শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
শৈশব পার হওয়া কিশোরি নিয়তি এক ফুরফুরে জীবনে প্রবেশ করছে। শীতকাল ফুরিয়ে যাওয়ার পর প্রলম্বিত হাওয়ার মত শৈশব পার হওয়া কৈশোর। সকালের জলের ওপর নির্মল শাপলার মত ফুটে উঠছে। মা আল্পনা যখন মেয়ের দিকে তাকান তখন একই সঙ্গে যেমন ওর বড় হয়ে ওঠা উপভোগ করেন, তেমনি কেমন এক দুশ্চিন্তা তাঁর ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়ে যায়। যেন ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’ হয়ে উঠছে মেয়েটা। সব মায়েরই মেয়ের বড় হয়ে ওঠা দেখে কেমন যেন আতঙ্ক বোধ হয়। তিনি লক্ষ্য করেছেন, মেয়ের পা দুটো আর শিশুর পা নয়। স্বাস্থ্যবান পা দুটো ভারী হয়ে উঠছে। হাঁটুর নীচের অংশে মিহি কালো পশম উঠতে শুরু করেছে। বুক ইতিমধ্যেই ফুলে উঠেছে। বুক বেড়ে ওঠা থেকেই এই যন্ত্রণা শুরু হয়। পুরুষ লোকের সামনে গেলেই ড্যাব ড্যাব করে বুকের দিকে তাকিয়ে গিলতে থাকে। মাংসপি-ের দিকে ক্ষুধার্ত হায়না যে দৃষ্টি নিয়ে তাকায়, পুরুষগুলোর দৃষ্টিতেও সেই চাহনি। আল্পনার নিজেরও এই বয়স ছিল। সে জানে।
নিয়তিও এসব লক্ষ্য করছে। তার চেনা জগৎ খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। বেশ কয়েক মাস ধরে সে আর মা-বাবার সঙ্গে ঘুমায় না। তার আলাদা খাট হয়েছে। নিয়তির বড় ইচ্ছা করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকতে। কিন্তু বাবা-মা এখন আর তাকে বিশেষ কাছে ঘেষতে দেয় না। ছোটবেলার মত কাছে নিয়ে আদর করে না। মাঝে মাঝে ওর মন খারাপ হয়। কাঁদতে ইচ্ছা করে। নিয়তি নিজেও শুনতে পায় সে বড় হয়েছে। কিছু একটা করতে গেলেই সবাই বড় হওয়ার খোটা দেয়। তাকে চলতে হবে নিয়মের পথ ধরে। দু-তিনদিন আগে সে ঘরের সঙ্গে লাগোয়া পেয়ারা গাছটায় উঠেছিল। ছোটবেলা থেকেই সে এই পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ারা খায়। গাছে উঠে একটা মোটা ডালের উপর বসতেই নিয়তি দেখল পাশের বাড়ির জেঠি মা ওদের বাড়িতে ঢুকছেন। নিয়তির চোখে চোখ পড়তেই তিনি বলে উঠলেন, ‘এই ধাড়ি মাইয়া, গাছে উঠছিন ক্যান? নাম!’
নিয়তি অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেমে গেছে। অথচ জেঠি মা এক বছর আগেও গাছের নীচে দাঁড়িয়ে পাকা পেয়ারা দেখিয়ে বলতেন, ‘নিয়তি, ওই পেয়ারাটা ফেলা তো!’
নিয়তির পরেশপুর গ্রাম দৌড়ে বেড়ানোর পারমিশনও বাতিল হয়ে গেছে। মাত্র এক বছরের মধ্যে বেলাল, গৌতম, নয়নদের সঙ্গে খেলাধুলা বন্ধ হয়ে গেছে। ওদের সঙ্গে দেখলেই মা কড়া করে ডাক দেন, নিয়তি, ঘরে আয়! ওরাও কেমন যেন আগের মত স্বাভাবিক আচরণ করে না। কেমন যেন লজ্জা পায়। স্কুল ছাড়া খুব বেশি দূরে এখন আর যাওয়া হয় না। ঘরের আশেপাশেই ঘুরঘুর করতে হয়। মা এখন যত্ন করে চুলগুলো তেল দিয়ে বেঁধে দেন। শ্যামলা বর্ণের তেল চিকচিকে নিয়তি যেন আরো ফুটে ওঠে।
ওইদিন বিকেলে চুল বেঁধে দিতে গিয়ে নিয়তির মা চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হা-রে নিয়, রক্তটক্ত আসে নাকি?’
‘কীসের রক্ত?’
‘না, মানে তোর পুর্সাপের রাস্তায় রক্তটক্ত দেখিস?’
নিয়তি অবাক হয়ে বলল, ‘রক্ত দেখপো ক্যান্?’
মা বিব্রত হয়ে বললেন, ‘না আইলেও, আসপে। ভয় পাইস না কিন্তু, আমারে কইস।’
নিয়তি মায়ের কথা কিছুই বুঝতে পারল না। তবুও মুখে বলল, ‘আচ্ছা।’
নিয়তির গোলগাল শ্যামলা মুখটায় এক অদ্ভুত সরলতা আছে। এমনিতেই এ বয়সের ছেলে মেয়েদের মুখে এই সরলতা থাকে। নিয়তির যেন আরো মোলায়েম সরল মুখ। মা খুব ছোট করে কিন্তু দৃঢ় গলায় বললেন, ‘কোনো পুরুষ ছেলে ডাকলে কাছে যাবি না।’
এসবের অর্থ নিয়তি কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু একটা জিনিস সে বুঝতে পারছে যে চারদিকে সমাজ নিষ্কণ্টক নয়।
নিয়তিদের বাড়ি ঘেঁষে সাপের মতো বিছানো হয়েছে উপজেলার রাস্তা। এই রাস্তাই উপজেলা পার হয়ে চলে গেছে ফরিদপুর শহর পর্যন্ত। রাস্তার অন্যমাথা নিয়তিদের বাড়ি থেকে মাইল সাতেক উত্তরে কুতুবপুর পর্যন্ত গিয়ে দুই ভাগ হয়ে গেছে। নিয়তিদের বাড়ি থেকে উপজেলা বাজার তিন কিলোমিটার হবে।
কিছুদিন আগেও রাস্তাটা ছিল হেরিংবনবন। শব্দটা সে হেমেন দাদুর কাছে শিখেছে। রাস্তায় বিছানো পুরোনো ইট যখন শ্রমিকরা তুলতে শুরু করেছিল তখন জেনেছে।
সেদিন নিয়তির বাবা হেমেন দাদুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের ইট দেখছিলেন। নিয়তি পাশেই দাঁড়িয়েছিল। বাবা কি খুশি! নতুন রাস্তা হচ্ছে। বাবা অখিল পোদ্দার হেসে হেসে বলছিলেন, ‘কাকা, হেরিংবোম রাস্তা আর থাকছে না। পিচঢালা রাস্তা হয়ে যাচ্ছে।’
হেমেন দাদু বললেন, ‘হু, খুবই কাজের কাজ হল। হেরিংবোম নয় অখিল, শব্দটা হেরিংবন বন্ড। ইট বিছানোর স্টাইল অনেকটা হেরিং মাছের কাঁটার মতো বলে এর নাম হয়েছে হেরিংবন বন্ড।’
ইট তুলে মাটি ফেলা হল। তার ওপর বিটোমিনের মসৃন নীলচে কালো রাস্তা হল। ফলে নিয়তিদের বাড়িটা যেন একটু নিচু হয়ে গেছে। ভালই হয়েছে। দীর্ঘকালের স্মৃতি বুকে নিয়ে কয়েকটি গাছ উঁচু ডালপালা দিয়ে বাড়ি ঢেকে রেখেছে। মনে হয় যেন চালের ওপর ছাতি ধরে আছে। প্রখর রোদের তাপও গাছগুলো মাথায় ঠেকিয়ে রাখে। বাড়ির মধ্যে সব সময় একটা ঠান্ডা ভাব থাকে। প্রকৃতি একটা নিয়ম মেনে চলে। বর্ষা প্রকৃতির স্নানের সময়। সে স্নান করতে ভোলে না। বর্ষায় সময় যখন মুষলধারে বৃষ্টি হয়, তখনো টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়।
নিয়তির বাবার প্ল্যান আছে, এবার শীতের আগে বাড়ির দক্ষিণপাশে রাস্তার ধারের বড় আম গাছটি কেটে ফেলবেন। এ ছাড়া আর কোনো গতি নেই। এরই মধ্যে গাছটির তিরিশ হাজার টাকা দাম উঠেছে। টাকার চেয়েও বড় কথা গাছটির জন্য বাড়ির উঠানে রোদ পড়ে না। শীতের সকালে রোদ উঠানে না পড়লে চলে?
এই গাছটির নীচে আশেপাশের দু-একটি ছেলেপুলে নিয়ে নিয়তির হাড়ি-পাতিল সংসারের জগৎ ছিল। এখানে কুতকুত খেলার ঘর কাটা আছে। জ্যাঠাতো ভাইবোন ইঁদু আর শীলা চলে যাবার পর থেকে খেলা ঠিক জমে উঠছে না। ইদানীং খেলার ওপর ঝোঁকও গেছে কমে। এক নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে নিয়তির। চেনা অচেনা যত মানুষের সঙ্গে দেখা হয় সবাই হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরুষ মানুষগুলো। মুখের দিকে তাকালেও এক কথা ছিল। সবাই বুকের দিকে বড়বড় চোখ করে তাকায়। ওভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলে নিয়তি অস্বস্তি বোধ করে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন শির শির করে। মাঝেমধ্যে যুবক ছেলেরা উৎপাত করে। ফুলের কুঁড়ি পাপড়ি ছড়াতে শুরু করলে যেমন পোকামাকড় এসে সেই সদ্য ছড়িয়ে পড়া পাপড়ির ওপর এসে বসে, ঠিক তেমনি নিয়তিকে ঘিরে পুরুষ জমতে শুরু করেছে। জীবন যে শুধু বাবার কোলের নিরাপদ আশ্রয় নয় সে উপলব্ধি দ্রুত নিয়তির মধ্যে প্রবেশ করেছে।
কেন সে বড় হয়ে উঠছে? বড় না হলেই ভাল ছিল। বাবা আগে দুপুরে খেয়ে-দেয়ে দোকানে যাবার সময় সাইকেলের কেরিয়ারে বসিয়ে নিয়ে যেতেন। পথের দোকান থেকে কিছু কিনে দিয়ে বলতেন, ‘এক দৌড়ে বাড়ি যাও। আমি দোকানে গেলাম।’
সেই বাবা এখন দোকানে নিতে চান না। জোর করে যেতে চাইলে বলেন, ‘না, না, বাইরে যায় না। ঘরে থাক্। কী লাগবে বল, আমি নিয়া আসব।’
বাবা কেন বাইরে নিতে চায় না সেটা আরো স্পষ্ট করে বুঝতে শুরু করল নিয়তি। অতি প্রয়োজনে বাবা সঙ্গে করে বাজারে নিয়ে গিয়েছিলেন কিছুদিন আগে। জামার কাপড় কিনতে। কাপড় কেনা শেষে নিরঞ্জনকাকুর দোকানের কর্মচারী পীযূষকে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। নিয়তি পীযূষদাদার সঙ্গে রিকশায় উঠেছে। আগেও পীযূষের সাথে সে বাড়ি ফিরেছে। ওমা! আজ পীযূষদা কেমন জানি শুরু করল। একেবারে গা ঘেঁষে বসেছে। কথা বলতে বলতে বারবার নিয়তির থোড়ায় হাত রাখছে। মৃদু চাপ দিচ্ছে। অস্বাভাবিক লাগল নিয়তির। সে সরে বসতে চেষ্টা করল। এরপর পীযূষ এক ভয়ানক কা- ঘটিয়ে বসল। সে নিয়তির বুকের উপর চাপ দিতে শুরু করল। নিয়তি সেদিন রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়েছে। আরেকটু হলে ডান পাটা ভেঙে যেতো। বুকের ওপর চাপ দেওয়ার এ কাজটি যে খুবই অপরাধ সেটা নিয়তির বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে দৃঢ় গলায় বলেছে, ‘বাবার কাছে বইলা দিব!’
কীভাবে যেন নিয়তি জেনে গেছে, এসব বলতে নেই। এসব বলা যায় না।
একেবারে প্রথম দিকে সে প্রতিটি বিষয় মায়ের কাছে নালিশের সুরে বলতো। কিন্তু এখন সে বুঝে গেছে, এসব কোনো বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়। কোনো বনই হরিণের জন্য নিরাপদ নয়। নিজের শরীরের মাংসই হরিণের বড় শত্রু। চারদিকে ক্ষুধার্ত চোখ। কোনো প্রাণী দূরে দাঁড়িয়ে আহার দেখে, কোনোটা ঝাঁপিয়ে পড়ে ভক্ষণ করতে চায়। এই নিয়মের জগতে সারাক্ষণ নিজেকে বাঁচিয়ে চলাই যে মেয়েদের কাজ। কিন্তু তারপরও মাঝে মাঝে মায়ের কাছে কিছু না বলে পারা যায় না।
নিয়তি সেদিন আচার কিনে বাড়ি ফিরছে। সুকুমার কাকুদের বয়সের দু’জন তার পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করল। দু’জনের কেউ তার একেবারে অপরিচিত না। একজন তার সহপাঠী রেহানার বড় ভাই। রেহানার ভাইয়ের নামটা যে কি সে ভুলে গেছে, ও মনে পড়েছে, লিটন ভাই।
লিটন তার পাশের ছেলেটিকে খোঁচা দিল।
সাথে সাথে পাশের ছেলেটা নিয়তির দিকে তাকিয়ে গরম চা পান করার মতো আওয়াজ করে বলল, ‘পুদ্দারের মাইয়া। একটা মাল হইয়া উঠতেছে। হিন্দু মাইয়া গুলারে আল্লাহ ঢাইলা দিছে!’
লিটন খিকখিক করে হেসে বলল, ‘আল্লাহ না, ভগবান দিছে! ভগবান আবার রঙ্গলীলা পছন্দ করে।’
এসব কথার অর্থ নিয়তি আগে বুঝতে পারতো না। এখনো পরিস্কার বুঝে উঠতে পারে না।
লিটন হাঁটতে হাঁটতে নিয়তির আরো কাছে চলে আসলো। দাঁত বের করে হাসল, ‘নিয়তি কেমুন আছ?’
নিয়তি মাথা নেড়ে বলল, ‘ভাল আছি।’
‘নিয়তি, স্কুলে যাও তো, নাকি স্কুল ছাইড়া দিছ?’
‘যাই।’
‘পড়ালেখা করবা, ভাল কইরা পড়ালেখা করবা।’
নিয়তি মাথা দুলিয়ে সায় দিল। বাবাও এরকম পড়াশোনার কথা বলে।
লিটন বলল, ‘চলো একদিন সিনেমা দেইখা আসি।’
নিয়তি বলল, ‘না।’
‘কেন? সমস্যা কী?’
‘মা রাগ করবে।’
লিটন অবাক হওয়ার মত করে বলল, ‘সিনেমা দেখা তো খারাপ কিছু না! মার কাছে বলবা ক্যান, তুমি যাবা আমার সাথে চুপে চুপে!’
‘তাইলে ভাইয়া রেহানারে নিয়া যান!’
লিটনের চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। তারপরও হাসতে চেষ্টা করল। পারল না। মুখটা শক্ত হয়ে গেল। লিটন দাঁতে দাঁত চেপে, চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘ওই যে আজান দিতেছে শুনছ? তুমি একদিন ওই আযানের আওয়াজ পাইয়া মাথায় কাপড় দিয়া অজু করতে যাবা। অবশ্য নিয়তি নামটাই থাকবে। শুনতে খারাপ না। এরপর চোয়াল শক্ত করে বলল, একটু অপেক্ষা কর। ব্যবস্থা হইতেছে।’
নিয়তি কিছুই বুঝতে পারল না কীসের ব্যবস্থা হচ্ছে। কথা না বোঝার কারণে অবাক হয়ে দুবার লিটনের দিকে তাকাল।
লিটন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে নিজেই প্রশ্ন করে নিজেই আবার উত্তর দিতে থাকল, ‘বুজলানা কিছু? আমাগো পৌর চেয়ারম্যান সাহেবের নাম কী? হাসান আহমেদ খান। তাঁর স্ত্রীর নাম কী? কৃষ্ণা চক্রবর্তী। এইটা কেমনে অইল?’
নিয়তি কোনো উত্তর না দিয়ে আরো দ্রুত, লম্বা পা ফেলতে শুরু করল।
লিটন বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি হাঁটতেছ কেন? জোরে হাঁইটা বেশি দূর যাওয়া যায় না।’
তারপর বিড়বিড় করে লিটন বলল, ‘গনিমাতের মাল!’
নিয়তি আরো জোরে পা ফেলে বাড়ি পৌঁছে গেল। দূরে কোথাও মাইকে গান বাজছে। লিটন মাইকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গাইতে গাইতে সেদিকেই চলল, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ…।’
নিয়তি বাড়িতে পৌঁছেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে রান্না ঘরের সামনে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল।
মা আল্পনা বলল, ‘কী রে নিয়, দৌড়াদৌড়ি করতেছিস?’
তাঁর কথার উত্তর না দিয়ে নিয়তি বিরক্তির সঙ্গে জানতে চাইল, ‘গনিমাতের মাল কী মা?’
আল্পনা অবাক হয়ে বললেন, ‘গনিমাতের মাল? কোথায় শুনলি?’
নিয়তি জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে অভিমানের সুরে বলল, ‘রেহানার বড় ভাই লিটন ভাই আমারে কয় গনিমাতের মাল। তার সাথে আরেকটা লোক। সে কয়, পুদ্দারের মাইয়া, একটা মাল হইয়া উঠতেছে।’
আল্পনা একটু চিন্তা করলেন। শব্দটা তিনিও কোথাও শুনেছেন। ঠিক মনে করতে পারছেন না। তারপরও শব্দটার মধ্যে কোথায় যেন একটা অশুভ ইঙ্গিত আছে বলে মনে হয়। ঠিক যে ভয় তিনি পাচ্ছিলেন তাই শুরু হচ্ছে! মাল শব্দটার ব্যবহার সম্পর্কে জানা আছে। নিয়তির বাবা দোকানে যেসব জিনিসপত্র তোলেন তাকে বলেন মাল। আবার তিনি শুনেছেন অল্প বয়সের ছেলেরা সুন্দরী মেয়েদের বলে মাল। নিয়তির মা’র ভেতর দুশ্চিন্তা জেঁকে বসল। তিনি উঠান থেকে বাড়ির পাটখড়ির বেড়ার বাইরে এসে দাঁড়ালেন। চারদিকে ভাল করে দেখলেন। রাস্তার ওপারে, ডানে-বাঁয়ে নতুন নতুন ঘর উঠছে। সব অপরিচিত ঘর। কেমন যেন নি:সঙ্গ, প্রাণহীন একটা অনুভূতি তাঁকে জাপটে ধরল।
নিয়তির মা আল্পনা পোদ্দারের বয়স এখনো চল্লিশ হয়নি। তারপরও তিনি ইদানীং স্মৃতি রোমন্থন করতে শিখেছেন। এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসার পর চারপাশে যে পরিবেশ ছিল তা যেন দ্রুত পাল্টে গেছে। তিনি সদ্য ফেলে-আসা অতীত স্মরণ করেন। নিয়তির দাদু অর্থাৎ অখিল পোদ্দারের জ্যাঠা যতীন পোদ্দারের বাড়ি বছর দুয়েক আগে বিক্রি হলেও নতুন মালিক সেই বাড়িতে এতদিন ওঠেননি। গত দুই বছর ধরেই তারা বাড়ির চেহারা বদল করেছেন। বড় বড় আমগাছ, দেবদারু গাছ যা ছিল কেটে ফেলা হয়েছে। সেখানে মেহেগনির চারা লাগানো হয়েছে। দেশের মানুষ এখন গাছ লাগানো বলতে মেহেগনির চারা লাগানো বোঝে। গাছগুলো সব নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করছে।
যতীন পোদ্দারের যে কালীপূজার ঘর ছিল তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাড়ি হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে এখন পাশাপাশি পাঁচ ইঞ্চি গাঁথনীর দুটো স্যানেটারি ল্যাট্রিন তৈরি করা হয়েছে।
যারা বাড়ি কিনেছেন তারা সবকিছু তো নিজেদের মতো করেই সাজাবেন। তাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরও চোখের কোণে কোণে আল্পনা এই পরিবর্তন লক্ষ করেছেন। এ এলাকায় যত নতুন বাড়ি উঠছে সবই মুসলমানদের। দীর্ঘকালের পুরোনো ভিটা, পুরোনো কুয়ো, মন্দির সব ভেঙে দিয়ে, পুরোনো সব কালো হয়ে যাওয়া বিশাল গাছগুলো কেটে ফেলে ভিটা-বাড়িগুলোকে ন্যাড়া করে ফেলা হচ্ছে।
মুসলমানরা সব সময় নগদ চায়। ওই সামনের দত্ত বাড়িতে ১০০ বছরের পুরোনো গাছ কেটে এখন লাগেছে বিচি-কলা গাছ। বিয়ের পর যখন তিনি এ-বাড়ি আসেন তখন এই তো পাশেই যতীন জ্যাঠার বাড়ি কী গম্গম্ করত। সন্ধ্যায় শঙ্খ বেজে উঠত। চার-পাঁচটি নারীকণ্ঠ একসাথে উলুধ্বনি দিয়ে উঠত। চারদিকের বাতাসে ছড়িয়ে পড়তো ধুপের গন্ধ। জয়ন্তী ঠাকুরঝি বসত হারমোনিয়াম নিয়ে। গলা বেশ ভালই ছিল। আকাশ বাতাস ছাড়িয়ে গলা সাধত। কোনো কোনো দিন সন্ধ্যায় গান শোনাতে বসত। মনের ভুলে আল্পনা হঠাৎ হঠাৎ এখনো সকাল সন্ধ্যায় জয়ন্তী ঠাকুরঝি’র গলা শুনতে পান। সুন্দর শ্যামাসঙ্গীত গাইতে পারতো ঠাকুরঝি। দুইটা শ্যামা আল্পনার খুবই পছন্দের ছিল। একটার কথা – আমার হাতে কালি মুখে কালি, আরেকটার কথা – আমি তো না হয় মান করেছিনু তোরাতো সবাই ছিলি। আল্পনা শুনেছেন, দুইটা শ্যামাই নাকি কোন মুসলমান কবির লেখা। বুকটার মধ্যে হু-হু করে ওঠে। বাড়ির বাঁ পাশ দিয়ে একটা মাটির নতুন পায়ে হাঁটা পথ সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক বাড়ি ওপাশে একটি মসজিদ উঠেছে। মুসলমানরা সারাক্ষণ টুপি পড়ে ওই রাস্তা ধরে যাতায়াত করে। এ গ্রামে সন্ধ্যাবেলা এখন আর শঙ্খ বাজে না। উলুধ্বনির জোর কমে গেছে। এদিক ওদিক পড়ে থাকা দু-একটা বাড়ি থেকে ক্ষঢু কণ্ঠে উলুধ্বনি শোনা যায়। সেই স্থান দখল করে নিয়েছে মাইকের আজান। ভোরবেলা, দুপরে, বিকালে, সন্ধ্যায় উপজেলায় অনেকগুলো মাইক থেকে একসঙ্গে আজান দেওয়া হয়। বিশেষ করে ভোরবেলা এবং সন্ধ্যায় অনেক দূর থেকেও মাইকের আযানের শব্দ ভেসে আসে। আল্পনা যতীন জ্যাঠাদের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকলেন।
ওই বাড়িতেই আজ নতুন মালিক সপরিবারে উঠছেন। সেই উৎসব চলছে। বাড়ি ভর্তি পুরুষ মানুষ প্রায় সবারই গায়ে শাদা পাঞ্জাবি। মাথায় শাদা টুপি। মেয়েলোক কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তারা বাড়ির অন্দরে। একাধিক টিনের বেড়া দিয়ে ভেতরটা আড়াল করা হয়েছে। বেশির ভাগ মানুষের পরনে লুঙ্গি, কেউ কেউ লুঙ্গির সাথে চামড়ার জুতা বা রাবারের জুতাও পায়ে দিয়েছে। নতুন তোলা লম্বা বড় ঘর এবং বারান্দায় লোকজন সারি বেধে বসেছে। গমগম করে একসাথে অনেকগুলো পুরুষ কণ্ঠ আরবিতে গেয়ে উঠল – ইয়া নবী সালা মালাইকা…।
কেউ কেউ এখনো টুপি মাথায় দৌড়ে আসছে। দূর থেকে আল্পনা দেখলেন নিয়তির বান্ধবীর ওই ভাই লিটনও টুপি মাথায় দৌড়ে তাড়াতাড়ি অজু সেরে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করছে। নতুন ঘরের সামনেই ডেকচি ভর্তি রান্না হচ্ছে। খিচুড়ি হয়ে গেছে। এখন দুই চুলাতেই গোস্ত রান্না হচ্ছে। একদিকে সেই গোস্তের ঘ্রাণ, অন্যদিকে সবার গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া গোলাপজলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশে। সাথে সাথে দরুদ শরীফের জোর বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ।
দরুদ শরীফ শেষ হল। মৌলভি সাহেব জোরে জোরে দোয়া পড়লেন – নাহমাদুহু আনুসাল্লিয়ালা রাসুলিহিল করিম,আবতাদিউল ইসলায়াবি…।
এবার তিনি হাত তুললেন দেওয়া পড়তে। উপস্থিত সবার নিয়ম জানা আছে। সবাই একসঙ্গে দেখাদেখি হাত তুলল।
মৌলভি সাহেব শুরু করলেন, ‘হে আমার পরম করুণাময়, হে আমার রাসুলের বন্ধু, তুমি আমাগো সকলের হেফাজতকারী। তুমি ছাড়া এ অধম মানুষের কোনো গতি নাই।’
মৌলভি সাহেবের প্রার্থনা আর যেন শেষ হওয়ার না। শেষ দিকে তিনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপারে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর সাহায্য চাইলেন, ‘হে পরোয়ার দিগার, আইজ আমাদের মুসলমানদের চাইরটা দল এক হইয়া ইলেকশনে দাঁড়াইতেছে। তুমি তোমার বান্দাদেরকে সুবুদ্ধি দাও আল্লাহপাক। তুমি সব কিছু পারো। দ্যাশ চাইলা যাইতেছে জালিম গো হাতে হে পরোয়ার দেগার। এরা তুমার শাসন, আদেশ নির্দেশ মানে না। ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থা এইসব নাফরমানরা মানে না ইয়া গাফুর। ইয়া রহমান, চাইর দলের নেতা ঠিকই বুঝতে পারছে, জালিমদের হাতে দেশ থাকলে মসজিদ থিকা উলুধ্বনি শুনা যাবে। নাউজুবিল্লাহ।’
কেউ একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনারা দয়া কইরা কেউ যাবেন না। সামান্য একটু নেওয়াজের ব্যবস্থা আছে।’
কিছু কিছু দিনে মৌলভি সাহেবদের বেশি মর্যাদা থাকে। যেমন কুরবানি ঈদের দিন। অথবা মরা বাড়িতে। যার ঘনিষ্ঠজন মৃত্যুবরণ করে তার নিজেকে অসহায় মনে হয়। এই পৃথিবীটা শূন্য মনে হয়। তখন মৌলভি দেখলে মনে হয় আল্লাহর প্রতিনিধি আসছেন। তাদের কথা গুরুত্বসহকারে শোনা হয়। আজও মওলানা সাহেবের জন্য একটি বিশেষ দিন। একটি বাড়িতে লোক উঠছে। এটি চারটেখানিক কথা নয়। একটি নতুন বাড়িতে লোক উঠলে সেই বাড়ি শতশত বছর থাকে। সেই বাস্তুভিটা মানুষকে সামাজিক মর্যাদা এনে দেয়, কারো কারো বাড়ি বিস্তৃত হয়ে অনেক বড় হয়ে ওঠে। বাড়ির নামে বংশপরিচয় তৈরি হয়। সেখানে মিলাদ দেওয়াটা একটা অতি জরুরি বিষয়।
মৌলভি সাহেব খুকখুক করে কাশি দিতেই ঘরের ভেতরে গুনগুন আওয়াজ থেমে গেল। তিনি শাহজাহান পাটোয়ারীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাড়িডা ছিল হিন্দুগো। মিলাদের ব্যবস্থা কইরা আপনে খুবই ভাল কাজ করছেন। এই যে আমরা দরুদ শরীফ পাঠ করলাম, এর বড় জোর। তিরমিযি শরীফের হাদিসে আছে রসুলে আকরাম বলছেন, ধ্বংস হউক ওই ব্যক্তি, যাহার সম্মুখে আমার নাম উচ্চারিত হইল, অথচ সে উহা শুনিয়াও আমার প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ করিল না। অথচ দ্যাখেন বে-দ্বীনদের কানে এইডা পৌঁছে না। জানালা দিয়া দ্যাখেন কিছু হিন্দু মেয়েছেলে ফ্যালফ্যাল কইরা তাকাইয়া আছে। আল্লাহ্পাক্ অনেক ধৈর্যশালী।’
সামনে বসা জব্বার লস্কর বলল, ‘এখন এরা বুঝতেছে না মৌলভি সাহেব। কিন্তু একদিন এগো তওবা কাটতেই অবে। হা-রে হাশরের ময়দানে যাবি কোথায়?’
‘বললাম না, আল্লাহপাক অনেক ধৈর্যশীল। তবে আশাহত হবেন না। এরা ঠিকই পথে আসপে। সত্যের পথে। আমরাই একদিন এদের সত্যের পথে আসতে সাহায্য করব ইনশাল্লাহ।’
মৌলভি সাব আবার শাহজাহান মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরো একটা কাজ করতে হবে শাহজাহান মিয়া। বাড়িডারে যে একটা বান্দা দিতে অবে। চাইরটা নতুন মাটির বরতন আর কয়েক টাকার মেশ্ক্ জাফরান কিনা আমার কাছে দিয়া আইসেন। সুরা লেইখা বাড়ির চাইরপাশে বাঁন্দা দিতে অবে। আর শাহজাহান মিয়া, আয়াতুল কুরসীটা কিছুদিন নিয়মিত পড়া দরকার। বাড়ির মেয়েছেলেদেরও বলবেন, তারা মনোযোগ সহকারে যেন পড়ে।’
একটু থেমে স্মিত হেসে বললেন, ‘এই বাড়িতে হিন্দুরা পূজাটুজা করছে, এখানে তো আর ফেরেশতারা থাকবে না। দীর্ঘকালের বসতি। অনেক ব্যাপারস্যাপার আছে।’
পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘বাড়ির মধ্যে একটা পুরানো কুয়া দেখলাম শাহজাহান বাই।’
শাহজাহান পাটোয়ারী মৌলভি সাহেবের দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘কুয়ার পানিডা বড় ঠান্ডা। চিন্তা করলাম আছে – থাক…।’
পাশ থেকে একজন মিলাদে অংশগ্রহণকারী বয়স্ক বলল, ‘অমুসলমানের ব্যবহার করা কুয়া। তাও আবার হিন্দু বাড়ির। ঘুমাইতে পারবেন না।’
মৌলভি সাহেব একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, ‘অমুসলমানের ব্যবহার করা কুয়া, এইডা না রাখাই বালো। নানান ব্যাপারস্যাপার আছে। এখন দ্যাখেন আপনে কী করবেন। ইমাম সাহেব কী বলেন?’
মৌলভি সাহেবের পাশে বসা বাজার মসজিদের ইমাম। তাকেও দাওয়াত করে আনা হয়েছে। আলোচনার সময় জানালা দিয়ে তাঁরও চোখ পড়েছে বাহিরের স্বাস্থ্যবতী এক রমণীর দিকে। হিন্দু রমণী। ইমাম সাহেব ওই রমণীকে দেখে মনে মনে সন্তোষ বোধ করছিলেন। হযরত ইবনে মছউদ হতে বর্ণিত আছে, রসুল করিম এক কিবান স্ত্রীলোককে দেখিয়া সন্তোষ বোধ করিলে তিনি ছউদার নিকটে আসিলেন। ছউদা তখন সুবাসিত তৈল তৈয়ার করিতেছিলেন এবং অন্যান্য স্ত্রীলোকগণও তাঁহার নিকট ছিল। রসুল তাহাকে একটি নির্জন স্থানে লইয়া গিয়া তাহার সহিত প্রয়োজন পূর্ণ করিলেন।
ইমাম সাহেবও বাড়ি ফেরার তাগিদ অনুভব করছিলেন। তবে তাঁর স্ত্রী এই মহিলাটির মতো স্বাস্থ্যবতী না। গায়ে গোস্ত কম। নবিজীর স্ত্রীরা ছিলেন একেকজন একেক গড়নের। শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত সব বয়সের স্ত্রী তাঁর ছিল। নবীজী তাঁর স্ত্রীদের কাউকে বঞ্চিত করেন নাই। মাশাল্লাহ। বড়ই আনন্দের বিষয়। মৌলভি সাহেবের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ইমাম সাহেব বললেন, ‘এইডা রাখা আপনার ঠিক অবেনা শাহজাহান মিয়া। মৌলভি সাহেব ঠিকই বলেছেন।’
শাহজাহান সাথে সাথে বলল, ‘হ, ঠিকই ইমাম সাহেব, কাইলই এইটায় মাটি ফেলানে হাত দিব।’
ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমাগো সাথে তো হিন্দু গো কোনো জমিজিরাত নিয়া বিবাদ নাই। কিন্তু দ্যাখেন, আমি রাজবাড়ির বড় মওলানার কাছে শুনছি, হিন্দুগো উলধ্বনি যতদূর পর্যন্ত যায়, ততদূর পর্যন্ত শয়তান বিরাজ করে। ওই উলুধ্বনি শুনতে শয়তানের আনন্দ হয়, নিজেকে নিরাপদ মনে করে।’
ওদিকে আল্পনা একটু দূর থেকে মানুষগুলোকে দেখে তারপর বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। যতীন কাকার বাড়ি থেকে যে সুর ভেসে আসল, এই সুর তিনি আগেও একবার এক মসজিদের পাশ দিয়ে যাবার সময় শুনেছেন। রান্নার গন্ধও একটু আধটু নাকে ভেসে আসছে। ভগবান জানেন কীসের মাংস রান্না হচ্ছে। তাঁর বুক ধুকধুক করছে। কেন তিনি জানেন না।
নিয়তি বলল, ‘যতীন দাদুর বাড়িতে আইল যে তার নাম কী মা?’
‘নাম শাহজাহান পাটোয়ারী।’
‘শাহজাহান পাটোয়ারী। হি: হি: হি:। পাটোয়ারী মাইনসের নাম অয়? হি: হি: হি:।’
আল্পনা চাপা ধমক দিলেন, ‘চুপ কর? মুসলমানগো এমুন নামই অয়, হাসি থামা!’ নিয়তি আবার বলল, ‘পাটোয়ারী হি: হি: হি:।’
আল্পনা এবার তার পিঠে আলতো জোরে কিল দিয়ে বললেন, ‘মানা করলাম না তোরে। খবরদার! ওগো সামনে কোনো সুময়…।’
কারা যেন বাড়ির ভেতরে আসছে।
নিয়তিও হাসি থামিয়ে অবাক হয়ে সেদিক দেখল। তার মায়ের চেয়ে একটু বেশি বয়সের একজন মহিলা। সাথে সেলোয়ার কামিজ পরা বড় একটি মেয়ে। নিয়তির চাইতে বেশ বড়। ২০-২৫ বছর হবে।
তাদের কারো মাথায় সিঁদুর নেই। হাতে শাঁখা নেই। মহিলার গায়ের কাপড়টা ইন্ডিয়ান প্রিন্ট না। দেশীয় সূতি। শাদা জমিনে সবুজ লতাপাতা আঁকা। ব্লাউজের রং খয়েরি। একটু মোটা হলেও তার চেহারা বেশ। গায়ের রংও ভালো। তারপরও শাঁখা-সিঁদুর না থাকায় কেমন ফ্যাকাশে লাগছে। সাথের মেয়েটাও ওড়নার একপাশ দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। আল্পনা অনুমান করলেন এরা শাহজান পাটোয়ারীর স্ত্রী এবং মেয়ে হবেন। আগেও তিনি দূর থেকে দেখেছেন।
মহিলার হাতে সিলভারে ঢাকুন দেওয়া একটা বাটি। তিনি কাছে এসেই নিয়তির মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
নিয়তির মাও হাসলেন।
মহিলা বললেন, ‘আদাপ বৌদি। আপনে তো আমাগো চেনেন না মনে অয়। আমরা আইজই নতুন বাড়িতে উঠলাম। ওর বাপের নাম শাহজাহান পাটোয়ারী।’
আল্পনা পলকের মধ্যে নিয়তির দিকে চাইলেন। না, সে হাসেনি। মন দিয়ে তার চেয়ে বড় যুবতী মেয়েটিকে দেখছে।
আল্পনা ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘না, না, চিনবো না ক্যান? আমি আফনেরে চিনি। আফনে মাঝে-মধ্যে বাড়ি দ্যাখতে আসতেন। তহন দেখছি। পরিচয় হয় নাই।’
‘এহনতো পরিচয় হইল। এহন তো আমরা বৌদি পর্তিবেশী হইয়া গেলাম। পর্তিবেশী হইল সবচাইতে বড় আত্মীয়। আইজ আমার একটা বিপদ অইলে সবাইর আগে আফনে দৌড়াইয়া যাবেন। আফনেগো কোনো বিপদ অইলে আমরা….’
‘তা ঠিকই, বিপদের বন্ধু হইল সবচাইতে বড় বন্ধু।’
পাটোয়ারীর বৌ বললেন, ‘আইজ আর বেশি কথা কবো না। বাড়ি ভরা মানুষ, মিলাদে আইছে।’
এতক্ষণ বাটি তার হাতে ধরাই ছিল। এবার নিয়তির মা’র এগিয়ে ধরে বললেন, ‘বৌদি মিলাদের একটু নেওয়াজ আনছি, কয়টা জিলাপী, যদি রাখেন। আপনেগো আবার কোনো সমস্যা নাই তো?’
আল্পনা এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন। সেই এক মুহূর্ত এত দ্রুত যে গভীর চোখে লক্ষ না-করলে দেখা যাবে না। তিনি জিলাপীর বাটি হাতে নিলেন।
‘তাইলে আইজ আসি বৌদি। আফনে কিন্তু যাইয়েন। হিন্দু-মুসলমান কোনো ঘটনা না বৌদি। আত্মার সম্পর্কই বড়’।
মহিলা নিয়তির দিকে ফিরে বললেন, ‘এই মেয়ে কি আফনের? কী সুন্দর চেহারা! তোমার নাম কি?’
‘নিয়তি রাণী পোদ্দার।’
‘বাহ্ সুন্দর নাম। তুমি যাইও মাঝেমইধ্যে।’
দুই বাড়ির মাঝখানে ছোট একটি পায়ে হাঁটা পথ। পথও ঠিক না, হাঁটাহাঁটিতে একটা গভীর দাগ বসে ছিল। সেই দাগ অনেকটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে দু’বছর না হাঁটাতে। ছোটখাটো দু-একটি কাটা গাছও হয়েছে।
মাত্র কয়েক গজের এই পথে সাবধানে পা ফেলতে ফেলতে শাহজাহান পাটোয়ারীর স্ত্রী নিচু গলায় মেয়েকে বললেন, ‘ক দেহি রিনা, ওরা কি জিলাপী খাবে না ফালায়ে দিবে?’
মেয়ে ঠোট উল্টিয়ে বলল, ‘কী জানি মা। খাইতেও পারে, নাও খাইতে পারে। তাও আবার মিলাদের জিলাপী।’
মা বললেন, ‘খাবে না রে, জাতে মালাউন। অত সোজা না।’
রিনা বলল, ‘এখন হিন্দুরা অনেক চেঞ্জ হইছে। শুনছি আগে হিন্দুর বাড়ির উপর দিয়া হাঁইটা গেলে সেই জায়গা দিয়া গোবরের ছিটা দিত। এখন ওরা অনেক পাল্টাইছে।’
রিনার মা বললেন, ‘হুম! কে কইছে তোরে পাল্টাইছে। অনেক চালাক হইছে। আগে যখন গোবর ছিটাইতো, মুসলমানরাও জানতো ওই বাড়ির উপর দিয়ে যাওয়া যাবে না। এখন মিষ্টি করে হাসে। কয়, আসেন দাদা। আর মনে মনে কয়, শুয়োরের বাচ্চা মুসলমান! শুনিস না, মাইনসে কয়, হিন্দু অয়না বন্ধু?’
আল্পনা পোদ্দার সত্যিই জিলাপী নিয়ে বিপদে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে তিনি আগে কখনো পড়েননি। সারা জীবনে মুসলমানের হাতে একগ্লাস জলও খাওয়া হয়নি। নিজের বাবার বাড়ি বালিয়াকান্দির হিন্দুপাড়ায়। সেই বাড়িতেও তাঁর গণ্ডি ছিল উঠান পর্যন্ত। দু-একটি জ্ঞাতি বাড়ি ছাড়া গোটা সমাজের সঙ্গে তাঁর উঠা বসা হয়নি। ফলে মুসলমান সমাজ তাঁর কাছে অপরিচিতই রয়ে গেছে। তাঁর জীবনে মুসলমান বলতে একজন। সুকুমারের বন্ধু নোমান। নোমানকে সে মাঝেমধ্যে ভাত বেড়ে খাইয়েছেন। এখনো ঢাকা থেকে এলে খাওয়ান। এর মধ্যে তিনি উচিত-অনুচিত দেখার সুযোগ পান না। উচিত অনুচিত খোঁজার ইচ্ছাও হয় না।
কিন্তু আজকের জিলাপীর ব্যাপার ভিন্ন। মিলাদের জিলাপী কি করবেন সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই।
নিয়তির বাবা বাড়ি ফিরতেই আল্পনা কাঁসার ঘটিতে জল নিয়ে এগিয়ে গেলেন। বারান্দার সামনে পা না-ধুয়ে তিনি ঘরে ঢোকেন না।
অখিল পোদ্দার ঘটি হাতে নিতে নিতে বললেন, ‘কী হইছে?’
আল্পনা ছোট করে বললেন, ‘কই?’
‘তুমারে চিন্তিত মনে হইতেছে যে?’
আল্পনা ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘তেমুন কিছু না। ছোট একটা ঝামেলায় পড়ছি।’
‘কী ঝামেলা আবার?’
‘ওই বাড়ি থিকা পাটোয়ারীর বৌ আর মাইয়া আসছিল। ওরা মিলাদের জিলাপী দিয়া গেল, এখন এইগুলো কী করব?’
অখিল পোদ্দার একটু চিন্তা করে বললেন, ‘কী করবা, খাইয়া ফেল। এখন আর এইগুলা বাদ-বিচারের দিন নাই, চাইরদিকে সবই মুসলমান ঘরবাড়ি হইতেছে। এতসব মাইনা চলা মুশকিল। দ্যাখতেও ভালো দেখা যায় না।’ তারপর হেসে বললেন, ‘অভ্যাস কর। এই যে তুমার সুকুমার। সে তো খায়ও নোমানগো বাড়ি, আবার পইড়া থাকে সেইখানেই। ভালই হইতেছে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কইমা যাবে।’
একটু থেমে বললেন, ‘আমারে একটু পান বানায় দেও, যাই দোকানের দিকে।’