শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
আজও অখিল পোদ্দারের ভালো ঘুম হল না। বিছানায় শুয়ে কতক্ষণ এপাশওপাশ করলেন। নানা কথা চিন্তা করতে করতে সকাল হয়ে গেল। তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। দোকানে যাওয়ারও তাড়া নেই। তবুও একবার যাওয়া দরকার। আজ দোকান করা যাবে কি না সন্দেহ। তবে তার একটা ভরসা আছে। বিএনপি আওয়ামী লীগের যখন যে চাঁদার জন্য গিয়েছে তিনি তার সাধ্যমত দিয়েছেন। তার ওপর কারো রাগ থাকার কথা না। তবুও সাবধানের মার নেই। তিনি আল্পনাকে বললেন, ‘দেখ তো, পীযূষ বাইর হইয়া গ্যাছে, না বাড়ি আছে?’ আল্পনা দেখতে গেলেন।
পীযূষ বাড়িই ছিল। সে আল্পনার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসল। অখিল পোদ্দার বললেন, ‘অবস্থা কী রে?’
‘অবস্থা আর কী? বিএনপি জিতা গ্যাছে বুঝাই যাইতেছে।’
‘না, তা-না। আমি জিগাইতেছি আমাগো উপজেলার অবস্থা কী?’
‘ও, উপজেলার অবস্থা ভালোই মনে অইতেছে।’
‘দুকানে যাওয়া যাবে রে? তোর কী মনে অয়?’
‘তা যাবে কাকা, হরিপদ কাকু গ্যাছে। আমিও যাব।’
অখিল পোদ্দার দোকানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বসে থেকে লাভ নেই। ঘর থেকে তো বের হতে হবে। তা ছাড়া নির্বাচন হয়ে গেছে গতকাল। ঝামেলা হলে তো গতকালই হওয়ার কথা ছিল। এখন আর কী?
আজ সুকুমার বাড়ি নেই। দুপুরে খেতে আসেনি। একটু সরে আছে। কাল হয়তো চলে আসবে। গতকালের নির্বাচনের প্রায় সব ফলাফল চলে এসেছে। উপজেলার সবখানে বিএনপি জামাতের লোকজনরা আনন্দ ফূর্তি করছে। বেশ কয়েকটি মাইকে গান বাজছে। সারাদিন বেশির ভাগ সময়ে একটি দেশাত্মবোধক গান বাজছে – প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ। আল্পনা রাজনীতি বোঝেন না। কিন্তু এটুকু বুঝেছেন যে নৌকা মার্কা অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এবার বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তবে যাহোক সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। বিশেষ কোনো ঝামেলা হয়নি।
সন্ধ্যাবেলা আল্পনা গোয়াল ঘরে ধূপ দিয়ে এসেছেন। অখিল বাবুদের বাড়িতে সব সময় দু-একটি গরু থাকে। অতিরিক্ত খাটাখাটুনি হলেও তারা কষ্ট করে গরু পালেন। বাড়িতে দুধের দরকার। খাঁটি দুধ পাওয়া যায়। তাই এখনো দুটি গরু আছে।
আল্পনা হঠাৎ কান সজাগ করে শব্দ শুনলেন। গরু ঘরে শব্দ হচ্ছে। চোর-চামার এলো কি-না কে জানে! তিনি আবার শুনেছেন মা মনসা গরুর দুধ খুব পছন্দ করে। গরুর পা-শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে নাকি দুধ খায়। গরু তখন বিশেষ নড়তে পারে না। আল্পনা সাহস করে বাতি নিয়ে বের হলেন।
আজকের আবহাওয়া ভালো। বৃষ্টি-বাদল নেই। আকাশে জ্যোৎ¯œার আলো থাকলেও তা বাড়ির ভেতরে পড়েনি। গাছের মাথাগুলো চিকচিক করছে। নীচে গোয়াল ঘরের দিকটা গাছের কারণে গাঢ় অন্ধকার।
আল্পনা কুপি হাতে বের হয়ে এলেন। হাতের কুপি তিনি মাথার কাছে উঁচু করে ধরে তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখতে চেষ্টা করলেন। আল্পনা দেখলেন, লাল গরুটা বের হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত পায়ে গরুর কাছে চলে এলেন। আদর করে বললেন, ‘এই বেটি কই যাস্।’ বলেই তিনি থমকে গেলেন। একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে!
‘কে!’ বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞেস করলেন।
লোকটি কোনো কথা বলল না। আল্পনার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে।
চোখের কোণা দিয়ে আল্পনা দেখলেন কালো গরুটাও বের হয়ে আসছে। পেছনে অন্ধকারের মধ্যে আরো দুজন গরুর পেছনে!
‘আমাগো গরু নিতেছেন কোথায়!’
কে যেন ঠান্ডা গলায় বলল, ‘গরুর ভাগা হবে। চাইলে এক ভাগ নিতে পারেন হেঃ হেঃ। জবর গোস্ত অবে।’
আল্পনা কী করবেন দিশা পাচ্ছেন না। এদিক ওদিক চাইতেই তার রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। হাত-পা অবশ হয়ে আসল। এক দল মানুষ তিনি লক্ষ করেন নাই! অন্তত ১০ জন! নিঃশব্দে অন্ধকার থেকে তার দিক এগিয়ে আসছে! দপ্ করে তার হাতের কুপি নিভে গেল! তিনি ‘নিয়তি’ বলে চিৎকার করতে গেলেন। ঠিক তখনই কে যেন পেছন থেকে শক্ত করে তার মুখ চেপে ধরল।
নিঃশব্দ বাড়িটিতে পড়ার টেবিলে নিয়তি বসে আছে। হঠাৎ মনে হল মা উঠানে কার সঙ্গে যেন কথা কয়?
নিয়তি চেয়ার ছেড়ে উঠতেই দেখল ঘরের ভেতর হুড়মুড় করে ঢুকছে চার-পাঁচজন মানুষ। সবে শৈশব পার হয়ে আসা নিয়তির কোনো ধারণাই নেই কী হতে যাচ্ছে। হায়না যেভাবে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করে, ঠিক তেমনি শক্তিশালী সব হাত নিয়তিকে টানাটানি শুরু করল। চ্যাং দোলা করে নিয়তিকে বের করে নিয়ে এল ওরা।
আল্পনা চিৎকার করতে চাইলেন। ইতোমধ্যেই তিনি রীনাদের বাড়ির দিকে দেখলেন। সেই বাড়ির সব জানালা-দরজা বন্ধ! আল্পনার মুখ দানবের মত চেপে ধরেছে। বেশ কয়েকজন শক্তিশালী মানুষ তাঁকে দ্রুত বাড়ি থেকে দূরে কোথাও নিয়ে চলেছে। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে হাত-পা নাড়াতে চেষ্টা করছেন। কোনো উপায় নাই! বলির পাঁঠার মতো তার সামান্য নড়াও সম্ভব হচ্ছে না! এর মধ্যে একটি হাত তাঁর কান খুঁজে নিল। হ্যাচকা টানে কান থেকে দুল ছিঁড়ে নিল। কানের লতি ছিড়ে গেছে! প্রচ- জ্বালা করতে শুরু করল! ছুটে যাওয়ার জন্য তিনি মাথা নাড়তে চেষ্টা করলেন। তার কান থেকে রক্ত এসে নিজের মুখে ছিটে পড়ল। আল্পনা প্রথম জ্ঞান হারালেন।
নিয়তিকে একজন ঘাড়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে আরো কয়েকজন দৌড়াচ্ছে। নিয়তি একবার শুধু বলতে পারল, ‘আমারে ছাইড়া দেন দাদা, আমি ভোট দেই নাই!’
‘কচি মাগী! তোরে দেইখা রাখতেছি বহুদিন! সুযোগ কি ডেইলি আসে!’
নিয়তি চিৎকার করতে চেষ্টা করল, ‘ও কাকু! ও বাবা বাঁচাও!’
অনেক বড় মাঠ। আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নাই। অনেকদূরে ঘর-বাড়ির টিমটিমে আলো দেখা যায়। উপজেলায় চলাচল করা দু-একটি গাড়ির সচল আলো দেখা যায়। আলো এ-পর্যন্ত এসে পৌঁছে না। গাড়ির শব্দও পাওয়া যায় অস্পষ্ট।
আকাশে মলিন একখণ্ড চাঁদ জেগে আছে। তারই আবছা আলোতে দেখা যাচ্ছে একদল শক্ত-সামর্থ মানুষ এক কিশোরীর নরম শরীরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ক্ষুধার্ত অনেকগুলো হায়েনা যেমন একটি হরিণ ছানা পেলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, এ যেন সত্যিই সেই দৃশ্য।
নিয়তির মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। একটি শক্ত হাত নিয়তির চুলের পিছন দিকে শক্ত করে ধরেছে। সেই হাতওয়ালা মুখ নামিয়ে এনে নিয়তির গালে প্রচণ্ড কামড় বসিয়ে দিল। এখন মনে হচ্ছে গালের মাংসও ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।
নিয়তির গায়ে একফোটা কাপড় নেই। প্রচণ্ড টানে সব টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। প্রকাণ্ড দেহ নিয়ে একজন নিয়তির উপর শুয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে ভারী একটা গাছ তার উপর ভেঙ্গে পড়েছে। সে নড়তে পর্যন্ত পারছে না। সম্পূর্ণ অসহায়! নিয়তির প্রস্রাবের রাস্তায় মনে হল লোকটি চাকু ঢুকিয়ে দিল। চিৎকার দিতে চেষ্টা করল। পারল না। গোঙানির মতো আওয়াজ হল। মনে হচ্ছে কে যেন তার যোনি পথে আগুন ঢেলে দিচ্ছে!
আল্পনার মনে হল স্বপ্ন দেখছেন। দৈত্যকারের এক রানী বসে আছে। আদিম যুগের রানী। তার গায়ে আদিম পোষাক। মাথা ভরা ছোট ছোট শিং। টিভিতে দেখা আলিফ লায়লা সিরিয়ালের মারিখার মতো কপালে ভুরু। রানীর সামনে আল্পনা সম্পূর্ণ নগ্ন। তাকে দাঁড় করানো হয়েছে স্টেডিয়ামের মতো একটি খোলা মাঠে। মাঠের মাঝখানে একটি শূল বানানো হয়েছে। শূলের আগা সূচের মতো চোখা। তা নীচের দিকে ক্রমে মোটা হয়ে গেছে। এই শূলে কল্পনাকে চড়ানো হবে।
স্টেডিয়াম পূর্ণ শত শত মানুষ। তারা হৈ হুল্লোড় করছে। চিৎকার করে আনন্দ করছে। রানী দাঁত বের করে হাসছে। স্টেডিয়াম ভরা লোকগুলোকে হাতের ইশারায় আরো উল্লাস করতে বলছে। আল্পনা তার দিকে করুণা ভিক্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটো যেন প্রার্থনা করছে, ‘ডাইনি হলেও আপনিও নারী! শুধু নারীর দোহাইতে আমাকে দয়া করা যায় না?’ অল্পনাকে শক্ত করে ধরে শূলে চড়িয়ে দেওয়া হল। শূলের চোখা আগা ধীরে ধীরে আল্পনার তলপেট, পেট, বুক হয়ে মাথার দিকে গেঁথে যাচ্ছে। আল্পনা নামছে মাটির দিকে। আল্পনা স্বপ্নের মধ্যে ভয়ঙ্কর চিৎকার দিলেন। জ্ঞান হতেই তিনি বুঝলেন বাস্তব অবস্থা স্বপ্নের চেয়েও করুণ। কারণ তার পাশেই দশ হাত দূরে তার ছোট মেয়েটির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে কয়েকজন। তিনি নিয়তির গোঙানি শুনতে পেলেন। আল্পনা চিৎকার দিয়ে বললেন ‘পায়ে পড়ি! একজন একজন করে যা!’
তিনি দাঁতে দাঁত চেপে ‘ইশ’ বলে শব্দ করে আবারও একই কথা বললেন।