‘জননী’ কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামালের নতুন উপন্যাস। মধ্যবিত্ত এক মমতাময়ী মা’র জীবনালেখ্য এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে মাতৃ ইমেজ উপস্থাপনার ইতিহাস অনেক পুরানো। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র যুগের উপন্যাসে মাতৃ ইমেজ ছিল ভারতীয় নারীর শুদ্ধ ও পবিত্র রূপ। পরবর্তীতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জননী’ উপন্যাসে তারই সম্প্রসারিত চিত্র দেখা যায়। তবে শওকত ওসমানের ‘জননী’ উপন্যাসে দরিয়াবিবির মা হিসেবে অস্তিত্ব-সংগ্রাম ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপিত হয়েছে। আনিসুল হকের ‘মা’ কিংবা সেলিনা হোসেনের ‘হাঙড় নদী গ্রেনেডে’র মাতৃ ইমেজ মুক্তিযুদ্ধে মহিয়সী নারীর অবদানের আখ্যান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে পার্ল এস বাক এবং ম্যাক্সিম গোর্কি এই উভয় ঔপন্যাসিকের একইনামের ‘মাদার’ উপন্যাস দুটি বিশ্ব সাহিত্যের অনন্য রচনা; যেখানে নিম্নবর্গের মা’র বেঁচে থাকার লড়াই, সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহ, সন্তানের রাজনৈতিক সংগ্রামে নিজেকে জড়িত করার অসাধারণ কাহিনী উপস্থাপিত হয়েছে। মার্কিন লেখক পার্ল এস বাকের আখ্যানের চৈনিক মাতা আর গোর্কির উপন্যাসের রাশিয়ান মা খানিকটা একইরকম মাতৃ ইমেজকে ধারণ করে পাঠককে আলোড়িত করে। আসলে মা’কে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে যত উপন্যাস রচিত হয়েছে তার সবগুলোতেই জননী হিসেবে নারীর একই ধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চরিত্রকে আত্মপ্রকাশ করতে দেখা যায়। মমতাময়ী, ধৈর্যশীল, সন্তানকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আগলে রাখার অদম্য প্রয়াস, নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে স্বামী-সংসার-সন্তানকে বড় করে দেখা; উপরন্তু সন্তানরা বড় হয়ে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হলে জননীর নিঃসঙ্গতা- এই প্রচলিত ছকে মাতৃ ইমেজ যুগে যুগে অনুসরণ করা হয়েছে। তবে পরিপ্রেক্ষিত ও দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হওয়ায় ঔপন্যাসিকরা স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছেন কাহিনী ও চরিত্র রূপায়ণে।
মোস্তফা কামালের ‘জননী’ এদিক থেকে ভিন্ন মাত্রায় মাতৃ ইমেজকে ধারণ করে স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছে। সানজিদা বেগম উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী এবং ইকবাল, ইমরান, আসিফ ও ফাতেমার জননী আর ইরিনা, ইশিতা, ইফতি’র দিদু; সকিনা, রোকেয়া আর মেনকার শাশুড়ি। সানজিদা বেগম স্বামী-সন্তান নিয়ে গ্রামীণ জীবনের সংসার শুরু করেছিলেন। কিন্তু স্বামী মোহাম্মদ আলীর সংসারের প্রতি বীতরাগ, দায়িত্ব পালনে অনীহা এবং পীরের দরবারে আশ্রয় গ্রহণ এই জননীকে মানসিক যন্ত্রণা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। স্বামী স্পষ্ট করে তাঁর সংসার পরিচালনায় অপারগতা প্রকাশ করার পর সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার লড়ায়ে অবতীর্ণ হন তিনি। অধ্যয়নরত বড় ছেলে ইকবালের মা’কে না জানিয়ে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে উপন্যাসে সন্তানদের মাতৃ-বৃত্তের বাইরে যাওয়ার সূচনা হয়। মাতৃ আজ্ঞা লঙ্ঘন, মা’কে উপেক্ষা করে স্ত্রীর প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া, একটি পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আসার আগেই পুত্রবধূর কারণে বিবাদের জন্ম হওয়া এবং ছোট ভাইবোনদের প্রতি দায়িত্ব পালনে বড় ভাইয়ের অবহেলা সবই পর্যায়ক্রমে উপন্যাসের কাহিনীতে উন্মোচিত হয়েছে। কেবল সানজিদা বেগমের সংসার এবং সন্তানের কাহিনী নয় তিন প্রজন্মের বেড়ে ওঠা সময়ের ছবি রয়েছে মোস্তফা কামালের এই আখ্যানে। ঔপন্যাসিক জননীর সংগ্রাম ও স্নেহময় চরিত্রের পাশে তুলে ধরেছেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে চাল ও লবণের সংকট ছয় সদস্যের এই পরিবারটির ওপর যে অভিঘাত ফেলেছিল তাও বর্ণিত হয়েছে। বিপদের সময় নিকট আত্মীয়দের দ্বারা প্রতারিত হওয়া এবং সেই কষ্ট জয় করে এগিয়ে যাওয়ার মনোবল চিত্রিত হয়েছে জননীর চরিত্রে।
উপন্যাসের কাহিনীতে ঘুরে ফিরে নিয়তি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মা’কে অবহেলা, অবজ্ঞা করার পরিণতি সঙ্গে সঙ্গেই টের পেয়েছে সন্তানরা, তাদের বধূসহ। ইকবালের চাকরির সূত্রে ঢাকা শহরে বসবাস এবং তার বিবাহের পর পুত্রবধূর সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে সানজিদা বেগমের স্বতন্ত্র এক রুমের একটি বাসা ভাড়া করে বসতি স্থাপন, সন্তানদের লেখাপড়া ও একটি যৌথ পরিবারের টিকে থাকার সংগ্রামে জয়ী হওয়ার ঘটনা সেই নিয়তির খেলাকে ত্বরান্বিত করেছে। ইকবাল তার স্ত্রীর কারণে মা’কে হেয় করেছিল। পরে চাকরি হারিয়ে এবং মধ্যপ্রাচ্যে চাকরির আশা নিয়ে সেখানে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে পুনরায় মা’র কোলেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ইমরান শহুরে স্ত্রীর পাল্লায় পড়ে মা’কে অস্বীকার করার সাহস দেখাতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত আলাদা বাসা নিয়ে বসতি শুরু করলেও পুনরায় মা’র কাছে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। ছোট ছেলে আসিফ ও মেয়ে ফাতেমা মা-কেন্দ্রিক কিন্তু আসিফের বিবাহের পর বাস্তবতা তাদের বাসা পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। তবে মায়ের বৃত্তের বাইরে কেউ-ই বের হতে পারেনি। ইমরানের স্ত্রী রোকেয়া তার ননদ ফাতেমার বিরুদ্ধে অনেক অপপ্রচার চালিয়েও শেষ পর্যন্ত সানজিদা বেগমের পরিবারের সঙ্গে তার স্বামীর বিচ্ছিন্নতা তৈরি করতে পারেনি। জননীর ব্যক্তিত্ব আর ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে জয়ী সানজিদা বেগমের কাহিনী প্রকৃতঅর্থেই অন্যান্য উপন্যাসের মা চরিত্র থেকে ভিন্ন। সন্তানরা বড় হয়ে সংসার করে সন্তানের বাবা হয়েও এই মা’কে নিয়েই দের সুখ-দুঃখের জীবনকে সাজিয়ে নিয়েছে। সেখানে মাতৃহারা নাতিনী ইরিনা স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় চলে যাচ্ছে বলে সানজিদা বেগমের যে বেদনা তার সঙ্গে ইকবাল-ইমরান-আসিফ একাত্ম। আর এভাবেই মায়ের চরণতলে আশ্রিত সংসারের পোড় খাওয়া মানুষগুলো। উপন্যাসে বিধৃত জননীর আত্মত্যাগ আর সেই অশ্রুপ্লুত দৃশ্যগুলো একটানা পড়ে শেষ করা সহজ কিন্তু বেদনার গভীরতা প্রত্যেককে স্পর্শ করতে বাধ্য। উল্লেখ্য, মোস্তফা কামাল গত দু’দশক ধরে সাহিত্য চর্চায় নিবেদিত। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা সত্তরের বেশি। এর মধ্যে সহজ-সরল-সাবলীল ভাষায় রচিত ‘জননী’ উপন্যাসটি পাঠকপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছে বলে আমরা মনে করি।