এক.
বাংলাভাষী একজন মানুষ, বাংলাদেশ যার আবাস, তার জীবনের সবচেয়ে দোলায়িত সময় কোনটি? হাজার বছর যে বাঙালির সাহিত্যিক ঐতিহ্য তার নির্মাণে কিন্তু ব্যয় হয়েছিল আরও কয়েক হাজার বছর। নৃতাত্ত্বি¡ক পরিচয় খুঁজলে আরও পেছনে তার সূত্র দেখা যাবে, রাজনৈতিক পরিচয়ে সে-বাঙালি মাত্র সেদিনের। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশীর পর বাঙালির রাজনৈতিক সে-সন্ধান কি অগ্রবর্তী হয়েছিল! দোলাচল এবং দ্বন্দ্ব এবং পরিণতিতে অগ্রসরই পৃথিবীর ইতিহাস। হয়তো আম্রকাননের পরাজয় সে-বাঙালিকে নতুন এক পরিচয় অর্জনের প্রয়োজনকে ইঙ্গিত দেয়। ঠিক একশত নব্বই বছর পর যখন উপমহাদেশ নতুন হিসেব-নিকেসে ব্যস্ত বাঙালি বুঝলো ‘মেলেনি মেলেনি’। এগুতে হবে আরও, দ্বন্দ্ব এখনও সমাধানহীন। ১৯৪৭-এর আপাত স্বাধীনতার দ্বন্দ্বটি বাঙালিকে যেন করে তোলে আরও অনুসন্ধিৎসু। এরপর আর পেছন ফেরা নয়। আঘাত-প্রতিঘাত-অগ্রসরণ এবং জয় এই সরলরৈখিক হিসেবে মাত্র চল্লিশ বছরেই পৃথিবীর মানচিত্রে একটি জাতিসত্তার জন্য একটি স্বীকৃতি দেশ। কিন্তু হায়! আবারও ভুল হয়ে যায়। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে, জাতির জনক নিহত হন। এই যে উত্তুঙ্গ সময় বাঙালির ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ শব্দরূপ নিয়েছে সেলিনা হোসেনের (জন্ম ১৯৪৭) দীর্ঘতম উপন্যাস এবং বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘতম ও প্রকৃষ্টতম উপন্যাসগুলির একটি ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’তে (১৯৯৪-১৯৯৬)।
কালের চিত্রায়ন সেলিনা হোসেনের প্রিয় বিষয়। ‘জল্লোচ্ছ্বাস’ (১৯৭২), ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ (১৯৭৬), ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’ (১৯৭৯), ‘যাপিত জীবন’ (১৯৮১), ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ (১৯৮৩), ‘পদশব্দ’ (১৯৮৩), ‘চাঁদবেনে’ (১৯৮৬), ‘নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’ (১৯৮৭), ‘ক্ষরণ’ (১৯৯৮), ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ (১৯৮৩), ‘খুন ও ভালোবাসা’ (১৯৯০), ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ (১৯৯২), ‘ভালবাসা প্রীতিলতা’ (১৯৯২), ‘টানাপোড়েন’ (১৯৯৪), ‘দ্বীপান্বিতা’ (১৯৯৭) এবং ‘যুদ্ধ’ (১৯৯৮) সর্বত্রই সেলিনা হোসেন নিমগ্ন কাল-চিত্রণে। কখনও প্রেম বা সামাজিক দ্বন্দ্ব বা অন্য উপাদান প্রাধান্য পেলেও পাঠক সহজেই ঋদ্ধ হন তাঁর কাল-সচেতনতায় যা বর্তমান সাহিত্যে মাঝে মাঝে দুর্লভ হয়ে উঠতে চায়। সহজাত সে ক্ষমতাকে আশ্রয় করেই সেলিনা হোসেন নির্মাণে সিদ্ধান্ত নেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত পরিধিকে। সে সময়ের শুরুটি কাকতালীয়ভাবে তাঁর নিজের জন্মবছরও বটে। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে দীর্ঘ দশবছর নিরবিচ্ছিন্ন মগ্নতার ফলস্বরুপ আমরা বাঙালি পাঠক পেয়েছি দীর্ঘ প্রায় আটশত ত্রিশ পৃষ্ঠার ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’র তিনটি খণ্ড।
বাংলা উপন্যাসে ক্ষীণ-তনুর চর্চা সেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকেই শুরু হলেও ভিন্ন স্রোতে যে মাঝে মাঝে দেখা যায় নি তা নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দু’তিনটি উপন্যাস কলেবরকে খানিকটা হলেও বড় করেছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ (১৯৭৪) অন্য প্রশ্নের সাথে আয়তন প্রশ্নেও উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ (১৯৮৬), আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলোকোঠার সেপাই’ (১৯৮৭) ও ‘খোয়াবনামা’ (১৯৯৬) এবং শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাঞ্চনগ্রাম’ও (১৯৯৮) একই তলের রচনা। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে উপন্যাস অর্থই যেন ৬/৭ র্ফমার একটি গল্পতে বদ্ধগ্রন্থ। কারো কারো সৃজনশীল প্রয়াস সে আয়তন দ্বিগুণের কাছে নিয়ে যায়, কিন্তু দু’শো/আড়াইশো কিছুতেই অতিক্রম্য নয় যেন। না, শারীরিক আয়তনকে বড় করে না দেখেও এ আলোচনা চলতে পারে।
যোশেফ কনরাডের Heart of Darkness জেমসের জয়েসের The Portrait of an Artist as a Young Man অথবা আর্নেস্ট হোমিংয়ের The Old Man and the Sea উপন্যাসের আয়তন স্বল্পতা অজানা নয় কারো। কিন্তু তাই বলে মার্সেল প্রুস্তের Remembrance of Things Past, লিয়েফ তলস্তোয়ের War and Peace বা Anna Karenina যে তাদের আয়তন প্রশ্নেও গুরুত্বপূর্ণ তা ভুলে যাওয়া চলে না। সবসময়ই আয়তন প্রশ্নে রিজিয়া রহমান বিশেষ উল্লেখের দাবিদার, আর সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ সে মাত্রায় নতুন সংযোজন।
দুই.
‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’র যখন শুরু তখন ভারত স্বাধীন হচ্ছে। সেই উত্তাল সময়ে দেশান্তরী হওয়ার সময় ট্রেনে জন্ম নিচ্ছে উপন্যাসের একটি অন্যতম চরিত্র প্রতীক। ট্রেনে সে-সময় এক বিশাল সংখ্যার উদ্ধাস্ত জনসমষ্টির সাথে রয়েছে প্রতীকের বাবা আলী আহমদ, মা পুস্পিতা এবং বড়ভাই ছয় বছরের প্রদীপ্ত। তারপর ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, এগারো দফা এবং গণঅভ্যুত্থান। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনী যখন সাধারণ মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে তখন প্রদীপ্ত’র স্ত্রীর সন্তান পৃথিবীর বাতাস নিতে আসছে। আর পঁচাত্তরের পনেরই আগষ্ট যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন তখন প্রদীপ্ত’র সন্তান নেয় নতুনতর নাম অজেয় মৃত্যুঞ্জয় মুজিব। এই যে সংক্ষিপ্ত কাহিনী-কথা তা কিন্তু গায়ত্রী সন্ধ্যাতে অনেক গভীরে প্রোথিত, বহুধা এর শাখাপ্রশাখা। আর চরিত্র? কয়েকশ মানুষ এ কাহিনীতে অংশগ্রহণ করেছে এবং অপসৃত হয়েছে। কিন্তু বারবার ফিরে এসেছে যারা কাহিনীর স্তম্ভে, তাদের আশ্রয় করেই নির্মিতি পেয়েছে বাঙালি জাতিসত্ত্ব¡ার নির্মাণ ইতিহাস, তার সাতাশ বছর। প্রধান কলাকুশলীদের তালিকাটিও প্রসারিত হয়েছে। আলী আহমদ, পুষ্পিতা, প্রদীপ্ত, প্রতীকের সাথে যুক্ত হয়েছে মঞ্জুলিকা ও বন্যা – প্রদীপ্ত ও প্রতীকের দুই প্রেমাস্পদ।
‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’র মূল উপজীব্য রাজনৈতিক চালচিত্র নাকি পরিবারভিত্তিক মানুষ? বর্তমান উপন্যাসের জন্য এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। কেননা, উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরাই সমাজ-পরিবারের বাসিন্দা এবং একাধারে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। কেননা, তারা এমন একটি সময় অতিবাহিত করছে যখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ত কোন-না-কোনভাবে দেশের প্রতিটি নাগরিককেই রাজনীতির সুতোয় বাঁধা থাকতে হয়েছে।
স্বীকার করতেই হবে ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’তে সেলিনা হোসেন সাতচল্লিশ থেকে পঁচাত্তর কালপরিধির সকল রাজনৈতিক অভিঘাতকে শব্দরূপ দিয়েছেন। সাতচল্লিশ-উত্তর বাংলায় একের পর এক আমরা কী দেখেছি? ভাঙার প্রশ্নে পাকিস্তানিদের অনড় মানসিকতা, নাচোল বিদ্রোহ, খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, এগারো দফা, গণআন্দোলন, নকশাল আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। এখানেই শেষ নয়, লক্ষ শহীদের রক্ত দিয়ে কেনা মুক্তিযুদ্ধও যেন দেশকে দিতে পারে না একটি সুস্থ প্রতিবেশ। প্রকাশ ঘটে জাসদের, অস্ত্রের ঝনঝনানি ধ্বনিত হয় সর্বত্র, উত্তরাঞ্চলে প্রসস্ত মুখগহ্বর নিয়ে এগিয়ে আসে দুর্ভিক্ষ এবং চুড়ান্ত ঘটে যখন শেখ মুজিব নিহত হন। এবং ১৫ আগস্টের ঘটনার ভেতর দিয়েই শেষ হয় সেলিনা হোসেনের কাল পরিক্রমা।
‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’র বৈশিষ্ট্য এখানেই যে এর চরিত্ররা রাজনৈতিক ডামাডোলের বাইরে কেউ নয়। সামগ্রিকভাবেই তারা ঐ সকল ঘটনার অংশীদার। কখনও কখনও সম্পৃক্ততার প্রশ্নটিকে স্বাভাবিক করার জন্য সেখানে অনুপ্রবেশ ঘটেছে নতুন চরিত্রের যারা ভিন্ন প্রশ্ন মাথায় রেখে যুক্ত আলী আহমদ ও তাঁর পরিবারের সাথে।
যখন ভারত স্বাধীন হচ্ছে যখন মহানন্দার উপর প্রসব যন্ত্রণায় ব্যাকুল পুস্পিতা, আলী আহমেদের সাথে মর্শিদাবাদ থেকে যে কাফেলা বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের মধ্যে ফজলে গাজী ও তার মা, হেডমাস্টার নরুল্লাহ ও তাঁর পরিবার প্রমুখ। এই ফজলে গাজীও তেভাগা আন্দোলনে ইলা মিত্রের সহযোদ্ধা, যেমন মাস্টার নসরুল্লাহ সতত চালিয়ে যান মানুষ নির্মাণের কাজটি যে মানুষ সকল সংসারকে ঠেলে আবির্ভূত হবে সামনের কাতারে। আর নসরুল্লাহর ছেলে মফিজুল সেই তো রাজশাহীতে উদ্বুদ্ধ করে ছাত্রদের ভাষা প্রশ্নে পশ্চিমাদের বক্তব্যের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে। জেলখানায় খাপড়া ওয়ার্ড হলো আশ্রয়। সেখানকার ঐতিহাসিক হত্যাকাণ্ডের দিন সেও হলো নির্মমভাবে নির্যাতিত। পরে মফিজুল ভর্তি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রয়ারিতে নিখোঁজ হয়ে গেল সে – লাশটাও পাওয়া যায় নি। আর অহি? ভাষাশহীদ অহির দোর্দণ্ড উপস্থিতি বাংলার মাটিতে তো চিরকালই অনুভূত। প্রদীপ্ত বা প্রতীক টের পায় অহির অদৃশ্য অস্তিত্ব। চৈতন্যের দূরালোকে কথাও হয় তাদের। অহির মত আরও একজন হলো লাশকাটা ঘরের ডোম বুলু দাস। অহি এবং বুলু দাস দু’জনে বাংলার ব্রাত্যজনের প্রতিনিধিত্বকারী, কিন্তু মঙ্গলচেতনায় ওরা দুজনে সহজেই হারিয়ে দেয় সভ্যজনদেরকেও। পিতৃপ্রতীম স্নেহ দিয়ে বুলু দাস অহিকে আপন করেছিল। যেমনভাবে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের কালো রাত্তিরে প্রদীপ্ত যখন প্রেসক্লাবে আশ্রয় নিয়ে ট্যাঙ্কের আক্রমণের মুখে পরে এবং পরবর্তীতে চেষ্টা করে বাসায় ফিরতে এবং পরে যায় একটি মিলিটারি গাড়ির সামনে তখন এই দুলু দাসই প্রদীপ্তকে আগলে রাখে এবং এক পর্যায়ে বুড়িগঙ্গা পেরুতে সাহায্য করে ওকে। আর এভাবেই প্রদীপ্তর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যে শতাধিক চরিত্রের সমাবেশ তা করতে গিয়ে সেলিনা হোসেন যে সর্বত্র কার্যকর সম্পর্ক ও যৌক্তিকতা রক্ষা করতে চলতে পেরেছেন তেমনটি দাবি করা চলে না। মূল ঘটনাস্রোতের রূপায়ণে এ উপকাহিনীর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বের নয়। একই রকমের প্রশ্ন সহজেই তোলা যায় নসিব হাফিজুদ্দিন রচিত উপন্যাসটির প্রকাশ প্রশ্নে। ১২৭ থেকে ১৫৮ এবং ১৬৪ থেকে ১৮১ মোট আটচল্লিশ পৃষ্ঠার একটি ক্ষুদ্র উপন্যাস ঢুকে পড়েছে ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’র দ্বিতীয় খণ্ডে। হয়তো কেউ দাবি করতে পারেন ষাটের দশকের বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের চিত্রণ ঘটানো হয়েছে। তা সত্য, কিন্তু এও তো সত্য যে সেটি প্রাসঙ্গিকভাবে করা হয় নি। অথচ পাশাপাশি এও তো সত্য নসিব-নাসিমার কাহিনী বা আমীর ভুবনের কাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে ষাটের কালের শহুরে জীবনের অনেক নতুন দিকের উন্মোচন ঘটিয়েছে। যেমন তৃতীয় খণ্ডে প্রদীপ্ত-মঞ্জুলিকা যখন সোনাখালিতে বেড়াতে যায় তখন অনেকগুলো নতুন মুখ ঘটনার প্রয়োজনেই উপন্যাসে প্রবেশ করেছে। তবে সে প্রবেশের ভেতর দিয়ে পাঠক যে অর্জনটি করেছেন তা হলো নকশাল আন্দোলনের শ্রেণিশক্র খতম অভিযান কেমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে তার একটি জীবন্ত রূপ পাওয়া গেছে। অথবা সত্তরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে যখন ভোলায় লাখ লাখ মানুষ প্রকৃতির নির্মমতার শিকার তখনও কাহিনীর যে বিস্তার ঘটেছে তা মূল কাহিনী কাঠামোকে ক্ষতি না করে বরং রাজনৈতিক যে প্রেক্ষাপট সে সময় দেশে তৈরি হচ্ছিল তাকেই পূর্ণতা দিয়েছে। আর সৈয়দপুর অংশ? তা তো উপন্যাসটিকে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা। বাঙ্গালি-বিহারি এ দ্বন্দ্ব আজ অনেকের কাছে কম বেশি অজানা হলেও তা ছিল তখনকার দিনের বাস্তবতা এবং সেলিনা হোসেন সে-বাস্তবতাকে আঁকেন অভিজ্ঞতার পূর্ণ আলোকে।
ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের কৃতিত্ব এখানেই যে উপন্যাসের বহুবিধ দ্বন্দ্বকে পরতে পরতে তিনি অনুসন্ধান চালিয়ে পূর্ণ চিত্রটিকে উপস্থাপন করেন এবং অনুপুঙ্খতায় যে লেখিকার সাথে ঘটনার কোন দূরত্ব পাঠকের দৃষ্টিতে লক্ষিত হয় না। আলী আহমদরা যখন দেশভাগের পর রাজশাহীতে প্রথম আবাস গড়ে তখন তাদের দ্বন্দ্বটি ছিল তাদের নিজস্ব জন্মভূমি না থাকা নিয়ে। যদিও সে-দ্বন্দ্বটি বারবার প্রকট হয়েছে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের বিভিন্ন খাতে। মুসলিম লীগের গুণ্ডারা রাজশাহীতে তাকে গালি দিয়েছে ভারতের চর বলে, কমুনিস্ট বলে, মালায়ন বলে। শারীরিক নির্যাতন করতেও ছাড়ে নি। ঢাকাতে এসেও অবসান হয় নি এসবের। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা স্বাধীনভাবে প্রকাশে বাধা এসেছে বিভিন্ন দিক থেকে। আলী আহমদের চেতনাগত এই যে দ্বন্দ্ব তার কারণ দুর্বল মুহূর্তে তার গৃহহীন হওয়া মনে হলেও আমরা বুঝি এটি হলো সে সমাজেরই একটি দ্বন্দ্ব যেখানে মানুষ মোহমুক্ত হয়ে তার ইতিহাস ঐতিহ্যের অনুসারী হতে বাধাগ্রস্ত হয়। ধর্মের নামে সে-সমাজ তার নাগরিকদের উপর চাপিয়ে দেয় শৃঙ্খলের বেড়ি। সে-সব শৃঙ্খলকে ভাঙার যুদ্ধই তো চলছিল দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরে। সৈয়দপুরের প্রেক্ষাপটে বিহারি-বাঙালি দ্বন্দ্বকে সেলিনা হোসেন যে মমতায় তুলে আনেন তা নিঃসন্দেহে উচ্চমার্গের শিল্পীসুলভ।
কিন্তু ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ কি তারপরও একটি রাজনৈতিক উপন্যাস? হয়তো কোথাও কোথাও রাজনৈতিক ইতিহাসের বিবরণাদি বড় বেশি সরাসরি, কিন্তু তা প্রয়োজনাতিরিক্ত নয় তা তো ঠিক। আর রাজনৈতিক সামন্তরালে ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ তো মানুষকেই চিত্রিত করেছে। আলি আহমদ নিজে, পুষ্পিতার সাথে তার সম্পর্ক, জুলেখার জন্য তার গোপন আকাক্সক্ষা, হেডমাস্টার নসরুল্লাহ ও তার পরিবার, মফিজুল, অহি, বুলু দাস, প্রদীপ্ত-মঞ্জুলিকা কাহিনী, বন্যা ও প্রতীকের আসা যাওয়া, নসীব নাসিম এপিসোড ইত্যাদি সবকিছুর ভেতর দিয়ে মানুষের কাহিনীই বিবৃত হয়েছে এ উপন্যাসে। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রতীককে যখন আমরা গেরিলা আক্রমণে দেখতে পাই তখন রাজনীতি নয় বরং মানুষের তীব্র জীবনবোধই আমাদেরকে প্রবুদ্ধ করে। সে জীবনবোধের মৃত্যু আমরা বুদ্ধিজীবি হত্যা দিবসে আলী আহমদের অপহরণের ভেতর বা ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘটনার ভেতর উপলব্ধি করি।
‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’র আর একটি অতিরিক্ত প্রাপ্তি হলো ইতিহাসের মানুষেরা এখানে বড় জীবন্তভাবে কথা বলেন। ইলা মিত্র, সোমেন চন্দ্র বা শহীদ সাবের নিজেই যখন প্রবেশ করে ফেলেন উপন্যাসের কাহিনীতে তখন আমাদের অনেক দ্বিধা অপসৃত হয়। সত্য অনেক বেশি উজ্জ¦ল হয়ে ওঠে। শেখ মুজিব যখন সাতই মার্চের ভাষণ শুরু করেন তখন ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’র কাহিনী যেন ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে সহজেই।
এবার আসছি উপন্যাসটির সাধারণ কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি প্রসঙ্গে। আলী আহমদের ঢাকা বদলির পর যেদিন অহি মার জন্য ঔষধ কিনে ছুটতে গিয়ে আলী আহমদের রিকশায় ধাক্কা খায় (১ম খ-, পৃ. ১৬১) তখন ঘটনাটিকে কাকতাল ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না যদিও এমন ঘটনা জীবনের জন্য অস্বাভাবিক নয়। উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের ব্যাপ্তি ঊনষাট থেকে ঊনসত্তর হলেও প্রকৃতপক্ষে একষট্টি থেকে ঊনসত্তর হয়েছে। প্রথম দুটি বছরকে সামান্য একটি কাহিনী কণিকা দিয়ে হলেও ভরাট করার দরকার ছিল। দ্বিতীয় খণ্ডের শুরুতেই (পৃ. ০৮) আমরা দেখি আবেদ আলী জেল থেকে বেরুতেই দেখা হয় প্রদীপ্তের সাথে যা খুব বেশি প্রত্যাশিত নয় আসলে। দ্বিতীয় খণ্ডে নসিবের যে দীর্ঘ উপন্যাস আমরা পেয়েছি তার ভাষা অন্তত ভিন্ন হওয়ার প্রয়োজন ছিল, এবং তেমনটি না হওয়ায় ওটি আসলে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস হয়ে গেছে। সে উপন্যাসের চরিত্র তিতুমীরের অবচেতনে (পৃ. ১৫৩) আমরা এমন সব জিনিস পেয়েছি যা অস্বাভাবিক। শহর নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, শ্রেণিদ্বন্দ্ব নিয়ে অনভিজ্ঞ একটি ছেলের স্বপ্নে এসব আসতে পারে না, কেননা আমরা জানি অবচেতন আকাশ থেকে আসা উদ্ভট কোন ফল নয়, তা চেতনের রূপান্তরিত অবস্থা মাত্র। আবার বিবেচনায় এমন মন্তব্যে পৌঁছুতেই হয় যে ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’র প্রথম ও তৃতীয় খণ্ডদ্বয় অধিকতর সফল দ্বিতীয় খ-ের তুলনায়। সেলিনা হোসেন ইতোপূর্বে তাঁর ‘নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’তে বাংলা সাহিত্যের এক অমর প্রতিভা সোমেন চন্দের জীবন কাহিনী লিখেছেন। যেমন ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’তে লিখেছেন ইলা মিত্রের কাহিনী। আর ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ হলো সারা বাংলার সব মানুষের কাহিনী। পাঠক এতে শুধু ইতিহাসের রসহীন ঘটনাবলীরই সাক্ষাৎ পান না, বরং জানে ইতিহাসেরই এমন কিছু কণিকা যা তার জানার পরিধির বাইরের হয়ে পড়ে অনেক সময়। আর সে সবের ভেতর দিয়ে ব্যক্তি মানুষের সুখ-দুঃখ-ভালবাসা-দ্রোহ শিল্পরূপ লাভ করে। ১৯৪৭ সালের সেই দিনে যখন আলী আহমদ মুর্শিদাবাদ ছেড়ে রাজশাহী আসে তখন পথে ট্রেনে জন্ম নেয় প্রতীক, অন্যদিকে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যরা ঝাপিয়ে পড়েছিল বাংলার অগণিত সাধারণ মানুষের উপর তখন জন্মগ্রহণ করেন প্রদীপ্তর সন্তান। এ দুটি জন্মগ্রহণের ঘটনাতেই যেমন প্রতিবাদের চিৎকার আছে, তেমনি আছে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ইঙ্গিত। অন্যদিকে সাহিত্যিক শহীদ সাবেরের ঘটনা ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু দেশের বিরাজিত চরম অব্যবস্থা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই সাবেরের পাগল হয়ে যাওয়ার অর্থ ভিন্ন।
দৈনিক সংবাদ-এ ১৫ নভেম্বর ২০০১-এ এবং নান্দীপাঠ (২য় সংখ্যা) এপ্রিল ২০০২-এ প্রকাশিত।
1 Comments
Al Amin
খুবই সুন্দর ছিল রিভিউ ।
অনেক খুজে এই রিভিউ পেয়েছি ।
এত্ত বড় একটা বই এর রিভিউ পাবো ভবি নাই তাও এত নির্মল !
ভালোবাসা রইলো আপনার জন্য ।