বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব ও স্বতন্ত্র লেখনীশৈলির কারণে তরুণ কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান-এর নাম এখন বেশ আলোচিত। তাঁর জন্ম ৮ নভেম্বর, ১৯৮০; ফেনীর পরশুরাম উপজেলার বিলোনিয়ায়। বর্তমানে নিউজ ম্যাগাজিন ‘সাপ্তাহিক’-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। বাংলাদেশি নভেলস-এর পক্ষে আজ আমরা তার মুখোমুখি হয়েছি। তাঁর মুখেই শোনা যাক তাঁর লেখালেখির কথা।
প্রশ্ন : ফাল্গুনের শুভেচ্ছা।
স্বকৃত নোমান : আপনাকেও ফাগুনের আগুনঝরা শুভেচ্ছা।
প্রশ্ন : এবারের অমর একুশে বইমেলায় আপনার কী কী বই এসেছে?
স্বকৃত : একটি উপন্যাস, ‘হীরকডানা’।
প্রশ্ন : কোন প্রকাশনী থেকে?
স্বকৃত : বিদ্যাপ্রকাশ থেকে।
প্রশ্ন : ‘হীরকডানা’ আসলে কোন ধরনের উপন্যাস?
স্বকৃত : আসলে এটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। উপন্যাসটির পটভুমি বৃহত্তর নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা। আঠার শতকের মাঝামাঝি দক্ষিণ-পূর্ববাংলায় শমসের গাজী নামের এক বিপ্লবীর অভ্যুদয় ঘটে। ‘বাংলার বীর’, ‘ভাটির বাঘ’ তাঁর উপাধি। মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুদের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তোলেন এক লাঠিয়াল বাহিনী। তার ভয়ে উপকূলীয় জনপদ থেকে বিতাড়িত হয় হার্মাদরা। কবি সৈয়দ সুলতানের উত্তরপুরুষ সৈয়দ গদা হোসেন তাঁর অন্তরে জ্বালিয়ে দিলেন জ্ঞানপ্রদীপ। জমিদারকন্যা দরিয়াবিবির সঙ্গে অসফল প্রেম তাঁর জীবনকে উন্নীত করে ভিন্ন মাত্রায়। কৃষক-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অধিকার করে নেন জমিদারি। প্রজাবিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে রোষানলের শিকার হন ত্রিপুররাজের। শুরু হয় তুমুল লড়াই। গর্জে ওঠেন ভাটির বাঘ। ভুখানাঙা চাষাভুষাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধক্ষেত্রে। শত্রুসেনা বিনাশ করতে করতে হয়ে ওঠেন অবিনাশী যোদ্ধা, অপ্রতিরোধ্য হন্তারক। অধিকার করে নেন রাজ-সিংহাসন। ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেন টানা এক যুগ। তাঁর কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ইংরেজ বেনিয়ারাও। নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিহত হওয়ার পর বেনিয়াদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয় তাঁর। শুরু হয় আরেক লড়াই। চম্পকনগর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী হলেও আবার পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। একদিকে তিনি অকুতোভয় বীর, প্রজাদরদি রাজা, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, অন্যদিকে মনকাড়া বাঁশিওয়ালা। গভীর রাতে বাঁশির সুর শুনে বেরিয়ে আসেন আত্মগোপন থেকে। অমীমাংসিত থেকে যায় তাঁর মৃত্যু। ইংরেজ ইতিহাস তাঁকে দস্যু-ডাকাত হিসেবে আখ্যায়িত করে, আর ভাটিবাংলার মানুষের কাছে কিংবদন্তীর মহানায়ক হিসেবে অমর হয়ে থাকেন। জোসনারাতে হীরকডানায় ভর করে জিন হয়ে জিনের সঙ্গে, পাখি হয়ে পাখির সঙ্গে উড়ে বেড়ান। আসলে আমি এই উপন্যাসে ইতিহাস, কিংবদন্তী ও কল্পনার নান্দনিক সম্মিলন ঘটাতে চেয়েছি। একটা বিস্মৃত সময়কে তুলে ধরতে চেয়েছি। বলে রাখা দরকার যে, এ উপন্যাসের বিষয় ঐতিহাসিক হলেও এটি উপন্যাসই, ইতিহাসের ডকুমেন্টেশন নয়।
প্রশ্ন : আপনার প্রথম উপন্যাস সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন…।
স্বকৃত : আমার প্রথম উপন্যাস ‘নাভি’। আমাদের এলাকায় একটা কথা প্রচলিত আছে যে, শ্বশানে হিন্দুদের দাহ করার সময় নাভিটি পোড়ে না। উপন্যাসটি লেখার সময় আমি চার্বাকীয় নাস্তিকতাবাদ নিয়ে বেশ পড়াশোনা করছিলাম, খানিকটা প্রভাবিতও ছিলাম। ‘নাভি’র কেন্দ্রীয় চরিত্র হোনান সারা জীবন শ্মশানে শ্মশানে এই নাভি খুঁজে বেড়ায়। তার ধারণা এই নাভি দিয়ে জাদুটোনা করা যায়। কিন্তু সে নাভি পায় না। এ উপন্যাসে আমি নাভির প্রতীকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটা প্রশ্ন করতে চেয়েছি। হোনান সারা জীবন নাভি খোঁজে, কিন্তু পায় না। মানুষ সারা জীবন ঈশ্বর খোঁজে, কিন্তু পায় না।
প্রশ্ন : আপনার বহুল আলোচিত উপন্যাস কোনটি?
স্বকৃত নোমান : বহুল আলোচিত বলতে যা বোঝায় সে অর্থে আমার কোনো উপন্যাস নেই। আমার উপন্যাসের পাঠক-সংখ্যা সীমিত। তবে ২০১১ সালে ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত ‘রাজনটী’ উপন্যাসটি মোটামুটি আলোচিত। উপন্যাসটির জন্য আমাকে ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম’ পুরস্কার দেয়া হয়। প্রকাশক জহিরুল আবেদীন জুয়েল জানালেন, বর্তমানে উপন্যাসটির দ্বিতীয় মুদ্রণ শেষ হওয়ার পথে।
প্রশ্ন : রাজনটীর বিষয়বস্তু কী?
স্বকৃত নোমান : বেশ কিছুটা বাস্তব, কিছুটা ইতিহাস, কিংবদন্তী আর বাকিটা কল্পনা। আঠার শতকের শেষের দিকের কথা। ত্রিপুরা রাজসভায় নূরজাহান নামে এক বাঈজী ছিল। মধ্যবয়সে সে বাঈজীবৃত্তি ছেড়ে জন্মভূমিতে ফিরে আসে। গত জীবনের ‘পাপের প্রায়শ্চিত্য’ হিসেবে একটি মসজিদ নির্মাণ করে। কিন্তু এলাকার মানুষ যখন জানল সে একটা বাঈজি, তখন কেউ আর ওই মসজিদে এক ওয়াক্ত নামাজও পড়ল না। শেষ পর্যন্ত নূরজাহান আবার বাঈজীবৃত্তিতে ফিরে যায়। তার নির্মিত মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ এখনো কুমিল্লা শহরের উপকণ্ঠে মাঝিগাছা গ্রামে আছে। এ বিষয়কে ভিত্তি করে ‘রাজনটী’ রচিত।
প্রশ্ন : আপনার বেশিরভাগ উপন্যাস ঐতিহসিক পটভূমিতে। সমকালীন বিষয় নিয়ে লিখছেন না কেন?
স্বকৃত নোমান : না, কথাটা সত্যি নয়। আমার বেশিরভাগ উপন্যাস ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা নয়। গত বছর আমার ‘বেগানা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। এটির বিষয়বস্তু হচ্ছে রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা সমস্যা তো একেবারেই সমকালীন তাই না? তাছাড়া প্রথম উপন্যাস, ‘নাভি’ ও তৃতীয় উপন্যাস ‘জলেস্বর’ও কিন্তু সমকালীন বিষয়কে কেন্দ্র করে। আমার ছয়টি উপন্যাসের মধ্যে ঐতিহাসিক পটভূমিতে লিখেছি মাত্র দুটি, ‘রাজনটী’ ও ‘হীরকডানা’। আসলে আমার সমকালীন লেখকরা যে বিষয়গুলোর উপর আলো ফেলছেন না, যে বিষয়গুলো কিছুটা আড়ালে থেকে যাচ্ছে, আমি সে বিষয়গুলোর উপর আলো ফেলার চেষ্টা করছি। আমার উপন্যাসের বিষয় নাগরিক জীবন নয় বলে আমি সমকালীন বিষয় নিয়ে লিখছিল না এ কথা বলা হচ্ছে। ‘জলেস্বর’ উপন্যাসটির বিষয় বেদে সম্প্রদায়ভুক্ত সান্দার। সান্দাররা কি বর্তমান বাংলাদেশে নেই? সান্দার কি অতীতের কোনো বিষয়? আসলে এরা সমাজের নিচুতলায় থাকে বলে উঁচু তলার মানুষরা তাদেরকে দেখতে পায় না সহজে।
প্রশ্ন : সাহিত্যে যৌনতা বিষয়ে আপনার অভিমত?
স্বকৃত নোমান : উপন্যাস তো জীবনেরই মহাকাব্য। আর যৌনতা তো জীবনেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জীবনের এ অংশটি সাহিত্যে না থাকার কোনো কারণ নেই। তবে সাহিত্যে যৌনতা আসবে শৈল্পিকভাবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যে শৈল্পিকভাবে যৌনতা এনেছেন ঠিক সেভাবে। দুর্বল লেখকরাই পাঠককে আকর্ষণ করতে তার রচনায় যৌনতাকে ন্যাংটোভাবে উপস্থাপন করেন। সাহিত্যে যৌনতা আসবে ঘটনার প্রয়োজনে, তবে শৈল্পিকভাবে।
প্রশ্ন : ‘হীরকডানা’র পর কী বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখার কথা ভাবছেন?
স্বকৃত নোমান : আসলে লেখার মতো এত কাহিনী মাথায় রয়েছে যে, এক জীবনে লিখে শেষ করতে পারব কিনা সন্দেহ। তবে বর্তমানে বহুল আলোচিত একটি খুনের ঘটনা নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার কথা ভাবছি। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। খুনের কারণ এবং খুনীর মনস্তত্বটা বোঝার চেষ্টা করছি। দেখা যাক কী হয় শেষ পর্যন্ত।
প্রশ্ন : শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনের ব্যাপারে যদি কিছু বলেন…।
স্বকৃত নোমান : বিয়াল্লিশ বছর ধরে বাংলার মানুষ যে বেদনা বুকে নিয়ে ঘুরছিল, এই আন্দোলনের মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শাহবাগ প্রজস্ম চত্বরে ইতিহাসের একটা পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ চলছে। আমার সৌভাগ্য যে, আমিও এই ইতিহাস রচনার কাছে অংশ নিতে পারছি। আমার ধারণা, নতুন প্রজন্মের এই আন্দোলনের মাধ্যমে একটা বাঁক পরিবর্তন করবে বাংলাদেশের সাহিত্য। এরপর থেকে এ দেশের সকল কবি নতুন দিনের কবিতা লিখবেন। সকল ঔপন্যাসিক, সকল গল্পকার নতুন দিনের নতুন কাহিনী লিখবেন। রাজাকারদের সঙ্গে আপোষ করতে করতে আমাদের অগ্রজদের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। তরুণরা মেরুদণ্ড সোজা করে এখন গণশত্রুদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। জয় আমাদের হবেই।
প্রশ্ন : এবারের বইমেলা কেমন দেখছেন?
স্বকৃত নোমান : শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে শুরু থেকেই সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছি, তাই বইমেলায় সময় দেয়া হচ্ছে না। তবে আমার মনে হয় আন্দোলন এবং বইমেলায় মানুষ শতস্ফূর্তভাবেই অংশগ্রহণ করছে।
প্রশ্ন : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
স্বকৃত নোমান : আপনাকেও।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: রাজিউল হাসান
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ; ১ ফাল্গুন, ১৪১৯ বঙ্গাব্দ