রাষ্ট্রযন্ত্রের আড়ালে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কীভাবে লঘুকণ্ঠে লড়াই সংগ্রাম করে দৈনন্দিন জীবনাচারে অভ্যস্থ এবং সেই অভ্যস্থ জীবনের নিরর্থক নির্ভরতায় মানুষে মানুষে যে অদৃশ্য বন্ধনে জালের মতো জড়িয়ে থাকা নিসর্গ চলনবিল, তার পরিবেশ প্রতিবেশ জনজীবন আর যেখানে শেকড় গাড়ে অশিক্ষা কুশিক্ষার অনুৎপাদনশীল আবেগ, সেই শ্রেণী গোষ্ঠীর আবেগ, জীবনাচার, নির্ভরতা, দৈনন্দিন জীবন সংগ্রাম, অভ্যাস, পরজীবিতা, পরনিন্দা, শ্লোকে শ্লোকে গেঁথে চলেন কথা সাহিত্যিক জাকির তালুকদার তাঁর ‘হাঁটতে থাকা মানুষের গান’ উপন্যাসে। ‘হাঁটতে থাকা মানুষের গান’ জাকির তালুকদারের তৃতীয় উপন্যাস।
বর্ষকালের কোনো এক অদ্ভুত ঘোর লাগা রাতে জিন্দান-শাহ পীরের তাবিজে ভর করে চলনবিলের ধর্মপ্রাণ যুবক আবদুর রহিম স্বপ্নে এক অদ্ভুত মায়া তৈরি করে। আবদুর রহিম বড়োই ভীতুমনের দুর্বল চিত্তের পুরুষ হলেও পুরো উপন্যাসে আমরা তাকে দু’বার খুব সাহসী ভূমিকা পালন করতে দেখি। আর সেই সুযোগ আর রহস্যকে হাতিয়ার করে এই সময়ের শক্তিমান কথা সাহিত্যিক জাকির তালুকদার অমন এক ভীতু চরিত্র আবদুর রহিমের মধ্যেও এক ধরনের আরোপিত সংগ্রামবোধ জাগানোর প্রয়াসে অনায়াসে ১৪৪ পৃষ্ঠা কখন যে ভরাট করে ফেলেন, তার স্বভাবসুলভ ঘটনা অনুঘটনার হাত ধরে পাঠক তা একটুও টের পান না। চলনবিলের চালচিত্র, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, ওখানকার সহজ সরল মানুষের পাশাপাশি রাষ্ট্র কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে তৈরি করা শোষক শ্রেণীর দৈনন্দিন অনাচারের বিবরণ, গ্রামীণ সহজ সরল মানুষগুলোর কঠিন জীবন সংগ্রাম, লঘুবুদ্ধি, ধর্মান্ধতা, শ্লেষ, মুর্খামী, ভণ্ডামী, আচার-আচরণ, কৃষ্টি সংস্কৃতিকে ঘিরে এগিয়ে চলে উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র লালসালু’তে মজিদ যেমন একটা যুক্তিসঙ্গত মাজারের সন্ধান পায়। জাকির তালুকদারের ‘হাঁটতে থাকা মানুষের গান’ উপন্যাসে সেই ধরনের একটা প্রচেষ্টা আবদুর রহিমকে কী করানো হয়েছে? যেখানে জিন্দান-শাহ পীরের অলৌকিক তাবিজের পেছনে যুবক আবদুর রহিমকে ছোটানোর ব্যাপারটা কী তাহলে পুরনো বোতলে নতুন মদ ঢেলে খাবার আকাঙ্খার মতো ব্যাপার? পড়তে গিয়ে পাঠক সন্ধান পাবেন এক বোবা যুবতীর। স্বপ্নে তাবিজের পরিবর্তে বোবা যুবতী মেয়েটি হয়তো যৌবন উন্মাদনা দেয়। এই বোবা মেয়েটি হয়তো আবদুর রহিমের স্বপ্নের নায়িকা। ‘হাঁটতে থাকা মানুষের গান’ জাকির তালুকদারের কোন ধরনের উপন্যাস? একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে কিছু পার্শ্ব চরিত্রের আরোপিত সাহায্য নিয়ে কয়েক মাসের ঘটনার কিছু রিপোর্টিং ফলাফলকে পুঁজি করে দিলেই উপন্যাস হয়ে যায় কীনা তা জানার জন্য জাকির তালুকদারকে আমি তাড়িয়ে বেড়াবো। উপন্যাসে যারা জনগোষ্ঠী, তাদের কী কী বিষয় উঠে আসাটা উপন্যাসের স্বার্থপূরণের জন্য জরুরী, চরিত্রের পুনঃপুনঃ কেন্দ্রিকতার জন্য কী কী সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য প্রয়োগ করা প্রাসঙ্গিক, কোন কোন বিষয় আশয় উপস্থাপনের ক্ষমতা থাকলে উপন্যাসের প্যাটার্ন বদল করা সম্ভব, উপন্যাসের সময় কাল কতোটুকু হওয়া চাই, পাত্রপাত্রীরা কী কী করবে, কী কী করবে না, পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা কী
হবে, শুধু রাতের গল্প বলা হবে নাকি দিনের আলোতে একই চরিত্রগুলো কী করে কী করে না তার পূর্ণাঙ্গ নাকী আংশিক বিষয়াবলী উপন্যাসের আঙ্গিক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় ইত্যাদি বিষয়ে আমি জাকির তালুকদারের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। তখন হয়তো তাঁর ‘হাঁটতে থাকা মানুষের গান’ উপন্যাসটা আমার কাছে আরো বেশি বোধগম্য হবে।
নাকী কিছু অলৌকিক ঘটনার সীমাবদ্ধতার গ্যারাকলে আমাদের যাদুবন্ধী রেখে জাকির তালুকদার শুধু গল্প শুনিয়ে যেতে ভালোবাসেন? শাজেরজাদী যেমন রোজ রাতে রাজাকে একটা নতুন গল্প শোনাতেন আমরাও জাকির তালুকদারের কাছে তাই শুনতে থাকি। কারণ, নতুন গল্প শুনাতে না পারলে রাজা শাহেরজাদীকে হত্যা করবেন। পাঠক হয়তো তা না করে জাকির তালুকদারকে শুধু এড়িয়ে চলবে। কিন্তু জাকির তালুকদার তাই নানা ফন্দি করে নতুন ঘোর লাগানের চেষ্টা করেন পাঠককে। পিসিখালি মসজিদের খাদেমের ছোট মেয়ে টুলটুলি তাই খুব বেশি কথা বলে। পাঠকের তখন না হেসে কী আর উপায় আছে?
‘হাঁটতে থাকা মানুষের গান’-এর দীর্ঘ প্যাঁচালীতে সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র আলাউদ্দিন মাস্টার তাই কিছুটা দাপুটে অবস্থান নিয়ে গল্পকে হয়তো ধরে রাখেন। গৌরাঙ্গকে পাগল বানানো আর ভালো বানানোর মাধ্যমে যে গল্প জাকির তালুকদার পাঠককে শুনতে বাধ্য করেন, সেখানে গৌরাঙ্গকে পাগল না বানিয়েও চরিত্রটি কিন্তু পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু জাকির তালুকদার শেক্সপেরিয়ান ভঙ্গিতে যখন তাকে খুন করান তখন তা আমার কাছে অনেকটা খেলো হয়ে যায়। পেছনে ধরা পড়ে তার বঙ্গভাই নিয়ে ঘটনার সাবালিক বয়ান আর এন্তাজ ও নান্নুর কারবার। খাদেম সাহেবকে কী করে ভুলে যাবে মানুষ? সে না হয় বাদ দিলাম, বোবা যুবতী মেয়েটা উপন্যাসে যে প্রবল শক্তিশালী মোচড়ের ঝিলিক মেরেছিল, জাকির তালুকদার সচেতনভাবে তা যেন এড়িয়ে গেলেন। এখানে আমার অনেক প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে জাকির তালুকদারকে। বোবা মেয়েটি তো অনেক কিছু করতে পারত। করল না কেন? নাকি প্রকাশকের কোনো অদৃশ্য তাড়না খেয়ে জাকির তালুকদার উপন্যাস শেষ করতেই ব্যস্ত ছিলেন তখন?
উপন্যাস লেখার আগে তার ব্যাপ্তি, অবয়ব, পাত্রপাত্রী, কল্পকাহিনী, কাল সচেতনতা ইত্যাদি বিষয়ের যে প্রাসঙ্গিক প্রয়োজনীয়তা তা ধরে রাখতে গিয়ে জাকির তালুকদার যেন ইচ্ছে করেই কদমের মতো শক্তিশালী ক্যারেক্টারকেও আহত করে হাসপাতালে শুইয়ে রাখেন। অথচ যে দেশি কুকুরটি মিছিলের পিছু পিছু যাচ্ছিল – তাকে মেরে ফেললে তো উপন্যাস বিলিন হয়ে যাবার কথা। পাঠক হিসেবে আমার তখন খুব কষ্ট হয়। কী সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হওয়া এমন একটা উপন্যাস শেষ করার ইচ্ছে জাকির তালুকদার নিজেই যেন গুটিয়ে রাখেন। জাকির তালুকদারের কী হাত ব্যথা করে? কেন তা আমার মাথায় আসে না। চলনবিলের বর্ষাকালের রাত যেমন পাঠককে নস্টালজিয়ায় ডুবিয়ে রাখে, দিনের বেলায় সেই চলনবিলের দিকে জাকির তালুকদার যেন পাঠককে ইচ্ছে করেই নিতে চাননি। অথচ পাঠক হিসেবে বারবার আমার শুধুমাত্র বর্ষকাল নয় বাংলার ছয় ঋতুর দিনরাত আর চলনবিলের যে রূপ পরিবর্তন তা দেখার ইচ্ছে ছিল ‘হাঁটতে থাকা মানুষের গান’ উপন্যাসে। যেসব পাঠক জীবনে একবারও
চলনবিল দেখেননি তাদেরকে জাকির তালুকদার ইচ্ছে করেই যেন চলনবিলের সেই নস্টালজিক ঋতু পরিবর্তনের গান শোনাতে চাননি। কিন্তু সকল পাঠক তো আর চলনবিলের মানুষ নয় যে বাকী সময়টা তারা এমনিতেই বুঝে নিতে পারবেন। চলনবিলের দিন রাত্রি ঋতু পরিবর্তন কী সকল পাঠক হুট করে বুঝতে পারবেন? এক্ষেত্রে জাকির তালুকদার অযথা যেন একটু বেশি কঞ্জুস রয়ে যান। একজন চলনবিল বাসী হয়েও জাকির তালুকদার তাই অনায়াসে চলনবিল শুকানোর দিনগুলোতে সেখানে যে প্রাণের জোয়ার স্রোতের মতো বইতে থাকে রহস্যময় কারণে তা হয়তো উপেক্ষা করেন। তখন পাঠক হিসেবে আমার ভারী অতৃপ্তি থেকে যায়। অথচ যা হয়তো এই উপন্যাসে খুবই জরুরী বিষয় হতে পারত। সত্যি কথা হল যা ‘হাঁটতে থাকা মানুষের গান’ উপন্যাসে পাঠক হিসেবে আমি খুঁজতে গিয়ে পাইনি। পেয়েছি জাকির তালুকদারের পছন্দের চরিত্র ঝিমানো স্বভাবের আবদুর রহিমের চোখে অপরিপক্ক এক চিত্র, যা শেষ পর্যন্ত কী আবদুর রহিমের মতো অপরিপক্ক হয়ে যাবার অছিলা খোঁজে কীনা আমার জানা নেই?
‘হাঁটতে থাকা মানুষের গান’ উপন্যাসে শক্তিশালী ক্যারেক্টার গুলো হল চলনবিল, আলাউদ্দিন মাস্টার, বোবা যুবতী, কদম আর গৌরাঙ্গ। এদের সকল বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে জাকির তালুকদার কেন এতো গরিমসি করেন নাকি সচেতনভাবেই তাদের সকল বৈশিষ্ট্য তুলে আনতে লেখকের সময় নেই তা আমার বুদ্ধিতে কুলোয় না? পাঠক হিসেবে আমার তখন জাকির তালুকদারের উপর চল্লিশ হাজার বছরের রাগ তৈরি হয়। আহা কতো সম্ভাবনাময়ী ক্যারেক্টারগুলোকে একজন লেখক এভাবে এড়াতে পারলেন? উল্টো যখন দেখি ভাড়া করা অনুযোগী ক্যারেক্টারগুলো যেমন এন্তাজ, মুন্না, বঙ্গভাই, এদের কর্মকাণ্ড নিয়েই জাকির তালুকদার বোগল বাজাতে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন আমার রাগ ক্ষোভ থেকে বিক্ষোভের দিকে ধাবিত হয়। ইচ্ছে করে জাকির তালুকদারের হাতের কলমটি কেড়ে নিয়ে নিজেই বাকীটা লিখতে বসি।
সব দিক বিচার করে হাঁটতে থাকা মানুষের গান’কে উপন্যাসের খণ্ডাংশ বললে বরং অতিরিক্ত আদিক্ষেতাই দেখায়। পাঠক হিসেবে বলতে পারি জাকির তালুকদার খুব যতেœ উপন্যাসের যে গ্রাউন্ড তৈরি করেছেন তা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু ইট বালি সরকি সিমেন্ট যেমন বিল্ডিং বানানোর উপাদান কিন্তু দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার, ক্রিয়েটিভ আর্কিটেক্ট, কুশলি রাজমিস্ত্রী আর সুন্দর নকশা না হলে বিল্ডিং যেমন অসুন্দর হয়ে যাবার আশংকা থাকে, বিল্ডিংয়ে যেমন প্রটেকশান থাকে না, ভূমিকম্প থেকে ওই বিল্ডিং রক্ষা পাবে কীনা কেউ জানে না, ওই বিল্ডিংয়ে পর্যাপ্ত আলো বাতাস এফোড় ওফোড় হুটোপুটি করতে পারবে কীনা দুঃশ্চিন্তা থেকে যায়, তেমনি নেয়ামুল কোরআন বুকে নিয়ে আবদুর রহিমের মাধ্যমে জাকির তালুকদার যতোই একটা ভালো উপন্যাস লেখার চেষ্টা চালান ততোই বুঝি তার সম্ভাবনাকে আতুর ঘরেই মেরে ফেলার দুর্বলতা ধরা পড়ে বা সময় উপেক্ষার বিষয় উন্মেচিত হতে থাকে।
আমরা যদি ঢাকার অভিজাত চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে কয়েকজন কথা সাহিত্যিককে তিন দিনের জন্য আটকে রাখি আর বলি আপনারা প্রত্যেকে একটা করে
উপন্যাস লিখুন। যাঁর উপন্যাস শ্রেষ্ঠ হবে তাঁকে বাংলাদেশী নোবেল পুরস্কার দেওয়া হবে। আপনাদের জন্য সময় মাত্র তিন দিন। পুরস্কারের মূল্যমান দশকোটি টাকা। খাবার দাবার, ঘুমানোর ব্যবস্থা, লাইব্রেরি, ডিকশোনারি, বিনোদন সকল বিষয়ের যথেষ্ট সাপোর্ট দেওয়া হবে। কারণ, এই প্রজেক্টে হয়তো চোখ বন্ধ করে মাল্টি কর্পোরেট কোম্পানির কেউ কেউ বিনিয়োগ করবেন। নাচ, গান, বিনোদন, সুইমিং, সকল সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু এই তিন দিন কোনো লেখক আমাদের কার্যক্রম শেষ না করে বাসায় যেতে পারবেন না। কাছের কোনো আত্মীয় মারা গেলেও না। উপন্যাস তাঁকে তিন দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। কারণ, আমরা জানি অমর একুশের বইমেলা উপলক্ষ্যে আপনারা কেউ কেউ এক রাতেও উপন্যাস শেষ করার মতো রেকর্ডধারী। যদি সত্যি সত্যিই এমন একটা আয়োজন করে আমাদের লেখকদের দিয়ে উপন্যাস লেখানোর একটা প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়, চলুন দেখা যাক এবার সেখানে কে কী লিখছেন? কারণ এই লড়াইটা লেখকদের হলেও এটা অনেকটা আমাদের ইস্কুল সময়ের শীতকালীন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মতো। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করাই এখানে আসল কাজ। তো চলুন আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি কে কী লিখছেন?
হুমায়ূন আহমেদ শুরু করেছেন একটা আজিব টাইপের নয়া হিমু ক্যারেক্টার দিয়ে। দিনের বেলায় এই হিমু সম্মেলন কেন্দ্রের ছাদে উঠে বসে থাকে। রাতের বেলায় হলে ঢুকে কাপের্টের নিচে তার নিখোঁজ প্রেমিকাকে দুরবীন দিয়ে খোঁজে। হিমুর ধারণা তার প্রেমিকা হয়তো হাওয়া খেতে পাশের চন্দ্রিমা উদ্দ্যানে একা একা ঘুর ঘুর করছে। কিন্তু তার নাগাল সে কিছুতেই পাচ্ছে না।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল শুরু করেছেন সূর্যের আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মি নিয়ে আদম নামের এক বিজ্ঞানীর গবেষণা দিয়ে। আকাশের অদৃশ্য সেই ফুটোটি বন্ধ করার উপায় বের করবেন আদম। আর এজন্য তার আছে তেরো জন লিলিপুট বিজ্ঞানী। যাদের বয়স তেরো থেকে ঊনিশ। যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে দিনরাত আদমের নের্তৃতে গবেষণায় মত্ত। পৃথিবীর তাপমাত্রা স্বাভাবিক করতে গ্রিন হাউজ এফেক্ট তারা যে করেই হোক ঠেকাবেন। নইলে পৃথিবীকে আর রক্ষা করা যাচ্ছে না। সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। পরিবেশ প্রকৃতি দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আদম মনে করেন তাদের গবেষণা ব্যর্থ হলে পৃথিবী নিশ্চিত ধ্বংস হয়ে যাবে।
সৈয়দ শামসুল হক শুরু করেছেন এক অদ্ভুত মানুষ টাকু সোলায়মানের গল্প দিয়ে। এই টাকু সোলায়মান শুধু হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। জন্মের সময় টাকু সোলায়মান দেখতে হয়েছিল একশো কুঁড়ি বছরের বৃদ্ধের মতো। মাথায় তার বিশাল টাক। মুখ ভরতি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। যতোই তার বয়স বাড়ে ততোই এই টাকু সোলায়মান বৃদ্ধাবস্থা থেকে ইয়ং হতে থাকে। সবাই বয়স বাড়লে যেমন বুড়ো হয় এই টাকু সোলায়মান তার ঠিক উল্টো। তার লাইভ সাইকেল উল্টো। বৃদ্ধ থেকে ধীরে ধীরে সে একদিন শিশু হয়ে যাবে। এবং একেবারে ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো হয়ে যাবার পর এই টাকু সোলায়মানের হয়তো মৃত্যু হবে। তার একমাত্র
মেয়ের মেয়ে মানে তার নাতনী তখন তাকে কোলে করে ঘুরবে। কারণ, টাকু সোলায়মানের বউ ততোদিনে একশো বছরের বৃদ্ধা।
সেলিনা হোসেন শুরু করলেন এক মুক্তিযুদ্ধের সাহসী নারীকে দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই নারীর বিয়ের রাতেই তার স্বামী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ঘর ছাড়েন। আজো তার স্বামী বেঁচে আছেন কীনা সখিনা বিবি তা জানেন না। সারা বাংলাদেশের বদ্যভূমি গুলো সে চষে বেড়ায়। সখিনা বিবির ধারণা তার স্বামী যদি যুদ্ধে মরেও যায় বদ্যভূমিতে সে তাঁর লাশ খুঁজে পাবে।
ইমদাদুল হক মিলন শুরু করলেন ভারত বাংলাদেশ বর্ডারের নো ম্যানস ল্যান্ডে বিএসএফের গুলিতে নিহত এক কিশোরীর গল্প দিয়ে। ছিটমহলের বাসিন্দা এই কিশোরী হেনা। কিশোরী হেনা গুলিতে নিহত হবার আগে কয়েকজন দুষ্টু কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছিল। অমাবস্যার রাতে সে ছিটমহলের বাড়ি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে গিয়েই বিএসএফের গুলির মুখে পরে। তারপর যত্তোসব বিপত্তি।
নাসরিন জাহান শুরু করেছেন অদ্ভুত এক কালো বিলাই দিয়ে। এই কালো বিলাই দিনের বেলায় লেখকদের টেবিলের নিচে আরামে ঘুমিয়ে থাকে। রাতের বেলায় এই কালো বিলাই ভৌতিক সব কর্মকাণ্ড শুরু করে। কালো বিলাইকে আটক করার জন্য সিকিউরিটির লোকজনদের সাথে বিশাল এক ঝামেলা হয়। সেখানে র্যাব পর্যন্ত আসে। ঘটনা কোন দিকে যাবে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
কাজী আনোয়ার হোসেন শুরু করেছেন এক গোয়েন্দার গল্প দিয়ে। এই গোয়েন্দার নাম মাসুদ রানা। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্র“য়ারি ঢাকার পিলখানায় যে বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছিল তার নেপথ্যে কে বা কারা জড়িত ছিল তাদের খুঁজে বের করতে মাসুদ রানা অভিযান শুরু করেছেন। সে বিভিন্ন বিডিআর ক্যাম্পে তার গোয়েন্দা কাজ করছেন। বর্তমানে মাসুদ রানা কুড়িগ্রামের রৌমারী ক্যাম্পে যাবার জন্য পুরাতন ব্রম্মপুত্র ঘাটে অপেক্ষা করছেন।
আনিসুল হক শুরু করেছেন এক বোবা মেয়ের প্রেমের গল্প দিয়ে। বোবা মেয়েটি ইন্টারনেটে চ্যাট করতে করতে এক সময় শহরের সবচেয়ে ভয়ংকর সন্ত্রাসী, পুলিশের তালিকায় যে কীনা এক নম্বর দাগী আসামী তাকে ভালোবাসতে থাকে। যেদিন বোবা মেয়েটি তার প্রেমিকের সাথে দেখা করবে, সেদিন বাংলাদেশ পুলিশ ওই সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। মেয়েটি যে বোবা তা সে ওইদিন-ই প্রথম বুঝতে পারে। জেলখানায় বসে মনে মনে শপথ করে ছাড়া পেলে সে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ছেড়ে দিয়ে বোবা মেয়েটিকে বিয়ে করে বিদেশে কোথায় চলে যাবে।
ঘুরতে ঘুরতে আমরা যখন আমাদের জাকির তালুকদারের সামনে আসি দেখি, তিনি শুরু করেছেন চলনবিলের নিচে এক বিশাল রতœভাণ্ডারের খোঁজে একদল খনিশ্রমিক দিনরাত খনন করে যাচ্ছেন এমন এক জটিল আজগুবি গল্প দিয়ে। সেখানে উপস্থিত বাংলাদেশী ভূতাত্ত্বিকবিদ, খনি গবেষক, প্রকৌশলী আর খনি শ্রমিকদের ধারনা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী
পারমানবিক বোমা তৈরির উপাদান ইউরোনিয়াম আর সাদা গ্রাফাইটে চলনবিলের তলদেশ পুরোপুরি ভরপুর। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশী যে সকল ভূতাত্ত্বিক এই কাজে জড়িত তারা সবাই এটা ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না। রাজনৈতিক দলগুলো আবার এটা নিয়ে মহা ক্যাচাল শুরু করেছে। কেউ বলছে রাশিয়া বা ভারত থেকে খনি বিশেষজ্ঞ আনা হোক। কেউ বলছে আমেরিকা বা পাকিস্তান থেকে আনা হোক। একদল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রীরা আবার দেশী বিশেষজ্ঞ দিয়ে কাজটা করানোর জন্য মহা আন্দোলনে যাবার হুমকি দিচ্ছেন। খনি থেকে ইউরোনিয়াম আর সাদা গ্রাফাইট তোলার কাজ আপাতত বন্ধ। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কোনদিকে যায় সেই অপেক্ষায় সবাই। তার মধ্যে গুজব শোনা যাচ্ছে কে বা কারা যেন রাতের অন্ধকারে চলনবিলের নানা পয়েন্টে খনন কাজ করছে। তারা কখন কী করছে কী নিয়ে যাচ্ছে এই নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন। পত্র পত্রিকা টেলিভিশনের চোখ এখন চলনবিলের অজ্ঞাত ওই গুপ্ত সম্পদের দিকে।
আমরা নাসরিন জাহানের কালো বিলাইয়ের দেখা মিলতেই ভয়ে দ্রুত সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরে চলে আসি। কে জিতবে প্রথম বাংলাদেশী নোবেল এই নিয়ে আমাদের তখন আড্ডা চলছিল। আড্ডায় কেউ একজন বলল, অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটা নদী ছিল। সেই নদীর নাম তিতাস নদী। যা থেকে তাঁর হাতে সৃষ্টি হয়েছে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। জাকির তালুকদারের একটা চলনবিল আছে বটে। কিন্তু সেই চলনবিল থেকে জাকির তালুকদার কতোটুকু সম্পদ ঘরে তুলতে পারবেন তার জন্য আমাদের হয়তো আরো অপেক্ষা করতে হবে। নাকি তিনি শুধু জোসনা রাতে চলনবিলে ঘুরে ঘুরে রাতের তারা গুনবেন তাও সময় বলে দিবে।
‘হাঁটতে থাকা মানুষের গান’ জাকির তালুকদারের এক রহস্যময় উপন্যাস। কোথাও কোথাও লম্বা বাক্য পাঠকের খেই ঘুরিয়ে দিতে পারে। তবু ভরসা চলনবিল আছে। সেখানকার হু হু হাওয়া আছে। জাকির তালুকদার সেই হাওয়ায় ভর করে পাঠককে ছুটিয়ে নিয়ে চলেন। আর আমরা বোকার মতো সেই গল্প গিলতে থাকি।
বনানী, ঢাকা
৭ ফেব্র“য়ারি ২০১১