বাংলা উপন্যাস ধারাকে যাঁরা জনপ্রিয় করে তুলেছেন মোস্তফা কামাল তাঁদের একজন। হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, নাসরিন জাহান, সৈয়দ শামসুল হক সম্প্রতি আধুনিক উপন্যাসের পতাকাবাহী হলেও মোস্তফা কামাল সে জলধি রথেরই একটি চাকা। আধুনিক উপন্যাস মন্থনে মোস্তফা কামালও অংশ নিয়েছেন স্বশক্তিতে। তাঁর চারটি উপন্যাসের ‘চার অপরূপা’য় সে অমৃত ধরা পড়েছে।
রবির আলোকে বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যিকরা আচ্ছন্ন ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন মৃত্যুর পর। বাঙালির হৃদয় বাজার তখন রবীন্দ্রনাথের একচেটিয়া দখলে। রবি যখন সরে গেলেন তখনই দেখা দিল জীবনানন্দের শিংয়ের মতো বাঁকা নীল চাঁদ, বের হলো ‘লক্ষ্মী পেঁচা’। হুমায়ূনের পর এখন মোস্তফা কামাল সে সম্ভাবনা নিয়ে দেখা দিয়েছেন। তাঁর কাহিনী, উপস্থাপনা, নাটকীয়তা, প্রাঞ্জলতা, সরসতা পাঠককে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। কামাল একজন আত্মপ্রচারহীন লেখক। প্রতিভাই তাঁকে লাজুক করেছে। আড়ালে থাকতেই তিনি ভালোবাসেন, সৃষ্টির মধ্যেই পাঠক তাঁকে খুঁজে পায়। ঢাকঢোল পিটিয়ে লেখকের জন্মদিন পালন, ঘটা করে প্রকাশনা উৎসব, উদ্ভট মোড়ক উন্মোচন, সাহিত্য জনসভায় অতিথি হয়ে প্রচারাভিযান চালানো তাঁর একেবারেই অপছন্দ। তিনি তাঁর সৃষ্টিকে এগিয়ে নিতে চান। তাই তাঁর নামডাক কেবল সুধীমহলে। কিন্তু আধুনিক যুগে বাজার দখলেরও একটা চেষ্টা থাকা চাই। কারণ এ যুগের মর্ম হলো – কিছু কাটে ভারে, কিছু কাটে ধারে। কামালের চারটি উপন্যাস আলোচনা করে তাঁর প্রতিভার কিঞ্চিৎ উদ্ঘাটন করতে চেষ্টা করব। আমি বড় লেখক নই, বড় সমালোচকও নই। কিন্তু যে বাটখারায় ওজন দেব তাতে পদার্থের যথার্থ পরিমাপ হবে – সন্দেহ নেই। চারটি উপন্যাসকে একত্রে কামাল নাম দিয়েছেন ‘চার অপরূপা’। উপন্যাস চারটি – ১. রঙ্গশালার নায়িকা; ২. বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় একা মেয়েটি; ৩. একদিন জোছনাভরা রাতে ও ৪. প্রিয়তমা। এ চারটি উপন্যাসকে নিন্মোক্ত মানদণ্ডে বিচার করা হলো।
কাহিনী: মোস্তফা কামালের চারটি উপন্যাসের কাহিনী অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। ‘রঙ্গশালার নায়িকা’ তার হারানো স্বামীকে খুঁজে বের করেছে। স্বামী তার আরেকটি বিয়ে করে ঢাকায় বেশ সুনামের সঙ্গে বিত্তের পাহাড়ে বসবাস করছিল। এদিকে নায়িকা সাদিয়া স্ত্রীর মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। তার একটি ১২-১৩ বছরের ছেলেও রয়েছে। অন্তত ছেলের জন্য হলেও স্বামী এন্তাজ মিয়াকে তার খুঁজে বের করা দরকার। প্রায় ২০ বছর পর সাদিয়া ঢাকায় এসেছে এন্তাজ মিয়াকে খুঁজে বের করতে। উত্তরায় এন্তাজ মিয়ার বিশাল বাড়ি। সাদিয়া সুকৌশলে বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং নিজেকে এন্তাজ মিয়ার স্ত্রী বলে পরিচয় দেয়। এতে বাড়িতে বিরাট হৈচৈ পড়ে যায়। কিন্তু সাদিয়ার দৃঢ়তা, সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার কাছে তারা পরাজিত হয়ে এন্তাজ মিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এন্তাজ মিয়া বিদেশ থেকে ফিরে এলে কাহিনীর জট খুলে। টানটান উত্তেজনাকর একটি কাহিনী ‘রঙ্গশালার নায়িকা’। বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় একা মেয়েটি: এ উপন্যাসের নায়িকা শাওন একজন খুনি। নিজের স্বামীকে খুন করে সে-ও আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল। জাহিদ তাকে বাঁচায় এবং নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেয়। ক্রমেই জাহিদ শাওনের প্রেমে পড়ে। শাওন আবার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে কিন্তু জাহিদের পূর্বসম্পর্ক ছিল নওরীনের সঙ্গে। নওরীন জাহিদের বাড়িতে এসে শাওনকে দেখে বিস্মিত হয়ে পড়ে। শাওন-জাহিদ-নওরীনের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় ত্রিভুজ প্রেমে। কাহিনীতে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়; সংঘাত এগিয়ে চলে। একদিন জোছনাভরা রাতে: এ উপন্যাস একটি দাম্পত্য সমস্যার কাহিনী চিত্রিত হয়েছে। আতিক ও প্রিয়া দুজন দুজনকে গভীরভাবে ভালোবাসে। সন্তান-সন্তুতি না থাকায় এ পরিবারে ফাটল দেখা দেয়। এ ফাটল প্রকৃত কোনো ভাঙন নয়; একান্তই বাহ্যিক। কাহিনীর শেষ দিকে এসে বোঝা যায় তাদের প্রেমের অতি গভীরতার জন্য এ কালো ছায়া দেখা দিয়েছিল। দীর্ঘ দ্বন্দ্বের পর যখন আতিক ও প্রিয়ার পরস্পরের ভুল বোঝাবুঝির সমস্যার সমাধান হয় তখন তাদের স্নিগ্ধ প্রেমের মহিমায় পাঠক হৃদয় আর্দ্র হয়ে ওঠে। এ কাহিনী ইংরেজি ছোটগল্প ‘জিম অ্যান্ড ডেলা’র কাহিনী স্মরণ করিয়ে দেয়। আতিক ও প্রিয়ার দাম্পত্য টানাপড়েনের মধ্যে মৃথিলার আবির্ভাব হলে কাহিনীতে ত্রিভুজ প্রেমের সৃষ্টি হয়। প্রিয়তমা: এ উপন্যাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইমতিয়াজ আহমেদের সঙ্গে তাঁর ছাত্রী ইরার প্রেম নিয়ে পল্লবিত হয়ে ওঠে কাহিনী। ইরার অপ্রতিরোধ্য একতরফা প্রেম শেষ পর্যন্ত ইমতিয়াজকে প্রভাবিত করে। ইমতিয়াজ শেষ পর্যন্ত ইরার প্রেমে সাড়া দেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী অনহিতার দুরবস্থা, কানাডার স্কলারশিপ ইমতিয়াজকে ভাবিয়ে তোলে। শেষে ইমতিয়াজ একরকম পাষাণের মতোই ইরাকে ফেলে চলে যায়। ইরা সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
‘রঙ্গশালার নায়িকা’ ও ‘একদিন জোছনাভরা রাতে’ দাম্পত্য কলহ এবং ‘বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় একা মেয়েটি’ ও ‘প্রিয়তমা’ উপন্যাসে অপূর্ণ প্রেমের কাহিনী পাঠকের মনে স্বাদের পূর্ণতা দেয়। কাহিনী বিন্যাসের ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক মোস্তফা কামাল হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনের মতো চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করতে পারেন।
উপস্থাপন কৌশল: মোস্তফা কামালের উপস্থাপন কৌশলে একটি নতুন ঢং সংযোজিত হয়েছে। বঙ্কিম-রীতিতে কাহিনী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঝরনার মতো বয়ে চলে, রবীন্দ্র-রীতিতে কাহিনী অলংকারপূর্ণ; কিন্তু কামালের রীতি অভিনব : তিনি মাঝখান থেকে কাহিনী শুরু করেন। উপন্যাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাহিনীর কিছুই বোঝা যায় না। নিরাভরণ, নিরলংকার স্রেফ সাদামাটা গল্প তৈরি করে কামাল পাঠকের হৃদয়ে ঢুকে পড়েন। কামাল কাহিনীকে উপন্যাসের ভেতরেই গড়ে তোলেন। অন্যদিকে বঙ্কিম একটি গঠিত কাহিনীকে বর্ণনা করে বোঝান। একটি উপমা দেওয়া যেতে পারে। যেমন – বঙ্কিম একটি সুরম্য অট্টালিকায় নিয়ে দর্শককে তা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখান। কামাল একটি সমতল ভূমিতে পিলার গাঁথেন, ধীরে ধীরে তাতে ইট, বালু, সিমেন্ট লাগান, ছাদ, দরজা-জানালা, কারুকাজ ও রঙের সমন্বয়ে শেষ পর্যন্ত দর্শক দেখতে পায় একট সুন্দর প্রাসাদ গড়ে উঠেছে। তা দেখে দর্শকচিত্ত প্রফুল্ল হয়। কামালের উপস্থাপনা সহজ-সরল। অত্যন্ত জটিল সমস্যাও সরল বলে মনে হয়। সিরিয়াস বর্ণনায়ও তিনি নির্লিপ্ত সরল ভঙ্গিটি ভোলেন না।
চরিত্র চিত্রণ: মোস্তফা কামালের উপন্যাস চরিত্রপ্রধান। কাহিনীও চিত্তাকর্ষক, তবে চরিত্রই কাহিনীজুড়ে বড় আকারে দৃশ্যমান। চরিত্রকে ঘিরে কাহিনী রূপ লাভ করেছে। তবে তিনি চরিত্রকে তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা দেননি। চরিত্র তার স্বমহিমায় বিকাশমান। রঙ্গশালার নায়িকার ‘সাদিয়া’ চরিত্রটি বাংলা উপন্যাস ধারার একটি বিপ্লবী চরিত্র। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাদিয়া যেন অগ্রদূত। সাদিয়ার জীবন পঙ্কিল হলেও সেখানে সতীত্বের একটি ধ্রুবতারা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। সে রঙ্গশালার নায়িকা হলেও কেবল এন্তাজ আলী ছাড়া আর কাউকে দেহ দান করেনি। অনেকেই তাকে পতিতা ভেবে কুপ্রস্তাব দেয়, সাদিয়া তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। স্বামী এন্তাজ আলী তাকে ফেলে চলে এলেও সে দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। একমাত্র ছেলের মুখ চেয়ে স্বামীর ধ্যানে গোটা জীবন পার করে দিল। তবু ভুল পথে পা বাড়াল না। কাদার মধ্যে বসবাস করেও তার গায়ে কাদা লাগেনি, জলে ডুবলেও তার পাখনায় জল বাঁধেনি। সাদিয়া বেগম দৃঢ়, সাহসী ও বুদ্ধিমতী মহিলা। নারীকে সে এখানে মহিমা দান করেছে। এন্তাজ মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী মনিজার সঙ্গে সাদিয়া বেগমের সতীনের মতো ঝগড়া লাগেনি। সে ধীরস্থিরে ব্যাপারটি লক্ষ করেছে এবং আবেগতাড়িত না হয়ে ধৈর্যের সঙ্গে সমস্যা মোকাবিলা করার কৃতিত্ব দেখিয়েছে। মনিজা এক নতুন বৈশিষ্ট্যের বাঙালি নারী। আবিদুর রহমানের চরিত্রটি একটি অদ্ভুত রকমের চরিত্র। সে সারা দিন মাথায় তেল চিকিৎসা, জল চিকিৎসা, যোগব্যায়াম ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। প্রথমত, তার এসব কাজ বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে তার যৌক্তিকতা মেলে। মূলত সে একজন খুনি, পিতৃঘাতী। পিতাকে হত্যা করে স্বামী, সন্তান, স্ত্রী ফেলে উধাও হয়ে যায় এবং এন্তাজ মিয়ার আশ্রয়ে পরগাছার মতো জীবনযাপন করে। অতীতের পাপ অনুশোচনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যোগব্যায়াম করে নিজেকে ভোলাতে চায়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। পাপ তাকে চারদিক থেকে গ্রাস করে এবং তার মৃত্যু হয়। পাপের পরিণতির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ আবিদুর রহমান। আবিদুর রহমানের হত্যাজনিত দুর্বলতা ছিল বলেই সাদিয়া বেগমকে তাড়ানোর জন্য পুলিশ ডাকতে রাজি হয়নি। এন্তাজ আলী মিয়া পুরো উপন্যাসে অনুপস্থিত অথচ তারই উপস্থিতি সর্বত্র। সবাই এন্তাজ মিয়ার জন্য অপেক্ষা করে। পাঠকচিত্তে এন্তাজ মিয়া গভীর প্রভাব ফেলে। মোস্তফা কামালের একটি বিশেষ কৃতিত্ব এন্তাজ মিয়া।
‘বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় একা মেয়েটি’ উপন্যাসে নায়িকা শাওন একটি প্রতিবাদী চরিত্র। তার স্বামী তাকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করাতে চাইলে সে স্বামীকে হত্যা করে। তার জীবনটা ধ্বংসের জন্য স্বামীকে সে দায়ী করে। নওরীন একটি বখাটে টাইপের মেয়ে। জাহিদের সঙ্গে তার বিবাহ চুক্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত সে ৬০ বছরের এক বৃদ্ধের প্রেমে পড়ে এবং তাকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। কামালের উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলো এমনি রহস্যময়ী ও পুরুষ চরিত্র থেকে উজ্জ্বল। ‘একদিন জোছনাভরা রাতে’ উপন্যাসে আতিক ও প্রিয়া দুজন ভালোবেসে বিয়ে করে। নিঃসন্তান এ দম্পতির জীবনে সন্তান-আকাক্সক্ষা প্রবল হয়। আতিক জানতে পারে প্রিয়ার জরায়ুতে সমস্যা থাকায় তার সন্তান জন্মদানের কোনো সম্ভাবনাই নেই। আতিক এ কথাটি প্রিয়াকে জানতে দেয়নি। এতে প্রিয়া কষ্ট পাবে। কিন্তু ব্যাপারটিকে সে পুরোপুরি মেনেও নিতে পারেনি। কেবল একাকী অন্তর্দহনে দগ্ধ হতে থাকে। তার এ মানসিক যাতনা প্রভাব ফেলে তার কাজে, চলাফেরায়, কথাবার্তায়। প্রিয়া তাকে ভুল বোঝে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের প্রেমিকা মৃথিলার সঙ্গেও দেখা হয়ে যায় একদিন। মৃথিলার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লেও প্রিয়ার প্রেমের বাঁধন থেকে সে নিজেকে ছিন্ন করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত প্রিয়ার কাছেই ফিরে যায়। এভাবে সে উপন্যাসে একজন মহৎ স্বামীতে পরিণত হয়। প্রিয়া নিরেট বাঙালি স্ত্রী; সে স্বামীকে সন্দেহ করে। তার সন্দেহের যৌক্তিকতা আছে কিন্তু আতিক কেন বদলে গেল তা সে ধরতে পারেনি। যখন ধরা পড়ল যে কেবল তার দোষেই তাদের সন্তান হচ্ছে না, তখন সে আতিকের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে গেল এবং আতিককে আরেকটি বিয়ে করানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ‘প্রিয়তমা’ উপন্যাসে এক আকর্ষণীয় চরিত্র ‘ইরা’। ইরা তার যৌবন-চাঞ্চল্য, হাস্য-পরিহাস, সর্বোপরি ভালোবাসা দিয়ে সুদর্শন যুবক ইমতিয়াজ আহমেদের হৃদয় জয় করে পুরোপুরি প্রিয়তমা রূপ ধারণ করে। ইরার হৃদয়-জয়ের কাহিনী লেখক অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে বর্ণনা করেছেন। ইমতিয়াজের হৃদয়জয় ইরার কাছে বিশ্বজয়ের চেয়েও আনন্দঘন। কিন্তু ইরা যখন বুঝতে পারল এ জয়ে ফাঁকি আছে, তখন সে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আÍহত্যা করে। আহমেদ ইমতিয়াজ সুদর্শন যুবক, মেধাবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি এ পর্যন্তই সমাপ্ত। হৃদয়ের বিকাশ তাঁর সংকীর্ণ, যদিও বুদ্ধির বিকাশ অসীম। স্ত্রী অনহিতা তাকে ছেড়ে চলে যায়, প্রিয়া ইরা তারই নির্বুদ্ধিতার জন্য আত্মহত্যা করে। বইপোকা এ জ্ঞানী মানবসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি চরিত্র। কেবল বই-ই তার নিয়তি, বউ সেখানে অনুপস্থিত।
কার্যকারণ: মোস্তফা কামালের উপন্যাসের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য কার্যকারণ সম্বন্ধ। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর চরিত্রের বিকাশ কার্যকারণ সম্বন্ধহীন বলে বোধ হয়। কিন্তু উপন্যাস পাঠ শেষে অজস্র যৌক্তিক কারণ এসে চরিত্রগুলোর কার্যকারণ সম্বন্ধ দাঁড় করিয়ে পাঠক হৃদয়ের ক্ষোভ দূরীভূত করে এবং পাঠক মুগ্ধ হয়ে যায় তাঁর কৌশল দেখে। প্রথমে আবিদুর রহমানের তেল, জল চিকিৎসার কোনো যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না। যোগব্যায়ামই বা সে কেন করে। পরে যখন প্রমাণিত হয় সে পিতৃঘাতী এবং সে অপরাধবোধকে দমন করতেই তার এত প্রচেষ্টা; তখন বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। প্রিয়ার প্রতি আতিকের অসংলগ্ন ব্যবহার এবং মৃথিলার প্রতি টান ক্ষুব্ধতার সৃষ্টি করে। পরে যখন জানা যায়, প্রিয়ার কষ্ট দূর করতেই আতিক এমন আচরণ করে, তখন ক্ষোভ ভালোবাসায় রূপ নেয়। মোস্তফা কামালের কার্যকারণ সম্বন্ধ একট অনিন্দ্যসুন্দর অলংকারে পরিণত হয়।
নাট্যগুণ: মোস্তফা কামালের উপন্যাস নাট্যগুণে ভরপুর। এ নাট্যগুণ পাঠককে চুম্বকের মতো ধরে রাখে। সাদিয়া বেগমের অভিযান, শাওনের আত্মহত্যার চেষ্টা, আতিক ও প্রিয়া সমস্যার গ্রন্থিমোচন, ইরার আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে অপূর্ব নাট্যগুণের সমাবেশ ঘটেছে কামালের উপন্যাসে।
এপিগ্রাম : মোস্তফা কামালের উপন্যাসে বুদ্ধিদীপ্ত কথাগুলো অলংকারের মতো পরিদৃশ্যমান। সময়ে সময়ে জীবন, দেশ, জাতি, নীতি প্রভৃতি সম্পর্কে চরিত্রগুলোর বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য পাঠকচিত্তকে নাড়া দিয়ে যায়।
সেটিং: আলোচ্য চারটি উপন্যাসের সেটিং প্রধানত মানব-হৃদয়। বাহ্যিক সেটিংয়ে কামাল বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। প্রিয়তমা উপন্যাসের ঘটনা-সংস্থান কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ও হোস্টেল। সেখানে ইরা ইমতিয়াজকে বিদ্ধ করতে পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। রঙ্গশালার নায়িকার সেটিং এন্তাজ মিয়ার বাড়ি। সেখানে দুই সতীনের মুখোমুখি সংঘর্ষে পাঠক উৎকণ্ঠিত।
মনস্তত্ত্ব: মোস্তফা কামালের উপন্যাসে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাই প্রধান। কাহিনীর মধ্যে অতিরিক্ত কল্পনা নেই, লোমহর্ষক ঘাত-প্রতিঘাত নেই; কিন্তু তার চেয়েও সাংঘাতিক হয়ে দেখা দেয় মানসিক জটিলতা। সাদিয়া, আবিদুর রহমান, আতিক, তমা, ইরা, ইমতিয়াজ সবাই মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের শিকার। আবিদুর রহমান খুনি; তার বর্তমান শত্রু সে নিজে। নিজের অস্থিরতা, অনুশোচনাকে ঢাকার জন্য তার চেষ্টার বিরাম নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে নিজের কাছে পরাজয় স্বীকার করে। ‘প্রিয়তমা’র ইরা জটিল মানসিক সমস্যায় পড়ে। সে বুক ভরে আশা বেঁধেছিল ইমতিয়াজের স্ত্রী হবে। কিন্তু তার আশাভঙ্গ হলে সে মানসিকভাবে আহত হয়। এবং তা-ই তার মৃত্যুর কারণ। আতিক ও প্রিয়ার কলহ মানসিক; বাইরের কেউ তা জানতে পারেনি। শাওনের মনে যে তীর দহন, তা তাকে আড়ষ্ট করে তুলেছে।
নৈতিকতা: মোস্তফা কামাল আধুনিক যুগের কথাশিল্পী হলেও নীতি-নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দেননি। তাঁর রঙ্গশালার নায়িকা সতীত্বের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পাপের ফলাফল অনিবার্য – এর প্রতিফলন ঘটেছে আবিদুর রহমানের চরিত্রে। আতিক ও প্রিয়ার পুনর্মিলনে নৈতিক জ্ঞানের পূর্ণ পরিচয় দিয়েছেন লেখক। ইরার পরিণতি তার উগ্র চলাফেরার প্রতিফল।
ঐতিহ্য: মোস্তফা কামাল প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এ জন্য তিনি রঙ্গশালার এক যাত্রা-অভিনেত্রীকে তাঁর নায়িকা করেছেন। আধুনিক ভাবধারাকেও তিনি গ্রহণ করেছেন সমভাবে। শিক্ষক ও ছাত্রীর প্রেমচিত্র অঙ্কন করেছেন নিখুঁতভাবে। শিক্ষক আর গুরুর আসনে নেই, বন্ধুর পর্যায়ে নেমে এসেছে।
আবহ: মোস্তফা কামাল পাঠককে তাঁর চরিত্রের মধ্যে সম্পূর্ণ মিশিয়ে দেন। চরিত্র, কাহিনী, কথাবার্তা, মানসিক জটিলতার মধ্যে পাঠক হারিয়ে যায়। তিনি জটিলতা সৃষ্টি করে কাহিনীর অগ্রগতির মধ্যে একটা মন্থরতা আনেন, আর তা পাঠকের কাছে অসহ্য হয়ে পড়ে। পাঠক অধীর আগ্রহে ছটফট করতে থাকে আসল কথাটি লেখক কখন বলবেন। ‘রঙ্গশালার নায়িকা’ উপন্যাসে এন্তাজ আলী মিয়াও আসে না, কাহিনীর পরিণতি কী হবে তা-ও জানা হয় না। এন্তাজ আলী মিয়া যখন আসে তখন বই প্রায় শেষ হয়ে যায়। পাঠক একটা আবহের মধ্যে পড়ে ঘুরপাক খেতে খেতে একসময় দেখে বই পড়া শেষ।
ভাষা: মোস্তফা কামালের ভাষা সহজ-সরল এবং স্রোতের মতো বহমান। উপন্যাসের ভাষা যেমন হওয়া উচিত তেমনি তাঁর ভাষা। দ্ব্যর্থহীন গল্পের ভাষা কামালের। প্রয়োজনমতো শুদ্ধ ভাষা, প্রয়োজনমতো আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন তিনি। কখনো চরিত্র অনুযায়ী ইংরেজি বাক্যও বসিয়েছেন চরিত্রের মুখে।
জীবন-দর্শন: কামাল জীবনকে বৈচিত্র্যময় করে দেখেছেন তাঁর উপন্যাসে। সব বিচিত্রতার মধ্যে একটি চিত্র বিশিষ্ট, তা হলো পাপের প্রায়শ্চিত্ত অনিবার্য, কর্মফল মানুষকে ভোগ করতেই হবে।
মন্দ কর্মফল: আবিদুর রহমান পিতৃঘাতী, পরিণাম মৃত্যু। ইরা উচ্ছৃঙ্খল, পরিণাম আত্মহত্যা। অনহিতা সন্দেহপ্রবণ, পরিণাম হাসপাতাল শয্যা। শাওন স্বামীঘাতী, পরিণাম জেল।
ভালো ফল: সাদিয়া ধৈর্যশীল, প্রাপ্তি স্বামী-সংসার। মৃথিলা পরিশ্রমী, প্রাপ্তি পিতামাতার স্নেহধন্য। ইমতিয়াজ পড়ুয়া, প্রাপ্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। আতিক হৃদয়বান, প্রাপ্তি স্ত্রীর ভালোবাসা। কামাল জীবনকে নানাভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছেন। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে সত্যের জয়, ধৈর্যের ফল, অপকর্মের কুফল তাঁর উপন্যাসে একটি স্নিগ্ধ ছায়া ফেলেছে।
আধুনিক বাংলা উপন্যাসে মোস্তফা কামালের অগ্রগতি ধাবমান স্রোতের মতো মার্গগামী। তাঁর চারটি উপন্যাসের আলোকে তাঁকে কিঞ্চিৎ মূল্যায়ন করার প্রয়াস পেয়েছি। সামগ্রিক কামালকে এর মধ্যে ধরা সম্ভব নয়। কারণ কামালের বৃত্ত স্থান পরিবর্তন করে। একই বৃত্তে কামাল আবর্তিত নন। কাহিনী, সংলাপ, ভাষা, চরিত্র সৃষ্টি, কার্যকারণ সম্বন্ধ, জীবন-দর্শন – সব কিছুতেই কামালের বুদ্ধিদীপ্ত পদচারণা। একেকটি উপন্যাস তাঁর অকৃত্রিম সৃষ্টি; নিখুঁত নির্ভেজাল বুনন জালের মতো সুবিন্যস্ত। পাঠকের অনুভাবনা সে জালে ধরা পড়ে। আশ্চর্য নির্মাণ-ক্ষমতা বলে মোস্তফা কামাল পাঠককে ধরে রাখেন তাঁর উপন্যাসে। মোস্তফা কামালের বর্তমান অগ্রগতি বাধা না খেলে তিনি কালজয়ী ঔপন্যাসিক হবেন তাতে সন্দেহ নেই।