শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
তরিকুল আজ তিনদিন রনিকে পড়াতে যায় না। অধিকাংশ সময় সে তার দোতলার ঘরটির ভেতরেই কাটিয়ে দিচ্ছে। বাড়ির কেউ এই ঘরটিতে বিশেষ ঢোকে না।
বহু কারণে তার মন ভাল নেই। কোথাও যেতে ভাল লাগছে না। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। দুপুরে মা কয়েকবার ভাত খেতে ডেকে গেছেন। তরিকুল যায়নি। একবার মনে হয়েছিল গান ছেড়ে দিলে মনটা ভাল হবে। উল্টো হয়েছে। গান শুনে আরো মেজাজটা বিগড়ে গেছে। দু’মিনিট পরেই বন্ধ করে দিয়েছে। এ সমস্যার সূত্রপাত নোমানের ঘটনার পর থেকে।
তরিকুল সিগারেট শেষ করে অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিল।
ঠিক তখন আস্তে করে ঘরের দরজাটা খুলে গেল। মা দাঁড়িয়ে আছেন। মায়ের পেছনে আরো কে যেন।
‘মা, দরজাটা বন্ধ করে দাও, আমি এখন ঘুমাবো।’
মা বললেন, ‘রনির আম্মা এসেছেন। তোর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাচ্ছেন।’
তরিকুল বিছানায় উঠে বসল। মা ঘরে ঢুকলেন। ঠিক তার পেছনে ঢুকলেন শায়লা। সে বলল, ‘খালাম্মা, ঘর গুমোট হয়ে আছে। জানালাগুলো খুলে দেই।’
‘হ্যাঁ, দ্যাখেন আপনি একটু বুঝিয়ে যান। আমার কোনো কথাই বুঝতে চাচ্ছে না।’
শায়লা একে-একে তিনটি জানালা খুলে দিলেন। মা নেমে গেলেন নীচে। জানালা খুলতে খুলতে শায়লা বলল, ‘হুম, গুমোট একেবারে! বিশ্রী সিগারেটের গন্ধ!’
তরিকুল কোনো কথা বলল না।
শায়লা বলল, ‘কী, সমস্যা কী?’
‘আমার কোনো সমস্যা নেই।’
‘সমস্যা তো নিশ্চয়ই, তিন দিন রনিকে পড়াতে যাওয়া হচ্ছে না।’
‘যাবো, মনটা একটু ভাল হলেই যাব।’
‘আমার ওপর কোনো কারণে মন খারাপ?’
‘নাহ্, সে অধিকার আমার আছে নাকি?’
‘তুমি ভাল করেই জানো, সে অধিকার তোমার আছে। সরি, আমি হঠাৎ করে তুমি বলে ফেলেছি।’
‘কোনো সমস্যা নেই। তুমি, আপনি, তুই – যা খুশি বলতে পারেন।’
শায়লা বেশ খানিক সময় চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘আমি কখনোই টিপু সাহেবের কাছে কিছু দাবি করি না। ইচ্ছা করে না। আনন্দও পাই না। তোমার কাছে টিপুর মূল্য যেমন, তারচেয়েও অনেক কম মূল্য আমার কাছে। সেটা তুমি ভালই বুঝতে পারো। তারপরও আমি নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে তারপর তাকে প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম।’
শায়লা আবার একটু সময় নিল, ‘বলেছিলাম, রনির শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নোমান। নির্দোষ ছেলেটিকে ওভাবে হত্যা করার উদ্দেশে যারা মারল, তাদের বিরুদ্ধে একটা মামলা হবে না, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না?’
শায়লা চুপ করে গেল।
শায়লার কথা বন্ধ হয়ে গেছে দেখে তরিকুল বলল, ‘কী বললেন উনি?’
শায়লা একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘গত তিনদিনে আমি অনেক ভেতরের কথা জানতে পেরেছি তরিকুল। আমরা, অর্থাৎ তুমি-আমি সবাই একটি নরকে বসবাস করছি! এটি কোনো মানুষের বসবাসের জায়গা হতে পারে না!’
‘আমি কি জানতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই জানতে পারো। কারণ নোমানের বিচার চাইতে গিয়ে আমি সব জেনেছি।’
‘কী সেটা?’
‘নোমানকে আঘাতের পেছনে প্রকৃত পক্ষে মানিক সরদারের কোনো হাত নেই।’
‘তার মানে?’
‘মানিক সরদার হল টিপিক্যাল আওয়ামী নেতা। ভেবে-চিন্তে না, ঝোঁকের মাথায় কথা বলে বসেন। নোমানকে আঘাত করার পেছনে আওয়ামী লীগের মানিক সরকারের না, প্রকৃতপক্ষে বিএনপি নেতা মাহবুব চৌধুরীর হাত আছে।’
‘কী রকম?’
‘বহু আগে থেকেই জামায়াতের হিটলিস্টে ছিল নোমানের নাম। জামায়াত মনে করতো, এ অঞ্চলের কিছু সরল সহজ বাউল সাধককে নিয়ে নোমান ইসলামবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছিল। এই আদর্শে মাহবুব সাহেব সম্পূর্ণ একমত। তিনিই টিপুকে সিগন্যাল দিয়েছেন জঞ্জাল দূর করতে। বিএনপি-জামায়াত কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলেছে। আরো ঘটনা জানো?’
তরিকুল কিছু বলল না। শায়লার দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকল।
‘শ্যামলী নামের যে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে, তার পেছনেও এক ভয়ানক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। এ অঞ্চলের হিন্দুদের আতঙ্কিত করা। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে হিন্দু-নির্যাতনের কলঙ্ক লেপ্টে দেওয়া। অবশ্য এর সবই সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগের দুর্বল চরিত্রের কারণে।’
তরিকুল বলল, ‘রনি ভাল আছে?’
‘হ্যা, তরিকুল, কোনো সতী সাবিত্রী বা রাবেয়া বসরি হওয়ার সখ বা সাধ্য আমার নেই। আমার একটা মন আছে, আমার ভালবাসতে ইচ্ছা করে। ভালবাসা পেতে ইচ্ছে করে।’
তরিকুল কিছু বলল না।
শায়লা বলল, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখানে আর থাকব না। ঢাকায় চলে যাব। এবং চিরদিনের জন্য যাব।’
‘ঢাকায় বাড়ি কিনছেন আপনারা?’
‘আপনারা মানে টিপু কিনছে কি না?’
‘হ্যাঁ।’
‘হয় তুমি বুঝতে পারোনি, অথবা না বোঝার ভান করছ। আমি টিপুর সঙ্গে থাকব না। ছেড়ে যাব।’
‘তাকে তো এত আমার এত খারাপ কিছু মনে হয়নি। টিপু সাহেব নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন। তুমি তাকে এত অপছন্দ কর?’
‘অপছন্দ নয়, ঘৃণা করি। কী করে জানো?
‘কী?’
‘বলতেই হবে?’
‘শুনি।’
‘আমার বাসায় দুটি কাজের মেয়ে দেখেছ না?’
তরিকুল অবাক হয়ে বলল,‘হ্যা!’
শায়লা চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘বৈপরিত্যে পুরিপূর্ণ মুলমানদের জীবনাচার। একদিকে নারীর পর্দা, অনার কিলিং, আরেক দিকে…।’
শায়লা একটু থামল। তারপর বলল, ‘একটা সত্যি কথা বলবে?’
তরিকুল মাথা নাড়ল।
‘আমি জানি, তুমি মনেমনে আমাকে ভালবাসো। ঠিক?’
তরিকুল একটু সময় চুপ করে থেকে বলল,‘হ্যাঁ।’
‘তুমি কি আমার সঙ্গে ঢাকায় চলে যাবে? চাকরি, ব্যবসা যা করতে চাও আমি ব্যবস্থা করব। আমার আব্বার দেওয়া দেড় কোটি টাকা আছে আমার কাছে।’
‘তোমার এ চিন্তা কি বাস্তবসম্মত?’
‘কেন নয়?’ শায়লার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিজের অজান্তে অথবা সিদ্ধান্ত নিয়ে তরিকুল তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেছে।
‘একসময় মোহ কেটে গেলে মনে হবে না যে কাপুরুষ, স্ত্রীর টাকায় ব্যবসা করছে?’
‘তুমি কী আমার ইচ্ছাকে মোহ বলে মনে করছ?’ শায়লা মুখ কালো হয়ে গেল।
তরিকুল দ্রুত বলল, ‘জন্মের পর থেকে মানুষের গোটা জীবনই তো মোহ।’
‘সেই মোহ কি স্থায়ী রূপ নিতে পারে না?’
‘হয়তো পারে, আমার জানা নেই।’
শায়লা আরেকটু কাছে এসে বসল,‘তা হলে তুমি কী করে বললে ভালবাসো? বলতে পারতে তোমার মোহ আছে।’
তরিকুল হাসল। বলল, ‘এসবই প্রেমবিষয়ক যুক্তির কথা। প্রেমিক প্রেমিকার আর্গুমেন্ট। আসল কথা হল বাস্তবসম্মত কিনা।’
‘যে কোনো কাজ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তা বাস্তব নয়, করা হলেই তা বাস্তবে রূপ নেয় তরিক।’
‘যুক্তি ঠিক।’
শায়লা বলল,‘আমি ভাল মানুষ তরিক। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো, আমাকে যা দেখছ আমি তার থেকে এক ফোটা আলাদা নই।’
হঠাৎ করেই তরিকুল হাত বাড়িয়ে দিল। শায়লা প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। তারপর নিজের হাত বাড়িয়ে দিল। তরিকুল দু’হাত দিয়ে শায়লাকে কাছে টেনে নিল- সুর করে বলল – চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল,
একথা বলিতে চাও বোলো।
এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল
তার পরে যদি তুমি ভোল….
শায়লা যখন ফিরল তখন সন্ধ্যা নামেনি। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল একটি অপরিচিত বাড়িতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। বাড়িটি কোনোক্রমেই নিজের অধিকারভুক্ত বলে মনে হচ্ছে না। বাড়ির সামনে প্রচুর লোক। পনেরো-বিশ জন হবে। এরা ইলেকশনের লোক। এ বাড়িতে ভিড় বাড়ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় নিয়েছে আজই। বিএনপির নানা ধরনের লোক গর্ত খুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগ বিএনপি এখন ‘কেহ কারো নাহি ছাড়ে’ অবস্থা।
শায়লাকে দেখে ছোটখাটো একজন লোক এগিয়ে এল। অতি বিনয়ের সাথে সালাম দিল। লোকটির বয়স বোঝা যায় না। অবশ্যই চল্লিশের উপরে বয়স। কিন্তু তুলনামূলকভাবে তরুণ মনে হয়। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। দু-একটি পেকেছে। পরনে একটা লুঙ্গি, গায়ে শাদা হাওয়াই শার্ট। মাথায় একটা গোল টুপি।
টিপু তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। মিটিমিটি হাসছে। বলল, ‘শায়লা, এরা সব উপজেলার লোক। বিএনপিতে প্রকাশ্যে যোগ দিতে এসেছে। উনার নাম আব্দুল ছাত্তার মোল্লা।’
ছাত্তার বলল, ‘জ্বি ভাবি, আমার বাপ একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাঁর কোনো মূল্যায়ন করে নাই। হেরপরও এতদিন চাপে পইড়া আওয়ামী লীগে থাকতে বাদ্য অইছি। কী করব? জান তো দিতে পারি না। আমরা এইবার কসম কাটছি ভাবি, মাহবুব সাবরে জিতাইয়া নিবই।’
টিপু লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে গর্বিত হাসি হাসছে। শায়লা শুধু বলল, ‘ও।’
এসব কোনোকিছুতেই শায়লার আগ্রহ নেই। কে জিতল, কে হারল তাতে কিছু আসে যায় না। তার দু’চোখ ভরা স্বপ্ন এখন। জীবনের ছাব্বিশটি বছর পার হয়ে গেছে। এই প্রথম সে স্বপ্ন দেখছে। ভেতরে ভিন্ন এক অনুভূতি, ভিন্ন এক তৃষ্ণার টান। মনে হচ্ছে আবার ছুটে তরিকুলের কাছে চলে যায়। সারাক্ষণ কানে বাজছে – এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল, তারপরে যদি তুমি ভোলো…