কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
আঠারো.
মদ খাওয়ার জন্য নয়, গোপেশ গ্রেপ্তার হয়েছে অন্য কারণে। মদ সে খায়, টেংরাখালীর বাগ্দিদের তৈরি চোলাই মদ। মহেশ্বর তাকে মদের এই আখড়াটা চিনিয়েছিল। রোজ রাতে গলা পর্যন্ত মদ না খেলে তো মহেশ্বরের ঘুম হয় না। তার জীবনের নিভু নিভু পিদিমটাকে জ্বালিয়ে রেখেছে এই মদ। বেঁচে থাকার জন্য তো উপাদান লাগে। বাবা লাগে, মা লাগে, স্ত্রী-সন্তান লাগে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব লাগে। এরাই বেঁচে থাকার উপাদান, এদের জন্যই তো বেঁচে থাকা। কিন্তু তার তো বেঁচে থাকার মতো কোনো উপাদান নেই। বউ-ছেলেমেয়ে সেই কবে পুড়ে মরেছে, বাবা-মা তারও আগে চিতায় চড়েছে। একটা বোন ছিল, সেও অকালে মরেছে। বিপিন বা রাধামাধবও তো নেই। এই গরানপুরে সে একা। তার একার জন্য তো বাড়িঘরেরও দরকার নেই। ভিটার অর্ধেকটা জলের দামে বেচে দিয়েছে। টাকাটা মেরে খায়নি, সন্দেশখালী গিয়ে বিপিন ও রাধামাধবকে ভাগ করে দিয়ে এসেছে। ভিটার বাকি অর্ধেকও রাখত না। কিন্তু দলিল-পর্চা ঠিক না থাকলে বেচবে কী করে? ঠিক যে নেই কেউ জানে না। কাউকে সে জানায় না। জানালে তো কবেই হাতছাড়া হয়ে যেত। আলাউদ্দিন বা তার মতো কেউ এসে বলত, জায়গা খালি করো বাপু, জায়গাটা আমার। এই দেখ দলিল-পর্চা।
মহেশ্বরও সন্দেশখালী চলে যেতে পারত। চলে যেতে তো কতবারই চেয়েছে। এখনো চায়। পারে না তার মরা বউটার কারণে। মদের নেশায় চুর হয়ে সে যখন বালিশে মাথা রাখে, তার মনে হয়, কাঞ্চি এসে তার রুখু চুলগুলো টেনে দিচ্ছে। পাকা চুলটা একটানে তুলে চোখের সামনে ধরে হাসতে হাসতে বলছে, ‘বুড়ো হুয়ে গিলে?’ মহেশ্বর বলে, ‘তুমিও তো বুড়ি হুয়ে গেচ।’ কাঞ্চি হাসে। হাসতে হাসতে তার মাথায় হাত বুলায়। গুনগুন করে গানও গায়। বউয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার ঘুম পায়। গভীর ঘুম। ঝড়-তুফানে ঘরটা উড়িয়ে নিলে, শত্রু এসে আগুন ধরিয়ে দিলে অথবা কেউ তাকে খুন করে ফেললেও ঘুমটা ভাঙবে না। এক ঘুমে ভোর। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রামছাগলটা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে না ডাকলে আটটা নটার আগে তার ঘুম ভাঙে না। মেলা দিন ধরে ছাগলটা তার সঙ্গী। টাকার অভাবে বেচে দিতে চেয়েছে কতবার। যায় না। অচেনা কেউ গলার রশিটায় হাত দিয়েছে তো এমন খুঁটি ধরবে, সারা দিন টেনেও এক চুল নড়াতে পারবে না।
তো কাঞ্চির ওই হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখার জন্য, মুখ দেখতে দেখতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার জন্য মহেশ্বরকে পেট ভরে মদ খেতে হয়। মদ না খেলে তো কাঞ্চি আসে না, কাঞ্চি না এলে তার ঘুমও হয় না। রোজ রাতে মদ খাবে, মদ খেলে কাঞ্চি আসবে – এই আশায় তার দিনটা কাটে। রাতে তো আর আশার দরকার হয় না। ঘুমের ঘোরে তো আশা-নিরাশা থাকে না।
দিনভর বনের একানী মরানী দেয়ানী ভরানীতে বড়শি ফেলে মাছ ধরে, বিকেলে গরানপুর বাজারে বেচে যা পায় তাতে চাল-ডাল-তরিতরকারির টাকাটা হয়ে যায়। বাড়তি থাকলে মদের টাকাটাও। বেচাকেনা শেষে বাড়ি ফিরে রাঁধতে বসে। ছাগলটা তার কাছে বসে জাবর কাটে। চান করে খেয়েদেয়ে টর্চলাইটা নিয়ে ফেলুর দোকানের মাচায় পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে বসে এক কাপ চা খাবে। অন্ধকারটা গাঢ় হলে জমিনের আল ধরে টেংরাখালীর দিকে হাঁটা ধরবে। হরিনগর বা মুন্সিগঞ্জেও মদ পাওয়া যায়। তবে চোলাই নয়, ওসব ইন্ডিয়ান মদ। হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালী থেকে চোরাইপথে আসে। চোরাইপথে আবার শ্যামনগর, সাতক্ষীরা বা খুলনায় চলে যায়। ওই মদ খেয়ে তার পোষায় না। তার দরকার চোলাই। দামে স্বস্তা, নেশাও তুমুল।
টেংরাখালী থেকে ফিরতে ফিরতে রাত নটা-দশটা বেজে যায়। শুরুর দিকে মদ খেয়ে হাটে-বাজারে যেত না, চুনকুড়ির তীরে শ্মশানের ধারে রাস্তার ওপর বসে থাকত। লোকজন বহুদিন তাকে রাস্তার ওপর বসে বসে কাঁদতে দেখেছে। এখন আরে কাঁদে-টাঁদে না, শ্মশানের রাস্তায়ও যায় না। গলা পর্যন্ত মদ খেয়ে টেংরাখালী থেকে হেলে-দুলে হাঁটতে হাঁটতে সোজা গরানপুর বাজারে এসে থামবে। মুখটা ভুলেও খুলবে না, শত প্রশ্ন করলেও উত্তর দেবে না। মাথাটা নুইয়ে ফেলুর দোকানের মাচায় অথবা রাস্তার ওপর চুপচাপ বসে থাকবে। যেই না আলাউদ্দিনকে দেখেবে, অমনি ফট করে মুখের তালাটা খুলে যাবে। শুরু হবে তার অনর্গল গালাগালি। না, আলাউদ্দিনকে নয়, গালি সে নিজেকেই দেয়। প্রথমে তার ঠাকুর্দাকে দিয়ে শুরু করে, তারপর তার বাবাকে, তারপর বিপিন ও রাধামাধবকে। মুখে যা আসবে তাই বলবে, কোনো রকমের রাখঢাক করবে না।
গালি আসলে কাকে দিচ্ছে মহেশ্বর, বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। আলাউদ্দিনও বুঝতে পারে। বুঝবেই তো। সে তো আর ম-লবাড়ির মাহিন্দার হাঁদারাম শৈলেন নয়। কিন্তু বুঝে কি হবে, কোন অভিযোগে সে মহেশ্বরকে ধরবে? কী করে বলবে গালিটা তো তুমি আমাকেই দিচ্ছ!
তবু একদিন ধরে বসল। মদ খেয়ে এলাকার পরিবেশ নষ্টের অভিযোগে মহেশ্বরকে হুমকি-ধমকি দিল। কিন্তু তার ধমকে কি মহেশ্বর ভয় পায়? সে কেন, খোদ জিয়ারত আলীও যদি তাকে ধমক দেন সে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। হুমকি-ধমকিতে সে আগে ভয় পেত। জোঁকের মতো কুঁকড়ে যেত, ইঁদুরের মতো গাঁতায় ঢুকে যেত। ভয় এখন তার ধারেকাছেও ভিড়তে পারে না। এক জাবেদ খান ছাড়া গ্রামের কাউকে সে খুব একটা গোনে না। কেউ তাকে চোখ রাঙালে সে পাল্টা চোখ রাঙায়। মহসিন মেম্বার একবার তাকে হুঁশিয়ার করল, ‘গ্রামে এরাম কাজ চলবে না বাপু।’ মেম্বারের মুখের কাছে মুখ নিয়ে সে বেশ শান্ত গলায় বলল, ‘চল্লি কী করবেন?’
মেম্বার চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল। সে পাল্টা চোখ পাকাল। গলাটা চড়িয়ে, বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলটা নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘উঁহু, কিচ্চু কত্তি পারবেন না। করার মতো কিচু তো নি মেম্বার শায়েপ। সব তো আগেই কুরে ফিলেচেন। পারবেন শুধু এখন মাইরে ফেলতি। কিন্তু এই যে মহেশ্বরটারে দিক্তেচেন’, তর্জনি দিয়ে বুকে টোকা মারতে মারতে বলে মহেশ্বর, ‘সে মরণে ভয় পায় না।’
মহসিন মেম্বার আর একটা কথাও বলল না। কোনোদিনও না। কিন্তু একটা হিন্দু মদ খেয়ে দিনের পর দিন এভাবে মাতলামি করবে, আলাউদ্দিনের কি সহ্য হয়? সে এই সমাজের মানুষ। সমাজের নিয়ম-শৃঙ্খলা বলে তো একটা কথা আছে। মহসিন মেম্বার না হয় নালায়েক, একটা হিন্দুকে শায়েস্তা করার মতো তার হিম্মত নেই। আলাউদ্দিন তো তার মতো নয়। বিস্তর ক্ষমতা তার। সে গরানপুর মাদ্রাসা কমিটির সহসভাপতি। গরানপুরে তাকে বাদ দিয়ে সালিশ-দরবার হয় না। হরিনগরেও তার ডাক পড়ে। পড়বে না? ছবেদালি চেয়ারম্যানের সঙ্গে যার হাত, আচার-বিচারে তো তাকে ডাকতেই হবে।
মহেশ্বরের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ করল আলাউদ্দিন। কে জানে চেয়ারম্যানের মনে কী ছিল, নালিশটা সে আমলে নিল না। উল্টো কড়া কথা শুনিয়ে দিল, ‘বাদ দ্যাও তো এসব। সব সোমায় তোমার এ্যাতো নালিশ শুনতি ভালো লাগে না। হিঁদুর জাত, মদ তো খাবেই। তোমার-আমার কী করার আচে? বাগ্দিগো দিকেচ না, থানাপুলিশও তো তাগো ঘ্যাঁটাতি যায় না।’
আলাউদ্দিন দমে গেল। তার পর থেকে আর কখনো মহেশ্বরকে ঘাঁটাতে যায়নি। রোজ রাতে মহেশ্বর গরানপুর বাজারে চিল্লাফাল্লা করবে―এটা এখন স্বাভাবিক ঘটনা। একদিন চিল্লাফাল্লা না করাটাই বরং অস্বাভাবিক। সবাই তখন বুঝে নেয় মহেশ্বর এখন কাজকামে ব্যস্ত। ধানের মরশুম লাগলে তার ব্যস্ততার শেষ থাকে না। তখন সে গেরস্তবাড়ির জোন খাটে। বাড়তি কিছু টাকা জমাতে পারলে সন্দেশখালী গিয়ে বিপিনের কাছে রেখে আসে।
গোপেশের সঙ্গে তার খাতিরটা জমে ধানের মরশুমে ম-লবাড়িতে জোন খাটতে গিয়ে। মরশুম লাগলে তো শৈলেন একা কুলিয়ে ওঠে না, দু-চারদিন বাড়তি একজন লোক লাগে। বাড়তি লোক হিসেবে মহেশ্বর এলো। চার দিন খেটেখুটে সব গুছিয়ে দিল। পাঁচ দিনের দিন গোপেশকে নিয়ে টেংরাখালীর দিকে রওনা হলো। কী যে হয়েছিল গোপেশের, নাকি মহেশ্বর তাকে জাদুটোনা করেছিল, মুখ ফুটে একবারও বলতে পারল না, না দাদা, আমি যাব না। ঘোরগ্রস্তের মতো মহেশ্বরের পিছে পিছে সে হাঁটা ধরল। মহেশ্বর তার হাতে যখন গেলাসটা ধরিয়ে দিল তখনও সে বলতে পারল না, না দাদা, আমি খাব না।
ওই ঘোরের মধ্যেই সে এক ঢোক গিলে ফেলল। গলাটা জ্বলে উঠল। নিচের দিকে যদ্দুর গেল ধীরে ধীরে জ্বলতে শুরু করল। নাকমুখ খিঁচিয়ে গেলাসটা মাটিতে রেখে সে উঠে দাঁড়াল, ‘এসব খালি তো প্যাট্টা ফুটো হুয়ে যাতি পারে মহেশদা!’
মহেশ্বর হাত ধরে টেনে আবার তাকে বসিয়ে দিল। গেলাসটা আবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘জীবনে একবার খালি কিচু হয় না।’
গোপেশ আরেক ঢোক খায়। তারপর গুম মেরে বসে থাকে। তার হাতে-পায়ে কাঁপুনি ধরে। বুকের ভেতরটাও বুঝি ধপধপ করে। হঠাৎ তার বাবার কথা মনে পড়ে। মনে হয় অন্ধকারে কোথাও দাঁড়িয়ে বাবা বুঝি তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছেন। এই বুঝি ছুটে এসে এক থাপ্পড়ে গালটা লাল করে দিলেন!
ততক্ষণে মহেশ্বরের মাথাটা ধরে আসে। গালটা ফোলা ফোলা লাগে, কথাগুলো জড়াতে শুরু করে, একটা বলতে আরেকটা বলে ফেলে। গেলাসটা খালি করে সে গোপেশের দিকে তাকিয়ে হাসে। ভুরুটা নাচিয়ে বলে, ‘এ্যাতো কী ভাবতেচ গোপেশ? জীবনডা ক’দিনের বলো? কের এ্যাতো বাচ্বিচার? এই পিতিবীতে তুমি তো আর কোনোদিন আসপা না। একবার মুরে গিলি কেউ কোনোদিন এরাম এট্টা গেলাস বাড়িয়ে ধুরে বলবে না, ন্যাও, খাও।’
গোপেশ মাথা নাড়ায়। আর এক ঢোকও সে খাবে না। মহেশ্বর খিক খিক করে হাসে, ‘আচ্চা বলো দিন দেকি মদ না খাইয়ে কেডা চিরদিন বাঁইচে আচে? নাই তো। দুনিয়াডা হুলো যমের আখড়া, থাকপে কেরাম কুরে! যম তোমারে মদ খালিও ধরবে, না খালিও ধরবে।’
সে-রাতে, নাকি তার পরের রাতে, নাকি তারও পরের রাতে জাবেদ খান প্রথম মহেশ্বরের সঙ্গে গোপেশকে মাতাল অবস্থায় দেখতে পেল। রাত তখন দশ কি সাড়ে দশটা। হরিনগর থেকে ফিরছিল সে। খানবাড়ির চৌরাস্তার মোড়ে এসে অন্ধকারে গলার আওয়াজ শুনতে পেল। কিন্তু সামনে পেছনে টর্চ মেরে কাউকে দেখতে পেল না। টর্চটা ঘুরিয়ে জমিনের দিকে ফেলতেই ঠাওর করল দুটো লোক প্রচ- শক্তি দিয়ে কী যেন ঠেলছে। ভাবল, ধানের বস্তা বুঝি নিচে পড়ে গেছে, দুজনে ঠেলে বস্তাটা বুঝি ওপরে তুলছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার টর্চ মারতেই দেখল বস্তা-টস্তা কিছু নয়, দুজনে রাস্তার মাটি ঠেলছে।
: গোপেশ না’ই?
: কেডা?
: গোপেশ?
: আরে কোন শালা?
জাবেদ খান তো অবাক। কপালে গিয়ে ঠেকল তার চোখ। গোপেশ তাকে গালি দিল! ব্যাপারটা কী? টর্চের আলোটা গোপেশের মুখের ওপর ধরলে পরে এক হাতে চোখ ঢেকে গোপেশ সোজা হয়ে দাঁড়াল।
: কেডা রে? খেঁকিয়ে উঠল মহেশ্বর।
: আমি…জাবেদ খান।
: ও, জাবেদ কাকা!
: কী কুত্তচ তোমরা ওকানে?
মহেশ্বর খিক খিক করে হেসে উঠল, ‘শোনো কাকার কতা। কাকার কি চোখ নি? দেক্তি পাচ্ছো না রাস্তার টেক সোজা কত্তিচি?’
কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারল না জাবেদ খান। ভয়ে তার শরীরে কাঁটা দেয়। এরা কি মানুষ? নাকি মানুষের সুরত ধরা জিন-ভূত! ঠেলে রাস্তার টেক সোজা করা কি মানুষের কাজ? ভারি তো অবাক কাণ্ড। টর্চটা ধরে রেখে সে গোপেশের পেছনটায় তাকাল। তার ছায়া পড়ল কিনা ভালো করে ঠাওর করল। মানুষ হলে নিশ্চয়ই ছায়া থাকবে।
হ্যাঁ, ছায়া পড়েছে। নিশ্চিত হলো জাবেদ খান। শরীরটা তার হালকা হয়ে এলো। টর্চের আলোটা সরাল না। গোপেশ ওপরে উঠতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে পড়ে গেল। জাবেদ খান আঁতকে উঠল। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে টেনে তাকে ওপরে তুলে আনল। মহেশ্বরের উঠতে কষ্ট হলো না। গোপেশের পেছনে এসে দাঁড়াল সে। গোপেশ দু-হাতে লুঙ্গির ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে জাবেদ খানের মুখোমুখি দাঁড়াল। সটান দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না – ডানে-বাঁয়ে ঢলে পড়তে চায়। কয়েকবার চেষ্টা করে পারল। মাথা নুইয়ে চোখ দুটো বুজে বলতে লাগল, ‘আমার নাম কিন্তু কাকা গোপেশচন্দ্র মণ্ডল। শুধু গোপেশ বুলে ডাকলি আমার কিন্তু কষ্ট লাগে। তুমি আমার কাকা, আমার বাবার মা’র প্যাটের ভাই। তোমার বাড়ির সামনে রাস্তার এ্যাতো বড় এট্টা টেক, তুমি চোকি দ্যাকো না? রাস্তার কোনো টেক্বেক থাকতি পারবে না, গোপেশচন্দ্র মণ্ডলের হুকুম। আমরা রাস্তার টেক সোজা কত্তিচি।’
উগ্র গন্ধ ঢোকে জাবেদ খানের নাকে। কিন্তু নাকে হাত চাপা দেয়ার কথা ভুলে বিস্ময়ে সে গোপেশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। গোপেশ সমানে বকে যাচ্ছে, আর মাথা দুলিয়ে তার কথার সমর্থন দিচ্ছে মহেশ্বর। তার মাথার দুলুনি দেখে বেজায় রাগ ওঠে জাবেদ খানের। টর্চ দিয়ে মাথায় তালুয় প্রচণ্ড একটা বাড়ি মারতে ইচ্ছে করে। কিন্তু না, একটা কথাও সে বলল না। টর্চটা নিভিয়ে অন্ধকারে বাড়ির পথ ধরল।
আর থামল না গোপেশ। প্রথম প্রথম মাসে একবার, তারপর দুবার। নেশাটা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। পনেরো দিন সে ধৈর্য ধরতে পারে না, প্রতি সপ্তায় অন্তত একবার তার মদ চাই। মহেশ্বরের আর টাকা লাগে না, টাকা দেয় গোপেশ। শুধু চোলাই নয়, মাঝে মধ্যে ইন্ডিয়ান মদের বোতল এনে গভীর রাতে বাড়ির বৈঠকখানায় অথবা চুনকুড়ির তীরে গোলপাতার মুড়াটার কাছে অথবা নৌকা নিয়ে মাঝনদীতে আসর বসায়। টাকায় টান পড়লে ধার করে। ধার শোধতে গিয়ে জমি বেচে। প্রথমে আধ বিঘা, তারপরও আধ বিঘা, তারপর এক বিঘা। এক বিঘা জমির দাম কম নয়। ছ-মাস আর টাকার চিন্তা থাকে না। তারপর আবার টান পড়ে। জমি বেচার জন্য উঠেপড়ে লাগে। কে তাকে বাধা দেবে? তাপসী? তার কি অধিকার? সে কি জমির মালিক? এক কড়া জমিও তো সে পাবে না। কেন পাবে? হিন্দু শাস্ত্রের কোথায় আছে বাবার সম্পদ মেয়েরা পায়?
তাপসী তবু বাধা দেয়, ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে। কখনো হাতটা চেপে ধরে শপথ করায়, ‘আর এক কাঠা জমিও তুই হাতছাড়া করিসনে ভাই। আমি না’ই পরের ঘরে যাবো, তোর বাকি জীবনটা তো পুড়ে আচে। কী খাবি ভবিষ্যতে? কী দে চলবি?’
গোপেশ কথা দেয়, না, এক কড়া জমিও আর বেচবে না। জীবনে কোনোদিন আর মদ ছুঁবে না। কিন্তু এক সপ্তাহ, বড়জোর এক মাস – তারপর দিদিকে দেয়া কথাটা আর মনে থাকে না। মনে থাকবে কী করে? দুর্ভাগ্য একবার পিছু ধাওয়া করলে সৌভাগ্যের সব বোধ তো সে ভুলিয়ে দেয়।
বেচতে বেচতে তিন বিঘায় এসে ঠেকল জমি, আর্থিক অনটন শুরু হলো সংসারে। তেল থাকলে সাবান থাকে না, সাবান থাকলে কেরোসিন থাকে না। দোকানপাটে বকেয়া বাড়ে। শৈলেনটাও যাই যাই করে। এত অনটনের মধ্যে সে বোঝা হয়ে থাকবে কেন? কিন্তু তার যাওয়া হয়ে ওঠে না। একটা মায়ার সুতোয় বাঁধা পড়েছে সে। দু-এক বেলা উপোস থাকতেও তার আপত্তি নেই।
এরই মধ্যে একদিন ঘরে আগুন লাগল। তাপসীকে নিয়ে গোপেশ সেদিন সন্দেশখালী পিসির বাড়ি গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরে খবরের পর খবর পাঠাচ্ছিল তাদের পিসি। তাপসীর জন্য সে একটা বর দেখে রেখেছে। বরপক্ষ মেয়ে দেখতে চায়। কিন্তু তাপসীর মত নেই, কিছুতেই সে সন্দেশখালী যাবে না। বলে, ‘দ্যাখার এ্যাতো শখ হুলে আইসে দিকে যাক না।’
এটা আসলে একটা ছুতো, তার উদ্দেশ্য অন্য। যতদিন ভাইটিকে একটা বিয়ে করিয়ে সংসারটা বউয়ের হাতে তুলে দিতে না পারছে ততদিন সে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। কিন্তু গোপেশ তা মানতে নারাজ। উপযুক্ত বোনকে ঘরে রেখে সে বিয়ে করবে কেন? তাছাড়া তার বয়সই-বা হয়েছে কত? বোনের একটা গতি হোক আগে, তারপর না হয় বিয়ে-থার কথা ভাববে।
দিদির বিয়ের খরচাপাতির জন্য দিদিকে না জানিয়েই আরো এক বিঘা জমি বেচে দিল। টাকাটা এবার নিজের কাছে রাখল না, তাপসীর হাতে দিয়ে বলল, ‘দু-বিঘে এখনো আচে, ওতেই আমার জীবন চুলে যাবে। আর তুই দেরি করিস নে দিদি। আর কদ্দিন? তোর মত পালি পিসিরে কতা পাকাপাকি কত্তি বলব।’
মতি ফিরল তাপসীর। ঠিকই তো, আর কতদিন? কুড়ি হলেই তো মেয়েরা বুড়ি। আর দেরি করলে শেষে সারাজীবন কপালে বর জুটবে না। তাছাড়া টাকাটা গোপেশ খরচ করে ফেললে আবারও সে জমি বেচবে। ছন্নছাড়া হয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে পথে নামতে হবে।
জগতীর কাছে ঘরের চাবি দিয়ে ভাইবোন দুজনে সন্দেশখালী রওনা হলো। শৈলেন মেলাদিন বাড়ি যায় না, সুযোগ পেয়ে সেও সঙ্গ নিল। যেদিন তারা গেল আগুন লাগল সেদিন রাতেই। লাগল, নাকি কেউ লাগিয়ে দিল কে জানে। শেষরাতে, ঝিঝিদের আদিম উল্লাসও যখন থেমে গেছে, তখন আগুন লাগলে কারো তো টের পাওয়ার কথা নয়। যখন টের পেল তখন আর রক্ষা করার মতো কিছু থাকল না। ভাগ্যিস, জগতী তার বাড়িতে ছিল। নইলে তাকেও পুড়ে মরতে হতো। ভোর পর্যন্ত ঘরে চিতার আগুন জ্বলল। পিঁড়িটা, ঝাড়ুটা, ভাত নাড়ার কাঠিটা, এমনকি ন্যাতাটা পর্যন্ত রক্ষা পেল না, পুড়ে সব হাপরের কয়লা।
তিনটা দিন কেটে গেল, গোপেশরা জানল না ঘরটা তাদের পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সন্দেশখালী থেকে গরানপুরের খবর তো জানার কথাও নয়। কে জানাবে? দুই দেশের ব্যাপার। কার এত ঠেকা বিডিআর-বিএসএফের চোখ এড়িয়ে এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে দুঃসংবাদটা জানিয়ে আসবে।
যে-রাতে ঘরটা পুড়ল সে-রাতেই বুঝি আলাউদ্দিনের মৃত্যুর দিন-তারিখ নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। প্রায় আড়াই মাস পর ত্রিরূপী আজরাইল মুকনোলির প্রান্তরে তার পথ আগলে দাঁড়াল। তখন চৈত্রের শেষ, মুকনোলির প্রান্তর বিরাণ। যেদিকেই চোখ যায় ধু-ধু মাঠ। আকাশে চাঁদ আছে। কিন্তু আলো এতই ক্ষীণ, কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার দূর করতে পারছে না। পথ চেনা না থাকলে সারা রাত হেঁটেও কেউ দিশা পাবে না, সারাটি রাত প্রান্তরেই ঘুরপাক খাবে। মহেশ্বর আগে আগে হাঁটছে, গোপেশ তার পিছে, মহব্বত সাজুনি সবার পিছে। তাপসীর বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করতে দুপুরে তারা সন্দেশখালীর উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। কিন্তু সীমান্তে গিয়ে বাধায় পড়ল। সীমান্তে কাক-পক্ষীও উড়তে দিচ্ছে না বিডিআর। নীলডুমুর হেড কোয়ার্টার থেকে বড় কোন অফিসার আসবে, বিডিআর তাই সতর্ক পাহারায়। সীমান্তে যাকে দেখছে খেদিয়ে দিচ্ছে। বাড়াবাড়ি করলে পাছায় ডা-ার বাড়ি দিতেও ছাড়ছে না। সারা বিকেল অপেক্ষা করল গোপেশরা, কোনোভাবেই সুবিধা করতে পারল না। ভেবেছিল সন্ধ্যায় হয়ত ক্যাম্পে ফিরে যাবে টহলপার্টি। কিন্তু না, রাত নটায়ও তাদের টহল থামল না। অগত্যা বাড়ির পথ ধরতে হলো তাদের।
তিনশ টাকায় সীমান্তের এক বাড়ি থেকে এক বোতল রাম কিনেছে গোপেশ। হাঁটতে হাঁটতে মহেশ্বরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাচ্ছে। মহব্বতকে সেধেছে কয়েকবার, সে নিল না। মদে তার আগ্রহ নেই। কাঁচা বয়সে একবার বাগ্দিপাড়ায় এক ঢোক খেয়ে তিনবার বমি করেছিল, তারপর আর কোনোদিন মুখে নেয়নি।
রামের নেশা জটিল। নেশার ঘোরে বিডিআরের চৌদ্দগোষ্ঠী ধরে গালাগালি করছে গোপেশ। মহব্বত চুপ। সে খানিকটা ক্লান্ত। মহেশ্বর খিকখিক করে হাসছে আর তালি মারছে। গালি গোপেশ একটা দিলে সে দেয় দুটো। মনের সুখে মন ভরিয়ে তারা গালি দিচ্ছে। কিন্তু কে শুনছে তাদের গালি! এই বিশাল প্রান্তরে সারা রাত চিৎকার করলেও তো কারো কানে পৌঁছবে না। তার ওপর দখিনা বাতাস তাদের চিৎকার ভাসিয়ে নিচ্ছে উত্তরে, প্রান্তর যেদিকে দিগন্তে মিশেছে।
হরিনগর বাজারের দক্ষিণে প্রাচীন তালবাগানটার কাছে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিল তারা, তারপর বড় রাস্তা পেরিয়ে আবার প্রান্তরে নামল। হরিনগর বাজারের কোথাও একটা আলোকবিন্দুও দেখা যাচ্ছে না। হাটবার ছাড়া রাত দশটার পর বাজারের দোকানপাট খোলা থাকে না। বাজার প্রান্তর আসমান জমিন সব কিছু নৈঃশব্দের চাদরে মোড়ানো।
মহব্বত তাড়া দেয়, ‘তাড়াতাড়ি পা চালাও, রাত কিন্তু ম্যালা হুয়েচে।’
কিন্তু পা কি চলে তাদের! এক পা বাড়িয়েই থমকে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কখনো বিডিআর, কখনো পুলিশ, কখনো আলাউদ্দিন, কখনো ছবেদালি, কখনো-বা জিয়ারত আলীর উদ্দেশে গালাগালি করে। ছবেদালি বাড়িতে দোতলা দালান তুলছে, এ নিয়ে মহেশ্বর দারুণ খাপ্পা। মহব্বতকে উদ্দেশ্য করে বারবার প্রশ্ন করছে, ‘এ্যাতো টাকা পেল কোনে ডেয়ারিং ছবু? কোনে?’
মহব্বত হি হি করে হাসে। সেও কম যায় না। হালের বলদের মতো দুজনের পিঠে দু-হাত রেখে জোরসে ধাক্কা মারে – হের…তি তি তি… হের…তি তি তি…। ধাক্কা খেয়ে তারা এক পা বাড়ায় তো ফের খুঁটি গেড়ে দাঁড়ায়। মহেশ্বর পেচ্ছাব করতে বসে, গোপেশ বিড়ি ধরায়।
প্রান্তরের মাঝামাঝি এসে, যেখানটায় আলাউদ্দিনের চিংড়ি ঘের, টর্চের আলো দেখতে পেল মহব্বত। জ্বলছে, নিভছে। কে জানে তার মাথায় কী ঢুকল, এবার সে থমকে দাঁড়াল। ঠাঁয় দঁড়িয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। তখনই বুঝি আজরাইল তার কাঁধে সওয়ার হলো। তার কানে কানে বলল, এই তো সুযোগ মহব্বত। এই নিশিরাতে কোনো সাক্ষী-সাবুদ থাকবে না।
আকাশের ভাঙা চাঁদ ছাড়া আর কোনো সাক্ষী রাখল না মহব্বত। মুন্সিগঞ্জ থেকেই বুঝি ফিরছিল আলাউদ্দিন, নাকি জেলাশহর থেকে কে জানে। তাকে তো মাসে অন্তত সাত-আটবার শহরে যেতে হয়। শহরে তার কত কাজ। নানা কাজে ছবেদালি চেয়ারম্যানকে শহরে যেতে হয়। সে চেয়ারম্যানের ডান হাত, সঙ্গে তো তাকেও যেতে হয়। তা ছাড়া আজ এই মামলার হাজিরা তো কাল ওই মামলার সাক্ষী। মহব্বতের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা তার লেগেই আছে। বাপ মরার পর পাল্টাপাল্টি মোট সাতাশটা মামলা হয়েছে দুই পক্ষে। মহব্বত একটা করলে আলাউদ্দিন করেছে দুটো। নিষ্পত্তি হয়েছে চব্বিশটা, চলছে আরো তিনটা। শেষ মামলাটা ঠুকেছে মহব্বত মাসখানেক আগে। মুকনোলির প্রান্তরে দেড় বিঘা জমির মাটি কাটিয়ে চিংড়ি ঘের করেছে আলাউদ্দিন। চারদিকে পাঁচ হাত উঁচু পাড়। বর্ষা এলেই গলদার পোনা ছাড়বে। মহব্বত কি এত সহজে ঘেরটা তাকে করতে দেবে? দেওয়ানি আদালতে সে মামলা একটা ঠুকে দিল।
তা হরিনগর বাজার পেরোতেই পায়খানার প্রচণ্ড বেগ পেল আলাউদ্দিনের। একবার ভেবেছিল চেয়ারম্যানবাড়ি গিয়ে কাজটা সেরে আসবে। কিন্তু এত রাতে যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে কোনোরকম চেপেচুপে ঘের পর্যন্ত এলো। পাড়ের ওপর জুতমতো বসে পেটটা খালি করল। ঘেরের চারদিকে একবার টর্চ ঘুরিয়ে পাড় থেকে নেমে পুব দিকে হাঁটা ধরল। সামনে টর্চের আলো ফেলেই চমকে উঠল সে। এত রাতে তিনটা লোক তার সামনে, সে একা – চমকে তো ওঠারই কথা। টর্চের আলোয় দেখল, চোখেমুখে বুভুক্ষু বাঘের হিংস্রতা নিয়ে তার সোদর তার দিকে তাকিয়ে আছে। পেছনে মহেশ্বর ও গোপেশ। মুখে কথা ফোটে না আলাউদ্দিনের। জীবনে প্রথমবারের মতো সে দারুণ অসহায়বোধ করে। তার মনে হয়, চেনা মানুষের রূপ ধরে খোদ আজরাইল যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে।
তাদের পাশ কাটিয়ে সে হাঁটা ধরল, অমনি পেছন থেকে থাবা পড়ল ঘাড়ে। মহব্বত এক ধাক্কায় তাকে মাটিতে ফেলে দিল। গলাটা চেপে ধরল মহব্বত, মুখটা চেপে ধরল গোপেশ। মহেশ্বর পা দুটো শক্ত করে ধরে রাখল। খুব জোরে একটা চিৎকার দিল আলাউদ্দিন। কিন্তু সেই চিৎকার গোপেশের হাতের তালু ভেদ করতে পারল না। গোপেশের দু-হাতে তখন বুঝি তার বাবা এবং বাবার বাবার সম্মিলিত শক্তি এসে জড়ো হলো, মুখটা সে এমন জোরে চেপে ধরল, আলাউদ্দিন আর দম ফেলতে পারে না। জবাই দেয়া পশুর মতো সে লাফায়। মহব্বত তার ঠ্যাং দুটো আরো জোরে চেপে ধরল। ততক্ষণ পর্যন্ত ধরে রাখল, যতক্ষণ না নিশ্চিত হলো তার চিরশত্রু আলাউদ্দিন আর লাফানোর চেষ্টা করছে না।