সামন্তযুগের সঙ্গে সঙ্গে বীরত্বগাথা বা মহাকাব্যের যুগের অবসান ঘটলে, পুঁজিবাদী সমাজে সে জায়গা দখল করে নেয় উপন্যাস। শুরুতে উপন্যাস বুর্জোয়া সমাজের বিনোদনের জন্য শিল্পসাহিত্যের একটি বৃহৎ শাখা হিসেবে চর্চিত হতে থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর অবস্থার পরিবর্তন হয়। উপন্যাস হয়ে ওঠে সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা। আধুনিক যুগে উপন্যাস বলা যায়, সংশয় কিংবা দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে বসবাসকারী নির্দিষ্ট সময়ের ব্যাক্তি মানুষের সুক্ষ্ম আচরণ, অনুভূতি, অন্তর্জগত বা বহিঃজগর্তের চালচিত্র। যার মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে বৃহৎ সময়ের জনপদ বা জাতির জীবনের নৈতিক ও অনৈতিক অবকাঠামোর চলমান ইতিহাস। যার মধ্য দিয়ে অনায়াসেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে প্রথাগত ধর্ম, রাজনীতি বা সামাজিক অপধ্যান-ধারণা। কিন্তু এসব কিছুর পরও বলতে হয়, একজন সফল ঔপন্যাসিক হওয়ার প্রাথমিক শর্ত ভাষা ব্যবহারের কুশলতা, ভাষার গতীশীলতা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা, পরিবেশ ও সময়কে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সময়োপযোগী ভাষার যথাযথ শক্তিকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা। এক্ষেত্রে স্বকৃত নোমানের উপন্যাস রচনায় দক্ষতার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
স্বকৃত নোমানের ‘হীরকডানা’ উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট বাংলা, বিহার, ওড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খাঁর শাসন আমল থেকে শুরু করে ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ব্রিটিশদের হাতে সিরাজউদ্দৌলার পতন পরবর্তী মীর জাফর ও তার জামাতা মীর কাসিমের শাসনামলের সময়কাল পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে এক বাঙালি বীরের আবির্ভাব ঘটে, যিনি হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ পূর্ববাংলা ও ত্রিপুরার রাজা। যিনি ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। তার নাম শমসের গাজী। বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও আজকের ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রচলিত বহু কেচ্ছা-কাহিনি, গ্রামগঞ্জ মসজিদ-মন্দির, দীঘি-নালার নামকরণের সাথে শমসের গাজী ও তার সমকালীন ইতিহাসের বহু তথ্য ছড়িয়ে রয়েছে। আর এসব কেচ্ছা-কাহিনি ও তথ্যকেই উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে স্বকৃত নোমান তার ‘হীরকডানা’ উপন্যাসটি লেখেন। হীরকডানা উপন্যাসটিকে বলা যায় শমসের গাজীর ধারাবাহিক উত্থান, বীরত্বগাঁথা, ট্রাজিক পরিনতি ও লোকমুখে তার মিথ হয়ে ওঠার গল্প। কিন্তু স্বকৃত নোমান উপন্যাসের বিষয় হিসেবে ইতিহাসকে বেছে নিলেন কেন?
এর উত্তর তিনি ‘হীরকডানা’ উপন্যাসের শুরুতেই পাঠকদের জানিয়ে দেন, “বর্তমান যখন নিরাশ করে, নিদারুণ বিপণ্ণতার দিকে ঠেলে দেয়, তখন অতীতের আশ্রয় নিই। ইতিহাস হয়ে ওঠে আমার নিরাপদ দুর্গ।” তিনি আরও জানিয়ে দেন, “দক্ষিণ-পূর্ববাংলায় একদা অভ্যুদয় ঘটেছিল বীর শমসের গাজীর। ঔপনিবেশিক ইতিহাস তাঁকে দস্যু-তস্কর হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আমার পূর্বপুরুষের গৌরবকে কলঙ্কিত করার কী জঘন্য অপপ্রয়াস! এই বেদনাবোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে বহুদিন। ইতিহাসের যে ভার আমি বহন করেছি বছরের পর বছর, এই উপন্যাসের মাধ্যমে তা খানিকটা হালকা করার চেষ্টা করেছি।”
ঔপনিবেশিক বিকৃতি থেকে পূর্বপুরুষের ইতিহাস পুনরুদ্ধারে স্বকৃত নোমানের ‘হীরকডানা’ উপন্যাস হিসেবে কতটা সফলতা অর্জন করেছে তাই-ই এখন দেখার বিষয়। বাংলাসাহিত্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’। উপন্যাসটি বাঙলার রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এ উপন্যাসে বঙ্কিম ‘সুজলং-সুফলং-মলয়জঃ শীতলং-বন্দেমাতরম’ যে গানটি সংযোজন করেছিলেন তা বঙ্কিমের মৃত্যুর সত্তর বছর পরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দলীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বাঙলার সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা বঙ্কিমের আনন্দমঠকে তাঁদের প্রেরণা পুস্তক বলে মেনে নিয়েছিলেন। এরপরও বলতে হয় উপন্যাসটির ব্যর্থতা এখানেই, এটা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সত্যকে জোরপূর্বক এড়িয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদেরই একচোখা প্রকাশ ঘটিয়েছিল।
‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধে বিজয় অর্জন করার পর ইংরেজরা যখন তৎকালীন সুবে বাঙলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসে, তার অব্যবহিত পরবর্তী সময়। ওই সময়ে মুসলিম ফকির মজনু শাহ এবং হিন্দু সন্ন্যাসী ভবানী পাঠক দুজনে মিলেমিশে তাদের দলবল নিয়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ব্রিটিশ সৈন্যের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়। বঙ্কিমচন্দ্র তার উপন্যাসে হিন্দু-মুসলমানের যৌথসংগ্রাম থেকে মুসলমানদের বাদ দিয়ে হিন্দুসন্ন্যাসীদের বিদ্রোহের একমাত্র নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করলেন। আহমদ ছফার ভাষায়, ‘এটা ছিল বঙ্কিমের সজ্ঞানকৃত একটি অপরাধ।’
এই একই সময়কে নিয়ে পরবর্তীকালে আখতারুজ্জামন ইলিয়াস লিখেছেন ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাস। ফকির মজনু শাহ এবং সন্ন্যাসী ভবানী পাঠকের সম্মিলিত সংগ্রামের কাহিনি বয়ানের মাধ্যমে ইলিয়াস তার উপন্যাসের উন্মোচন প্রক্রিয়াটি সূচনা করেছিলেন। আধুনিক বিশ্লেষণে উপন্যাস একটি সোশ্যাল ডিসকোর্স। যে সমাজে মানুষ বাস করে সে সমাজে মানুষ যে পরস্পরের সঙ্গে চিকন-মোটা নানারকম সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ, সেই সম্পর্কগুলোর যথার্থ স্বরূপ নিরূপ করাই হলো উপন্যাস লেখকের আসল কাজ।
এক্ষেত্রে কেউ সোশ্যাল ডিসকোর্সটিকে খুন করে উপন্যাস লেখেন। কেউ সোশ্যাল ডিসকোর্সটিকে প্রাণবান এবং গতিশীল করে তোলার জন্য উপন্যাস রচনা করেন। বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে মনগড়া মিথ্যা ডিসকোর্সেও ওপর দাঁড়িয়ে তার বয়ান এবং বিশ্লেষণ করেছেন। অপরদিকে ইলিয়াস বঙ্কিমের ডিসকোর্সটি ভেঙে চুরমার করে নির্মাণ করে সম্পূর্ণ নতুন একটি ডিসকোর্স, যেখানে বাঙলার হিন্দু-মুসলমান যৌথভাবে ইতিহাসের অংশ দাবী করে এবং ইতিহাসের অগ্রযাত্রায় এক অন্যের শরিক হয়ে ওঠে।
ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মাত্র কয়েক বছর আগেই ত্রিপুরায় শমসের গাজীর সঙ্গে তৎকালীন নবাব মীর কাসিম, বিতাড়িত ত্রিপুরার মহারাজ ও ইংরেজ সৈন্যদের যুদ্ধ হয়। হীরকডানা উপন্যাসের শেষের দিকে সেই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ স্বকৃত নোমানের উপন্যাসের টাইম স্পেস বঙ্কিমচন্দ্র এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামার বিষয়গত সময়ের কাছাকাছি।
২.
‘হীরকডানা’ উপন্যাসে শুরুতেই দেখা যায় বর্গী-তাণ্ডবে অতিষ্ঠ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বর্গী প্রতিহত করে মানুষের আস্থার স্থানে অধিষ্ঠিত হন শমসের গাজী। আর এই আশ্রয় স্থান লাভের ক্ষেত্রে শমসের গাজী ও তার বন্ধু সাদুল্লাহ মিলে বর্গীদের বিরুদ্ধে যে বীরত্ব প্রদর্শন করেন তাতে লোকমুখে প্রচারিত হয় শমসের গাজীর পক্ষে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল একদল জি¦ন, যারা শমসের গাজীর অনুগত। এই লোকপ্রচারের ফলে তার উপর সাধারণ গ্রামবাসীর ভরসা বেড়ে যায় আরও বহুগুণ। জনপ্রিয়তায় নিয়োগ পান পানুয়া গড়ের অধ্যক্ষ পদে। পরে এই অধ্যক্ষ থেকে কঙ্গুরার তালুকদার, দক্ষিণশিকের জমিদার, তারপর ত্রিপুরা রাজ্যের রাজাধিরাজ পদে অভিশিক্ত হন শমসের গাজী। এছাড়া একসময় নবাব আলীবর্দী খাঁর কাছ থেকে নায়েবে নওয়াব খেতাবেও ভূষিত হন।
উপন্যাসে স্বকৃত নোমানের কাহিনি বয়নের ভঙ্গি ও উপন্যাসের বর্ণিত সময়ানুযায়ী যথাযথ পরিবেশ বর্ণনা, ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা আর ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করতে যথাযথ কল্পনাশক্তির ব্যবহার সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। খুবই সাবলিলভাবে এক অধ্যায় থেকে আরেক অধ্যায়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়, চলচ্চিত্র দেখার মতো আমোদ আর উত্তেজনার মধ্য দিয়ে শমসের গাজীর প্রেম, বিরহ, যুদ্ধ আর রাজ্যশাসনের বিচিত্র কর্মকা-ের পাশাপাশি স্বাধীনতা বিষর্জন ও রাজ্যহারা হওয়ার ট্রাজিক পরিণতি মনশ্চক্ষে দেখতে পাওয়া সম্ভব হয়। স্বকৃতের যুদ্ধ বর্ণনার দক্ষতা তুমুলভাবে রণপরিবেশের মধ্যে নিয়ে যায়। যেমন যুদ্ধ বিবরণের একটি লাইন হচ্ছে এরকমম, “ডানে বাঁয়ে শত্রু হনন করতে করতে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে চলে শমসের। কখনো বুকে, কখনো পিঠে, কখনো শত্রুর পেটে তীব্রবেগে ঢুকিয়ে দেয় তরবারি।”
সারা উপন্যাসজুড়েই মুগ্ধ হয়ে লক্ষ করতে হয় বাঁশি বাজানোতে দক্ষ, অস্ত্রচালনা ও কুস্তিতে পারদর্শী, শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি ও জ্ঞানবিজ্ঞান সচেতন, সর্বগুণে গুণান্বিত, আদর্শবাদী এক নায়োকোচিত বৈশিষ্টের অধিকারী শমসের গাজীর উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কিভাবে মনের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধকে নাড়া দেয়।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শমসের গাজী ছাড়াও জগন্নাথ সেন, দক্ষিণশিকের জমিদার নসিরমন চৌধুরী, তাঁর কন্যা দরিয়া বিবি, শমসেরের বাল্যবন্ধু সাদুল্লাহ (সাদু), পুঁথি লেখক শেখ মনোহর, সৈয়দ গদাপীর, ত্রিপুরার উজির জয়দেব ইত্যাদি ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো প্রাণ পায় স্বকৃত নোমানের চরিত্র-নির্মাণ দক্ষতায়।
কিন্তু সমস্ত চরিত্র ছাপিয়ে শমসের গাজী এতটা নায়োকোচিত কেন বা কেন অতি মানবীয়? উপন্যাস থেকে নায়ক বা সর্ব গুণে গুণান্বিত নায়োকিচিত ব্যাপার বিতাড়িত করা হয়েছে অনেক আগেই। বলা যায় কাহিনি বর্ণনায় এর বিলুপ্তি ঘটেছে সেই সামন্তযুগীয় মহাকাব্যিক চিন্তাধারার অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই। আজকের দিনে এসে তবে এ বীরত্বগাঁথা ফাঁদা কেন? শমসের গাজী কি কোনো অলীক মানুষ ছিলেন? ঐতিহাসিক চরিত্র বলেই কি শমসের গাজীকে এভাবে উপস্থাপন? আধুনিক উপন্যাস তো দ্বিধাদ্বন্দে পরিপূর্ণ রক্তমাংসের সাধারণ মানুষকে দেখাতে চায়। আসলে এ উপন্যাসে খুব সাধারণ অবস্থা থেকে রাজপুরুষে পরিণত হওয়া যে শমসের গাজীর কথা বলা হয়েছে, তা সবই ইতিহাস, পুঁথিসাহিত্য ও লোকমুখে প্রচলিত কেচ্ছা-কাহিনি থেকে উপকরণ নিয়ে লেখা। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, লোকমুখে যে শমসের গাজীর পরিচয় ‘বাংলার বাঘ’ বা ভাটির বাঘ হিসেবে, প্রজাদরদী শাসক হিসেবে, ইংরেজদের কাছে ৩০০ বছর আগে সেই শমসের গাজীই পরিচিত ছিলেন ডাকাত সর্দার হিসেবে। কিন্তু এক দশকের বেশি সময় দক্ষিণ বাংলা ও ত্রিপুরার রাজা হিসেবে সফলভাবে রাজ্য শাসনের পরও শমসের গাজী কেন এমন এক নেতিবাচক পরিচয়ে পরিচিতি পেলেন তা উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে স্পষ্টভাবেই। ইংরেজদের কাছে শমসের গাজী ডাকাত হিসেবে শুরুতে পরিচিত ছিলেন না, রাজা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। এমনকি শমসের গাজীকে ইংরেজরা নিয়মিত করও প্রদান করত। কিন্তু যখন পলাশীর প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটল তখনই ইংরেজরা তাদের ঔপনিবেশিক কুটচালের নিয়মে শমসের গাজীকে ইচ্ছাকৃতভাবেই ডাকাত হিসেবে পরিচিত করাতে শুরু করে। কেননা শমসের গাজীর বীরত্ব আর জনপ্রিয়তা ঔপনিবেশক শাসক ইংরেজদের কাছে ছিল বিষফোঁড়ার মতো।
ইতিহাসে এমন অসংখ্য নজির রয়েছে, শোষিত বা নিপীড়িত মানুষের কাছে যাকে বিপ্লবী মনে হতো, জনপ্রিয় মনে হত – ঔপনিবেশিক শাসকসমাজ তাকে সন্ত্রাসী, ডাকাত বা লুটেরা হিসেবে আখ্যা দিত। আজকের বিশ্বেও এমন উদাহরণ বিরল নয়। যে চে গুয়েভারা আমাদের কাছে বিপ্লবী, সেই চে গুয়েভারা আমেরিকানদের কাছে আজও সন্ত্রাসী হিসেবেই পরিচিত। আবার ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন বা প্রীতিলতা আমাদের কাছে ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী শহীদের মর্যাদা লাভ করলেও ব্রিটিশদের কাছে আজও তারা নৈরাজ্যবাদী পরিচয়েই পরিচিত। আসলে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার একটি প্রক্রিয়া, যখন কেউ ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতা করে জনগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে তখন ঔপনিবেশিকদের প্রাথমিক কর্ম থাকে ওই বিরোধী ব্যাক্তিটির বা সম্প্রদায়ের চরিত্র হনন, এর বিরুদ্ধে নানান অপপ্রচার। আর এই অপপ্রচারের মাধ্যমে জনমনে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করে তারা আক্রমণ পরিচালনা করে। এ প্রবণতারই পরিবর্তিত রূপ আজকের বিশ্বের তথ্য সন্ত্রাস বা মিডিয়া সন্ত্রাস। সে হিসেবে বলা যায় শমসের গাজীর মতো একজন ঐতিহাসিক রাজ-চরিত্রকে ৩০০ বছর পর নতুনভাবে উপন্যাসের ভেতর দিয়ে জনসম্মুখে উপস্থাপন বীরত্বব্যঞ্জক বা নায়োকোচিত হবে এটাই স্বাভাবিক। আর এজন্য বড় ধরনের ধন্যবাদ প্রাপ্য স্বকৃত নোমান।
এরপরও খটকার সৃষ্টি হয় যখন বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক চরিত্রকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নানা আদর্শ ও নীতি নৈতিকতার লেবেল চরিত্রটির মধ্যে আরোপ করা হয়। উপন্যাসটিকে তখন খুব সরলরৈখিক আর আদর্শবাদী মনে হয়। আর এখানেই ব্যক্তিবন্দনাহীন আধুনিক ঐতিহাসিক উপন্যাসের সঙ্গে প্রচলিত বীরত্বগাঁথার পার্থক্য। স্বকৃত নোমানের হীরকডানার শমসের গাজীকেও এই সরলরৈখিক প্রবণতাজনিত ত্রুটি থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না। যার ফলে শমসের গাজীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে বীরত্ব, সাহসিকতা, শিল্পমানস, আধুনিকমনা, জ্ঞানপিপাসু, ধর্মভিরুতা, সৎচরিত্র, মাতৃভক্তি, মানবিক, দক্ষ রাজনীতিবিদ, দেশপ্রেমিক, প্রজাবৎসল ইত্যাদি সমস্ত মহৎ দিকসমূহ একাডেমিক ও প্রথাগত ভঙ্গিতে বীর বন্দনার মতো দ্বিধাহীণভাবে বর্ণনা করতে দেখা যায়।
এছাড়া উপন্যাসের অনেক জায়গায়ই শমসের গাজীর উত্থান প্রক্রিয়াকে মনে হয় তিনি যতটা না রজনৈতিক, তারচেয়েও অনেক বেশি নিয়তিতাড়িত। এমনকি তিনি যখন জমিদার নসিরমন চৌধুরীর কন্যা দরিয়াবিবির সঙ্গে প্রেমের কারণে জমিদারের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে বাধ্য হন, তখন শমসের গাজীর সঙ্গে সৈয়দ গদাপীরের বিভিন্ন মুহূর্তকে মনে হয় অনেক বেশি স্বাপ্নিক, সিনেমাটিক আর নিয়তি নির্ধারিত ঘটনার মতো। মনে হয় ক্ষমতার প্রতি কোনো মোহ ছিল না শমসের গাজীর। কিন্তু তার ভাগ্যই তাকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে আর তিনি হয়ে উঠেছেন অপ্রত্যাশিত বিজয়ী। এক্ষেত্রে শুরুতে বিভিন্ন সংকট মোকাবেলায় ও যুদ্ধজয়ে বড় ধরনের অনুপ্রেরণাদাতার ভূমিকা নিতেই যেন গদা পীর মুখোমুখি হন শমসের গাজীর। শমসের গাজীর চরিত্র নির্মাণে স্বকৃত নোমানের এই সরলরৈখিক প্রবণতা ও প্রথমদিকে চরিত্রটিকে কখনও কখনও নিয়তি নির্ভর বা সৌভাগ্যের বরপুত্র করে ফেলাকে বলা যায় আধুনিক মননের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এরপরও বলতে হয়, বাঙালির ইতিহাস স্বাক্ষী শমসের গাজীর বীরত্ব ও দূরদর্শীতা ছিল সংশয়হীন। প্রয়োজনে শমসের গাজীও তার হাতকে রক্তে রঞ্জিত করতে দ্বিধা করেননি, তা উপন্যাসে স্বকৃত নোমান কিছু সংলাপের ভেতর দিয়ে জানিয়ে দেন। এবং সংলাপের মধ্য দিয়েই স্বকৃত আধুনিক মননের সঙ্গে সাংঘর্ষিক পরিনতিকে অনেকখানিই প্রতিহত করেন। এক্ষেত্রে সংলাপ নির্মাণ ও সংলাপ প্রদানের জন্য উপযুক্ত সময়, পরিবেশ ও পাত্র-পাত্রী নির্ধারণে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন স্বকৃত। সংলাপের ভেতর দিয়ে চিরায়ত কিছু রাজনৈতিক সত্যকে সাহিত্যিকভাবে তুলে ধরেন। যেমন – জমিদার শমসের উজির জয়দেবকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,
‘কে খুনি নয়? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনি খুনি নন? যুগে যুগে ত্রিপুরার রাজারা কি মানুষের রক্তে হাত রাঙাননি? সিংহাসন অধিকার করতে ত্রিপুরেশ্বর বিজয় মাণিক্য কি কম খুন করেছেন? গিলিয়ার প্রান্তরে মানুষের খুনে কি রঞ্জিত হয়নি নবাব আলীবর্দী খাঁর খঞ্জর? কুরুক্ষেত্রে অর্জুন কি হাজার হাজার মানুষ খুন করেননি? রাবণকে কি খুন করেননি রাম? (পৃ. ১২৯)।’
কিংবা,
‘খুনে খুনে ফরাক আছে মশাই। হার্মাদদের খুন আর মহামতি অর্জুুনের খুনের মধ্যে বিস্তর ফরাক। চৌধুরিকে আমার লোকেরা খুন না করলেও আগে-পরে তিনি কোনো না কোনোভাবে খুন হতেন। কারণ খুনির স্বাভাবিক মৃত্যু খুব কমই হয়। রাজা যখন প্রজাবান্ধব না হয়ে প্রজার সঙ্গে দুশমনি শুরু করে, রাজ্যে যখন অন্যায় অবিচার শুরু হয়, তখন খুন হওয়া তার অনিবার্য হয়ে ওঠে। আমার চুরি-ডাকাতি সম্পর্কে আপনি বিস্তর খোঁজ খবর নিয়েছেন, কিন্তু চৌধুরীর জোরজুলুম সম্পর্কে তিল পরিমাণ খোঁজ নেননি। নেয়ার দরকার মনে করেননি। কারণ তিনি ছিলেন মহারাজের সনদপ্রাপ্ত খুনি। (পৃ.১২৯-১৩০)।’
এই সংলাপগুলিই শমসের গাজীর ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আর রাজনৈতিক দূরদর্শীতাকে স্বচ্ছ করে তোলে। তবে উপন্যাসে সংলাপ নির্মাণে স্বকৃত দক্ষতার পরিচয় দিলেও দু’এক জায়গায় সংলাপ ঐতিহাসিক প্রেক্ষপটের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি। যেমন – ত্রিপুরার রাজত্ব দখলের পর বনমালীর ঠাকুরের উদ্দেশ্যে বলা শমসের গাজীর সংলাপ –
: মহারাজ, জাতিগতভাবে আপনি মুসলমান। আজ হোক কাল হোক, আপনার রাজ্যে তো মুসলমানি রেওয়াজই চালু হবে।
: আপনি ভুল করছেন মশাই, জাতিগতভাবে আমি মুসলমান নই।
: কী বলছেন মহারাজ! আপনাকে তো আমি একজন মুসলমান হিসেবে দেখছি।
: ভুল দেখছেন মশাই। আমার চৌদ্দ পুরুষ বাঙালি, বাঙালির ঔরসে আমার জন্ম, আমার শরীরে বাঙালির রক্ত বইছে। হ্যাঁ, সম্প্রদায়গতভাবে আপনি আমাকে মুসলমান বলতে পারেন। (পৃ. ১৭৩)
এখানে উপন্যাসে নির্বাচিত ঐতিহাসিক সময়কে এড়িয়ে আজকের বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপলব্ধির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংলাপ বিনিময় করা হয়েছে। ওই সময়ে ধর্মকে অতিক্রম করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার অনুভূতিটা আদৌ জাগ্রত ছিল কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাই যখন সংলাপে শমসের গাজীকে বাঙালি হিসেবে গর্ব করতে দেখা যায়, তখন বিষয়টাকে স্বাভাবিক মনে হয় না, আরোপতি মনে হয়। তবে এরকম কদাচিৎ ক্রটিকে বাদ দিলে দরিয়াগাথা, বিজয়গাথা ও বিষাদগাথা শিরোনামে তিনটি পর্বে বিভক্ত হীরকডানা উপন্যাসে মুগ্ধ হওয়ার মত, পুলকিত হওয়ার মত অসংখ্য জায়গা রয়েছে যা পাঠককে কিছু সময়ের জন্য হলেও ঘোরগ্রস্ত করার ক্ষমতা রাখে।
৩.
ঔপনিবেশিক ইতিহাসের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে একজন বাঙালি বীরকে যথাযথ মর্যাদা দানে স্বকৃত নোমানের ‘হীরকডানা’ উপন্যাস ৩০০ বছর আগের ইতিহাসকে ধারণ করতে সমর্থ হয়েছে বলা যায়। এ উপন্যাসের ভেতর দিয়ে যে শমসের গাজীর দেখা পাওয়া যায় তিনি আসলে আজকের ইতিহাস সচেতন বাঙালির জীবনেও প্রাসঙ্গিক। তাই একজন বাঙালি হিসেবে ‘হীরকডানা’ উপন্যাসে শমসের গাজীর মত প্রজাদরদী বাঙালি বীরের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ের বর্ণনায় আবেগাপ্লুত না হয়ে উপায় থাকে না। মনের অজান্তে বলতে ইচ্ছে হয় উপন্যাসে বর্ণিত শেখ মনোহরের পুঁথির লাইন –
এখানে আসিয়া কবি শেখ মনোহর ভনে
শমসের গাজী ভাটির বাঘ জানুক জনে।
আলোচক : কবি