কামাল রাহমানের উপন্যাস ঝুমপাহাড়। লেখক এখানে পাহাড়ি একটি পরিবারের তিন প্রজন্মের অস্তিত্বের লড়াই, জীবন সংগ্রাম, ওদের আচার ও কৃষ্টি, প্রভৃতির ভিতর দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর সামগ্রিক ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন। ব্রিটিশ সাম্রা জ্যের সূর্য অস্তমিত যাওয়ার যুগ সন্ধিক্ষণ থেকে তিনি উপন্যাসের পটভূমি সূচনা করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে একটি মারমা পরিবার ও সমাজের ইতিবৃত্ত থেকে উপন্যাসের পথ নির্মাণ শুরু করেন তিনি। অনেক সময় পাহাড়ি পরিবারগুলো অনন্ত পরিব্রাজকের মতো স্থান হতে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়ায়। তেমনই একটি পরিবারের গৃহকর্তা পাইমং। স্ত্রী রেইনু ও সন্তানসন্ততি নিয়ে তার সুখের সংসার। শিকার, ঝুমচাষ ও সন্ধ্যার মদমত্ত উদ্দামতা তার জীবন সংস্কৃতি, তার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা শক্তি। কিন্তু সম্প্রসারণবাদী ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতি আইজলের গহিন বনেও অশুভ প্রভাব বিস্তার করে। পাহাড়িদের মধ্যে হিংসাবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আত্মকলহে ডুবিয়ে বিভাজিত করে ফেলে। উপন্যাসের সূচনাতে দেখা যায়, ক্যাথলিক খ্রিস্ট ধর্মের কারণে পাইপং তার বন্ধু উছার হাতে নিহত হয়। অর্থাৎ গহিন বনের সরল মানুষগুলো যতই সমতলের জৌলুস থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুক না কেন, মৃত্যুর ছায়ার মতো সাদা মানুষের ঈশ্বর তাদের অনুসরণ করে। পাহাড়ি মানুষের অজ্ঞতা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা রোগ শোক ও কর্মহীনতাকে অশ্র্রয় করে খরস্রোতা ঝর্ণা, পাহাড় নদী স্রোতের বাঁকে বাঁকে ধর্মজাজক ও রাষ্ট্রশক্তি ক্রসের চিহ্ন এঁকে দেয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ সময় তারা সেবা ও সাহায্যের নামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আন্তঃবিভাগকে আরও বেশি প্রকট করে তোলে।
ঝুমপাহাড় উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিহত পাইপংয়ের ছেলে গ্রী। লেখক মূলত তার মাধ্যমেই আজন্ম বঞ্চিত, নিপীড়িত, নিগৃহীত পাহাড়ি জনজাতির আখ্যানকে মূর্ত করে তুলেছেন। আপাত নিস্তরঙ্গ মনে হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অন্যান্য জাতির মতো পার্বত্য অঞ্চলের জাতিসত্ত্বা, আবাসভূমি, রাষ্ট্র ভাবনা, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও আলোড়ন তোলে। প্রায় দুই শতাব্দীর ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পার্বত্য অঞ্চলের পরিধি কোন রাষ্ট্র সীমানার মধ্যে পরিগণিত হবে, সেই বিষয়ে তাদের মধ্যে কোন সুস্পষ্ট রাজনৈতিক চেতনা দানা বাঁধেনি। ফলে দেখা যায়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বার্মার পতাকা, কেউ ভারত, কেউ বা পাকিস্তানের জাতীয় পতাকাতলে নিজেদের মুক্তি ও জাতি স্বাতন্ত্র্যের পথ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, নিজেদের আত্মস্বীকৃতি, জাতিসত্ত্বা, কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ব্যাপারে তারা পুরো মাত্রায় সজাগ ছিলেন। কিন্তু অপূর্ণতা ছিল সুসংঘবদ্ধ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দক্ষতা সৃষ্টিতে। উপন্যাসে আর একটা বিষয় লক্ষণীয় মাত্রায় ফুটে ওঠে। পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীগুলোর নিজেদের ভিতর আগ্রাসন প্রবণতা। উপন্যাসের বিস্তৃত জায়গা জুড়ে তাই মূর্ত হয়ে ওঠে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী লুসাই জনজাতি অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ওপর ক্রমাগতভাবে নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। লুসাইদের আক্রমণ ও নৃশংসতার কারণে মারমা, ম্রো, টিপড়া, মণিপুরী রাখ্যাইন চাকমা প্রভৃতি জনজাতিগুলো সবসময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। লুসাই যোদ্ধারা মারমাদের বাড়িঘর, ফসলের ক্ষেত জ্বালিয়ে দিয়েছে, নারীদের ধরে নিয়ে গেছে, বর্শা ফলকে তাদের ছিন্ন মাথা ঝুলিয়ে উন্মাদ নৃত্য করেছে। তাদের ভয়ে অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে, এক বন থেকে অন্য বনে ও অন্য নদীর বাঁকে বারবার বসতি পরিবর্তন করেছে। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার লুসাইদের ভয়ে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সন্ত্রস্ত থাকলেও তারা কিন্তু অস্তিত্ব সংকটে পড়েনি। পরবর্তী সময় পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বারবার যা তাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
শিক্ষা, স্বজাতি প্রেম, সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ ও দৃঢ় প্রত্যয়, ধীরস্থিরতা, সংকল্পবদ্ধতা সহজেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে গ্রীর চরিত্রে। পাশাপাশি লেখক এসব নৃ-গোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, বংশ পরম্পরার পরিচয় ও আদিবসতিকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন। ইতিহাসের যে-সব প্রেক্ষাপট তাদের ভাগ্যকে বিড়ম্বনার ভিতর ঠেলে দেয় তাও বিবেচ্য বিষয়। লেখকের গদ্য শৈলী থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হলো:
১. “মোঘল সুবাদার শায়েস্তা খান ‘মগজমা’ নামে এক ধরনের কর চাপিয়ে দেয় আরাকানিদের কাঁধে, এছাড়া ওদের উপর অন্যান্য অত্যাচার নেমে এলে সমতল ছেড়ে ধীরে ধীরে পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করে ওরা। কর্ণফুলী নদীর উভয় তীরে, চন্দ্রঘোনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত এবং শঙ্খ ও মাতামুহুরি নদীর উজানের দু’তীরে আরাকানি বসত গড়ে ওঠে।”
২. “ব্রিটিশ-রাজ ছেড়ে যাওয়ায় বান্দরবান শহরে বার্মার পতাকা ওড়ায় থোয়াইচরা। রাঙ্গামাটিতে গ্রী ওড়ায় ভারতের পতাকা। শেষ পর্যন্ত কোনোটাই থাকে না ওদের, কয়েকদিনের মধ্যে চাঁদ-তারা পতাকা ওড়ে উভয় শহরে। খুব আপত্তি নেই এতে ওদের। তেমন কোনো প্রতিবাদও জানায় না কেউ। নতুন দেশের সঙ্গে সহজে একাত্ম হয়ে ওঠে।”
৩. “আমি মনে করি জমির দাবি মানুষের ভেতর সৃষ্টি করা হয়েছে অভাব থেকে নয়, কেবল প্রয়োজন থেকে নয়। তুমি তো জানো, এক সময় মোঙ্গলরা কত দরিদ্র ছিল, নির্দিষ্ট একখণ্ড ভূমিও ওদের ছিল না, জমি দখল করতে যেয়ে সমগ্র এশিয়াকে করায়ত্তে এনেছিল ওরা। মঙ্গোলিয়া রাষ্ট্র কতটুকু এখন, ওখানে কোনো জমি কেনাবেচা হয় না, জানো?”
৪. “ঠিক কুকি বলে কোনো উপজাতি নেই, লুসাই বনযোগী, হোলাং, সেন্দু প্রভৃতি উপজাতিকে অন্যান্য পাহাড়িরা কুকি নামে ডাকতো, ওদের তেমন কোনো ভাষা ছিল না, কু-কি জাতীয় চিৎকার ছিল মূলত ওদের ভাব প্রকাশের শব্দ মাধ্যম, ওরা থাকতো কুন্দল পাহাড়ের ঐধারে, ঐ কুন্দল অঞ্চলটাই এখন ভারতের মিজোরাম, ওরা সবাই এখন মিজো হয়ে গেছে।”
৫. “পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি অনুপাতে চাষাবাদের জমি খুব কম। তিন পার্বত্য জেলার মোট আয়তন প্রায় পাঁচ হাজার বর্গমাইল। এর শতকরা দুভাগ মাত্র চাষাবাদের জমি। কর্ণফুলিতে বাঁধ দেয়ায় প্রায় চারশো বর্গমাইল পানির নিচে তলিয়ে যায়, হারিয়ে যায় চাষাবাদের চলি¬শ ভাগ জমি। প্রায় চলি¬শ হাজার পাহাড়ি, জনসংখ্যার প্রায় সাতের এক ভাগ, প্রতিবেশী দেশ দুটোতে পাড়ি দেয়।”
৬. “দুপুরের খাবার খেতে বসে গ্রীর চক্ষু যেন চড়ক গাছ! পাহাড়ি মানুষ হিসেবে এমন অনেক প্রাণী সে খেয়েছে যা সমতলের মানুষ কখনো খায় না, কিন্তু বানর খায়নি গ্রী। ওর সম্মানে একটা বানর-ভোজের ব্যবস্থা করেছে ওরা। ওটার রক্তমাখা তাজা মগজ দিয়ে কাঁচা সালাদ করেছে, ও মাংসের এক ধরনের ঝোল রেঁধেছে। বানরের একটা হাত ওখানে ভেসে থাকতে দেখে ওর ভেতর বিবমিষা জেগে ওঠে। কিন্তু প্রধান অতিথি সে, তাকে তো খেতেই হবে।”
৭. “আসরের শুরু অনেকটা নীরবে সম্পন্ন হয়। যে যার গ¬াসে চুমুক দিয়ে যায়। রসুন আদা আর ধনেপাতা দিয়ে ভাজা ব্যাঙের মাংস অপূর্ব স্বাদ নিয়ে আসে পান পর্বটাতে। কিন্তু ত্রিপুরাদের ঘরে তৈরি পানিয়টাকে কিছুটা জলো মনে হয় গ্রীর।”
৮. “যেমন ইহুদিরা, গ্রী তো সাহিত্য-প্রিয় মানুষ, নিশ্চয়ই আইবি সিঙ্গারের লেখা পড়েছে। ভদ্রলোক কিন্তু সংস্কৃতের মতো একটা মৃত ভাষায় লিখেছেন। ঐ ইড্ডিশ ভাষা বোধ হয় তখন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের আয়ত্তাধীন ছিল। ঐ ভাষায় লিখে তিনি চরম সার্থকতা পেয়েছেন। পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে। নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি।”
৯. “এক বিতর্কিত সিদ্ধান্তে ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয় এ রাজ্য। এই সংযুক্তির পিছনে ‘৪৭ পরবর্তী সময়ে সীমানা পেরিয়ে আসা বাঙালিদের চাপ রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। কয়েক পুরুষ আগেও যে রাজ্যে বাঙালিদের কোনো স্থায়ী বসতি ছিল না বলা চলে, সেখানে বাঙালিরাই বর্তমানে ত্রিপুরার প্রধান জনগোষ্ঠী, এবং বাংলা হচ্ছে প্রধান ভাষা।”
১০. “কিন্তু গ্রী বাংলা অক্ষরের পরিবর্তে বার্মার বর্ণমালা নেয়ার পক্ষে। রাখ্যাইনরাও ঐ বর্ণমালা ব্যবহার করে… এটা নিরীক্ষা করে কিছু দিন। ১৩টা অক্ষর খুঁজে পায় গ্রী, যেগুলো বার্মা ও বাংলায় প্রায় একই রকম দেখায়। ওগুলোর সঙ্গে বাংলা থেকে ১০টা ও বার্মা থেকে ১০টা নিয়ে মোট ৩৩টা বর্ণের একটা কাঠামো দাঁড় করায় … প্রাথমিকভাবে পাঁচ হাজার শব্দ নিয়ে ভাষার কাঠামো নির্মাণ করে গ্রী।”
উপন্যাসের এসব অংশ থেকে পুরো আখ্যানের গতি ও প্রবণতা উপলব্ধি করা যায়। পাহাড়ে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো নিজেদের মধ্যে আত্মকলহে লিপ্ত হয়েছে। আবার বারবার তারা বৃহৎ জনগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রশক্তি কর্তৃক নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। বারবার তাদের স্বকীয়তা সংস্কৃতি ধর্ম ও কৃষ্টি ব্যাহত হয়েছে। তাদের নারী, জমি ও ফসল লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে। তবে তাদের উপর চিরস্থায়ী বঞ্চনার সূচনা হয় পাকিস্তান আমলে, ১৯৬৬ সালে। সেই সময় তাদের বিশেষ পাহাড়ি মর্যাদা হরণ করে নেয়া হয়। একই সময়ে কাপ্তাই বাঁধ দেয়ার ফলে তাদের কৃষি জমির চলি¬শ শতাংশ পানির নিচে তলিয়ে যায়। অর্ধ লক্ষ পাহাড়ি প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। লেখক কামাল রাহমান ইতিহাসের নির্যাস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অত্যন্ত গতিশীল গদ্যশৈলীতে পাহাড়ি অঞ্চলের বর্ণনা করেছেন। লেখক এখানে একজন কথকের ভূমিকায় অত্যন্ত সফল। পার্বত্য আঞ্চলের এই সকল ক্ষুদ্র জনজাতির জীবন সংগ্রাম ও যন্ত্রণাকে ভাষার অনুপম কারুকার্জে মূর্ত করে তুলেছেন। ইতিহাসের এসব তথ্য উপস্থাপনে কোথাও গতানুগতিক ঘটনা প্রবাহের মতো মনে হয়নি, বরং একজন জীবন শিল্পী হিসেবে কামাল রাহমান তা ব্যক্ত করেছেন ভাষা ও শব্দ শৈলীর বিশিষ্টতায়। গদ্য ধারায় লাইনের পর লাইনে তিনি কবিতার ভাষা ও আবহ তৈরি করে পাঠককে মুগ্ধতায় ধরে রাখতে পেরেছেন।
আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হই, স্বাধীনতা যুদ্ধে পাহাড়িদের অংশ গ্রহণ। কিন্তু পরিস্থিতিগত কারণে হোক কিংবা জাতিগত বিদ্বেষই হোক, তারা বৃহৎ বাঙালিদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তাই দল বেঁধে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে চাইলে অস্ত্র ও ট্রেনিং থেকে বঞ্চিত হয়। আবার মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লগ্নে তারাই বাঙালিদের লক্ষ্যে পরিণত হয়ে নৃশংসতার শিকার হয়। বঙ্গবন্ধু তাদের বাঙালি হয়ে যেতে বলেন। বঙ্গবন্ধুকে পরিস্থিতি কিছুটা বোঝাতে সক্ষম হলেও ‘৭৫ পরবর্তীকালে সমগ্র পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়। তারা বাঙালি পুনর্বাসন, পাহাড়ে পাহাড়ে সেনা ক্যাম্প স্থাপন করে আগ্রাসন, নির্মম ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তারই অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে তৈরি হয় শান্তিবাহিনী। লেখক অত্যন্ত সুনিপুণভাবে এসব তার ভাষা ও গদ্যশৈলীতে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসে লেখকের অনবদ্য সৃষ্টি গ্রী। গ্রীর ভাতিজা মেজর থিন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা মানুদা প্রমুখ। এসেছে ছোট বড় অনেক পার্শ্ব চরিত্র, প্রদীপ কুমার তালুকদার, মোহনলাল, রংচা প্রমুখ।
আখ্যানে এই রংচা চরিত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লুসাইদের ক্রমাগত আক্রমণে ক্ষিপ্ত হয়ে তরুণ গ্রী লুসাই বালিকা রংচাকে অপহরণ করে। সময়ের বিবর্তনে রংচার রূপগুণ ও আনুগত্যে গ্রী প্রণয়াসক্ত হয়ে ওঠে। রংচা ছল ও কৌশলের আশ্রয় নেয়। যদিও ক্ষণিকের জন্য রংচা গ্রীর প্রতি দুর্বল ও মুগ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু তার অবচেতন মনে সে যে একজন মিজো জনজাতির সদস্য সেই বিষয়ে সে পুরোপুরি সজাগ ছিল। এক সময় গ্রীর হৃদয় ভেঙে সে তার পরিবার পরিজনের নিকট ফিরে যায়। নিঃসঙ্গ গ্রীর জীবন একাকিত্ব ও অস্থিরতায় ভরে ওঠে। লেখক কামাল রাহমান অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বিরহ কাতর একজন মানুষের ছবি এঁকেছেন। যা কোন সংবেদনশীল মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়।
লেখক উপন্যাসে মানুদার নেতৃত্ব, মহৎ গুণ, তার হৃদয়ের বিশালত্ব, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য মমত্ববোধ, দায়িত্ববোধ, প্রভৃতির এক মানবিক আখ্যান সৃষ্টি করেছেন। মেজর থিনের অপার সাহস, দেশপ্রেম ও যুদ্ধকৌশলের ছবি উপন্যাসের উজ্জ্বল অধ্যায়। আবার বিকল্প দৃশ্যও দেখা যায়, শান্তিবাহিনীর নেতৃত্বের লোভে নিজেরা উপদলীয় কোন্দল ও যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাদেরই একটি বিপথগামী অংশ পাহাড়িদের অধিকার আদায়ের অবিসংবাদী নেতা মানুদাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। তারাই অনেকটা তলিয়ে পড়ে অতল গহ্বরে। সর্বোপরি লেখক আখ্যান ভাগের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটি শক্তিশালী চরিত্র গ্রীকে অঙ্কন করেছেন পরম মমতায়। সে তার জীবন যৌবন অনন্য সাংগঠনিক দক্ষতা ও মেধা পাহাড়িদের ভাগ্য বদলের জন্য ব্যয় করেছে। পাহাড়িদের স্বকীয়তা, সংস্কৃতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে। গ্রী পাহাড়িদের শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় শব্দ-দৃশ্যের মাধ্যমে লেখক যে দৃশ্য-চিত্র অঙ্কন করেছেন তাতে পার্বত্য অঞ্চলের সমাজ ও সংস্কৃতির একটি পরিপূর্ণ ছবি পাওয়া যায়। অবশ্য একথাও সত্য পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালির সমাজ ও মানস গঠন কি রকম ছিল, তার চিত্র এখানে অনুপস্থিত। কারণ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। আবার একথাও সত্য যে, বাঙালি জনগোষ্ঠীর সবাই কিন্তু আগ্রাসী মনোভাবের নয়। আবার পাহাড়ে স্থায়ী বাঙালি বসতি ও সেটেলার বাঙালিদের মানসগঠন ও পাহাড়িদের সাথে সম্পর্কের ধারণা এক নয়। সব কিছুর পরে যে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তা হলো বাংলা ভাষায় ইতোপূর্বে পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবন সংগ্রাম ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে এত বিস্তৃত আখ্যান কেউ রচনা করেনি। লেখক কামাল রাহমান স্বার্থকভাবে ঝুমপাহাড় উপন্যাসের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের আখ্যান কাব্য তৈরি করেছেন।
ঝুমপাহাড় ॥ কামাল রাহমান ॥ প্রকাশক: রোদেলা, ঢাকা ॥ প্রকাশকাল: বইমেলা ২০১২॥ প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল ॥ পৃষ্ঠা: ২৬৪ ॥ মূল্য: ৩৪০ টাকা।