শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
অখিল পোদ্দারের বাড়িতে টু-শব্দ নেই। রাত প্রায় দুইটা বাজে। কেউ এখনো ঘুমায়নি। ছোট নিয়তিও এখনো জেগে বসে আছে।
জানা গেছে নোমানকে ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। স্যালাইন, অক্সিজেন নিয়ে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নোমানের দুই হাত কব্জি থেকে কেটে নিয়েছে। সেই হাত নিয়ে সদর্পে চার-পাঁচ যুবক বাজারের ভিতর দিয়ে হেঁটে গেছে। অখিল পোদ্দার দোকানে ছিলেন না। কিন্তু হরিপদ বণিক দেখেছে। সন্ধ্যার একটু পরপর। হরিপদ বণিকের দোকানে চার-পাঁচটি যুবক এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘দাদা, সিগারেট দ্যাও।’ হরিপদ সিগারেট বের করল। ওদের হাতে-গায়ে রক্ত-টক্ত দেখা যাচ্ছে। মনে হল পাখিটাখি মেরে এনেছে। যুবকদের দেখলে হরিপদ একটু কথাবার্তা বলে, বাড়তি খাতির রাখতে চায়। কখন কী হয় বলা তো যায় না। সে সিগারেট দিতে দিতে বলল, ‘কী পাখি মারলেন দাদা?’
এরমধ্যে স্বাস্থ্য ভাল বড়বড় চোখের ছেলেটি হাত উঁচু করে ধরল। বলল, ‘নিজের চোখে দ্যাখেন কী পাখি।’
হরিপদ প্রথম বুঝতে পারল না। আরো ভাল করে তাকিয়ে দেখল মানুষের কাটা হাত! সে সারা জীবন দেখেছে প্রতিটি মানুষের দুই হাতে দুটি পাঞ্জা। হয়তো কখনো কখনো দেখা যায় কারো একটি কোণা আঙুল বেশি, অথবা কারো একটি বুড়ো আঙুলের পাশে ছোট আরেকটি বুড়ো আঙুল। কিন্তু এ কি! বিচ্ছিন্ন হাতের কব্জির উপরের দিকে ধরে আছে, পাঁচ পাঁচটি আঙুলসহ পূর্ণ বয়স্ক মানুষের রক্তাক্ত হাত! হরিপদের মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল। সে দোকানের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
অখিল পোদ্দারের বাড়িতে এসে হরিপদ নিজে এই বর্ণনা দিয়ে গেছে। সে প্রত্যেকটি ছেলেকেই চেনে। কিন্তু মরে গেলেও তাদের নাম বলতে পারবে না! শুধু নিজেদের মধ্যে বলা যায়। অখিল বাবুর ঘরের চারদিকে ভালো করে দেখে সে ফিসফিস করে বলেছে, ‘দাদা, এর মধ্যে আছে মনা দপ্তরির ছাওয়াল লিটন, খোরশেদের ছাওয়াল ছক্কা – এইডা তো আগে চুরিটুরি করত!
নিয়তি বলল, ‘মা, নোমান কাকু হাত না থাকলে ভাত খাবে ক্যামনে?’
আল্পনা কোনো উত্তর দিল না।
নিয়তি আবার বলল, ‘কাকুর হাত ঠিক অবে না মা ?’
নিয়তির এসব প্রশ্ন শোনার কেউ নেই, উত্তরও দিচ্ছে না কেউ। সবাই খুবই চিন্তত। আল্পনা নিয়তির বাবাকে বললেন, ‘সুকুমার যে ঢাকায় গেল, ওর কোনো অসুবিধা অবে না তো?’
অখিল পোদ্দার কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, ‘ক্যামনে কবো? অইলে আর কী করার আছে। নোমানের এই বিপদে সে না যাইয়া পারে?’
‘নোমানের বাবা-মা গ্যাছেন সাথে?’
‘হ, মোয়াজ্জেম সাহেব নাকি হাসপাতালে সুকুমারের দেইখা কইছেন, ‘আর কী চাও, আমার একমাত্র ছেলেটারে তো শেষ পর্যন্ত খেলে।’
অখিল পোদ্দার নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার বললেন, ‘বেচারার মাথার কি ঠিক আছে? পরে নাকি মোয়াজ্জেম সাহেব সুকুমাররে জড়ায় ধইরা হাউমাউ কইরা কানছেন।’
শুধু অখিল পোদ্দারের বাড়িই না, রাত দুটোর মতো বাজলেও উপজেলা ও তার আশেপাশের গ্রামগুলোর অধিকাংশ হিন্দুবাড়ির বয়স্ক লোকজনই জেগে আছে। হিন্দু বাড়িগুলোতে যেন শোকের ছায়া পড়েছে। যে কোনো ঘটনা ঘটলেই হিন্দুদের নীরবে, সতর্কতার সঙ্গে তা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। এই ক্ষেত্রে ডাক্তার ব্যবসায়ী, দোকানের কর্মচারী ধনী-গরিব সব হিন্দু লোকেরই নজর থাকে। তার ওপর আজ এমন একজনের ওপর দিয়ে ঘটনা গেছে, যাকে হিন্দুরা নিজেদের ভরসার জায়গা মনে করে। সবাই এটাও জানে যে ঘটনার সূত্রপাতে আছে হেমেনবাবুর কাজের মেয়ে শ্যামলীর ধর্ষণ, অতঃপর খুন। মুসলমানরা উৎসাহ নিয়ে হাসপাতাল গিয়ে দেখে এসেছে। দোকানে দোকানে, বাড়িতে বাড়িতে হাত কাটার বর্ণনা চলছে। তারপর যথাসময়ে খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমাতে গেছে। কিন্তু হিন্দুদের সেই উপায় নেই। কেউ কেউ ভয়ে হাসপাতালেও যায়নি। কিন্তু ঘুম যেন হারাম হয়ে গেছে। রাত দুটোর সময় পীযূষকে সঙ্গে নিয়ে হরিপদ বণিক আরেকবার অখিল পোদ্দারের বাড়িতে এল।
পীযূষও হাসপাতালে গরম অবস্থার সময় উপস্থিত ছিল। সবাই মিলে আরেকবার তার কাছে ঘটনা শোনার দরকার আছে।
পীযূষ বলল, ‘হাসপাতালে অনেক লোক অইছিল। আমি গিয়া দ্যাখলাম নোমান ভাইর জ্ঞান নাই। রক্ত দেওয়া অইতেছে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম মানিক সরদার আসলো। সাথে ওসি সাব। লোকজনের ভিড় সরিয়ে দিল। নোমান ভাইর আব্বারে বুকে জড়াইয়া ধইরা মানিক সরদার কইল, ‘এর বিচার আপনে পাবেন। মাটির তলা খুইরা সন্ত্রাসীগো খুঁইজা বাইর করা অবে। সে যেই দলেরই হোক। বুঝেন না কারা এইগুলো করতেছে? সব আওয়ামী লীগরে দায়ী করার চক্রান্ত।’
অখিল পোদ্দার বললেন, ‘নোমানের আব্বা তখন কী কইল?’
‘সে কিছু কয় নাই। কওয়ার মতো অবস্থা কি তার আছে? তার চোখ দিয়া শুধু পানি পড়তেছে।’
‘না, মানিক সরদার তো ঠিক কতাই কইছে। এইসব কাম যারা করে তারা কি আর মানিক সরদারের কাছে জিগাইয়া করে?’
পীযূষ রাগের সুরে বলল, ‘আপনে কি কন কাকা, যারা করছে সব কয়ডা মানিক সরদারের লোক। এরাই তো শ্যামলীরে মারছে, সবাই জানে।’
‘কিন্তু এইগুলোর জন্য তো আওয়ামী লীগ দায়ী না।’
হরিপদ বণিক বলল, ‘না, আওয়ামী লীগ দায়ী হবে ক্যা? কয়েকটা মাস্তান নিয়া তো আর আওয়ামী লীগ না। আমরাও তো আওয়ামী লীগার। আমরা কি মানুষ মারতে যাই?’
পীযূষ আবার শুরু করল। বলল, ‘কাকা শুনেন, মানিক সরদার চইলা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আসলো টিপু সাহেব। সে মাথা নাড়াইয়া কইল, ‘আর কয়দিন এমুন চলবে? ডাইলের মজা তলায়। ক্ষমতা কারো কেনা না। আপনেরা শুধু দ্যাখেন, হিন্দু মুসলমান সবাইর উপর কী অত্যাচারডা চলতেছে। আমি মাহবুব সাহেবরে ফোনে জানাইছি। তিনি কইছেন, দৈনিক ইনকিলাব, দিনকালসহ পত্রিকাগুলারে জানাইতেছি, বিশেষ ক্যাপশানে খবর বাইর হবে।’
পীযূষ আবার বলল, ‘সে কী কয় জানেন? সে মোয়াজ্জেম সাহেবের কানেকানে কয়, এই ঘটনার পিছে কয়েকটা মালাউনেরও হাত আছে। ধৈর্য ধরেন কম্বলের লোম একটা একটা কইরা বাইছা দিব।’
আল্পনা বড়বড় চোখ করে সব শুনছেন। হরিপদ বলল, ‘ওই তো, যা হওয়ার তাই অবে। দেইখেন, সব দোষ গিয়া পড়বে হিন্দুগো উপর। কলাইর ডলায় মুসুরি চেপ্টা আর কি!’