আর কেশব মাস্টারের সন্ধান করব না। হয়ত তিনি গুম হয়ে গেছেন, এই জল-জঙ্গলের দেশে মানুষ যেভাবে গুম হয়ে যায়। অথবা তিনি খুন হয়ে গেছেন, দস্যু-ডাকাতের এই দেশে মানুষ যেভাবে খুন হয়ে যায়। কে জানে, হয়ত বাঘ সাপ কামোট কুমিরের শিকার হয়েছেন, হয়ত ঝড়জলে তার লাশ ভেসে গেছে অকূল সাগরে। আর যদি বেঁচে থাকেন হয়ত তিনি ফিরে আসবেন। কোনো এক ধূসর সন্ধ্যায় অথবা কোনো এক উজ্জ্বল ভোরে দরজার কড়া নেড়ে বলবেন, ‘দরজা খোলো চারু, আমি আইচি।’
চারুবালা আর স্বামীর সন্ধান করেনি। স্বামী তার ফিরে আসবে কোনোদিন―এই আশাও ছেড়ে দিয়েছে। গোপেশের কাঁধে সংসারের জুয়োলটা তুলে দিয়ে সে গরানপুর থেকে হারিয়ে গেল। হ্যাঁ, হারিয়ে গেল বৈকি। একে তো হারিয়ে যাওয়াই বলে। গোপেশ বাইরে সামলায়, তাপসী সামলায় ঘর। গরানপুরের মানুষরা তো গোপেশকে দিনে অন্তত একবার হলেও দেখে। তাপসীও তো আর দেখার বাইরে থাকে না, তাকেও নানা কাজে বাইরে বেরোতে হয়। কিন্তু চারুবালাকে তো কেউ দেখে না। বাশ্ঘরের কোণার কামরাটায় দিনরাত চুপচাপ বসে থাকলে তাকে তো কেউ দেখার কথা নয়। কালাজ্বরে পড়ে তার শরীরের বাঁ দিকটা অবশ হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে প্যারালাইসিস। চিকিৎসা চলছে। উপজেলা সদর হাসপাতালের ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ডাক্তার আশা দিয়েছে ভালো হয়ে যাবে, তবে কবে নাগাদ ভালো হবে ঠিক নেই। ছয় মাসও লাগতে পারে, ছয় বছরও লাগতে পারে। জগতী বেওয়া এখন তার অন্ধের নড়ি। ভাতের সঙ্গে নিয়ম মাফিক তিন বেলা ওষুদ খাওয়ানো, দিনে অন্তত চার-পাঁচ বার ধরাধরি করে পায়খানা-পেচ্ছাবখানায় নিয়ে যাওয়া, উঠোনে বসিয়ে চানটা করিয়ে দেওয়া, কাপড়টা কেচে দেয়া – সবই সে করে দেয়। বিনিময়ে মাসে দুই শ টাকা আর তিন বেলা ভাত।
চকির ওপর কাঁথা-বালিশের তাকে হেলান দিয়ে সারাদিন বসে থাকে চারুবালা। চোখ পড়ে থাকে চুনকুড়ির দিকে। চুনকুড়িতে জোয়ার আসে, ভাটা পড়ে। জোয়ার-ভাটার কথা তার খেয়ালে থাকে না, হামেশা নদীটাকে তার একই রকম মনে হয়। একই জল, একই স্রোত, একই ঢেউ, একই কিসিমের নৌকা আসছে, যাচ্ছে। মাঝিমাল্লারাও একই রকমের। কে মৌয়াল, কেউ বাওয়ালি, কে দূরদূরান্তের যাত্রী – আলাদা করে চিনে উঠতে পারে না। চেহারা দেখে বোঝা যায় না তার মনে কখনো কোনো শোক-তাপ ছিল বা এখনো কোনো শোক-তাপ আছে। সে বেঁচে আছে – মাঝেমধ্যে এ কথাটিও তার খেয়ালে থাকে না। দুপুরে এক থালা ভাত খেয়ে ওই তাকটায় হেলান দিয়ে বসল, সারা বিকেল চুনকুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকল, তাকিয়ে থাকতে থাকতে সন্ধ্যা নামল, চুনকুড়ির জল অন্ধকারের জালে ঢাকা পড়ল, তখন সে বেঁচে থাকাটা টের পায়। হয়ত সে চুপচাপ বসে বসে হরিনাম জপে। হরিনামের সঙ্গে মাঝেমধ্যে হয়ত শোয়ামির নামটাও।
উপযুক্ত সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে অপহরণ মামলাটাও দুর্বল হয়ে গেল। সাক্ষী তো নেই-ই বলতে গেলে। শুধু পুলিশের সাক্ষীতে কি আসামির জেল-ফাঁসি হয়? এজাহারে সাক্ষীর নামের জায়গায় ছবেদালি মোড়ল, আলাউদ্দিনসহ আরো দুজনের নাম লিখে দিয়েছিল পুলিশ। সাক্ষী দিতে তারা রাজি তো হলোই না, উল্টো প্রতিবাদ করেছে। যে ঘটনা চোখে দেখেনি তার সাক্ষী তারা দেবে কেমন করে? মামলার বাদী চারুবলা বটে, কিন্তু সে তো নির্দিষ্ট করে কাউকে আসামি করেনি। এজাহারের কোথাও তো সে ভক্তদাস, বিপিন, রাধামাধব বা মহেশ্বরের নাম উল্লেখ করেনি। পুলিশি তদন্তে তাদের নাম উঠে এসেছে। ভক্তদাস তো শুরু থেকেই জেলে ছিল, বিপিনরা মাস তিনেক আত্মগোপনে থেকে কোর্ট-সারেন্ডার করতে গেলে তাদেরও জামিন বাতিল হলো। প্রায় দু-বছর পর মামলার অভিযোগ গঠন হলে পরে চারুবালাকে কোর্টে যেতে হলো। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সে সোজাসাপ্টা বলে দিল, আসামিদের সঙ্গে তার স্বামীর কোনো শত্রুতা ছিল না, এমনকি তার সঙ্গেও কোনো শত্রুতা নেই। এরপর কোর্ট তো আর আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারে না, পরের তারিখেই তাদের জামিন দিয়ে দিল।
খালেক বেপারির জবানবন্দি মোতাবেক মামলার মূল আসামি গোলাপ গাজী। কিন্তু সেও তো আর বেঁচে নেই। আসামি করতে হলে একমাত্র মোছলেম তালুকদারকে করতে হয়। করেছেও হয়ত পুলিশ। কিন্তু তাতে কী। ডজন ডজন মামলা তার বিরুদ্ধে, একটা মামলা যোগ হলে তার কী আসবে-যাবে?
মামলা থেকে খালাস পেয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে বিপিন তার বুড়ো মা আর বউ-বাচ্চা নিয়ে সন্দেশখালী চলে গেল। একদিন যেভাবে দাসবাড়ির হিন্দুরা চলে গিয়েছিল, যেভাবে চলে গিয়েছিল হরিনগরের হিন্দুরা। এই যাওয়া চলতে থাকে। খুব নীরবে। সাতচল্লিশে গেছে, চৌষট্টিতে গেছে, একাত্তরে গেছে, এখনো যাচ্ছে, ভবিষ্যতেও যাবে। সবাই যায়, কেউ ফেরে না। রাধামাধব ও মহেশ্বরও যাই যাই করে। ঠিকঠাক দামে ভিটাটা বেচে দিতে পারলে যাওয়াটা ত্বরান্বিত হয়। যত আগে যাওয়া যায় তত মঙ্গল। বলা তো যায় না কখন আবার কোন মামলায় ফেঁসে যায়, কখন কে ভিটাটা কেড়ে নিয়ে যায়। তারা তো হিন্দু, মেরে ফেললেও তো কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করবে না। সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে মামলা থেকে তারা খালাস পেয়েছে বটে, কিন্তু গ্রামের মুসলমানদের সন্দেহ থেকে তো খালাস পায়নি। মুসলমানদের মনে এখনো সন্দেহ, এখনো ক্ষোভ, এখনো তারা মারমুখী। তারা কানাঘুষা করে, আইন সবসময় আসামির পক্ষে। আকাশে যত তারা আইনের তত ধারা। আইনের মারপ্যাঁচে আসামিরা জেল-ফাঁসি থেকে বেঁচে গেছে। চারুবালা হিন্দু বলে এই হিন্দুদের পক্ষ নিয়েছে। পুলিশ তো এমনি এমনি তাদের আসামি করেনি। নিশ্চয়ই কোনো হেতু আছে।
বিপিনটা চলে গেল, অথচ কেউ একবারও জিজ্ঞেস করল না, কেন চলে যাচ্ছ বাপু? বাপ-ঠাকুর্দার দেশ ছেড়ে কেউ কোথাও যায়? অবশ্য জিজ্ঞেস করার মতো সুযোগও পায়নি। যাওয়ার সময় বিপিন তো কাউকে বলে যায়নি। বিপিন যে গরানপুরে নেই, দেড়-দুই মাসেও কেউ টের পেল না। টের পাবে কী করে, তার ঘরটা তো আগের মতোই আছে। দুয়ারটা খোলা থাকল কি বন্ধ থাকল, তা দেখে তো বোঝার উপায় নেই ভেতরে কেউ আছে বা কেউ নেই। সে বাওয়ালি, বনে-জঙ্গলে তার কারবার, বউ-বাচ্চাকে শ্বশুরবাড়ি রেখে হয়ত সে মহালে গেছে। রাধামাধব ও মহেশ্বরও তো কাউকে বলেনি। বললে তাদের অমঙ্গল হয় পাছে! গ্রামে আলাউদ্দিনের মতো লোকের তো অভাব নেই। বিপিন চলে যাওয়ার কথা শুনে ভূমি অফিস থেকে একটা জাল দলিল তৈরি করে এনে যদি দাবি করে বসে বিপিনের ভিটাটা তার, তখন তার সঙ্গে কে ফ্যাসাদে জড়াবে?
কিন্তু কথা তো আর চিরকাল গোপন থাকে না, একদিন না একদিন ফাঁস হবেই। বিপিনের কথাটাও একদিন ফাঁস হয়ে গেল। কেউ আফসোস করল, ‘আহারে, ক্যানো চুলে গ্যালো বেচারা?’ কেউ অভিমান করল, ‘কেরাম নিষ্ঠুর মানুষ দ্যাখো, যাবার সোমায় এট্টাবার বুলেও গ্যালো না।’ কেউ কেউ রাগ-ক্ষোভও প্রকাশ করল, ‘হিঁদুর জাতটাই আসলে স্বার্থপর।’ কেউ বিপিনের আর্থিক অনটনের প্রসঙ্গ তুলে বলল, ‘গেচে ভালোই কুরেচে। এই পোড়া দেশে পুড়ে থাইকে কী লাভ?’
একমাত্র ব্যতিক্রম দেখা গেল মুন্সিগঞ্জের আতা মৌলবিকে। বিপিনের বাবার সঙ্গে তার ভালো খাতির ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছোট নাগপুরে একই ক্যাম্পে ছিল তারা। তখনই সম্পর্কটা গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্ক আমৃত্যু অটটু ছিল। বিপিনের বাবাকে চিতায় চড়ানোর সময় শ্মশানে হাজির ছিল সে। মুসলমানরা এ নিয়ে কত সমালোচনা করল, ইমান-আকিদা নষ্ট হয়ে গেছে আগুনি হুজুরের। নইলে কোনো মুসলমান হিঁদুর শ্মশানে যায়! আতা মৌলবি বলেছে, ‘শোনো, মানুষ মরার পর সে আর হিঁদু-মুসলমান থাকে না, সে তখন মড়া। মড়ার আবার জাত-ধর্ম কী?’
সবচেয়ে বেশি খেপেছিল হেদায়াতে ইসলামির লোকেরা। তার বিরুদ্ধে তারা মুন্সিগঞ্জ বাজারে সালিশও ডেকেছিল। তাকে ডেকেছিল, সে যায়নি। বলেছে, ‘হিঁদুর শ্মশানে গিলি ইমান নষ্ট হয় এডা কোন কেতাবে লেখা আচে আগে দেখাও। তারপর সালিশ-দরবার।’
সপরিবারে বিপিন দেশ ছাড়ার খবরটা চাউর হলে পরে আতা মৌলবি এক হাটবারে হরিনগর বাজার গরম করে তুলল। বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে বগলের নিচ থেকে ছাতাটা বের করে নাড়াতে নাড়াতে বলতে লাগল, ‘বিপিন ক্যানো যাবে? এ দেশডা কি বিপিনের না? এই দেশের ওপর আমার যদি হক থাকে বিপিনের ক্যানো থাকপে না? এই দেশে হিন্দুরা থাকতি পারবে না, সরকার কি এরাম কোনো আইন জারি কুরেচে?’
বটগাছের নিচে জটলা পাকিয়ে উঠল। সবাই অবাকচোখে দেখল আগুনি হুজুর সত্যি সত্যি আগুনের মতো জ্বলে উঠেছে। তার আরেক নাম আগুনি হুজুর। উপাধিও বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় চার পাকিস্তানি সেপাইকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল বলে নামটা ফেটেছিল। মুকনোলির প্রান্তরের দক্ষিণ সীমানায় দাঁড়িয়ে গলা টান টান করে, হাতের তেলো কপালে ঠেকিয়ে, নজরটাকে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর করে উত্তরে তাকালে টালির চানি দেয়া মাটির যে ঘরটা দেখা যাবে সেটি আতা মৌলবির। বর্ষাকাল ছিল তখন। মুকনোলির প্রান্তর ডুবে আছে অথৈ পানির নিচে। গরমও পড়ছিল প্রচণ্ড। তাঁতানো রোদে অতিষ্ঠ হয়ে রাইফেলধারী চার পাকিস্তানি সেপাই তার দলিজে আশ্রয় নিল। তাদের সঙ্গে আরো সেপাই ছিল। কদমতলা কি হরিনগরের কোন এক মুক্তিযোদ্ধাকে ধরতে গেল তারা।
দুপুরে রাতা মোরগ জবাই দিয়ে চিকন চালের ভাত রেঁধে চার সেপাইকে পেট পুরে খাওয়াল আতা মৌলবি। খিদাও পেয়েছিল তাদের, খেলও গলা পর্যন্ত। রুটির বদলে পেটে ভাত পড়লে যা হয় তাই হলো, ঘুমে তাদের চোখ ভেঙে এলো। প্রান্তরধোয়া নির্মল বাতাস আরো উস্কে দিল ঘুম। শরাব-টরাবও খেয়েছিল বুঝি এক-আধটু। রাইফেলগুলো দলিজের মাটির দেয়ালের সঙ্গে খাড়া করে রেখে শীতল পাটিতে গা এলিয়ে দিয়ে নাক ডাকতে শুরু করল চার সেপাই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল, তাদের নাক ডাকা থামল না। গায়ে আগুনের আঁচ না লাগলে রাতটাই হয়ত ঘুমের ঘোরে কেটে যেত। চোখ খুলে দেখল সারা ঘরে দাউদাউ আগুন। আগুনের ফুলকি নিয়ে গোলপাতার চালখানা ঝরে ঝরে পড়ছে তাদের গায়ে। দরজা-জানালা সব বন্ধ, বেরোবার কোনো পথ খোলা নেই। খোলা থাকলেই কি, চারদিকে দাউ দাউ আগুন। কোনদিকে দরজা, কোনদিকে জানালা বোঝার তো কোনো উপায় নেই।
মুন্সিগঞ্জে তখন মানুষ কোথায়? যুদ্ধ লাগার পরপরই তো সবাই ছোট নাগপুর, সন্দেশখালী বা হিঙ্গলগঞ্জ চলে গেছে। যারা ছিল ঘটি-কলসি নিয়ে তারা আগুন নেভাতে এলো। কিন্তু ভেতরে গুলির শব্দ পেয়ে যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল। উপকার করতে এসে গুলি খাওয়ার এত শখ কার! দলিজের আগুন নেভার আগেই সারা গ্রাম ফাঁকা। গরু ছাগল হাঁস মুরগি আর গ্রামের কয়েকটা কুকুর ছাড়া মানুষ বলতে কেউ থাকল না।
রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি চালাতে চালাতে গ্রামে ঢুকল। মুন্সিগঞ্জ বাজারে যাকে সামনে পেল ধরে-বেঁধে নিয়ে গেল, কয়েকটা মুদিখানা লুট করে আগুন দিল, মার্চ করতে করতে সৈন্যরা আতা মৌলবির বাড়িতে ঢুকে তার বাশঘরটা পুড়িয়ে দিল। সর্বগ্রাসী আগুনে তার সারা বাড়ি ছাই। আতা মৌলবি তো নিপাত্তা, বউ-ছেলেমেয়েসহ কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। তারপর আরো পাঁচ মাস যুদ্ধ চলল, রাজাকার আলবদর ও শান্তিকমিটির লোকেরা গরুখোঁজা খুঁজেও তার সন্ধান পেল না।
আতা মৌলবি পাস করা মৌলবি বটে। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার উলা পাস। কিন্তু স্বভাব-চরিত্রে মৌলবির গুণাগুণ যতটা থাকা দরকার তার মধ্যে ততটা নেই। ঠিকমতো পাঁচ অক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়ে না, এলাকার মৌলবি-মুন্সিদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রাখে না। এ কারণে কোথাও কোনো বাড়িতে খতমের দাওয়াত পায় না, ছ-মাস বছরেও খয়রাতের দু-চারটা টাকা পকেটে পড়ে না। একটা চাকরি-বাকরিও জুটল না কোথাও। না কোথাও কোনো মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, না কোনো মক্তব-মাদ্রাসার মোদাররেস। সারা জীবন মুকনোলির প্রান্তরে তিন বিঘা জমি চাষাবাদ করেই সংসারটা টেনেটুনে চালাচ্ছে। মৌলবি হিসেবে মানুষের কাছ থেকে যেটুকু ভক্তিশ্রদ্ধা পাওয়ার কথা তাও পায় না। ভক্তিশ্রদ্ধা তো মনের ব্যাপার, মন থেকে আসতে হয়। মুকনোলির প্রান্তরের আলে বা চুনকুড়ির চরে বসিয়ে প্রেমের টানে ঘরছাড়া ছেলেমেয়েদের বিয়ে পড়ালে লোকের মন থেকে ভক্তিশ্রদ্ধা আসবে কেমন করে? গ্রামে এমন কথাও চালু আছে, কেশব মাস্টারের মেজ মেয়ে দীপিকাকে কলমা পড়িয়ে মুসলমান বানিয়েছে এই আতা মৌলবি। দীপিকার সঙ্গে দিদারের বিয়ের কলমটাও সে পড়িয়েছে। যদিও সে কখনো এ কথা স্বীকার করেনি। দীপিকা বা দিদারও কোনোদিন কাউকে বলেনি। বলেনি তাতে কি, মানুষ কি বোঝে না? এমন বিয়ে আতা মৌলবি ছাড়া আর কে পড়াবে? এই চুনকুড়ি তীরের আবাদে গোপনে যেসব বিয়েশাদি হয়, সব কটিই পড়ায় আতা মৌলবি। দুজন সাক্ষী, এক প্যাকেট বিস্কিট আর কুড়িটা টাকা হলেই হলো – আতা মৌলবি কলমা পড়াতে রাজি। তাকে তো দোষ দেয়া যায় না। মানুষ এসে তার হাত-পা ধরে পড়ে থাকলে রাজি না হয়ে তো তার উপায়ও থাকে না। মেয়েটাকে মনে ধরেছে, পীরিতিও চলছে তলে তলে, কিন্তু মেয়ের বাবা-মা কিছুতেই তোমার কাছে বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছে না। মেয়ে তোমার পীরিতে এমন মজাই মজেছে তোমার সঙ্গে ঘর ছাড়তেও রাজি। তাকে ঘরে তুলতে তোমারও আপত্তি নেই। কিন্তু তুমি মুসলমান, বিয়ে ছাড়া তো একটা বেগানা মেয়েকে ঘরে তুলতে পারো না। তুললে শরীয়তমতো বিয়ে করেই তুলতে হবে। কিন্তু বিয়েটা পড়াবে কে? গ্রামের সব মোল্লা-মৌলবির হাত তো সমাজের কাছে বাঁধা। তারা বিয়ে পড়াতে রাজি হবে কোন দুঃখে? তখন আতা মৌলবির পা ধরে পড়ে থাকা ছাড়া উপায় কী। মুকনোলির প্রান্তরে কাশবনের আড়ালে অথবা চুনকুড়ির চরের দূর্বাঘাসে দুজন সাক্ষী নিয়ে তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসো। তার মুখে মুখে বলো, কবুল। ব্যাস, হয়ে গেল। এবার মেয়েটাকে নিয়ে যেখানে খুশি ওঠো, যা ইচ্ছা করো। তোমাকে কেউ আর বাধা দেবে না।
সারা জীবনে কম করে হলেও গোপনে দু-ডজন ছেলেমেয়ের বিয়ে পড়িয়েছে আতা মৌলবি। এ কারণে অপমান-অপদস্তও কম হয়নি। শালা-বানচোতও শুনতে হয়েছে বহুবার। কিন্তু কখনো প্রতিবাদ করেনি, হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কেউ বেশি বাড়াবাড়ি করলে বড়জোর এটুকু বলেছে, ‘শরীয়তের বরখেলাফ তো কিচু করিনি, যা করিচি শরীয়ত মতোই করিচি।’ তখন আর কিছু বলার থাকে না কারো। কী বলবে? বললে যে শরীয়তের বিরুদ্ধে যায়!
এই চুনকুড়ি পারেই কেটে গেল তার এক জীবন। সারা জীবনে দু-একবার হয়ত জেলাশহরে গিয়ে থাকবে। উপজেলা সদরে দু-তিন বছরেও একবার তার কাজ পড়ে না। মুন্সিগঞ্জের বাইরেও খুব একটা যাওয়া হয় না। কাজ না থাকলে কী করবে গিয়ে? ঘুরে বেড়ানোর শখও তো নেই আর। ব্রিটিশ সরকারের রাজধানী কলকাতায় চারটা বছর কাটিয়ে এসেছে। দুনিয়ায় এমন কিছু নেই যা কলকাতা শহরে নেই। দিল্লি, আগ্রা, আজমিরও ঘুরে এসেছে একবার। মন ভরিয়ে চোখ জুড়িয়ে হিন্দুস্তানের কত কিছু দেখেছে, দেখার মতো আর তো কিছু বাকি নেই। সারা দিন ক্ষেতে-খামারে পড়ে থাকে, রোজ বিকেলে বগলের নিচে ছাতাটা নিয়ে হরিনগর অথবা মুন্সিগঞ্জ বাজারে গিয়ে কোনো একটা চা-দোকানে বসে একটা ডালপেঁয়াজু অথবা এক কাপ চা খেয়ে মাগরিবের নামাজটা পড়ে আবার বাড়ি ফিরবে।
হয়ত ইচ্ছে করেই এই গণ্ডির ভেতরে ঢুকে যাওয়া। চোরা বিয়ে পড়ায় বলে এমনিতেই সে লোকের চোখে ভালো না, তার ওপর হেদায়াতে ইসলামির নেতা-কর্মীদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ। হেদায়াত পার্টির কারো সঙ্গে কখনো কোনো বিষয়ে সে তর্কে জড়ায়নি, তবু পার্টির লোকেরা তাকে সহ্য করতে পারে না। পেছনে ‘ভণ্ড মৌলুবি’ বলে গালি দেয়। কখনো গালিটা হয়ত তার কানে যায়, কিন্তু পাল্টা কোনো জবাব দেয় না।
সেদিন হরিনগর বাজারটা তাঁতিয়ে দিয়ে রাগে-ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়ি চলে গেল। এশার নামাজটা পড়ে ভাত না খেয়েই শুয়ে পড়ল। মাঝরাতে বড় ছেলের বউ পেচ্ছাবখানা থেকে ফিরে লোটাটা ডবার ওপর রাখতে গিয়ে দেখল, ঘরের উত্তরের ডবায় চুপচাপ বসে আছে তার শ্বশুর।
: বাপজানের কি শরীল খারাপ?
: না, গরম লাগতেচে খুব। শরীলডা এট্টু ঠাণ্ডা হোক।
ছেলেবউ ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল সবে, হঠাৎ একটা হুড়মুড় শব্দে সে ঘুরে দাঁড়াল। টেমিটা উঁচিয়ে উঠোনের উত্তর কোণায় নজর করে দেখল তার বাপজান উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
ছেলে আর ছেলেবউরা এসে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেল তাকে। নাকে-মুখে রক্ত বেরোচ্ছে। রক্তবমি করেছে বুঝি। সাদা দাড়িগুলো রক্তে লাল, গেঞ্জিটাও রক্তে ভিজে যাচ্ছে। বাড়িতে কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল। এত রাতে ডাক্তার-কবিরাজ পাবে কোথায়। গ্রামে কবিরাজ আছে একজন, বড় ছেলে ছুটল কবিরাজবাড়ি।
রাতভর আজরাইলের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ল আতা মৌলবি। একবার হুঁশে আসে তো ফের বেহুঁশ। ছেলে আর ছেলেবউরা শিয়রে বসে সারা রাত কোরান তেলাওয়াত করল। ভোরে তার হুঁশ ফিরল। সবার সঙ্গে কথা বলল, কিছু অছিয়তও করল। মুন্সিগঞ্জ জামে মসজিদের ইমাম গোফরান মৌলানা এলো তাকে দেখতে।
: এখন কেরাম লাগে মৌলুবি শায়েপ?
আতা মৌলবি জবাব না দিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। শিয়রে বসা তার ছেলেরা বিব্রতবোধ করে। গোফরান মৌলানা মানিগুনী মানুষ, মুন্সিগঞ্জে হেদায়াতে ইসলামির নেতা গোণা দিলে তার নাম সবার আগে আসবে। বহু বছর ধরে মুন্সিগঞ্জ জামে মসজিদে ইমামতি করছে। তার সঙ্গে আতা মৌলবির কোন গোপন শত্রুতা আছে কে জানে, সারা জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজও তার পেছনে পড়েনি। পাঞ্জেগানা তো প্রায়ই ঘরে পড়ত, জুমার নামাজটা পড়ত হরিনগর মসজিদে। মৃত্যুকালেও বাপের সেই তামাদি গোপন শত্রুতাটা খেয়াল করে বড় ছেলে গোফরান মৌলানার হাত দুটো চেপে ধরল, ‘আম্নি আমার আব্বারে মাফ কুরে দ্যান হুজুর। তার হুঁশ নি, সব কতা ঠিকমতোন বুঝতি পারতেচে না।’
গোফরান মৌলানা হেসে উঠে মৃত্যুযন্ত্রণাকাতর আতা মৌলবির মুখের দিকে তাকাল। তখন যদি কেউ মৌলানার তাকানোটা ভালো করে খেয়াল করত, দেখত সেই তাকানোর মধ্যে কতটা ক্রোধ মেশানো।
গলাটা যতটা পারে নরম করে মৌলানা বলল, ‘আমার মুকি মুকি এস্তেগফারটা পুড়ে ন্যান মৌলুবি শায়েপ।’
গোফরান মৌলানার চোখে চোখ রাখল আতা মৌলবি। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে, চোখের মণি দুটোও কাঁপছে। ডান হাতটা তোলার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। বড় ছেলে হাতটা ধরে উরুর ওপর রাখল। কব্জিটা তুলে কাঁপা গলায় বলল, ‘আপনার মুখি আমার এস্তেগফার পড়তি হবে না ইমাম শায়েপ। এস্তেগফার তো আমি পড়তি জানি। আগেও পড়িচি ক’বার।’
তারপর ছোট ছেলের উদ্দেশে বলল, ‘তুই এট্টাবার গরানপুরি যাতি পারবি বাপ?’
: ক্যান আব্বা?
: যাবি কি না বল?
: জাবেদ কাকারে ডাকতি হবে?
: না। কেশব মাস্টারের বউর সঙ্গে আমার কিচু জরুলি কতা ছিল।
কিছু বুঝতে না পেরে গোফরান মৌলানার মুখের দিকে তাকাল ছোট ছেলে। গোফরান মৌলানা বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়ছে। আতা মৌলবির মুখে লম্বা একটা ফুঁ দিয়ে বলল, ‘আপনি ভুল কত্তিচেন মৌলুবি শায়েপ। তার নাম কিশোয়ার মোহাম্মদ। নামডা তো আপনারই দেয়া।’
উরুর ওপর রাখা ডান হাতের কব্জিটা আবার নাড়াল আতা মৌলবি, ‘না না, ভুল কতা। তার নাম কেশব মাস্টার। অনন্তচন্দ্র মণ্ডলের ছেলে কেশবচন্দ্র মণ্ডল।’
: নাউযুবিল্লাহ! সে না নওমুসলিম? আপনার কাচেই তো সে কলমা পুড়ে মোসলমান হুয়েছে! কী আচ্চয্য!
হাতের কব্জিটা বুঝি আবারও নাড়াতে চাইল আতা মৌলবি। খানিকটা নাড়ালও বুঝি। কিন্তু সেই নড়নটা কারো নজরে পড়ল না। সবার চোখ তো তার মুখের দিকে, আলাদা করে তো কেউ কব্জিটার দিকে তাকিয়ে নেই। মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বড় ছেলে ভালো করে নজর করে দেখল, তার বাপজানের চোখ দুটো পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। আর পলক পড়ছে না।