অন্য আলো
কামাল রাহমান
১০
এতো নিরুচ্ছ্বাস ফেরা কখনো হয় নি আর, ফেলে আসা দেশের জন্য বুকের ভেতর চাপা ব্যথা, সেই সঙ্গে মুক্ত-বিশ্বের জাগতিক সব প্রাপ্তিগুলোর প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ থাকে, কোনো কিছুই নেই এসবের, এক ধরনের নির্লিপ্তির ভেতর ডুবে আছি। ফেরার কথা জানাইও নি কাউকে, বাসায় ঢুকে জানালা খুলে ঘরের গুমোট বের করে দেই, হেইনে যে প্রায়ই এসে ঘরদোর পরিষ্কার করে রেখে গেছে বোঝা যায়। শাওয়ার নিয়ে শুয়ে পড়ি, খেতে ইচ্ছে করে না কিছু, ঘুম আসে না। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি, কাজের মধ্য দিয়ে ভুলে থাকতে চাই সব।
কোনো কোনো বিকেলে আইসিস নদী বরাবর হাঁটি একা একা, খুঁজে বের করার চেষ্টা করি নদীর ঐ অংশটা, যেখান দিয়ে গরুগুলো পিঠে বোঝা নিয়ে পেরিয়ে যেতো নদীটা। আমার পিঠে এখন আমারই জীবনের বোঝা, কোথাও পেরোতে হবে এ নদীটা, নামাতে হবে বোঝা, ক্লান্ত আমি, ভীষণ ক্লান্ত এখন। মনে মনে ভাবি গরুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অক্সফোর্ডের নাম, যারা রেখেছিল তারা কি জানতো একদিন জ্ঞানীদের রাজ্য হবে এটা! গরু ও জ্ঞানী, পার্থক্য কত এ দু জনের? ইংরেজরা এক সময় গর্ব করে বলতো অক্সফোর্ডের চেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পৃথিবীতে নেই, ইউরোপের অন্য অংশ কখনোই এটা মেনে নিতো না। ইংরেজদের খেলাধুলা প্রীতির সঙ্গে মিলিয়ে অক্সফোর্ডকে কটাক্ষ করতে ছাড়তো না। অক্সফোর্ড থেকে পাশ করেছো? কি বিষয়ে, ক্রিকেট না ফুটবল? এ রকম অনেক কৌতুক আছে অক্সফোর্ডকে ঘিরে।
নিজেকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। এগিয়ে আসছে সন্ধ্যা, কেরোলকে সঙ্গে নিয়ে এমন অনেক সন্ধ্যা কাটিয়েছি এই নদীটার তীরে, সূর্যের সোনালি রং এখনো পাহাড়ের চূড়ায় আলো ছড়ায়, নদীর কাছাকাছি গাছপালায় ধূসর ছায়া, পুরোনো ঔক গাছের ছায়াগুলো মিলিয়ে যাওয়ার আগে নিজেদের প্রসারিত করে যত দূরে সম্ভব, সন্ধ্যার অনালোকিত অনুভব বুকের ভেতর প্রবেশ করে, মনে হয় নিজের ভেতরও নেমে আসছে অনাগত রাতের অন্ধকার, কেরোল মারা যাওয়ার পর লেইডি মালকিনের ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দেই নি, কোনো কোনো দিন ওখানে কাটিয়ে আসি কিছু সময়, সব কিছুতেই এতো বেশি প্রাণবন্ত ওর উপস্থিতি! অথচ মানুষটা নেই, এখন বুঝি, শুধু কেরোলকেই ভালোবেসেছিলাম আমি, লেইডি মালকিনের সঙ্গে প্রতি মাসে দেখা হয় ভাড়া দেয়ার সময়, প্রায়ই বলে বাসাটা ছেড়ে দিতে, এ পাগলামীর অর্থ হয় না, পারি না, ছেড়ে দিতে পারি না ওটা।
হেইনের সঙ্গে ব্যবহার প্রায় ঝগড়ার পর্যায়ে চলে যায় কখনো কখনো, বোঝাপড়াটা এতো ভালো আমাদের যে দু জনেই সামলে নেই। একদিন রেগে যেয়ে বলি, ইউ আর দ্য ওনলি অক্স ইন অক্সফোর্ড সিটি হু ডাজ নট ইট গ্রাস। হেসে বলে, বিকজ আই লিভ দেম ফর ইউ। আমি হলে হয়তো আর কথাই বলতাম না ওর সঙ্গে।
এমন একটা জীবনই কি চেয়েছিলাম আমি? অথবা কিছুই চাই নি, কোনো স্বপ্ন ছিল না আমার, যেভাবে এগিয়ে গেছে জীবন, ভেসে গেছি সেভাবে, প্রতিকূল স্রোতে এখন চরায় আটকে গেছি, ক্লান্ত মানুষ যেমন খরকুটো ধরে বাঁচতে চায়, তেমনি হাত বাড়াই কোরবিনের দিকে। ফোন করি এক দিন –
হ্যাঁ, মিস কোরবিন, আমি . . .
কে তিনি?
আমি …, আপনার উপর তলায় ভাড়া ছিলাম।
বিশ্বাস করতে পারি না কোরবিন চিনে নি আমাকে, না চেনার ভান করতে পারে এটা ভাবাও কষ্টকর। বলে –
বলুন, কীভাবে সাহায্য করতে পারি।
তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কথা না পেয়ে জিজ্ঞেস করি –
আপনার উপর তলাটা খালি আছে?
না, এখন ভাড়া দেই না ওটা, ছোট্টো একটা মিউজিক স্কুল দেয়া হয়েছে ওখানে।
ও আচ্ছা। একটু থেমে বলি, আপনার সঙ্গে কি সাক্ষাতে একটু কথা বলতে পারি মিস কোরবিন?
কি বিষয়ে বলুন তো?
সাক্ষাতে বলতে চাই।
এড়িয়ে যেতে চায়। বলে –
দুঃখিত মি. এব্রাম, আমার হাতে তো সময় নেই। সময় হলে জানাবো, বাই।
ফোন রেখে দেয়। ভাবতেও পারি না এভাবে প্রত্যাখ্যাত হবো, কি আছে ওর, নিজেকে কেন এতো নামিয়ে নিলাম! অবশেষে মেনে নেই বিষয়টা, প্রত্যেকেরই তো নিজের ইচ্ছের স্বাধীনতা রয়েছে। মরিয়া হয়ে আরেকদিন ফোন করি –
মিস কোরবিন, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম সংগীত বিষয়ে, আমাদের কিছু লোক-সংগীত আছে, ইচ্ছে হয়েছিল আপনাকে শোনাতে, আপনাদের পিয়ানোয় যদি ওগুলোর নোটেশান করে দিতে পারেন, এটার জন্য যথাযোগ্য সম্মানী আপনাকে দেবো।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে –
ঠিক আছে, নিয়ে আসুন এক দিন।
পরের রোববারই যাই ওখানে, সখিনা বিবির পালা নিয়ে, ওসব শুনে বলে কিছুই বুঝতে পারছি না, আমার মনে হয় না কিছু করতে পারবো আমি।
ওয়ার্ডিংগুলো না বুঝলে কিছু করা সত্যি মুস্কিল, ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেবো আমি, আপনি শুধু সুরটা তুলে দিন।
আচ্ছা দেখবো চেষ্টা করে।
সামান্য আন্তরিকতাও নেই কোরবিনের ব্যবহারে, পুরোপুরি আনুষ্ঠানিক।
আমি কি পরের হপ্তায় আসবো?
না, আরো একটু সময় দিন।
দু’হপ্তা পরের রোববার যাই আবার, কিছুটা কাছাকাছি সুর তুলেছে পিয়ানোয়, শব্দগুলোকে বসিয়ে ঐ সুরে গেয়ে শোনাই, কিছু শব্দ বদলে দেয় কোরবিন, কয়েক হপ্তা চেষ্টার পর একটা অবস্থায় পৌঁছে ওটা। জিজ্ঞেস করে, কি করবো এটা নিয়ে। বলি, যদি সঠিক মানে এটাকে পৌঁছে দেয়া যায়, উপস্থাপন করবো। এখনো অনেক দূর যেতে হবে, তবে যেটুকু হয়েছে, ভালো কোনো কোম্পোজারকে বোঝানো যাবে অন্তত যে বিষয়টা কি।
কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে কোরবিন, সংগীতের জগত নিয়ে জীবন পার করে দিচ্ছে, কিছুটা সুর মেশানোর চেষ্টা করি আমিও। কোনোভাবেই খোলসের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে না, মনে হয় প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে। পালাটার একটা অংশে ওকেও গলা মেলাতে বলি, সুরের সঙ্গে ভালোভাবেই মিশে যায়, আবেগের জায়গাগুলো বুঝিয়ে বলি, চেষ্টা করে সেসব সুরে ধরার জন্য। একদিন কিছুটা আবেগাকুল মুহূর্তে জিজ্ঞেস করি, আরেকবার তোমার হাতটা ধরার অনুমতি দেবে কোরবিন?
স্পষ্ট বলে: না।
এর পর আর এগোনো যায় না, জীবন থেকে কোরবিনের পৃষ্ঠাটা ভাঁজ করে রাখি।
এখন কষ্ট হয় বাবার জন্য, আমাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন ছিল ওর। কৌতুক করে দেয়া হেইনের পরামর্শটাই আদর্শ মনে হয়, ও বলে, একটা দেশি মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসো, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। হয়তো ওর অনুমানটাই ঠিক, কিন্তু এ বয়সে বিয়ের উপযোগী কাউকে পাওয়া অসম্ভবের কাছাকাছি। জীবনের শুরুতে, যাকে হয়তো ভালো লেগেছিল, আমার আদর্শ ছাত্রী, এখন নিশ্চয় নানি-দাদি সে! চাচার মেয়ে আয়েশাও তাই। এলিনার কোনো খোঁজ জানি না, শুনেছিলাম দেশে যেয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল, বিয়ে-শাদী করে ভালোই নাকি আছে।
মাথা থেকে এলিনাকে নামাতে পারছি না ক’দিন থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় দু দিন বন্ধ থাকায় উইকেন্ডের সঙ্গে ঐ দু দিন যোগ করে মাঝখানে একদিন ছুটি নিয়ে ইসলামাবাদের বিমানে উড়াল দেই। তৃতীয় বিশ্বের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা যে কত বড় এ্যাডভেঞ্চার বুঝতে পারি। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে, বিলেতের একজন বিজনেস ডেলিগেট দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত দেখা করার সুযোগ পাওয়া যায়। অনেক বছর পর আবেগ সামলানো একটু কঠিন হয়, প্রায় একই রকম আছে এলিনা, কালো ফ্রেমের একটা চশমা উঠেছে চোখে, মাথায় হিজাব, আচরণে গাম্ভীর্য।
কেমন আছেন?
ভালো, আপনি?
কোনো কাজে এসেছেন?
না, আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য শুধু, এটারও কোনো কারণ জানি না।
চা খাবেন?
আপনার কোনো সমস্যা না থাকলে।
চা দিয়ে বেয়ারা বেরিয়ে যাওয়ার পর বলে –
এটা তো আমার কাজের জায়গা, কথা বলার জায়গা না, বলুন কি জন্য এসেছেন।
কোনো কিছুর জন্যই আসি নি এলি, তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্যই শুধু।
কণ্ঠে আমার আকুলতা ছিল কিনা জানি না, চুপ করে থাকে এলিনা। আবার বলি –
মনের সঙ্গে পেরে উঠি নি এলি, মন চাইছিল, তোমাকে একবার দেখি। দেখেছি, খুব খুশি হয়েছি, দেখা করার অনুমতি দিয়েছো তুমি। এজন্য অনেক ধন্যবাদ। যদি চাও, চলে যেতে পারি এখন।
না, বসো।
চুপচাপ বসে থাকি। নোট বই ঘেঁটে জিজ্ঞেস করে –
পরশু পর্যন্ত আছো?
শুক্রবার… হ্যাঁ। তুমি চাইলে সারা জীবনও থেকে যেতে পারি।
কথার যাদু এখনও তেমনি আছে তোমার!
শুধুই কথার?
দুপুরে একটা জায়গায় দেখা করতে বললে পারবে?
আশা করি, যদি তোমার দপ্তরের মতো না হয়।
একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিয়ে বলে, বারোটার মধ্যে পৌঁছে যেও, কোনো কারণে আমার একটু দেরি হলেও মনে কিছু করো না।
না না, ঠিক আছে।
দুটো দিন ইসলামাবাদ শহর দেখে কাটিয়ে দেই। রেস্টুরেন্টের যেখানে বসতে বলেছিল একটু আগে থেকেই বসে থাকি ওখানে যেয়ে। ফ্রেশ ম্যাঙ্গো জ্যুস পান করি, সাড়ে বারোটায় আসে এলিনা। এসেই বলেÑ
আমার তো একটু সমস্যা আছে, বোঝোই। ফ্যামিলি রুম আছে এখানে, চল একটায় ঢুকে পড়ি। উঠে যাই, ম্যানু দেখে খাবারের অর্ডার দেয় এলিনা।
এবার বলো, কেন এসেছো।
কেন বিশ্বাস করছো না এলি!
একটু কঠিন। তা ছাড়া এতো বছর পর!
কথায় কথায় অনেক কথা বলা হয়ে যায়, খুব তাড়াতাড়ি বরাদ্দ সময় শেষ হয়ে যেতে থাকে। খুব ব্যস্তভাবে নাকি জীবন পার করে দিচ্ছে। বাইরে থেকে ওকে মনে হয় খুব ক্ষমতাবান! প্রতি রাতে স্বামীর পাশবিক অত্যাচার, বছর বছর বাচ্চা, শরীর ক্ষয় করে শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচার করে ওটা ফেলেই দিয়েছে। গত বছর থেকে স্বাস্থ্য একটু ভালো যাচ্ছে। এই রাজনীতিটা হচ্ছে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন, দ্রুত জীবনটাকে শেষ করে দেয়ার ভালো একটা পথ, কারো প্রতিই কোনো আকর্ষণ নেই, দায় বা ভালোবাসাও নেই, এমনকি ছেলেমেয়েদের প্রতিও না, বড় মেয়েটা সংসারের সবকিছু দেখে, রাজনীতি চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে রেখেছে স্বামী, ওর ব্যবসায় দারুণ সুবিধে হচ্ছে এতে, ব্যবসাটাই ওর কাছে মুখ্য, এলিনা অথবা পরিবার কোনো কিছুই না ওর কাছে। যাদের জন্য রাজনীতি করে ওদেরকেও ভালোবাসে না, ওরাও ভালোবাসে না ওকে। দু বার গুলি করেছে গাড়িতে, বাসায় বোমা মেরেছে, নিরাপত্তা-রক্ষী ছাড়া চলা ফেরা করতে পারে না। একটা মার্কেটে সপিংএর জন্য যেয়ে, টয়লেটে ঢুকে বোরখা বদলে অন্য মানুষের বেশে এখানে এসেছে। ঐ সপিং সেন্টারের বাইরে ড্রাইভার এখনো অপেক্ষায় আছে, টেক্সি ভাড়া করে এসেছে এখানে।
খুব ঝামেলায় ফেলেছি তোমাকে এলি।
না ঝামেলা না, অনেকদিন পর একটু মন খুলে কথা বলতে পারছি, আর কিছু না।
যদ্দুর শুনেছি, জেনেছি সুখে আছো তুমি!
সুখ দুঃখ বুঝি না, জীবনটা যাপন করে যাচ্ছি।
ওটা করতে পারাই বোধ হয় অনেক বড় এলিনা।
খুশি হলাম, আমার খোঁজ খবর তুমি নিয়েছো জেনে। তোমার খবর বল।
কোনো খবর নেই এলি।
বিয়ে শাদী, ঘর সংসার?
হো হো হো করে হাসতে যেয়েও হাত চাপা দেই মুখে। এটা তো আবার রামগরুড়ের ছানাদের দেশ!
কেন?
কোনো কারণ নেই।
চুপচাপ কিছু সময় কাটে। ওরা এত ভালো কাবাব বানায় কীভাবে? এটা সেটা খাই, বোরহানিটায় ঝাল একটু বেশি যেন, নীরবতা ভেঙ্গে বলে এলিনা –
ভেবেছিলাম বড় মেয়েটাকে বিলেতে পাঠাবো পড়াশোনার জন্য, নিজের জীবনের কথা ভেবে বাদ দিয়েছি।
সবার জীবন একই পথে এগোয় না। কারোই না।
তা ঠিক, তারপরেও মনে হয়েছে, যে সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত এদেশের মানুষ, তা মেনে নিয়েই জীবন যাপন করুক, ওখানে যেয়েও যে অন্য রকম কিছু একটা হবে তার নিশ্চয়তা কি?
অনেকেরই তো হচ্ছে।
আমার তো হয় নি, ভয়টা এজন্য।
তোমার বাবা-মা, বোন কেমন আছে?
ভালোই, বোনের বিয়ে হয়েছে, ব্যবসাটা ওরাই চালায়, বেশির ভাগ সময় বাবা-মা এখানে কাটায়।
চলে আসো না আবার?
কেন?
জীবনটাকে আরেকটা মোচড় দিয়ে দেখতে দোষ কি?
লোভ দেখাচ্ছো?
তোমাকে দেখানোর মতো লোভনীয় কোনো কিছুই নেই আমার এলিনা, নিজের জন্যই আসো।
আর কোনো কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই আমার!
কত বিচিত্র আনন্দ আছে পৃথিবীতে, সংসার যাপনটাই তো সব না।
প্রাচ্য দেশের নারীদের জন্য এটাই প্রধান।
জীবনে অপ্রধানের গুরুত্বও কম না। ছুটি কাটাতে আসো, বেড়াতে আসো, এমনিতেই আসো, আমার জন্য আসো।
আশ্চর্য সুন্দর ওর চোখ দুটো তুলে তাকায়, মুক্তোর মতো জলের বিন্দু যেন জমতে শুরু করেছে ওখানে। বলে –
আমার শীত লাগছে। শরীরে জড়ানো ওড়না খুলে পাতলা করে ছড়িয়ে দেয় শরীরের একপাশে। বলিÑ
জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকাও। তুষার ঝরছে, কি দারুণ তুষার, তোমার গাড়িটা কত পুরু তুষারের নিচে চাপা পড়েছে দেখেছো!
মুহূর্তে যেনো বিদ্যুৎ খেলে যায় ওর ভেতর, অকস্মাৎ স্মৃতির সুখে ভেসে যেয়ে হেসে উঠতে চায়, সেই পুরোনো অপ্সরা হাসি, যাদুর রঙিন হাসি, সঙ্গে সঙ্গে ওড়না চাপা দেয় মুখে, চোখে কিশোরীর লজ্জানম্র চপলতা।
ভুলেই গেছিলাম যে আমি বিলেতে নই এ মুহূর্তে!
আমারও তাই মনে হয়েছে এলিনা।
অতীত সুখের উল্কাপিণ্ডটা নেড়েচেড়ে দেখছে যেনো এলিনা, ওর চোখেমুখে খুশির লাবণ্য।
তোমার হাতটা একটু ধরি এলি?
চুপ করে থাকে। করতলের ভেতর দেবীর আরতির জন্য নেয়া অর্ঘ্যরে ফুলের মতো কোমল হাতের স্পর্শ নিয়ে বসে থাকি অনেকক্ষণ, পা থেকে জুতো খুলে ওর দু পায়ের পাতার উপর চেপে রাখি। আবেগ আর ধরে রাখতে পারে না এলিনা, চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসে ছাই-চাপা দুঃখ, হালকা হতে দেই ওকে। অনেকখন পর বলে –
তুমি যদি বলো আসবো।
আসো এলিনা।
স্বামী, সংসার, দেশ, সব ছেড়ে-ছুঁড়ে আসবো।
না, সব রেখেই আসো।
কি বলছো তুমি? দ্বিচারিণী হতে পারবো না আমি।
একটু যেনো রুক্ষ ওর কণ্ঠ।
দ্বিচারিণী হতে বলছি না এলিনা, নিজের জন্য আসো, অন্তরের জন্য আসো, আবারও বলছি আমার জন্য আসো।
একটু থেমে বলি –
শরীরের ঐ চাহিদা আমার আর নেই।
একটু যেন লজ্জা পায়, বলে –
আমার আছে, পুরোপুরি।
আবারও হাসি দু জনে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, মাই গড, আমার ড্রাইভার বোধ হয় দুশ্চিন্তা শুরু করেছে।
ওঠার আগে বলি –
তাহলে এই কথাই রইলো এলি, তুমি আসছো, আগামী তুষারের আগেই।
জানি না, হয়তো শুধু তুষারই আসবে।
তুমি না এলে বিলেতে এবার তুষার আসবে না এলিনা!
না আসুক।
না এলি, দুটোই চাই আমি, তুষার ও তোমাকে।
একটা চুমো দেবে আমাকে, দাউদ?
ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখি, এতো বিদ্যুৎ! এতো প্রবল আকর্ষণ, কোথাও পাই নি এ জীবনে!
বিলেতে ফিরে আসি, মনের ভেতর সুখের প্রজাপতিটা ওড়াউড়ি শুরু করে আবার। পুরোনো প্রেমিকারা নতুন করে উদ্দীপনা ছড়াতে শুরু করে, আইসিস নদী দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া জল দেখি। সব কিছুই সুন্দর, প্রকৃতির নিয়মে স্বাভাবিক। অথচ আশ্চর্য, এবারের শীতে তুষার ও এলিনা, কেউই আসে না! অনেক বছর পর একটা ব্যতিক্রমী শীত এসে আবার ফিরে যায় উত্তরে।
রাজনীতি করে প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠেছে এলিনা, জীবনের হিসাবটায় ভুল করে নি এবার, আবেগে ভেসে যায় নি, দ্বিতীয়বার ঝুঁকি নেয় নি, ভালোই করেছে।
আমি এ জীবন লইয়া কি করি?
জন্মগতভাবে পাশ্চাত্যের হলে এমন একটা জীবন মেনে নেয়া খুব কঠিন ছিল না, কিন্তু বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারি না, বাবাকে সুখী দেখতে চাই, বাবার একটা স্বপ্ন ছিল, ওটা সফল দেখতে চাই। আমাদের ভাষায়, বা আমার, ছেলেকে মানুষ করার জন্য বিলেতে পাঠিয়েছিলেন বাবা, কীভাবে আর মানুষ হবো, উচ্চশিক্ষা যতটুকু সাধ্য গ্রহণ করেছি। ডক্টরেট, পোস্ট-ডক্টরেট সবই করেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। অর্থ, বিত্ত, সুখ, নারীসঙ্গ সবই উপভোগ করছি। শুধু একটা সংসারের অভাব, আমার দিক থেকে, খুব যে অসুবিধায় বা না পাওয়ার মধ্যে আছি, তা তো না।
বাবা তাহলে ঐ সব জাগতিক সুখের সঙ্গে ঘরভরা নাতি-পুতি চেয়েছেন, আমার অন্য ভাইয়েরা সেসব খুব যতœ নিয়ে উৎপাদন করে চলেছে। বাবার নামে প্রচুর জমিজমা কিনি, ভাইয়েরা মহাখুশি, বাবা মারা যাওয়ার পর এসব সম্পত্তি ওদেরই হবে।
বাবাকে খুশি করা, ও রাখার জন্য বলি –
একটা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে দেই, আপনি পরিচালনা করেন ওটা।
বেশ খুশি হয়ে ওঠেন। একটা ভালো প্রস্তাব যেন দিয়েছি। একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য দশ একরের মতো বড় এক খণ্ড জমি গ্রামে পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত পাকা রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে সব মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ একরের কয়েক টুকরো জমি একসঙ্গে করা যায়। সামনের রাস্তা পর্যন্ত জমির ছোট ছোট খণ্ডগুলো দ্বিগুণ-আড়াইগুণ দামে কিনে চওড়া রাস্তা বানিয়ে দু পাশে গাছ লাগিয়ে জমি প্রস্তুত করি। বছর খানেকের মধ্যেই ভবন তৈরি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্ম শেষ করি। ওটার নাম রাখতে চাই বাবার নামে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে ওঠেন বাবা, ‘না, ওটা তোমাদের মায়ের নামে’ মুহূর্তের জন্য বাবার চোখে প্রেমের স্ফুলিঙ্গ দেখি, থ হয়ে যাই, মায়ের কথা কোনো প্রসঙ্গে কখনোই শুনি নি বাবার মুখে! জীবনের এই শেষ কালে এক নতুন রূপে আবিষ্কার করি বাবাকে। ওখানেই কি প্রেম, ভালোবাসা! গভীর গোপনে? প্রকাশ্য সবই মেকি!
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নাম রাখেন বাবা, রোজিনা আশ্রম। এখানে শুধু স্বাস্থ্য-সেবাই না, স্বামী-পরিত্যক্তা অথবা পুনর্বিবাহ করতে অনিচ্ছুক দুস্থ বিধবাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র, ও শিশুকিশোরদের জন্য একটা লাইব্রেরিসহ বেশ বড় একটা কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়। মন প্রাণ দিয়ে খাটছেন এটাতে বাবা, একটা ট্রাস্ট গঠন করে বাবাকে আজীবন চেয়ারম্যান, স্কুলের প্রধান শিক্ষক, থানা কমপ্লেক্সের ডাক্তার, মহকুমা সদরের একজন ম্যাজিস্ট্রেট, গ্রামের মেম্বার, আমাদের পরিবারের তিনজন সদস্য, এরকম এগারো জনের ট্রাস্ট কমিটি গঠন করে দেই এটা পরিচালনার জন্য। আমাদের অনুপস্থিতিতে এটা যেন বন্ধ না হয়ে যায়, এজন্য এটার খরচ নির্বাহের ব্যবস্থা করি। বাবার নামে আমার অর্থে কেনা সকল সম্পত্তি ট্রাস্টের নামে লিখে দেয়ায় আমার ভাইয়েরা মহা খেপা। গ্রামের হাটের সঙ্গে লাগানো তিন একর জমি কিনে একটা খোলা চত্বর পাকা করে উপরে ছাদ দিয়ে দেই, ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় থাকবে ওটা। একসারিতে মাছের দোকান, যা দিনে দু বার, সকাল আটটা থেকে এগারোটা, ও বিকাল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত চালু থাকবে। অন্যান্য দোকান ন’টা-পাঁচটা। বাজার বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব ধুয়ে মুছে পরিষ্কার রাখার জন্য ক্লিনার ও দারোয়ান রাখি দু জন। সব মিলিয়ে গ্রামের মানুষজন খুশি, বাবাও খুশি।
খুশি না হয়ে আর উপায় আছে আমার?
প্রতিষ্ঠানটা চালু করে একদিক দিয়ে খুব ভালো হয়েছে, বাবা ব্যস্ত হয়ে ওঠেছে, শরীর স্বাস্থ্য বেশ ভালো যাচ্ছে, আমাকেও ঘন ঘন দেশে আসতে হচ্ছে। যন্ত্রণাগুলো দূরে রাখা যাচ্ছে।
তুষার-ঝরা এক রাতে মালকিনের ফ্ল্যাটে যাই, এতো বেশি কেরোলময় সব কিছু, মনে হয়, এই তো টয়লেটে গেছে, নয়তো উপরতলায় পরিপাটি হতে গেছে, এক্ষুণি বেরিয়ে আসবে, অথবা নেমে আসবে, ওর কেনা আমার প্রিয় পানীয়ের বোতলগুলো এখনো পূর্ণ, ইচ্ছে হয় না ওগুলো পান করি। আমার ভালোবাসার, ভালোলাগার প্রতিটা জিনিসের প্রতি এতো সূক্ষ্ম দরদ ছিল ওর! ফ্রীজের ভেতর এখনো পুরোনো জল জমে বরফ হয়ে আছে, ব্যবহার করা হয় নি কত দিন! অথচ, কত কী যে হতো আরো! কাঁদতে ইচ্ছে করে, ভগবান, এই কি জীবন!
হঠাৎ দরোজায় টোকা, অবাক হই, কারোই তো আসার কথা না। ভুল শুনি নি তো? আহা ভুল করেও যদি শুনে থাকি, আর দরোজা খুলে দেখি কেরোল!
দ্বিতীয়বার টোকা শুনে ভুলটা ভেঙ্গে যায়, সেই সঙ্গে স্বপ্নটাও।
দরোজা খুলে তো আরোও অবাক, মিটিমিটি হাসছে আওয়ার লেইডি মালকিন!
তোর ঘরে আলো দেখে আসলাম।
এই তুষার ভেঙ্গে?
না, পিটার পৌঁছে দিয়ে গেছে।
ওকে নিয়ে আসো নি কেন, যাবে কিভাবে এখন?
যাবো কেন?
হেসে উঠি গলা ফাটিয়ে, মনটা ভালো হয়ে যায় হঠাৎ।
ও রে মজার বুড়ি!
আধ ঘণ্টা পর আবার আসবে পিটার।
তাই বলো। বুঝলে কিভাবে, ঘরে আছি?
ওকে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে বলেছি, এ সময়ের মধ্যে না নামলে চলে যাবে ও।
অনেক বুদ্ধি তোমার! কি খাবে, চা কফি?
ব্র্যান্ডি।
বা বা।
অনেকদিন পরে এলি মনে হয়।
হ্যাঁ, দেশে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় আজকাল।
চা দে এক কাপ।
দু কাপ চা নিয়ে বসি, মনে হয় একটু দুর্বল হয়ে গেছে মজার বুড়ি।
তোমার শরীর স্বাস্থ্য ভালো আছে তো মালকিন?
নারে, ভালো নেই। বুড়োটা যে কেন পালালো আমাকে রেখে!
তুমি একা নও মালকিন।
হ্যাঁ। ফিরবি কখন?
আজ ফিরবো না মালকিন।
এখানে কাটাবি!
হ্যাঁ, মালকিন, কোরোলের রেখে যাওয়া সুধাগুলো এখনো রয়েছে সেলারে, ফ্রীজে জমানো ওর হাতে রেখে যাওয়া জল।
বুকের ভেতরটা ছল ছল করে ওঠে। আর কথা আসে না মুখে। মালকিনও বোঝে, চুপচাপ বসে থাকি। চায়ে চুমুক দিয়ে বলেÑ
কেন যে একসঙ্গে শুতে বারণ করেছিলাম তোদের, এখন দুঃখ হয়।
হঠাৎ বদলে যায় পরিবেশটা। আবার হেসে উঠি গলা ছেড়ে।
এখন আর দুঃখ করে কি হবে মালকিন?
কি আর করতে পারি, প্রায়শ্চিত্ত করি এখন, আয় আমার সঙ্গেই শুবি।
হাসতে হাসতে চায়ের কাপ উল্টে ফেলি, ধুলো তো নেই যে লুটোপুটি খাবো।
আহা রে, মজার বুড়ি, পৃথিবী এতো বদলে গেছে, অথচ তুমি সেই মজার বুড়িই রয়ে গেছো!
আধ ঘণ্টা হয়ে গেছে রে, উঠতে হবে। যাওয়ার সময় বলে –
খুব বেশি ভাবিস না, তুইও এক দিন মজার বুড়ো হয়ে উঠবি।
দরোজা খুলে দিয়ে বলি –
মজার হবো কিনা জানি না, বুড়ো তো প্রায় হয়েই গেছি।
ওটাও হবি, শুভরাত্রি।
শুভরাত্রি, আওয়ার লেইডি মালকিন।
কেরোলের চেইঞ্জারটায় আমার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতের ছ’টা রেকর্ড চাপিয়ে ওর রকিং চেয়ারটায় বসি, সুরা ও সংগীতের ভেতর ভুলে যাই জীবনের অন্য সব কিছু।
অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উপলব্ধি করতে পারি কী অসীম বেদনা, কত গভীর যাতনা নিয়ে কবিগুরু রচনা করেছিলেন:
এসো এসো ফিরে এসো, বঁধু হে ফিরে এসো
আমার ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত চিত, নাথ হে, ফিরে এসো।
ওহে নিষ্ঠুর, ফিরে এসো,
আমার করুণকোমল এসো.
. . . . . . . . .
আমার ধরম-করম-সোহাগ-শরম-জনম-মরণে এসো।।
ওখান থেকে কেউ ফিরে আসে না হে কবি! বৃথাই এ কামনা, এই প্রার্থনা। কাঁদতে ইচ্ছে করে আমার।
জীবনের মধ্য বয়সে পৌঁছে এখন পেছনে ফিরে দেখতে ইচ্ছে হয় যাপিত জীবনটুকু, এখানটায় পৌঁছে গৃহী পুরুষদের নিজের বলে খুব বেশি কিছু থাকে না, পুত্র-কন্যা-পরিবার-পরিজনের জীবনের স্বপ্ন আশা আকাংখার যোগান দিতে যেয়ে শূন্যে মিলিয়ে যায় অবশিষ্ট দিনগুলো।
মাত্র কিছুদিন আগে এলাম দেশ থেকে, আবার বাবার তলব, আশ্রম পরিচালনায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে, একা সামলাতে পারছেন না। আরো একটা যন্ত্রণা সৃষ্টি করলাম নাকি! কি দুঃখে নিরোদ বাবু আমাদের ‘আত্মঘাতী’ বলেছিলেন, বুঝতে পারি, এদের জন্য ভালো কিছু করাও বোধ হয় বোকামী, মাদ্রাসার মতো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে পরকালের আফিমের ভেতর এদের ডুবিয়ে রাখাই ভালো। মাসখানেক পর দেশে যেয়ে কিছুটা সামাল দিয়ে আসি। ওসব ঠিকঠাক করার সময় একদিন আমার এক আওয়ামী ভাগ্নে এসে জিজ্ঞেস করে, এসব করছি কেন, আগামী নির্বাচনে দাঁড়ানোর কোনো ইচ্ছে আছে কিনা। আমি তো আকাশ থেকে পড়ি, স্বপ্নেও ভাবি নি এরকম কিছু, এরা তাহলে এই ভেবেছে! মনের কথা চেপে যেয়ে ওকে বলি, ইচ্ছে তো আছে, তবে তোদের দল থেকে না, তোরা তো ক্ষমতায় নেই, ধানের শিষ থেকে নমিনেশান ঠিক করে ফেলেছি। আঁতকে ওঠে ও। বলে, আগে কেন বলি নি, মন্ত্রী বানিয়ে ছাড়তো আমাকে। মনে মনে বলি, বিলেতে কিং মেইকার আছে, বাংলাদেশে যে এ সময়ের মধ্যে মিনিস্টার মেইকার জন্ম নিয়েছে জানতে পারি নি, ভালোই অগ্রগতি হচ্ছে তাহলে দেশের, খুব শীঘ্র ফিরে আসি।
হেইনের মতো একটা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। নিজেও যখন কোনো এক ঘূর্ণাবর্তের ভেতর রয়েছি, তখন সমস্যা কি আর, ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে চলে জীবন। মাঝে মাঝে আমার স্বভাবজাত বিষণœতা লুকাতে পারি না। ঝড়ের মতো একদিন এসে আবার বলে হেইনে –
এক কাজ করো ডাউ, একটা দেশি মেয়ে বিয়ে করে আনো, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, আগেও বলেছিলাম মনে হয়।
বাহ্, এতো সহজ সমাধানটা আমার মাথায় আসে নি কেন? তুমি একটা ব্রিলিয়্যান্ট!
ঠিক আছে, তাহলে আর একটা বলি। একটা জার্মান মেয়ে ব্যবস্থা করে দেই, ওদের মতো ভালো বউ এই পৃথিবীতেই হয় না, হাজব্যান্ডের জন্য সবই করে ওরা।
আরো ভালো বলেছো হেইনে, অনেক ধন্যবাদ। দুটোতেই রাজি আমি, ব্যবস্থা করো। কিছু মনে না করো যদি, জিজ্ঞেস করতে পারি কেন এত বছরেও একটা জার্মান মেয়ে নিজের জন্য ব্যবস্থা করতে পারো নি তুমি?
কিছুটা তো বলেছি তোমাকে ডাউ, কীভাবে ওরা মেয়েগুলোকে সরিয়ে নেয় আমার কাছ থেকে।
হ্যাঁ হ্যাঁ হেঁইনে, অনেকবার বলেছো, আর দরকার নেই।
ঠিক আছে, আর বলবো না, তবে একটা জিনিস কি জানো, একজন মানুষের বিয়ে করতেই হবে এমন কোনো দিব্যি তো নেই।
নিশ্চয় নেই, জীবনের কোনো কিছুই তো থেমে নেই।
তাহলে আর এটা নিয়ে ভেবে লাভ কি?
না ভেবেও লাভ কি? যাহোক, আমি ভাবছি না। কি আনবো বলো?
জানোই তো।
একটু চেইঞ্জ করো না কেন আজ?
তাহলে যা খুশি তোমার।
জার্মান ভোদকা মনে হয় জার্মান মেয়েদের মতো, যদিও খুব জানি না ওদের সম্পর্কে।
কেন বল তো?
এখনো ওটার মাত্রা ঠিক করতে পারি নি আমি, কখনো দেখি দু পেগেই বেশ ভালো আছি, কখনো চার পেগেও ধরা দেয় না।
ঠিকই বলেছো, শরীর ও মনের উপর কিছুটা নির্ভর করে ওটা। যাহোক, বুঝে যাবে ধীরে ধীরে। কোনো জার্মান মেয়ের সঙ্গে যদি সখ্য গড়ে ওঠে তোমার, বুঝে যাবে আশা করি।
একটু থেমে আবার বলে –
ধীরে ধীরে।
হ্যাঁ, ধীরে ধীরে।
অনেক রাতে ফিরে যায় হেইনে, ওর সকল রহস্য নিয়ে উধাও হয়ে যায়। আমি খুঁজে পাবো কি আর, ব্রিটিশ পুলিশ, কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাও কোনো কিছু জানতে পারে নি, অথবা প্রকাশ করতে পারে নি!
জানি না ঐ সরল, অথবা আবর্তিক পথে কীভাবে এগিয়ে গেছে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো, অন্তরে এখন অন্য আলো, অচেনা অন্ধকার, কোনো কিছু হয় না আর, হচ্ছে না, হবেও না, এরকম একটা বোধের ভেতর থেকেও অবশেষে কিছু না কিছু তো হয়েছিল অবশ্যই, হেইনের দেয়া দুটো পরামর্শের একটার সূত্র ধরে, না-হলে আগামী দিনগুলোয় আমার নাতি-পুতিরা পৃথিবীর বৃহত্তম ঐ বদ্বীপটায় যেয়ে গবেষণা করবে কীভাবে?