[স্বকৃত নোমান। বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ঔপন্যাসিক। গত দু-বছর ধরে তিনি লিখেছেন ‘কালকেউটের সুখ’ নামের একটি উপন্যাস। বইটি এবারের বইমেলায় জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সঙ্কট এ উপন্যাসের বিষয়। উপন্যাসটি লেখার সময় বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন এ সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কুলদা রায়]
কুলদা রায় : ‘কালকেউটের সুখ’ উপন্যাসটি লিখতে শুরু করলেন কেন? গল্পের বীজ কিভাবে পেলেন? বীজটি কীভাবে বিস্তার ঘটালেন?
স্বকৃত নোমান : ২০১৩ সাল। একুশে বইমেলায় আমার ‘হীরকডানা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হলো। পরবর্তী উপন্যাস কী নিয়ে হবে ভাবছি। মার্চের শেষের দিকে তরুণ লেখক বন্ধুবর শাহান সাহাবুদ্দিনের জন্য কনে দেখতে মাগুরায় যাই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কনেকে বর পছন্দ করলেন না, কিংবা বরকে কনে পছন্দ করলেন না। মনের দুঃখে শাহান বললেন, চলুন আমরা খুলনায় চলে যাই। আমি তো ভ্রমণপাল মানুষ, রাজি না হয়ে পারি? শুরু হলো আমাদের পরিভ্রমণ। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কটি জেলা আমরা ভ্রমণ করলাম সেবার।
আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সুন্দরবন দেখতে যাব, সাতক্ষীরার শ্যামনগর। তার আগে যাত্রাবিরতি করলাম খুলনার ডুমুরিয়ায় নীলিমাদের বাড়িতে, যিনি স্থানীয় একটি ইউনিয়ন চিকিৎসাকেন্দ্রে চাকরি করেন। তাঁর সঙ্গে শাহানের আগে থেকে যোগাযোগ, কারণ তিনিও অল্পবিস্তর লেখালেখি করেন। তাঁর কন্যা তন্নী লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত।
সেদিন দুপুরে আমরা নীলিমার বাড়িতে খেলাম। বেশ ভালোই আপ্যায়ন করলেন। আলাপের এক পর্যায়ে জানতে পারি সম্প্রদায়গতভাবে নীলিমা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী, যাঁদের সুন্নি মুসলমানরা ‘কাদিয়ানি’বলে থাকে, যাঁরা পাকিস্তানের তাত্ত্বিক (সুন্নী মুসলমানদের দৃষ্টিতে যিনি বিতর্কিত, কাফের) গোলাম আহমদ কাদিয়ানির তত্ত্বের অনুসারী। অপরদিকে নীলিমার মা হিন্দু ধর্মের অনুসারী। কিন্তু মা-মেয়ে একই বাড়িতেই থাকেন। মা পুজা-অর্চনা করেন, মেয়ে নামাজ পড়েন। দুজনের দুই ধর্ম পালনে কোনো সমস্যা হয় না। জানতে পারি, নীলিমার প্রয়াত বাবা হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছিলেন এবং নীলিমার আরো দুই বোন মুসলমান। এক বোন ও এক ভাই ধর্মান্তরিত হননি, তারা যথারীতি হিন্দু ধর্মের অনুসারী। নীলিমার বাবাবাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার সুন্দরবন ঘেঁষা যতীন্দ্রনগর গ্রামে, যেখানে আমাদের যাবার কথা।
ব্যাপারটা আমাকে খানিকটা বিস্মিত করল। বিশেষ করে নীলিমা ও তাঁর মায়ের যৌথ বসবাসের ব্যাপারটা। কারণ আমি যে জায়গায় যে পরিবেশে যে পরিবারে বড় হয়েছি সেখানে হিন্দু-মুসলমান একত্রে একই বাড়িতে বসবাস প্রায় অকল্পনীয়, অসম্ভব। খুনোখুনি হয়ে যাবে। নীলিমাদের পারিবারিক কাহিনি শুনে আমার মধ্যে একটা উপন্যাসের বীজ বপিত হয় তখনই। আমার মধ্যে একটা ঘোর সৃষ্টি হয়। সিদ্ধান্ত নেই আজই যতীন্দ্রনগর চলে যাব। আমার মনে হয়েছিল আমি একটা প্লট পেয়ে গেছি। এটাকে ধরতে হবে। আজই। হারিয়ে যাবার আগেই। কিন্তু নীলিমা ও তাঁর কন্যা তন্নীর সঙ্গে শাহান আড্ডায় এতটাই ডুবে গিয়েছিলেন যে আমার বারবার তাগাদা সত্বেও তিনি ওই বাসা থেকে বেরুচ্ছিলেন না। আমি তো অস্থির। এক পর্যায়ে শাহানের সঙ্গে রাগারাগিও করি। শাহান আমার ওই ঘোর, ওই অস্থিরতা হয়ত বুঝতে পারছিলেন না। না বোঝারই কথা। কে জানে, হয়ত বুঝেছিলেন।
যাই হোক, পড়ন্ত বিকেলে আমরা যতীন্দ্রনগরের উদ্দেশে যাত্রা করি। নীলিমার ছোট বোন দীপালি ও ভাতিজি নীলাঞ্জনার নামের সঙ্গে আমি পরিচিতি, তাঁরা ইতোপূর্বে আমার লেখাজোখা পড়েছেন, অল্পবিস্তর লেখালেখি তাঁরাও করেন। তখন আমি সংবাদ ম্যাগাজিন ‘সাপ্তাহিক’-এর সহসম্পাদক। ডাকযোগে তাঁরা ‘সাপ্তাহিক’-এর ‘ডাকবন্ধু’বিভাগে নানা বিষয়ে লেখা পাঠাতেন, আমি সেগুলো যত্নসহ ছাপতাম। কারণ তাদের লেখা ছিল ভালো। লেখালেখির সুবাদে তাঁদের সঙ্গে সাহাবুদ্দিনের আগে থেকেই ভালো সম্পর্ক। তাঁরা যতীন্দ্রনগরেই থাকেন। তাঁদের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে রাত প্রায় বারোটা বেজে গেল।
পরদিন একটা ডিঙা নৌকা নিয়ে দিপালি, নীলাঞ্জনা, মোহন ও শাহানসহ সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকি। আমি নৌকার গলুইতে বসা। দীপালি খালা বলছিলেন, ‘এদিকটায় হামেশা বাঘ আসে।’ওই ‘হামেশা’শব্দটি আমাকে এমনভাবে প্রভাবিত করল, পুরো উপন্যাসের কাহিনিটা যেন ওই শব্দটার মধ্যেই লুকায়িত ছিল। মনে মনে ঠিক করি উপন্যাসটির নাম হবে ‘হামেশা’; যদিও পরে এই নাম আর থাকেনি।
কুলদা রায় : কোনো আউটলাইন করে নিয়েছিলেন উপন্যাসটির?
স্বকৃত নোমান : হ্যাঁ, আউটলাইন একটা করেছিলাম। আউটলাইন করতে গিয়ে দেখি, নীলিমা খালা বা তন্নী বা দীপালি বা নীলাঞ্জনার কাছ থেকে আমি তাদের পরিবারের যে কাহিনিটা শুনেছিলাম সেটা থাকল না। কাহিনিটা ছড়িয়ে পড়ল আরো বিস্তৃত পরিসরে। ইতিহাসকে ধারণ করল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সংকট ঢুকে পড়ল। সমকালীন রাজনৈতিক ও সমাজিক বাস্তবতাও ইন করল। মূল কাহিনির নব্বই ভাগই হারিয়ে গেল। পরে তো লিখতে গিয়ে আউটলাইনটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
কুলদা রায় : এই উপন্যাসটি লেখার জন্য কি কোনো ধরনের ফিল্ডওয়ার্ক করেছিলেন? করলে কতবার সুন্দরবন এলাকায় গিয়েছেন? সেখানে কী কী বিষয় আপনাকে লক্ষ করতে হয়েছে? লেখা শুরু করার পরে কি আবার গিয়েছিলেন?
স্বকৃত নোমান : ফিল্ডওয়ার্ক তো করতে হয়েছে বিস্তর। মে কি জুনের দিকে আমি আবার সুন্দরবন যাই উপন্যাসের পটভূমির মানচিত্রটাকে রপ্ত করার জন্য। চুনকুড়ি, রায়মঙ্গল, মালঞ্চ, কালিন্দি ইত্যাদি নদীর গতিপথটা আমাকে দেখে নিতে হয়েছে। উপন্যাসটির মূল পটভূমি যতীন্দ্রনগর গ্রাম। গ্রামটির পূর্বদিকে চুনকুড়ি নদী, নদীর ওপারে সুন্দরবন। পশ্চিম দিকে কালিন্দী নদী। কালিন্দীর ওপারে ভারতে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা। এই ভুগোলটা আমাকে বুঝতে হয়েছে। কিন্তু সচেতনভাবে আমি আর যতীন্দ্রনগরে গেলাম না। কারণ আমার কেবলই মনে হয়েছে আমি যদি ফের ওই গ্রামে যাই, তাহলে কাহিনির যে বাস্তবতা, তার মুখোমুখি হলে কাহিনিটা আমার কাছে পানসে হয়ে যাবে। আমি গ্রামটাকে স্মৃতিতে পাঠিয়ে দিতে চাইলাম অভিজ্ঞান তৈরির জন্য। পারলামও।
এরপর সুন্দরবনের উপর অনেক বই সংগ্রহ করলাম। শ্যামনগর, যতীন্দ্রনগর বা সুন্দরবন অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য খুঁজে বের করলাম নানা সূত্র থেকে। ওই গ্রামের পাশ্ববর্তী গ্রাম হরিনগর। সেখানে থাকেন নীলিমা খালার স্বামী আকরাম। যতীন্দ্রনগর গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার ফোন নম্বরটি নিয়েছিলাম। ঢাকায় ফিরে তার সঙ্গে এবং নীলাঞ্জনার সঙ্গে প্রায়ই কথা বলতে শুরু করি। নানা বিষয়ে জানতে চাই। কোনো কোনোদিন দু-আড়াই ঘণ্টাও কথা হয়। তাঁদের কাছ থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে নিয়েছি নানা তথ্য-উপাত্ত।
যখন অনুভব করলাম উপন্যাসটি লেখার মতো যথেষ্ট পরিমাণ রসদ আমার মাথায় জমা হয়েছে তখনই আমি লিখতে শুরু করি। লেখা শুরুর পর আর ওই এলাকায় যাইনি। যাওয়ার দরকার মনে করিনি। কারণ আগেই বলেছি, গেলে আমি বাস্তবতার মুখোমুখি হতাম, যে বাস্তবতা আমার কল্পনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করত।
কুলদা রায় : এই লেখাটির জন্য কী কী ধরনের বইপত্র পড়েছেন? কেন পড়েছেন?
স্বকৃত নোমান : দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধের উপর নানা বই পড়েছি। সাম্প্রদায়িক সংকটের উপরও বেশ কিছু বই পড়েছি। দুই খণ্ডে ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ এবং ‘সাতক্ষীরার উপভাষা : স্বরূপ ও স্বাতন্ত্র’ বইটাও পড়ে ফেলি। সুন্দরবনের উপর যেখানে যে বই পেয়েছি সংগ্রহ করে পড়েছি। কিন্তু আঙ্গিকটা ধরতে পারছিলাম না। আঙ্গিকটা ধরার জন্য স্প্যানিশ ও কিছু রুশ উপন্যাস পড়ি, বাংলা অনুবাদের। পাশাপাশি দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ ও ‘তিস্তাপুরাণটা’ আবার পড়ি। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ উপন্যাসটা পড়ার চেষ্টা করি, যদিও শেষ করতে পারিনি এটি। পড়ি আর পড়ি, কিন্তু কিছুতেই আঙ্গিকটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পড়াপড়ি বাদ দিয়ে কদিন ঝিম মেরে থাকি।
হঠাৎ একদিন, রাত দেড়টায় ঘুমাতে বিছানায় গেলে দারুণ উত্তেজনা অনুভব করি। শব্দরা আমার মাথায় কিলবিল করতে থাকে। আমি শোয়া থেকে উঠে দ্রুত খাতা-কলম নিয়ে বসে যাই। সে-রাতেই উপন্যাসটার লেখা শুরু হয়। দু-পৃষ্ঠার মতো লিখেছিলাম সেদিন।
কুলদা রায় : উপন্যাসটি লেখার আগে-পরে কি কোনো সিনিয়র লেখক বা এডিটরের পরামর্শ নিয়েছিলেন?
স্বকৃত নোমান : মোটেই না। এই কাজটি আমি কখনোই করি না। ঔপন্যাসিক হিসেবে আমি কী লিখছি, আমার উপন্যাস কী হয়-না-হয় সে বিষয়ে আমি সচেতন থাকি। অর্থাৎ আমি জানি যে আমি কী লিখছি। মানে কতটা ভালো লিখছি বা কতটা খারাপ লিখছি সে বিষয়টা আমি বুঝি। আমি মনে করি, প্রত্যেক ঔপন্যাসিকই একেকজন ঈশ্বর। তার কোনো শরীক নাই। তিনি একা, সয়ম্ভু; তার জগতে তিনি সর্বশক্তিমান। তার কোনো সাহায্যকারীর, পরামর্শকের প্রয়োজন হয় না। লেখার দুনিয়ায় তিনি যা ইচ্ছে লিখবেন।
কুলদা রায় : লেখাটি লিখতে লিখতে কি কখনো রাইটার্স ব্লকে আক্রান্ত হয়েছিলেন? কখনো কি মনে হয়েছে যা লিখতে চেয়েছেন সেটা হচ্ছে না। বা আদৌ কিছু হচ্ছে না, বা সূত্র হারিয়ে যাচ্ছে? এই রাইটার্স ব্লক যদি হয়ে থাকে তাহলে কীভাবে কাটিয়ে উঠলেন?
স্বকৃত নোমান : হ্যাঁ ব্লকে আক্রান্ত হয়েছিলাম। একবার। সেটা ছিল ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা। কাহিনিটা কোনোভাবেই আমি এগিয়ে নিতে পারছিলাম না। উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র কেশব মাস্টারকে অপহরণ করে সুন্দরবনের দস্যুরা। তার অপহরণের পর লেখক হিসেবে আমি নিজেও যেন অপহৃত হয়ে গেলাম। আমার লেখাও। কাহিনিটা কোনদিকে মোড় দেয়াবো কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না। দিনের পর দিন অপেক্ষা করি। লিখতে পারি না। কেবলই মনে হতে থাকে, ধুত্তুরি! প্রান্তিক মানুষের জীবনের এসব ক্যাঁচাল-প্যাঁচাল লিখে কী লাভ? এসব কে পড়বে? লিখে আমারই-বা কী লাভ? পড়ে পাঠকেরই-বা কী লাভ? একটা ফালতু কাজ। অহেতুক সময় নষ্ট করছি। লিখবই না উপন্যাসটা। তার চেয়ে বরং গল্প লিখি বা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখতে শুরু করি। তাও করা হয় না। কিছু না করে আড্ডা দেই, এখানে ওখানে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি।
একদিন শাহবাগে বিশেষ একজন মানুষের সঙ্গে কথা হয়। এটা হয়ত আমার ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা যে, সবসময় আমার মনে হয়, আমি যা কিছু লিখি সবই তার জন্য। তিনি পড়বেন বলেই লিখি।
সেদিন অনেকক্ষণ তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে যখন বাসায় ফেরার জন্য তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হচ্ছিলাম তিনি পেছন থেকে ডাক দিলেন। বললেন, একটা কথা বলব?
বললাম, বলুন
: না, থাক।
: আরে বলুন তো।
: আপনি কখনো লেখা ছাড়বেন না। লেখাই আপনার সৌন্দর্য। মনে থাকবে তো?
আমি কী উত্তর দিয়েছিলাম জানি না। সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়েছিলাম। তার কথা কটি শুনে কেন যেন প্রচণ্ড আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। কেন জানি না। বাসায় এসে খেয়েদেয়ে লিখতে বসে যাই। সে-রাতেই ওই যে ব্লকটার কথা বললাম, সেটা ছুটে যায়। এক প্রচণ্ড ভাবাবেগ আমাকে পেয়ে বসে। কম্পিউটারে আমি লিখতে শুরু করি। মনে আছে, যখন লিখছলাম কীবোর্ডে খুব শব্দ হচ্ছিল। এত দ্রুত কম্পোজ করছিলাম যে, আমার পাশে কেউ থাকলে তিনি আমার আঙুলগুলো স্পষ্ট দেখতে পেতেন না হয়ত। রাত তিনটা নাগাদ প্রায় সাত কি সাড়ে সাত হাজার শব্দ লিখে ফেললাম। লেখা শেষে আমি দরজা বন্ধ করে খুব কেঁদেছিলাম। এটা আমার মাঝে মাঝেই হয়। অহেতুক কাঁদি। পরে ওই কান্নার জন্য নিজেই নিজের কাছে লজ্জা পাই।
কুলদা রায় : যে চরিত্রগুলো নির্মাণ করলেন তাদের সঙ্গে কি বাস্তবে কোনো ব্যক্তির মিল আছে? এরা কি কোনোভাবে আপনার অভিজ্ঞতার ভেতরে ছিল?
স্বকৃত নোমান : হ্যাঁ, মিল আছে। তবে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির সঙ্গে নয়, মিল অসংখ্য ব্যক্তির সঙ্গে। প্রতিটি চরিত্রে আমার চেনা-পরিচিতি অসংখ্য মানুষের স্বভাব-চরিত্র যোগ হয়েছে। যেমন ধরুন কেশব মাস্টার চরিত্রটা, এই চরিত্র যখন লিখি তখন বিস্ময়করভাবে তাঁকে কখনো কখনো আমার বাবা বলে মনে হয়েছিল। তার মানে আমার বাবার চারিত্রিক কিছু বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে স্থাপিত হয়েছে। আবার কখনো কখনো মনে হয়েছে তিনি আমার এলাকার গুম হয়ে যাওয়া ভক্ত মজুমদার। তার জায়গাজমি দখলের জন্য মুসলমানেরা তাকে গুম করেছিল। সেই রহস্য আজো অনুদঘাটিত। কিংবা আমি যখন দীপিকা চরিত্রটি দাঁড় করাচ্ছিলাম আমার মনে হচ্ছিল দীপিকার সঙ্গে আমার ইমিডিয়েট বড়বোনটার বেশ মিল। কিংবা আলাউদ্দিন চরিত্রটার সঙ্গে আমার এলাকার কবির মোল্লা নামক এক লোকের, যিনি আমার চাচা সম্পর্কীয়, মিল আছে।
কুলদা রায় : উপন্যাসটি শেষ করে এক লেখায় আপনি লিখেছেন আপনাকে কয়েকটি লড়াই করতে হয়েছে। শব্দের সঙ্গে লড়াই, বাক্যের সঙ্গে লড়াই, কাহিনির সঙ্গে লড়াই, আঙ্গিকের সঙ্গে লড়াই। লড়াই সংলাপের সঙ্গে এবং চরিত্রের সঙ্গেও। এই লড়াইটি বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বলুন।
স্বকৃত নোমান : উপন্যাস লেখা মানে তো ভুখণ্ড জয় করা। পটভূমিটাই ভুখণ্ড। ভুখণ্ড জয় তো লড়াই ছাড়া হয় না। আর উপন্যাসের লড়াই তো কুরুক্ষেত্রে ভীম-অর্জুনের লড়াইয়ের চেয়েও দুন্ধুমার। অর্জুনকে তো কৃষ্ণ হেল্প করে। ঔপন্যাসিকের তো কৃষ্ণ-ভগবান কেউ থাকে না, যে কথা আগেই বলেছি। ঔপন্যাসিককে প্রচণ্ড শক্তির, ধৈর্যের অধিকারী হতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেবিলে বসে থাকতে হয়। একেকটি চরিত্র শত্রুর মতো আচরণ করতে শুরু করে, প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তারা ঠিক আমার নিয়ন্ত্রণে থাকতে চায় না। নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয়। যেমন কেশব মাস্টারকে আমি দোষে-গুণে মানুষ দেখাতে চাই, অথচ তিনি বারবার ফেরেশতার মতো আচরণ করেন। আরে কী আশ্চর্য! মানুষ আবার ফেরেশতা হয় নাকি! অতএব তার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে।
আর শব্দের সঙ্গে তো হামেশা লড়াই করতে হয়। এই শব্দটা না দিয়ে ওটা দিলে কেমন হয়! যেমন শ্যামনগর অঞ্চলের মানুষ ‘সবসময়’কে বলে ‘হামেশা’, ছেলেকে বলে ‘ছাওয়াল’ বা ‘ছাবাল’। তাহলে আমি কোনটা লিখব? ছেলে, ছাওয়াল না ছাবাল? ফলে ‘সবসময়’, ‘হামেশা’, ‘ছেলে’, ‘ছাওয়াল’ আর ‘ছাবালে’র সঙ্গে আমাকে তুমুল লড়াই করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে দুটার – সংলাপে ‘ছাওয়াল’আর বর্ণনায় ‘ছেলে’ লিখেছি।
শব্দচয়নের ব্যাপারে আমি খুব খুঁতখুঁতে। যথাযথ শব্দ বসাতে পারিনি বলে কোনো কোনো সময় দু-চার দিন লেখা বন্ধও রাখতে হয়েছে। একইভাবে লড়াইটা বাক্যের সঙ্গেও, কাহিনির সঙ্গে তো বটেই, যা ইতোপূর্বে বলেছি। লেখার সময় প্রতিটি পর্ব অন্তত দশ বার এডিট করি স্ক্রীনে। প্রতি পর্ব আবার প্রিন্ট নিয়ে একবার এডিট করি। পুরো লেখা শেষ করে তিনবার প্রিন্ট নিয়ে এডিট করি। তার মানে প্রায় বিশ-পঁচিশবার এডিট করতে হয়। তাহলে বুঝুন লড়াইটা। এ লড়াই ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে যতক্ষণ পর্যন্ত না ছাপার উপযুক্ত হয়ে প্রকাশকের হাতে যাবে।
কুলদা রায় : আপনার উপন্যাসের অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে ইতিহাস, কিংবদন্তী। এক্ষেত্রে আপনার যাত্রা স্বতন্ত্র। এই ইতিহাসলগ্নতার কারণ কী? এর সঙ্গে কি আপনার আগ্রজ সেলিম আল দীনের কোনো প্রভাব কাজ করেছে?
স্বকৃত নোমান : আমার সব উপন্যাস কিন্তু ইতিহাসলগ্ন নয়। যেমন ‘জলেস্বর’-এর কথাই ধরুন। উপন্যাসটির বিষয় কিন্তু ইতিহাস নয়। বেদে সম্প্রদায়ভূক্ত সান্দারদের জীবন নিয়ে এটি লেখা। কিংবা ‘বেগানার’ কথাই ধরুন, এটি রোহিঙ্গাদের নিয়ে লেখা। একেবারেই সমকালীন বিষয়। বাকি চারটি উপন্যাস অবশ্য ইতিহাস ও কিংবদন্তী কেন্দ্রিক। ইতিহাসের প্রতি আমার এক ধরনের দুর্বলতা আছে। আর বাঙালি মানুষের জীবনে কিংবদন্তী তো একটা উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে আছে। বাংলাদেশে কত হাজার হাজার কিংবদন্তী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসব কিংবদন্তী নিয়ে কয়েক শ উপন্যাস লেখা যাবে। কিন্তু লেখা কি হয়েছে খুব বেশি? কিংবা আমাদের উপন্যাসে কি কিংবদন্তী ওভাবে এসেছে?
আর, সমকালীন বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখার প্রতি আমার বিশেষ কোনো আগ্রহ কাজ করে না। কেননা সমকালীন বিষয়ের শুরুটা আমরা জানি, শেষটা কিন্তু জানি না। তার মানে উপন্যাসের পরিণতিটা সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল নই। যেমন ধরুন সাভারের রানা প্লাজা নিয়ে বিশাল পটভূমিতে একটা উপন্যাস লেখা সম্ভব। কিন্তু এই ঘটনার রেশ তো এখনো চলমান, শেষটা কোথায় গিয়ে ঠেকে তা আমরা কেউ জানি না। কিংবা শাহবাগের গণজাগরণের কথাই ধরুন। এই জাগরণ কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি, চলমান। কেউ যদি গণজাগরণ নিয়ে উপন্যাস লেখেন সেটা আমি মনে করি না সম্পূর্ণ উপন্যাস হবে।
কে জানে, এগুলো হয়ত সঠিক উত্তর নয়, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যই হয়ত বলা। আসল কথা হচ্ছে ইতিহাস ও কিংবদন্তীর প্রতি আমার এক ধরনের প্রীতি আছে। আর সেলিম আল দীনের প্রভাব থাকার প্রশ্নই আসে না। অনেকে মনে করতেন বা করেন আমার লেখায় সেলিম আল দীনের প্রভাব আছে। আমার প্রথম উপন্যাস ‘নাভি’ বা ‘ধুপকুশী’তে (পরিবর্তিত নাম বংশীয়াল) হয়ত তাঁর প্রভাব আছে। কিন্তু পরবর্তী কোনো উপন্যাসে তাঁর বিন্দুমাত্র প্রভাব কেউ আবিস্কার করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। আমি সচেতনভাবেই তাঁর প্রভাব প্রত্যাখ্যান করেছি। আর তিনি লিখেছেন নাটক, আমি লিখি উপন্যাস। দুজনের দু-ধারা। প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ নেই।
কুলদা রায় : আপনার অন্য উপন্যাসের সঙ্গে এই উপন্যাসের পার্থক্য কী? নতুন কী?
স্বকৃত নোমান : মূল পার্থক্য হচ্ছে, নিকট অতীতের বাংলাদেশের যে সমাজ বাস্তবতা, সেটা এই উপন্যাসে কিছুটা ধরতে পেরেছি বলে আমার মনে হয়। কাহিনিতে নতুনত্ব আছে, বয়ানেও নতুনত্ব আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক ক্রাইসিস নিয়ে বড় পরিসরে কেনো উপন্যাস রচিত হয়েছে, আমার ঠিক জানা নেই। বিচ্ছিন্নভাবে হয়ত কোনো কোনো উপন্যাসের সাম্প্রদায়িক ক্রাইসিস এসেছে। কিন্তু এই উপন্যাসটির পুরোটাই সাম্প্রদায়িক ক্রাইসিস। নতুন কী আছে সেটা বোধকরি পাঠকই সবচেয়ে বেশি ভালো বলতে পারবেন।
কুলদা রায় : বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। নির্যাতনকারীদের প্রথম পছন্দ হিন্দু এবং কাদিয়ানী। এদের পক্ষে কথা বলাটাও বিপজ্জনক। ভারতের দালাল-মুরতাদ ইত্যাদি অভিধা জোটে। অথবা নির্বাসন। আপনি এই হিন্দু, কাদিয়ানীদের চরিত্র করে লেখার সাহস করলেন কীভাবে?
স্বকৃত নোমান : সাহসটা তো আমাকে দিয়েছে শিল্প। আমি প্রথমে যাচাই করে দেখেছি হিন্দু বা কাদিয়নী নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঠিক শিল্পীতভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব কি না। যখন উপলব্ধি করতে পারলাম যে সম্ভব, তখনই আমি লিখতে শুরু করি। প্রকৃত শিল্পী তো কোনো কিছুকে ডরায় না। কোনো বিশেষ গোষ্ঠী যদি আমার উপর ক্ষিপ্ত হয় তাতে আমার কিচ্ছু যায়-আসবে না। সমস্ত পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো সাহস আমার আছে। এই সাহস আমি অর্জন করেছি নিরন্তর পাঠের মধ্য দিয়ে। নিশ্চয়ই পাঠ আমাকে সাহসী করে তুলেছে। দালাল বললে আমার কী যায় আসে। মুরতাদ হলেই বা অসুবিধা কী? ওসব আমি থোড়াই কেয়ার করি।
কুলদা রায় : এই উপন্যাসটির পরে নতুন কি লেখা শুরু করেছেন? বা পরিকল্পনা করছেন?
স্বকৃত নোমান : এটা তো সবে লেখা শেষ হয়েছে। মানে কঙ্কালটা দাঁড়িয়েছে। এখনো মাংসা জোড়া দেয়ার বাকি। প্রচুর এডিট করতে হবে। এটা পুরোপুরিভাবে শেষ করার আগে অন্য কিছু লেখার তো প্রশ্নই আসে না। তবে পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা এখনো মাথায়। কয়েকটা বিষয় আমার সামনে আছে। এ বছর আর তা নিয়ে ভাবছি না। আগামি বছর হয়ত শুরু করব। বিরতির খুব দরকার।