শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
লম্বা পা ফেলে সুকুমার হাঁটছে নোমানদের বাড়ির দিকে। আফ্রিকার খরাপীড়িত প্রাণীগুলো যেমন পানির উদ্দেশে ছুটতে থাকে, সুকুমারও যেন তা-ই ছুটছে। প্রায় ছয় মাস দেখা হয় না। নোমান যে ক’দিন গ্রামে থাকে সেই কয়েকদিন মনে হয় এ জগতটা ভিন্ন এক জগত। এই দেশ উদার, সভ্য মানুষে পরিপূর্ণ। আবার চলে গেলে নিরস একটি জীবন শুরু হয়।
টিন দিয়ে ঘেরা বাড়িটায় ঢুকতেই দেখা গেল নোমান বারান্দায় বসে একটা পেয়ারা খাচ্ছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ। তৃপ্তি করে চিবিয়ে পেয়ারার খাচ্ছে। সুকুমারকে ঢুকতে দেখে নোমান কিছু বলল না।
সুকুমার কাছে এসে দাঁড়াল। আস্তে করে বলল, ‘ছয় মাসে বেশ একটু মোটা হইছিস। শরীর ছাইড়া দিতেছে।’
নোমান মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘বয়স হইতেছে যে। পেয়ারা খাবি?’
‘না।’
‘বাড়ি আসলে যা খাই, তাই ভাল লাগে। তুই তো আর বাড়ির বাইরে থাকিস না, বুঝবি কী?’
‘থাকিস না ঢাকায়। চলে আয়। তুই ফিজিক্সের ছাত্র ছিলি। গ্রামে চইলা আয়। গ্রামের স্কুলে ছেলে-পুলেগো মন দিয়া বিজ্ঞান শিখা। বাড়ির ভাত খাইয়া বিনা বেতনে মাস্টারি।’
নোমান ছোট করে বলল, ‘ভাল বলছিস। আদর্শের কথা। মাথায় রাখলাম। কিন্তু সহজ না।’
সুকুমার হেসে বলল, ‘যার কাছে সহজ, তার কাছে পানির মত। যার কাছে কঠিন তার কাছে লোহার চাইতেও কঠিন।’
‘ঠিক। নে, এখন চল যাই। তোর জন্য বইসা আছি এক ঘণ্টার বেশি।’
‘কুথায় যাবি?’
নোমান গলা নামিয়ে বলল, ‘মতি সাধুর বাড়ি। বহুদিন মানুষগুলার সঙ্গে দেখা হয় না।’
সুকুমার মৃদু আপত্তি করে বলল, ‘নারে, গাঁজা খাবো না।’
নোমান কৃত্রিম রাগ করে বলল, ‘ভদ্র ভাষায় কথা ক সুকুমার। আমরা গাঁজা খাই নাকি?’
‘তাইলে কী খাই?’
‘আমরা হঠাৎ কোনো কোনো দিন আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করি। এইটারে গাঁজা খাওয়া কয় না।’
মতি সাধুর বাড়ির দিকে যেতে যেতে নোমান বলল, ‘সুকুমার, তুই চোরের মত তাকিতুকি করতেছিস কেন?’
সুকুমার তার চোরা ভাব ঢাকতে চেষ্টা করল না। এদিক ওদিক লক্ষ রাখতে রাখতে বলল, ‘বুঝিস না, মতি সাধুর বাড়ির দিকে যাইতে দেখলে মাইনসে বুঝবে গাঁজা টানতে যাই। আমাগো এখন বয়স হইতেছে। সমাজে আর বদনাম কামাইতে চাই না।’
‘হঠাৎ দু-একদিন গাঁজা খাইয়া পাপ করছিস, এখন সমাজের পথে হাঁটা দরকার?’
সুকুমার প্রতিবাদ করে বলল, ‘মোটেই না। কিন্তু সমাজ তো মাইনা চলতে হয়।’
নোমান মাথা নাড়ল, ‘তা চলতে হয়। কিন্তু পারলাম কই। সমাজ মাইনা চলতে হইলে নিজের উপর সারাক্ষণ দমন-পীড়ন চালাইতে অয়। সারাক্ষণ ভণ্ডামি করতে হয়। এত বৈপরিত্যে ভরা সমাজে ভণ্ডামির আশ্রয় নেওয়া ছাড়া চলা সম্ভব না।’
সুকুমার দ্রুত বলল,‘ভণ্ডামি বিষয়ক কোনো আইনের বই নাই?’
‘তা জানি না। বাংলা ভাষায় ভণ্ডামির উপর কোনো বইও দেখি নাই। তবে ইংরেজিতে অনেক বই আছে। ইংরেজি ভাষাতে অনুবাদও আছে। এমার্সনের একটা বই আছে, দি কনফ্লিক্ট অব লাইফ: এ ফিলজফিক্যাল রিডিং। ভার্জিনিয়া উলফের একটি বই আছে, এ রুম অব অন’স ওন। শুনছি ভণ্ডামির উপর নতুন একটা বই আসতেছে, মৌলিক কাজ। বেলাসাবাডোস আর এলডন সইফারের লেখা, হিপোক্রিসি: এথিক্যাল ইনভেস্টিগেশন। নে, একটা সিগারেট ধরা।’
নোমান পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা সুকুমারের দিকে বাড়িয়ে ধরল। সুকুমার মাথা নেড়ে বলল, ‘আনাম খাবো না, একটাই হবে, ভাগ কইরা খাই।’
একটু থেমে সুকুমার বলল, ‘নোমান একটা কথা ঠিক। গাঁজার ব্যাপারে মুসলমানগো একটু বেশি এলার্জি। গাঁজাখোরের চেয়ে ঘিন্না মওলানা মৌলভীরা আর বেশি কিছুরে করে না।’
নোমান সিগারেটে আগুন দিয়ে হাসল। বলল, ‘গাজা খাওয়া ইসলামে নিষেধ নাই। আরব দেশে ইসলাম যারা সৃষ্টি করছেন, তাদের গাঁজা সম্পর্কে ভাল জ্ঞান ছিল বলে মনে অয় না।’
সুকুমার বলল, ‘যা বেটা, কী কইস! পৃথিবীতে বহু আগের থিকা গাঁজা ভাং চালু আছে। শিবের প্রসাদ ছিল ভাং। আরব দেশেও তখন বহু নেশাদ্রব্য ছিল।’
‘ছিল। সব বস্তুই পাওয়া যাইত। এখনো যেমুন পাওয়া যায়। আফ্রিকা থিকা, ভারত থিকা নানা দ্রব্য সেইখানে সওদাগরেরা নিয়া যাইত। আরব নিজে হইল তিন বস্তুর দেশ। বালি, খেজুর আর ধর্ম। গাঁজা উৎপাদন হইতো না। এই গাঁজা সম্পর্কে কোরআন বা হাদিসে কিন্তু কিছু লেখা নাই।’
‘নেশা করা তো নিষেধ আছে!’
‘তা আছে। তবে কোন নেশা কেমন সেটা না জাইনা নিষেধ করা কতটা মাইনা চলার বিষয় সেইটা হইল কথা।’
নোমান একটু থেমে বলল, ‘নারীও তো একটা নেশা। পৃথিবীর সবচেয়ে তীব্র নেশা। এই নেশায় তো আরবরা শত শত বছর ধইরা বুঁদ হইয়া আছে। মূল কথা কী জানিস? ইসলাম বিভিন্ন দেশে গিয়া বিভিন্ন রূপ নিয়ে। নতুন নতুন হাদিস বাইর হইছে, নতুন নতুন ধর্মীয় বিধি নিষেধের কথা শোনা গেছে ওই স্থানে মুসলমানদের সুবিধার বিবেচনায়।’
সুকুমার বলল, ‘সেদিন সোবহান মওলানা কইতেছিলেন, ইসলামের দৃষ্টিতে বলে মদের চাইতেও গাঁজা বেশি নাজায়েজ।’
নোমান সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘সোবহানাল্লাহ! সোবহান মওলানার বুদ্ধি আছে। এইখানেই তো ইসলামের মজা। ওই যে বললাম, ইসলামের ব্যাখ্যা নানা দেশে নানা রকম। লক্ষ কইরা দ্যাখ, বহু ব্যাপারে এই ভারতবর্ষে হিন্দুরা যা করে, তার উল্টা সবক দিছে মওলানা মৌলভিরা। আবার দ্যাখ, উত্তর আফ্রিকার দ্যাশগুলাতে ইসলাম খুবই শক্ত। আফ্রিকার মানুষের সঙ্গে বন্য জীবন খুবই ঘনিষ্ঠ। তাই আফ্রিকার মানুষদের যৌন ক্ষুধা নিবৃত করা কোনো ধর্ম দিয়া বা আইন দিয়া সম্ভব না। সেই কারণে আফ্রিকার জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা। পুরুষগুলা পাঁচটা দশটা বিয়া কইরা যৌনক্ষুধা মেটায়। ধর্ষণ কইরা যৌনক্ষুধা মিটায়। আর মহিলারা যাতে তীব্র যৌন ক্ষুধা অনুভব করতে না পারে সে জন্য ওদের করা হয় খৎনা। এখন অবশ্য কমে আসতেছে।’
সুকুমার দুষ্টামির মত হেসে বলল, ‘আমি মাঝে মাঝে ভাবি, মেয়েগো খৎনা করে কেমনে? কাটে কী? পুরুষগো তো সামনের কতটুক চামড়া কাইটা ফেলাইলেই হয়।’
নোমান হাসল। তারপর গোপন কথা বলার মত করে বলল, ‘মেয়ে গো ভ্যাজাইনার যেই অংশ সবচেয়ে স্পর্শকাতর, সেই জায়গাটা বিশেষ কায়দায় কাইটা ফেলানো হয়। যাতে তীব্র যৌনসুখ অনুভব করতে না পারে। অবশ্য এই কর্তন করতে গিয়া অনেক মেয়ে মারা যায়। তাতে কী। নারীর প্রাণের চাইতে ইজ্জত বড়। আবার এই নারীর ইজ্জত মারার জন্য সারা দুনিয়া পাগল হইয়া থাকে। হাস্যকর এক জাত রে ভাই! আর পুরুষগো যেইটা করা হয় সেইটার ফলে যৌন সুখ তো কমেই না, বরং নুনুর আগাটা কাটা থাকায় বহু সুবিধা পাওয়া যায়। খাপ খোলা ছোরার মত, বুঝলি না? নুনুর আগায় ওই চামড়াটুকু না থাকায় একটি মেয়ের সিক্ত না হইলেও চলে। জোর করে পুশ কইরা দেওয়া যায়। এমুনকি ধর্ষণ করতেও সুবিধা। এই যে তোর সঙ্গে যেই নুনুটা আছে, এইটা দিয়া কোনো মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে তোর ওই চামড়া ছিড়া যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমার নাই হিহিহি। আমারটা হইল তুর্কি ছোরা, ভজপুরি ছোরা।’
‘তুই যাই বলিস, আমি শুনছি এই খৎনা করা বিজ্ঞানসম্মত।’
নোমান হেসে বলল, ‘ভাল বুঝছিস, মডারেট মুসলমানগো মত বুঝছিস। এর চে’ বিজ্ঞানবিরোধী কথা আর কিছু নাই। শরীরের কোনো অংশ অপ্রয়োজনীয় হলে প্রকৃতিই সেটা ফেলে দেয়। বিজ্ঞানও সেটাই মনে করে। জোর করে ফেলে দেওয়া প্রকৃতি এবং বিজ্ঞানবিরোধী। তারচেয়ে বড় কথা, যারা হামেশাই বিজ্ঞানের নিকুচি করে, তাগো এই খৎনার বেলায় বিজ্ঞানের দোহাই দেওয়া ভ-ামির চূড়ান্ত লক্ষণ।’
‘তুই বললি প্রকৃতি ফেলে দেয়। মানুষের শরীরে যে অ্যাপেন্ডিস আছে তা নাকি কোনো কাজে লাগে না?’
‘নিশ্চয়ই কিছু না কিছু কাজে লাগে। হয়তো চিকিৎসকরা সেই প্রয়োজনের কথা এখনো জানেন না। আর যদি নাই-ই লাগে, অবশ্যই কালক্রমে প্রকৃতি ফেলে দেবে।’
তখন সন্ধ্যা গড়িয়েছে। রাস্তা থেকে কয়েক পা হেঁটে মতি সাধুর বাড়িতে ঢুকতে হয়। কিন্তু আখড়া ঘরটিতে ঢুকতে বাড়ির ভেতর না ঢুকলেও চলে। ছোট্ট একচালা ঘরের দু’পাশে দুটো দরজা আছে। অবশ্য ভেতর দিয়ে আখড়ায় ঢুকতেও কোনো অসুবিধা নেই। তাতে সাধুর বৌ বা মেয়েটির ইজ্জত যায় না। সাধু তাদেরকে সেভাবেই গড়ে তুলেছেন।
নোমান আর সুকুমার গিয়ে আখড়ার দরজায় দাঁড়াল। ভেতরে দুটো কুপি ঘিরে চার-পাঁচ জন সাধুসঙ্গকারি। মতি সাধুর মুখে অবিন্যস্ত কাচা-পাকা দাড়ি। জয়নাল সাধুর হাতে একটা দোতারা। সে টুং টাং শব্দ করছে একটা গান ধরবে বলে। এমন সময় মতি সাধুর চোখ পড়ল দরজায়। তাঁর মুখের ভাব পাল্টে গেল। যেন হঠাৎ খরাপীড়িত প্রকৃতিতে বৃষ্টি নেমে এসেছে। দু হাত প্রণামের ভঙ্গিতে উপরে তুলে সাধু প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, ‘জয় গুরু, জয় গুরু!’
ওরা ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘জয় গুরু।’
মতি সাধু একটু সামনে এগিয়ে নোমানের পা স্পর্শ করতে গেল। নোমান সঙ্গে সঙ্গে সাধুর হাত দুটো ধরে ফেলল, ‘এইটা কী সাধু, খুব খারাপ কথা!’
সাধু ঠান্ডা মাথায় নোমানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জ্ঞান আর জ্ঞানীর পদধূলির মধ্যে গড়াগড়ি করাই যে আমাগো ধর্ম!’
নোমান বলল, ‘না সাধু, এই তত্ত্বে ভুল আছে। জগতের সব প্রাণী যার যার মতো করে জ্ঞানী। ওই দেখ সাধু, ঘরের কোণা দিয়া একটা ছোট ইঁদুর ঘুরতেছে। ধরতে পারবা?’
এ কোণার দিকে বসা আসলাম খান বলল, ‘না তো! সবাই মিল্লাও না। ফুড়–ৎ কইরা কই পলাবে!’
নোমান এবার হেসে বলল, ‘তাইলে আর কীসের জ্ঞানী। শোনাও সাধু, দুইটা বাণী শোনাও। মনটারে একটু ধুইয়া যাই। তুমি ছোট ফকিরের ওই গানটা ধরো।’
‘কুনটা?’
‘ওই যে, পাঁকে পাঁকে তার ছিড়ে যায় দৌড়াদৌড়ি সার।’
সাধু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গান ধরল-
‘পাঁকে পাঁকে তার ছিড়ে যায় দৌড়াদৌড়ি সার
মনের অনুরাগ তরীতে একান্ত চিত্তে হওরে সওয়ার
ছয় রিপুকে বশ করিয়া
নামের পেরেক দাও আটিয়া
হিংসা নিন্দা কাঠ কাটিয়া
পোক্ত কর তরী তোমার ।
শুদ্ধ রাগের কর পাটাতন
গুন-মাস্তুলে কপির সৃজন চল যেথায় মানুষ-রতন
ধর্ম বাদাম দিয়ে এবার।
মানুষ-রতন কাঁচা সোনা
জীবন থাকতে তা দেখলাম না
ভোলাই বলে ঊর্ধ্বরতি, জ্বালাও বাতি
ঘুচবে মনের অন্ধকার।’
সবাই নীরব। নোমান নীরবতা ভাঙল। বলল, ‘ছোট ফকির বলা হইতো ভোলাই শাহ্’রে। ভোলাই শাহ্ ছিলেন অতি শান্ত আর ভাবুক প্রকৃতির। সাঁইজী তারে নিজের সন্তান হিসাবে গ্রহণ করছিলেন। সাঁইজী তাঁর কন্যা পেয়ারী বেগমকে বিয়া দিছিলেন ভোলাই শাহ’র সঙ্গে।
সেটেলমেন্ট অফিসের ড্রাইভার রেজাউল বসা নোমানের বাঁয়ে। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ঠিক আমাদের নবীজী যেমুন তাঁর কন্যারে হযরত আলীর সঙ্গে বিয়া দিছিলেন।’
নোমান হাসিমুখে বলল, ‘দুইটা এক কথা না। একটু পার্থক্য আছে।’
রেজাউল বলল, ‘কী পার্থক্য?’
‘আপনি তো মনে অয় বছর খানেক হইল এইখানে যাতায়াত। আরেকটু সময় দেন এইসব পার্থক্য বুঝতে।’
মতি সাধু চোখ তুলে নোমানের চোখে তাকাল। তারা কে কী বুঝল কে জানে। মতি সাধু বিড়বিড় করে আওড়াল –
‘দেবতা হারিয়ে পূজারি কাঁদবি কতো দিন
অন্ধকারে ঘিরে নিল, মন্দিরে নেই তো আলোর চিন…’
নোমান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘খোদা বকশ শাহ্। ধর ধর, পুরাটাই ধর।’
মতি সাধু গান ধরল।
সাধুর আকড়া থেকে যখন নোমান আর সুকুমার বের হল তখন রাত দশটা বেজে গেছে। উপজেলার রাস্তা জনশূন্য, নীরব। রাস্তায় বিদ্যুতের আলো নেই। কিন্তু আকাশে ভরা চাঁদ। আঁকাবাঁকা পথটা ফকফকা পরিষ্কার। রাস্তার দু’পাশে মাঠে চাঁদের আলোতে মেখে আছে। সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে ভাল লাগছে। নোমান কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করল –
‘পৃথিবী রয়েছে ব্যস্ত কোনোখানে সফলতা শক্তির ভিতর
কোনোখানে আকাশের গায়ে রূঢ় মনুমেন্ট উঠিয়াছে জেগে
কোথাও মাস্তুল তুলে জাহাজের ভিড় সব লেগে আছে মেঘে।
জানি নাকো, আমি এই বাংলার পাড়াগাঁয়ে বাঁধিয়াছি ঘর…।’
নোমান হঠাৎ থেমে গেল। খুবই সাধারণ গলায় বলল, ‘ঢাকায় একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হইছে। ছেমরির নামটা খুব সুন্দর, রোদনা। বাপ-মা রোদনা রাখছে ক্যান কে জানে!’
‘শুধু আলাপ হইছে, নাকি অন্য কিছু।’
নোমান টেনে টেনে বলল, ‘অন্য কিছু মানে কী? মানে সেক্স করছি কিনা? নাকি প্রেম হয়েছে কি না?’
‘ওই ধর যে কোনোটাই।’
‘এর কোনোটাই হয় নাই।’ এবার হেসে বলল, ‘তবে প্রেমের দিকে আগাচ্ছে। রীতিমতো পাগলামি করতেছে। মনে অয় বড়লোকের মেয়ে। একা গাড়ি নিয়া খুঁজতে আসে। নিজে ড্রাইভ করে আসে।’
‘পড়াশুনা কী?’
‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। দর্শনের ছাত্রী।’
‘পরিচয় হইল ক্যামনে?’
‘একদিন প্রথম পাবলিক লাইব্রেরিতে দেখা। তখন নাম পরিচয় হইছে। এর কয়েক দিন পর বেঙ্গল গ্যালারিতে আবার দেখা। এই দ্বিতীয় দিনই মনে অয় ভাললাগার শুরু।’
‘কার ভাললাগা, তোর, নাকি মেয়েটির?’
‘আমার একটা জিনিসই প্রথম ভাল লাগছে।’
‘কী সেইটা?’
‘মেয়েটা একদমই সিম্পল। কোনো বাড়তি সাজগোজ নাই। ন্যাচারাল যারে কয়। আইজকাল এরকম মেয়ে প্রায় নাই। শুধু কমিউনিস্ট পার্টি করা কয়েকটি মেয়েরে দেখছি এরকম। কিন্তু ওদেরটা ভিন্ন কারণে। এছাড়া গার্মেন্টসকর্মী থিকা শুরু করে মন্ত্রী-এমপি পর্যায়ের মেয়েরাও এই চরম স্থূল কাজটি করে।’
‘একটি মেয়ে নিজেকে সাজায়ে রাখবে, এই কাজটারে তোর কাছে স্থূল মনে অয়?’
‘অবশ্যই মনে অয়। একটা সাজগোজ করা মেয়ে দেখলে মনে হয় মেয়ে না, স্নো পাউডার দেখতেছি। আমার রীতিমতো রাগ হয়। প্রকৃতি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে যে মেয়েটিকে সাজিয়েছে, সেই সাজ ফেয়ার এন্ড লাভলি কোম্পানি ঢেকে দিচ্ছে। প্রত্যেকটি মেয়ের ভ্রু আলাদা আলাদা সৌন্দর্য দিয়ে তৈরি করেছে প্রকৃতি। অথচ সব মেয়ে এখন ভ্রু তুলে এক রকম করে রাখতেছে।’
একটু থেমে নোমান আবার বলল,‘এই ভ্রু তোলার পরিণাম কী জানিস?’
‘না।’
‘একটু বয়স হইলেই ভ্রু’র উপরের মাংস বিশ্রী রকমের ফুলে উঠে। তখন দেখা যায় আরব দেশের ডাইনির মত!’
একটু থেমে নোমান আবার বলল, ‘আরেকটা কথা কই?’
‘বল।’
‘দর্শনগত বিচারেও সাজার পেছনে একটি ভয়ানক অর্থ দাঁড়িয়ে আছে। কী সেটা জানিস?’
‘বল, শুনি।’
‘সব দেশে, সব কালে সাজগোজ করতো বাঈজী, নর্তকী আর পতিতারা। খরিদ্দারকে আকর্ষণ করতে।’
‘তাহলে তুই কিন্তু বলতেছিস, এই সাজগোজের একটা আকর্ষণ আছে। দ্বিতীয়ত, মানুষ সুন্দর পোষাক পড়ে ক্যান। ন্যাংটা থাকলেই তো পারে।’
‘না, তোর এই দুইটা যুক্তির বিরুদ্ধেই শক্ত জবাব আছে। আকর্ষণের রুচি ভেদ আছে। ঘরে স্ত্রী রাইখা সন্ধ্যাবেলা পান চিবাইতে চিবাইতে টুক করে যে লোক পতিতালয়ে ঢোকে, সে আসরে ওই স্নো পাউডার খাইতেই যায়…।’
সুকুমার বাধা দিয়ে বলল, ‘যাহোক, এই ব্যাখ্যা পরে শুনব। তুই রোদনার কথা ক।’
‘আমি কিন্তু রোদনারে দেইখা তলে তলে বিস্মিত হইছি।’
‘কী রকম?’
‘চিন্তায় আর কাজে এত সাধারণ মেয়ে আমি আর দেখি নাই। শুনিও নাই।’
সুকুমারের হাতে একটা সিগারেট দিতে দিতে নোমান বলল, ‘সুকুমার, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিছি।’
সুকুমার বলল, ‘কী?’
‘ঢাকায় যাব না।’
সুকুমার হেসে বলল, ‘ঢাকায় যাবি না কী করবি?’
‘এইখানে থাকব। তুই যে বললি, ওই বাচ্চাদের পড়াব। অঙ্ক পড়াব। দুই দুগুণে চার, তিন দুগুণে ছয়। হিসাবটা এই তিন দুগুণে ছয়ের মধ্যে মেলাব। বহুদি ধরে এমন একটা চিন্তা আমার মধ্যে কাজ করতেছে। এবার তুইও কইলি।’
সুকুমার নার্ভাস হয়ে গেল। বলল, ‘আমি তোরে একটা কথার কথা কইছি। তুই পাগল হইছিস। এই গিরামে থাইকা কী করবি? জীবন নষ্ট হবে রে।’
নোমান সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘মানুষের জীবন ডাঙায় তোলা ইলিশ মাছ না যে শিগগির ধুয়ে-কূটে না রানলে নষ্ট হইয়া যাবে। পচা গন্ধ বাইর হবে।’
‘পাগলামি চিন্তা বাদদে নোমান। তোর মাথায় কিছু ঢুকলে সেইটা না করা পর্যন্ত রক্ষা নাই। তাই তোর হাতে ধরি এই চিন্তাটা বাদ দে।’
‘বাদ দেওয়ার কিছু নাই।’
‘জীবন মূল্যহীন হইয়া যাবে।’
নোমান বলল, ‘হারে বলদ, জীবন কী গরুছাগল যে গাবতলী হাঁটে বিক্রি করলে দাম বেশি পাওয়া যাবে? তরিকুল আছে। সঙ্গে ওকেও নিলাম। তরিকুলের মধ্যে এমন কাজের উৎসাহ দেখেছি।’
সুকুমার হাসল। বলল, ‘তরিকুল কী করে জানিস?’
‘না।’
‘ওতো টিপু সাহেবের ছেলেকে পড়ায়।’
‘টিপু আবার সাহেব হল কবে?’
‘অস্বীকার করার উপায় নেই নোমান, বাংলাদেশে এখন টিপুরাই সাহেব। কেউ কেউ কানাকানি করে টিপুর স্ত্রীর সঙ্গে নাকি তরিকুলের ঘটনা আছে। অবশ্য আমি এখনো ওরে কিছু জিজ্ঞাসা করি নাই।’
‘তা তো থাকতেই পারে। নায়িকার মত স্ত্রী রাইখা সারাদিন-রাত নোংরা রাজনীতি করে বেড়াইলে স্ত্রী ছেলের মাস্টারের সঙ্গে সময় দেবে সেইটাই তো স্বাভাবিক। তাও তরিকুলের মত আকর্ষণীয় যুবক।’
সুকুমারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উঠোনের দরজা দিয়ে ঢোকার সময় নোমানের মা আফিয়া বেগম দেখলেন। ঘরে ফেরা দেখে স্বস্তি পেলেন। তাঁর হয়েছে নতুন এক সমস্যা। কেন জানি নোমানকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়। দুশ্চিন্তা করতে করতে প্রেসার বেড়ে যায়। কাজের লোকের সঙ্গে খিটমিট করেন। দুপুরের ভাত খেতে বিকাল হয়ে যায়। রাতে দেখা যায় না খেয়েই শুয়ে পড়েছেন।
উপজেলার অবস্থা খুব খারাপ। কয়েকদিন পর পরই মার্ডার হয়। মানুষ মানুষকে হাত পা কেটে দিচ্ছে। চারদিকে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। একমাত্র ’৭১ সাল ছাড়া আর কখনো তিনি এমন দেখেন নাই।
নোমান তার একমাত্র সন্তান। আল্লাহর রহমতে কারো সঙ্গে সে ঝগড়া বিবাদে নাই। কিন্তু কার ঘাড়ের ভূত কার ঘাড়ে এসে চাপে কিছু বলা যায়? পারলে আফিয়া বেগম ছেলেকে সিন্ধুকে তালা দিয়ে রাখতেন। অথবা কোলে বসিয়ে আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখতেন। কিন্তু ইউনিভার্সিটি পাশ করা ছেলেকে কি তা সম্ভব?
তাঁর এসব টেনশনের কথা আর কেউ না বুঝলেও মোতালেবের মা বোঝে। মোতালেব বেঁচে নেই। আট বছর বয়সে মোতালেব টাইফয়েড হয়ে মারা গেছে। থাকলে সেও নোমানের মতো বড় হয়ে উঠত। দুজন একই বয়সের ছিল। মোতালেবের মৃত্যুর বছর খানেক পর তার বাপ নিকাহ করে অন্যত্র চলে যায়। তখন থেকেই মোতালেবের মা আফিয়া বেগমের সঙ্গে ছায়ার মতো আছে। এত লোক থাকতেও আফিয়া বেগমেরও কেন জানি মোতালেবের মাকে ছাড়া চলে না।
নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল মোতালেবের মা। বলল, ‘নোমান আব্বা আইছে। ভাত দিব?’
আফিয়া বেগম বললেন, ‘আমি দিতেছি। তুমি একটু জগ ভইরা পানি নিয়া আসো।’
আফিয়া বেগম ভাত বেড়ে আনলেন। নোমান টেবিলে এসে বসেছে। প্লেটে ভাত দিতে দিতে আফিয়া বললেন, ‘ঢাকায় কী তুই ফরিদপুরের ভাষায় কথা বলিস?’
‘না মা। একেবারে খাঁটি প্রমিত বাংলা। আব্বা যেভাবে বলে। খাঁটি সৈয়দ শামসুল হকী ভাষা। গ্রামে এলে তালগোল পাকিয়ে মিলিয়ে-মিশিয়ে বলি। ওই ভাষায় কথা বললে গ্রামের লোকদের আপন করে নিতে কষ্ট হয়। যতই ভাল শোনা যাক, শুদ্ধ বাংলা ওদের কাছে অনেকটা ইংরেজির মতো পর।’
‘তা ঠিক বলছিস। আমিও তাই করি। তোর আব্বার প্রথম পোস্টিং হয়েছিল সুনামগঞ্জ। গিয়ে যে কী বিপদে পড়লাম! কারো ভাষা বুঝি না। রাস্তার তরকারি বিক্রেতাকে ডাকি, সে কী বলে, কয়টাকা দাম চায় কিচ্ছু বুঝি না। এরপর বদলি হলেন চিটাগাং। আরো সমস্যায় পড়লাম।’
নোমানের মা আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সন্টুকে ঘরে ঢুকতে দেখেই তার অন্য এক কথা মনে পড়ল। বললেন, ‘ভালো কথা, খবর কিছু শুনেছিস নোমান? ইদ্রিসের ছেলেটারে কারা যেন মেরে ফেলছে।’
নোমান বলল, ‘হুম।’
‘তিন-চারদিন দিন হবে, নারে সন্টু?’ তিনি সন্টুর দিকে তাকালেন।
সন্টু মানুষ ছোটখাট হলেও তার গলা ভারী। সে বিড়িতে টান দিয়ে মোটা গলায় বলল, ‘আইজ চাইর দিন।’ বিড়ি সে অল্প বয়সেই ধরেছে।
নোমান বলল, ‘তুই তো বিবিসির মত খবর রাখিস। দিন তারিখ সব মনে থাকে। লাশ দ্যাখতে গেছিলি?’
‘কন কি, একটা মার্ডার অইল, লাশ দ্যাখতে যাবো না? দুনিয়ার সব মানুষ আইছে লাশ দ্যাখতে।’
‘কেস্টেস্ হইছে, কারো ধরতে পারছে?’
সন্টু পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কেস দিবে কিডা? নিজেরা কুতুপ মাডারের আসামি না? হেই কেসে ইদ্রিস আলী হুকুমের আসামী। তয় সরকারী কেস অইছে। কোনো আসামীর নাম নাই।’
সে আরো কাছে এসে বসল। ফিস্ফিস্ করে বলল, ‘সবাই কইতেছে মার্ডার করাইছে মানিক সরদার। রাইতের অন্ধকারে ট্যাটা দিয়া কুপাইছে। বুকের ঠিক মইদ্যেখানে আর ঘাড়ে ট্যাটার কোপ। দেহি, ঘাড়ের সাতে ট্যাটার ফলা ভাইঙ্গা রইছে। মইরাও শান্তি নাই, বুজলেন ভাই, মাথাডা একদিকে কাইত হইয়া রইছে।’
নোমান ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হুম। জামাত-শিবির মারে নাই তো?’
‘না ভাই। জামায়াত-মিবিরের মাইর আলাদা। হেরা মারলে জবাই করে, হাত-পায়ের রগ কাটে। আমি বহু সময় লাশটার কাছে দাঁড়াইয়া রইলাম। এক সুময় পুলিশ সারেরা সবাইর লাশ দ্যাখা বন্দ কইরা দিল। হেরপরও আমি দাঁড়ায় ছিলাম।’
‘তোরে দাঁড়াইতে দিল?
‘দিতে চায় না। এক পুলিশ স্যার আমারে লাঠি দিয়া মারতে আইল। আমি তা-ও সরি নাই। শ্যাষকালে এক পুলিশ স্যার আইসা আস্তে আদুর কইরা একখান কতা কওয়ার লগে লগে আমি সইরা পড়ছি।’
নোমান অতি আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘একটা কতা কওয়ার পর লগে লগে সাইরা গেলি, কী কতা?’
সন্টু ঠান্ডা গলায় বলল, ‘পুলিশ স্যার আস্তে কইরা আমারে আইসা কয়, ট্যাকা দে। আমি কইলাম, স্যার, আমি টাকা পাবো কুতায়? আমার কথা শুনেই না, মাথা নীচের দিকে দিয়া আবার কয়, যাহ, দশ টাকা দে। আমি ‘ওরে বাবারে’ কইয়া দিলাম দৌড়।’
‘ক্যান? তোরে তো গায়ে হাত দেয় নাই। এত ভয় পাইলি ক্যান।’
‘আপনে মানুষ মাইরা ফেলান, দেখপেন পুলিশ স্যাররা ধরলেও আপনারে একটা টুকাও দিবে না। কিন্তু ট্যাকা চাইয়া না পাইলে খুব রাগ অয়। মনে অয় তার পকেটে ট্যাকা নাই, এর জন্য আপনে দায়ী।’
এতক্ষণ চুপচাপ কথা শুনছিলেন আফিয়া বেগম। তিনি অভিযোগের সুরে বললেন, ‘দ্যাশে বিচার-আচার কিচ্ছু নাই রে, কী অইল দ্যাশের? হাসিনা এইগুলা দ্যাখে না?’
‘চারদিক অস্থির হয়ে উঠেছে মা। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বহু লোক বহু ধরনের সুযোগ নিয়া থাকে।’
চশমা মুছতে মুছতে মোয়াজ্জেম সাহেব কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছেন নোমান টের পায়নি। তিনি বললেন, ‘শুধু পুলিশ নারে, দেশের কোনো অফিস-আদালত টাকা ছাড়া নড়ে না। জনগণের সঙ্গে ডিল করে বলে পুলিশেরটা বেশি চোখে দেখা যায়। এদেশ টিকবে কী করে?’
নোমান বলল, ‘কেউ টিকবে কেউ টিকবে না। এভাবেই আরো কিছুকাল চলবে।’
প্রসঙ্গক্রমে মেয়াজ্জেম সাহেব বললেন, ‘তুই ঢাকায় ফিরবি কবে?’
নোমান হাত ধুতে ধুতে বলল, ‘দেখি, ঠিক নেই।’
মোয়াজ্জেম সাহেব একটু অবাক হলেন। কিন্তু প্রকাশ করলেন না। বললেন, ‘ঠিক নেই মানে কি? দু-এক মাস বা ইলেকশন পর্যন্ত থাকবি চিন্তা করেছিস?’
‘তাও না আব্বা। প্রয়োজন হলে যাব।’
মোয়াজ্জেম সাহেব একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, ‘সুকুমার ছেলেটার সঙ্গে তোর আলোচনা আমার কানে আসছিল। ও তোকে বুদ্ধি দিচ্ছিল গ্রামে থেকে, গ্রামের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কথা। তাই করবি নাকি?’
‘তা হয়তো করব না। কিন্তু চিন্তাটা খারাপ না। আব্বা, যদি ধরেন আমি এমন চিন্তা করি, আপনার আপত্তি আছে?’
‘সত্যি কথা বলব?’
‘হুম।’
‘আছে’, তিনি হাসলেন, ‘সুকুমাররা একটু অসুবিধা বোধ করলেই ঘর-বাড়ি, জন্মস্থান ছেড়ে সোজা পাড়ি দেবে কলকাতায়। একটু আয় বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেই সারা জীবনের জন্য দেশ-গ্রাম ছেড়ে যাবে। আর তোমাকে বুদ্ধি দেবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাল রেজাল্ট করে বের হয়ে গ্রামে এসে ছেলে মেয়েদের পড়াতে। কেমন বিচার, বল তো?’
‘সুকুমারদের বিচার যাই হোক, আইডিয়াটা কেমন?’
মোয়াজ্জেম সাহেব ক্ষোভের সঙ্গে বললেন,‘ধ্বংসাত্মক। এরচেয়ে বড় বাঁশ আর কিছু হয় না। তুমি তো বাপু বন্ধু বন্ধু কইরা পাগল। তুমি পড়াশোনা করছ ঠিক আছে। কিন্তু এদের এক দাঁতের বুদ্ধিও তুমি আয়ত্ব করতে পারোনি।’
নোমান মাথা নেড়ে বলল, ‘আপনার কথা হয়তো ঠিক। তবে ওদের বুদ্ধিটা অনেকটা সহজাত। আমি প্রশংসা করি। পৃথিবীর প্রতিটি মাইনরিটিকে বুদ্ধি করে চলতে হয়। তাও যদি আবার সে মাইনরিটি বাস করে মুসলমানদের মধ্যে, তাহলে তো কথাই নেই।’
‘তোমাকে বোঝানো যাবে না। এরা বাবা জাতে হিন্দু। স্বার্থ উদ্ধার অবে, দেখবা বন্ধু নাই! ওই যে শোন না মানুষ বলে, হিন্দু হয় না বন্ধু। আমি একসময় অনেক মিশছি এদের সঙ্গে। আমার দেখা আছে।’
তিনি একটু থামলেন। বললেন, ‘তুমি তো জানো, আমি কারো ক্ষতি চাই না। সারা জীবন চাকরি করেছি, একটি টাকা কারো কাছ থেকে ঘুষ খাইনি। তাই আজ উপজেলা শহরে বাস করছি। আমি কোনো হিন্দু লোকেরও ক্ষতি চাই না। কিন্তু একটা কথা বলি, এরা খুব বিপজ্জনক। এবং অদ্ভুত ব্যাপার হল, এরা সবাই একরকম! আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই। তাই মাঝে মাঝে আমি একটা কথা চিন্তা করি।’
নোমান মেয়াজ্জেম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,‘কী?’
‘আমি আগে হিটলারের উপর খুব নাখোশ ছিলাম। ভাবতাম কী করে একজন মানুষ ৬০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করতে পারে। এখন বুঝি, কেন হিটলার পুরো একটি জাতির উপর ক্ষেপে ছিল।’
শেষ বাক্যটি শুনে নোমানের রাগে, দুঃখে মাথার দু’পাশের রগ ফুলে উঠল। ভাত আর খেতে মুখে নিতে পারছে না। মাছের কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, ‘আপনার কথা সত্যিই খাঁটি মুসলমানের মতো। আপনি খাঁটি ইসলাম পালন করছেন।’
মোয়াজ্জেম সাহেব সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘কেমন?’
‘ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু সর্বাধিক পরিমাণ রক্তারক্তি মুসলমানদেরই করতে হয়। আপনি আগে অনেক বই পুস্তক পড়তেন। এখন একগ্রন্থের পাঠক হয়েছেন। আপনার দ্বারা এমন চিন্তা করাই স্বাভাবিক!’
মোয়াজ্জেম সাহেবের মুখ দেখে মনে হল তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু নোমান আজ সেটা গায়ে মাখছে না। সে আবার বলল, ‘তবে প্লিজ আব্বা, এসব নিয়ে আপনি আমার সঙ্গে শেয়ার করবেন না। আমাকে মৌলবাদী বানাতে চেষ্টা না করাই ভাল।’
মোয়াজ্জেম সাহেব রাগে কাঁপছেন। বললেন, ‘মৌলবাদী বানাতে চাইব কেন? আর সে কথাই যদি বল, মৌলবাদী কে নয়? তুমি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। এক সময় আমিও তোমার মত ভক্ত ছিলাম। এখনো পড়ি। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখ, তিনি এমন এক ভাষায় লেখালেখি করেছেন যেখানে সংখ্যায় মুসলমানরা মোটেই কম নয়। কই, দেখাও তো, ক’টি জায়গা মুসলমান নিয়া লিখেছেন? তিনি বলেছেন, হিন্দু আর মুসলমানের পরিচয় এক না। মুসলমান একটি বিশেষ ধর্ম কিন্তু হিন্দু কোন বিশেষ ধর্ম না। হিন্দু হল ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটা জাতিগত পরিণাম। এই কথা বলে তিনি একটি বিশাল সম্প্রদায়ের মানুষকে দূরে ঠেলে দেননি? এই কথায় তাঁর গর্বিত হিন্দুত্ব ফুটে ওঠেনি? তুমি বাস করবে পাঞ্জাবে আর শিখদের জীবনযাত্রা, ধর্মাচরণ তোমার সাহিত্যে, তোমার লেখায় থাকবে না, তুমি তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে না – এটা কী মৌলবাদ নয়?’
তিনি থামলেন। বললেন, ‘বাবারে, জীবনভর চাকরি করলাম, রিটায়ার করলাম। দেখতে দেখতে শিখলাম। নজরুলের কত শ্যামাসঙ্গীত, কত দুর্গাগীতি, কত বন্দনা আছে! যে অপূর্ব শ্যামা নজরুল লিখেছেন তা আজও কারো লেখার সাধ্য হয়েছে? তিনি লিখেছেন, “আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন, মায়ের রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব, যার হাতে মরণ বাঁচন।”। আবার লিখেছেন, “লুকাবি কোথায় মা কালি, আমার বিশ্ব ভুবন আঁধার করে, তোর রূপে মা সব ডুবালি।” আহাহা! আমাদেরই তো বুকটার ভেতর কেমন এক ভক্তি জেগে উঠতে চায়। অথচ কোনো সময় দেখেছো যে হিন্দুদের আচার অনুষ্ঠানে নজরুলের এই সঙ্গীত বাজে? শুধুমাত্র তাঁর মুসলমান নামটার জন্য আধা শিক্ষিত, অশিক্ষিত হিন্দুরা জানে যে ওগুলো বাজানো যাবে না। ও গান মুসলমানের লেখা।’
নোমান একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল। মোয়াজ্জেম সাহেব তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘না না দাঁড়াও, আমাকে আগে শেষ করতে দাও। হোমিওপ্যাথিতে হেমেন ডাক্তার আর এলপ্যাথিতে রাধা ডাক্তার ছাড়া উপজেলায় আর ডাক্তার নেই? হিন্দুদের কাউকে দেখেছ যে অন্য কারো কাছে যায়? শুধু এদের কাছে যায় না, মুখে মুখে অ্যাডভার্টাইজ নিয়েও ঘুরে বেড়ায়। এহ্, রাধার উপর ডাক্তার নাই!’
এবার নোমান বলল, ‘আব্বা, এক কথা রবীন্দ্রনাথের বাপ-দাদার ধর্ম ব্রাহ্মসমাজ…।’
‘জানি বাবা। এইডা আরো বড় হাসির কথা। রবীন্দ্রনাথের বাপদাদারা যেই মতবাদ দিয়েছিলেন তা উগ্র হিন্দুবাদেরই আরো বড় মডেল। তুমি দেখ…’
এ আলোচনা নোমানের মোটেই ভালো লাগছে না। বড় পুরানা ইস্যু। ছোটবেলা থেকেই এ কথাগুলো শিক্ষিত মুসলমান মুরুব্বিদের মুখে শুনে আসছে। তারচেয়ে বড় কথা কিছু বিশ্বাসে মানুষের মন গেঁথে যায়। সেই বিশ্বাস থেকে সরানোর কোনো উপায় থাকে না। তার বাবাও সে অবস্থায় চলে গেছেন। পরিবেশ হালকা করাই ভাল। নোমান বলল,‘ এ আলোচনা থাক আব্বা। আপনার শরীর কেমন এখন?’
মোয়াজ্জেম সাহেব কিছুক্ষণ থেমে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘শরীর আর ভালো কই। গ্যাস্ট্রিকের জ্বালাতন। ডায়বেটিস বেড়েছে। অবশ্য হাপানিটা এখন নেই।’
নোমান বলল, ‘ভারতীয় যোগশাস্ত্র মতে একটা আসন আছে। নাম অর্ধকুর্মাসন। কিছুটা নামাজের সিজদায় যাবার মতো করে করতে হয়। করতে পারবেন? পেটের ইরিটেটিং বাউল সিনড্রম বা ইবিএস সেরে যাবে। শরীর মনও প্রফুল্ল থাকবে। অষুধের মত কাজ হয়।’
ছেলের কথা মোয়াজ্জেম সাহেবের পছন্দ হল না। তিনি খুব মন দিয়ে শুনলেন বলে মনে হল না। নোমান আবার বলল, ‘এ উপমহাদেশ থেকে পশ্চিমারা সহজে কিছু গ্রহণ করে না। তবে যোগাসন কিন্তু অতি আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করেছে।’
মোয়াজ্জেম সাহেব বললেন, ‘যাই, নামাজের সময় হল।’ মনে মনে ভাবলেন, ‘আবার সেই হিন্দু মতবাদ!’
মা আফিয়া বেগম এতক্ষণ চুপ হয়ে ছিলেন। মোয়াজ্জেম সাহেব বের হয়ে যেতেই বললেন, ‘তোর আব্বা মুখে যাই বলুক, মনটা কিন্তু দরদে ভরা। সুকুমারকে কিন্তু মনে মনে খুবই আদর করেন।’
নোমান বুঝতে পারল মা মেকআপ দিতে চেষ্টা করছেন। বলল, ‘আব্বার সমস্যাটা আমি জানি। মানুষ হিসাবে আব্বা খুবই দরদী। কিন্তু এই বয়সে এসে যেগুলোকে কর্তব্য বা পালনীয় বলে মনে করছেন, সেগুলোর মধ্যেই যত ঝামেলা।’
আফিয়া বেগম বললেন, ‘কী ঝামেলা?’
‘ধর, পারলে এখন গাড়ি ঘোড়া বাদ দিয়ে ১৪ শ’ বছর আগের একটি উট নিয়ে চলাফেলা করতেন। কিন্তু তা কি সম্ভব মা?’
নোমান একেবারে মোক্ষম বিষয়টি ধরে ফেলেছে দেখে মায়ের ভাল লাগল না। তিনি বললেন, ‘তোর যত উদ্ভট কথা। যা, এখন ঘুমাতে যা।’