সম্প্রতি কাজী রাফির ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসটির ভেতরে আমি ডুবে ছিলাম দীর্ঘদিন। আদ্যপান্ত পড়েছি বেশ কয়েকবার। ‘ত্রিমোহিনী’ একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। বিষদ এবং বিশাল এর কলেবর। বাংলাদেশে সচরাচর এই পরিসরের উপন্যাস হাতে পাওয়া যায় না। ঔপন্যাসিকরা লেখেন না। এর অনেক কারণ উদঘাটন করা সম্ভব। সেটা উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে ত্রিমোহিনীর কাহন গাওয়া। বইটি পড়ে আনন্দ পেলাম। নিজেকে আশ্বস্ত করতে পারলাম যে, পরম্পরা নিয়ে ভাবনার কিছু নেই।
পরের প্রজন্ম আমাদের মতো করে ভাবে না বা ভাবতে চায় না – কাজী রাফি এই ভ্রম ধারণাকে যেন সংশোধন করে দিলেন এই উপন্যাসটির জন্ম দিয়ে। পরিবেশ, প্রকৃতি ও কাল তার সৃষ্টিকে ধরিত্রির বুকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিজে নিজেই প্রয়াস পায়। কাজী রাফি এই পরিবেশ, প্রকৃতিরই সৃষ্টি। একটুও প্রগল্ভতা নয়। বইটি না পড়লে তো আর আমার এই উপলদ্ধির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয়।
উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনা করি। প্রতিশ্রুতিশীল লেখকের সততা এই উপন্যাসকে তিনটি পৃথক উপন্যাস হতে দেয়নি। তাই এর অবয়ব স্থূল। সম্ভবত এটি লেখকের মাথায় প্রথম থেকেই ঘুরপাক খেয়েছে নিরলস, নইলে উপন্যাসের নামকরণ ‘ত্রিমোহিনী’ কেন?
উপন্যাসটির প্রারম্ভে পিতা-মাতা-পুত্রের কথোপকথন লক্ষণীয়। ঔপন্যাসিক যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রেক্ষাপট নিয়ে কাজ করবেন তার সংকেত এই কথোপকথোন। কাটখোট্টা ইতিহাস উপন্যাসে পড়ে লাভ কি! না সেটা হয়ও নি। ইতিহাস আছে উপন্যাসের পাতায় পাতায়। তবে লেখকের হৃদয় নিঙড়ানো গল্পটাই এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে যা পাঠকের জন্য তিনি হৃদয়গ্রাহি করে তুলেছেন। সম্পূর্ণ উপন্যাসটি পড়তে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয় না একটুও বরং গল্পের রহস্যময়তায় পাঠক বুঁদ হয়ে থাকেন।
উপন্যাসের প্রথমেই ছোট্ট প্রিন্সেস মাহজাবিন-এর উজ্জ্বল দৃষ্টি আর দৃঢ়তা দেখে নবাব মোহাম্মদ আলী যা নিজে করতে পারেন নি সেই কর্মগুলো তাকে দিয়ে করানোর সংকল্প মনে মনে স্থির করে নেন। অর্থাৎ লেখক ইঙ্গিত দিয়ে দিচ্ছেন যে এই উপন্যাসের একটি অন্যতম চরিত্র মাহজাবিন। অবশ্যই মাহজাবিন চরিত্রটি লেখকের সৃষ্ট একান্তই কল্পিত চরিত্র। উপন্যাসটিতে মাহজাবিনের উত্তরপুরুষের তৃতীয় ধাপ নওরিন পর্যন্ত গল্পের বিস্তার। তাকে ঘিরেই ইতিহাসের বলয়। শেষাবধি নদীর স্রোতের মতো আপন ছন্দে প্রবহমান এই রচনা। অনেক সত্য কাহিনী আর কল্পনার মিশ্রণ তার লেখাকে করেছে মহিমাময় এবং গতিময়। প্রাগঐতিহাসিক যুগ থেকে আরম্ভ করে সমসাময়িক পর্যন্ত ইতিহাস ঔপন্যাসিক বলে গিয়েছেন সাবলীল ভাষায়। প্রাচীন টেথিস সাগর আর পোঁদ শব্দ – যাকে আমরা গালি ভেবে মানুষের বিষোদগার করি – আর প্রাচীন ভারতবর্ষের ভৌগলিক উত্থান অথবা পুণ্ড্র সভ্যতার ব্যুৎপত্তি অবলীলায় চিত্রিত। উপন্যাসে সন্নিবেশিত প্রাগৈতিহাসিক পর্বটি নিয়েই অনায়াসে একটি পৃথক উপন্যাস হতে পারত।
উপন্যাসে প্রেমের পর্ব না হলে কী চলে? অবতারণা হলো নওরিন-নির্ঝর উচ্চ মার্গের প্রেমকাহিনী পর্ব। উপন্যাসের অন্যান্য অংশেও প্রেম বিষয় পাওয়া যাবে তবে নির্ঝর-নওরিন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে আধুনিক উপকরণের যথোচিত প্রয়োগ বিদ্যমান। বাড়ি-গাড়ি-উচ্চ চাকরীকে আশ্রয় করে কাহিনীর বিস্তার আর সেল ফোনের যথেচ্ছ সংক্রমিত ব্যবহার। এইকালে যে ধারায় উপন্যাস রচনা সহজ এবং তার উপযুক্ত উপাদান-উপকরণসমূহ প্রয়োগ করে লেখক লিখলেন ঠিকই। কিন্তু প্রতারণা করলেন না, লিখলেন প্রয়োজনের তাগিদে। স্বচ্ছ স্ফটিক তার স্থিতি, দূর্দান্ত তার গতি। এগুলো সন্নিবেশিত হয়ে এটিও আর একটি নতুন উপন্যাস হতেও পারত।
৪২৮ পৃষ্ঠার উপন্যাসের জাল বুনন করতে আর একটি পর্বের রচনা করা হয়। যেটাকে আমি বলব উপন্যাসের কেন্দ্রীয় রসায়ণ। আর একটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি। জীবনের অস্তিত্ব মাত্রই প্রাণের স্পন্দন। আমাদের দেহ অনেকগুলো প্রাণের সমন্বয়ে, আমরা যাকে কোষ বলি, তার দ্বারা গঠিত। এই কোষের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে ক্রোমোজম। ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসের এই ক্রোমোজম অংশটি হচ্ছে গল্প বলিয়ে নামের এক অনন্য, অসাধারণ চরিত্রের দ্বারা সৃষ্ট পর্বগুলো। গল্প বলিয়ের অংশটি অভিনব। মন, প্রাণ জুড়ানো। কিশোর বয়স থেকে নির্মাণ করা এই চরিত্রকে বলিষ্ঠ করে গড়ে তোলার শৈলী অদ্ভুত। শুধুমাত্র এই অংশকে নিয়েও অভূতপূর্ব একটা উপন্যাস হতে পারত। লেখক তিনটি পৃথক পর্বকে সম্বন্বিত করে একটি উপন্যাসে প্রয়োগ করে কেবল নিজের সৃষ্টি দক্ষতারই পরিচয় দেন নি বরং বাংলা ভাষার কথা সাহিত্যে এমন এক অবদান রাখলেন যা এখন থেকে শুরু করে সুদূর ভবিষ্যত পর্যন্ত আলোচিত হবে।
ত্রি অর্থ তিনটি আর মোহিনী অর্থ যে নারী মোহিত করতে পারেন। আলোচিত উপন্যাসে অনেকগুলো বলিষ্ঠ নারী চরিত্রের সন্নিবেশ। কিন্তু তিনটি নারী উপরোল্লিখিত তিনটি পর্বে মোহিনী রূপে বিরাজমান। প্রথম পর্বের মাহজাবিন যিনি উপন্যাসের শেষাবধি আকীর্ণ – কল্পিত এই চরিত্র এবং তার পরিভ্রমন ইতিহাসের ভেতর দিয়ে। যে চরিত্রের দৃঢ়তা আমাদের সংগ্রামী জীবনে ভীষণ অপরিহার্য। মাহজাবিন অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন চরিত্র। লেখকের সূক্ষ্ম অনুভূতি এই মর্যাদাকে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে ধর্ষিত হতে দেননি। পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ধৃত এই মোহিনী-মহিলার সম্ভ্রম নষ্ট হয়নি। প্রশংসনীয় কৌশল বলতেই হয়।
‘ত্রিমোহিনী’-র আর এক মোহিনী সিফাত। হিন্দু ধর্মাবলম্বী একটি শিশুকে মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত করে হীনমন্যতা এবং মুসলমান উগ্রপন্থিদের কু-প্রবৃত্তির বর্ণনায় ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করে। স্বার্থান্বেষী লোভী চক্র কত নিষ্ঠুর হতে পারে, এই পর্বে তা বিধৃত। নিরঞ্জন আর সুফিয়ানের কুচক্রি বলয় ছিন্ন করে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত এই সিফাত চরিত্রটি। এই নিষ্পাপ প্রাণ বার বার হোঁচট খায়। সমাজের ঘুণপোকা মানুষগুলি থেকে সিফাতের মতো মোহিনীর নিস্তার নেই। লেখক এই চরিত্রকে নির্মাণ করেছেন সুফিয়ান-নিরঞ্জনের মতো সমাজের ক্ষত সৃষ্টিকারীদের মুখাবয়ব উন্মোচনের জন্য। এই ঘুণপোকাগুলো সমাজে দূরারোগ্য ব্যাধির মতো বিস্তৃত। এদের সাথে যুদ্ধ করেই জীবন ধারণ করতে হয়। উপন্যাসের পরতে পরতে লেখক তার যাদু বিস্তারকারী ভাষায় পাঠকের অন্তরাত্মায় সুর-বীণায় ইতিহাসের পাখনা ধরে মানবজীবনের বেদনার সুরকে অনুভব করিয়েছেন। গল্প বলিয়ের প্রেমিকা নিভৃতচারিণী সিফাত এদের বিরুদ্ধে আশৈশব সংগ্রাম করেছে। আহ্! কী বিভৎস সিফাতের জীবনের পরিণতি। পড়তে পড়তে নয়নের নীর সিক্ত হয়। আর গল্প বলিয়ে? আত্মহত্যা করেনি সে। জীবনকে শুধুই অনন্তের পথে ছড়িয়ে দিয়েছে। তার অন্তর্লোকের যাত্রা আগামী সুন্দর মানসলোক দ্বারা নির্মিত মানবিক এক সমাজ গঠনের পথে। এটাকে কি প্রতিশোধ বলব? হ্যাঁ প্রতিশোধই বটে। যে বলিষ্ঠ চরিত্র অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে উপন্যাসে সৃষ্ট বিধ্বস্ত সমাজকে জাগাতে এবং অনুপ্রেরণা যোগাবে আগামী এক বিধ্বস্ত সমাজকে জাগিয়ে তুলতে। সেই সমাজের পঙ্কিলতা সে স্বচক্ষে আলোকন করতে চায়নি। নিজকে নিজেই সে অন্ধ করেছে। নতুন কোনো গল্পের সৃষ্টি নয় অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পুরাতন গল্পগুলোকে ধারণ করে তা অবলোকন করার মতো গল্প বলিয়ের যে মানসলোক তা ঔপন্য্যসিকের সৃষ্টি শক্তিশালী এবং অনন্য এক প্রতীক মাত্র।
‘ত্রিমোহিনী’র তৃতীয় মোহিনী নওরিন। আধুনিক প্রাণোজ্জ্বল নারী। ভালোবাসার আধার। তবু এই আধুনিকা অন্তরালে নিজের উত্তল পেলবিত বুকে ফুটে থাকা ছোট কালো তিল দেখে আড়ষ্ঠ হয়ে যায়। লেখক নির্ঝরের প্রেমিকাকে এই ভাবেই দেখতে চেয়েছেন। যে সর্বান্তকরণে নারী হবে কিন্তু আধুনিকত্ব হবে তার আভরণ। ভালোবাসার মধ্যে কমনীয়তা যে বড়ই আরাধ্য। পুরুষরা হয়তো তাদের প্রেমিকাদের নওরিনের মতো মানসলোকের নারীকেই কল্পনা করে। পুরুষের আরাধ্য আর চিরকল্পিত নারী চরিত্রের স্ফুটনে ঔপন্যাসিক দারুণভাবে তার সক্ষমতা দেখিয়ে দেন।
এখানে জয়পীড় আর কমলার কথা না বললেই নয়। ঐতিহাসিক চরিত্র জয়পীড়ের সাথে কমলা চরিত্রের চমৎকার মিলন ঘটিয়ে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে ঐন্দ্রজালিক মহিমায় উত্তরণ ঘটানো হয়েছে। বলতেই হবে যে কমলা চরিত্রটিও একটি শক্তিশালী মোহিনী রূপ ধারণ করেছে। ইতিহাসে কমলা –জয়পীড় সংক্রান্ত তেমন কোনো প্রেক্ষাপট না পাওয়া গেলেও ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসের এই অংশটি এমন সব দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে লেখক পরিস্ফুটন করিয়েছেন যে উপন্যাসের এই অংশটিই একদিন সমাজের মননে ইতিহাস হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা।
ত্রিমোহিনী উপন্যাসে আদতে কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই । তবে নারীদের আবর্তনে পুরুষ চরিত্রগুলোর বিকাশ তথা মাহজাবিনকে কেন্দ্র করে তার স্বামী এবং ভাইয়ের সমস্ত কার্যকলাপ। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অনন্য অবদান। সিফাতকে ঘিরে গল্প বলিয়ের আবর্তন। কমলাকে ঘিরে জয়াপীড়ের ঘূর্ণন। সমস্ত উপন্যাসে নওরিনের উপস্থিতি নির্ঝরের অনুপ্রেরণা। আর নির্ঝরের মা? তিনি তো আরম্ভ থেকে শেষাবধি জানান দিয়ে যাচ্ছেন একটি সন্তানকে কীভাবে ভালোবেসে গড়ে তুলতে হয়। এই জননী-ই তো তার মমতা দিয়ে নির্ঝরকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন।
চরিত্র নিয়ে অনেক বলা হলো। এবার কাহিনীর বিন্যাস নিয়ে বলি। যে বিশাল ক্যানভাসে ত্রিমোহিনী চিত্রিত হয়েছে তা সত্যি অপূর্ব। প্রথমেই লেখক নির্ঝর আর বাবার সাথে কথোপকথনে পাঠকদের আভাস দিয়ে দিচ্ছেন যে এই গল্পের পরিসর হবে ইতিহাসকে আশ্রয় করে। পাঠককে একটুও বিচলিত না করে গল্পের বিস্তার ঘটেছে নির্বিঘ্নে। বিরস ইতিহাস এতো সরস হয়ে উঠতে পারে উপন্যাসটি আদ্যোপান্ত না পড়লে তা হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না। সাবলীল অথচ প্রয়োজনীয় ইতিহাসগুলো যেন নীরবে ঝর্ণার গতি নিয়ে ছন্দ তুলে তুলে পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে। লেখার নিজস্ব শৈলী কোথাও গতিকে পতিত করেনি। ইতিহাসে পৌন্ড্র সম্রাট অশোক, জমিদার-নবাবের ইতিহাস যেমন বিবৃত হয়েছে তেমনি সমাজের সমসাময়িককালের ক্ষত চিহ্নগুলোও অঙ্কিত হয়েছে। একটি উপন্যাসে ঔপন্যাসিক প্রাচীন সময়ের সাথে বর্তমানকে যে অবলীলায় জুড়ে দিয়েছেন তার প্রকরণ এবং সক্ষমতা অনবদ্য এবং একই সাথে তা আমাদের বিস্ময় জাগায়।
নিজের জন্মস্থানে যে সুখ বিদ্যমান সেই সুখ পরবাসে পাওয়া দুষ্কর। জন্মভূমির সাথে একজন মানুষের যে মানসিক বন্ধন যা তার সত্তার মধ্যে বিরাজমান তার বিকাশ অন্যত্র হয় না। সেই শান্তি, সেই শক্তি পরবাস জীবনে বিরল। পরবাসে সেই ভিত্তি স্থাপন করতে অন্তত তিন পুরুষকাল সময়ের প্রয়োজন। মানুষ এটা জানে তথাপি আহারের সন্ধানে, জীবন ধারণের সন্ধানে, সুখের সন্ধানে অজানার উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়া হয় মানুষ। ‘ত্রিমোহিনী’-তে এমনি এক হতভাগা সৌমেন গ্রামবাসীর দৃষ্টির আড়ালে জীবন বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি জমায় অজানার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে নীলকরের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও পরবাসে সুখের কল্পনা তাকে নিষ্কৃতি দেয়নি। সন্তানের জন্য এক আঁজলা জল আনতে গিয়ে সৌমেনের নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেয়ার বর্ণনা বড়ই বেদনাঘন। চারজনের পরিবারের ভয়াবহ পরিণতি শরীরে শিহরণ জাগায়। প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দেয় যে অন্য কোথাও নয় নিজের জন্মভুমিই সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। লেখক কি কেবলই উপন্যাসের পরিসর বাড়ানোর জন্য এই গল্পের অবতারণা করেছেন? মোটেই না। বিমূর্ত বার্তা এই বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে প্রবহমান। জীবন যদি যায়, যাক, তবু উদ্বাস্তু হওয়া যাবে না। এই অমোঘ সত্যটি লেখকের গভীর উপলব্ধি, তীক্ষ্ম দৃষ্টি আর ভাষার অপূর্ব সৌন্দর্য্য দিয়ে তার দর্শন হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে। বাহুল্য বর্জিত লেখায় মাটির সোঁদা ঘ্রাণ পাওয়া যায়। সৌমেন দীপান্বিতা হয়ে সুশীল তথা সিফাতের জীবন আখ্যান বিমোহিত করবেই যে কোন সংবেদনশীল পাঠককে।
উপন্যাসটি যেভাবে তার পরিণতির দিকে এগিয়ে গেল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এ রকম- ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মদদ দেওয়ার কারণে চৌধুরী আসাদুজ্জামানের শেষ বংশধরদের হন্যে হয়ে খুঁজছে ব্রিটিশ-চর। তাদের নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো মুন্সি আব্দুল বশির একদিন নওয়াব মোহাম্মদ আলীর কাছে এসে নাগিব আহমেদ এবং তার কনিষ্ঠ বোন ছোট্ট মাহজাবিনের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। নওয়াব এই কন্যাটির তেজ্জোদীপ্ত দৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে ‘প্রিন্সেস মাহজাবিন’ বলে সম্বোধন করলেন। মাহজাবিন নওয়াবের স্নেহের ছত্রছায়ায় বড় হয়ে ওঠে। পরিণত বয়সে সে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. পি কে মুখার্জী, সৈয়দ মুজতবা আলীসহ নিজের অধ্যাপক স্বামীকে নিয়ে সম্পৃক্ত হয় বাংলার মহান ভাষা-আন্দোলন এবং পুন্ড্র সভ্যতার ঐতিহ্য রক্ষার জন্য। আর এই প্রস্তুতির অনুষঙ্গ হিসেবে সে এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করে। সৃষ্টি করে শুভ্র নামের একজন গল্পবলিয়েকে। এই গল্পবলিয়ে মাহজাবিন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেকে সফল কথক হিসেবে তৈরী করে এবং গল্প শোনানোর মাধ্যমে ত্রিমোহিনীবাসীর অন্তর্লোক বিনির্মাণ করার ব্রত নেয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধে মাহজাবিন কন্যা নাজ তিতির কৌশলে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে সক্ষম হলেও নাগিবের স্ত্রী এবং দীপন আহমেদ তুষারের মা বিখ্যাত গজল গায়িকা মেহের নিগার দিশাকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রিগেডিয়ার তোজাম্মুলের ক্যাম্পে। ‘ত্রিমোহিনী’র গল্প বলিয়ে শুভ্রর স্ত্রীর মৃত নগ্ন সিফাতকে শিবলিঙ্গের উপর বসিয়ে রাখা হয় শিবমন্দিরের পুরোহিত নিরঞ্জন এবং মাহজাবিনের এককালের খাজাঞ্জি রাজাকার সুফিয়ানের কূটবুদ্ধিতে। এক সময় নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের অবসানে সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। আকাঙ্খিত স্বাধীনতা আমরা পেলেও সমাজে সর্বত্রই অবক্ষয় দানা বাঁধতে থাকে। শুরু হয় নতুন এক যুদ্ধ। ভ্রাতুষ্পুত্র দীপন আহমেদ তুষারকে রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে তোলার সাধনায় নিমগ্ন হন মাহজাবিন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে নিজের চোখ নিজে অন্ধ করে ফেলা গল্প বলিয়ে শুভ্র তার সমস্ত গল্প শোনায় আগ্রহী এক কিশোরকে।
তার অনেক বছর পর… বড় হয়ে ইতিহাস-প্রিয় ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠা সেই কিশোর একদিন সহযাত্রী নওরিনকে দেখে চমকে ওঠে – এ যে প্রিন্সেস মাহজাবিন! নির্ঝরকে সেই কৈশোর থেকে মাঝে মাঝেই যিনি স্বপ্ন ঘোরে সম্রাট অশোকের সমাধিস্থল দেখানোর কথা বলে নিয়ে যান অচেনা এক জগতে। নির্ঝরের কাছ থেকে তার উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়তে নিয়ে নওরিন অনুরাগে জড়িয়ে যায় নির্ঝরের সাথে। সারথী হয় দরিদ্র শিশুদের জন্য নির্ঝরের নির্মিত আশ্রমের সাথে। সে আশ্রম রক্ষার সংগ্রামে তারা যখন মরিয়া তখনই আশ্রমের দলিল ভেবে সন্ত্রাসীরা নিয়ে যায় খামের প্যাকেটে মোড়া নির্ঝরের লেখা ঊপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। ল্যাপটপসহ উপন্যাসের পান্ডুলিপি উদ্ধারে ঔপন্যাসিক নির্ঝর ফ্লার্টিং শুরু করে স্থানীয় সাংসদ-কন্যার সাথে। প্রাচীন টেথিস সাগরের নাম অনুকরণে তিনি যার নাম রেখেছেন টিথিয়া আহমেদ দীপ্তি। গ্রন্থের মাঝে গড়া, মা-হীনা দীপ্তির অন্তর্লোক নিয়ে খেলতে গিয়ে নির্ঝর করে বসে জীবনের এক চরমতম ভুল।
কিন্তু নির্ঝরও যাকে দখলদার ভেবে তার কন্যার সাথে প্রেমাভিনয় করছে সে আর কেউ নন, মাহজাবিনের তিল তিল স্বপ্নে গড়া এক রাজনীতিবিদ এবং একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা দীপন আহমেদ তুষার। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, নওরিন নিজেকে এক শিক্ষকের কন্যা জানলেও সে প্রিন্সেস মাহজাবিনের নাতনী। রহস্যের জাল বিস্তৃত হয়ে রয়েছে ‘ত্রিমোহিনী’-র বিশাল ক্যানভাসে।
‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসে সংঘটিত সকল ঘটনাই শুধু পুন্ড্র তথা বগুড়া অঞ্চলের নয় বরং তা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ঐতিহ্য বহন করে। সম্রাট অশোক আর্য পরিচয়ধারী সকল বিদেশীদের রাজ্য ছাড়া করেছিলেন অথবা অন্যেরা নয় বরং ভারতবর্ষের অধিবাসীরাই ছিলেন আর্য- কাজী রাফি কি এই বিশ্বাস পোষণ করেন? ফকির মজনু শাহ, রাণী ভবানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক চরিত্রের সাথে এক ডজন শক্তিশালী প্রধান চরিত্রের কর্ম যজ্ঞে কাজী রাফি এমনই এক বিস্তৃত এবং মোহাচ্ছন্ন জগত তৈরি করেছেন যা একই সাথে রহস্যময় এবং আমাদের জাতিসত্তার চিহ্ন বহনকারী গবেষণালব্ধ দলিল। আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্যকে ধারণকারী এক গতিময় কাব্যব্যঞ্জনা। এই উপন্যাসটি বাংলা ভাষার কথা সাহিত্যে একটি অসাধারণ এবং নব সংযোজন। উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে মাইল ফলক হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। গ্রন্থটি আমাদের অতীত ইতিহাস, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য দিয়ে শুধু পাঠকের জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে না বরং উপন্যাসটি প্রতিটি বাঙালিকে নিয়ে যাবে তার সত্তার শিকড়ের কাছে আর গর্বিত করবে তার মানসলোক। ৪২৮ পৃষ্ঠার অনন্য এই উপন্যাসটি একখণ্ডে প্রকাশ করেছে পার্ল প্রকাশনী।
উপন্যাসে বিশেষ কিছু শব্দের প্রতি ঔপন্যাসিকের মোহ অথবা দুর্বলতা লক্ষনীয়। এই উপন্যাসে কিছু বানান প্রমাদ রয়েছে যা অমার্জনীয়। অসচেতন হওয়া মোটেই উচিৎ হয় নি। বিশালত্ব এবং প্রথম সংস্করণ হিসেবে ক্ষমা করা যায় বৈকি
কাজী রাফির লেখার বিষয়বস্তু উপন্যাস এবং ছোটগল্প। ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার-১০’। ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসটিও এই রকম স্বীকৃতি পাওয়ার দাবী করে।