‘কাঞ্চনগ্রাম’ শামসুদদীন আবুল কালামের (১৯২৬-৯৭) কততম উপন্যাস সে প্রশ্ন সাধারণভাবে বিশেষ গুরুতর না হলেও প্রশ্নটির উত্তর অজানা থাকায় এটি প্রমাণিত হয তিনি আমাদের কাছে যথেষ্ট সমাদর পাননি। চল্লিশ বছর বিদেশ বাস এবং বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গন থেকে তাঁর স্বেচ্ছা নির্বাসন নিশ্চয়ই এর জন্য অনেকখানি দায়ী। কিন্তু ‘কাঞ্চনগ্রাম’-এর মত ৫৭৪ পৃষ্ঠার মহাকাব্যিক এক উপন্যাস প্রত্যাশিত আলোড়ন সৃষ্টি করতে না পারায় এ ক্ষেত্রে আমাদের দারিদ্রও প্রমাণিত হয় বটে। ‘শাহেরবানু’, ‘পথ জানা নাই’, ‘অনেক দিনের আশা’, ‘ঢেউ’, ‘দুই হৃদয়ের তীর’, ‘পুই ডালিমের কাব্য’, ‘মজা গাঙ্গের গান’ প্রভৃতি গল্পগ্রন্থ এবং ‘আলমনগরের উপকথা’, ‘কাশবনের কন্যা’, ‘কাঞ্চনমালা’, ‘জীবনকাণ্ড’, ‘জায়জঙ্গল’, ‘সমুদ্রবাসর’, ‘নবান্ন’, ‘যার সাথে যার’, ‘মনের মতো ঠাঁই’ প্রভৃতি উপন্যাস ছাড়াও তাঁর অন্তত পাঁচটি গ্রন্থ এখনও অপ্রকাশিত।
আবুল আহসান চৌধুরীকে লেখা এক পত্রে তিনি অপ্রকাশিত যে গ্রন্থগুলোর নাম জানিয়েছিলেন সেগুলো হলো: ‘নাট্যমণ্ডপ’, ‘ক্ষীরসায়রের উপন্যাস’, ‘পাল তোলা নাও’, ‘ঢেউ ভরা নদী’ ও ‘সাগর ঠিকানা’। আত্মীয় এ. এম হারুণ অর রশীদের এক লেখা থেকে শামসুদদীন আবুল কালামের আরও দুটি অপ্রকাশিত গ্রন্থের নাম জানা যায় যেগুলো হলো ‘কল্যাণীয়াসু’ এবং ‘ক্যামেলিয়াকে চিঠি’ (উল্লেখ্য উপরোক্ত দুটি সূত্রই সেলিনা বাহার জামান সম্পাদিত ‘শামসুদদীন আবুল কালাম স্মারক গ্রন্থ’ থেকে গৃহীত)। শামসুদদীন আবুল কালাম তাঁর একাত্তর বছর জীবনের প্রায় চল্লিশ বছর পাকাপাকিভাবে রোমে বসবাস করলেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর আগ্রহ এবং চর্চা আদৌ কমে নি। সর্বশেষ প্রকাশিত উপন্যাস ‘কাঞ্চনগ্রাম’ শুধু তাঁর নয় সমগ্র বাংলা উপন্যাস জগতের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন এ কারণে যে এটি বিষয় এবং আঙ্গিক উভয় নিরিখেই অসামান্যতা অর্জন করতে পেরেছে।
‘কাঞ্চনগ্রাম’-এর বিষয় কী? মূল উপন্যাস থেকে এর উত্তর খোঁজার আগে দেখা যাক এ বিষয়ে লেখকের নিজের অভিমত কেমন। “… আমার জন্মভূমির মানুষের জীবন সংগ্রামের ছোট-বড় কিছু কাহিনী বর্ণনার চেষ্টা করেছি; ক্রমে ক্রমে মনে গভীর অনুপ্রেরণা অনুভব করেছিলাম যে, একটা ব্যাপক জীবন-চেতনা ও অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে তাকে উপস্থাপন হয়ত আরো সার্থক ও কার্যকরী হবে।’ (আবদুল মতিন ‘কাঞ্চনগ্রাম’-এর ‘পাণ্ডুলিপি প্রসঙ্গ’-তে শামসুদদীন আবুল কালামের এ উদ্ধৃতি দিয়েছেন)। লেখক আরও জানিয়েছেন, “… কোন বিশেষ জনপদ, গোষ্ঠী অথবা চরিত্রসমূহের হুবহু আখ্যান নয়; বরং বিভিন্ন দৃষ্টিকোন হতে মৌল জীবনবাসনাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষার চেষ্টা, একই সঙ্গীতের মূলধারা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ও কণ্ঠের স্বননে উপস্থাপন একটি অভিজ্ঞানকে রূপ-কল্পদানের প্রয়াস; …বরং কোন দূর বীক্ষ্যণে একটি কল্পিত জনপদ এবং তাহার মধ্যে ও বাহিরে বিভিন্ন প্রকার জীবনান্দোলনকে অনুধাবনের প্রয়াস করিয়াছি মাত্র।’ আর বইটির ফ্লাপে যে দীর্ঘ বক্তব্য উদ্ধার করা হয়েছে তা নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস’ থেকে। এবং এসব থেকেই পাঠক সহজেই বুঝে নিতে পারেন ‘কাঞ্চনগ্রাম’ প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির সহস্র বছরের দীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্যেরই শিল্পরূপ। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দুই দশকের ইংরেজি উপন্যাস এবং জেমস জয়েসের Ulysses নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে Arthur Honeywell যেমনটি বলেছেন ‘Novelists lost interest in constructing logical or rational sequences and turned to the third possibility, that of structuring the events of the novel so as to present a coherent world or vision of reality; (Plot in the Modern Novel) তেমনই ‘কাঞ্চনগ্রাম’ যেন একটি vision of reality-র প্রতিরূপ যা আত্মস্থ করেছে বাঙালির সুদূর অতীতের সকল ঐতিহ্যের সংস্পর্শ থেকে শুরু করে প্রাক-মুক্তিযুদ্ধকালের বাঙালির সামগ্রিক চেতনাকে। কোন বিশেষ ব্যক্তি নয়, একটি সামগ্রিক চিত্রনির্মাণ এর লক্ষ্য এবং প্রত্যয়। আর সকল বিচারে এ উপন্যাসের protagonist তাই হয়ে ওঠে এ জনপদ যা বহু অর্থেই great বলেই উপন্যাসটি great হয়ে উঠতে পারে সহজেই। ‘Great literature is great because its characters are great, and characters are great when they are memorableÕ (The Concept of Character in Fiction by William H. Gass)। বাস্তবের স্মরণযোগ্য (memorable) সে-ভূমিকে উপন্যাসেও স্মরণযোগ্য করে তুলেছেন শামসুদদীন আবুল কালাম।
দেড় পৃষ্ঠায় ‘মাঙ্গলিক’ এ লেখকের আকাঙ্ক্ষার ঘটেছে নৈর্ব্যক্তিক ভাষারূপ। তারপর ‘উপক্রমণিকা’ দিয়ে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ‘উপসংহার’-এ। মোট পঁচিশটি অধ্যায় ৫৬৩ পৃষ্ঠা ব্যাপৃত। তবুও শেষ হতে চায় না। আধা পৃষ্ঠার একটি ‘পরিশিষ্ট’ দরকার হয়। যেমন আরম্ভটিও সহজে ঘটেনি। সর্বপ্রথম ‘বোধিসত্ত্বদান কল্পলতা’ থেকে উদ্ধৃতি আধা পৃষ্ঠার মত। তারপর ফরাসি লেখক ও দার্শনিক মার্সেল প্রুস্তের একটি সংক্ষিপ্ত বাক্য ‘বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করে আমাদের স্মৃতির মধ্যে’। এবং তারও অনেক পর ‘মাঙ্গলিক’-এর আগে বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখা থেকে উদ্ধৃতি। ‘…A life confined to what is personal is likely, sooner or later, to become unbearably painful’ – আর সেজন্যেই ব্যক্তিজীবনের যে সংকট শামসুদদীন আবুল কালামকে দেশান্তরী হতে বাধ্য করেছিল তা থেকে মুক্তি পেতে তিনি এমন সাহিত্য রচনাতে নিবদ্ধ হলেন যা impersonal-এর বাড়া। ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সামগ্রিক এই চেতনা লেখক ‘কাঞ্চনগ্রাম’-এ মুখ্য করে তুলেছেন কোন বিশেষকালে প্রেক্ষাপটের নয় বরং সুদীর্ঘকালের সমন্বিত অনুধাবনের ভেতর দিয়ে।
দীর্ঘ এ উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে একটি ছোট গ্রামকে কেন্দ্র করে, যার নাম ‘কাঞ্চনগ্রাম’। নদীধৌত এ গ্রাম রাজধানী শহরের কাছাকাছি। অনুমান হয় সোনারগাঁওয়ের নিকটবর্তী। কেমন করে এলো এ নাম। বৌদ্ধস্তূপ কাঞ্চনপুরী থেকে? “সেইখানের [কাঞ্চনগ্রামের] প্রায় সমস্ত অধিবাসীরা আরও ধনাঢ্য ছিল সন্দেহ নাই। অথচ তেমনই ছিল [সোনারগাঁওয়ের মতন] নগরপুরী অথবা সাধারণ গ্রামের দপ্তর। একটা আদর্শ। ভাঙা-আধাভাঙা বাড়িঘরগুলিতে কেবল মহারাজাদের প্রাসাদের অনুকরণই নয়, বিদেশী ঔপনিবেশিক যুগের জীবনযাত্রার প্রভাব ষ্পষ্ট” (পৃ. ২৬) এমন যে গ্রাম তার কিন্ত কোন ইতিহাস নাই যদিও পাহাড়পুর-মহাস্থানগর, মোয়েঞ্জোদারো-হরপ্পার রয়েছে লিখিত ইতিহাস। এমন যে গ্রাম যে তো আসলে সমগ্র সমতট অঞ্চলেরই প্রতিভূ। আর তার জনমানুষ? “আমরা ছিলাম এই মুলুকের বাসিন্দা, সকল রকম বৌদ্ধ রীতিনীতি আছিলো আমাদের ধর্মকর্ম। কিন্ত কবে কোন এক সময় হিন্দুরা বড় অত্যাচার শুরু করে, তার জের কাটাইয়া উঠতে না উঠতেই আসলো মুসলমানরা। তখন তাদের আপস মানিয়া লওন ছাড়া আর কোন গত্যন্তর আছিলো না” (পৃ. ৭৭) – উপন্যাসের প্রধান চরিত্র জালাল মিঞা তার কন্যাতুল্য কদভানুকে নিজের যে ইতিহাস বলেছে তাতো সমতট অঞ্চলের সকল জনমানুষেরই ইতিহাস। তারপর এসেছে ইংরেজ। ক্রমে ক্রমে সব হাতছাড়া হয়ে গেছে। তারও পর “একদিকে দূর শহরে মসজিদের সম্মুখে বাজনা বাজাইবার অধিকার লইয়া মারামারি, অন্যদিকে নদীর মধ্যে চরের দখল লইয়া মুসলমান-কৈবর্ত-নমশূদ্রদের মধ্যে যুদ্ধ, তাহার উপর ইংরেজ না স্বরাজ ইত্যাদি বিষয় লইয়া চতুর্দিক হইতে যেন ঘোর বিপর্যয়ের মেঘ রুষিয়া-ফুঁসিয়া ছড়াইয়া পড়িতে শুরু করিয়াছিল সর্বত্র” (পৃ. ৪৪)। এভাবেই সারা উপন্যাস জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইঙ্গিত যার পূর্ণ বুনন নির্মাণ করে একটি পূর্ণরূপ – এ বঙ্গভূমির অতীত বিষয়ে। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর সে ইতিহাস এমন “একদিক দিয়া হিন্দু দূর দূর করে, আরেক দিক দিয়া সব পাকিস্তানি নয়া মুসলমানরাও কেমন হিন্দু হিন্দু ভাবে, তাদের কাছে কোন্টা হিন্দু আর কোন্টা বৌদ্ধ আচার তার তেমন সূক্ষ্ম বাছ-বিচার নাই, তাদের নিজ ধর্মের ধ্যান-জ্ঞান ও এই দেশের আসল সব জিনিসগুলোরেও আপন করিয়া লইতে পারে নাই” (পৃ. ৭৭)। সে পাকিস্তানের পর্বের শেষকালে যখন “মনে কয় শহরের দিকে বেশ বড় রকমের গ-গোল লাগিয়া গেছে” (পৃ. ৭২) শুরু হয় ‘কাঞ্চনগ্রাম’-এর উপাখ্যান।
সামগ্রিক পরিধিতে হাজার বছরের বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতি ‘কাঞ্চনগ্রাম’-এর বিষয় হলেও যে কাহিনী নিয়ে এত সব আবর্তন তার বিস্তার কিন্তু শীর্ণ – উত্তেজনার শুরু থেকে যুদ্ধশুরুর ঢাকা শহর পর্যন্ত। সারা উপন্যাস জুড়ে ইতিহাস ঐতিহ্যের এলাকার বর্ণনার ভেতর বারবার ঐ ‘গণ্ডগোলে’র আভাস এসে পৌঁছেছে কাঞ্চনগ্রামের মতো দূর প্রত্যন্ত এলাকাতেও। আগুনের সে ছোঁয়া থেকে বাচাতে নিজেদেরকে একতাবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করেছেন কাঞ্চনগ্রামবাসী। পাক সেনাবাহিনী ও তাদের দেশিয় দোসরদেরকে প্রতিরোধের মোকাবিলায় তারা যূথবদ্ধ। স্বাধীনতার স্বপ্ন বাসনায় তাদের অঙ্গীকার যৌথ এবং সুদৃঢ়।
এ যূথবদ্ধতার উৎস কোথায়? – প্রকৃত উৎস ঐ হাজার বছরের ঐতিহ্যের মধ্যেই। সুদীর্ঘকাল ধরেই এ জাতি ‘ঝড়-ঝঞ্জা, বন্যা-তুফান, এমনকি অন্য আপদ বিপদেও তো সকলে একজোট হইয়া তাহার মোকাবিলা করিয়াছে’ (পৃ. ৫৩)। আর তার ক্ষয় এবং ধ্বংস শুরু হয়েছে তখনই যখন তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে একে অন্যের কাছ থেকে। এ বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি ঘটেছে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে – যার ইঙ্গিত শামসুদদীন আবুল কালম দিয়েছেন কাঞ্চনগ্রাম-এর সমাপ্তিতে এসে। জয়নাল শেখদের মতো কয়েকজন যারা পাকিস্তানি শক্তিকে কুর্নিশ করে দেশকে গোলাম বানিয়ে রাখতে চায় তারা বাদে বাকি শতসহস্র সব গ্রামবাসী একতাবদ্ধ। লক্ষ্য তাদের এক, একই পরিকল্পনায় তারা আদিষ্ট। এ সম্মিলনের কারণেই স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালির মুক্তি লাভ।
বিবিধ প্রসঙ্গে এই যে বিস্তারণা তা কি কোন গল্পকে আশ্রয় করে ঘটে নি? ঘটেছে, তবে তার সূক্ষ্মতা অনস্বীকার্য। কেননা, প্রচলিত কোন গল্প পূর্ণাঙ্গরূপে এ উপন্যাসের ভেতর দিয়ে উঠে আসে নি। গল্পের যে আভাসটুকু ঘটে তা উপন্যাসের মূল থীমকে অগ্রসরণের প্রশ্নেই। সে গল্পের মূল সূত্রধর জালাল মিঞা, প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা যার নেই – যদিও প্রজ্ঞার প্রকাশ তার সকল আচার-আচরণে। সে জালাল মিঞার বাড়িতে আশ্রিতা রূপা যার স্বামী কিনা দীর্ঘকাল নিরুদ্দেশ। রূপার ছেলে কানু এবং মেয়ে কদভানু সব স্নেহ-ভালোবাসার ভেতরেই জালাল মিঞার বাড়িতে ক্রমবর্ধমান। এ পরিবারের সাথে যুক্ত আবদুল মাস্টার গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। যুব শক্তির প্রতিনিধি মাস্টার তেমনই একজন যে কিনা বিনা যুক্তি-তর্কে মেনে নিতে রাজি না সেই ‘গণ্ডগোলে’র পরিণতি যুদ্ধকে। জালাল মিঞার বাড়িতে যাতায়াত আছে মাস্টারের। জালাল মিঞার একান্ত ইচ্ছা কদভানুর সাথে মাস্টারের বিয়ে দেবেন। চারপাশে রয়েছে আরও অনেক চরিত্র। ছোট ছোট সেগুলোর ভেতর থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে জনার্দন কর্মকার, হেদায়েতুল্লাহ, দবিরদ্দি, কালুর মা, মকবুল খাদেম, শিমুলী বা শ্যামলী প্রমুখ। এরাসহ আরও অনেককে নিয়ে তৈরী একটি সমাজ যা ভাঙনের দীর্ঘ অতীতের পর যূথবদ্ধ স্বাধীনতা অর্জনের প্রত্যয়।
উপন্যাসের প্রথম অর্ধেক ঘরে কাহিনীর এমন কিছু অগ্রসরণ ঘটে নি। শুধুমাত্র অমঙ্গলের আশঙ্কার ঘটেছে পুনরাবৃত্তি। গ্রামবাসী পরিকল্পনা করেছে প্রতিরোধের, সান্ত্বনা নিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিবেশীর পাশে। কিন্তু আশঙ্কা তীব্র হয়ে ওঠে যখন গ্রামে অচেনা মানুষের আনাগোনা লক্ষিত হয়। অজানা আশঙ্কার তীব্রতায় জালাল মিঞার মত প্রজ্ঞাবান পুরুষও নীতিগত আশ্রয়ের প্রত্যাশী হন। শহরে ছোটেন উকিলের সাথে পরামর্শের আশায়। লক্ষ তার দুটি – রূপাকে কাগজে কলমে তার স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া এবং সম্পত্তির উইল করা। দুরাত্মারা কেড়ে নেবে এ ভাবনা থেকে জালাল মিঞার এ পরিকল্পনা। এবং এ সময়েই দেখি ঘটনাশ্রোত দ্রুত অপসৃয়মান। জালাল মিঞা শহর থেকে ফেরার আগেই অন্ধকারে আক্রমণ ঘটে জালাল মিঞার বাড়িতে। সজাগ ও কৌশলী থেকেও রূপা ও কানু-কদভানু প্রাথমিক পর্যায়ে পরাস্ত হয়েও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এবং সবশেষে কানু বল্লমহাতে অংশ নেয় আবদুল মাস্টারদের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে।
জালাল মিঞা এবং আবদুল মাস্টার ছাড়াও মকবুল খাদেম, জনার্দন কর্মকার, দবিরদ্দি প্রমুখ প্রভূত ইঙ্গিতবাহী। যেমন মকবুল মামা মসজিদের মৌলভী হলেও ধর্মান্ধতায় সে বিশ্বাসী নয়। ইসলামের নামে পাকিস্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তার ভাবনা “ধর্মের নাম ভাঙ্গাইয়া অধর্মের কাম কোন্ দেশেই বা কখন না হইছে” (পৃ. ৮২৭)। নির্দ্বিধ চিত্তে মকবুল খাদেম ঘোষণ দেয় “দ্বীন দীনিয়াতের বিষয় লইয়া রাজনীতি কি ব্যবসা করনের সাধ্য আমারও নেই” (পৃ. ৪৩০)। আবার অন্যদিকে জনার্দন কর্মকারের মত একজন হিন্দুর ওপর ভার পড়ে মসজিদে কোরআন শরীফ রাখার জন্য রেহেল নির্মাণের। জনার্দন কর্মকার সে রেহেল নির্মাণ করে গভীর মমতা এবং যত্নে। দবিরদ্দি জন্ম-পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এ দেশে যে তার জন্ম সে বিষয়ে সে নিশ্চিত। আর তাই সারা গ্রাম জুড়ে প্রতিরোধের নেটওয়ার্ক নির্মাণে দবিরদ্দি অগ্রণী ভূমিকায়।
`কাঞ্চনগ্রাম’ উপন্যাসে এমন বিষয় প্রচুর যেখানে বিবিধ মত ও ভাবনার সুযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক ইতিহাস-সংক্রান্ত আলোচনা নিয়ে সম্ভাবনা বেশি। যেমন মতভিন্নতা কোন কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়েও সম্ভব। এবং শামসুদদীন আবুল কালামের সাফল্য এই তিনি ইতিহাসের সত্যকে বিবৃত করেছেন, কোন বিশেষ ব্যক্তির অভিমত ব্যক্ত করেন নি। লেখক যখন উপন্যাসে ইতিহাস পরিক্রমায় রত থাকেন তখন ক্রমান্বয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সুভাস বসু, কায়েদ-ই-আজম, ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেক ব্যক্তিত্ব। মন্তব্য-পাল্টা মন্তব্যের ভেতর দিয়ে ইতিহাসের বিশ্লেষণও পাঠককে প্রীত করে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মকবুল খাদেমের ভাবনা “মিটিংয়ে মিটিংয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ জমায়েত হইতে আছে ঠিকই, কিন্তু অত্তো বড় একজন নেতারে লইয়া যারা মঞ্চ সাজাইয়া বসতে আছেন, তারা যখন বারবার হাত উঠাইয়া সমর্থন দেখাইতে বলেন, নেতারেও সেই কথাটা স্মরণ করাইয়া দেন, তখন কেন যেন মনে কয় “কোনখানে কিছু ফাঁক আছে” (পৃ. ২৮২)। অথবা ফজলুল হকের কর্মকা- নিয়ে জালাল মিঞার বক্তব্য “যার সাহস পায় নাই হিন্দুরা, তারও বেশি করলো তারই নিজ সমাজের শিষ্যেরা, যাদের তিনি হাত ধরিয়া হাঁটাইতে শিখাইছিলেন। তা-ও আবার যার সাহস করে নাই পাকিস্তানি পশ্চিমারাও, তাদের ছড়াইয়া গেল বাঙালি মুসলমানেরা। আমি এখনও যেন বিশ্বাস করিয়া উঠতে পারি না কি কার্যকারণে সেই কোন বগুড়ার কোন মোহাম্মদ আলীর কি সাহস হইছিলো তাঁরই দেশদ্রোহী বলিয়া ঘোষণা দেওয়ার” (পৃ. ৩২৩)। অথবা কাদের চৌধুরীর সাথে কথোপকথনকালে স্ত্রী ফারহানার ভাষ্য “কেন খামোকা দোষ দিচ্ছো ছাত্রদের? তারা চোখের সামনে যা ঘটতে-ঘটাতে দেখেছে, সেরকমই শিখেছে। আমার তো মনে হয় আমি চোখ বুজলে এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই কালো শেরওয়ানি পরা মুসলিম লীগের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান জোর করে সভাপতির আসন দখল করে বসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সভায়” (পৃ. ৩৩৫) ইত্যাদি অনুপঙ্খ স্মরন ও বিশ্লেষণে শামসুদদীন আবুল কালামের আগ্রহকেই প্রকাশ করেন।
বিভিন্ন মতের প্রকাশ ও সমঝোতা ঘটেছে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালির অংশগ্রহণ নিয়েও। ‘গোপনাভিসার’ অধ্যায়ে এ বিষয়টি মূর্ত হয়ে উঠেছে বিস্তারিতভাবে। সেখানে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী আব্দুল মাস্টারের সাথে আছে তার বন্ধু খালেদ, খালেদের স্ত্রী, সহকর্মী তারেক, তরুণ ছাত্র সেন্টু প্রমুখ। মত, পথ, কর্মকা-,ভবিষ্যৎ ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে বির্তক চললেও একটি সত্য সবার সামনে স্পষ্ট তা হলো “অনেক শতাব্দীর পরে আমরা একটা কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়েছি”। ‘কিন্তু খেয়াল রাখতে হইবে জনতাকে ধোঁকা দিয়া সুবিধাবাদীরা নানা রকম গণতন্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাইছে সব সময় নিজ স্বার্থের খবরদারির আগ্রহে। এই দেশের মানুষ বড় নিরুপায়, অসহায়, সরল। তাদের ধোঁকা দেওনের কাজ আরও বড় অপরাধ হইবে” (পৃ. ৩৪১)। এ পর্যালোচনা আবদুল মাস্টারের হলেও তা সর্বজন-স্বীকৃত। আর তাই মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সরকার ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও যুদ্ধে অংশীদারী হয় সকলেই।
শামসুদদীন আবুল কালাম ‘কাঞ্চনগ্রাম’-এর খসড়াটি প্রথম রচনা করেন ১৯৭২ সালে। যদিও ‘ব্যাটল অব বাংলাদেশ’ নামে তাঁর অপ্রকাশিত ইংরেজি উপন্যাসটি প্রকৃতপক্ষে ‘কাঞ্চনগ্রাম’-এরই প্রথম ভাষ্য। ১৯৭২ সালেই তিনি ওটির বাংলা ও ইংরেজি চিত্রনাট্য রচনা করেন। ১৯৮৬-র অক্টোবর থেকে ১৯৮৭ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি যে পুনর্লিখন করেন তাই বর্তমানের ‘কাঞ্চনগ্রাম’।
সাম্প্রতিক সময়ের এ উপন্যাসটি রচনায় শামসুদদীন আবুল কালাম সাধুভাষা ব্যবহার করেছেন যা আপাতভাবে অযৌক্তিক মনে হলেও একথা আমরা মানতে বাধ্য যে উপন্যাসের প্রথম অর্ধাংশে এর উপযোগিতা যথেষ্ট। লেখক নিজেই যেমন বলেছেন “বিষয়টি প্রাচীন এবং যে ভাষা অনুরূপ ধ্রুপদী চরিত্রের সহযোগী ও অনুকূল তাহাই অবলম্বনে বাধ্য হইযাছি।” লক্ষণীয় তৎসব শব্দের প্রাচুর্যে যে ভাষাটি লেখক নির্মাণ করেছেন তার ব্যবহার আনুপাতিকহারে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটেছে। তৃতীয় পুরুষে অতীত বর্ণনায় প্রাচুর্য যত বেশি, বর্তমানের বিবরণে তার কিয়দংশ থাকে মাত্র; অন্যদিকে গ্রামীন অন্ত্যজ মানুষের বাচনে তা শুধুমাত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এমন উচ্চমার্গের একটি উপন্যাসের প্রথম প্রকাশ বাংলা উপন্যাসের শুধু নব্বইয়ের দশকেই নয় সামগ্রিক বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে সন্দেহ নেই।
দৈনিক সংবাদ-এ ১১ মে ২০০০-এ প্রকাশিত।