পোশাকশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভীত; প্রতি বছর কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে এ খাত থেকে। কিন্তু এ শিল্পের যারা কারিগর , যাদের শরীরে ঘামে এ ভীত দাঁড়িয়ে আছে তাদের জীবনের কথাগুলো যেন ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সংগ্রাম করে টিকে থাকার আমৃত্যু জীবন যুদ্ধে সামিল হওয়া মানুষগুলোর পুড়ে মরাই যেন একমাত্র পরিনতি। হরহামেশা দুর্ঘটনায় জীবন হারানো শ্রমিকদের পরিবারগুলো পরে যায় অথৈ সাগরে। ক্ষতিপূরণ কিংবা দায়ভার এড়াতেই মালিক পক্ষের হীন মানসিকতায় বেওয়ারিশ হয়ে কবরে শুয়ে থাকাই যেন চির – শান্তির ঘুম। এইসব খেটে খাওয়া মানুষগুলোর খুব সাদামাটা জীবনের কথা নিয়েই উপন্যাস ‘দায়ভার’।
আমেরিকার লস এঞ্জেলস প্রবাসী কথাসাহিত্যিক তপন দেবনাথ তাঁর অনুপম সৃজনশীলতায় সুনিপুনভাবে রচনা করেছেন উপন্যাসটি। যেখানে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের একটু স্বচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার গল্প ফুটিয়ে তুলেছেন। ঠিক গল্প নয়; কখনও কখনও পাঠকের মনে যে ছবি ভেসে উঠতে বাধ্য করেছেন, সেটা ‘জীবনালেখ্য’ না বললে নিতান্তই কম বলা হয়ে যায়।
ঔপন্যাসিক তপন দেবনাথ উপন্যাসের জমিন বয়নের ক্ষেত্রে সহজ-সরল-সাবলীল ভাষা ব্যবহার করেছেন। সমাজের ক্ষতগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অবহেলিত শিক্ষক সমাজ, অভাবের তাড়নে ঢাকায় আশা মানুষের টিকে থাকা, নিম্ন মধ্যবিত্তের বিনোদন, ভালোবাসা- রোমান্টিকতা, আতিথেয়তা, ঘুষ নামক ব্যধি , অনিরাপদ কর্মস্থল, নারীর প্রতি অসম্মানের দৃষ্টি, গ্রামীন ফতোয়াবাজ, গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডসহ আরো অনেক বিষয় পাঠকের সামনে তুলে এনেছেন কখনও প্রকটভাবে আবার কখনও প্রচ্ছন্নভাবে। তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় ঔপন্যাসিক ঘটনাপ্রবাহ চিত্রণে অত্যন্ত সফল এবং সার্থক।
পারুল উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার বাবা রফিক মাস্টার একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষ। ভোলার প্রত্যন্ত গ্রামে কায়ক্লেশে বেঁচে থাকা জীবনের নাম। পবন উপন্যাসের আরেকটি কেন্দ্রীয় চরিত্র। পবন ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে। প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে তার কাছে পারুলের একটা চাকরির জন্য অনুরোধ করেন রফিক মাস্টার। শিক্ষকের অনুরোধ রাখতেই পারুলের জন্যে একই গার্মেন্টসে একটা কাজের ব্যবস্থা করে পবন। ঢাকায় এসে কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় প্রতিনিয়ত সংগ্রামের। বাড়তে থাকে উপন্যাসের গতি, বাড়তে থাকে পারুল-পবনের জীবনের অধ্যায়। যেকোনো পাঠকের কল্পনায় চলে আসবে লক্ষ-লক্ষ গার্মেন্টস কর্মীর জীবনের ছায়া।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, উপন্যাসের প্রায় সব চরিত্রের বাড়ি ভোলা। এখানে একই অঞ্চলের মানুষের প্রতি যে গভীর মমত্ব, যে আন্তরিকতা, যে সৌহার্দ্য দেখা যায় তা সত্যি বিরল।
পারুলের জন্যে পবন গার্মেন্টসে কাজের ব্যবস্থা করেছে জেনে রফিক মাস্টার খুব খুশি হলেন ঠিক কিন্তু পরিনামের বিষয়ে পাঠকের মনে এক অজানা শঙ্কার জন্ম দেন ঔপন্যাসিক।
‘‘অবসর গ্রহনের পর পেনশনের কাজে রফিক মাস্টার গত কয়েক বছর আগে ঢাকা গিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে ঢাকা শহর অনেক বদলে গেছে। পারুল এর আগে কখনও ঢাকা যায়নি। ঢাকায় যাবে জানতে পেরে সেও খানিকটা উচ্ছ্বসিত। ঢাকার কত গল্প সে শুনেছে। এবার ঢাকা শহর নিজের চোখে দেখবে। ঢাকায় থাকবে, চাকরি করবে। এত সুখ কপালে সইবে তো ?’’
সুখ কপালে সইবে কি না সে সংশয় থেকেই যায় উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত। শিক্ষকের মেয়ের জন্যে শুধু গার্মেন্টসে চাকরি নয়, সেই সাথে থাকার ব্যবস্থাও করে দেয় পবন। পবনের মনের মধ্যে পারুলের জন্যে যে জায়গা তৈরী হয় তা কেবল ভালোবাসার কারণে হতে পারে।
নারীদের কর্মস্থল যে এখনো অনিরাপদ, নানান কারণে সেইসব বিষয়ে ফোকাস করেছেন ঔপন্যাসিক।
নুরিসলাম পারুল-পবনদের সুপারভাইজার। মানুষ হিসেবে খুব একটা সুবিধার নয়। সবসময় কর্মচারীদের সাথে বাজে আচরণ যেন তার চরিত্রেরই অন্য পিঠ। আর তার অধীনে কর্মরত নারীকর্মীদের প্রতি প্রচ্ছন্নভাবে যৌন আশা চরিতার্থ করা কিংবা কু-নজর দেওয়া যেন তার রুটিন মাফিক কাজ। উপন্যাসের একপর্যায়ে নুরিসলামের নজর পরে পারুলের ওপর। তার বিষয়ে সব খবর সে রাখত। নানান ফন্দি করে তাকে পবন, রহিমা, লাইজু, কাদেরদের থেকে আলাদা করার পরিকল্পনা নেয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পারুলকে ঢাকার গার্মেন্টস থেকে আশুলিয়ার গার্মেন্টস বদলি করার ছক এটে ফেলে। পবন বেশ বুদ্ধিমান বলে সেটা আগেই বুঝে ফেলে। সে এটাও জানে নুরিসলাম ঘুষ হিসেবে নানান উপকরণ যেমন মাছ, দই ইত্যাদি পেতে পছন্দ করে। ঈদের বন্ধে পারুল আর পবনের বিয়ের কথা মোটামুটি পাকাপাকি হয়ে যায়। পারুলের বদলি ঠেকাতে ঈদের বন্ধ শেষে নুরিসলামের জন্যে ভোলা থেকে টাটকা মাছ এবং দই নিয়ে আসে পবন। কিন্তু তাতে কোনো লাভই হয় না।
ঔপন্যাসিক তপন দেবনাথ উপন্যাসের শরীর গঠনে তুলে এনেছেন নিম্ন মধ্যবিত্তের বিনোদন সহ আরো অনেক দিক। সপ্তাহান্তে সিনেমা হলে সিনেমা দেখা, রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর মত বিষয়, চিড়িয়াখানা ঘুরে বেড়ানকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। হলে সিনেমা দেখার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘‘গেটে টিকেট নিয়ে ঢোকার পর টিকেট চেকার লাইট টিপে প্রথমে পারুল, এরপর পবন, তারপর রহিমা ও সবশেষে লাইজুকে সিট দেখিয়ে দিলো। একটু পরেই সিনেমা শুরু হয়ে গেল। হলটি অন্ধকার। এখন আর কেউ কাউকে দেখছে না। সকলের দৃষ্টি পর্দার দিকে। রহিমার ডান পাশে পবন। সে বার বার দান দিকে দেখার চেষ্টা পবনের হাত কোথায়। তার আরেকটি হাত পবন ধরবে কি না ভাবছে। পারুলের বাম হাতে পবন ডান রাখল। কায়দা করে তার পুরো হাতটি মুঠো করে নিজের হাতে নিলো।’’
দিন রাত পরিশ্রম করে পারুলের মত অসংখ্য মানুষ নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে গার্মেন্টসে করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের লাঞ্ছনার শিকার হয়। তাতেও তারা ভেঙ্গে পরে না। পারুলদের বেশ পরিবর্তন এসেছে। তার পাঠানো টাকায় রফিক মাস্টার বাড়িতে কিনেছেন একটা সাদাকালো টেলিভিশন। কিন্তু গ্রামীন ফতোয়াবাজদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো উপায় কি করতে পেরেছিলেন? বজলু মাতাব্বর, পারুলকে ঢাকায় পাঠানোর পর থেকেই রফিক মাস্টারের পেছনে লেগেছিল। নানান সময় ধর্মকে হাজির করতে চেষ্টা করেছে। যুবতী মেয়েকে একা একা ঢাকা পাঠিয়ে রফিক মাস্টার কিভাবে রাতে ঘুমায় তেমন প্রশ্নও করেছে। শরিয়ত নিয়ে তো বাড়াবাড়ি ছিল সীমার বাইরে। পারুলের রোজগারটা হালাল কি না এমন প্রশ্নও উঠেছে। কিন্তু পারুলের টাকায় কিছুটা স্বচ্ছলতা আসার পর সেই বজলু মাতব্বর তার উড়নচণ্ডি ছেলের জন্যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে ওদের বাড়িতে। সেইসাথে তার ভাবনায় থাকে তার ছেলের জন্যে একটা কর্মসংস্থান বিষয়টি। ফতোয়াবাজরা কী অদ্ভুত শ্রেনির মানুষ হয় তা দেখিয়েছেন ঔপন্যাসিক।
উপন্যাসের একপর্যায়ে পবন, কাদের, রহিমা, লাইজু যখন সুপারভাইজারের পারুলকে আশুলিয়ায় বদলি করার সিদ্ধান্ত বদলাতে ব্যর্থ হয় তখন ঔপন্যাসিক পাঠককে এটাই ভাবতে বাধ্য করেন যে অন্যায় মেনে নেওয়াই যেন তাদের নিয়তি। আর পবন ভালোবাসার মানুষকে একই কর্মস্থলে রাখতে না পারার কষ্টে আপ্লুত হয়ে যায়।
পারুল চলে যায় আশুলিয়া। সেখানে যাওয়ার কিছুদিন পর আগুন লাগে তাদের কারখানায়। গেট বন্ধ ছিল বলে অনেকেই ভেতরে আটকা পরে। পারুলের টাকায় কেনা টেলিভিশনে অগ্নিকাণ্ডের খবর দেখে তার মা-বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার পর একেইবারেই নির্বিকার থাকে সুপারভাইজার। তপন দেবনাথ বোঝাতে চেয়েছেন গার্মেন্টসের লাগার পেছনে অনেক ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট অনেকেই জড়িত থাকে। এক্ষেত্রে সুপারভাইজার নুরিসলাম সন্দেহের বাইরে নয়। যদিও এদের ধরার জন্যে যে প্রমাণ প্রয়োজন তা এ উপন্যাসেও পাওয়া যায়নি।
পারুলের সন্ধান পাওয়া যায় না। ওর মত অসংখ্য গার্মেন্টস শ্রমিকের মধ্যে থেকে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের নামে যা দেওয়া হয় অপমানের ভিন্ন নাম। কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই দায়ভার নেই না। শুধু কর্তৃপক্ষ নয় আমাদের সমাজের কেউই এ দায়ভার নেয় না। অথচ গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঘামে, রক্তে, দীর্ঘশ্বাসে পূর্ণাঙ্গ জীবনালেখ্য রচিত হয় ইতিহাসের পাতায়।
লেখক: কবি, ঔপন্যাসিক ও আলোকচিত্রী