শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
ভীষণ চঞ্চল রনি। পড়তে বসালে সে কলম হাতে নিয়ে বসে থাকে। সুযোগ পেলেই চোখের ওপর খোঁচা দিতে চায় কলম দিয়ে। তরিকুল মনে মনে ভাবে, একটা বানরের বাচ্চা কন্ট্রোল করার চাইতে একশটা ঘোড়া কন্ট্রোল করা অনেক সোজা।
কয়েকটি বিশেষ কারণে তরিকুল এই বাচ্চাটাকে গাইড করার কাজ ছেড়ে যেতে পারে না। প্রথমত যত দুষ্টই হোক বাচ্চা মানুষ তো। কী মিষ্টি চেহারা! মায়ের কাছ থেকে চেহারাটা পেয়েছে। অবুঝ এই শিশুর হাসি দেখলে তার মন ভরে যায়। স্বভাবটা মনে হয় পিতৃকূলের।
দ্বিতীয় কারণ হল ছাড়তে চাইলেই ছেড়ে যাওয়া যায় না। স্বয়ং ইমারত হোসেন টিপু নিজে তার বাচ্চাকে গাইড করার জন্য অনুরোধ করেছে। এখন ছেড়ে গেলে সে ক্ষেপে যাবে। টিপু হল উপজেলার সবচেয়ে ঠান্ডা মাথার নিষ্ঠুর লোক। শেষে কী দিয়ে কী বিপদে ফেলবে ঠিক নাই। এখন মিষ্টি মিষ্টি হাসে। কিন্তু বিএনপি আজ ক্ষমতায় এলেই লোকটা ভয়ানক হয়ে উঠবে। গত বিএনপির আমলে যেমন ছিল। তিনটা মার্ডারের সঙ্গে নিজে জড়িত ছিল। অন্তত ছয়জন মার্ডার কেইসের আসামীকে মুক্ত করেছে। এই লোক তরিকুলের মতো মানুষকে ট্যাবলেটের মতো গিলে ফেলবে। আর বিএনপির ক্ষমতায় আসা অসম্ভব না। সারাদেশের মানুষ আইন শৃঙ্খলার অবনতির কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সব রাগ, ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে হাসিনা সরকারের ওপর। ইদানীং মানুষের মনে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টও বেশি দেখা যাচ্ছে। আর ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট বাড়া মানেই বিএনপি-জামায়াত জোটের লাভ।
আরো একটি কারণে রনিকে পড়ানো সে ছাড়তে চায় না। সে কারণটি নিজের মধ্যে লুকানো। রনির আম্মা দেখতে একটু বেশিই সুন্দর। বয়সে তরিকুলের চেয়ে কিছু ছোটই হবে। এমন সুন্দরী রমণীর কাছাকাছি থাকতে খারাপ লাগে না। আর কিছু না, ফ্রয়েডীয় কারণ। শায়লা ম্যাডাম তার কপাল সমান উঁচু। চোহারা অনেকটা ভারতের নায়িকা শাবানা আজমীর মত। শরীরে মেদের ছিটেফোঁটাও নেই। কোমরের ঠিক নীচের দিকে মৎস্যকন্যার মতো শেইপ। অনেকখানি চওড়া শোল্ডার। উন্নত বুক। সুডৌল হাত। খাড়া নাক। পোড়া দুধের মতো গায়ের রং। একেই বলে ললনা! এই ধরনের মেয়েদের কাছাকাছি থাকলে হাত পা কাঁপে। এই রূপ রাজ্য ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। এই ধরনের মেয়েদের কথাই অন্য মেয়েরা ফিস্ফিস্ করে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে, শুনেছি স্বভাব ভালো না।
এইরকম সুন্দরী মেয়েরা হয় মূর্খ। অথবা দাম্ভিক। শায়লা ম্যাডাম এর কোনোটাই না। সেন্স অফ হিউমার প্রখর। সত্যিই ইমারত সাহেবের ওপর হিংসা হয়। তরিকুল আক্ষেপ করে ভাবে, জগতের যত প্রকৃত সুন্দর মেয়ে, সব চলে যায় নাদানদের দখলে। প্রায় বছর পঞ্চাশে বয়সের টিপু সাহেব খাটো মানুষ। পাছার মাংস উঠে এসেছে পেটে। চুল উঠে অনেকখানি কপাল খালি হয়ে গেছে। চেহারার মধ্যে একটা ছোটলোক ভাব। কানের নীচে দুপাশের চোয়াল অনেকটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তারচেয়ে বড় কথা, দেখলেই মনে হয়, অকাট মূর্খ। অথচ শায়লা তার স্ত্রী। এটা কিছু হল?
তরিকুল জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখল, শায়লা ম্যাডাম দু’ কাপ চা নিয়ে আসছে।
‘ম্যাডাম কী করছেন, আপনি কেন চা নিয়ে আসছেন।’
শায়লা চা রাখতে রাখতে বলল, ‘জোবেদা মেয়েটা অন্য কাজ করছে।’ তারপর হেসে বলল, ‘তাছাড়া ওরা চা নিয়ে আসলে তো সেটা আমার খাওয়ানো হল না।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
শায়লা রনিকে না দেখে বলল, ‘রনি পড়ছে না?’
‘বাথরুমে গেছে, ওই রাহেলা মেয়েটা নিয়ে গেছে।’
তরিকুল হেসে বলল, ‘পড়ার চেয়ে দুষ্টুমিতেই মন বেশি ম্যাডাম। স্থির বসতে চায় না।’
শায়লা হেসে বলল, ‘সে তো আমি জানি। ওর জিন থেকে কিছু কোড ইরেজ করা দরকার ছিল।’
‘বাচ্চা মানুষ, ঠিক হয়ে যাবে ম্যাডাম।’
‘আপনার তাই মনে হয়? সেটা তো ভাল কথা। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় ঠিক হবে না। বড় হলে অন্য একটা ফর্মে দুষ্টু থেকে যাবে। আমার একমাত্র সন্তান, এখনো শিশু। কিন্তু আপনার কাছে সত্যি করে বলি, ওকে হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন টিপুরই ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে মনে হয়।’
‘সেটাই তো স্বাভাবিক ম্যাডাম। বিজ্ঞান তো তাই বলে। ও তো একই গাছের চারা। তাতে দোষের কী?’
শায়লা মনে হল একটা ধাক্কা খেল। বেশ খানিক সময় চুপ করে থাকল। তারপর হাসতে হাসতে বলল, ‘পৃথিবীতে একটি প্রাণীই আছে যার দুটি ব্রেইন, জানেন?’
তরিকুল বলল, ‘জ্বী, বানরের। একটি মস্তিস্কের কাজ শুধু লেজ নিয়ে।’
আরো একটি প্রাণীর দুটি মস্তিস্ক আছে।
তরিকুল অবাক হয়ে বলল, ‘কোন প্রাণীর?’
‘তার নাম টিপু। একটি মস্তিস্ক সারাক্ষণ কাজ করে মাহবুব চৌধুরীকে নিয়ে। তাই ভয় করে, আমার ছেলের যদি এমন দুটি মস্তিস্ক হয়। কোনো এক মাহবুব আলমের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেয়!’
‘ম্যাডাম, আমাদের সবাইকেই কিন্তু কোথাও না কোথাও বিক্রি হতে হয়। পৃথিবীতে বিনিময় প্রথা বা মুদ্রাব্যবস্থা চালুর পর থেকেই এই বেচাকেনা চলছে। আপনি কী করবেন?’
এ সময় রনি দৌড়ে এল। পেছন থেকে ১৫-১৬ বছর বয়সের কাজের মেয়েটি বলল, ‘খালাম্মা, ও বাথরুম করে নাই। শ্যাম্পু সব পানির ভিতর ঢাইলা ফেলছে।’
শায়লা যেন মেয়েটির কথা শুনতে পায়নি। বলল, ‘আপনি আমাকে ম্যাডাম বলবেন না। ম্যাডাম শুনলে কেমন যেন নিজেকে টিচার-টিচার মনে হয়।’
‘ঠিক বলেছেন, আমার নিজেরও ম্যাডাম ডাকা পছন্দ নয়।’
‘তাহলে ডাকেন কেন?’
‘যে বাচ্চাকে পড়াই, তার মাকে অন্য কি বলে ডাকা যায় তা খুঁজে পাইনি।’
শায়লা হাসল। বলল, ‘সত্যিই মুশকিলের কথা। এক কাজ করুন। ভাবীই ডাকুন।’
প্রায় সাথে সাথে বলেছে, ‘ভাবী, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। যদি আপনি আপত্তি না করেন।’
‘বলেন।’
‘আপনাকে কখনো ঢাকায় যেতে দেখেনি। অথচ ছোটবেলা থেকে ঢাকার পরিবেশে মানুষ হয়েছেন।’
‘কিছুই না। এমনিতেই। ঢাকা এমন কোনো গ্রেট জায়গা না যেখানে থাকতেই হবে।’
শায়লা একটু নীরব হয়ে গেল। তারপর বলল, ‘আমার আব্বার মৃত্যুর পর পার্মানেন্টলি ঢাকায় চলে যাবো।’
শায়লা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে চলে গেল।
তরিকুল রনিকে পড়ানো শেষ করে বের হয়ে এল। নোমান এসেছে ঢাকা থেকে। এখনো দেখা হয়নি। তরিকুল নোমানের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। বাড়ি পর্যন্ত যেতে হল না। পথেই দেখা হল নোমান আর সুকুমারের সঙ্গে। তিন জন এক জায়গায় দাঁড়াতেই তরিকুল সুকুমারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কীরে শয়তানের মত হাসতেছিস ক্যান?’
সুকুমার বলল, ‘শয়তান দেইখা।’
তরিকুল হাসতে হাসতে বলল, ‘শয়তান আমি, না তুই। নোমানের কাছে কবো, কী করতেছিস?’
নোমান সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘কী করে রে? আমার কাছে কিচ্ছু কয় না।’
তরিকুল নালিশের সুরে বলল, ‘আয়েশা নামে এক মেয়ের সঙ্গে প্রেম লাগাইছে। ওর কত্ত বড় সাহস একবার চিন্তা কর।’ এবার সুকুমারের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,‘ধরা পড়লে তোরে কী করা অবে জানিস?’
সুকুমার বলল,‘কী?’
‘জানিস না? ধরা পড়লে উপজেলার স্কুলের মাঠে আয়োজন কইরা শূল বানানো অবে। সেই শূলে তুই চড়বি, সারা গিরামের মানুষ উল্লাসের সঙ্গে দেখপে, তোর পাছা দিয়া শুল ঢুইকা মাথা দিয়া বাইর হইতেছে। এইটার নাম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আরো অনেক কিছু হইতে পারে। আরবের মতো চাইরপাশে মানুষের মইধ্যে বসাইয়া এক কোপে গলা নামানোও হইতে পারে।’
নোমান সুকুমারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কীরে সুকুমার, সত্যি নাকি, তুই তো আমার কাছে কইস নাই?’
‘আরে ও ফাউ কথা কয়! খাইয়া আর কাজ নাই, আমি মুসলমান মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে গেছি।’
নোমান বলল, ‘তুই আয়েশা নামের কোনো মেয়েরে চিনিস?’
‘চিনি। সেইটা মিথ্যা না।’
তরিকুল বলল, ‘আচ্ছা, যদি ধর তোর সঙ্গে প্রেম হইয়াই গেল, তুই ওরে বিয়া করবি?’
‘আমার ঘাড়ে মাথা কয়টা?’
‘ধর কেউ কিচ্ছু বলবে না। বিষয়ডারে প্রেম হিসাবেই সবাই নিবে, তাইলে?’
সুকুমার নাক ফুলিয়ে বলল, ‘এক্ষণ বিয়া করব। ১০ মিনিট পরেও না, এক্ষণ। কিন্তু হাজার বছরেও বাংলাদেশে সেটা সম্ভব হবে না। দ্যাশের সব প্রগতিশীল মানুষও ছুইটা আসপে আমার কল্লা নিতে।’
তারপর একটু থেমে বলল, ‘তসলিমা নাসরিনের একটা উপন্যাসে কল্পনায় একটা হিন্দু ছেলের কাছে মুসলমান মেয়ে শোয়ায় দিছিল। তাইতেই আগুন জ্বলছে সারা দ্যাশে। তাসলিমার দ্যাশ ছাড়তে অইছে।’
নোমান বলল, ‘আচ্ছা ঠিকাছে। ব্যাপারটা আমরা সিরিয়াসলি নিলাম না। এইবার তুই ক তরিকুল কী করছে?’
সুকুমার হেসে বলল, ‘ আমি কিছু কই না। মাইনসে কয়।’
‘কী কয়?’
‘বাচ্চা পড়াইতে গিয়া টিপুর বৌয়ের সঙ্গে নাকি খু-উ-ব চলতেছে।’
নোমান হেসে বলল, ‘হুম এইটা খারাপ না। বর্তমানে বাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্য নাকি অনেক মা-ই মাস্টারদের একটু আধটু ছাড় দিতেছে। ক্যান, দি ফরেস্ট গাম্প সিনেমাটা দেখিস নাই সুকুমার?’
সুকুমার বলল, ‘না, বল কী দেখেছিস।’
‘টম হ্যাংস নায়ক। দারুন ছবি। ছেলে ভর্তি করাইতে গিয়া মা প্রিন্সিপালরে একটু ছাড় দেয়। বারান্দায় বসে ছোট ছেলে সেই শব্দ শুনতে পায়।’
সুকুমার বলল, ‘বাংলাদেশের মায়েদেরও নতুন রোগ অইছে। বাচ্চার লেখাপড়া নিয়া এমুন প্রতিযোগিতা শুরু করছে যে কোনো কিছু ছাড় দিতে আপত্তি নাই। অসুস্থ বিদ্যাশিক্ষা!’
তরিকুল সুকুমারের দিকে তাকিয়ে বলল,‘নে আর ভ-ামি করিস না।’
এই হাসি তামাশার মধ্য দিয়েই তিনজনের জম্পেশ আড্ডা চলল। রাত প্রায় ১২টার দিকে যে যার বাড়ি চলে গেল।
গভীর রাতে তরিকুলের ঘুম ভেঙে গেছে। একটা স্বপ্ন দেখে। দেখল শায়লা ম্যাডাম তার কাছে এসে বসেছে। স্বপ্নের মধ্যেও তরিকুল বিশ্বাস করতে পারছে না। সে থর থর করে কাঁপছে। শায়লা হাসতে হাসতে বলছে, মানুষের বাইরে থেকে কি বোঝা যায় কে কি চায়? এরপর সে তার উষ্ণ ঠোঁট এগিয়ে দিল। ভরা বুকটা এসে পড়েছে তরিকুলের বুকে। আর বিশ্রী কা-টা তখনই ঘটল!
ঘুম ভেঙ্গে তার নিজের কাছে নিজের লজ্জা লাগতে থাকল। রাতে আর ঘুম হল না। পরদিন সারাক্ষণ কেমন এক সুখানুভূতি কাজ করতে থাকল। বিকেল পাঁচটার সময় রনিকে পড়াতে যাবে। দুপুর থেকে সে অন্তত ২০ বার ঘড়ি দেখল।
কিন্তু ঘটনা ঘটল অন্যরকম। টিপু সাহেবের বাড়িতে ঢুকেই রনি বা তার মাকে দেখতে পেল না। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখল কাজের মেয়ে দুটোর একটি। সে এগিয়ে এসে বললো, খালাম্মায় ছাদে, আপনে আসলে উপরে যাইতে কইছে।
মেয়েটি ছাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। এ বাড়ির ছাদে কখনো ওঠা হয়নি।
এক মুহূর্ত ইতস্তত করে তরিকুল ছাদের গেইট দিয়ে প্রবেশ করল। বিশাল মাঠের মতো ছাদ। মাঝখানে বড় ছাতি টাঙানো। সমুদ্র সৈকতে সাধারণত এগুলো দেখা যায়। ছাতির নীচে একটি সুন্দর টেবিলের চারকোণায় ছোট ছোট সুন্দর ডিজাইনের চারটি চেয়ার। একটিতে বসে আছে শায়লা। পরনে শাদা রঙের একটি শাড়ি। কালো বর্ডার। ঠিক সাজেনি, তবে যতœ করে পরিপাটি হয়েছে বোঝা যায়। টেবিলের ওপর চায়ের পট, কাপ। কোমর সমান উঁচু ছাদের পাঁচিল। রনি সারা ছাদ দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
শায়লা বলল, ‘আসেন, আজ এখানেই চা খাওয়া যাক।’
তরিকুল কিছু বলল না। সে সামনে এগিয়ে গিয়ে শায়লার উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসল। ২৬-২৭ বছর বয়সের এক মিষ্টি গৃহবধু তরিকুলের জন্য চা ঢালছে। কার না ভাল লাগে। তরিকুল মন ভরে দেখতে থাকল।’
নিচ দিকে তাকানো অবস্থাতেই শায়লা বলল,‘কী দেখছেন?’
তরিকুল লজ্জা পেল। ভড়কে গিয়ে নিজেকে আর লুকাতে চেষ্টা করল না। বলল, ‘দেখছি এই সৃষ্টি কত সুন্দর!’
খিলখিল করে হাসল শায়লা। তারপর বলল, ‘এ তো ১৪শ’ বছর আগের কথা। নতুন কিছু বলেন।’
তরিকুল কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সাথে সাথে নজর পড়ল রনির দিকে। তার বুকের ভেতর ধপাস করে উঠল। ছাদের উপর দশ ইঞ্চি গাঁথনী করে দু’ফুটের মতো উঁচু রেলিং করা। কী করে জানি রনি তার উপর উঠে দাঁড়িয়েছে। শায়লা দেখতে পায়নি। সে তরিকুলের দিকে তাকাল। তরিকুল আড়চোখে দেখল ঠিক শায়লার পিছনে রনির ছোট পা দুটি টলমল করছে। একটু এদিক-ওদিক হলেই কমছে কম বিশ ফুট নীচে!
তরিকুল ঠান্ডা মাথায় দ্রুত বলল, ‘ভাবী, খবরদার! একদম শব্দ করবেন না। পিছনে তাকাবেন না! খবরদার!’ বলতে বলতে তরিকুল উঠে দাঁড়ালো।
তরিকুলের চোখে এমন কিছু ছিল যে শায়লা তার আদেশ মানল। শায়লা বিপদ বুঝতে পেরেছে। তবে কি ধরনের তা জানে না।
তরিকুল ঠান্ডা মাথায় ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। রনির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। যেন ছাদের কার্নিশে উঠা খুবই সাধারণ ঘটনা। দুধের ফিডার খাওয়ার মতোই স্বাভাবিক ঘটনা।
তরিকুল ধীর পায়ে স্বাভাবিক গতিতে এগোচ্ছে। সে জানে মানুষের দিকে মানুষকে দ্রুত গতিতে এগোতে দেখলে প্রতিক্রিয়া হয়। সেই সামান্য প্রতিক্রিয়ায় রনি নীচে পড়ে থেতলে যাবে।
তরিকুলও হাসতে হাসতে এগোলো। হাতের নাগালে আসতেই বিদ্যুৎ বেগে সে রনির ছোট জামাটা ধরে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল দীর্ঘক্ষণ পরে সে দম টানতে পারল। তরিকুল যেন নিজেই নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। রনি অবাক হয়ে গেছে। কিন্তু তরিকুল থরথর করে কাঁপছে।
শেষ মুহূর্তে দৃশ্যটি শায়লা দেখে ফেলেছে। চোখ বিস্ফারিত। কিছু বলতে গিয়ে মুখ আটকে গেছে। সে হা হয়ে আছে।
শায়লা নিঃশব্দে অনেকক্ষণ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে রাখল। তার চোখ দিয়ে টপ্ টপ্ করে পানি পড়ছে। তরিকুল বলল, ‘আজ আমি যাই। কাল আসব।’
শায়লা একবার চোখ তুলে তাকাল।
রাতে টিপু বাসায় ফিরেছে। ততক্ষণে শায়লা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কেন জানি এই ঘটনা শায়লার বলতে ইচ্ছে করেনি।
রাতের খাবার টেবিলে টিপু সাহেব চাক্-চুক্ করে খাচ্ছে। টিপু মাংসের হাড়ে শব্দ করে চোষা দিয়ে বলল, ‘তুমি খাবা না?’
‘না, খিদে নেই।’
টিপু হেসে বলল, ‘এইবার আল্লাহ আল্লাহ কইরা ক্ষমতায় আসতে দেও। ঢাকায় বাড়ি করব তিনডা। একটা তুমার, একটা আমার, আরেকটা রনির নামে। ইস, আগের বার মিস কইরা ফালাইসি!’
শায়লা নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘কী মিস করেছেন?’
হাড় চিবাতে চিবাতে টিপু বলল, ‘আসল জায়গা ধরতে পারি নাই। এইবার কাজ করব ওয়াপদায়। পয়সার খনি। ছ্যাচড়া কাম না। ওয়াপদায় প্রকল্পই আয় কমসে কম ১০০ কোটি টাকার!’
‘তাতে লাভ কী?’
‘আরে কও কি তুমি! পানির মইধ্যে ব্লক ফেলানের কাম। তুমি ফ্যালাইছ, নাকি ফ্যালাও নাই কারো বাপের ধরার সাধ্য নাই। দ্যাখা যায় তিন কোটি টাকার কাম কাগজে কলমে পড়ছে, পানিতে পড়ে নাই, হিহিহি। শালা মানিকরা এখন বসাইতেছে।’
‘কাল ছাদের রেলিংটা আর দু’ফুট গেঁথে দেবার জন্য রাজমিস্ত্রি খবর দেই, কী বলেন? রনি সারাক্ষণ ছুটাছুটি করে।’
‘হে, হে দ্যাও। কাইল ঢাকায় যাবো। কী লাগবে খালি কও।’
‘কিচ্ছু লাগবে না।’
‘এইবার টিপু দুষ্টামির হাসি দিল, কিছু কও, তুমার জন্য করতে পারি না এমুন কাজ আছে? সুন্দরবন যাইতে হবে? বাঘের চোখ আনতে হবে?’
শায়লা হাসল। বলল, ‘আচ্ছা ঠিকাছে, আমার জন্য দু’টো ভিডিও ছবি নিয়ে আসবেন।’
‘হিন্দি না বাংলা? সালমান খানের, না শাহরুখ খানের?’
‘কোনো খানেরই না। একটির নাম ব্রীজ অন মেডিসন কাউন্টি। অন্যটির নাম ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি। আমার প্রিয় ছবি।’
‘আর কিছু না, দুইটা ইংরেজি ছবি? তুমারে একটা কথা কই ডারলিং, ইংরাজি বই দেইখো না। এইগুলো পরিবার নিয়া দেখা যায় না। কী দরকার? কত ভালো ভালো হিন্দি ছবি আছে সেইগুলা দ্যাখ। যাও, তুমার জন্য দশটা লেটেস্ট বই নিয়া আসব।’
শায়লা কোনো কথা বলল না।
টিপু বুঝতে পারল তার কথা শায়লার পছন্দ হয়নি। তাই ব্যাখ্যা করে বলল, ‘এই ইংরাজি ছবি যারা বানায় সেই পরিচালকরা সেক্স ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝে না। কথায় কথায় কাপড় খুলন্তি, কথায় কথায় চুমাচুমি। পর্থমে কিছুক্ষণ দ্যাখতে ভালোই লাগে। তারপর আর ভাল লাগে না। ছবিতে কোনো ঘটনা নাই।’
এবার শায়লা একটা চায়ের কাপে নিজের জন্য চা ঢালতে ঢালতে বলল, ‘ইংরেজি ছবি বলতে আপনি দেখেছেন শুধু ব্লুফিল্ম। তাই সবকিছুকেই আপনার কাছে অশ্লীল মনে হয়।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে। তুমি নাম লেইখা দ্যাও।’
‘নিশ্চয়ই লিখে দেব। তা না হলে আপনি মনে রাখবেন কী করে? বাংলায় লিখে দেব। আপনি তো আর ইংরেজি পড়তে পারেন না।’
টিপু এবার বলল, ‘খোটা দিতেছ আমার লেখাপড়া নিয়া? দ্যাও। আমার তাতে কিছু আসে যায় না। পুরুষ পোলাগো টাকাই সব। যার টাকা আছে, তার সব আছে। যার টাকা নাই তার কিছু নাই। শিক্ষা দিয়া, জ্ঞান দিয়া আঙুল চুষা ছাড়া আর কিছু অয় না।’
শায়লা বলল, ‘আমি তা মনে করি না। পুরুষ ছেলের সব অহঙ্কার, সব সম্পদ তার জ্ঞান। যদি সে একটা পিয়নের চাকরিও করে।’
টিপু হাত ধুয়ে উঠতে উঠতে বলল, ‘তুমারে তাইলে জ্ঞানের রোগে ধরছে!’
শায়লা সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘ও রোগ আমার নতুন না।’
টিপু গায়ে জামা চড়িয়ে বের হয়ে গেল। শায়লা ডাইনিং টেবিলে বসেই চা খেতে থাকল।
মনে পড়ে যখন বিয়ে হয়েছিল তখন তারা কেউ জানত না যে লোকটি এমনকি ম্যাট্রিক পাশও না। শায়লার বাবাও জানতো না। তার বাবা ডা. কুতুবউদ্দিন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাহবুব চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। অফিসিয়াল কিছু সমস্যার কথার ফাঁকে কাচুমাচু হয়ে মন্ত্রীকে বলেছেন, ‘স্যার, টিপু সাহেবের সাথে আমার মেয়ের কথা ভাবছি। উপ-পরিচালক এহসানুল করিমের মধ্যস্থতায়, টিপু সাহেব তো স্যার আপনার…।’
মন্ত্রী চশমা খুলতে খুলতে বলেছেন, ‘চমৎকার ছেলে, আনডাউটেডলি, আই ডু অ্যাপ্রেশিয়েট।’
সেট্ল্ ম্যারেজের পর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। পাত্র-পাত্রী নিজেকে জাহির করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। নানা বিষয়ে গপসপ চলে।
টিপুও কম গেল না। সেও তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে বোঝাতে চাইল যে তার জানা শোনার পরিমাণ একেবারে কম নয়। যেমন বিয়ের দ্বিতীয় দিনেই সে গান নিয়ে কথা বলছিল। তার প্রিয় শিল্পী রুনা লায়লা। সে গম্ভীর হয়ে বলছিল, ‘তুমি তো বোধ হয় জান না, আমাদের শিল্পী রুনা লায়লাকে ভারত সরকার চাইছিল। তারা বলছে তোমরা রুনা লায়লাকে দিয়ে দাও, আমরা তোমাদের গঙ্গার পানি দেব।’
শায়লার মাথার ভেতরটা ঘুরে উঠেছিল। বলে কি লোকটা! আব্বা আমাকে এ কার হাতে তুলে দিল! একজন রাজনীতিবিদের এই হল একটি রাষ্ট্র সম্পর্কে জ্ঞান! এরকম আরো কয়েকটি ঘটনার পর বাড়ি ফিরে গিয়ে সে মায়ের কাছে বলেছিল, ‘আমি যাব না।’
মা মোমেনা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘রাজনীতিবিদদের এমন জ্ঞানই হয়। তুই যা মা, তোর পায়ে পড়ি। লোকটা ভালও হইতে পারে।’
শায়লা চিৎকার দিয়ে বলেছিল, ‘হইতে পারে না! অশিক্ষিত একজন মানুষ ভাল হইতে পারে না!’
সেই দিনই রাতে কুতুবউদ্দিন সাহেব শায়লার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঠান্ডা মাথায় শায়লা বলেছিল, ‘কারো সঙ্গে প্রেম করিনি আব্বু। ইচ্ছা হয়েছে। কিন্তু পড়াশোনার চাপে প্রেম হয়ে ওঠেনি। সেই সুযোগটা নিলে?’
কুতুব সাহেব পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলেছেন,‘দামী পাজেরো গাড়ি। সচিবরা সমীহ করে, ডাক্তাররা সব তার সঙ্গে খাতির করতে ব্যস্ত। আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি যে অন্তত ম্যাট্রিকও পাস করেনি! আমি সর্বনাশ করে ফেলেছি!’