তিন ফর্মার ছোট্ট বই। অথচ মুগ্ধতায় ঠাসা। বইটি পড়া শুরু করতেই পাঠক চলে যান এক ঐতিহাসিক জাদুবাস্তবতায়। গোলাপ ফুলের জন্মরহস্য নিয়ে বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীদের গবেষণা, ঈশ্বরের মতো এক তরুণ কবির উপস্থিতি, গোলাপ মেয়ের ভালোবাসার থরোথরো গল্প হাজিরের জন্য লেখকের যথাযথ প্লাটফর্ম খোঁজার কায়দা নিশ্চয়ই মুগ্ধ করবে পাঠককে। গোলাপ মেয়ের সাথে স্বর্গযাত্রা উপন্যাসিকাটি হাতে নিয়ে পড়া শুরু করতেই পাঠক টের পান ভিন্নতর গল্প বলার ঢঙ। লেখক দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজান অভূতপূর্ব সব দৃশ্যকল্প দিয়ে, যা বাস্তব না হলেও পাঠককে টেনে নিয়ে যায় অসম্বভ এক কল্পিত বাস্তবতার কাছে। গল্পের কিছু দূর যেতেই দেখা মেলে ভুবনজয়ী চিত্রকর ভিনসেন্ট ভ্যানগগকে। যিনি গোলাপ মেয়ের সূর্যমুখী বাগানে বসে ছবি আঁকার লোভে ছুটে আসেন বাংলাদেশ।
মিথ, রুপকথা আর জাদুবাস্তবতার ঢঙে লেখক বলে চলেন এক তরুণ-তরুণীর অপেক্ষা, অভিমান আর সুখের গল্প। বইটি নাসিমূল আহসান-এর প্রথম মলাটবন্দী হওয়ার প্রচেষ্টা হলেও গল্প বলার ঢং, সৃষ্টিশীলতা, শব্দ ও বাক্যের বুনন দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। গোটা বইটিকে লেখক ১২টি ছোট ছোট খণ্ডে ভাগ করে নিয়েছেন। প্রতিটি খণ্ডকে দিয়েছেন আলাদা নাম। পাঠক এক ঝটকায় এই নামগুলো দেখেও পরোখ করে নিতে পারেন বইটির কাব্যময়তার স্বরূপ। এছাড়া এগুলো ঘটনার গন্তব্যকেও আন্দাজ করতে সহায়তা করবে পাঠককে। বইটিতে ব্যবহৃত অলঙ্করণগুলো দেখলে প্রথমেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেন অনেকে। বাংলাদেশের প্রচলিত অলঙ্করণের ধরণ, কাঠামো ও দৃশ্যমান বৈশিষ্টসমূহ ভেঙে শিল্পী মোঃ শফিকুল ইসলাম পরাবাস্তবতার সাথে হাজার বছরের বাঙালি শিল্পকলার মিশেলে উপস্তাপন করেছেন এক যাদুবাস্তব জগত। পাঠক পাতা উল্টালেই প্রতিটি অলঙ্করণে খুঁজে পাবেন আলাদা আলাদা গল্পের সুর, যা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে গোটা বইয়ের ঘটমান বাস্তব-অবাস্তবসমূহের সাথে।
নাসিমূল যে জগতের কথা কল্পনা করেন, তার দেখা বাস্তবে মেলে না। কিন্তু পাঠকের কল্পনাশক্তি একে একে সবকিছু তার চোখের সামনে হাজির করে। রূপকথা, মিথ আর আমাদের সাহিত্য-ঐতিহ্য থেকে লেখক হাজির করেন আলাদিনের দৈত্য, চাঁদের বুড়ি, ব্যাঙ-রাজপুত্র, পদ্মাবতী, ভিনসেন্ট ভ্যানগগ আর মহাকবি আলাওলকে। প্রবল ক্ষমতাবান দানবাকৃতির আলাদিনের দৈত্য হাজির হন এক অসম্ভব সুন্দর রোমান্টিক চরিত্রে। দৈত্য গোলাপ মেয়ের প্রেমিককে বলতে থাকেন, – শোন সাহেব, আমার নতুন জামা-কাপড় চাই। চাই আলো ঝকমকে টুপি। সুগন্ধি আতরও লাগবে। গোলাপ মেয়েকে দেখতে যাবো, আর একটু সাজগোজ না করলে লোকে বলবেটা কী! – গোলাপ মেয়েকে দেখার জন্য গ্রিক মিথের পৃষ্ঠা ছেড়ে ঢাকার পথে উড়ে উড়ে আসে এক পঙ্খিরাজ ঘোড়া। সারা গায়ে হীরের ফুল, গলায় মুক্তোর মালা জড়িয়ে পঙ্খিরাজ অপেক্ষায় থাকে গোলাপ মেয়েকে দেখার জন্য। লেখক গল্পের নায়ককে দৈত্যের পিঠে চড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে যান গোলাপ মেয়ের গাঁয়ে। যে গাঁয়ে গেলে পাঠক খুঁজে পাবেন এক অনিন্দ্য সুন্দর ঝরনা। যে ঝরনায় পানির বদলে সারাদিন টুপটাপ করে ঝড়ে পড়ে শিউলি-বকুল ফুল। সাদা-হলুদ ফুলের পাপড়িরা ঝরনার জল বেয়ে ভেসে যায় কর্ণফুলি নদীতে। যে গাঁয়ে প্রতিদিন ফুলের গন্ধে ঘুম ভাঙে গ্রামবাসীর।
ভালোবাসার মানুষকে এক নজর দেখার জন্য মানুষের যে প্রবল আকুলতা, লেখক সেগুলোকে তুলে এনেছেন প্রবল মমতায়। গোলাপ মেয়ের অপেক্ষার যাতনা বোঝাতে গিয়ে লেখক বলতে থাকেন, – ভালোবাসার মানুষটাকে দেখবে, তাই গোলাপ মেয়ে প্রতিদিন এসে দাঁড়ায় পৃথিবীর সব বাসস্টপে। সবুজ পাতায় হলদে খাতায় লিখে রাখে প্রেমের অশ্রুসজল যত চিরকুট আর হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে সেগুলো পৌছে যায় প্রেমিকের শহরে। কালো মেঘ ওর চোখের কাজল। প্রজাপতিরা চুলের ক্লিপ। অপেক্ষা কেবল বাড়ে! প্রেমিককে জড়িয়ে কখন চুলে কাটবে বিলি? নাকে ঘষে দেবে নাক? প্রেমিকার জন্য প্রেমিক দিনরাত এক করে লিখতে থাকে তিন হাজার পৃষ্ঠার চিঠি। আর প্রেমিকের অপেক্ষা, শুকনো শুকনো মুখ রবীন্দ্রনাথ মুচকি হেসে বলেন, যাও ভালোবাসো’।
এভাবেই ভ্যানগগ থেকে রবীন্দ্রনাথ, পদ্মাবতী থেকে চাঁদের বুড়ি, ব্যাঙ-রাজপুত্র থেকে আলাদিনের দৈত্য এসে মিশে যায় গোলাপ মেয়ের সাথে স্বর্গযাত্রা বইটিতে। সবাই মিলে গোটা গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে যান। কোঁকড়া চুলের প্রেমিক ছেলেটি কখন গোলাপ মেয়ের দেখা পাবে, তাই নিয়ে যেন সবারই অপেক্ষা! বইজুড়ে এমন অসংখ্য অপেক্ষার জাল বুনতে বুনতে লেখক এগিয়ে নেন ঘটনা। মহাকবি আলাওল পদ্মাবতীর দেশে যাওয়ার নিমন্ত্রন জানান প্রেমিক যুগলকে। পঙ্খিরাজ ডান ঝাপটিয়ে, আলাদিনের দৈত্য আর চাঁদবুড়িকে নিয়ে সবাই ছুট দেন সিংহল দ্বীপে। পুকুর ঘাটে পা ডুবিয়ে ফিসফিসিয়ে গল্প করেন পৃথিবীর সুন্দরতম দুই নারী। স্বর্গ খুঁজতে বেরিয়ে গোলাপ মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় দুঃখী এক দেশের। অনেক পাঠক হয়তো বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হিসেবে এটাকেই বিবেচনা করতে চাইবে। বইটির নাম শুনে পাঠক যে অলৌকিক স্বর্গের কল্পনা তৈরি করেন, লেখক সেটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেন। গোলাপ মেয়ের সামনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে হঠাৎ দেখা হওয়া ছোট্ট, মিস্টি একটা দেশ। অবিশ্রান্ত অশ্রুজলে গোটা চোখটাই ঘা হয়ে গেছে যার। আহা, অন্ধ চোখে পথ খুঁজে ফিরছে গোলাপ মেয়ের প্রিয়তম স্বদেশ। প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার মিস্টি গল্পের খামে লেখক পুরে দেন দেশপ্রেম আর মাতৃত্বের এক অভাবনীয় দৃশ্যকল্প। দেশটির কাছে গিয়ে গোলাপ মেয়ে জানতে চান, – ও ছোট্ট মিষ্টি দেশ; তুমি কাঁদছো কেনো? তোমার কি হয়েছে ভাই? – উত্তরে দেশটি জানায়, – এই যে দেখো মানুষ হাঁটছে, ঘুরছে, রাজনীতি করছে, পরীক্ষা দিচ্ছে, পাস করছে, ঘুষ খাচ্ছে, আমার নদী, আকাশ, মাঠ, ধানক্ষেত, সুন্দরবনকে খুন করছে, কিন্তু কারো কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। কেউ আমাকে একবারও জানতে চায় না, ও দেশ তুমি কেমন আছো? – লেখক দেশকে দিয়ে বলিয়ে যেতে থাকেন, – দেখো আমার আঁচল কেমন ছিঁড়ে গেছে! এমন শাড়ি নিয়ে ঘর থেকে বেরুনো যায়, বলো? আমার সম্মান গেলে কার কি এসে যায়? মানুষগুলো নির্দয়ের মতো আমার পথে পথে বিছিয়ে রাখে কাঁটা। চারপাশে শুধু নেকড়ে আর নেকড়ে। আমার ছোট্ট হরিণশাবক, খরগোশ ছানা, মনুষ্যশিশুদের উপর ওরা হামলে পড়ে প্রতিদিন! ছিঁড়ে খুড়ে খায়!
গোলাপ মেয়ের সঙ্গে প্রিয় দেশের এমন কথোপকথন অসহায় করে তোলে পাঠককে। গোলাপ মেয়ে যেমন পা ছড়িয়ে বসে বুকের মধ্যে টেনে নেয় প্রিয় জন্মভূমিকে, তেমনি পাঠকও এখানে নিজের দেশের দূরবস্থার কথা ভেবে আবেগগ্রস্থ হয়ে ওঠে। গোলাপ মেয়ের স্নেহ আর অফুরান যতেœ একটু একটু করে নিজের দেশকে সুস্থ হয়ে উঠতে দেখে পাঠককের সাহস আর স্বপ্নে পালে লাগে দোলা। পাঠক দেখতে পান, দেশটির সুস্থ চোখে ফুটে উঠেছে আলো। নেকড়েরা ভুলে যাচ্ছে অন্ধকারের গান। সচিবালয়, মন্ত্রনালয়, সংসদভবন হয়ে উঠছে গন্ধরাজের বাগান। বুড়িগঙ্গা সুগন্ধির নহর। পুলিশ আর র্যাবের সদস্যরা গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। গোলাপ মেয়ে গান ধরে, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…। আর এভাবেই আমাদের চিরচেনা বাংলাদেশ বাস্তব-অবাস্তব অতিক্রম করে লেখকের কল্পনায় হয়ে ওঠে সত্যিকারের স্বর্গ। গোলাপ মেয়ে প্রেমিকের হাত ধরে হেঁটে যায় স্বর্গ স্বর্গ দেশের সব পথঘাট। স্বর্গের কল্পিত ছবি না এঁকে লেখক পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন নিজস্ব বাস্তবতায়। চিন্তা ও কল্পনাশক্তির বলে পাঠককে নিয়ে যান এমন এক কাম্য মূহুর্তে, যা তাকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। নরনারীর মানবিক আবেগ-অনুভূতির পাশেই পাশেই বেড়ে ওঠে দেশপ্রেমের ছোট্ট সবুজ চারা। সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখার এক চিলতে জানালা।
চারপাশে আমাদের সম্পর্কগুলো যখন ভেঙে পড়ছে, সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছে, তখন আবেগ জাগানিয়া এমন একটি বই পাঠকের ভালো লাগবে বলেই বিশ্বাস। এক নিঃশ্বাসে গোটা বইটা পড়া শেষ করে কেউ হয়তো নিশ্চয়ই বলবে, আহ্, অনেকদিন পর সুখজাগানিয়া একটি বই পড়লাম! লেখককে ধন্যবাদ, পাঠককে কল্পনা করার এই স্পেসটুকু তৈরি করে দেয়ার জন্য।
গোলাপ মেয়ের সাথে স্বর্গযাত্রা
নাসিমূল আহসান
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৫
প্রকাশক: পলল প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : দেওয়ান আতিকুর রহমান