দেশ তাহলে একটা পুকুর। অঞ্জু মঞ্জুর মতো এর নিস্তরঙ্গ নিথর তলদেশে চিরকালের জন্যে হারিয়ে গিয়েছে রঞ্জু। এই নির্জন পুকুর পাড়ে একা একা সারাটা জীবন যে সে কি করে কাটাবে খোকা তা ভেবে পায় না; সে তো জানেই সহজে তার মৃত্যু নেই, কেননা কোনো অসতর্ক মুহূর্তে যদি এমন কথা তার মনে উঁকি দেয়, তখনই রঞ্জু তাকে শাসন করে বলে, ‘দাদা, আমি না তোর বুকে থুতু দিয়েছি!’ (জীবন আমার বোন)
মাহমুদুল হক (১৯৪১-২০০৮)-এর ‘জীবন আমার বোন’ (১৯৭৬)-কে শেষ থেকে পাঠ করলেও পরম্পরাচ্যুতির বোধ মাথায় কাজ করে না। বরং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে কোনো অংশের পাঠেই দেশের সমান্তরালে জীবন আর জীবনের সমান্তরালে দেশের উন্মোচন ঘটে। আর্দ্র-রক্তিম উদ্ভাসনায় সমষ্টি এবং ব্যক্তির মধ্যবর্তী রেখাগুলো গুঁড়িয়ে যায়।
এই উপন্যাসের শুরুর দিকে এক জায়গায় গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ উপন্যাসের কুঁজো বামন অস্কারের প্রসঙ্গ আসে। হ্যাঁ, অস্কারের ড্রাম বাদনের মতোই ‘জীবন আমার বোন’-এর খোকার বাম দিকে, ডান দিকে, দশ দিগন্তে মুহুর্মুহু বাজনা, লাঠি-লোহার রড, কালো পতাকা-বর্শা-তরোয়াল-বৈঠা-কোদাল-শাবল ইত্যাকার বহু কিছুর মিলিত বাদনে কান ঝালাপালা হয়ে যাবার জোগাড়। এ বাজনার একতালে যেমন গণমানুষের মৃত্যুর মিছিল অন্য তালে তেমনি মধ্যবিত্ত মানসলোকের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, পুঁজি, মুনাফা, শ্রেণিসংগ্রাম, গণতন্ত্রের গ্যাঁড়াকল। সে এক সময়, ১৯৭১। রাজপথের অগ্নি খোকাকে তার নিজস্ব নিরুত্তাপ কোটর থেকে টেনে বের করে আনে।
মানুষের ভিড় কেটে বেরুতে পারছে না খোকা। বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। আসন্ন ত্রাস তাড়া করছে তাকে; মুহূর্তের সামান্য ব্যবধানে একটা আবশ্যিক প্রতিক্রিয়ায় সবকিছু হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে, ভেঙে পড়বে বিচারালয়, ভেঙে পড়বে মিলনায়তন, ভেঙে পড়বে পানশালা, স্টেডিয়াম। এতোদিন তার চোখে যা ছিলো সামান্য মানুষ, এখন তা সংগঠিত অবিচ্ছিন্ন মিছিলে। খোকা শিউরে উঠলো, এতোদিন তার কাছে যা ছিলো দয়িতা যামিনী মদিরার মতো তিন অক্ষরের হাল্কা পালকে মোড়া পাখির মতো নিছক একটি রোগা শব্দ, এখন তা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়েছে শহরময়, জনতা!
নতুন নির্মাণের জন্য পুরানো সব প্রবলও ভেঙে ফেলতে হয়। ভেঙে যায়। ভেঙে পড়ে। আর অভিধানের সীমিত গণ্ডি ছাপিয়ে বোমা-বারুদের চেয়েও তীব্র বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উত্থান ঘটে একটি দীপ্তিময় শব্দের – ‘জনতা’। ‘জীবন আমার বোন’ আসলে ব্যক্তি ও জনতার মিলিত কাহিনি। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব অসহযোগ কালপর্বের অগ্নিগর্ভ শিল্পভাষ্য। তবে মাহমুদুল হক গৎবাঁধা ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসমূলক উপন্যাস’-এর তালিকা বাড়াতে ‘জীবন আমার বোন’ লিখেননি যদিও এ নিয়ে সমালোচকেরা প্রায়ই ভুল ব্যাখ্যা করেন।
এক সাক্ষাৎকারে জীবন আমার বোন সম্পর্কে মাহমুদুল হক –
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালের অসহযোগ আন্দোলনের পঁচিশ দিনের কিছু খ-চিত্র তাতে আছে, যা সম্পূর্ণ ঢাকা শহরকেন্দ্রিক; আমি মুক্তিযুদ্ধের কোনো ইতিহাস রচনা করিনি, কোনোদিন ঠাট্টাচ্ছলেও বলিনি এটি ঐতিহাসিক উপন্যাস।
[সূত্র: আলোছায়ার যুগলবন্দি, ‘মাহমুদুল হক স্মরণে’; সাহিত্যপ্রকাশ, ২০১০]
মাহমুদুল হক তথ্যসারণিকে ইতিহাসজ্ঞান করেননি। উত্তাল বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালার ভেতর ব্যক্তির বিবিক্তি, দ্রোহ, সমর্পণ ইত্যাকার মানবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেতর থেকে সংগ্রহ করেছেন ইতিহাসের শাঁস। কবি শামসুর রাহমান ‘জীবন আমার বোন’-এর শেষ প্রচ্ছদে মাহমুদুল হকের সাহিত্যকৃতি বিষয়ে যে মূল্যায়ন করেন তাতেই যেন যথার্থ ব্যাখ্যাত এ উপন্যাস।
জীবনের উপরিস্তরেই তার দৃষ্টি সীমাবদ্ধ নয়, তার দৃষ্টি যায় আরো অনেক গভীরে – যেখানে আদিম লতাগুল্মে আচ্ছাদিত এক জটিল জগৎ, যা মানুষের অস্তিত্বকে নাড়া দেয় – ‘আমূল, আলো-অন্ধকারে সম্পূর্ণ নগ্ন করে দেয়।’
বস্তুত এক চরম নগ্নতার আখ্যান ‘জীবন আমার বোন’। কোনো আড়াল নেই, কোনো ভণিতা নেই। সব ধ্বসে পড়েছে হুড়মুড় করে। সমস্ত শিল্প-প্রসাধন ভেদ করে আমরা মুখোমুখি হই কেঁচো-ক্লিন্ন জীবনের। খোকার কাছে যে জীবন রঞ্জুর মতো নিমজ্জিত বোনের প্রতিমা।
মাহমুদুল হক তার চরিত্রের যান্ত্রিক গঠনে বিশ্বাসী ছিলেন না বলেই খোকাকে তার অন্তর্গত আলো-অন্ধকার, তার সংগ্রামকাতর এবং একই সাথে পিছুটানপ্রবল চৈতন্যকে নিগূঢ় রসায়নে রূপায়ণ করেছেন। এয়ারপোর্ট থেকে হাজার হাজার পাক সৈন্য নামছে। কসাই টিক্কা খান ঢাকায় আসছে। প্রাণ দিচ্ছে আসাদ। আর আমাদের খোকা উদ্ভূত পরিস্থিতির গনগনে আভার ভেতর থেকে মাঝেমধ্যেই ডুব দেয় নীলাভাবীর খোঁড়লে।
হীরার মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছিলো নীলাভাবী। খোকা হাবার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে নীলাভাবীর দুচোখ দিয়ে। মাঝখানে দুটি বিন্দুর মতো দুজনকে বসিয়ে অকারণ আনন্দে চারটি দেয়াল যেন হাত ধরাধরি করে শিশুর মতো নেচে নেচে ঘুরপাক খাচ্ছে; দেয়ালগুলো এখন জর্জিয়ান লেসের কাজে মোড়া টিপয়ের ছাউনি দুলছে, দুলছে ফুলদানি, দুলছে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রজনীগন্ধাগুচ্ছ, ট্রানজিস্টার যেন বনবিড়াল, খাড়া করে মৃদু মৃদু নাড়ছে এরিয়েললেজ; হাওয়া, এতো হাওয়া আসে কোথা থেকে? সমুদ্রের খুব কাছে তারা, কিংবা একটা জাহাজের ভিতর, হাওয়ায় মাছের ফিসফিসানি, হাওয়ার গভীর গোপনে সুগোল শূন্যতাবোধ ওজনহীন এক চাঁদের মতো অবিরাম সাঁতার কাটছে।
নীলাভাবী’তে খোকার এই নিমজ্জন মোটেও অস্বভাবী নয়। নীলাভাবীর প্রতি খোকার আসক্তিকে অনেকে মধ্যবিত্ত চরিত্রের দুর্বলতা-ভীরুতা-কাপুরুষতা হিসেবে চিহ্নিত করবেন হয়ত কিন্তু আমরা বলি খোকা নীলাভাবীর ভেতর দেশকে খুঁজে পেয়েছে। দুঃখিনী দেশ। দুঃখিনী নীলাভাবী। নিঃসন্তান নীলাভাবী। ভালোবেসে রাজীবকে বিয়ে করেছেন। দৃশ্যত কোনো দাম্পত্য অসুখ নেই। আবার ‘এক ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই নেবার নেই আমার।’
এ স্বীকারোক্তি এক চরম নিঃস্বের, রিক্তার। যে ভালোবাসাহীনতায় শুকিয়ে আছে। শিল্পপ্রেমী স্বামীর কাছে তার এস্রাজের চেয়ে, গল্পের চেয়ে, গানের চেয়ে নীলার আলাদা অস্তিত্ব কখনও সাকার হয়ে দেখা দেয়নি। নীলাভাবীর অবস্থা অনেকটা এইরকম।
পাগলের মতো অবস্থা আমার। হেঁশেলের কোণে পড়ে থাকা শিলনোড়া, কিংবা উঠোনের একপাশে ফেলে রাখা মুড়োঝাঁটা, আমি তো এই-ই! নচেৎ একটা পুরানো আমলের সুখপাঠ্য বই, যা খুব যত্ন করে ‘আর কোনোদিন পড়া হবে না’ এমন এক ভঙ্গিতে ঠেসে দেওয়া হয়েছে দেয়ালের নোনাধরা তাকে; বৃষ্টিতে ভিজে পচার কিংবা অক্ষরগুলো ধুয়েমুছে যাবার কোনো ভয় নেই ঠিকই, কিন্তু ভাঁজে ভাঁজে আস্তানা গাড়বে কীট, দিনের পর দিন কুরে কুরে খেয়ে খাস্তা ঝরঝরে করে দেবে। এভাবে পড়ে থাকার চেয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঢের ভালো।
দেশের অবস্থাটা নীলাভাবীর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। এর পরের অনুচ্ছেদে দেখব বন্ধু মুরাদের সাথে তর্ক হয় খোকার। দেশ কী তা নিয়ে। তর্ক কোনো সিদ্ধান্তে না পৌঁছলেও তারা অনুভব করে দেশ কতকগুলো অবস্থার নাম। এই যেমন নীলাভাবীর অবস্থা। দেশ তো নীলাভাবীকে বাদ দিয়ে নয়। তাই বাইরের তুমুল হৈহল্লা-পেরিয়ে নিস্তরঙ্গ নীলাভাবীর জগতের প্রতি অমোঘ আকর্ষণকে ‘লিবিডোচেতনা’ বলে সাহিত্যের কলেজপাঠ্য প্রশ্নোত্তরে পরিণত করা এই মহত্তম উপন্যাসের প্রতি চরম অবিচারের নামান্তর।
২
রক্ত। রক্ত। রক্ত।
খোকা দেখছে ‘রক্ত চাই’ বলে ভুখা দেশমাতা হাঁক দিচ্ছে। কবিতার বই বেরুচ্ছে ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ শিরোনামে। রেসকোর্স ময়দানেও রক্তদানের প্রতিশ্রুতি। নিরঙ্কুশ রক্তবৃষ্টির মাঝে খোকা বাংলাদেশকে আবিষ্কার করে প্রীতিলতার মতো বিষপায়িনী হিসেবে। কখনও রাক্ষসি হিসেবে যে তার গহ্বরে শালিকের মতো পুরে নেয় – কিশোর মতিয়ুরকে। খোকা জানে একটা পরিবর্তন আসন্ন। মুরাদও জানে। তবে পরিবর্তনটা শুধু পাঞ্জাবি সোলজারের স্থলে বাঙালি সোলজারের প্রতিস্থাপন – তা মানতে নারাজ খোকা। খোকা আয়নায় আমাদের নিজেদের চেহারাটাও দেখে –
আমরা যে কি মাল প্রত্যেকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই তা বলে দেবে।
যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শুধু পরিবর্তন নয় রূপান্তর চেয়েছিল খোকা। শুধু খোকা নয়, অধিকাংশ বাঙালির তা-ই ছিল চাওয়া। খোকার মধ্য দিয়ে মাহমুদুল হক কণ্ঠ দিয়েছেন বৃহত্তর বাঙালির আকাঙ্ক্ষাকে।
খোকার চারপাশে লাশবাস্তবতা। খোকার চেনা বন্ধুবান্ধব সবাই যুদ্ধের রক্তকুণ্ডে আহূতি দিয়েছে। কিন্তু খোকা ঠিক করতে পারেনি তার যথাকর্তব্য। সে জানে না দেশ কাকে বলে। অঞ্জু মঞ্জুকে পুকুরডুবিতে হারিয়েছিল খোকা। এখন জীবন বলতে অবশিষ্ট বোন রঞ্জু। জীবন মানে বোন। জীবন মানে রঞ্জু। বিপন্ন রঞ্জু। বিপন্ন দেশ। আর্মি ক্র্যাক ডাউনের প্রথম রাতেই বাক্শক্তিহারা রঞ্জু। খোকা প্রাণপণে রঞ্জুকে বাঁচাতে চায়। রঞ্জু পলায়নপর অজস্র মানুষের মাঝে ঝড় আর শিলাবৃষ্টির কবলে পড়ে। ভিজে। রঞ্জুর জ্বর আসে। তারপর ভোরের দিকে মেশিনগান ও মর্টারে সজ্জিত ক্ষিপ্র সৈন্যদলের প্রাণঘাতী গুলিবৃষ্টিতে যখন খোকাও নিজ প্রাণ নিয়ে পলায়মান তখন –
এক লক্ষ চল্লিশ হাজার পায়ের তলায় পড়ে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিলো কি নিরঞ্জন রঞ্জু?
খোকা নিশ্চিত না। একটা ট্রমার মধ্যে পড়ে যায় সে। সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় সে দেশের সংজ্ঞা দাঁড় করাতে অজ্ঞান হয়েছে, কিন্তু পারেনি। তবে আজকের এই ট্রমা খোকাকে এক বিষণœ-স্বচ্ছ অভিজ্ঞানে পৌঁছে দেয়। মেটামরফসিসে আক্রান্ত খোকা, প্রতি সকালে নিজেকে গ্রেগর সামসার মতো বিটকেলে পোকা হিসেবে আবিষ্কারকারী খোকার আজ উপলব্ধি –
দেশ তাহলে একটা পুকুর। অঞ্জু মঞ্জুর মতো এর নিস্তরঙ্গ নিথর তলদেশে চিরকালের জন্যে হারিয়ে গিয়েছে রঞ্জু।
বোনের মৃত প্রতিমায় দেশ আর জীবনের এমনতর আবিষ্কারণ ‘জীবন আমার বোন’-কে কালের মহত্তম শিল্পকর্মের মহিমা দেয়।