বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের (জন্ম ১৪ জুন ১৯৪৭; রাজশাহী শহর) গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে আমার পরিচয় ছাত্রজীবন থেকে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’ (১৯৭২), প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ (১৯৬৯)। তাঁর ‘আগস্টের এক রাত’ (২০১৩) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে রচিত একটি আবেগী কথামালার বিন্যাস। ‘গাছটির ছায়া নেই’ (২০১২) তাঁর ৩২তম উপন্যাস; বিষয়বস্তু দুরারোগ্য ব্যাধি এইডস। আর একাদশতম গল্পগ্রন্থ হলো ‘অবেলার দিনক্ষণ’ (২০০৯)। প্রকাশিত গল্প-উপন্যাসগুলোর অধিকাংশ পাঠ করে এই ঔপন্যাসিকের জীবনদৃষ্টিতে ইতিবাচক প্রত্যয় লক্ষ্য করেছি; উজ্জীবিত হয়েছি তাঁর বাঙালির প্রতি মমত্ববোধ দেখে। তিনি আমাদের জাতীয় জীবনের সকল শুভ প্রয়াসের পূজারি। বিষয় ও চরিত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের জগৎ ছুঁয়ে তিনি আমাদের আধুনিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গহীনে প্রবেশ করেছেন অবলীলায়। ব্রিটিশ ভারতের সন্ত্রাসবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন ও দেশভাগ, পূর্ব পাকিস্তানের তেভাগা এবং ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বৃহৎ কালপর্বে তিনি ব্যক্তিক ঐতিহ্য স্মরণ করেছেন। এজন্য কাহ্নু পা, চাঁদ সওদাগর, কালকেতু-ফুল্লরা যেমন তাঁর উপন্যাসের চরিত্র তেমনি ইলা মিত্র, প্রীতিলতা, মুনীর চৌধুরী, সোমেন চন্দ, রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যে উদ্ভাসিত পাত্রপাত্রী। মিথ-ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাইরে তিনি গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে সাধারণ মানুষের কথাও লিখেছেন। আবার নাগরিক জীবনের মনস্তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ করেছেন কাহিনির বিচিত্র গতিসূত্রে। উপরন্তু ব্যবচ্ছেদ হওয়া বেদনার কথাও তাঁর শৈল্পিক নির্মিতিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তিগত শোকের স্নিগ্ধ সরোবরে অবগাহন করেছেন আবার বিএনপি-জামায়াত জোটের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে অপদস্ত পূর্ণিমার কাহিনি কুশলি বর্ণনায় উপস্থাপন করেছেন। বিষয় বৈচিত্র্য তাঁর কথাসাহিত্যের একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রান্ত। আর কেন্দ্রীয় চরিত্র কিংবা কেন্দ্রীয় ঘটনার বক্তব্যে তিনি সদর্থক জীবনের জয় ঘোষণায় অকুণ্ঠ। কথাসাহিত্যে তিনি দেখিয়েছেন মানুষের মর্মান্তিক ক্ষরণ ও যন্ত্রণা; অপমৃত্যু ও অসীম বেদনা; সকল শুভ প্রয়াসের অন্তর্ধান- তবে এসবই তাঁর উপন্যাস কিংবা গল্পের শেষ পরিণতি নয় বরং তা থেকে উত্তরণের পথ উজ্জ্বল শিখায় বর্ণময় হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি শেষ পর্যন্ত জীবনের কথাই বলেন; জীবন থেকে পলায়নের নয়। বর্তমানে স্বপ্ন দেখানোর মানুষ কমে গেছে; হতাশার জয় ঘোষিত হচ্ছে চারিদিকে। এ পরিস্থিতিতে সেলিনা হোসেনের কথাসাহিত্য মানব জীবনের ইতি-নেতির গল্পের ধারায় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিজয় হিসেবে বিশিষ্ট। উলে¬খ্য, দুই বাংলায় তিনিই প্রথম মির্জা গালিবকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন; বঙ্গবন্ধুকে উপন্যাসের আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন। উভয় বাংলায় ছিটমহল নিয়ে প্রথম উপন্যাস রচনার কৃতিত্বও তাঁর। পূর্ববঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথকে আখ্যানে উপস্থাপনও তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম।
প্রথম অনুচ্ছেদের বিবরণে বলা হয়েছে কথাসাহিত্যিক হিসেবে সেলিনা হোসেন-এর সার্থকতার মূল রহস্যটি নিহিত রয়েছে বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য অনুসন্ধান ও পুনর্মূল্যায়নের সজ্ঞান প্রয়াসের ভেতর। তিনি এ-ধারার অন্যতম কথাকারদের একজন। প্রতিকূল রাষ্ট্র-আদর্শ ও কাঠামো-অন্তর্বর্তী হওয়া সত্ত্বেও জাতিসত্তার মৌল আবেগকে তিনি তাঁর উপন্যাসে মুখ্য তাৎপর্যে গ্রহণ করেছেন। একাত্তর-উত্তর কালের দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও গতির রূপায়ণে তিনি সন্ধান করেছেন অনিবার্য শিল্পরীতি। বাঙালির আত্মসন্ধান, সত্তাসন্ধান ও জাতিসত্তাসন্ধানের ঐকান্তিকতায় তিনি ‘পুরাণ, লোক-পুরাণ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যিক রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে সমকালীন সংকট ও জীবনজিজ্ঞাসার রূপকল্প সৃষ্টিতে মনোযোগী হয়েছেন’। সময়, সমাজ ও শ্রেণীসতর্ক জীবনচেতনা পরিশ্রুত সেলিনা হোসেন ‘সাম্প্রতিক জীবনানুভবের বস্তুগত অভিপ্রায়কে শিল্পরূপ দিতে গিয়ে’ রোমাণ্টিক জীবনাবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাঁর সৃজিত অধিকাংশ চরিত্রের ভেতর থাকে বর্তমানে শূন্যতা ও ভবিষ্যতের অসীম প্রত্যাশার স্বপ্ন। এসবই ‘মর্গের নীল পাখি’ (২০০৫) কেন্দ্রীয় আখ্যানের ভেতর প্রসারিত। এক্ষেত্রে জীবনবোধ, মমতা এবং দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রাণবন্ত কথকতায় তিনি হয়ে উঠেছেন সাহসী ও সচেতন কথাশিল্পী। ‘জাতির নাড়ির স্পন্দন স্পন্দিত’ করার জন্য খুঁটিনাটি চালচিত্র তাঁর উপন্যাসে প্রাধান্য পায় বেশি। তবে কখনো কখনো ঔপন্যাসিক-উদ্দেশ্যের নীতিধর্মিতাও তাঁর উপন্যাসের একটি অন্যতম বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সেলিনা হোসেন নাগরিক বৃত্তের যন্ত্রণা আবিষ্কার ও নাগরিক মধ্যবিত্তের স্বরূপ চিত্রায়ণে অধিকতর সার্থকতার দাবিদার। এক্ষেত্রে মনোবাস্তবতা ও সামাজিক-বাস্তবতাবোধের সমন্বয় ঘটিয়েছেন তিনি।
২.
‘মর্গের নীল পাখি’ উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ। অপমৃত্যুর পর মর্গে আনা হয় লাশ, করা হয় ময়দাতদন্ত। মর্গের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক। আইন অনুসারে অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য শব-ব্যবচ্ছেদ করা হয়। অবশ্য তাতে জীবনের মূল্য বাড়ে না। তাই বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া মৃত্যুর ঘটনা কখনো ব্যক্তিগত শোককে ছাড়িয়ে রাষ্ট্রের কাছে জিজ্ঞাসা চিহ্ন হিসেবে প্রতিভাত হয়। উপন্যাসের একদল তরুণ-তরুণী তাদের পরিচিত এবং আপনজনদের মৃত্যুর সূত্রে মর্গের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নিজেদের রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে; জীবনের প্রয়োজনে নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা দেখেছে কতভাবে সংঘটিত হয় মৃত্যুর মতো বেদনাবহ ঘটনা। কখনো ব্যক্তিগত শোক মর্গের ছোট ঘরটিকে বৃহৎ শোকে বদলে নিয়েছে। কখনো পরিবারের প্রবল কষ্ট থাকা সত্ত্বেও এবং নিজের আপনজনকে চিনতে পারলেও আত্মসম্মানের কারণে অস্বীকার করায় মর্গের ব্যবচ্ছেদের পর বেওয়ারিশ হয়ে গেছে লাশ। ‘পারভিনকে বাবা-মা-ভাইবোনদের সামনে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়িতে উঠতে হয়েছিল।’ (পৃ ২১) একই ঘটনা ঘটেছিল রুচিরার ক্ষেত্রে। উচ্চাকাক্সক্ষার জন্য গৃহের বাইরে বের হয়ে প্রতারণার জালে পড়ে খুন হতে হয়েছে তাদের দুজনকেই। তরুণ প্রজন্ম এসব দেখতে দেখতে বদলে দিচ্ছে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা। বলছে রাষ্ট্র নিজেই বেওয়ারিশ লাশ বহনকারী আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের গাড়ি। মূলত উপন্যাসে স্পষ্ট করে বলা না হলেও আমরা বুঝতে পারি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থার কথা বলছেন ঔপন্যাসিক। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশের ভেতর গুম-খুন এবং গ্রেনেড-বোমার আঘাতে অপমৃত্যুর ঘটনা তরুণ প্রজন্মের ওপর যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তার দিকেই আঙুলি নির্দেশ করেছেন সেলিনা হোসেন। এজন্য তাঁর আখ্যানে অনেক কিছুর পরও অপমৃত্যুর রাজত্বে তরুণ-তরুণীরা বেঁচে থাকার অর্থ খোঁজে। তারা জীবনকে সহজ করে নেয়, বিচিত্র অভিজ্ঞতার তিক্ততা তাদের দমাতে পারে না। এ উপন্যাসের চরিত্ররা ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়ার ভেতরে দিনযাপন করে। বড় কিছু করার সাধ্য তাদের নেই। তেমন কিছু করার চিন্তাও ওদের থাকে না। তারা ব্যক্তির জীবনযাপনের বাইরে শুধু দু’পা ফেলার মতো পরিসর দেখতে পায়। সেই ছোট পরিসরকে অর্থবহ করার জন্য জীবন এবং মৃত্যুকে সমান্তরাল রাখে।
মর্গের ডোম প্রাণেশ্বরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে শুদ্ধ’র। শুদ্ধ এক আনন্দময় জগতের বাসিন্দা। তার ব্যবসায়ী পিতা, মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে পারিবারিক জীবন সততার মধ্য দিয়ে নির্বাহ হয়। কিন্তু মধ্যবিত্ত জীবনের সংকীর্ণ পরিধির ভেতর তার বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজতে হয়। তাঁর উপলব্ধি- ‘বারবারই মনে হয় এই দেশটা একটা মর্গ হয়ে গেছে, আমরা সেই ঘরের লম্বা টেবিলে শায়িত। আমরা মরছি বুলেটে, ছুরিতে, লাঠির আঘাতে -অন্ধকারে কিংবা দিনের বেলায় – আমাদের ঝাঁঝরা শরীর চিরে ফাঁক করার জন্য জায়গা খুঁজে পায় না ডোমেরা -আমাদের শরীর পচতে থাকে, পচা মাংস খসে পড়তে থাকে – দুর্গন্ধ গোটা দেশের বাতাসে।’ (পৃ ২১) শুদ্ধ বুঝতে পারে মানুষ সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। একারণে মর্গ, বাড়ি আর খোলা চত্বর শুদ্ধ’র পৃথিবী। বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যাও তার প্রিয়। প্রিয় প্রাণেশ্বরের ছোট বাসা। কারণ মর্গের বাইরে পৃথিবীটা অনেক বড়, সোনালি রোদ বয়ে যায় রুপালি জলের ওপর, সবুজ ঘাসে ফুটে থাকে বেগুনি ফুল – জীবনের ভাঁড়ারটা অনেক বড়। উপন্যাসে ডোমদের রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন মিডফোর্ড হাসপাতালের মর্গের ডোম যাদবের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন ঔপন্যাসিক। রাষ্ট্রের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের চেতনার রেখাটিও তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন তার মধ্য দিয়ে।
তরুণ-তরুণীদের চরিত্র সৃজনে ঔপন্যাসিক এক একজনকে চিন্তা-ভাবনা ও পারিবারিক পরিবেষ্টনে স্বতন্ত্র করে এঁকেছেন। কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র ছাব্বিশ বছর বয়সের বিম্ববতীর জীবন সংগ্রাম দেখিয়েছেন ইতিবাচক ঘটনার মধ্য দিয়ে। তার নিঃসঙ্গতা, অসুস্থ মা ও ছোট ভাই বোনদের নিয়ে নিরন্তর সংগ্রামের অনুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে আখ্যানে। ‘ওরা চার বোন, তিন ভাই, একে অপরকে দেখাশোনা করে, এর মধ্যে বিশ্ববতীর দায়িত্ব বেশি, কারণ ও সবার বড়।’ (পৃ ৫৪) বাবা-মায়ের বড় মেয়ে হিসেবে পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তার প্রেমিক দীপাল তার লড়াইকে মেনে নিতে পারেনি। দূরে সরে গেছে। বিশ্ববতীর পরিবারকে কেন্দ্র করে নাগরিক জীবনে পারিবারিক সমস্যাগুলোর দিগন্ত স্পষ্ট করে তুলেছেন ঔপন্যাসিক। পিতা শাহাবুদ্দিন অসুস্থ স্ত্রী ও ছোট ছোট সন্তানদের রেখে দ্বিতীয় বিবাহ করে আলাদা হয়ে যায়। বিম্ববতীর পাশে তখন এসে দাঁড়ায় শুদ্ধ। একদিন মর্গে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ বিম্ববতীকে ভালোবাসার কথা জানায়। তাদের লক্ষ ঠিক হয়। একদিকে রাষ্ট্র, সরকার, মর্গ, লাশ অন্যদিকে জীবনের প্রয়োজনীয়তা বাসা বাঁধে। তবে মার মৃত্যুর পর পিতার দ্বিতীয় বিবাহ এবং ছোট বোন রাশিমণির আত্মহত্যা বিম্ববতীকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি করে দিয়েছিল। একদিকে সকলকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই অন্যদিকে পরিবারের ভেতরে ভাঙন সব নিয়েই চাকুরিজীবী বিম্ববতীকে এগিয়ে যেতে হয়। লেখক ইতিবাচক ফলের মধ্য দিয়ে তাদের পরিবারটিকে গড়ে তোলেন। দেখান একজন শিক্ষিত নারীর সংগ্রাম কত বিচিত্র। বিম্ববতী ও শুদ্ধ’র কাহিনি কেবল তাদের সমস্যা নিয়ে স্থির করে রাখেন নি লেখক। তিনি শুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রমিতার কাহিনি সংযুক্ত করেছেন। প্রমিতা ও সারিনার কাহিনি এবং সারিনার মৃত্যু ও সারিনার মার মাতৃস্নেহের প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে। প্রমিতার সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক আমাদের গ্রামে নিয়ে গেছেন। সারিনার মা তাকে স্নেহ করেন আর তার খালার আশ্রয়ে বসবাস তার। তার সূত্রেই রুচিরার ঘটনা আসে আখ্যানে। রুচিরার মা পরিশ্রম করে মেয়েকে শিক্ষিত করলেও শেষ পর্যন্ত রুচিরা চাকরি খুঁজতে গিয়ে মিডিয়া জগতের ক্লেদাক্ত জগতে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।
আসলে এ উপন্যাসে তরুণ প্রজন্ম যেন নিজেদের খুঁজে ফিরছে। এজন্য প্রমিতা বলতে পারে, ‘আমি সারিনার মায়ের সঙ্গে যে আচরণ করি সেটাও আমার কৌশল। নিজেকে ভুলে থাকার কৌশল। তার মতো একজন নামি লোকের সঙ্গে অমন আচরণ করে আমি মজা পাই। আমার মনে হয় পৃথিবীর দরজাটা আমার সামনে খুলে গেল।’ ( পৃ ১০৪) প্রমিতার সূত্রে ঢাকা শহরের বাসাবাড়ির কাজের বুয়ার স্বামীহীন বাস্তবতা এসেছে উপন্যাসে। প্রমিতার অন্তর্দাহ গভীর; মর্গের মতো নিঃসঙ্গ। তার বাবা মাকে খুন করেছিল যখন তার পাঁচ বছর বয়স। খুনের কারণে তার বাবার ফাঁসি হয়। এই জটিল সংকটের উপকাহিনি উপন্যাসটিকে ভিন্নতর মাত্রা দিয়েছে। খালার আশ্রয়ে তার বেড়ে ওঠা। প্রমিতার মার খুন হওয়ার ঘটনা ব্যক্তি জীবনে প্রভাব রেখেছে। তার খালাকে ছেড়ে গেছে প্রেমিক। বন্ধুত্ব রাখলেও বিয়েতে রাজি হয়নি অনেকেই। প্রমিতাকে অন্যেরা করুণার চোখে দেখে। কিন্তু প্রমিতার প্রজন্মতো দেশকে অন্তরে ধারণ করে। ভালোবাসে তার যা কিছু গৌরবের। এ প্রজন্মের একজন বিথি। শহীদ পরিবারের সন্তান। সে যুদ্ধ শিশুকে বিয়ে করতে চায়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের গৌরব বহন করে বেঁচে থাকা তার অভিলাস। তাদের বয়সীরা মুক্তিযুদ্ধ না দেখলেও সেই যুদ্ধের গৌরবের অংশিদার। তারা সেই গৌরবকে বয়ে নিয়ে আরেক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবে। কিন্তু তারা বাস্তব সংকটে নিমজ্জিত। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেও দিশাহীন। ‘কেন জিজ্ঞেস করব রুচিরার জীবন থেকে সার্টিফিকেটের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় কেন? কেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সার্টিফিকেট নিয়েও ও শক্ত জমিন পায় না পায়ের নিচে? কেন ও একটি বিশাল মাল খুঁজে নিজেকে সমর্পণ করে সেখানে? আমি রুচিরার কথা মনে করে স্তব্ধ হয়ে যাই।’ (পৃ ১১৪) অন্যদিকে প্রমিতার সোনার চেইন ছিনতাইকারীর কাহিনিও যুক্ত করে লেখক দেখিয়েছেন আদমজী পাটকল বন্ধ হওয়ার পর সেখানকার ক্ষুদ্র চাকুরিজীবীদের সন্তানরা কত অসহায় হয়ে পড়ে। লেখাপড়া ছেড়ে অপরাধ-জগতে জড়িত হয়ে যায় যুব সমাজ। (পৃ ১১৯) তবু বর্তমান যুব সমাজ মর্গের সামনে দাঁড়িয়েই প্রেমের কথা জানায়। ‘হ্যাঁ, আমাদেরকে মর্গের সামনে দাঁড়িয়েই ভালোবাসার কথা বলতে হবে। কারণ এই মুহূর্তে রাষ্ট্র নিজেই আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ি। লাশ বহন করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না।’(পৃ ১৪৭)
অন্যদিকে গ্রামে গিয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবতার সম্মুখীন হয় দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক প্রমিতা। তবে দাদার বাড়িতে গিয়ে মানসিকভাবে স্বস্তি খুঁজে পায় সে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো তাকে ঘিরে সমস্যার কথা বলে, সমাধানের পথ খোঁজে। তখন সে ভাবে- ‘এমন করে যেন মানুষের কাছে থাকতে পারি একথা নিজেকে অনবরত শোনাই।’(পৃ ১২২) দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি, সন্ত্রাস পদে পদে, চাঁদাবাজিও, গুম-খুন গ্রামেও আছে। আর আছে অসহায় নারীর প্রতি জুলুমবাজদের অত্যাচারের কাহিনি। মারেফা বুয়ার জীবনের দুঃসহ ঘটনা রয়েছে সেখানে। সে স্বামীছাড়া, চার সন্তানের জননী। গণধর্ষণের শিকার মারেফা বিচার পায় না। অপবাদের মুখে সে জানে না চরিত্রহীনা কাকে বলে। বরং সে পালিয়ে গেলে জমি দখলের সুবিধা হয় এ প্রত্যাশা অপরাধীদের। আবার গ্রামে সুদেব স্যারের মতো মানুষ আছে। অভাবের মধ্যে থেকেও দরিদ্র ছাত্রদের বিনা পয়সায় পাঠ দান করেন তিনি। গ্রামের আলোকিত মানুষ; তিনি যাদেরকে পড়ান তারা কেউ সন্ত্রাসী হয় না। গ্রামে একটি সুন্দর নীল পাখি দেখায় প্রমিতার চাচা। উপন্যাসে ঘুরে ফিরে ‘নীল’ শব্দটি প্রয়োগ হয়েছে একাধিক প্রসঙ্গে। গ্রামের অশান্ত ঘটনাগুলো তার মনকে উতলা করে। কিন্তু তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে মাতার খুন হওয়া ও বাবার ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো দৃশ্য তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। গ্রামের একটি বাড়িতে আগুন দিয়ে দুটি তরুণীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। বাপ-দাদার চৌদ্দ পুরুষের গ্রাম এখন পাল্টে গেছে। সরকারের সন্ত্রাসবাদ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। ঢাকাতে ফিরে গ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশ করে সে। তারপর খালার পুরানো প্রেমিক ফিরে এলে নিজের পিতার কথা মনে করে আবেগায়িত হয়। রুচিরার খুনের ঘটনা তাকে আতঙ্কিত করে তোলে। আবার সহকর্মী রাকিবের প্রেম নিবেদন তাকে সামনে এগিয়ে নেয়। রুচিরা বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যাওয়ায় প্রমিতাকে রাগ দেখায় শুদ্ধ। তারা বোঝে- ‘শহরটাই এখন এমন। কেউ কারো দায়িত্ব নেয় না। শুদ্ধ আমরা সবাই যে কোনো সময় এই দেশে বেওয়ারিশ লাশ হবো। সময় এমন যে আমাদের কারো কারো লাশ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা কেউ কেউ গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবো মাঠেঘাটে-পথে-প্রান্তরে।’(পৃ ১৪৭) বিপ্রতীপ পরিস্থিতির মধ্যে শুদ্ধ-প্রমিতারা একত্রিত হয়। ‘ওরা বেওয়ারিশ হবে না। এই শহরে সবাই কেন বেওয়ারিশ হবে, কেউ না কেউ তো বেওয়ারিশদের দায় মুছে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসবেই।’ (পৃ ১৪৮) এই ইতিবাচক প্রত্যাশা জেগে থাকে একদল তরুণ-তরুণীর মধ্যে।
শুদ্ধর প্রাণের বন্ধু প্রাণেশ পাল্টে যায়। তার স্ত্রীকে হত্যা করে সামান্য সন্দেহের বশে। আর একদল সন্ত্রাসীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে টুকরো টুকরো কেটে মানুষ খুন করে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। ঔপন্যাসিক নিম্নবর্গের এই চরিত্রটিতে অনেক মানবিক গুণ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তার শেষ পরিণতি তৎকালীন সন্ত্রাসের ভয়াবহতার দৃষ্টান্ত হিসেবে চিত্রায়ণ করেছেন। প্রাণেশের আসন্ন পরিণতি শুদ্ধকে বিচলিত করেছে। কিন্তু অদৃষ্টের তাড়নায় যা ঘটার তাই ঘটে। আখ্যানে সমান্তরাল আরো অনেক ঘটনা সংযুক্ত হয়েছে। সুনন্দ অনিতাকে প্রেম নিবেদন করতে ব্যর্থ হয়েছে; দূর থেকে ভালোবেসে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সামনে অনিতা দুর্ঘটনায় মারা গেলে সে তার প্রতি নিজের প্রেমের অর্ঘ্য জানায়। মোম জ্বালিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গায়। শুদ্ধ তাকে নিজের বাসায় নিয়ে আশ্রয় দেয়। মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। পিতৃহীন সুনন্দ মার একমাত্র সম্বল। অন্যদিকে প্রাণেশকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে খুনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। প্রাণের স্ত্রী প্রীতি চলে গেছে, একমাত্র সন্তান সোমেন বেঁচে আছে। তাই টাকাগুলো শুদ্ধর কাছে রেখে ছেলের দায়িত্ব তাকে দিয়ে বিদায় নেয় সে; আর ফিরে আসে না। ‘প্রাণেশের হাতে টুকরো করা মানুষের শরীর উদ্ধার করা হয়েছে ঢাকার বাইরে থেকে। আর পুলিশ প্রাণেশের অখ- লাশ পেয়েছে, ঢাকা শহরের একটি এলাকায়। গুলিবিদ্ধ প্রাণেশ।’ (পৃ ১৯০) অন্যত্র-‘বিবেকহীন, নিয়ন্ত্রণহীন এ কেমন স্বদেশ আমার। মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের বিশাল জন-অধ্যুষিত ছোট্ট ভূখণ্ড। কিলবিল করা মানুষেরা আর মানুষ নেই, সব পোকা।’ (পৃ ১৮৭) এই শহরে শিশু কন্যা জুনিয়া ধর্ষণের শিকার হয়ে বিম্ববতীর আশ্রয়ে থাকে। আসলে নানা জটিল আবর্ত মধ্যবিত্ত জীবনে অস্তিত্ব-সংকট তৈরি করে। ‘প্রতি মুহূর্তের এই অনিশ্চিত জীবন নিয়ে আমরা কতদিন বাঁচব শুদ্ধ?’ (পৃ ১৮৭)
সংকট কিন্তু শুরু হয়েছে উপন্যাসের সূচনা থেকেই। বিম্ববতীর জীবনে তার প্রকাশ রয়েছে। তার দেখা একটি স্বপ্ন এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। উপন্যাসে স্বপ্ন ব্যবহৃত হয়েছে মনোলোক ও অদৃষ্টের কার্যকারণ প্রকাশের জন্য। বিম্ববতী শুদ্ধকে বলেছে- ‘তুমি আর আমি কোথায় যেন যাচ্ছি হেঁটে হেঁটে, আর আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে একটি পাখি, চমৎকার অদ্ভুত রঙের একটি পাখি, ওর রঙটা মর্গের নীলাভ টাইলসের মতো।… দেখি সেই পাখিটা মর্গের ছয় ফুট লম্বা টেবিলে পড়ে আছে, ও আর ছোট পাখিটি নেই। একদম টেবিলটার সমান সমান, যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া।’ (পৃ ৭৮) এই ইঙ্গিতময় বর্ণনা নিজের ছোট বোনের আত্মহত্যার ঘটনা দিয়ে স্পষ্ট হয়। বিম্ববতী চিৎকার করে বলে, শুদ্ধ এই তো আমার নীল পাখি।’ (পৃ ৮৭) নীল রঙ আনন্দ থেকে বেদনায় অভিসিক্ত হয়। ‘রাশমণিকে মর্গে দেখে বোকার মতো সবার মুখের দিকে তাকায় প্রাণেশ। শুদ্ধ ও বিম্ববতীর বিয়েতে ও রাশমণিকে দেখেছিল, সেই থেকে ওকে ভুলতে পারেনি। শুদ্ধকে বলে, ও এমন পাগলের মতো মরল কেন? কী হয়েছিল।? …একটু পরে ময়নাতদন্তের জন্য ডাক্তার আসবে। তার আগে শুদ্ধ আর বিম্ববতী মর্গের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রাণেশের ক্ষেত্রেও নীল রঙ আবির্ভূত হয়। নীল পূর্ণিমা রাতে প্রাণেশের খোঁজে বের হয় শুদ্ধ-বিম্ববতী। ঔপন্যাসিক নীল পূর্ণিমা ও নীল ফিনিক্স পাখির প্রসঙ্গ এনেছেন প্রাণেশের মৃত্যু ঘটনায়- ‘তুমি মর্গের দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসো নীল পাখি।’ (পৃ ১৯১) শুদ্ধ ও বিম্ববতীর সূত্রে প্রিয়ভাষিণীর শিল্পভুবনের খবর আছে উপন্যাসে। (পৃ ১৫১) ঢাকা শহর মর্গ হয়ে গেলেও শিল্পীর ভুবনে আমরা প্রাণের স্পন্দন জেগে থাকতে দেখি। অন্যদিকে ঔপন্যাসিক রনবীরের আঁকা টোকাই চরিত্রের কথা জানিয়েছেন। সাধারণ মানুষের পিপাসা মিটিয়েছেন যে শিল্পী তার কথা বলে তিনি শহরের বস্তিবাসী রিকশাওয়ালার প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। আজাহারের উদ্বাস্তু জীবনের গ্লানি প্রকাশ পেয়েছে সেখানে। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে শহরবাসী হয়েছে আজাহার। এভাবে সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রাম আর মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব-সংকটের মনোবাস্তবতা তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। আখ্যানের শেষে বন্ধুদের নিয়ে প্রাণেশের লাশের সঙ্গে শ্মশানে যায় শুদ্ধরা। শ্মশানে যাবার আগে রাকিব ও প্রমিতার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। সংকট আর সকল সমস্যা উত্তীর্ণ হয়ে জীবনের গান গেয়ে শেষে শ্মশান যাত্রা দেখিয়ে লেখক ইতিবাচক জীবন দৃষ্টির মহিমা ব্যক্ত করেছেন।
৩.
‘মর্গের নীল পাখি’ উপন্যাসে চরিত্রসমূহের আবেগ-অনুভূতি-চিন্তা, সমাজ-গোষ্ঠীর জীবনপ্রবাহ এবং প্রতিকূল পরিবেশে অস্তিত্ব সংগ্রামের ইতিকথা উপস্থাপিত হয়েছে। ঔপন্যাসিকের ইতিহাস জ্ঞান, সমাজ-অভিজ্ঞতা এবং বস্তুময় জীবনদৃষ্টি নিবিড়। এজন্য তিনি ব্যক্তিজীবন ও মতাদর্শের সংকটকে সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন মনোযোগের সঙ্গে। সমকালীন চেতনা ঔপন্যাসিককে কেবলমাত্র রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ঘটনায় নয় বরং মধ্যবিত্তের স্বপ্নভঙ্গ, আত্মরতি ও আত্মকু-লায়নের বিপরীতে প্রত্যাশা-প্রেরণা ও উদ্দীপনার ইতিবাচক জীবনদৃষ্টিতে প্রাণিত করেছে। আমরা জানি সেলিনা হোসেন তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মের শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়নে মানুষের জীবনচর্যা ও শিল্পচর্চা যে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল, তার স্বরূপ উন্মোচনে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বর্তমান উপন্যাসেও উপন্যাসবিধৃত চরিত্রসমূহের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার বাস্তবতা প্রত্যয় ও প্রত্যাশায় উদ্ভাসিত। একারণে একঝাঁক প্রাণবন্ত তরুণের জীবনে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গক্রমে সম্পৃক্ত করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সেলিনা হোসেনের বক্তব্য : ‘একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের জীবনের একটা প্রান্তসীমা। এ যুদ্ধ আমাদের অস্ত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে এবং অনেক মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তন ঘটিয়েছে।’ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ¯œাত চরিত্রের মূল্যবোধের নতুন রূপ এ উপন্যাসে আছে। সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা তথা জীবনসত্যের অন্বেষণে বহির্জাগতিক ঘটনার আলোড়নের পটভূমিতে এ উপন্যাসের চরিত্রগুলো অন্তরজগতেও ক্ষয়িত হয়েছে। জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানসের জটিল ও দ্বন্দ্বময় স্বরূপসসত্যটি উন্মোচনে লেখক প্রেম ও সংগ্রামকে একীভূত করেছেন। নতুন নতুন অভিজ্ঞতার অভিঘাতে যেমন যাপিত জীবনে শুদ্ধ-বিম্ববতী-প্রমিতা সামাজিক ও রাজনৈতিক মানুষ হয়ে উঠেছে তেমনি রাষ্ট্রের সন্ত্রাস ও নিপীড়নের মধ্যে অজেয় জীবনীশক্তির সন্ধান করেছে। ডোম প্রাণেশ সেই জীবনীশক্তির ইঙ্গিত বহন করে প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
বস্তুত সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে বিধৃত ‘মর্গের নীল পাখি’ উপন্যাসে ব্যক্তির অন্তর্গত যন্ত্রণার আবর্তে বৌদ্ধিক ও নৈতিক সংঘাতের অনুধাবন ও চরিত্রের আত্ম-নিগ্রহ যথাযথভাবে প্রতিফলিত। জীবনকে অবলোকনের ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের গুম-খুন ও হত্যার নানা ঘটনা, ব্যক্তির প্রতিবাদী সত্তার উদ্ভবে এবং মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের সীমাবদ্ধতায় সমাজ পরিবর্তনের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। আধুনিক সমাজে যেসব আবেগ-বাসনা-আকুতি সমকালের ঘটনাপুঞ্জের প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তির চিন্তায় চাপ সৃষ্টি করে, সেই চিন্তার চাপ জীবনদৃষ্টি গঠনে ভূমিকা রাখে। কল্পনার পরিবর্তে জীবনের বস্তুময় স্বরূপে শিল্পিত হয়েছে আখ্যান; চরিত্রের আবেগমত্ততা, চঞ্চলতা, তার টেন্শন ও প্রগতিশীল চেতনায় উজ্জীবিত কাহিনির সকল প্রান্ত। একবিংশ শতাব্দীর ক্রমবর্ধমান স্ফীতকায় মধ্যবিত্তের পারিবারিক জীবন ও ঘটনা এবং বহির্জাগতিক বিচিত্র সংকটের মধ্য দিয়ে সেই পরিবারের একজন শুদ্ধ কিংবা প্রমিতার সচেতন ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন- পটভূমি, চরিত্র ও পরিচর্যার সামঞ্জস্যে অনন্য। সেলিনা হোসেনের এ উপন্যাসের ভাষা কাব্যময়, সাবলীল ও গতিশীল। তবে তা রাজনীতিচেতনায় বর্ণনাত্মক পদ্ধতিতে ভাস্বর। ঔপন্যাসিক সন্ত্রাসী রাজনীতির প্রচলিত ভাষা-ছকে কথা বলেছেন। রহস্যের মায়াজাল সৃষ্টি করেননি। সমকালীন বাস্তবতার স্বরূপ উন্মোচনে সময়স্বভাবকে নিরীক্ষণ করেছেন। এজন্য তাঁর চরিত্রগুলো ক্রমাগত জীবনজিজ্ঞাসায় হয়ে উঠেছে অস্তিত্ববান। বস্তুত সামাজিক অভীপ্সার গতিপরিবর্তন ও অস্তিত্বজিজ্ঞাসার নিত্য রূপবদল এ ঔপন্যাসিকের কথাসাহিত্যের অন্যতম বিশেষত্ব। অবলম্বিত বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রকরণে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তাঁর এ উপন্যাস।
{মর্গের নীল পাখি(২০০৫), ঢাকা: অক্ষর প্রকাশনী, ২০১৩ }
(ড. মিল্টন বিশ্বাস, সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)