‘চিলেকোঠার সেপাই’ (১৯৮৬) আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রথম উপন্যাস। প্রকাশের পঁচিশ বছর পরও কি আমরা, পাঠকেরা উপন্যাসটির গন্তব্য চিহ্নিত করতে পেরেছি? মনে হয় না। কারণ এই উপন্যাসের গন্তব্য আর আমাদের গন্তব্য তো অভিন্ন। ওসমান, আনোয়ার, হাড্ডি খিজির যে আলো আর অন্ধকারের ভেতর ঘূর্ণায়মান, আমরা বাংলাদেশের মানুষও সেই আলো ও অন্ধকারে যুগপৎ ধাবিত। আমরা সমষ্টিগত সংকল্পের কথা বলি, রক্তপাত করি আবার ক্রমাগত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। ব্যক্তিবলয়ের প্রাগৈতিহাসিক কোটরে অতঃপর স্থান হয়ে আমাদের।
‘চিলেকোঠার সেপাই’ পড়তে গিয়ে উপন্যাসটির কাঠামো শুধু নয়, সময়ের ভেতর ব্যক্তি অবস্থানের কাঠামোকেও পাঠক তদন্ত করতে বাধ্য হবেন। ১৯৬৯-এর পূর্ব বাংলা তিনশত ঊনত্রিশ পৃষ্ঠায় ধারণ করে চলে ব্যাপ্ত সময়। ঢাকা স্পর্শ করে সুদূর বৈরাগীর ভিটাকে। চিলেকোঠাবাসী ওসমান ওরফে রঞ্জুর মোলাকাত হয় ফকির বিদ্রোহের নেতা মজনু শাহের সঙ্গে। এভাবে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ কালের অগ্নিকে ধারণ করেও মুহুর্মুহু ভেঙে চলে কালিক সীমা, নির্দিষ্ট স্থানকে পটভূমে রেখে গুঁড়িয়ে দেয় স্থানিক অপরিসরতা এবং কতিপয় ব্যক্তির অবস্থানকে রূপান্তরিত করে নিযুত মানুষের বিশাল জমায়েতে। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ আগুন নয়, আগুনের সংবাদ। গর্জন নয়, গর্জনের আভা।
ওসমানের মোড়কে পূর্ব বাংলা জানান দেয় – ‘আমি আসছি’।
আপাত এক বিসংলগ্নতায় উপন্যাসের শুরু। একই দালানে জনৈক যুবকের রাজনৈতিক মৃত্যু আর অপর এক যুবকের নিদারুণ আত্মরতি আমাদের ধন্দে ফেলে দেয়। ওসমানের চিলেকোঠা যেন আমাদের যাবতীয় মধ্যবিত্তের পলায়নের আখড়া। কিন্তু এক নেতায় বিশ্বাসী আলাউদ্দিন, ভোটের রাইট প্রার্থী আলতাফ কিংবা রাজনীতি বিশ্লেষক বামপন্থি আনোয়ার-এরা কেউই ওসমানকে চিলেকোঠার খপ্পর থেকে উদ্ধার করে না বরং একপ্রকার সর্বহারা হাড্ডি খিজির অসীম স্পর্ধায় ওসমানকে চিলেকোঠার চৌহদ্দি থেকে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় গনগনে আগুনের সামনে। তখন পোড়া ব্যতীত ওসমানের গত্যন্তর নেই। হাড্ডি খিজির তবে কে? বারংবার দগ্ধ হয়ে যার আর আগুনের ভয় নেই সে-ই হাড্ডি খিজির। ইলিয়াসের অনন্যতা এইখানে যে হাড্ডি খিজিরকে তিনি ইচ্ছাপূরণের পুতুলে পরিণত করেননি বরং তাতে যুক্ত করেছেন রক্ত-মাংসের সংবেদন। তাই সে তার স্কুটারের বিপন্ন আরোহীর কাছেও ন্যায্য পাওনা চাইতে দ্বিধায় ভোগে না। ‘না। আমরা কুত্তার বাচ্চা, মানুষ হইলেন আপনেরা’ বলে ভদ্দরলোককে প্রশ্নের মুখোমুখি করার স্পর্ধা হাড্ডি খিজিরের যেন অনায়াসলব্ধ। মহাজনের কাছে সে পরাজিত হতে পারে কিন্তু আইয়ুব-মোনেমের কারফিউকে সে বুড়ো আঙুল দেখাতে জানে। হাড্ডি খিজির স্পষ্ট উপলব্ধি করে সমস্ত শোষণ ও পীড়নেরই রয়েছে অচ্ছেদ্য গাঁটছড়া। তাই
ভদ্রলোকরা যখন আন্দোলনের ব্যাপারে শৌখিন আলাপে মত্ত, দ্বিধান্বিত তখন সে নিজেই শুধু রাস্তায় নামে না সঙ্গে সঙ্গে আর দশজনের মাঝেও ছড়িয়ে দেয় রক্তাভ প্ররোচনা। হাড্ডি খিজির পাঠকের অলক্ষ্যেই যেন নির্মাণ করে চলে আলোচ্য উপন্যাসের প্রধান পাটাতন।
রানুর প্রতি ওসমানের জৈববাসনা আর রানুর ভাই সনামী রঞ্জুকে ঘিরে অস্বাভাবিক আবেগ কি ওসমানকে বিপর্যস্তই করে শুধু? বরং মনে হয় এসব বাস্তবের মারে নিঃশেষিত হতে হতে ওসমান একটু একটু করে জ্যান্ত হয়ে ওঠে। নিজের বিবরগুলো এতদিন বাদে স্পষ্ট দেখতে পেয়েই যেন ওসমান বৈকল্যে ভোগে। আর চিলেকোঠা ভাঙচুরের তাড়নায় যেন বা সে পাগল হতে থাকে। সমস্ত শুশ্রুষা যখন ব্যর্থ তখন আবারও সেই হাড্ডি খিজির তার নিদান হয়ে দাঁড়ায়।
জেমস জয়েসে যেমনভাবে ডাবলিনকে পাওয়া যায়, নগিব মাহফুজে যেমন কায়রোকে আর ওরহান পামুকে যেমন ইস্তাম্বুলকে তেমনি চিলেকোঠার সেপাইয়ে পাই ঢাকাকে। যে ঢাকা শুধু ছিঁচকাঁদুনে মধ্যবিত্তের নগর নয় বরং সিপাহি বিদ্রোহের দাগ লেপ্টে আছে যার আনাচে-কানাচে। আর কেবল ঢাকাই নয় উপন্যাসটি তার ঘটনাবিচিত্রা ও চরিত্রসূত্রে যাত্রা করে পূর্ব বাংলার নিভৃত পল্লিতেও। যেখানে শ্রেণিশত্রু খতমের জন্য বসে জনতার আদালত। চেংটু, খয়বার গাজী, নাদু পরমানিক, নবেজ উদ্দিন করমালি প্রমুখের কাছে নগরবাসী নেতা আনোয়াররা উপস্থিত হয়ে বৃহত্তর সংগ্রামের হাওয়ার কথা জানান দিলেও মৌলিক সংগ্রাম যেন তাতে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ জাতীয় স্বাধীনতার কাছে তখন অনেকটাই অবহেলিত হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি-প্রশ্ন। উপন্যাসটি পাঠে প্রায়শই ঢাকা থেকে পাঠককে যখন চরাঞ্চলে দৃষ্টি দিতে হয় তখন পাঠকের দারুণ ক্লেশ অনুভব হলেও উপন্যাস পাঠান্তে বোধ জন্মে যে, গ্রাম ও নগরের এ আচমকা উপস্থিতি আমাদের ইতিহাসের অনেক না মেলা হিসাবকে দিনের আলোয় জাজ্বল্য করার জন্য অপরিহার্য ছিল। গ্রাম ও নগরের এই দূরান্বয়ী সম্পর্ক তো আমাদের অজস্র দুর্ঘটের মূলও বটে। উপন্যাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংকটের সমাধান দেননি, কয়েকটি জরুরি রেখাপাত করে গেছেন প্রকৃত চিত্রীর মতো। সময় মানুষকে ক্লীব করে। আবার সেই সময়ই মানুষকে যোদ্ধার রূপ দেয়। ‘চিলেকোঠার সেপাইয়ে’র ওসমানসহ আমাদের সবাইকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার শিল্পক্ষমতায় সময়ের উত্তালে নিক্ষেপ করেন। সময়ের একটি তরঙ্গ থেকেও আমাদের কারও নিস্তার নেই। ওসমানের মতো চিলেকোঠায় গিয়েও আমরা পালিয়ে বাঁচতে পারব না।
শকুন ও শেয়ালে ঘেরা চারদিক। একটি রাস্তা শুধু অনেক দূর চলে গেছে। সেদিক থেকে ওসমানকে এবং আমাদেরও ডাকে বেরিলি, মীরাট আর ভিক্টোরিয়া পার্কে ফাঁসিতে ঝোলা অসংখ্য সিপাহি। ডাকে ফকির মজনু শাহ। সে পথে গেছে হাড্ডি খিজির। নিহত খিজিরের সঙ্গে শামিল হতে ব্যাকুল ওসমান –
গ্রহ নক্ষত্রের ফোকাসে গোলাপি নীল, নীলচে নীল, গোলাপি সাদা এবং নীলচে সাদা আকাশের নিচে এবং পানিকাদা কফ থুতু গু-মুতের ওপর পা টানতে টানতে ওসমানের চেহারায় নতুন দাগ পড়ছে।
আমাদের খোঁয়ারি কি তাতেও ভাঙে?