শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
শোক শোকের মতো প্রবাহিত হয়। কিন্তু জগৎ থেমে থাকে না। আস্তে আস্তে শোকের গায়ে আস্তরণ পড়তে থাকে। একসময় শোক মানুষের কাছে স্বাভাবিক পরিণতি হয়ে যায়। মানুষ ফিরে পায় স্বাভাবিক জীবনের গতি।
নোমানদের বাড়িতে আজ টেলিভিশন খোলা হয়েছে। নাটক-ফাটক দেখতে না। শুধুমাত্র খবর শোনার জন্য। নোমান পঙ্গুতে থাকার সময়েই তত্ত্ববধায়ক সরকার ক্ষমতাগ্রহণ করেছে। কিন্তু দলীয় সরকারের সময় যে তীব্র গতিতে সন্ত্রাস চালু হয়েছিল তার বেগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার থামাতে পারছে না। এমনকি একটু বাঁধার সৃষ্টিও করতে পারেনি। তাই এই নির্দলীয় সরকার প্রায়ই সন্ত্রাস দমনের কথা সরাসরি না বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাদের দায়িত্বের কথা বলছেন। তারা বলছেন, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে আমরা নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করব। এদের বক্তব্য বিবৃতি আমলাতান্ত্রিক। জনগণ এদের কথা পুরোপুরি ধরতে পারে না। এদের কথার মধ্যে বহু ফাঁক-ফোকর থেকে যায়।
রাত ৮টার বাংলা খবর শুরু হয়েছে। খুবই গরম গরম খবর। দেশের বাইরের পরিবেশও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি জায়গায় যাত্রীবাহী বিমান দিয়ে হামলা করা হয়েছে। মোট চারটি যাত্রীবাহী বিমান প্রায় একই সময় হাইজ্যাক করে এ হামলা চালানো হয়। সারাবিশ্ব স্তব্ধ হয়ে গেছে। নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভেঙে পড়েছে। ঠিক সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারের উত্তর টাওয়ারটিতে প্রথম হামলা হয়। এর ঠিক ১৭ মিনিট পর সকাল ৯টা ৩ মিনিটে দক্ষিণ টাওয়ারে আছড়ে পড়ে আরেকটি বিমান। ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে সুউচ্চ ভবন দুটি। কয়েক হাজার লোক নিহত হয়েছে বলে প্রাথমিক খবরে জানানো হয়! নিখোঁজ রয়েছে আরো অনেক লোক। ওয়াশিংটনের পেন্টাগন সদর দপ্তরে আঘাত হানা হয়েছে ঠিক সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে। আমেরিকা থেকে নতুন নতুন সব খবর আসছে। প্রাথমিকভাবে কারা এই সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ বলেছে এই হামলার জন্য আফগানিস্তানে অবস্থিত সৌদি আরব থেকে বিতাড়িত ধনকুবের ওসামা বিন লাদেন দায়ী। এই হামলা করেছে লাদেনের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক আল-কায়দা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছেন, যেই আক্রমণ করে থাকুক তার বিরুদ্ধে বা তাদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিশোধ নেওয়া হবে। তিনি আরো বলেছেন, ইটস্ এ ক্রুসেড। অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধ!
বিদেশের গরম খবরের সাথে দেশেরও প্রচুর উত্তেজনাপূর্ণ সংবাদ পাঠিকা পড়ে যাচ্ছে। খুন হত্যা চলছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একে অপরকে দায়ী করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু মাত্র ফেনীতেই খুন হয়েছে চারজন!
এক বিন্দু পরিমাণ স্বস্তির খবরও আছে। রাজধানীর তেজগাঁও থানা পুলিশ নাখাল পাড়া থেকে তিন হত্যাকা-সহ সাত মামলার আসামী কুত্তা লিটনকে গ্রেফতার করেছে। টুন্ডা হাসেম, মাইছ্যা কাদের, মুরগী মিলন এসবের পর দেখা যাচ্ছে কুত্তা লিটনও আছে।
খবর শুনলে একটু মন হালকা হবে চিন্তা করে মোয়াজ্জেম সাহেব নোমানের মাকেও এনে বসিয়েছেন। নোমানের মা আফিয়া বেগম স্থির তাকিয়ে আছেন টিভির দিকে। কথাবার্তা বলছেন না।
টিভিতে শেখ হাসিনার নির্বাচনী প্রচারণার খবর দেখানো হচ্ছে। এদেশের মানুষের বোধকরি কাম-কাজ নেই। একমাত্র কাজ বিশাল জনসভায় যোগদান করা। খণ্ড খণ্ড করে কয়েকটি নির্বাচনী সভার দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। প্রতিটিতেই হাজার হাজার মানুষ। গাছের ওপর পর্যন্ত মানুষ বসে আছে। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নৌকার বিজয় অবশ্যম্ভাবী, তাই ওরা দিশেহারা। একাত্তরের রাজাকার আর পঁচাত্তরের খুনীরা এক হয়েছে।’
আবার অন্য দৃশ্য আসলো। শেখ হাসিনা বলছেন, ‘আমরা ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। খালেদা জিয়ার সময়ে চল্লিশ হাজার মেট্রিকটন খাদ্য ঘাটতি ছিল। আমরা পূরণ করেছি। আমরা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছি…।’
আফিয়া বেগম হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বলতে থাকলেন, ‘আরে মা, আমরা তো খাবার চাই নাই, আমরা বাঁচতে চাইছি…. অথচ আপনের চোখে পড়ল না, আসল বিপদ চোখে পড়ল না…!’
তিনি কাঁদতে কাঁদতে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন।
সংবাদে এখন খালেদা জিয়াকে দেখানো হচ্ছে, তিনি হাত নাচিয়ে বলছেন, ‘আর কোনোদিন ওদের ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না, ওদের ভরাডুবি ঘটাতে হবে… আমরা দেশের সব হত্যা ও সন্ত্রাসের বিচার করব…. সন্ত্রাস দেশ থেকে নির্মূল করব এনশাল্লাহ…।’
ঠিক এমন সময় দরজার কাছে এসে দাঁড়াল তিন চারজন মানুষ। সবার চোখে মুখে ভয়ানক এক জ্বালা। এরা বাউল সম্প্রদায়ের লোক। তাদের দেখেই মোয়াজ্জেম সাহেব বুঝলেন এরা নোমানের সঙ্গে দেখা করতে চায়। তাদেরকে ঘরে আসতে বলে তিনি অন্য রুমে চলে গেলেন। একে একে ঘরে ঢুকল চারজন বাউল। সবার প্রথম মতি সাধু। সে হাত জোর করে আছে। বলল, ‘জয় গুরু, জয় গুরু।’
মতি সাধু হাসছে, কিন্তু তার চোখ দুটো অশ্রুতে টলটল করছে।
অনেকদিন পর নোমানের মনে যেন বেঁচে থাকার একটি ইচ্ছা জেগে উঠল। তাই কণ্ঠে এই প্রথম একটি আক্ষেপ প্রকাশ পেল। বলল, ‘জয়গুরু। কিন্তু আমি তো তোমার মত হাত উঠিয়ে জানাতে পারছি না।’
মতি সাধু বলল, ‘দিলের কারবার আমাগো। দিল কী কইল সেইটাই বড় কতা সাদু। বাইরের সব শোভা।’
মতি সাধু এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আর তিন বাউল কাঁদতে শুরু করল।
নোমান বলল, ‘কাইন্দো না সাধু। তোমার মত সাধকের জন্য কান্নাকাটি না।’
সাধু আরো জোরে কেঁদে বলল, ‘নিজেরে তো পাথর বানাইতে পারি নাই সাধু। পাথর বানাইতে পারি নাই।’
‘পাথর বানাও সাদু। নাইলে খালি কানবা।’
সাধু হাত জোর করে আছে। কান্না থামিয়ে বলল, ‘একটা ছোট আর্জি নিয়া আসছি তুমার কাছে। অধমরে ফিরাইবা না কও!’
একটু সময় নিয়ে নোমান বলল, ‘তুমি আমারে কোনো বিপদে ফালাইও না সাধু। জোর কইরা কেউ আমার হাত কাইটা নিতে পারে, কিন্তু বিপদে ফেলানোর ক্ষমতা খুব বেশি মানুষের নাই। তার মইধ্যে তুমি একজন।’
‘আমি সেই শক্তি নিয়াই তুমার সামনে হাজির হইছি।’
‘বল।’
‘তুমার এখন থিকা একজন মানুষ দরকার। সারা জীবনের জন্য দরকার। ময়নারে আমি সারা জীবনের জন্য তুমার দাসী বানাইতে চাই! জগতে কারো কাছে আমার কোনো দাবি নাই। আমি তুমার কাছে এই দাবী নিয়া আসছি। আমার সাধু ভাইয়েরাও এই দাবী নিয়া আসছে।’
মতি সাধু একটু থেমে বলল, ‘সাফ জামাকাপুড় ময়নারে কিনা দিতে পারি নাই। কিন্তু তার দিলটা সাফ কইরা দিছি তমি জানো। আমি তারে জোর করি নাই। ময়নাই তার মারে এই প্রস্তাব দিছে। আমি পর্থম বুঝতে পারলাম, বাপ জীবন আমার সফল হইছে।’
এই প্রথম নোমানের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মতি সাধু উঠে এসে যত্নের সঙ্গে নোমানের চোখ মুছে দিল। বিড়বিড় করে ভেজা চোখে বলল, ‘কি আনন্দ ধাম, সাধুসঙ্গ নাম / নয়নে হেরিলাম পূর্ণ মনস্কাম…।’