‘লীলাবতী’ উপন্যাসের প্রথম আকর্ষণ: বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে – সপ্তম শতকের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্যের একমাত্র কন্যার নাম ‘লীলাবতী’। মেয়েটির কপালে বৈধব্যযোগ – এই অজুহাতে কন্যাসম্প্রদানের আগে আগে বরপক্ষ মেয়েটির বিয়ে ভেঙে দেয়। লীলাবতী যখন গভীর দুঃখে কাঁদছিল তখন ভাস্করাচার্য বললেন, ‘মা গো, তোমার জন্য কিছু করার সামর্থ্য আমার নেই, তবে পৃথিবীর মানুষ যেন বহু যুগ তোমাকে মনে রাখে আমি সেই ব্যবস্থা করছি।’ তিনি তাঁর বিখ্যাত গণিতের বইটির নাম দেন লীলাবতী। গল্পটি আমাকে এতই অভিভূত করে যে, একরাতে লীলাবতীকে স্বপ্নেও দেখি। এই নামটা আমার মাথার ভেতর ঢুকে যায়। অনেকদিন ইচ্ছে ছিল স্বপ্নে দেখা মেয়েটিকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখব। নাম দেব ‘লীলাবতী’।
দ্বিতীয় আকর্ষণ: উৎসর্গতে রয়েছে –
শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ/কবি, আমি কখনো গদ্যকার হতে চাই নি।/ আমি আপনার মত একজন হতে চেয়েছি।/ হায়, এত প্রতিভা আমাকে দেয়া হয় নি।
বর্তমান আলোচনার ওপরের অংশটুকু পড়লে আমি মোটামুটি নিশ্চিত, তিনিও হুমায়ূন আহমেদের সাম্প্রতিক উপন্যাস লীলাবতী পড়তে শুরু করবেন, যেমনভাবে বর্তমান আলোচকও করেছেন এবং ‘আকর্ষণের সংখ্যাটি ক্রমেই বাড়তে থাকবে, যদিও উপন্যাসের শেষে এসে কতখানি বোধগত সমগ্রতা পাঠক খুঁজে পাবেন তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। লেখালেখির ভুবনে প্রবাদ-পুরুষ হুমায়ূন আহমেদের দক্ষতা এবং ব্যর্থতা এখানেই।
হুমায়ূন আহমেদ বেশ কয়েক বছর মোটা মোটা উপন্যাস লিখছেন। মোটাটি বইমেলায় প্রকাশিত হয়, চিকনগুলো বছরের অন্যান্য সময়ে। মোটার শুরু ১৯৯৬(?)-এর দিকে। কবি সম্ভবত তাঁর প্রথম মোটা প্রয়াস। সে-তালিকায় পরে যুক্ত হয়েছে ‘শুভ্র’ (২০০০), ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ (২০০৪) এবং বর্তমান বছরে প্রকাশিত ‘লীলাবতী’। যে-কোনো পাঠকই তাঁর দীর্ঘ কলেবরের এ-সকল উপন্যাসে লক্ষ করেন:
প্লটের শৈথিল্য,
অপ্রয়োজনীয় বিবরণের ভার,
মূল কাহিনীতে ভূমিকা রাখে না এমন চরিত্র ও ঘটনার সমাহার।
আর সে-কারণেই তাঁর অধিকাংশ উপন্যাস যে-কোনো ভালো সাহিত্যপাঠকের কাছেই মানোত্তীর্ন হতে ব্যর্থ হয়। যদিও তাঁর গ্রন্থের আকর্ষণক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য। এমন অনেক
উপন্যাস পাঠককেই, এবং তাঁদের অনেকেই বয়ঃভারে ন্যুজও বটে, আমাদের চারপাশে দেখা যায়, যাঁরা এই ঔপন্যাসিকের উপন্যাস বিষয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সীমা রাখেন না, কিন্তু ‘কতটি পড়েছেন’ প্রশ্নের উত্তরে ‘আশি/নব্বই’ বলতে দ্বিধা করেন না। এটি কী কম সম্মোহনী ক্ষমতা যে, তুচ্ছতাচ্ছিল্যকারী একজন বোদ্ধা পাঠকও শেষ করে ফেলেন এই লেখকের এতবেশি বই!
‘লীলাবতী’ শুরু হয়েছে সিদ্দিকুর রহমানকে নিয়ে। সারা উপন্যাস জুড়েই এ-চরিত্রটির দোর্দণ্ড প্রতাপের বিস্তারণ। শেষ হয়েছে জেলহাজতের ছোট্ট ঘরে – যদিও সেটি তাঁর সেই বিস্তারিত প্রতাপেরই ফসল। পরাজয় নয়, ভুল-শুদ্ধের অঙ্ক কষাকষি নয়। নিজেকে তুলে রাখা। সবার ওপরে মানুষের নিজেকে উপস্থাপনের যে গূঢ় ইচ্ছা তারই প্রতিরূপ যেন সিদ্দিকুর রহমান – এবং সে-বিচারে উপন্যাসের নাম ‘ভাস্করাচার্য’ হওয়া প্রত্যাশিত ছিল কি! ‘লীলাবতী’ নামের চরিত্রটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হওয়াতেই সম্ভবত ঔপন্যাসিক সে-নামটি শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
রেললাইনের পাশে মাঠে বসে সাতান্ন বছরের সিদ্দিকুর রহমানের চিন্তায় প্রবহমান পার-করে-আসা জীবনের কথা। সে-প্রবাহে প্রথমে আসে প্রথম স্ত্রী আয়না। আয়নাকে বিয়ে করে আনার পর সিদ্দিকুর রহমানের দাদির কাছে নবপরিণীতা বধূর কী অসহায় অবস্থিতি! দাদির ব্যাপারে সিদ্দিকুর রহমানের সহনশীলতা স্ত্রীর কাছে অসহনীয় এবং অগ্রহণীয়ও বটে। একদিন স্ত্রী জানালো:
আপনার দাদিজান আমার শরীর শুঁকে বলেছেন – আমার শরীরে পরপুরুষের গন্ধ আছে। আপনার গায়ের গন্ধ উনি চিনেন। আপনার গায়ের গন্ধ না-কি আমার শরীরে নেই। প্রথম যে-পুরুষের সাথে মেয়ে শোয় সেই পুরুষের গন্ধ গায়ে লেগে যায়। আমি না-কি বিয়ের আগে অন্যপুরুষের সঙ্গে শুয়েছি। সেই পুরুষের টকটক গন্ধ আমার গায়ে আছে। যে মহিলা এমন কথা বলেন তাকে আমি দুষ্ট মহিলা বলব।
এভাবেই বইয়ের পৃষ্ঠাপাঁচেক পরই শুরু হয় চমক সৃষ্টি। আয়না জিদ ধরে, সে বাপের বাড়ি চলে যাবে এবং যতদিন দাদি জীবিত থাকবে ততদিন সে আসবে না। মৃত্যু-সংবাদ পাওয়ার পর আসবে। এবং সিদ্দিকুর রহমান বাধ্য হন স্ত্রীকে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। এ-পর্যায়ে গল্পের ঘনঘটা বেশ। আয়নাকে আনতে লোক পাঠালেও সে আসেনি। পরের বছর সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। ওদিকে দাদি ফুলবানুর শরীর দীর্ঘ রোগশেষে ক্রমে ক্রমে পচতে থাকে। চিৎ-কাত করে শোয়াতে গেলেও তাকে হাত দিয়ে ধরা যায় না, যদিও ক্রমেই যেন তার বাকশক্তি এবং ঘ্রাণশক্তি বাড়ছে। এরই মধ্যে দ্বিতীয় স্ত্রী রমিলা এসেছে বাড়িতে। দায়িত্ব তার দাদিজানকে দেখার। মাথা নিচু করে বিকারগ্রস্ত ফুলবানুর অশ্লীলতম গল্পও শুনতে হয় তাকে। গল্পে তারপর দেখা যাচ্ছে দাদিজানের জবান বন্ধ হয়েছে, শরীর থেকে তীব্র পচা গন্ধ বেরুচ্ছে, বসতবাড়ি থেকে অনেক দূরে পুকুরপাড়ে দাদিজানের জন্য ঘর
তুলে তাকে রাখা হয়েছে সেখানে, আর তার সেবা করতে নিয়োজিত রয়েছে রমিলা। রাতে সে-ঘরের ভেতর অদৃশ্য মানুষদের হাঁটাহাঁটি-ফিসফাস।
তারপর এক শ্রাবণের মধ্যরাতে রমিলা সাঁতার কেটে গোসল করল, নতুন শাড়ি পড়ল, চুল বাঁধল, চোখে কাজল দিল এবং সিদ্দিকুর রহমানের শোবার ঘরের বন্ধ দরজায় কড়া নাড়ল। স্বামীকে জানাল দাদিজান মৃত্যুর খবর। কিন্তু মরাবাড়িতে স্ত্রীর এত সাজগোজ দেখে সিদ্দিকুর রহমানের মনে হলো: ‘তার কি মাথায় গোলমাল হয়েছে! যে-যন্ত্রণা তার উপর দিয়ে গিয়েছে, মাথায় গোলমাল হবারই কথা।’ এবং সেদিনই প্রথম রমিলার মাথা খারাপের লক্ষণ প্রকাশ পায়। আমরা জানতে পারি, সিদ্দিকুর রহমানের প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের নাম লীলাবতী। মৃত্যুর আগে দাদিজান লীলাবতাকে এ-বাড়িতে নিয়ে আসতে বলেছেন।
জমাট এ-কাহিনীবিস্তার কিন্তু সিদ্দিকুর রহমানের স্মৃতি-সঞ্জাত। স্মৃতি থেকে দৃশ্যগোচরে আসলে প্রত্যক্ষ হয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান বিত্তবান এক মানুষ। লোকমান এবং সুলেমান ভ্রাতৃদ্বয় তার পাহারাদার, টোটাভরা বন্দুক আর অলঙ্গায় অলংকৃত দুই ভাই। তবে সিদ্দিকুর রহমানের নাটকীয়তাও কিন্তু দ্রুত প্রকাশিত। যেমন, রেললাইনের পাশ ধরে তার হাঁটার অভ্যাস। নামাজের সময় তার অদ্ভুত দোয়া: হে রহমানুর রহিম, তুমি রমিলার মৃত্যু দাও ইত্যাদি। চিন্তা এবং আচরণের প্রচলের বাইরে চরিত্রস্থাপন হুমায়ূনের স্বভাবজাত। সিদ্দিকুর রহমান তেমন প্রকাশের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। সারা উপন্যাসব্যাপীই চরিত্রটির প্রচলনবিরোধী ভাব এবং আচার। উপন্যাসের অন্যসব চরিত্র যেমন আনিস, মঞ্জু, সিদ্দিকুর রহমানের বড় ছেলে মাসুদ, পরীবানু সবাই কমবেশি ভিন্নভিন্ন রকমে স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে। হয়েতো লীলাবতীই বরং একমাত্র স্বাভাবিক চরিত্র।
‘লীলাবতী’র কাহিনী শুরু হয়েছে ইংরেজি ১৯৫০ সালে। কাহিনী বিস্তার ঘটেছে সাত বছর ধরে। শেষ হয়েছে ১৯৫৭-তে। স্থান ময়মনসিংহের ধর্মপাশার একটি অঞ্চল। সিদ্দিকুর রহমানের পরিবারের সঙ্গে সে-অঞ্চলের অতীত ঐতিহ্যও জড়িত। সে-ঐতিহ্য বর্ণিত হয় তার আবাস, যেটি নাকি ‘শহরবাড়ি’ নামে পরিচিত, তার বিবরণে। বাংলো ধরণের এ-বাড়িটি বানিয়েছিলেন তার দাদাজান হামিদুর রহমান, বাড়ির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ফুলার কটেজ’ Ñ পূর্ববঙ্গ এবং আসামের প্রথম লেফটেন্যান্ট-গভর্নর ফূলার সাহেবের নামে। বাড়ির ডিজাইন করা হয়েছিল ফুলার সাহেবের লন্ডনের বাড়ির ছবি দেখে। পাখি-শিকারে বিপুল আগ্রহী ফুলার এ-অঞ্চলে এসে ওই বাড়িতে থাকবেন এমনটিই আশা ছিল হামিদুর রহমানের। যদিও শেষ পর্যন্ত ফুলারের আসা হয়নি। স্বদেশী আন্দোলনকে কঠিন হাতে দমন করতে গিয়ে ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেন তিনি। শেষ পরিণতি পদত্যাগ। আর ওই পদত্যাগে ভারতবর্ষের যে-মানুষটি সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি হামিদুর রহমান। অনেকের ধারণা, ওই শোকেই তিনি
সে-বছর মৃত্যুবরণ করেন। পরে বাড়ির নাম ক্রমে পরিবর্তন হয়ে শহরবাড়ি হয়ে যায়। আর এভাবেই রাজনীতি এবং ইতিহাসের মিশেলে লীলাবতীর প্রেক্ষাপট হয়ে উঠতে থাকে দুর্দান্ত আকর্ষণীয়। আনিস সম্পর্কে খোঁজ নিতে এসে ধর্মপাশা থানার ওসি যেদিন সিদ্দিকুর রহমানের বাড়ি থেকে সন্দেহবশত মঞ্জুকে ধরে নিয়ে যেতে থাকে সেদিন যেন ওই আকর্ষণের চূড়ান্ত। সিদ্দিকুর রহমান চাপা গলায় বললেন, ‘আমার বাড়ির মেহমান পুলিশ আমার সামনে থেকে ধরে নিয়ে গেল। এত বড় অপমান আল্লাহপাক আমার জন্যে রেখেছেন? ‘তারপর? আসুন’ ঔপন্যাসিকের ভাষায় শুনি:
তাঁর কথা শেষ হবার আগেই সুলেমান নিঃশব্দে উঠান ছেড়ে গেল। সুলেমানের ছোড়া অলঙ্গায় (বর্শাজাতীয় অস্ত্র) ধর্মপাশা থানার ওসি নিহত হলেন, সেকেন্ড অফিসার গুরুতর আহত হলেন। রিজার্ভ পুলিশ তলব করা হলো ময়মনসিংহ থেকে। সিদ্দিকুর রহমান সাহেবকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ নিয়ে যাওয়া হলো পরেরদিন ভোরে। সেইদিন দুপুরেই শতশত মানুষ ধর্মপাশা থানা ঘেরাও করে থানা জ্বালিয়ে দিল। দৈনিক আজাদ পত্রিকায় যে-রিপোর্টটি ছাপা হলো তার শিরোনাম Ñ ধর্মপাশা থানা ভস্মীভূত ও লুন্ঠিত/ চার পুলিশ নিহত।
বাস্তব-বর্ণনার কাহিনীর যে-উত্তুঙ্গতা, তা কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের আকর্ষণ লেখক-চারিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য। এবার আসছি আনিসের কথায়। আনিসুর রহমান পার্শ্ববর্তী নান্দাইল শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক কলেজের ইতিহাসের বেতনহীন প্রভাষক। সে সিদ্দিকুর রহমানের বাড়িতে জায়গির থাকে – পড়ায় তার দুই মেয়ে জইতরী-কইতরীকে। সর্বজ্ঞ কথক-বর্ণিত এই উপন্যাসের দুটি অধ্যায় কিন্তু আনিস কর্তৃক বর্ণিত। কথক পরিবর্তন ঘটেছে অন্য আরেকটি অধ্যায়েও। সেটিতে বক্তা লীলাবতী। আনিস-বর্ণিত অধ্যায় দুটির একটি উপন্যাসের প্রথম দিকে, অন্যটি মাঝামাঝির পর। আনিস নিজেই জানে তার অন্য নামগুলো – কুঁজা মাস্টার, গুঁজা মাস্টার, ভোঁতা মাস্টার। তার অনেক পাঠ, অনেক প্রশ্ন, অনেক না-বলা উচ্চারণ। মানুষটির একটি সমৃদ্ধ অতীত আছে। একসময়ে সে আন্দোলন করেছে, দেওয়ালে চিকা মেরেছে, মিটিং করেছে বিপ্লব আনার। তাকে বই পড়া শিখিয়েছে মালেক ভাই নামের এক কমরেড। সে বলতে চায়, ‘আমি আল্লাহ খোদা, ভগবান, জেসাস ক্রাইস্ট, গড কিছুই বিশ্বাস করি না।’ কিন্তু সে পারে না, কারণ সে ক্রীতদাস। তিনবেলা অন্ন দিয়ে সিদ্দিকুর রহমান তাকে কিনে নিয়েছেন। সে অন্নদাস। তার ভাবনা:
আমার সব স্বপ্ন আমার সঙ্গে গর্তে ঢুকে গেছে। কোনোদিন যদি গর্ত থেকে বের হই তাহলে কি স্বপ্নগুলি সঙ্গে নিয়ে বের হব, না-কি তারা গর্তেই থেকে যাবে?
আনিস ইতিহাস খুঁজে বেড়ায়। সে জানে লীলাবতী নামে বিদুষী গণিতজ্ঞের কথা। যেমন সে জানে সিদ্দিকুর রহমানের দাদা হামিদুর রহমান ‘খান বাহাদুর’ উপাধি পেয়েছিলেন চারজন স্বদেশীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। চারজনের তিনজনের হয় ফাঁসি, একজনের কালাপানি আর হামিদুর রহমানের ‘খান বাহাদুর’ উপাধি।
সিদ্দিকুর রহমান বা আনিসের চমকে দেওয়ার মতো অনেক কথা বা আচরণ আছে। তবে সবচেয়ে বেশি চমকাতে পারে রমিলা। তার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাকে মনে হয় অতিমানবীয়। আবার তার মস্তিষ্ক বিকৃত বলেই কি তার সে-ক্ষমতা বেমানান ঠেকে না! তুফানের যে-রাতে লীলাবতী সিদ্দিকুর রহমানের বাড়িতে আসে, আগেভাগেই সে-সংবাদ রমিলা জানিয়েছিল প্রথমে তার গর্ভজাত দুই মেয়েকে এবং শেষে তার স্বামীকে। প্রথমবার সংক্ষিপ্ত সফরশেষে ঢাকার ট্রেনে একদিন লীলাকে তুলে দেওয়া হয়। সেদিন রমিলার পাগলামিটা বাড়ে। সিদ্দিকুর রহমান যখন তাকে অনুরোধ করে খেয়ে নেওয়ার জন্য তখন রমিলা বলেছিল যে, লীলা ফিরে আসছে এবং সে লীলার সঙ্গে খাবে। এবং আমরা দেখি লীলা সত্যসত্যই ফিরে এসেছে। এমন অভাবিতপূর্ব চমকের ছড়াছড়ি হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য উপন্যাসের মতো লীলাবতীতেও দুর্লভ নয়। এবার আসছি লীলাবতীর কথায়। লীলাবতীর বয়স একুশ, যখন সে নান্দাইলে আসছে। ঢাকার ইডেন কলেজে পড়ে সে। এবার অনার্স পরীক্ষা দিয়েছে। সে তার বাবাকে দেখতে সুদূর ঢাকা থেকে ট্রেনে এসেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে দুঃসম্পর্কের মঞ্জু মামাকে। বাবা সম্পর্কে তার ধারণা নিচুমানের, যদিও যখন দেখা হলো বাবার সঙ্গে অবতারণা হলো ভিন্নতর একটি দৃশ্যের, সেটি এমন:
সিদ্দিকুর রহমানের ঘুম ভাঙল ফজরের আজানের কিছুক্ষণ পর। তিনি চোখ মেলে দেখলেন অসম্ভব রূপবতী অপরিচিত একটি তরুণী তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তরুণীর মুখ হাসিহাসি। চোখে বিস্ময়। তাঁকে চোখ মেলতে দেখেই তরুণী তাঁর দিকে ঝুঁকে এসে বলল – বাবা, আমি লীলা। লীলাবতী। আপনার কি শরীর খারাপ?
মনে হয় আবহমান বাংলার শাশ্বত পিতা-পুত্রীর দর্শন-দৃশ্য।
লীলাবতী অসংকোচে তাঁর বুকের উপর হাত রাখল। সিদ্দিকুর রহমানের দুই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করল। কতদিন পর নিজের মেয়েকে দেখছেন। কী সুন্দর মেয়ে।
এভাবেই উপন্যাসে লীলাবতীর অনুপ্রবেশ। সিদ্দিকুর রহমানের গভীর আবেগ জন্মাতেও সময় নেয়নি। যেমনভাবে রমিলা বা তিন ছেলেমেয়েও খুব দ্রুতই কাছে টেনেছে তাকে। এমনকি রমিলার বড় ছেলে মাসুদের স্ত্রী পরীবানুও তাকে দ্রুত ভেবেছে আপনজন। আরো যে-একজন লীলাবতীকে প্রিয়জন ভেবেছিল, সে আনিস মাস্টার। সিদ্দিকুর রহমানের বাড়িতে পুলিশ
সার্চশেষে পেয়েছিল চারটে বাঁধাই করা মোটামোটা খাতা – প্রতি পাতায় একটি শব্দ লেখা ‘ লীলাবতী’।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে একটি অধ্যায় আছে উপন্যাসটিতে, যেটি লীলাবতীর লেখা। সেখানে সে লিখেছে তার ভাইয়ের কথা। বিশেষ করে মাসুদ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করার পর তার শেষকৃত্য নিয়ে যেসব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল সেগুলোর কথা। লীলা আরো লিখেছে তার বাবার কথা – যৌবনকালে বাবা নদীর পারে থেকে অতীন্দ্রিয় যে-অবয়ব দেখেছিল তার কথা বাবা সম্পর্কে তার সামগ্রিক মূল্যায়ন এমন:
আমি এখন আমার বাবার প্রসঙ্গে কিছু কথা বলি। তিনি শুরুতে আমার কাছে ছিলেন অতি দুষ্টু একজন মানুষ। যে তাঁর স্ত্রী-কন্যাকে দূরে ঠেলে দেয় – আরেকটি বিবাহ করে। সুখে যে ঘর-সংসার করে তা-না। স্ত্রীকে তালা আটকে বন্দি করে রাখে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হবার পর মনে হলো – ভয়াবহ দুষ্টু মানুষদের একজন সম্ভবত তিনি না। ক্ষমতাধর মানুষদের দুর্বলতা তাঁর মধ্যে আছে। বদরাগ, অহঙ্কার – এইসব বিষয় তাঁর কাছে চরিত্রের অহঙ্কার। দুর্বলতা না। এখন মনে হচ্ছে মানুষটা ভাবুক প্রকৃতির। শুধু যে ভাবুক তা না। তাঁর মধ্যে চিন্তা করার দুর্লভ ক্ষমতা আছে। মানুষটির ভালোবাসার ক্ষমতাও প্রবল। তাঁর ভালোবাসা আড়াল করার চেষ্টাটাও চোখে পড়ার মতো – আমি ভালোবাসব কিন্তু কেউ যেন তা বুঝতে না পারে।
হয়তো এমনটি বলা অত্যুক্তি হবে না যে, সিদ্দিকুর রহমানের যে-মূল্যায়ন লীলাবতীর লেখায় আমরা পাই সারা উপন্যাসের কাহিনীর ভেতর দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ নিজেও কিন্তু তাই প্রমাণ করেছেন। সিদ্দিকুর রহমানের মতো চিন্তা করার দুর্লভ ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্র হুমায়ূনের অন্যান্য উপন্যাসেও দুর্লভ নয়্। ‘বাণী’ বাক্যের মতোই তাঁদের অনেক উচ্চারণ, যা পাঠককে দেয় গভীরতর উপলব্ধির স্বাদ।
লীলাবতীর তেমন কয়েকটি হলো:
সুখী মানুষদের মধ্যে হঠাৎ বৈরাগ্য দেখা দেয়। অসুখী মানুষরা সাধু-সন্ন্যাসী হয় না। তৃপ্ত পরিপূর্ণ মানুষরাই হয়। (পৃ ২০)
মানুষ সব জানতে চায় কিন্তু জানতে পারে না। আমরা অল্পই জানি কিন্তু ভান করি অনেক জানি। (পৃ ৬৭)
আনন্দ পেলে মানুষ তার আনন্দের খবর সবাইকে জানাতে চেষ্টা করে। মানুষ দুঃখ পেলে কিংবা কষ্ট পেলে তার খবর কিন্তু জানাতে চায় না। গোপন করে রাখে। (পৃ ৬৮)
বিষধর সাপের বিষ শেষ হয়ে গেলে সাপের মৃত্যু হয়। পুরুষের তেজ শেষ হওয়া মানে পুরষের মৃত্যু। (পৃ ১০২)
যে একবার বিশ্বাস ভঙ্গ করে সে বারবারই করে। (পৃ ১০৬)
যে ভালো সে নিজে জানে সে ভালো। যে মন্দ সে নিজে জানে না সে মন্দ। (পৃ ১০৯)
অনেক সময় মানুষ তার নিজের পছন্দের কথা নিজে বুঝতে পারে। বোকাদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটে না। বোকারা খুব ভালোমতো জানে কোনটা তার পছন্দ, কোনটা তার পছন্দ না। (পৃ ১২১)
পৃথিবীর মহৎ চিন্তার আশি ভাগ করা হয়েছে জেলখানায়। (পৃ ১৫৬)
ভূত দেখা কলেরা রোগের মতো। একজনের হলে তার আশেপাশে দশজনের হয়। (পৃ ২০২)
বর্তমান আলোচনার যে-কোনো পাঠকের কাছে বিসদৃশ মনে হতে পারে বাণী-সদৃশ উপর্যুক্ত বাক্যগুলোর উৎকলন। আসলে আমি চেষ্টা করেছি হুমায়ূনের উপন্যাসের প্রতি পাঠকের আকর্ষণের কারণ-অনুসন্ধানের। রহস্যময় চরিত্র, অব্যাখ্যেয় কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য ঘটনাবলির সঙ্গে সঙ্গে আকর্ষণীয় বাক্যবলির ব্যবহারও হুমায়ূনের উপন্যাসের বিবেচ্য উপাদান।
এবার আসছি ইতিহাস-সম্পৃক্ত লীলাবতী প্রসঙ্গে। ‘বাংলা বিশ্বকোষে’ (৪র্থ খণ্ড, মুক্তধারা, ১৯৭৬) ‘ লীলাবতী’ ভুক্তিতে বলা আছে:
সাবধানতা সত্ত্বেও বিবাহের পরেই লীলাবতী বিধবা হন। ভাস্করাচার্য কন্যাকে যতœসহকারে বিদ্যাশিক্ষা দেন। ভাস্করাচার্য প্রণীত বিখ্যাত গ্রন্থ সিদ্ধান্ত-শিরোমণি-এর তৃতীয় খণ্ড লীলাবতী কর্তৃক রচিত হয়।
কথাকার হুমায়ূন আহমেদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক। বর্তমান আলোচনার শুরুতে ‘লীলাবতী’ উপন্যাসের ফ্ল্যাপ থেকে যে-উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে বিশ্বকোষের ভুক্তির তথ্যগত পার্থক্য বিপুল। বিদুষী লীলাবতীকে নিয়ে যে-তথ্যভ্রম সৃষ্টি হলো তার সমাধানের দায়িত্ব বিজ্ঞানী-ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ নিজেই যদি দেন, তবে তাঁর বিশাল পাঠকসমাজ উপকৃত হবেন বলে বিশ্বাস। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, সম্প্রতি প্রকাশিত এ-উপন্যাসে হুমায়ূন অনেক বেশি একনিষ্ঠ। বিশেষ করে গ্রামীণ জীবনের একটি প্রাণবন্ত চিত্র হিসেবে লীলাবতী উপন্যাসটি ভবিষ্যতে উল্লেখের দাবি রাখবে। সংস্কার ও শক্তির এমন সামগ্রিক রূপায়ণ ঔপন্যাসিকের কোনো গ্রন্থে লভ্য বলে মনে হয় না।
লীলাবতী
হুমায়ূন আহমেদ
অন্যপ্রকাশ
ঢাকা, ২০০৫
২২৫ টাকা
রচনাকাল: ২০০৫