এতদিন আমরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর [জন্ম ১৫ আগস্ট ১৯২২, মৃত্যু ১০ অক্টোবর ১৯৭১] তিনটি উপন্যাসকে ঘিরেই তাঁর ঔপন্যাসিকখ্যাতি আলোচিত হতে দেখেছি। পরবর্তীকালে, দীর্ঘ সময় পরে, তাঁর দুটি ইংরেজি উপন্যাসের বাংলা ভাষান্তর আমাদের হাতে আসে। শিবব্রত বর্মণের অনুবাদে ২০০৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ‘দ্য আগলি এশিয়ান’-এর বাংলা রূপ ‘কদর্য এশীয়’। আর অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয় ‘হাউ ডাজ ওয়ান কুক বীন্স্’-এর বাংলা ভাষান্তর ‘শিম কীভাবে রান্না করতে হয়’। প্রথমটি রাজনীতি-বিষয়ক; দ্বিতীয়টিতে রূপায়িত হয়েছে সাংস্কৃতিক ভাববিনিময়ের সূত্রাবলি ও চিত্রাবলি। আমাদের বর্তমান আলোচনা ‘কদর্য এশীয়’কে ঘিরে।
তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক-সংস্কৃতি এবং আমেরিকানির্ভরতার বিশ্বস্ত ছাপচিত্র তাঁর এই উপন্যাস; ভিন্নভাবে দেখলে অনুধাবন করা যায় যে, এশিয়ার যে কোনো দেশই এর ক্যানভাস। জাতি হিশেবে আমরা – এশীয়রা যে পিছিয়ে-পড়া, স্মৃতিরোমন্থনপ্রিয় – অহেতুক অতীতচারি, আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জনের আগেই মৃত্যুবরণ করে থাকি, আমাদের হাতে থাকে না কোনো তথ্য-পরিসংখ্যান, নিজের সংস্কৃতিকে কেবল গান-বাজনার মাধ্যমেই প্রকাশ করতে অভ্যস্ত, ’বিনাপ্রশ্নে প্রভূর নির্দেশ পালন’কে ধ্যান-জ্ঞান জেনে ’নৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা’য় ডুবে থাকতে আর ঝিমানোর ফাঁকে ফাঁকে কোকাকোলা খেয়ে ঠোঁট ভেজানোয় আমাদের আনন্দ, ভিনদেশি মনোভঙ্গি বিষয়ে আমাদের যে স্পষ্ট কোনো অভিমত নেই; ঐতিহাসিক কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে আমরা যে অহেতুক লম্বা বক্তব্য দিতে পারঙ্গম – এমন কিছু জটিল অথচ জরুরি বিষয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্মের অনেক আগেই আমরা যেন এই দেশটির একটি সাবলীল পরিচয়ও পাঠ করতে থাকি। “একটা দেশকে আসলে কীভাবে চেনা যায়? কোথায় দেশের শুরু?” – এসব প্রশ্ন আর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রবাহে মানবমনের বিচিত্র ওঠানামার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হতে থাকে উপন্যাসটির আবহ।
কথানির্মাতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ অনুভব করেছেন যে, আমরা অনেকেই এদেশে জন্মগ্রহণ করে সন্তুষ্ট নই; নিজের দেশকে ভালোবাসতে, দেশ নিয়ে গর্ববোধ করতেও যেন আমাদের খুব কষ্ট। আমরা যেন কোনো কথা কাউকে বুঝিয়ে বলতে গেলেও অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। তরুণরা যেন অল্পকাল পরেই সকল উদ্যম হারিয়ে মিইয়ে যেতে থাকে। আর এদেশের সচেতনসমাজ রাজনীতির কথা উঠলেই বড় বেশি ধর্ম আর ধার্মিকদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মত্ত হয়ে পড়ে। আর কেউ কেউ আছেন, যারা চিন্তার মুক্তিতে বিশ্বাসি তরুণসমাজকে কব্জা করে বিদেশপ্রীতির আনন্দ ও সুবিধা ভোগ করে থাকেন। লেখকের ভাবনায় :
“এদের যে কাউকে যে কোনো সময় কিনে ফেলা যায়। কখনো একটা রেফ্রিজারেটর কিংবা একটা টেপরেকর্ডার বা এমনকি ভাগ্নেকে স্টেটসে পাঠানোর কথাতেও কাজ হয়ে যায়।”
এমনই এক ধনাঢ্য-প্রভাবশালী ব্যক্তির আতিথ্য গ্রহণকারী আমেরিকান এক সাংবাদিক মি. জনসনকে ঘিরে তৈরি ও আবর্তিত হয়েছে বর্তমান উপন্যাসের কাহিনীবলয়; যে কিনা তার দেশের একটি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রয়োজনে তথ্য-উদঘাটনের মিশনে এখানে এসেছেন। কাহিনীকার গল্পের পটভূমি এই দেশকে কল্পনা করেছেন একটি উত্তপ্ত-গুমোট-ঘনতমসাঘেরা ঘর হিশেবে; সেখানে অবস্থানের এবং পরিকল্পনা-আঁটার স্বাভাবিক পরিবেশ নেই। আমরা জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন পশ্চিমা পুরাতন পরাশক্তিগুলোর বেহাল দশা, সমাজতন্ত্রের জাল যখন মানুষকে অনেকাংশে ঘিরে ফেলেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র দাঁড়িয়ে গেছে একমাত্র পরাশক্তি রূপে। এই পরাশক্তির নতুন পররাষ্ট্রনীতি – বিশেষত আফ্রিকা এবং এশিয়া বিষয়ে রাষ্ট্রটির পলিসি কী, তা পর্যবেক্ষণ এবং মানুষের মর্যাদা, মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করার প্রয়োজনীয় পরামর্শ তৈরির জন্য ’অপিনিয়ন’ নামক পত্রিকার অ্যাসাইনম্যান্ট নিয়ে এখানকার প্রকৃত অবস্থা অবলোকন করতেই মূলত আগমন ঘটেছে মি. জনসনের। আমেরিকার মদদ এবং সহযোগিতা কোন ধরনের ব্যক্তি কিংবা দলের প্রতি থাকা উচিৎ – এমন ভাবনাও তাঁর পর্যবেক্ষণ-কর্মসূচির অন্বিষ্ট বিষয়। সদ্যস্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিকাশমান অর্থনীতির এবং নবতর রাজনীতির অতি প্রয়োজনীয় কতিপয় বিষয় উপন্যাসটির ফ্রেম নির্মাণ করেছে। আর কাহিনী-পরিসরের ফ্রেমে প্রবেশ করেছেন ইতিহাসের অধ্যাপক, অর্থনীতির অধ্যাপক, ব্রিটিশ কাউন্সিলের কর্মকর্তা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, চিত্রশিল্পী, তরুণ শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক অধ্যাপক [আহসান নামের এই প্রফেসরকে মার্কিনিরা অপছন্দ করে; দেশের পক্ষে অনেককিছু ভাবতে গিয়ে, ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি তিনবার জেল খেটেছেন; আমেরিকানদের দেশভ্রমণের আমন্ত্রণ তিনি প্রত্যাখান করেছেন; তাদের দেশে যাবার ইচ্ছা তার নেই, তারা এদেশে কী করছে সে বিষয়ে তার আগ্রহ] ও তাঁর ভক্ত ছাত্রী, প্রধানমন্ত্রী, ঝিমিয়ে-পড়া কোনো এক সচিব, শিল্পকারখানার বিদ্রোহী শ্রমিক, বিক্ষোভরতশিক্ষার্থী, উপাচার্য, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও সংবাদকর্মি, ভিনদেশি এনজিও কর্মি, জাদরেল ব্যবসায়ী, মার্কিন গোয়েন্দা-উপদেষ্টা, পুলিসপ্রধান, গোয়েন্দাপ্রধান, তরুণ সেনাকর্মকর্তা, জাতীযতাবাদি রাজনৈতিককর্মি তরুণী আর পরিপার্শে¦র কোনো কোনো প্রাসঙ্গিক চরিত্র। পরিবেশিত হয়েছে মানুষের বিচিত্র প্রবণতা; যা সমাজ-রাজনীতিকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রতিভাত করে।
নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের নতুন নির্বাচন আর নবগঠিত সরকারের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতি; অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন-পরিকল্পনা, বিদেশি সাহায্য বিনিয়োগের ক্ষেত্র নির্ধারণ, নির্বাচনী ওয়াদা পালন-না-পালন প্রসঙ্গ এবং রাষ্ট্রপ্রধানের ব্যক্তিত্ব ও হঠকারিপ্রবণতা উপন্যাসটিতে প্রক্ষেপণ করেছে নতুন বারতার আলোক। একটি অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর দিনলিপি এবং ভোটাধিকার নিয়ে রাজীতিবিদরা কী ধরনের খেলা খেলে থাকেন; উন্নত দেশগুলো – বিশেষত শোষণের লোভ যাদের রয়েছে, অশিক্ষিত অসহায় জনগণের ভাগ্যলিপিতে কীভাবে কালো দাগ আঁকেন – এসবের ভাবনাছবি পরিবেশিত হয়েছে ‘কদর্য এশীয়’তে। কমিউনিস্টবিরোধী গণতন্ত্রকামী শাসকরা শিল্পায়নের গতিকে স্থবির করে নিরপেক্ষতার ফাঁকা বুলি ছড়িয়ে রাস্তা-সংস্কার, বন্যা-খরা প্রভৃতি দুর্যোগে খাদ্য-বস্ত্র-ওষুধ প্রভৃতি বিতরণ করে জনগণের মন জয়ের কায়দা অন্বেষণ করছেন; আর খুঁজছেন একাজে তাদের অনুগত সরকার। ওয়ালীউল্লাহ্ বর্তমান উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে আমাদেরকে জানাচ্ছেন, এশীয়া-আফ্রিকা প্রভৃতি দারিদ্র্যশাসিত অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী কিংবা সমাজতান্ত্রিক যে দল বা মোর্চাই ক্ষমতায় আসীন হোক-না-কেন আমেরিকার তাবেদারির বাইরে যাবার যোগ্যতা তাদের নেই; ব্যক্তিস্বার্থ আর নিজ দেশের প্রতি দেশের জনগণের প্রতি প্রবল অনাসক্তিই শেষপর্যন্ত তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। ভিনদেশপ্রীতি, দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি অনীহা ইত্যাকার আধুনিক(!) চিন্তায় একশ্রেণির সুবিধাভোগী সমাজ হয় রাষ্ট্র পরিচালনা করে নয়তো পরিচালনায় সহায়তা করে; এরা কোনোভাবেই জনসম্পৃক্ত নয়; দেশের আলো-বাতাসের সাথে তাদের জীবনপ্রণালি মানানসইও নয়।
সরকারি চাকুরি প্রতি অবিকল্প আস্থাশীল, উপনিবেশবাদের ফেলে-যাওয়া উৎকট গন্ধের প্রতি অকৃত্রিম অনুগত, ধোঁকাবাজির গণতন্ত্র চর্চাকারী জনতা যে প্রকৃতপক্ষে নিজের মুক্তি আনতে পারে না, সে কথা লেখক বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য নেতারা ক্ষমতায় যাবার আগে ভালো ভালো বলে থাকেন; এই উপন্যাসে বর্ণিত আবদুল কাদের, পরে যিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন [এবং যথারীতি আমেরিকার দালালি করেছেন], সংসদ সদস্য থাকাকালে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন :
“আসুন, দেশের প্রতিটি ঘরে মুক্তির নির্মল প্রাণোচ্ছ্বল বাতাস বইয়ে দিই। এ বাতাস আমাদের দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত, নদী-নালা, সমভূমির ওপর দিয়ে বয়ে যাক। আসুন জেগে উঠে আমরা মুক্তির স্বাদ নিই, এর আনন্দ এবং এমনকি এর ঝুঁকির সঙ্গে পরিচিত হই।”
প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক সংগ্রামে মানুষকে সমবেত করতে, কৃষিবিপ¬বের মধ্য দিয়ে দেশের সামাজিক-মানবিক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে অসমর্থ মানুষগুলিই যে এশিয়ার জন্য প্রধান অভিশাপ, সে রকম ইঙ্গিতই বোধকরি, ওয়ালীউল্লাহ পরিবেশন করতে চেয়েছেন বর্তমান উপন্যাসের বিরাট ক্যানভাসের আড়ালে থেকে। তাবেদার প্রকৃতির লোকেরা যে দেশ এবং বিদেশ কারো জন্যই মঙ্গলকর নয়, সেরকম আভাস প্রকাশ পায় কাহিনীতে বর্ণিত আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের কল্পনায়। তিনি জানান :
“এশীয় দেশগুলিতে আমাদের অবস্থান আসলে বালির বাঁধ, এক মুহূর্তে আমরা ধসে পড়তে পারি। এতকাল ভাবতাম কোনো লক্ষ্যে তীর ছুড়ছি, এখন দেখছি লক্ষ্য নেই, তীর বিঁধছে হাওয়ায়।”
ক্ষুধাকে জয় করার, আর্থিক নিশ্চয়তায় জীবনযাপনের আর অনির্ভর চিন্তা প্রয়োগের যে জাতীয়তাবোধের স্বপ্ন প্রফেসর আহসান লালন করছেন, তার পরিপূর্ণ সফলায়নের মধ্য দিয়ে এশিয়ায় [এমনকি আফ্রিকায়ও] প্রতিষ্ঠিত হোক সত্যিকারের স্বাধীনতা; ভিনদেশি হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হোক পিছিয়ে-পড়া সব জাতি; নিজস্ব পদক্ষেপে বেড়ে উঠুক তাদের সমৃদ্ধি – এই অভিপ্রায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর। আর কদর্য এশীয় সেই ভাবনা পরিবেশনের এক স্বচ্ছ পাত্র।
আমেরিকার বিভিন্ন তথ্য-সংগ্রহকারী সংস্থা এশীয়াতে কাজ করে চলেছে, তাদের দেশের অভিপ্রায় সম্বন্ধে ধারণা প্রদানের মিশন নিয়ে; ভিশনও আছে নিশ্চয়ই। ’মানুষের মর্যাদা, মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষের শক্তি’ হিশেবে নিজেদেরকে জাহির করে তারা মূলত রাষ্ট্রীয় ফায়দা অর্জনের চেষ্টায় রাতদিন ব্যস্ত। বৃটিশ শাসকদের এ দেশ ছেড়ে যাবার প্রায় দুইদশক আগে তাদের আনুকূল্য পাওয়া স্বায়ত্তশাসিত সরকারের একজন মন্ত্রী, পরে যিনি স্বৈরশাসক ও দুর্নীতিবাজ হিশেবে পরিচয় লাভ করেছেন, তাঁর [কাল্পনিক হলেও তিনি ভারতের নেতা; তাকে দিয়েই চিনতে পারা যায় আমাদের জাতীয নেতাদের চরিত্র] সাথে সাক্ষাৎ করে একজন আমেরিকান সাংবাদিক যে তথ্য আবিষ্কার করেছেন, তা আমাদের জন্য দারুণ শিক্ষণীয় বারতা বহন করে। তিনি জানাচ্ছেন :
“মন্ত্রী হিসেবে তার অভিজ্ঞতা অবশ্য পূর্ব থেকে তৈরি করে দেওয়া কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করার বেশি কিছু দাঁড়ায়নি, কোথাও কোনো কর্তৃত্ব ফলানোর সুযোগ তার ছিল না। কোথাও কল্পনাশক্তি খাটাতে হয়নি, কোনো দায়দায়িত্ব বহন করতে হয়নি।”
অবশ্য তিনি লন্ডন থেকে জামাকাপড় বানিয়ে আনতেন, তার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতো ইংল্যান্ডের সেরা সেরা স্কুলে, অবকাশ যাপনের জন্য সেদেশে একটা সুরম্য বাড়িও কিনেছিলেন। মুশকিল হলো দেশ স্বাধীনের পর, যখন তাকে নতুন জন্ম-নেওয়া একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের দায়িত্ব নিতে হলো। তিনি স্বাভাবিকভাবেই কিছু স্বার্থান্বেষি লোকের দ্বারা পরিবেষ্টিত হলেন। কেননা, ’নেতা নিজ দেশ সম্পর্কে অনাসক্ত থাকলে, তার চারপাশে এমন সব লোকজন ভিড় করে, যাদের একমাত্র আসক্তি ব্যক্তিস্বার্থে।’ নির্বাচনে তার ভরাডুবির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমেরিকান সাংবাদিক বের করে ফেলেন তাঁর দুর্বলতার আর নির্ভরতার জায়গাগুলি। যখন, আজকের বিশ্বে, দুরদৃষ্টি কিংবা দূরভিসন্ধিই হলো রাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতির চাবিকাঠি, সেখানে এমন ব্যক্তির নেতৃত্ব একটা ভূখণ্ডের জন্য কতোটা ক্ষতিকর হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। লেখক আমাদেরকে কৌশলে জানাতে চেয়েছেন আমাদের জাতীয় এবং ঐতিহ্যিক দুর্ভাগ্যের ইতিহাস। বলছেন: “একটি নতুন দেশ, যার সামনে অনেক সংস্কারের কাজ পড়ে আছে, যাকে বহুকিছু তৈরি করে নিতে হবে, সে দেশে এসব লোক কোনো উপকারে আসে না।”
‘নিরপেক্ষতা’ নামক যে নিদ্রাবটীকা খেয়ে আমরা [ভারতীয়] রাষ্ট্রনীতিকে পরিহাস করি, তার সত্যাসত্যের কিছু ইঙ্গিতবারতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পাঠিয়েছেন বর্তমান কাহিনির মাধ্যমে। উপন্যাসে বর্ণিত কাহিনিতে দেখা যায়, আমেরিকান নীতির অন্ধ-অনুসারি নানাভিকে পরাজিত করে নির্বাচনে আব্দুল কাদের জয়ী হয়েছেন সমাজবাদিদের ওই ‘নিরপেক্ষতা’ নীতিকে সমর্থনের কথা প্রচার করে। লেখক জানাচ্ছেন : “আব্দুল কাদেরের দিক থেকে এটা ছিল স্রেফ এক নির্বাচনী কৌশল। নিরপেক্ষতা নীতিতে কোনোকালে তাঁর আস্থা ছিল না।” নতুন জন্ম-নেওয়া পাকিস্তানের চালচিত্র সম্বন্ধে দুজন ইংরেজের কথোপকথনের মাধ্যমে কথাশিল্পী তাঁর নিজ দেশের মানুষদের যে চরিত্র প্রকাশ করেছেন, তা আজও আমাদের চোখের সামনে সত্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সমকাল এবং উত্তরকালের দ্রষ্টা শিল্পী ওয়ালীউল্লাহ্ লিখেছেন:
“দেশটা খারাপ না, এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। এখানকার লোকজন ধর্মপ্রাণ, সমাজতন্ত্রের তোয়াক্কা এরা করে না। যারা সত্যি-সত্যি করতে পারত, তারাও সরকারি চাকরিতে ঢুকে পড়েছে, সরকারি চাকরি এরা আবার খুব পছন্দ করে। তারপর আছে ব্যবসায়ী আর শিল্পপতিদের একটা ক্ষুদে, বর্ধিষ্ণু গোষ্ঠী, তারা কোনো সমস্যা পাকাবে না। কাজেই যদি মূল নেতা ঠিক থাকে তো সব ঠিক।”
‘নিরপেক্ষতা’র আড়ালে আমরা যে আমেরিকানদের চিন্তাচেতনাকেই ধারণ ও লালন করি, সে সত্যই লেখক পরিবেশন করতে চেয়েছেন। আমরা জানি, রাষ্ট্রশাসনের জন্য একজন নেতাকে অনেক গুণে ও শিক্ষায় আলোকক মানুষে পরিণত হতে হয়; তাঁকে জানতে হয় জনগোষ্টীর দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতার শতাব্দীপ্রাচীন সমস্যাবলি, সংসদ ও সরকার-ব্যবস্থার যাবতীয় খুঁটিনাটি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিভিন্ন অর্থনৈতিক তত্ত্ব, সমকালীন বিশ্বের পরিস্থিতি; তাঁকে বুঝতে হয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সম্ভাবনা ও ঝুঁকিসমূহ। লেখক বারবার তাঁর পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, আমেরিকা এবং তার সহযোগীরা ভারত-পাকিস্তানের মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করার জন্য রাজনৈতিক তৎপরতা চালায় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধের মতবাদকে জোরদার করার লক্ষ্যে; আধুনিক শিল্পায়ন না করে তারা চিরপ্রাচীন কৃষির ওপর জোর দিতে চায় – যেন অর্থনৈতিক সংগ্রামে তারা বিশ্ব পরিমণ্ডলে পরিভ্রমণ করতে না পারে; আর বিদেশি হস্তক্ষেপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকার প্রত্যয়ে গড়ে-ওঠা জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারাকে তারা প্রশ্রয় দিতে চায় না কিছুতেই। ক্ষুদ্র দলবিশেষকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনের আগে জোটপাকানো এবং বিজয়লাভের পরে জোটের শরিক হিশেবে তাদেরকে মূল্যায়ন না-করার যে নোংরা পলিসির কালচারে আমরা অভ্যস্ত, তার গতি-প্রকৃতিও লেখক বুঝাতে চেষ্টা করেছেন আমেরিকান-পাকিস্তানি কৌশল-নির্ধারণ-আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে।
শিল্পকারখানায় শ্রমিকনির্যাতন আর শ্রমিকবিদ্রোহ দমনের অমানবিক-অগণতান্ত্রিক নিয়মধারা বিষয়ক কিছু রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধে পাঠক ধারণা লাভ করেন এই উপন্যাসটির পাঠ থেকে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বেশি বেতনভোগী বিদেশি কর্মকর্তার প্রয়োজনীয়তা, সার্বভৌম একটি দেশের শৃঙ্খলাবাহিনির সদস্যের বিদেশপ্রভূনির্ভরতা, রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড, ঘটে-যাওয়া কোনো দুর্ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি নিয়ে সত্য-মিথ্যার খেলা প্রভৃতির চিত্রকে সামনে দাঁড় করিয়ে লেখক আমাদের অসামর্থ্যরে জাতীয় চরিত্রকেই প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন মাত্র। ‘আবছায়া দিগন্তে ফ্যাকাশে চাঁদ’, ‘ভয়’, ‘প্রাচীন গাছপালার বৃষ্টিস্নাত শীর্ষদেশ’, ‘যুবকের ছায়া’ এবং ‘যুবকের মনস্থির’ প্রকৃতির কথামালায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ হতাশা আর আশাবাদের মায়াচ্ছন্নতার আবেশ নির্মাণ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন বলে মনে করা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাসঙ্গিক দাবি ও বিক্ষোভ এবং প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর দেশি-বিদেশি শাসক ও নিয়ন্ত্রকদের জুলুম-অন্যায়ের ছবিও ওয়ালীউল্লাহ এঁকেছেন দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে। সরকারের কোনো দায়িত্বশীল [ক্ষমতাশীলও নিশ্চয়] ব্যক্তির বক্তব্যের সমালোচনা করার জন্য সংবাদকর্মির ওপর অবিচারের খড়গ চাপানোর যে দৃশ্য আমরা আজও অবলোকন করি, আজ থেকে চল্লিশ কিংবা ষাট বছর আগের সে রকম পরিস্থিতির কথাই লেখক আমাদের সামনে হাজির করেছেন। ‘নতুন সরকার দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির যে কোনো রকম ষড়যন্ত্র কঠোর হাতে গুঁড়িয়ে দেবে’ মর্মের বাণীকে বিবেচ্য রেখে কাহিনিকার তাঁর পাঠককূলকে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অবস্থান, সুবিধাভোগী ও তাবেদার উপাচার্য ও পুলিস বাহিনির নির্লজ্জতা – নির্বিচারে গুলি ও হত্যা, আর প্রতিবাদি ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষার্থী ও প্রচারমাধ্যমকর্মির দিনলিপি-রাতপঞ্জির বাস্তবতার ছায়াছবির ভাষ্য ও চিত্রাবলি। কয়েকটি উদ্ধৃতি থেকে আমরা বুঝতে পারবো দেশের প্রতি নিমগ্ন মানুষের অসহায়তা, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের অস্পষ্ট অবস্থান, সচেতন মানুষের বিভ্রম আর বিভ্রম-উত্তরণ-ভাবনার কথামালা :
[ক] “বিকেলে ছাত্ররা জড়ো হলে তিনটি ভ্যানবোঝাই বেয়নেটধারী পুলিশ নীরবে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বাইরে অবস্থান নেয়। স্তব্ধ ও অশুভদর্শন খাকি পোশাকের সশস্ত্র পুলিশ দেখে কিছু যুবকের মনে ভীতি সঞ্চারিত হয়, বাকিদের মনে পোস্টার-কথিত রহস্য আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠে। এরপর আর পিছু হটা চলে না।”
[খ] ‘‘কাসেমকে এখানে-সেখানে সাইকেল থামাতে হচ্ছে, বারবার নবতে হচ্ছে, কারণ অন্যদের মতো উইন্ডশিল্ডের ভেতর ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে পেশাগত পরিচয়পত্র মেলে ধরার সামর্থ্য তার নেই, এ জন্য যখন সে মন্ত্রীর কক্ষের করিডোরে পৌঁছায়, ততক্ষণে সেখানে বেশ বড়সড় ভিড় জমে গেছে।… একজন কর্মকর্তা সবার হাতে একটি করে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে যায়। তাতে বড়জোর দশ-বারটি বাক্য লেখা। তারা যতোক্ষণে পড়ে, মন্ত্রী তাঁর কাজ চালিয়ে যান। কর্মকর্তাটি অন্ধকার কোণে মিশে যায়।
কাসেম দ্রুত দশটি লাইন পড়ে ফেলে, তারপর পৃষ্ঠা উল্টে দেখে উল্টোপিঠে কিছু আছে কি না, তারপর দেয়ালের দিকে চেয়ে বসে থাকে।… তথ্যবিবরণীতে একটি ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে, ষড়যন্ত্রটি পাকিয়েছে কতিপয় রাষ্ট্রবিরোধী পক্ষ ও রাজনীতিবিদ, যারা ’চিহ্নিত বিদেশী শক্তির’ পক্ষ হয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালায়।”
[গ] “উপাচার্য নিজে পুলিশকে দায়মুক্ত করেছেন। বলেছেন, পুলিশ ভুল করেনি।”
বিরাট ক্যানভাসের এই উপন্যাসটিতে মর্যাদার সাথে উপস্থাপিত হয়েছে ভিনদেশি উন্নয়নসংস্থার লক্ষ্য ও কার্যাবলি, তাদের কাজ সম্বন্ধে দেশের মানুষের ভাবনা ও মত-প্রকাশে অংশগ্রহণ; প্রসঙ্গত, স্পষ্টভাবেই, রূপলাভ করেছে লেখকের অভিপ্রায়। কথানির্মাতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ধারণা শিক্ষা-সমাজ-কৃষি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ইচ্ছার কথা বলে, দূরদেশ [বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র] থেকে আগত, যে সকল সমাজকর্মি ধর্মপরায়ণতা-মানবপ্রেম-কর্তব্যজ্ঞানকে আশ্রয় করে আমাদের দেশে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কাছে সহানুভূতি ও সহযোগিতা কামনা করে, তারা মূলত ওই জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে চায়। এ রকম আস্থা বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পলিসি প্রচারের সাথে মারাত্মতভাবে জড়িত; এমন চিন্তাও লেখকের ভাবনারাজিকে আন্দেলিত করে; তিনি এমন তথ্যও [গল্পে] পরিবেশন করেছেন যে, এই সমাজ-উন্নয়নকর্মিরা সরকার এবং নির্বাচন-ব্যবস্থার সাথেও নানানরকম আঁতাত করে, আমজনতাকে প্রকৃতপক্ষে তারা ভালোবাসে না। তাই, তিনি তৈরি করছেন এমন এক আবহ, যাতে করে দরিদ্র এই দেশটির পিছিয়ে-থাকা মানুষগুলো তাদের অধিকার ও মর্যাদা সম্বন্ধে সতর্ক হতে শেখে। একজন স্থানীয় প্রশাসক আর বিদেশ-আগত একজন এনজিও কর্মির কথোপকথনের মাধ্যমে কাহিনিকার সেই সম্ভাবনার ইঙ্গিতই রচনা করছেন বলে মনে হয়। তিনি লিখছেন:
“জেলা কর্মকর্তা পূর্ববৎ চিন্তাচ্ছন্ন হন। ঘরে গভীর নিস্তব্ধতা নামে। এন্ড্রুর অস্থিরতা কাটে না।
‘আপনারা এমন একটি জিনিস [আস্থা] দাবি করছেন, যা দেওয়া কঠিন’, প্রবীণ ভদ্রলোক অবশেষে বলেন, ’আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, কিছুই চাওয়ার নেই মনে করে কাজ করে যান। যদি সত্যি প্রত্যাশা ত্যাগ করতে পারেন, আরো ভালো।’
এন্ড্রুর চোখমুখের কোণ ঈষৎ কুঞ্চিত হয়। শান্ত ভঙ্গিতে সে জিজ্ঞাসা করে, ‘তাহলে আমরা কাজ করব কেন?’
’সেটি তো আপনাদের সিদ্ধান্ত।’
এন্ড্রু কিছুক্ষণ বসে থেকে একসময় উঠে পড়ে। করমর্দনের সময় সে জেলা কর্মকর্তার দিকে তাকায় না।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের নৌবিহারের আমোদে আড়ালে লেখক স্থাপন করেছেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চোরাগলি আর দুর্বল সরকারকে উৎখাত করার জন্য সেনা অফিসারদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারাদি; দেখিয়েছেন এশীয় এই দেশটির মানুষের মাত্রাতিরিক্ত আতিথেয়তার ঐতিহ্য, তথ্য-পরিসংখ্যানের দিক থেকে ভয়ানকভাবে পিছিয়ে থাকার বাস্তবতা আর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বাড়াবাড়ির কিছু প্রসঙ্গ। জাদরেল ব্যবসায়ী ইদ্রিসের আমন্ত্রণে, তারই বিলাসবহুল নৌযানে, নদীভ্রমণে রাষ্ট্রদূত হথর্ন, এমন সময় খবর পেলেন নতুন এই দেশটিতে সেনাবাহিনি ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র প্রায় গুছিয়ে এনেছে; তাকে সংবাদটি দিয়েছে এ দেশের গোয়েন্দসংস্থার আধুনিকায়ন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা [অবশ্য তার অবস্থান কূটনীতিকদের কাছে গভীর রহস্যময়] হ্যারি রাইট। হথর্ন এ ধরনের সংবাদে সন্দেহ পোষণ করেন। কেননা, তাঁর জানা মতে:
“পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির অধিকাংশ নেতা কারাবন্দি। ছাত্র বা শিক্ষকরাও বেশি কিছু করতে পারবে না, কারণ শুধু যে বিঘ্নসৃষ্টিকারীরা কারারুদ্ধ তা-ই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলিও সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
সেনাবাহিনির ‘কতিপয় তরুণ লেফটেন্যান্ট সরকারকে উৎখাত করতে’ পারবে বলে তাঁর মনে হয না; আর যদি তা ঘটেও, তাতে মার্কিনমুলুকের তেমন কিছুই যায়-আসে না। কারণ, প্রত্যেক সেনাসদস্যের ‘প্রতিটি পালিশ করা বোতামের ঔজ্জ্বল্যে মার্কিন ডলার ঝিকমিক করে’ আর ভাবনার অতলে থাকা ‘নিরপেক্ষবাদ’ তারা কখনোই প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। অন্যদিকে ষড়যন্ত্র প্রতিফলিত হবার আগেই যখন তা আবিষ্কৃত এবং তা মার্কিনিদের হাতেই, কাজেই আর কোনো শঙ্কা নেই। আরেকটি বিষয়ও ভেবে নেন রাষ্ট্রদূত হথর্ন। তা হলো:
বোকামিঘেরা আদর্শবাদের তাড়নায় অবাস্তব দ্রুত গতিতে দেশের উন্নয়ন ঘটানোর চিন্তায় কিংবা তাড়াহুড়ো করে পদোন্নতি নেওয়ার লোভে তারা এ রকম ষড়যন্ত্রের পথে হাঁটতে পারে; কিন্তু মার্কিন পলিসির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস এই সেনাবাহিনির নেই।
দেরিতে হলেও খরবটি পৌঁছে স্বদেশি পুলিসপ্রধানের কাছে; তার শ্যালক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সরবরাহ করে খবরটি। খবরটি জানার পর পুলিসপ্রধানের ভাবগতিক সম্বন্ধে আমরা ধারণা পাচ্ছি লেখকের বর্ণনা থেকে :
[ক] “পুলিসপ্রধানের মুখে নাটকীয পরিবর্তন ঘটে; শঙ্কায় না কি স্বস্তিতে, বোঝা যায় না। নিঃসন্দেহে তার ভেতরে পরস্পরবিরোধী অনেক অনুভূতি একত্রে ক্রিয়া করছে।”
[খ] “আমার চৌহদ্দির মধ্যে যা পড়ে না, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ আমার নেই।”
অন্যদিকে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানের অভিব্যক্তি, চিন্তাধারা, আচরণ এবং কর্তব্য-নির্ধারণের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক তাঁর পাঠককে বোধকরি জানিয়ে রাখতে চেয়েছেন যে, চরম সংকটে কিংবা অঢেল সুবিধা পাবার প্রত্যাশার কাছাকাছি অবস্থান করেও কিছু মানুষ দেশের সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা জানাতে ভুল করে না। স্বদেশের সম্ভ্রম কিংবা অস্তিত্ব রক্ষায় নিবেদিন-প্রাণ কিছু মানুষ সব সময়ই থাকে, তা আমরা বিশ্বাস করি। বর্তমান কাহিনিতে বিবৃত গোন্দোপ্রধানের দেশলগ্নতার বাস্তবতা আমাদেও ওই চেতনাকে আরো শাণিত করে কেবল। এবার আমরা জেনে নিই স্বদেশের এই বন্ধুটির উপলব্ধির, বহিঃশক্তি কিংবা আগত সহযোগির অথবা দেশীয় দায়িত্বশীলদের কর্তব্য-অঞ্চল সম্বন্ধে তাঁর অনুভবজ্ঞানের, স্তরবিন্যাসপর্যায়সমূহ:
[ক] “আমাদের উপদেশ দেওয়ার জন্যই সে এসে থাকলে উপদেশ বিতরণের মধ্যেই তার সীমাবদ্ধ থাকা উচিত, অন্য কিছুতে নয়। গোয়েন্দাগিরির কী কী নতুন কৌশল বেরিয়েছে, সেসব শিক্ষা সে আমাদের দিতে পারে, কিন্তু এতদিন আমরা এখানে কী বানিয়েছি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না। আমাদেরে মতামত সে নাও মানতে পারে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা ভুল। ভুল তো তারও হতে পারে।”
[খ] “আমি না কি মার্কিনবিরোধী।”
[গ] “আমি পদত্যাগ করবোই, বলে সে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করে। ভেতরটা তিক্ত মনে হয় তার। ভাবে, পুলিশপ্রধানের সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই, কারণ তিনি তার অভিজ্ঞতাকে চোখের ঠুলি হিসেবে ব্যবহার করেন।”
জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার আর ভিনদেশি চাটুকারিতাজনিত নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তির জন্য যে জাগরণ দরকার, তার অনুভব সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নাড়া দিয়েছে প্রবলভাবে। সে অনুভবেরই শৈল্পিক প্রয়াস তাঁর ‘কদর্য এশীয়’।