শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য আর আপন জাতিত্বের অস্তিত্বের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকলে আগুন পাখির মতো উপন্যাস লেখা তো দূরের কথা, পড়াও যায় না। এমন কি পড়া আরম্ভ করলেও শেষ করা যায় না, যদি জীবনের ভেতরের জীবনে, ইতিহাসের ভেতরের ইতিহাসে, অন্তরের ভেতরের অন্তরে ডুব দেওয়ার কোনো পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকে। আগুনপাখি কেবল প্রথাগত চরিত্র নির্মাণ ও সংলাপ ধারণার বাইরের কোনো উপন্যাস নয় বলেই বলছি না, এর কাহিনীতে সেই অর্থে কোনো গল্প ফাঁদা নেই, বলবার মতো কোনো প্রণয় নেই, আকৃষ্ট করবার মতো ন্যূনতম কোনো যৌনতা নেই; এমন কি যে ভাষায় কাহিনীটি কথিত হয়েছে, সেই ভাষাটির সাথেও এদেশের অধিকাংশ পাঠকের বিশেষ কোনো যোগাযোগ নেই।
রাঢ়বঙ্গের রূপকার বলে পরিচিত হাসান আজিজুল হক দীর্ঘ প্রস্তুতি শেষে গল্পকার জীবনের শীর্ষখ্যাতিতে পৌঁছে উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছেন। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস আগুনপাখি আমাদের ইতিহাসেরই রক্তক্ষরণের এক শিল্পিত দলিল। প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে শুরু হয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, বিলিতি পণ্য বর্জন, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, সাতচল্লিশের দেশ বিভাগ এবং দু-দুটো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে উপদ্রুত পল্লীবাংলার একটি সাধারণ মুসলিম পরিবারের আরও সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষাহীন নারীর আঞ্চলিক বয়ানে বিশিষ্ট হয়ে ওঠা এক প্রতি ইতিহাস।
বর্তমান পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক সাধাসিধে গৃহবধূ তার বাল্য থেকে বৃদ্ধাপ্রায় জীবনের ছোট-বড় ঘটনাগুলো নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায় নিতান্ত সরল ভাবনাতেই বর্ণনা করেছেন্ অবশ্য ভাবনা তার শেষ পর্যন্ত সরল থাকে নি, কেননা, জীবন আর জীবনের ঘটনাপ্রবাহগুলো সরল থেকে জটিল এবং জটিল থেকে জটিলতর রূপ নিয়েই তবে শেষ হযেছে। ত্রিকালদর্শী লেখক হাসান আজিজুল হক একেবারে ব্যক্তিগত যাপিত জীবনের থেকে বাস্তব রস সংগ্রহ করে একজন নারীর বয়ানেই তা প্রকাশ করেছেন। এই নারীটি এবং নারীটির চারপাশের মানুষ ও মানুষের জীবন যে লেখকের নিজের জীবন ও পরিবারের খুব কাছের তা উক্ত কাহিনী এবং লেখকের জীবনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
কাহিনীটি বর্ধমান জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সম্ভ্রান্ত একটি মুসলিম পরিবার ও পরিবারের আশে-পাশের হিন্দু-মুসলমানদের জীবন থেকে নেওয়া । কথক, তথা কেন্দ্রীয় চরিত্রটিতে যে নারীটি উপস্থিত, তিনি একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে, বিরাট একান্নবর্তী পরিবারের গৃহবধূ। তাঁর স্বামীরা পাঁচ ভাই, তাদের বউ-ছেলে-মেয়ে এবং একটি বাল্যবিধবা বোন। বোনটি আবার বাড়ির গিন্নিও বটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং দেশভাগ শেষে পুনরায় সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ, অতঃপর এক বাংলা থেকে অপর বাংলায় গমনাগমনের মধ্য দিয়ে কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটেছে। উদ্দিষ্ট নারীটি যে লেখকের খুব কাছের এমনকি মা কিংবা মাতৃস্থানীয় কেউ, তা বোধ করি অনুমান করাই যায়। কেননা, হাসান আজিজুল হকের জন্মস্থানও বর্তমান পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার জবগ্রামে। তাঁর বাবারা ছিলেন পঞ্চভ্রাতা। বউ-বাচ্চাসহ বিরাট যৌথ পরিবার। ছিলেন এক বাল্যবিধবা বোনও; যিনি কিনা আগুনপাখির কাহিনীর মতোই পরিবারের গিন্নি ছিলেন। তার কথাতেই সবকিছু হতো। এবং লেখকের পিতাই ছিলেন পরিবারের কর্তা, যা কাহিনীতেও প্রত্যক্ষ। এই কর্তা তাঁর পিতার মৃত্যুর পর নুয়ে পড়া সংসারটিকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন, যতটুকু গড়ে তোলা যায়। প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ছিলেন অনড় ও অনিবার্যপ্রায় অবলম্বন। লেখকের দু’একটা সাক্ষাৎকারেও এদিকটির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আগুনপাখিতেও আমরা দেখি একজন পুরুষ অল্প বয়স থেকেই কী অনমনীয় দৃঢ়তায় একটি নূহ্যপ্রায় পরিবারকে কেবল টেনে তুলছেন তাই নয়, সর্বোচ্চ নিষ্ঠায় পুরনো আভিজাত্যকে ফিরিয়ে আনারও চেষ্টা করছেন। এবং আনছেনও। প্রতিকূল সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখন সকলে পর্যুদস্ত, মন্বন্তরের অন্তহীন যাতনায় যখন অনেক মানুষ অনাহারে মৃত ও মৃত্যুপথগ্রস্ত ; তখনও সংসারকে প্রায় পূর্ণতই এসবের থেকে মুক্ত রাখতে সমর্থ হয়েছেন তিনি। এবং লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সঙ্গতি রেখেই কাহিনীতেও ভেঙে গিয়েছে যৌথ সংসার, ভেঙেছে জন্মমাটিতে বসবাসের আজন্ম স্বপ্নসাধ।
এদিক থেকে আগুনপাখি হাসান আজিজুল হকের আত্মন্মৃতিমূলক উপন্যাস। কিন্তু কাহিনীর শুরু হয়েছে লেখকের জন্মের অনেক আগে থেকেই, এবং শেষ হয়ে গেছে তাঁর কৈশোর উত্তরণের অব্যবহিত পূর্বেই। তাহলে কতটুকু প্রত্যক্ষিত বা নিজের দেখা সেই সময় ও জীবন ? আক্ষরিক সত্যে বেশি নয়। নয় বলেই হয়তো নিজের কথায় না বলে মাতৃবাচনেই আগুনপাখিকে উপস্থাপন করেছেন আমাদের সামনে। কিছুটা নিজের দেখা, কিছুটা মা কিংবা অন্য কোনো অগ্রবর্তীদের নিকট থেকে শোনা আর অনেকটাই আত্ম ইতিহাসজ্ঞান ও শিল্পচৈতন্যনির্ভর গভীর জীবন জিজ্ঞাসার উপর নির্ভর করে যে কাহিনী তিনি লিখেছেন তা প্রক্ষিপ্ত বা বানানো তো নয়ই বরং বাস্তবতার এক রূঢ় অধ্যায়ের শিল্পিত প্রকাশ। কিন্তু কাহিনীটি লেখকের পিতা কিংবা অন্য কোনো পুরুষের বয়ানে লেখা হলো না কেন ? এরকম প্রশ্নও করতে পারেন কেউ কেউ। কারণ, প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর সময় ও স্বদেশ, যেখানে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন; আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিলিতি পণ্য বর্জন; রাজনীতিবিদদের ভুলের সূত্র ধরে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দু-দুটো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বীভৎস হত্যাযজ্ঞ; সীমাহীন মন্বন্তরে সারা বাংলায় অজস্র মানুষের মৃত্যু; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার ভয়াবহতার আঁচ গ্রামেও পৌঁছে যাওয়া এবং অপরিণামদর্শী দ্বিজাতিতত্ত্বের তলোয়ারে মাতৃভূমি বাংলার দ্বিখণ্ডিকরণের মতো দৈশিক আন্তর্দৈশিক সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষঙ্গগুলো গভীর গুরুত্বের সাথে প্রতিফলিত হয়েছে, যা কি না পুরুষের জীবনপ্রবাহের সাথে অধিকতর মানানসই। তাছাড়া কথক তথা স্মৃতিচারণকারী হিসেবে যে নারীটি আছেন তাঁর জন্ম এমন একটি পরিবারে যেখানে পিতার কাছে কন্যার লেখা-পড়া কেবল প্রয়োজনহীন নয়; পণ্ডশ্রমেরও। আবার স্ত্রী হিসেবে যে পরিবারে তার প্রবেশ লেখাপড়ার প্রতি অনীহা না থাকলেও কত্তা কিংবা কত্তামার হুকুম তামিল করা ছাড়া নারীর কোনো মূল্য নেই। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বলতে রান্না-বাড়া আর সন্তান উৎপাদনটাই সেখানে মুখ্য। সংসারের ভালো-মন্দের ভাবনা কিংবা অন্য কোনো মন্তব্যে তার কোনো অংশগ্রহণ নেই। অগ্রগতি বলতে এটুকুই যে স্বামীর স্বদিচ্ছাতে অক্ষরজ্ঞানের মতো প্রাথমিক লেখাপড়া শিখে নিচ্ছেন গল্পের স্মৃতিচারক। এবং বাড়িতে আসা বঙ্গবাসী পত্রিকাটিও মাঝে মাঝে পড়ার চেষ্টা করছেন। তবু দীর্ঘ সংসার জীবনে যিনি দুচারবার মোটে ঘরের বাইরে বেরিয়েছেন, তাও আবার পর্দায় ঢাকা মোষের গাড়িতে চড়ে; নিজের গ্রামটাকেও ঘুরে দ্যাখেননি পায়ে হেঁটে; তাঁর মুখ দিয়ে এরকম একটি কাহিনী বলিয়ে না নিলেই কি পারতেন না ? পারতেন বৈ কি। কিন্তু তাতে বোধ হয় লেখকের উদ্দেশ্য সাধিত হতো না । এমনকি দৃষ্টিভঙ্গিতেও হয়তো নিরপেক্ষতা বজায় রাখাও সম্ভব হতো না। কেননা, যে পুরুষ নিজেই নানা ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে থাকেন, তাঁর পক্ষে আত্মস্মৃতি উচ্চারণে নিরাবেগী বা পক্ষপাতশূন্য থাকা সম্ভব নয়। সে দিক থেকে ঔপন্যাসিক সম্ভবত ঠিক কাজটাই করেছেন। তারপরও এতটা সরল ও সংক্ষেপে রায় দিয়ে দিলে হাসান আজিজুল হকের মতো জীবন ঘষে আগুন জ্বালানো শিল্পীর প্রতি সুবিচার করা হয় না। রাজনীতির ভেতরের রাজনীতিতে, সমাজের ভেতরের সমাজে, পরিবারের ভেতরের পরিবারে, জীবনের ভেতরের জীবনে, হৃদয়ের ভেতরের হৃদয়ের রহস্য উদ্ঘাটনের দক্ষ ডুবুরি হাসান হয়তো অন্য কথা; এর চাইতে গভীর কথাই ভেবেছেন। মানুষের মুক্তির কবি নজরুল লিখেছিলেন,
কোন্ রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি, কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা ?
(নারী)
সভ্যতার ইতিহাসে, যুদ্ধের পরিহাসে, পুরুষের নাম যতই পূজ্য হোক, আলোচ্য হোক, এই কথাটা তো সত্য যে, যুদ্ধ, সংগ্রাম, স্বাধীনতা কিংবা সমাজ পরিবর্তনের যে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় নারীদেরও অবদান অল্প নয়; কখনও আবার নারীরাই সবচাইতে অবহেলিত, লাঞ্ছিত ও ক্ষতিগ্রস্থ হন। বিশেষত, পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থায় কেবল শারীরিক মানসিকভাবেই সে অমূল্যায়িত থাকে না, স্বামী-পুত্র-ভ্রাতার মতো পুরুষদেরকে হারিয়েও চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। যারা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকেই কেবল ইতিহাস বলে মনে করেন, সেইসব ঐতিহাসিকের লেখায় এসব নারী ধর্তব্যের বাইরেই থাকেন। কিন্তু যারা রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ভেতর ও বাইরের সমাজটাকে দ্রষ্টার চোখ দিয়ে দ্যাখেন, সেইসব সাহিত্যিকের কলমে উপদ্রুত নারীরাই হয়ে উঠতে পারেন পরম প্রয়োজনীয় উপাদান। তাছাড়া সামাজিক- অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ঘটনা-দুর্ঘটনা যে সমাজের উপর সর্বোচ্চ প্রভাব বিস্তার করে সেই সমাজের সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে হলে, এবং সেই চিত্রকে সর্বজনগ্রাহ্য নিরপেক্ষতায় প্রতিস্থাপিত করতে হলে সমাজের ভেতরের নীরব সাক্ষী নারীকে তো সামনে আনতেই হবে। কন্যা, জায়া ও জননীরূপে নারীর যে অবলোকন, তাকে তুচ্ছ ভাবা সমাজমনস্ক প্রগতিশীল কোনো লেখক-শিল্পীর পক্ষে সম্ভব নয়; উচিত তো নয়ই। এবং হাসান আজিজুল হকের মতো মহৎ ভাষাচিত্রীদের কাছে এই নারীরাই বরং পরম আকাক্ষার বিষয়। বলা বাহুল্য, সে কাজটাই তিনি গভীর মনোযোগের সাথে করার চেষ্টা করছেন সারাজীবন ধরে। আলোচ্য আগুনপাখিতেও এর ব্যত্যয় নেই; ব্যাপকতা আছে। আছে অপার গভীরতাও। এমনকি চরিত্র হিসেবে নারীটির যে বিবর্তন, তাও শেষ পর্যন্ত বিস্ময়কর।
২.
আমার মায়ের য্যাকন মিত্যু হলো আমার বয়েস ত্যাকন আট-ল বছর হবে। ভাইটোর বয়েস দেড়-দু বছর। এই দুই ভাই-বুনকে অকূলে ভাসিয়ে মা আমার চোখ বুজল। ত্যাকনকার দিনে কে যি কিসে মরত ধরবার বাগ ছিল না।
এরকম সরল বাচনে, অকৃত্রিম আঞ্চলিকতায়; আজকের দিনে সাহিত্যবোদ্ধারা যাকে dream realism বা স্বপ্নবাস্তবতা বলেন, তার মতো করেই আত্মস্মৃতি রোমন্থন শুরু করেন এক নারী। বয়স বোঝা না গেলেও তিনি যে জীবনের অন্তিম পর্বে উপনীত, তা বলাই যায়। মায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে গল্প তিনি বলতে শুরু করেন তা বাবার পুনর্বিবাহ, প্রিয় দাদীর (বাবার খালা) মরে কাঠ হয়ে যাওয়া, বিয়ের মাধ্যমে নিজের বাড়িকে পিতার বাড়ি বানিয়ে ডোবা থেকে দিঘিতে আসার মতো স্বামীর বিরাট একান্নবর্তী পরিবারে প্রবেশের মতো সরল ঘটনার মধ্য দিয়ে কাহিনীর শুরু হলেও আস্তে আস্তে তা জটিল হতে থাকে। সাংসারিক সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছানো স্বামী, আর সুন্দর পুত্রে গর্বিত চিরন্তন বাঙালি নারী একদিন উপলব্ধি করতে শুরু করে সংসারে তার অবস্থান, অন্যান্য নারীদেরই বা কী ভূমিকা । অতঃপর পরিবারের, সমাজের অপরাপর পরিবর্তনও তার চোখে ধরা পড়তে থাকে। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরও সুযোগ পেলে বাড়িতে আসা বঙ্গবাসী পত্রিকায় চোখ বুলানো এবং স্বামীর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (ইউনিয়নের) হওয়া ও বাইরের মানুষের সাথে চলা-ফেরার মতো ঘটনাগুলো নারীটির ব্যক্তিসত্ত্বা তৈরি হতে সাহায্য করেছে। তথাপি কাহিনীর শেষ প্রান্তে পাঠকের জন্য অপর এক বিস্ময় অপেক্ষা করে থাকে।
হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ অতঃপর সাতচল্লিশের দেশবিভাগের মতো ভয়াবহ ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপটে অনেক মুসলিম পরিবারের পশ্চিম বাংলা থেকে পূর্ব বাংলায় আগমন এবং অগণিত হিন্দু পরিবারের পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় গমন আমাদের ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ও স্বাভাবিক সত্য। আগুনপাখিতেও সে সত্য প্রতীয়মান। কিন্তু এই স্বাভাবিক সত্যের বিপরীত সত্যও আছে। আগুনপাখির স্মৃতিচারণকারিণী, পশ্চিম বাংলার প্রত্যন্তগ্রামের এক নিরীহ জননী যখন স্বামী-পুত্র-কন্যার শত অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করে একলাই থেকে যান শিকড় আঁকড়ে, তখনই আমাদের কাছে পরিষ্কার হতে থাকে শিল্পী হিসেবে, মানুষের অন্তর্বাস্তবতার রূপকার হিসেবে হাসান আজিজুল হকের যথার্থ বার্তাটা কী! যন্ত্রণাটাই বা কী? বাধ্যত জন্মমাটি ছেড়ে আসা এই মানুষটা নিজে না পারলেও গল্পের মূল চরিত্রটির অনমনীয়ত্বের ভেতর দিয়েই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, যে মাটিতে যার জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তাকে সেখান থেকে আলাদা করতে নেই। কারণ, ছোট্ট চারাগাছকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে রোপণ করলে সে বাঁচে ও বেড়ে ওঠে, কিন্তু যার শিকড় অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে সেই বৃক্ষকে স্থানান্তর করলে সে বাঁচে না। কিছুদিন বাঁচলেও তার প্রাণ শক্তি থাকে না। আর সে কারণেই কথক নারীটি, যিনি কি না সারাজীবন স্বামীর সাথে তর্ক করা তো পরের কথা, মুখ তুলে সামান্য ভালো-মন্দ জানতে বা জানাতেও সাহস পান নি; সেই নারী মুসলমানদের আলাদা দেশের নামে বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে স্বামীর সঙ্গে কেবল তর্কই করেন না, ধর্মের নামে মাতৃভূমি খণ্ডিতকরণের অসারতাকেও তুলে ধরেন। স্বামী তাকে পরিত্যাগ করার হুমকি দিলেও নারীটি জানিয়ে দেন, আমি থাকব। তবু তার স্বামী মনে মনে ভাবেন, সাময়িকভাবে বিরোধিতা করলেও ভিটে-জমি বিক্রি করে সবকিছু নিয়ে যখন রওনা হবেন তখন তার স্ত্রী না করতে পারবেন না নিশ্চয়ই। এই ভাবনা ইতোমধ্যে পূর্ববাংলায় চলে আসা প্রিয় সন্তানদেরও। এমন কি পাঠক হিসেবে আমরাও ধরেই নিই, মালপত্র বোঝাই হয়ে গরুর গাড়ি তিনটে যখন যাত্রা শুরু করবে, তখন বেশ নাটকীয় কায়দায় নারীটিও ওর একটি গাড়িতে গিয়ে উঠবেন। কিন্তু পিতা-পুত্রের আশার গুড়ে বালি দিয়ে, আর আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে সত্য-সত্যই তিনি থেকে যান। এবং এক রাতের অশ্রুনদীতে ভেসে, বিপুল বিষণœতা শেষে পুনরায় জেগে উঠতে চান। বলেন,
সকাল হোক, আলো ফুটুক, তখন পুবদিকে মুখ করে বসব। সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াব আমি।
আমি একা।
মো. আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের খড়গে অখণ্ড বাংলার দ্বিখণ্ডিকরণ কিংবা হিন্দু-মুসলমানের আলাদা ভূখণ্ডকরণের মতো সমাজ পরিবর্তনের কারণে সীমাহীন উপদ্রুত, নিঃস্ব নারীটিকে এভাবে একা মাথা তুলে দাঁড়াতে দিয়ে হাসান আজিজুল হক হয়তো সে দায়টি পালন করলেন কিংবা করার চেষ্টা করলেন, যা আমাদের এই সংকীর্ণ সামাজিক, ধার্মিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বাস্তবতায় পালন করা সম্ভব হয়নি। হয়তো হবেও না কোনদিন। আর এখানেই হয়তো তিনি আদায় করে নিলেন অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিবোধ সম্পন্ন অগণিত বাঙালির স্যালুট।