পাপড়ি রহমানের ‘বয়ন’ উপন্যাসটি আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছে। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের মুগরাকুল গাঁয়ের জামদানি প্রস্তুতকারক জোলা সম্প্রদায়ের জীবনকথা বলেছেন তিনি। প্রথম কথা বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানসহ সমগ্র উপমহাদেশটিই হরেদরে একটি বিশাল কৃষিভিত্তিক, সামন্ততান্ত্রিক গ্রামই। এমনকি তার শহর-নগরগুলোর ওই গ্রামেরই সম্প্রসারিত রূপ। কাজেই, এমন একটি বিশাল গ্রামে জন্মে, তার অন্নে-জলে প্রাণধারণ করে, তার হাওয়া থেকে প্রাণবায়ু নিয়েও লেখক হিসেবে সেই গ্রামজীবনকে নিয়ে অন্তত একপাতা না লিখলে এ উপমহাদেশের লেখকের স্রেফ কলমশুদ্ধি হবে না। আনন্দের কথা, পাপড়ি রহমান এই উপন্যাসে সেই মাতৃঋণ শোধ করবার চেষ্টা করেছেন।
দ্বিতীয় কথা, পৃথক পৃথক রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব থাকলেও এই বিশাল কৃষিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক ভূখ-ের বিভিন্ন অংশের গ্রামীণ জীবনপ্রবাহের মধ্যে মৌলিক ফারাক সামান্যই। সেখানে নারায়ণগঞ্জ, পুরুলিয়া, মহারাষ্ট্র, লারকানা একাকার। শ্রীমতী রহমানের এটাই কৃতিত্ব যে, তিনি তাঁর উপন্যাসের জীবনপ্রবাহে এমন একটি সার্বজনীনতা তৈরি করতে পেরেছেন যে, নারায়ণগঞ্জের মুগরাকুল গ্রামের বস্ত্রশিল্পীদের জীবনকথা পড়তে পড়তে এপার-বাংলার সমুদ্রগড়ের কিংবা আহমেদাবাদের তাঁতশিল্পীদের, এমনকি কাশ্মীরের কিংবা পেশোয়ারের পশম শিল্পীদের, উড়িষ্যা-কেরালার শঙ্খশিল্পীদের জীবন উঁকিঝুঁকি মেরে গেল সারাক্ষণ। শ্রীমতী রহমানের ‘বয়ন’ উপন্যাসটি তাই কেবল নারায়ণগঞ্জ নয়, বাংলাদেশ নয়, কেবল বস্ত্রশিল্পই নয়, মূর্ত হয়েছে কৃষিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক সমগ্র উপমহাদেশটির তাবৎ গ্রামীণ শিল্পের ভুবনটিও। এ উপন্যাসের গ্রামীণ বস্ত্রশিল্প, শিল্পী, তাদের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, লোকযান, তাদের ভাবনা, বিশ্বাস, সংস্কার ও কুসংস্কারের জগৎ, প্রেম-ভালোবাসা, বঞ্চনা, সবকিছুই সামন্ততান্ত্রিক কৃষিভিত্তিক সমগ্র মহাভূখণ্ডের মৌলিক চরিত্রের সঙ্গে যেন একসূত্রে বাঁধা।
তৃতীয়ত, বড় মুন্সিয়ানার সঙ্গে ‘বয়ন’ উপন্যাসের শরীরটিকে গড়েছেন লেখিকা। সেখানে স্বপ্ন, বাস্তব, রূপকথা, মীথ, কিংবদন্তি মিলেমিশে একাকার। মুগরাকুলের বস্ত্রশিল্পীরা যেমন জামদানির গায়ে হাজারো রঙদার বুটি-নকশা তোলেন, রঙে রঙ মেলান, ঠিক তেমনই কেবল কলম দিয়ে নয়, সঙ্গে রেশম, মাকু, কা-ুল, সানা, দকতি, নরত, নাচনিকাঠি, জুইতাস, তলপাওর, মুনিখিলি ইত্যাদি নিয়েও অনুরূপ দক্ষতায় লেখিকা যেন বয়ন করেছেন এক আশ্চর্য ‘জামদানি’। তার খোলে, আঁচলে, পাড়ে যেন হাজার রঙের বুটি নকশার কারুকার্য। সেখানে নদী-আকাশ-আসমান নিয়ে নিসর্গপ্রকৃতি রয়েছে, সেই আকাড়া প্রকৃতির বুকে জীবন রয়েছে, বৃত্তির দৈনন্দিনতা রয়েছে, তাকে অতিক্রম করে মানবিক জীবনদর্শন রয়েছে, আর তার পাড়-আঁচলের বর্ণময় কারুকার্যের খাজেভাঁজে লুকিয়ে রয়েছে তাঁদের বৃত্তিগত গান, হাজারো বিশ্বাস, সংস্কার (কুসংস্কারও), মীথ, কিংবদন্তি…। আর সেই বুটি-নকশাগুলো তৈরি হয়েছে এমন অপরূপ গদ্য দিয়ে, যা পড়তে পড়তে মনে হয়, অতি সাধারণ শব্দ উপমাগুলোর শরীর থেকে বিচিত্র সব
আরো ঠিকরে পড়ে কী আশ্চর্য রহস্যময়তায় মুড়ে দেয় গদ্যের শরীর। একেবারে ম্যাড়ম্যাড়ে শব্দগুলোও একেবারে হীরের মতো জ্বলে ওঠে। আর চরিত্রের মুখের কথাতো বটেই, এমনকি লেখিকার নিজস্ব গদ্যটিও সারাক্ষণ মেখে নিয়েছে পটভূমির সৌরভ। শিল্পগদ্যকে পটভূমির মাটি ও শীতলক্ষ্যার জল দিয়ে এমন আশ্চর্য রসায়নে মেখে নিয়েছেন তিনি, গোটা উপন্যাসের শরীর থেকে সারাক্ষণ ভেসে আসে পটভূমির ভুরভুরে গন্ধ। এই গন্ধটাই তো পাঠকের মনে নেশা ধরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
চতুর্থত, আতিমনি-সবেদআলি-আলাউদ্দিন, মুল্লুচান-কমলাসুন্দরী-আয়রননেছা, পয়রনবিবি-জাজমিয়া-মোহতন-ঝুম্পাড়ি, নূর মোহাম্মদ-আয়েশা বেগম-চাঁদবিবি-আকাইল্যা, মোমেনা-সাধু এমনতরো একটি-দুটি-তিনটি চরিত্র দিয়ে একটি গুচ্ছ, তারা তৈরি করেছে এক একটি বৃত্ত, সেই বৃত্তগুলো উপন্যাসজুড়ে পাক খেয়েছে অবিরাম। পাক খেতে খেতে মাঝে মাঝে এক বা একাধিক বৃত্ত পরস্পরকে জ্ঞানত কিংবা অজান্তে ছুঁয়ে ফেলেছে। তার ফলে মৃদু ঘর্ষণজাত ধ্বনি সৃষ্টি হয়েছে। কখনো সেই ধ্বনি ভোমরার মতো সুরেলা, কখনো বা তাতে ধাতব-ঘর্ষণের খরবাস্তবতা।
পঞ্চমত, সারা উপন্যাসে তৈরি হয়েছে অসংখ্য নকশা ছবি। ভাষা দিয়ে যে কী আশ্চর্য ছবি আঁকা যায়, এ উপন্যাসটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। নিপুণ চিত্রশিল্পী যেমন একটি বা দুটি বাড়তি রেখা যোগ করে একটি মুখম-লে অনায়াসে এনে দেন একটি সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি, শ্রীমতী রহমানও বহুক্ষেত্রে একটি বা দুটি মাত্র বাড়তি শব্দ কিংবা একটি বা দুটি মোক্ষম উপমা প্রয়োগ করে গোটা ছবিটার মধ্যে অকস্মাৎ এনে ফেলতে পেরেছেন নতুন নতুন মাত্রা। ‘আর (আতিমুনির) কোমরের বাঁক ছিল নতুন কেনা কাস্তের মতো ধারালো,’ ‘তামার পয়সার মতো রং ধরা পা’, ‘মুল্লুক চানের জোলারক্তে সুর খলবলিয়ে ওঠে।’ কমরা জানে না কি আছে এই অন্ধকার গুদামের মতো উদরের গহীনে।’ ‘জোলার ছাওয়ালের আঙুল হওয়ার নাগে যাদুর কাঠির লাহান য্যান চক্ষের পলকে ভাও ধইরা ফালায়। য্যান চক্ষের পলকে শাড়ি আওগায়। য্যান চক্ষের পলকে কা-ুলে বুটা ওড়ে… ডালিম তেছরি, পোনাফুলে ঘুড্ডিপাইর সোন্দও মতো সিজিল কইরা থোয়া যায়।’ ‘মায়া হলো আগাছা। যা না বুনলেও গছিয়ে ওঠে। মায়ার বীজ বুনতে হয় না, রোপণ করতে হয় না – কিন্তু মায়া গজায়।’ ‘তার মাথার রক্ত শীত কি গ্রীষ্ম সব সময়ই টগবগিয়ে ফুটতে থাকে। আর ওই ফুটন্ত গরম রক্ত এদিক-সেদিক কমবেশি ছিটকিয়েও পড়ে। (জজমিয়া) খরগোশের মতো কান দুটি খাড়া করে নতুন গল্পের গন্ধ নেয়।’ ‘কটকটে শক্ত চাল আগুন-বালিতে পড়ামাত্রই ফুলের মতো ফুটে ওঠে। আতিমুনি জানে না ভোরবেলায় ফুলেরা কীভাবে ফুটে ওঠে। তবে তার ধারণা, মুড়ি ফোটার মতো করেই হয়ত ফুলেরা ফোটে।’ ‘হয়ত বা আসমানে… যেখানে কাকের পালকের মতো অন্ধকার ফুঁড়ে ডিমের কুসুম-চাঁদ জোছনা ঝরিয়েছে।’ ‘কুন অচিন রঙে আটকা পইড়া আছে বুড়ির নয়নজোড়া।’ এদিকে সকালের সূর্য কুয়াশা কেটে তরতর করে মাথার ওপর উঠে পড়ে। গাছপালা, ঘরবাড়ি, মানুষজনকে দিনের ভেতর ঠেলে দিলে শীতলক্ষ্যার ওপর খাড়া হয়ে ঝুলে
থাকে। এই জ্বলন্ত রোদ্দুর থেকে জলের ভিতর রুপা গড়ে পড়ে। তাল তাল রুপা। চকচকে রুপা। রুপা গলে মিশে যায় স্রোতের সঙ্গে। আর চিকচিকে সাদারঙে ভেসে যায় শীতলক্ষ্যার জল।’ ‘দীঘি বরাবোর ম্যাঘ হইলো চিতইপিঠার পাছার মতো পুড়া-লাগা।’…ছবি, ছবি, এমনতরো শত শত আশ্চর্য শব্দ-উপমার ফুল-বুটির নকশা ছড়িয়ে রয়েছে ‘বয়ন’ নামক জামদানিটির পাড়ে, আঁচলে, সমগ্র জমিতে।
তাঁর সবচেয়ে মুন্সিয়ানার জায়গাটা হলো, মুগরাকুল নামক নিছক একটি গ্রামের জনকয় মানুষের জীবন রীতিতে, দৈনন্দিনতায়, বিশ্বাসে, সংস্কারে (কুসংস্কারের), মীথ-কিংবদন্তিতে, প্রবাদ-প্রবচনে, উপমায় ও ভাবনায় চারিয়ে দিতে পেরেছেন পূর্ব-উল্লিখিত গোটা উপমহাদেশের জনজাতির জবীন রীতিকে। পড়তে পড়তে এমন বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, যতই রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকুক না কেন, এই উপমহাদেশের জীবন প্রবাহটি হরেদরে এক এবং অখ-।
খুবই পরিশ্রমী প্রয়াস। জামদানির কারিগরদের উপকরণ, সুতা, রঙ, যন্ত্রপাতি, আয়ব্যয় ও কাজের খুঁটিনাটিগুলো যেভাবে তাঁর উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে এসেছে, তাতে এ প্রয়াসকে ডকুমেন্টেশন বললে নেহাৎই কম বলা হয়। ওঁদের জীবন একেবারে জলের সঙ্গে চিনির মতো মিশে যেতে না পারলে এভাবে ছত্রে ছত্রে তার খুঁটিনাটি এমন জীবন্ত হয়ে ধরা পড়ে না। মনে হয় লেখিকা বুঝি এই সমাজেই জন্মেছেন, বড় হয়েছেন এবং হাতেনাতে দীর্ঘদিন জামদানির শরীরে বুটি নকশা তুলেছেন।
সমগ্র উপন্যাসটি সেই মুঘল আমল ও ইংরেজ আমল থেকে আজ অবধি এদেশের গ্রামীণ বস্ত্রশিল্পের ইতিহাসের বিবর্তনটিকে ধরা যায়। গ্রামীণ বস্ত্রশিল্পীদের বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাসও রয়েছে উপন্যাসটির ছত্রে ছত্রে।
কয়েকটি নিছক টেকনিক্যাল খামতি ছাড়া উপন্যাসটি আমাকে একেবারে মজিয়ে দিয়েছে।
আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, ছোটোগল্প ও উপন্যাস আমাদের নিজস্ব শৈলী নয়। ইংরেজ শাসকদের মাধ্যমে তা আমাদের দেশে আমদানি করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে এসেছিল ওই দুটি শাখার সৃষ্টিগুলোর উৎকর্ষ-অপকর্ষ বিচারের জন্য সমালোচনার মডেলও। দীর্ঘকাল ওই বিদেশি ছকে (মডেলে) পড়তে পড়তে, লিখতে লিখতে, সমালোচনা করতে করতে কবে জানি আমরা ওই ছক বা মডেলটিকে আমাদের নিজস্ব জ্ঞানে আঁকড়ে ধরে রয়েছি। এমনকি, বিদেশি শাসকের থেকে স্বাধীন হওয়ার পরেও ওই মডেলটিকে আমরা অন্ধের মতো অনুসরণ করেই লিখে চলেছি আমাদের ছোটোগল্প-উপন্যাসগুলো। অর্থাৎ আমাদের সাহিত্যগুলো এখনও মূলত ইউরোপীয় সাহিত্যের ভারতীয় সংস্করণ। কেউ কেউ বা তাতে ইদানীং কিছুটা ল্যাটিন আমেরিকা ফোড়ন দিচ্ছেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, স্বকীয়তা ছাড়া কোনো শিল্পই বাঁচে না, থিতু হয় না, জগৎসভায় স্বীকৃতি পায় না। আমাদের দেশজ সাহিত্য রচনার সময় হয়েছে। অধুনা বাংলাদেশসহ এই বিশাল উপমহাদেশের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি, সুপ্রাচীন ইতিহাস, তার বিপুল জনজাতি, ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর শক্তপায়ে দাঁড়াতে পারে আমাদের নিজস্ব সাহিত্য। সেই উদ্যোগ অন্তত বাংলাভাষায় শুরু হয়েছে দুটি ভূখণ্ডেই। ভাবতে ভালো লাগছে,
পাপড়ি রহমানও সেই মহতী উদ্যোগে নিজেকে অতি সক্রিয়ভাবে যুক্ত করে ফেলেছেন। অন্তত তাঁর ‘বয়ন’ উপন্যাসটি পড়বার পর আর এ বিষয়ে কোনোরূপ সংশয় থাকা উচিত নয়। কেবল গ্রামীণ জীবনের আখ্যান লিখলেই তা দেশজ সাহিত্য হয়ে ওঠে না। সাহিত্যের শরীরে কোন কোন লক্ষণরেখাগুলো ফুটে থাকলে তাকে দেশজ সাহিত্য বলা যাবে, তা বিস্তৃতভাবে বলবার অবকাশ এখানে নেই। তবে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, শ্রীমতী রহমানের ‘বয়ন’ উপন্যাসে সেই সব লক্ষণচিহ্নের অনেক সার্থক সমাবেশ ঘটেছে।
আলোচক: কথাসাহিত্যিক