‘তাজতন্দুরি’ উপন্যাসটি গতানুগতিক উপন্যাস থেকে একটু ব্যতিক্রম। আমাদের সাহিত্যে এরকম উপন্যাস খুব বেশি নেই। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ব্রিটেন। সময়কাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ। ক্যানভাস হিসেবে এটা অনেক বড়। নানা কারণে বইটি পাঠকের ভালো লাগবে। ১২৬ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি ১৩ পর্বে লেখা। লেখক উত্তমপুরুষে দুটি চরিত্রকে প্রধান করে উপন্যাস এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একজন দীর্ঘদিন ধরে বিলেত প্রবাসী ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করেন। তাকে দিয়েই উপন্যাস শুরু। মূলত তার বয়ানেই আমরা জানতে পারি বিলেতে বাঙালি রেস্টুরেন্টের ইতিবৃত্ত।
‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয় ভাগ্যান্বেষীরা ব্যাপকভাবে বিলেত আসতে শুরু হয়। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই লন্ডনে এক ডজনের ওপর ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট চালু হয়ে যায় এবং বাঙালি খাবার ধীরে ধীরে ইংরেজদের আকৃষ্ট করতে থাকে।’ এভাবে প্রথম চরিত্রটি নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেষকালে সফল হয়। অন্য জন সম্প্রতি বিলেতে গিয়েছেন। তার উদ্দেশ্য বিলেতে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টগুলোর ইতিহাস নিয়ে একটা বই লেখা। বইটি লেখার জন্য তিনি বিলেতে অনেক জায়গায় যান এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে থাকেন। ফলে উপন্যাসটি হয়ে ওঠে বিলেতে বাঙালি রেস্টুরেন্টের ইতিহাসের দলিল। লেখক নিজে ইতিহাস-সচেতন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। উপন্যাসে তিনি যেসকল অঞ্চলে পরিভ্রমণ করেছেন সেগুলোর আদি বৃত্তান্তও নিটোলভাবে বিধৃত করেছেন। ওই সময়ের ইতিহাস বয়ানের পাশাপাশি বর্তমানকেও তিনি এঁকেছেন নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে। উপন্যাসের একটি বিশেষ লক্ষণীয় দিক হলো, বিদেশি ঐতিহ্য তুলে ধরার পাশাপাশি দেশীয় ঐতিহ্যের উপস্থাপন। অর্থাৎ লেখকের সমগ্র সত্তাজুড়ে আছে তাঁর দেশ-বাংলাদেশ-জন্মভূমির মাটি। তাই উপন্যাসে ‘মাদাম কুরি’, কোপার্নিকাসে’র পাশাপাশি এসেছে ‘রবি ঠাকুর’, ‘মধুসূদন’, ‘সুভাস’, ‘দেশবন্ধু’ ও ‘বঙ্গবন্ধুর’ নাম। তেমনি জার্মানির ভিশুয়া, লন্ডনের টেমসের নামের সঙ্গে উচ্চারিত হয় আমাদের বুড়িগঙ্গার নাম। কুক আইল্যান্ড, সিসিলি দ্বীপ, দিয়াগো গার্সিয়া, আন্দামান দ্বীপের পাশাপাশি এসেছে কুতুবদিয়া, মহেশখালি, রাঙাদিয়ার নাম। স্বদেশ আর বিদেশ মিলে একাকার হয়ে গেছে লেখকের কলমে।
বিলেতের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কাহিনির সাথে সাথে স্বদেশের চিত্রও তুলে ধরেছেন তিনি নিখুঁতভাবে।
উপন্যাসটির প্রথম বাক্যটিই ছিল—‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জার্মানরা গোলা দেগে আমার একটা পা উড়িয়ে দেয়…।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানুষ, জনপদ ও পারিপার্শ্বিকের বর্ণনায় তিনি কুশলতা দেখিয়েছেন। অসংখ্য বিষয়ের সমাবেশ তিনি ঘটিয়েছেন অত্যন্ত দক্ষতায়। রাশিয়া, চীন, ভারত, আমেরিকা, পোলান্ড, পাকিস্তান, গ্রিস -সর্বোপরি কোনো দেশই বাদ যায়নি ঔপন্যাসিকের বিষয় বিস্তার থেকে। পৃথিবীর সব ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তিনি ছুঁয়ে গেছেন। ‘বাঙালি তো শঙ্কর জাতি, পৃথিবীর সব জাতিই তো শঙ্কর’, ‘আমার কাছে এটা অত্যন্ত গৌণ, একেবারে তুচ্ছ, মানুষকে আমি মানুষ হিসেবেই দেখি, তার দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ – সবই আকস্মিক, প্রাকৃতিক ঘটনাসঙ্গত, অনিয়ন্ত্রিত দৈবচয়ন, যাতে ঐ মানুষটার কোনো ভূমিকাই নেই’ – এই হলো লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি।
উপন্যাসটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অপ্রকাশিত ইতিহাসের দলিল। বর্তমান প্রজন্মের পাঠকের জন্য এটি খুব প্রয়োজনীয় অংশ। একটি দেশের স্বাধীনতা একটি বড় অর্জন। কত সহস্র মানুষকে কতভাবে কতকিছু ত্যাগ করতে হয় এই স্বাধীনতাকে নিজের করে নিতে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রবাসীদের অবস্থান এবং বহির্বিশ্বে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা ইত্যাদি লেখক খুব দরদ দিয়ে বিধৃত করেছেন। সে সময় ব্রিটেনে অবস্থানরত বাঙালিদের শ্রম, ত্যাগের কথা তুলে ধরেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে বিলেত প্রবাসী বাঙালিদের উদ্বিগ্নতা ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য প্রবাসীদের উদ্যোগে বিলেত থেকে উকিল হিসেবে পাঠানো হয় ব্যারিস্টার স্যার টমাস উইলিয়ামকে। উনসত্তরে বঙ্গবন্ধুর লন্ডন গমন ও সত্তরের এপ্রিলে আওয়ামী লীগ যুক্তরাজ্য শাখা গঠন তাদের উদ্যোগেই করা হয়। এ সমস্ত কাজেই প্রবাসীরা যুক্ত ছিল যুদ্ধের পুরো ৯ মাস। প্রতিবাদ-সমাবেশ, ঘেরাও-কর্মসূচি, বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ছয়শ ত্রিশজন সদস্যের মধ্যে তিনশ সদস্যের স্বাক্ষরিত একটা প্রস্তাব পার্লামেন্টে উপস্থাপন করেন এমপি ব্রুস ডগলাসের মাধ্যমে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এত অধিকসংখ্যক এমপি স্বাক্ষরিত প্রস্তাব উপস্থাপন একটি বিরল ঘটনা।
টানটান এ উপন্যাসটিতে যতি চিহ্ন ব্যবহারে লেখক প্রচলিত পথে হাঁটেননি। শুধু কমা এবং মাঝে মধ্যে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে তিনি উপন্যাসটি লিখেছেন। ফলে উপন্যাসটি পাঠের সময় নিবিড় মনযোগ আবশ্যক।