অন্য আলো
কামাল রাহমান
৯
বিমান বন্দরে স্বাগত জানাতে এসেছে হেইনে ও আবীর। এবারের বিলেতে আসায় প্রাণের কোনো উন্মাদনা নেই, উত্তেজনা তৈরি হয় না কোনো, সবই পুরোনো, চেনা বিশ্ব, বাতাসে কেবল অদেখা দীর্ঘশ্বাস, মনের ভেতর কোনো আনন্দ নেই, শিহরণ নেই, গতি হারিয়ে ফেলা নদীর মতো বয়ে চলা নিস্তরঙ্গ জীবন! হেইনে বলে, ওর ফ্ল্যাটে একটা রুম একেবারে খালি পড়ে আছে, বইপত্র ও টুকিটাকি জঞ্জাল পরিষ্কার করে ওখানে থাকতে পারি ইচ্ছে হলে। আবীরদের যে-কোনো একটা রেস্টুরেন্টের স্টাফ রুমেও থাকতে পারি আপাতত। কি করবো বুঝতে পারি না, হেইনে বলে, আবীরের সঙ্গেই যাও, তোমার ইচ্ছে হলে যে-কোনো সময় আমার এখানে চলে আসতে পারো।
গ্লস্টার ও অক্সফোর্ড কাউন্টির সীমানায় চমৎকার একটা গ্রাম হেজলি। আবীরদের একটা রেস্টুরেন্ট আছে ওখানে, উপরে অনেক ক’টা স্টাফ রুম, প্রায় সারা বছরই এক দু’টা খালি পড়ে থাকে, ওখানে নিয়ে আসে আবীর, হেইনে পৌঁছে দেয় গাড়ি করে, রাতের খাবার ওখানেই সেরে নেই হেইনে সহ। আমাকে রুমে গুছিয়ে রেখে ফিরে যায় আবীর, ঘুমিয়ে পড়ি চটজলদি, আজকাল খুব ভালো ঘুম হয়, কোনো কোনো দিন দশ বারো ঘণ্টা, অলসতার ভেতর কাটাতে ভালো লাগে। এতো বছর বিলেতে কাটিয়েও আমার বাঙালি হোটেলকর্মী ভাইদের সঙ্গে মেশা হয় নি, এখানে এসে ওদের জীবনযাত্রা দেখে মনে হয় বাংলাদেশেই আছি, রুমের ভেতর গুমোট গন্ধে ঢোকা যায় না, মেঝে জুড়ে ছড়ানো ছিটানো টুথপিক ও অন্যান্য টুকিটাকি, টেবিলে স্তূপ করে রাখা জঞ্জাল, প্রত্যেকের খাটের নিচে একটা করে স্যূটকেইস, প্রত্যেকের মাথার কাছে, দেয়ালে রশি টানিয়ে ঝোলানো কাপড়-চোপড়, ঘুমোতে আসে শেষরাতে, এগারোটা পর্যন্ত ঘুমোয়, মাঝরাতে হোটেলের কাজ শেষে আড্ডায় বসে, টিভি দেখে, তাস খেলে অনেকে, অনেকটা বন্দিশালায় কাটানো জীবনের মতো।
দু হপ্তার মধ্যে আর একটা বিশাল ঘটনা সামান্য এ জীবনের অনেক হিসেব-নিকেশ পাল্টে দেয়, কর্মজীবন নির্দিষ্ট হয়ে যায় এটাতেই। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইন্ট জন’স কলেজে গবেষক-শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেয়ে যাই, সবাই খুব খুশি, একদিনও দেরি না করে ঢুকে পড়ি। এবিংডনে ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে দেয় আবীর, হেজলির অস্থায়ী আবাস ছেড়ে উঠে আসি নতুন বাসায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পটা এতো ভালো লাগে আমার, মন-প্রাণ ঢেলে দেই, তিন বছর লাগে রেডিওলোজির সাহায্য নিয়ে একটা যন্ত্র তৈরি করতে যা বিশুদ্ধ পানির প্রবাহ নিশ্চিত করবে, পানির পাইপ-লাইনের দুটো প্রান্তের মাঝামাঝি বসানো যন্ত্রটায় থাকবে একটা ডিটেক্টর, পানিতে অগ্রহণযোগ্য কোনো উপাদান যন্ত্রটার আওতায় আসা মাত্র বিশুদ্ধ পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে অন্য একটা ভালব খুলে যাবে, যেখান দিয়ে পানি অন্য আধারে চলে যাবে আবার বিশুদ্ধ করার জন্য। বিশুদ্ধ পানি আসা আবার শুরু হলে এটা বন্ধ হয়ে আগেরটা চালু হয়ে যাবে, এভাবে এক শ ভাগ বিশুদ্ধ পানির প্রবাহ নিশ্চিত থাকবে। গৃহস্থালি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও এটা কাজে লাগবে, ওখান থেকে পচনশীল, অপচনশীল, ধাতু, কাপড়, কাগজ প্রভৃতি বস্তু পৃথক করে ফেলতে পারবে যন্ত্রটা। এটা একটা বড় ধরনের কাজ আমার, স্বীকৃতিও এনে দিয়েছে আমাকে। জীবনের তিক্ত দিকগুলো থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখি কাজে ডুবে থেকে।
হেইনের কাছ থেকে আর একটা জ্ঞান অর্জন করেছি, অসংখ্য ছোট দৈর্ঘের প্রেম করে সে, কোনো কোনোটা এমনকি এক হপ্তার! জীবনের চাহিদা তো মেটাতেই হয়, আমিও অভ্যস্ত হয়ে পড়ি ছোট দৈর্ঘের প্রেমে। জীবনের কেরোলপূর্ব অবস্থায় ফিরে যাই অনেকটা। চাকরি থেকে যা উপার্জন করি, আমার জন্য অঢেল, দেশে যাই প্রতি বছর, বাবাকে সুখী রাখতে চেষ্টা করি। প্রেমিকাদের নিয়ে হলিডেতে যাই বিভিন্ন দেশে। এবিংডনের ছোট্ট বাসাটা ছেড়ে দিয়ে উইটনিতে একটা ডিটাচড বাড়ি কিনেছি। বিশাল, সামনে অনেক বড় বাগান, পেছনে প্রায় ফুটবল খেলার মাঠ, একটা পাহাড়ের চূড়ার সব-শেষ বাড়ি, অনেকটা দূরে অন্য পাহাড়, ফসল আবাদ হয় সেখানে। এতো বড়ো বাড়ি, ফাঁকা লাগে কখনো কখনো, ইউরোপের ইনডিভিজুয়ালিস্টিক জীবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি, খুব একটা অসুবিধা হয় না। প্রেমিকাদের কখনো বাসায় আনি না, উইকেন্ডে কাছাকাছি কোথাও ট্যূরে যাই, হলিডেগুলোয় একটু দূরে। একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছিলাম, ওখানে একটা ডায়লোগ ছিল, ‘মেরে ঘর, মেরে মন্দির’, একটা চলচ্চিত্রও ছিল এ নামে। আমারও নিজের আবাসটাকে কালিমাহীন রাখতে চেষ্টা করি, আত্মার মতো।
আবীর মাঝে মাঝে আসে উইকেন্ডে, আড্ডার জীবন কিছুটা আবার ফিরে পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে মোটামুটি চলে। আবীরের জীবনটাও এলোমেলো হয়ে যেতে শুরু করেছে, ওর বাবা-মা এতো বেশি মেয়ে দেখেছে ওর জন্য, অথচ সত্যি ম্যাচিং হয় এমনটাই দেখছে না বা খুঁজে পাচ্ছে না, আমারই পছন্দ হয় না, কি দোষ দেবো আবীরকে। ওর বাবা একদিন ডেকে বলে, ওকে নিয়ে দেশ থেকে বেরিয়ে আসো ক‘দিনের জন্য, যে মেয়েই পছন্দ করুক, বিয়ে ঠিক করে দেবো আমি। ভাবি, প্রস্তাবটা মন্দ না। ওদের গ্রামের বাড়ি যাই, বিশ্বনাথের দেওকলস গ্রামে। সিলেটের মুরারী চাঁদ কলেজে নতুন চাকরিতে ঢুকেছে, এমন এক মেয়ের সন্ধান পেয়ে ছুটে যাই, কথা-টথা বলে আমারই পছন্দ হয়ে যায়। বলিÑ
আমারই তো ইচ্ছে হচ্ছে।
লাফিয়ে ওঠে সে।
তাই সই, তোর জন্যই কথা বলি।
দূর যাহ্, ঠাট্টা করলাম, আর সিরিয়াসলি নিয়ে নিলি, দিলি লাফ।
সত্যি বলছিস?
হ্যাঁ, সত্যি আবীর, তোর বাবাকে বল।
তুই বল।
পরের হপ্তায় ওর বাবা এসে হাজির, দু হপ্তার মধ্যে ধূমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় ওদের। মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য ওদের কক্সবাজার পাঠিয়ে ওর বাবার সঙ্গে আমিও ফিরে আসি ইংল্যান্ডে।
ওর স্ত্রীর ইংল্যান্ডে আসার জন্য কাগজপত্র তৈরি প্রভৃতি সারতে আরো তিন মাস থেকে যায় আবীর, তারপরও ওকে আনাতে প্রায় এক বছর অপেক্ষা করতে হয়। ছেলেকে বিয়ে করিয়ে আবীরের বাবার খুশি দেখে অভিভূত হই, বুকের ভেতর বাবার জন্য কাঁটার খোঁচা অনুভব করি, তাঁকে খুশি করতে পারলাম না, স্বার্থপরের মতো নিজের জীবনটাই যাপন করে চলেছি, মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারি ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। কিছুদিনের জন্য হলেও বিলেতে নিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেছি, কোনোভাবেই রাজি করাতে পারি নি, মা তো মরে গেলেও বিমানে চড়বে না। আগামী বছর যেয়ে চেষ্টা করবো হজ্জ্ব করতে রাজি করিয়ে ওখান থেকে জোর করে হলেও ইংল্যান্ডে নিয়ে আসবো।
চাকরিটা করে বেশ আনন্দ পাচ্ছি, ক্রিয়েটিভ অনেক কিছু থাকার কারণে সম্ভবত। একটা প্রমোশনও পেয়েছি, বেশ ক’জন চমৎকার সহকর্মীও পেয়েছি।
বিলেতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখে এটা বুঝতে পেরেছি, নব্যধনীদের অথবা উপরে উঠতে মরিয়া বিত্তবানদের বাজে কাজে অবসর কাটানোর জন্য এগুলো গড়ে ওঠে নি। জনগণের সম্পদ এসব, এখানে যারা শিক্ষা নেবে বা দেবে, তারা নৈতিক জীবন যাপন করবে। কারিগর, চিকিৎসক, গবেষক, ব্যবসায়ী, সাহিত্যিক হবে, জনগণের অবদানের বিনিময়ে যারা উন্নত সেবা দেবে ঐ জনগণকে, নিজেদের ভবিষ্যতও সুন্দর করে গড়ে নেবে। গলায় টাই ঝোলানো ভৃত্যকুলের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয় করে না এরা, ভৃত্যদের যোগ্যতা আদেশ পাঠ ও পরিপালনের বেশি কখনোই নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী কেউ আমলা-জাতীয় সরকারী ভৃত্যের কোনো পদের জন্য আবেদন জানালে ওভার-কোয়ালিফাইড বলে বাতিল করে দেয়, প্রকৃত মেধাবীরাই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। নতুন যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠছে, বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ, মানববিদ্যার অগ্রগতি, প্রভৃতির সবই পাশ্চাত্যের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান।
এক তরুণ গবেষক সম্প্রতি যোগ দিয়েছে আমাদের বিভাগে, সহকারী হিসেবে ওকে পেয়ে বেশ ভালোই লাগছে। কিছুটা উড়ণচণ্ডী স্বভাবের এক জার্মান-স্কটিশ, নাম নীল ম্যাককিন, লম্বা ঢ্যাঙা, লালচে চুল, ভাইকিংদের উত্তরপুরুষ সম্ভবত। বিকেল হলেই বেরিয়ে যাবে বাস্কেট বল নিয়ে, রোম্যান্টিক চেহারা, অথচ অস্বাভাবিক রকম লাজুক আচরণ করে ওর সহকর্মী ও সহপাঠিনীদের সঙ্গে। সময়টা এখন অবাধ মেলামেশার স্বর্ণযুগ, প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের সঙ্গে একটু হলেও মিশতে চায়, এমন সুসময়ে নিজেকে বঞ্চিত করার কোনো অর্থ হয়!
বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে ওর একান্ত জগত, আমাদের বিভাগীয় প্রধান ড. চেস্টারম্যান ওর আদর্শ, আরবদের সম্পর্কে কথাপ্রসঙ্গে কিছু সেকেন্ড-হ্যান্ড তথ্য দিয়ে ওকে অভিভূত করে ফেলেছিল চেস্টারম্যান। ওর ধারণা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জ্ঞানের সংযোগ ঘটিয়ে মধ্যযুগে আরবরা রসায়ন ও জীববিদ্যায়, গণিত ও পদার্থবিদ্যায় অনেক জ্ঞানী হয়ে ওঠেছিল, গবেষণা করে এখন যা কিছু আবিষ্কার করছি আমরা, ওদের যদি থামিয়ে দেয়া না হতো, তখনই এসব করে ফেলতে পারতো ওরা, আরবদের নতুন ধর্মটা প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানচর্চার জন্য উদার, অথচ ওদের শাসককুল ছিল প্রকৃত অর্থেই বদমাশ, জ্ঞানের ও দর্শনের চর্চায় ওরা বাধ সাধে যেনো সাধারণ মানুষ প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে উঠে ভ্রান্ত ও দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদদের বিপক্ষে চলে যেতে না পারে, জীবনরক্ষার্থে বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের পালিয়ে বেড়াতে হয় এমনকি, ধর্মকে ওরা ব্যবহার করে নিরক্ষর জনগণকে দারিদ্র ও অশিক্ষার ভেতর আটকে রেখে নিজেদের ভোগ বিলাসিতা বজায় রাখার কাজে, ওটায় এতোটাই সফল হয় ওরা যে এখনো তা চালিয়ে যেতে পারছে চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে, অথচ ওদের ধর্মটা ছিল সে-সময়ের জন্য উদারতম। অন্য ধর্মাবলম্বীরা সময়ের সঙ্গে নিজেদের শিথিল করেছে, যুগোপযোগী করে নিয়েছে, অথচ ওরা এখনো ঐ কট্টরই রয়ে গেছে। গবেষণা করতে কখনো দেখা যায় না চেস্টারম্যানকে, অবসর সময়ে এ ধরনের ছোট ছোট ভাষণ দিয়ে, ও কুকুর পুষে আনন্দ পায়। সবার কাছে প্রিয় হওয়ার মতো কি যেন একটা ছিল ওর ভেতর, ছোট্ট একটা ঘরোয়া পার্টিতে আমন্ত্রণ করে সে আমাদের ক’জনকে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক বিভাগে অন্তত একজন পাগলাটে গবেষক রয়েছেন। এরা বিভাগীয় সম্পদ, ছাত্রদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করায় ওস্তাদ এরা, ছাত্রদের দু চারজনকে বিপর্যস্ত করে এক ধরনের আনন্দ পায় ওরা, যাদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যায় এমনকি। আমাদের বিভাগেও যথারীতি এমন একজন রয়েছে, বিভাগীয় প্রধান নিজেই। সুনীতি বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন তিনি, এগুলোকে বলেন আপাত-অনুকূল স্বার্থান্বেষী নীতি, ভবিষ্যতে যা বাতিল হবে, সত্য হচ্ছে ক্রম-প্রসারমান, ধ্র“ব সত্য বলে কিছু নেই। গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র, কোনোটাতেই আস্থা নেই, ঈশ্বর অথবা শয়তান, কারো অস্তিত্বেই বিশ্বাস বা অবিশ্বাস নেই। সবকিছুকে একই রঙের ভিন্নরূপে দেখেন, শাসক ও শাসিতের সুবিধে অনুসারে একটা মধ্যাবস্থা। আস্তিক ও নাস্তিকের মধ্যে খুব সামান্যই পার্থক্য রয়েছে বলে মনে করেন, যদিও ইহুদি বলে জানে ওকে সবাই, ওর আচরণে প্রেসবাইটেরিয়ানদের সঙ্গে মিল বেশি। কেন যে নীল এতোটা আস্থা অর্জন করেছে ওর মাঝে মাঝে ভেবে পাই না।
আজকের সন্ধ্যায় ওর মেজাজ বেশ প্রসন্ন, প্রতিভাবান কাউকে সে মনে করে হয় ইহুদি, নয় তো আরব, এই অদ্ভুত ধারণার পেছনে শত শত যুক্তি দাঁড় করাতে পারে সে, একারণে কেউই নিজেকে প্রতিভাবান প্রমাণ করতে চায় না ওর সামনে, ফলে সব সময় আসর থাকে ওর দখলে, স্বল্প-দৈর্ঘের বিভিন্ন রশ্মি নিয়ে গবেষণা করতো জার্মানিতে, ওখান থেকে পালিয়ে আসার পর ফিরে যায় নি আর, বস্তুত যাওয়ার মতো কেউ ছিল না। গবেষণাগারে যাওয়া, নিজের ও কুকুরের জন্য খাবার-দাবার কেনার জন্য হপ্তায় একবার সপিং সেন্টারে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো কারণে ঘরের বাইরে বেরোতো না সাধারণত। বিভিন্ন উদ্ভট আচরণের জন্য ছাত্রদের ভেতর অনেক গুজব ছিল ওকে নিয়ে, কেউ কেউ ওকে সমকামী বলতেও ছাড়তো না। আলোর তরঙ্গ-দৈর্ঘের চেয়েও ছোটো তরঙ্গ নাকি প্রায় আবিষ্কারই করে ফেলেছে সে! প্রচলিত নিয়ম অনুসারে ছাত্রদের সঙ্গে সহকর্মীদের বিষয়ে আলোচনা করে না শিক্ষকেরা, নীলের সঙ্গে তাই ওর বিষয়ে কোনো কথা বলি না। এটা বুঝতে পারি, কোনো প্রসঙ্গে নীলের সঙ্গে এভাবে কথা পেঁচিয়ে তোলে সে, যেনো আমার প্রসঙ্গ এসে যায়, এভাবে আমার বিষয়ে টুকটাক জানতে চায় চেস্টারম্যান, কথার পিঠে কথা নিয়ে আসার আশ্চর্য ক্ষমতা ওর, কোনো কারণ পাই না ওর ঔৎসুক্যের, হয়তো ভেবেছে যেহেতু মুসলমান আমি, আরবদের মিশ্রণ ঘটে থাকতে পারে আমার ভেতর, তায় আবার নামের নাকে একটা শেখ বসিয়া আছেন! ওর অনুমানটা খুব মিথ্যেও না, উন্নত জীবনের লোভে ইয়েমেনের এক দল সুযোগসন্ধানী এসেছিল আমাদের অঞ্চলে, যারা ফিরে যায় নি আর কখনো।
আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে চেস্টারম্যানের বন্ধু, বিখ্যাত এক কবি রয়েছেন আমাদের সঙ্গে, নিয়মিত কবিতা পাঠের জন্যই হয়তো ওর গলার স্বর সব সময় উঁচুতে থাকে, চেস্টারম্যানকে খুঁচিয়ে উত্তেজিত করে তোলা ও আসর ভণ্ডুল করে দেয়ার কৃতিত্ব নেয়ার জন্য ওর জুড়ি দ্বিতীয় কেউ নেই, সবার ইচ্ছে সব শেষে কথা বলুক সে, যখন সবাই সত্যিই ঘরে ফিরে যেতে চায়। অথচ কি এক প্রসঙ্গ এসে যায় হঠাৎ, চেঁচিয়ে বলেÑ
আমরা যারা স্বপ্ন ও সৌন্দর্য ভালোবাসি, এটা বিশ্বাস করি ও নির্মাণ করি, তাদের অবহেলা করার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই তোমার, চেস্টার, বিজ্ঞানের সব আবিষ্কার ও অগ্রগতি হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করি আমরা, বিশুদ্ধ সংখ্যা বা গণিত দিয়ে যা প্রমাণিত নয় তার যদি কোনো মূল্যই না থাকে, তাহলে তোমার স্ত্রীকে বলো-না, ঠোঁটে লিপস্টিক না লাগাতে, কেশ-সজ্জা না করতে, প্রসাধন ব্যবহার না করতে …
ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে চেস্টার –
চুলোয় যাক, সৌন্দর্যের কোনো মূল্য নেই এমন ধারণা কস্মিনকালেও আমার ছিল না, নেই, এবং থাকবেও না।
বিষয়টা যেন এগিয়ে যেতে না পারে, এবং এটা থেকে পরিত্রাণ পেতে দারুণ এক কাজ করে আমাদের তরুণ অতিথি, উঠে যেয়ে চেস্টারের স্ত্রীকে জানায় –
আপনার স্বামীর যদি আপত্তি না থাকে তাহলে চলুন এক পাক নাচি।
নিশ্চয়, বলেই মিউজিকের ভলিউমটা বাড়িয়ে দিয়ে সত্যিই নাচতে শুরু করে ওরা। বাজনাটা ছিল মধ্যলয়ের, একে একে সবাই জোড় বেঁধে নাচতে শুরু করে, জোড় না থাকায় বসে বসে দেখি। পরিবেশটা আবার আনন্দঘন হয়ে ওঠে। একটা চমৎকার সন্ধ্যা উপভোগ করে সবাই, মিসেস চেস্টারম্যান ঘরে-বানানো তিন স্তরের চকোলেট কেইক পরিবেশন করে পার্টির শেষে এসে।
বাইরে যথেষ্ট ঠাণ্ডা হলেও হেঁটে ঘরে ফেরার ইচ্ছে হয়, সঙ্গী জুটে যায় নীল, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অনেকগুলো ছোট বড় ভবন ও বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই, শরীরের ভেতর থেকে শীতের অনুভুতি চলে যায় একটু পরে, একটা ভবনের কাছাকাছি যেতে বাইরের বাতিটা নিভে যায়, একটু আশ্চর্য হই, বাল্ব ফিউজ হয়েছে না রাতজাগা কোনো প্রাণী নিজেকে আড়াল করার জন্য বাতিটা নিভিয়ে দিয়েছে! কয়েক মিনিট পর আমাকে বিদায় জানিয়ে ওর বাসার দিকে ঘুরে যায় নীল, বেশ বড় একটা মাঠের পাশ দিয়ে পেরোতে হবে রাস্তাটা। নির্মম শীতের শান্ত রাতের মলিন আলোয় দীর্ঘ শরীর, জগত-সংসার বিষয়ে নির্লিপ্ত, আত্মসমর্পিত, অদ্ভুত আচরণ এক মানুষের আবির্ভাব ঘটে। আর্যদের উঁচু নাক ও গোল কপালের দু পাশে উজ্জ্বল দুটো চোখ মেঘমুক্ত আকাশের øিগ্ধ তারার মতো, পৃথিবী ও পরিপার্শ্ব সম্পর্কে অচেতন, আত্মমগ্ন, হয়তো নিজেও জানে না কোথায় হেঁটে যাচ্ছে অথবা কেন, হাত দুটো ওভারকোটের পকেটে ঢোকানো, কাছাকাছি আসতেই একটা হাত বাড়িয়ে দেয় একটুও অপ্রতিভ না হয়ে, যেনো এখানেই থাকার কথা আমার, পূর্ব-নির্দিষ্ট!
কেমন আছো ডাউ?
ড. লিস্টেনবর্গ!
চিনতে পারছো না?
কষ্ট হচ্ছে।
হবারই কথা। সেই বিকেল থেকে ফোন করে চলেছি তোমাকে, রিং বাজছে, ধরছো না কেন?
বাইরে থেকে ঘরের ভেতর ফোন ধরার কৌশলটা এখনো শেখা হয় নি তোমার কাছ থেকে, হেইনে, আশা করি শীঘ্রই শিখে নেবো এটা…। তোমার মতো অলৌকিক ক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারি নি, দুঃখিত এজন্য।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমার এখানে আজ রাতটা কাটানো যায় ডাউ?
আমি খুব ক্লান্ত হেইনে, এখন যেয়েই ঘুমিয়ে পড়বো, সুবিধে হবে না তোমার।
তোমার লিভিং রুমের সোফায় ঘুমোতে পারবো আমি।
ব্রিটিশেরা তোমার মাপে সোফা বানায় না তো, পা নয়তো মাথা, কোনো একটা ঝুলিয়ে রাখতে হবে তোমাকে।
দেখা যাবে ওটা, চলো এগোই তাহলে।
অগত্যা বলি –
চলো।
দুঃখিত ডাউ, তোমার অনুমতি না নিয়ে এসে পড়ার জন্য।
এতো ভদ্রতা দেখাতে হবে না, অনেকদিন আগে থেকেই অভ্যস্ত হয়ে গেছো এতে।
একটু চুপ করে থাকে হেইনে, ছোট্ট একটা চাপড় দেই পিঠে।
কিছু মনে করো না।
না না ডাউ। একটু থেমে বলে, হয়তো জানো, ইংল্যান্ডে একমাত্র তোমার সঙ্গেই এমনটা করি আমি।
জানি জানি।
আর অধিকার তুমিই দিয়েছো।
রাখো তো ওসব হেইনে।
একটা উৎকট ঝামেলা মনে হচ্ছে, সত্যিই যেয়ে ঘুমানোর ইচ্ছে এখন, ঘরে ঢুকে উপর থেকে বিছানাপত্র এনে দেই ওকে। বলি, শুয়ে পড়ো।
ফ্রেশ হয়ে উপরে উঠে শুয়ে পড়ি। ঘুমোবো, দীর্ঘ ও নির্বিঘ্ন একটা ঘুম চাই এখন, বিছানায় শুয়ে ঘুম আসে না, আমার ঘুমের প্রাকৃতিক অষুধ, পাশ্চাত্যের উচ্চাঙ্গ সংগীতের ছয়টা রেকর্ড চেঞ্জারে চাপিয়ে দেই, খুব লো ভলিউমে, ঐ সব সংগীতের অনেকগুলোরই বৈশিষ্ট্য এমন যে মাঝে মাঝে জোরে বেজে উঠে ধীরে ধীরে এতো ক্ষীণ হয়ে যায় যে মনে হয় অনেক অনেক দূরে কোথাও বাজছে, ঘুমোনোর জন্য এর চেয়ে ভালো আর কিছু এখনো আবিষ্কার করতে পারি নি। এতেও কাজ হয় না এখন! হেইনের মতো এমন একটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, যাকে ভগবান গড়েছেন নিজ হাতে অনেক যত্ন করে, তাকে নিচে রেখে ঘুমোনো অসম্ভব! ধুত্তোর, বলে নিচে নেমে অবাক হই, চুপচাপ সোফায় বসে আছে, বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা ভাবছি, ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছি। বলেÑ
ঘুমাই নি।
তাই বলো। আলো জ্বালবো?
জ্বালো।
একটু দুঃখবোধ হয় ওর জন্য, আরেকটু ভালো হওয়া উচিত ছিল আমার, বেচারা!
ঘরে পড়ার পোশাক দেই হেইনে, একটু স্বচ্ছন্দ হও?
দিতে পারো।
কাপড় পাল্টে হাতমুখ ধুয়ে আসো, কিছু একটা তৈরি করি তোমার জন্য, কি খাবে বলো?
যে-কোনো কিছু, যা খুশি তোমার।
জেইমির চিকেন সালাদ দিয়ে একটা স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেই, একটা হ্যাডক ফিলে ও কয়েকটা পটেটো ওয়েজেসও ভেজে দেই।
খাবার দেখে খুশি হয়ে ওঠে।
বাহ্!
ওর খাওয়া দেখে বুঝি ক্ষুধার্ত ছিল, আমি ঘুমিয়ে পড়লে নিশ্চয় অন্যায় হতো, ভাগ্যিস ঘুমাই নি! একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি –
ভাবলে কি করে যে ঘরে পাবে আমাকে, এতোটা পথ পেরিয়ে এসেছো।
আগেও বলেছি তোমাকে ডাউ, মনের টানে চলি সব সময়, সাধারণত মনের বিপক্ষে যাই না আমি, মন যা বলে তাই করি। এক শ ভাগ ক্ষেত্রেই যে মনের ইচ্ছেটা ঠিক হয়ে যায়, তা না, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনের ইচ্ছেটাই জয়ী হয়, দু একবার বিপরীত হলেও মনে কিছু করি না, ওটাই প্রকৃতির নিয়ম। শত ভাগ সঠিক বা অভ্রান্ত বলে কিছু নেই পৃথিবীর কোথাও। মন তো মানুষেরই, আর মানুষ প্রকৃতিরই অংশ, এটা মেনে নিতে কষ্ট হয় না আমার, মন বলেছে, ঘরে পাবো তোমাকে আজ, একটু দেরিতে হলেও পেয়েছি। মন বলেছে, ঐ পথ ধরে ফিরে আসবে তুমি, তাই এসেছো, মন বলেছে, তুমি এখন ঘুমাবে না, ঘুমোও নি…
হেইনে, তোমার ভেতর তো দেখি প্রোফেসি রয়েছে! বলো দেখি আরো কি কি বলে তোমার মন, আমার কাজে লাগবে।
ওর সেই নিঃশব্দ হাসিতে ভরিয়ে দেয় আমার মনের সবটুকু। জিজ্ঞেস করি –
আমার মন যে কিছু বলে না হেইনে?
কোথাও একটা কাঁটার খোঁচা খাই। দু কাপ স্ট্রং কফি বানিয়ে নিয়ে আসি, ওরেওর মিক্সড বিস্কুটের একটা টিন খুলি, এই বিস্কুটগুলো কেন যে এতো ভালো লাগে আমার, থামতে পারি না!
সবার মনই কিছু না কিছু বলতে চায় ডাউ।
যাদের মনের বলা কথায় অধিকাংশ বাস্তবের সঙ্গে মিলে যায় তাদের অতিলৌকিক কোনো ক্ষমতা আছে বলে ধরে নেয়া হয়।
এখানেই ভ্রান্ত হই আমরা, অথবা ভ্রান্তির ভেতর পড়ে যাই নিজেরা। তুমি তো আবার নীৎসে প্রসঙ্গ তুলতে দেবে না, এই ভ্রান্তি সম্পর্কে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি।
না, নীৎসের প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই আমার। তবে শেষ পর্যন্ত আঙ্গুলটা এসে তার চোখেই গুঁতো দেয়।
অস্বীকার করছি না, শেষ পর্যন্ত ভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে বেরোতে পারেন নি তিনিও। কথা হচ্ছিল মনের কথা নিয়ে, যখন বিজ্ঞান, আরো সংকীর্ণ হয়ে বললে, মনোবিদ্যা, যেটাকে বিজ্ঞানের একটা অংশ বলে মনে করি, এতোটা অগ্রগতি অর্জন করে নি, দেড়-দুই-আড়াই হাজার বছর আগে, যে সব মহান ব্যক্তিদের মনের কথাগুলো অধিকাংশ বাস্তব বা প্রায়-বাস্তব রূপ লাভ করে, সাধারণভাবে চিন্তা করতে অক্ষম আমজনতা ওদের ঐ ক্ষমতাকে অলৌকিক ভেবে নেয়, ওদের মনের যে-সব কথা ঠিক হতো না, বা ফলে যেতো না সেগুলো দক্ষভাবে চেপে যেতো ওদের গুণগ্রাহীরা, তাবেদাররা, বা উপকারভোগীরা। ঐ সব মানুষদের শিখণ্ডী বানিয়ে ওদের উপর প্রোফেসি আরোপ করে নিজেদের মনের অনেক কথাও ওদের বলে চালিয়ে দিতো, অনেক কিছু আবার দৈব বাণী বলে প্রচার করতো, প্রায় প্রতি প্রজন্মে বিভিন্ন গোত্রে এ রকম এক-আধজন অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের আবির্ভাব হতো, ওদের অনেকে সাধু, অথবা ভণ্ড, অথবা এ দুটোর মিশেল।
এভাবে বলো না।
শুধু তোমার সঙ্গেই বলছি এসব।
কাউকেই এতো বেশি বিশ্বাস করো না।
তা হলে তো নিজেকেই অবিশ্বাস করতে হয়।
ওদের উদ্দেশ্য কিন্তু অসৎ ছিল না।
তা বলি নি, কিন্তু একটা ভ্রান্তির বেড়াজাল তৈরি করেছিল ওসব, মানুষের স্বাধীন চিন্তাশক্তির জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এতো অসংখ্য ছিল ওরা, কেউ কেউ বিভ্রান্তি ছড়াতেও পারে।
হ্যাঁ, হিন্দু শাস্ত্রে বলে তেত্রিশ কোটি দেবতা, তোমাদের শাস্ত্রে বোধ হয় কয়েক লক্ষ পয়গম্বর।
শাস্ত্র বিশারদও হয়ে ওঠেছো দেখছি, কি নও তুমি!
দেখো, ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে সব চেয়ে বেশি অনাগ্রহ আমার, অথচ কথা বলতে গেলেই ওদুটো এসে পড়ে।
তার মানে ওদুটো বাদ দিয়ে জীবন হতে পারে না, এজন্যই তো বলি শিল্প সাহিত্য নিয়ে কথা বলো।
ওখানে ওদুটো নেই?
বেকায়দায় ফেললে হেইনে।
থাক, তাহলে কি আমার বিষয়টা নিয়ে কথা বলবো?
খবরদার, মুখ খুলেছো তো টুটি চেপে ধরবো।
এতো কষ্ট করে এলাম!
না, এজন্য আসো নি তুমি। আমার মনও মাঝে মাঝে কথা বলে, সেগুলো ঠিক ঠিক হয়ে যায়।
হেসে বলে, বিশ্বাস করো।
অনেক বার করেছি।
কেন যেনো মনে হচ্ছে ডাউ, তোমার কাছে এসব বলার জন্য খুব বেশি সময় আমার হাতে নেই।
তোমার মন বলছে এ কথাটা?
হ্যাঁ।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
কিছুটা বিষণ্ন মনে হয় ওকে, এই প্রথম ওর চোখে অন্য এক আলো দেখি, নিষ্প্রভ, শীতের কুয়াশামাখা ধূসর! বলি –
ঠিক আছে হেইনে, সব সময় যেখানে এসে থেমে যাও, তার পর থেকে যদি বলতে চাও, বা পারো, সেখান থেকে শুরু করতে পারো, আগের কথাগুলো অন্যভাবে বলে বোকা বানানোর চেষ্টা করো না আমাকে।
ঠিক আছে, সোফায় হেলান দিতে পারি একটু, ক্লান্ত বোধ করছি।
নিশ্চয়, শুয়ে পড়তে পারো, বালিশটা নাও, শুয়ে শুয়ে বলো।
তাই ভালো, কিছু একটা পান করতে পারি, ওয়াইন জাতীয়।
সেলার থেকে নিয়ে নাও যা খুশি, টয়লেট থেকে আসছি আমি।
হিটার অন থাকায় বেশ গরম হয়ে উঠেছে ঘর, টয়লেট থেকে ঘুরে এসে দেখি মৃদু নাক ডাকছে হেইনে! অবাক হই, এমন হুট করে ঘুমিয়ে পড়ার কথা তো না, কিছুক্ষণ বসে থাকি, আরো ভারি হতে থাকে ওর শ্বাস-প্রশ্বাস, উপরে উঠে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, যা চাইছিলাম ক’ঘণ্টা ধরে।
ঘুম থেকে উঠে দেখি অন্য আকাশ, অন্য আলো, এতো ঝকঝকে, ঘরের ভেতর থেকে গ্রীষ্ম বলে ভুল হয়, হেইনেকে বলি, আজ আমার যাত্রা নাস্তি, ঘরের বাইরে পা রাখা যাবে না, গান শুনবো শুধু, আর খাবো-দাবো, ফুর্তি করবো।
নাচবে না?
সঙ্গী নেই।
দুঃখের বিষয়! তা আমার যে আবার যাত্রা শুভ।
মাঝামাঝি কিছু একটা হবে, ময়ূরী পছন্দ করো তুমি?
স্যাঙ্কচুয়ারিতে দেখেছি, খুব সুন্দর, তোমাদের একটা কবিতা পাঠের আমন্ত্রণে যেতে হয়েছিল, জীবনে ঐ একবারই, একটা শব্দ বুঝতে না পেরে ওটার মানে জানতে চেয়েছিলাম, মনময়ূরী, কোনোভাবে মিলাতে পারি নি মনের সঙ্গে ময়ূরীর সম্পর্ক, ওর অনুবাদটাও সম্ভবত ভালো ছিল না।
এটা কোনো বিষয় না, ভাষার এ রহস্যটা সব ভাষায়ই আছে, আমার কাছে ঐ শব্দটা ভীষণ দ্যোতনা সৃষ্টি করে, বর্ষার সঙ্গে মনের সম্পর্ক, ঐ ঋতুতে ময়ূরী কেন পেখম মেলে, প্রকৃতির এসব অনুষঙ্গ তোমাদের নেই, এটা না বোঝাই স্বাভাবিক তোমাদের, পাশের গ্রামে একটা ময়ূরীর খামার আছে, বিকেলে যেতে পারো।
এক সঙ্গে অনেকগুলো ময়ূর দেখে অভিভূত হেইনে, বেশ বড় লেজের পূর্ণ-বয়স্ক একটা ময়ূরী দেখে বিস্ময়-চোখে, ওটার ছবি দেখাই। এরকম পেখম মেলে ওরা বর্ষা এলে, ওদের প্রজননকাল। মৌসুমী বর্ষায় বাংলাদেশের মানুষের মনও নেচে ওঠে, ওরা যখন পেখম মেলে, এমনভাবে কাঁপে ওটা, মনে হয় ময়ূরীটা নাচছে যেনো, চমৎকার ছন্দ আছে ওখানে, ভারতীয় নাচের মুদ্রায়ও এটা ব্যবহার করা হয়, রোম্যান্টিকতায় তোমার মনও নেচে ওঠে ওভাবে।
একটু একটু বুঝতে শুরু করেছি।
হালকা ফুরফুরে মন নিয়ে পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, এক সঙ্গে বেশ ক’টা ভালো সংবাদ, আমার একটা আর্টিক্যাল জার্মানিতে অনুবাদ করার জন্য অনুমতি চেয়ে পত্র পেয়েছি, আমেরিকার একটা বিখ্যাত জার্নালে বড় একটা আর্টিক্যাল বেরিয়েছে, নতুন একটা গবেষণার জন্য বড় একটা ফান্ড ও আরো এক জন সহকারী পেয়েছি।
ঘরে ফিরেই হেইনের ফোন!
অভিনন্দন।
জানলে কি করে?
শুধু আমার পেছনেই স্পাই নেই।
তোমার টিকটিকির লেজ কেটে দেবো আমি।
ও বেটা জার্মান, লেজ ছাড়াও দৌড়াতে পারে।
নীলের সঙ্গে কথা হলো কখন?
দুপুরেই ফোন করেছিল, খুব খুশি ও, একটা পার্টি দাও।
আমি পার্টি দিলে তো আবার মাতাল হয়ে যাও তুমি।
এবার হবো না।
দেবো তা হলে।
আমার মনের বিষয়টা তো বলেছি তোমাকে, এবার আমার মন বলছে একজন বড় বিজ্ঞানী হয়ে উঠবে তুমি।
বিজ্ঞানী হতে চাই না সেভাবে, হয়তো।
কেন?
হতে চেয়েছিলাম, কবি, গৃহী, কোনোটাই হই নি।
গৃহী না হতে পারার বিষয়টা জানি, দুঃখজনক, এখনও তো অনেক সময় আছে। কবি না হতে পারার বিষয়টা তো জানি না।
ছাত্রজীবনের শুরুতে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম, বলতে পারো এটা বাঙালির স্বভাব, কিন্তু আমার কবিতাগুলো মনে হয় ছিল অসাধারণ, কবিতার খাতাটা সঙ্গে আনতে যেয়েও আনি নি। ভাবতেও পারি নি এভাবে বিলীন হয়ে যাবে ওটা।
কি হয়েছিল?
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বলি।
আবার লেখা শুরু করো, অসুবিধা কোথায়, যদি কবিতা-বোধ থাকে তোমার ভেতর।
ঐ লেখাগুলোয় আমার কবিতার বীজ রুয়েছিলাম, এতোদিনে ওগুলো গাছ হয়ে জন্মাতো, মুকুলিত হতো, রং ছড়ানো ভোরের আকাশে, সন্ধ্যার গোধূলি আলোয়, হয়তো বা।
আবার রোপণ করো।
হয় না, হবে না। বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করা যায়, কবিতা না এলে মাথা কুটে মরলেও কিছু হয় না।
ওটা বুঝি না আমি।
না বোঝাই ভালো।
যাহোক, পার্টি হচ্ছে কবে?
আমাদের দেশে একটা কথা বলে, রাঙা শুক্রবার।
মানে কি?
রঙিন যে শুক্রবার।
তাও বুঝি নি।
যে শুক্রবার কখনো আসে না।
দরকার নেই, শনিবারে হবে।
তাহলে হোস্ট তুমি।
হতে হলে হবো, কো-হোস্ট।
বাহ্!
হেইনের চাপে পড়ে অক্সফোর্ডের বিখ্যাত এক রেস্টুরেন্ট তাজমহলে একটা পার্টি দেই, আমার জন্মদিনে। ইতোমধ্যে আমার আর একটা আর্টিক্যালের ফরাসী অনুবাদ বের হয়েছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ পাই নিয়মিত। ব্যক্তি জীবন, অথবা আরো নির্দিষ্ট করে বললে, পারিবারিক জীবনটা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলেও কর্মজীবনে উন্নতি ঘটতে থাকে, শনৈ শনৈ!
চেরওয়েল ও আইসিস, উভয় নদী দিয়ে এতো জল সমুদ্রে গড়িয়ে গেছে কখন বুঝতেই পারি নি! জুলফিতে পাক ধরেছে, বান্ধবীরা ঠাট্টা করে। পৃথিবীর অনেক জায়গাই ঘুরে দেখা হয়েছে, সিদ্ধান্ত নেই সাব্বাটিক্যাল লিভ নিয়ে দীর্ঘ সময় কাটাবো দেশে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি পেয়ে যাই।
দেশে ফিরে অনেক বেশি সময় কাটাতে চাই বন্ধুদের সঙ্গে, এ দেখি ভিন্ন এক জগত, এতো বদলে গেছে সব! বন্ধুরা সব পরিবার-পরিজন চাকরি-বাকরি নিয়ে এতো ব্যস্ত, দম ফেলারও ফুসরত নেই কারো! কেনো এই জীবন? কেউ ছুটি নিতে পারে না, অফিস চলবে কি করে? ব্যবসায়ী কোথাও যেতে পারে না, ব্যবসা লাটে উঠবে! প্রত্যেকেই অপরিহার্য করে তুলেছে নিজেদের। ঢাকা ছেড়ে গ্রাম-গঞ্জের বন্ধুদের সঙ্গে কাটানোর পরিকল্পনা করি, শান্তি পাই না, মানসিক ব্যবধান এতো বেড়ে গেছে, পুরোনো দিনের জাবর কাটা ছাড়া নতুন প্রসঙ্গ খুঁজে পাই না। কক্সবাজারের এক পুরোনো ইয়ারের সন্ধান করি অবশেষে। বাংলাদেশের অনেক কিছুর মতো সেও উধাও হয়ে গেছে।
সামাজিক শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক শৃঙ্খলা, প্রভৃতি সবই ঠিক থাকে যদি অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় থাকে। স্বার্থান্বেষী চক্র অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দেশটাকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছে। যে সকল মানুষের কাছে নুনের পয়সাও ছিল না, পান্তার বদলে পোলাও কেনার সামর্থ রাতারাতি এসে গেছে ওদের, জীবন যাপনের স্বাভাবিক হিসাব নিকাশ গুলিয়ে ফেলে ওরা। ঘাপটি মেরে থাকা রাজাকারের দোসররা মুখোশের আড়াল থেকে সুযোগ বুঝে বেরিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল, অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল তাহের হত্যার মাধ্যমে অতি-জঘন্য রাজনীতির সূত্রপাত করেন। ভুঁইফোড় নব্যধনী, সুযোগ-সন্ধানী সামরিক ও বেসামরিক আমলা গোষ্ঠী, স্বার্থান্বেষী আওয়ামী-গোষ্ঠী, পুনর্বাসিত রাজাকার, মাথাপচা ভণ্ড বামপন্থী, আস্তাকুড়ঘাটা বুদ্ধিজীবী নামধারী ঘোড়েল, প্রভৃতি, ও এক শ্রেণির পা-চাটা জনতার মিশ্রণে এক অভাবনীয় দল গড়ে তোলে, যাদের না ছিল কোনো আদর্শ বা দেশপ্রেম! যে-রকম নৃশংসতায় বিরোধী কাঁটাগুলো পথ থেকে অপসারণ করেছিলেন তিনি, একই রকম হিংস্রতার সঙ্গে তাকেও সরানো হয়। পরবর্তী একনায়ক জেনারেল তার অসমাপ্ত কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করা শুরু করেছেন। এই কালো রাজনীতির হাত থেকে নি®কৃতি পাওয়া দেশের জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে। এতো অপরিকল্পিতভাবে একটা জাতি এগোয় কীভাবে, আরবরা যেমন এক সময় অন্ধকার যুগের বলে ওদের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য সব নিশ্চিহ্ন করা শুরু করেছিল, তেমনি পুরানো সব কিছু ভেঙ্গে ফেলে যেখানে যা খুশি গড়ে উঠছে, এমনকি শত শত বছরের পুরোনো গাছপালাও কেটে ফেলা হয়েছে। সভ্য দেশে হাইওয়ের কাছ থেকে বাজার, লোকালয় প্রভৃতি জনবহুল স্থান দূরে রাখা হয়, এখানে রাস্তার উপর বাজার বসানো হচ্ছে, গাড়ি-ঘোড়া আটকে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির এই বৈপরীত্য অবাক হওয়ার মতো, পেছনে হাঁটার প্রতিযোগিতা যেনো চলছে এখানে! সাধারণ মানুষের স্বপ্ন ধুলায় গড়িয়ে পড়েছে, মুষ্টিমেয় সুযোগসন্ধানীরা অর্থের পাহাড় গড়ে তুলছে। এসব দেখেশুনে ছুটি শেষ হওয়ার আগেই বিলেত ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়।
গত দু বছর ধরে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছে নিউইয়র্কের সেজানের সঙ্গে, ওকে ফোন করি, কাউকে না জানাতে বলে সে আমাকে। ভালোই হয়েছে, সময়টা কক্সবাজারে কাটিয়ে দেবো। অখণ্ড অবসর পেয়ে স্মৃতিগুলো উথলে ওঠে মাঝে মাঝে। কক্সবাজার যাই। হায়, এই সেই হাকসোবাজার! আদিবাসী রাখ্যাইনদের সুন্দর, ঝকঝকে ছোট্ট শহর বদলে এখন এতো কুৎসিত! নোংরা রাস্তাঘাট, চারদিকে আবর্জনার স্তূপ, মধুমাসের নীলমাছির মতো রঙিন মানুষের ঝাঁক, রিক্সায় অচল রাস্তা, পর্যটকদের টেক্সিগুলোর অকারণ হর্ণ, এসব পেরিয়ে হোটেল সীসাইডের দুয়ারে পৌঁছি। সঙ্গে সেজান, আমি ডাকি সজনি, বছর তিনেক ধরে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি, ডিভোর্স হয়ে যাবে শীঘ্র। নিউইয়র্কে প্রায়ই আমার হোটেল-রুমে আসে রাত কাটাতে, হলিডেতেও যায় মাঝে মাঝে, এবারই প্রথম দেশে আসে আমার সঙ্গে, আমি যেমন কাউকে জানাই নি, সেও না। নিউইয়র্কের ব্যার্ড কলেজে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশানস পড়ায় সেজান, জন্মসূত্রে আমেরিকান, দেশ থেকে পাত্র পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছিল বাবা-মা, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, আমেরিকায় যেয়ে চোখ-টোখ ফুটে সাদা মেয়েদের চাটা হয়েছে এখন, স্ত্রীর কোনো মূল্য নেই ওর কাছে, নব্যধনীদের যা হয়। ওর বাবা নাকি জেনারেলের দলের এক পাতি-মন্ত্রী, বাংলাদেশের মানুষেরা ওদের রায়ত, যা খুশি করা যায় এদের নিয়ে!
হোটেলের পাঁচতলায় সমুদ্রমুখী একটা রুম বেছে নেই, রেজিস্টারে তথ্য লিখতে যেয়ে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়ি, পৃথিবীর এতো দেশের এতো এতো হোটেলে থেকে এলাম কোথাও সঙ্গিনীর সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ লিখতে হয় নি, এখানে এটা লিখতে যেয়ে মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত হই, কাউন্টারের লোকটার সন্দেহ সৃষ্টি না করার জন্য চট করে লিখে ফেলি ‘স্ত্রী’, সজনি এটা লক্ষ্য করে, কনুই দিয়ে পাঁজরে গুঁতো দেয়, বেশ শক্ত, প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করি না, রুমে ঢুকেই হেসে লুটিয়ে পড়ে।
এই যে ভাই, মিথ্যে পরিচয় দিচ্ছেন কেন?
উপায় তো ছিল না, এখানে ‘পার্টনার’ লিখলে সোজা পুলিশের তেরো খোপ।
রুম সার্ভিস ডেকে খাবার আনিয়ে নেই, ডাইনিংএ যেতে ইচ্ছে করে না, ঝুল-বারান্দায় টেবিল পেতে খেতে বসি, চোখ জুড়িয়ে দেয় সামনের সমুদ্র, পেছনের নোংরা শহর মুছে গেছে স্মৃতি হতে, এমন সমৃদ্ধ একটা সৈকত থাকতে এদেশে পর্যটন শিল্পটাই গড়ে উঠতে পারছে না। রুমে টেলিফোন বেজে ওঠায় চমকে উঠি, কথা তো ছিল না! কে হতে পারে?
হ্যালো?
স্যার, আপনার গেস্ট এসেছে, কথা বলতে চান, দেবো?
কে?
সোয়েচিন।
সোয়েচিন! ও হ্যাঁ, দিন।
হ্যালো সোয়েচিন?
হ্যাঁ, সোয়েচিন, তুমি কেমন আছো?
আমি ভালো, তুমি?
আমিও ভালো।
জানলে কি করে আমি এখানে?
বলবো, তোমার ওখানে আসবো?
আসবে?
হ্যাঁ, আসছি তাহলে।
না হয় এক কাজ করো, তুমি ওয়েটিঙে বসো, আমি বেরিয়ে আসছি, এক সঙ্গে বেড়াতে যাবো কোথাও।
তাও হয়, আসো, ঠিক আছে।
ফোন রেখে ফিরে আসি খাবার টেবিলে। সেজান বুঝতে পারে ফেঁসে গেছি, চোখে ওর দুষ্টু হাসির ঝিলিক। কি করি, প্রাণের এমন বন্ধুকে নিয়ে এখন! সোয়ে সত্যিই আমার অন্তরের দোসর, আমার অনেক লেখার প্রথম পাঠক, আমার অনেক কবিতার চরণ ওর মুখস্ত, যা আমারও নেই। একজন উঁচুমানের পাঠক, ওর সিনেমা সংগ্রহ ছোটোখাটো একটা আর্কাইভ হয়ে যায়, এমন চলচ্চিত্র বোদ্ধা আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ নেই, এমনকি যারা ছবি বানায়, ওরাও, অথচ সে কিছুই লেখে না, কিছুই বানায় না, কখনো কখনো গানে বুঁদ হয়ে থাকে, দেশের আনাচে কানাচে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেরও কোথায় কোথায় চলে যায় গ্রামীণ সব গান সংগ্রহের জন্য, সরাসরি এসব রেকর্ড করে নিয়ে আসে, উঁচুমানের শিল্পরসিক, কক্সবাজার ছেড়ে কোথাও যাবে না, নাম আসলে সোয়েব চৌধুরি। কক্সবাজারে আমাদের বন্ধুদের অধিকাংশই রাখ্যাইন, পান-ভোজনের নিষেধ-জালের বাইরে থাকার কারণেই হয়তো। সোয়েচিনকে দেখায়ও অনেকটা রাখ্যাইনদের মতো, ছোট নাক, ফর্সা, বেঁটে। ওকে যখন সোয়েচিন বানিয়ে ফেলি, প্রতিবাদ করে নি, বন্ধুদের মধ্যে এটা চালু হয়ে যায়, আমাকে গুম হয়ে থাকতে দেখে সেজান বলেÑ
ভাবাভাবির কিছু নেই, আমি এখন ঘুমোবো, নির্দ্বিধায় যেতে পারো তুমি।
তাই?
হ্যাঁ, সত্যিই ঘুম পেয়েছে, ক্লান্তিও লাগছে।
ঠিক আছে, ফিরতে দেরি করবো না।
না না, তা কেন! বরং রাতে না ফিরলেও পারো।
ও বুঝতে পেরেছে, আমার কক্সবাজার জীবনের গল্প বলেছি ওকে এক সন্ধ্যায়, কক্সবাজারের রাত মানে মাতাল, মদির, অধীর, চঞ্চল! পার্টনারের এই সুবিধে, কোনো দায় নেই তেমন, যা পুরোপুরি রয়েছে একজন স্ত্রীর কাছে। পাশ্চাত্যের মানুষেরা এটা বুঝেই সহজ সম্পর্কটা গড়ে নিয়েছে। বিশ্বের অপরাপর অংশের মানুষেরাও বুঝে নেবে ধীরে ধীরে, যাদের সামাজিক বিকাশ যত আগে হবে!
সোয়েকে দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে এতোটা একই রকম রয়ে গেছে, শুধু নাকের দু পাশের দাগ দুটো নতুন মনে হয়, ছোটো ছোটো চুলে এক দু’টা সাদা দাগ! দু জনে দু জনকে কয়েক পলক দেখে পরস্পরে জড়িয়ে ধরি।
কেমন আছিস রে শোয়ে?
বরাবরের মতোই। তুই?
আমিও।
তা কেন?
কোনো কারণ নেই।
এ রকম বলছিস কেন? বড় বিজ্ঞানী হতে চলেছিস, স্বপ্নের দেশে স্বপ্নের মতো জীবন, স্বপ্নের রাজপুত্র!
অর্ধেক রাজত্ব ও রাজকন্যা ছাড়া।
বিয়ে করিস নি?
হয়ে ওঠে নি।
বলিস কি! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
তোর কি খবর?
বাস করি প্রেতরাজ্যে, নিজেই এক প্রেত, বিয়ে করেছি পেতœী।
দেখাবি না পেতœী?
তোকেও তো প্রেত হতে হবে তাহলে।
হলাম না হয়।
বাদ দে ওসব।
সত্যিই বউ দেখাবি না?
আমারও হয় নি রে।
অবাক কাণ্ড তো!
রিক্সায় চড়ি, কলাতলী সৈকতে প্রতিদিন একটা বৈকালিক বাজার বসে, স্থানীয় জেলেরা তাজা মাছ, শাক সবজি ও ফলমূল বিক্রি করে খোলা আকাশের নিচে। মাইকের শব্দে কান ঝালাপালা, গান বাজিয়ে যাচ্ছে কেউ, সেই সঙ্গে কারো মৃত্যু সংবাদ! এই সংস্কৃতি কারা গড়ে তুলছে, অথবা কীভাবে গড়ে উঠছে বুঝতে পারি না। স্বাস্থ্যকর স্থান বলে পরিচিত এখানে এই শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পরিবেশ-দূষণ, এসবের কোনো প্রতিকার নেই কেনো! এসব তো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, অথবা পূণ্যভূমি আরবের বাদশাহ, বা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এসে করে দেবে না, স্থানীয় জনগণকেই এসব ঠিক করতে হবে, নিজেদের যোগ্য নেতৃত্ব ঠিক করতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে হবে, জাগাতে হবে, লোকাল ও কমিউনিটি কন্সেপ্ট গড়ে তোলার জন্য কেউ নেই কক্সবাজারে! মনে মনে ভাবি, এখানটারই বা দোষ দেই কেন? এ কন্সেপ্টটা তো দেশের কোথাও গড়ে ওঠে নি। সভ্য দেশগুলো এগিয়ে যেতে পেরেছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে, লোকাল ডেভেলপমেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তুলে, আর আমরা আরো কেন্দ্রীভূত করছি ক্ষমতা! আরো আরো ক্ষমতা চাই, কেবল আমার হাতে, ঐশ্বরিক ক্ষমতা চাই। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে চেয়ে জেলা গভর্নর সিস্টেমটা যে চালু করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, তা যদি বাস্তবায়ন করা যেতো, দেশের অবস্থা হয়তো অন্য রকম হতো আজ। বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প তো কিছু নেই এখনো, আজ হোক, কাল হোক, এটা করতেই হবে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েও স্বৈরশাসকের মতো আচরণ করছে অনেকে, এসবের অবসান কি কখনো হবে!
আমাকে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে শোয়েও চুপচাপ হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করিÑ
ওখানে কি বাজার করবি?
হ্যাঁ, মাছ ভাজা খাওয়াবো তোকে।
ফরেস্ট অফিসের উল্টোদিকে বাঁশের বেড়া দেয়া টিনের ছাউনি ঐ হোটেলটা আছে না?
আছে আছে, হোটেল নিরিবিলি।
হ্যাঁ নিরিবিলি, নিরিবিলি।
ওখানের চিংড়ি শুঁটকি ভর্তা খেতে ইচ্ছে করছে, লইট্টা মাছের লাল ঝোল, ছুরি শুঁটকি ও সিমের বিচির ঝোল, মগজ ভুনা, আমার জিভে জল জমে গেছে রে, এতো মজা করে রাঁধে কীভাবে ওরা?
হঠাৎ দু একদিন অন্য রকম স্বাদ সব সময়ই ভালো লাগে, তাছাড়া পরিবেশ পরিস্থিতি, অনুকূল মানসিক অবস্থা, সব মিলিয়ে একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে, এর উপর, ওদের রান্না তো অবশ্যই ভালো।
সোয়েচিনের বাসায় এসে মনটা ভরে যায়, সরাসরি দোতলায় উঠে যাই, নিচের তলায় থাকে ওর এক বোন। বিধবা, দুটো বাচ্চা নিয়ে থাকে, উপর তলাটা ওরাই দেখেশুনে রাখে, ঘরের ভেতর ঢুকে মনেই হয় না বাইরে এতো ঘিনঘিনে, নোংরা কুৎসিত এক পৃথিবী রয়েছে। সব সময়ই রুচি বজায় রেখে জীবন যাপন করে সোয়ে, ধরে রেখেছে এখানেও, অনেক ব্যাচেলার বন্ধুর রুমে ঢুকলে দেখা যায় অগোছালো কাকে বলে। আমার স্বভাব বলে, অগোছালো হওয়ার কথা আমারও। নটরড্যাম কলেজ হোস্টেলে থাকার কারণে পরিপাটি থাকার অভ্যাসটা গড়ে উঠেছিল, রয়ে গেছে এখনো।
দোতলার রান্নাঘরটা নাকি কালেভদ্রে ব্যবহার করা হয়, আজ কিছু সময়ের জন্য হবে, বুয়াকে বলে মাছটা কুটে দিতে, এক ব্যাগ ঘিমা শাক এনেছে, ওটা নাকি খাওয়াবে আমাকে, আমি তো অবাক, হুইস্কির সঙ্গে ঘিমা শাক! ও বলে, দেখতে দোষ কি? সাইড ব্যাগ থেকে বুশমিলস আইরিস হুইস্কির বোতলটা বের করে ওর হাতে দেই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলে, দারুণ জিনিস তো, ঘিমা শাকের জন্যই তৈরি, হেসে উঠি আমি, প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের একটা রেকর্ড চাপিয়ে বলে ফ্রেশ হয়ে নে দাউদ, রাখ্যাইনদের লুঙ্গি আছে, একেবারে নতুন, মাড় না দেয়া, দেখ পরে কত আরাম। একটা লুঙ্গি ও ফতুয়া পরি, সত্যি আরাম, একটা গুমোর ফাঁস করে দেয় সে, রাখ্যাইন কাপড়ের চাহিদা আজকাল এতো বেড়েছে যে ওরা তাঁত চালিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না, নতুন আসা বাঙালিদের চাপে অনেক রাখ্যাইন বার্মায় পাড়ি দিয়েছে, এসব কাপড়ের অনেকটাই নাকি এখন আসে কুমিল্লার কুটির শিল্প হতে।
চুলো ধরিয়ে মাছ ভাজা শুরু করে সোয়ে, মাছ ভাজার গন্ধ বরাবরই প্রিয় আমার, খাওয়া শুরু করি, মাছটার কাঁটার রং সবুজ! জীবনেও সবুজ কাঁটার মাছ দেখি নি, মাছটা দেখতেও অন্য রকম, অনেকটা গজার মাছের মতো, আরো লম্বা ও চিকন, সাদা চকচকে আঁশ, খেতে ভালোই। বড় একটা পাতিলে ঘিমা শাক সেদ্ধ বসায়, ছোট্ট এক টুকরো নাপ্পি দেয় ওখানে, জিজ্ঞেস করি, এতো শাক কে খাবে? বলে, দেখাই যাক না। তাজা শাকের ভাঁপ থেকে ছড়ানো গন্ধও যেনো সবুজ। সোয়ে জিজ্ঞেস করেÑ
নাইখ্যংছড়ির বনযোগীদের ঘরে বানানো একটা মদ আছে, দেখবি নাকি একটু চেখে?
বোতল খুলতেই মৌলির তীব্র গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে, বলিÑ
মাপ চাই, আজকাল এসব পারবো না রে সোয়ে, বয়স হয়েছে না!
ঠিক আছে বলে বুশমিলের বোতল খুলে দু জনের জন্য দুটো গ্লাসে ঢালে।
চীয়ার্স! তোর ভবিষ্যৎ সঙ্গিনীর জন্য।
চীয়ার্স।
এলকোহোল জাতীয় সবকিছুকেই আমরা মদ বলি কেন রে সোয়ে?
কেতাব থেকে এসেছে বোধ হয়, নেশা জাতীয় পানীয়কে মদ্য বলা হয়েছে ওখানে।
অথচ মদ একটা ভালো পানীয়, যদিও এলকোহোল আছে ওখানে, স্বাস্থ্যের জন্য ভালো এটা।
এলকোহোল তো অনেক অষুধেও আছে, কাশির অষুধেও নাকি আছে, ওসব বোঝাবি কাকে?
নন-এলকোহোলিক মদও আছে অনেক।
ঘিমা শাক নিয়ে আসে দু বাটি, এক চামচ মুখে দেই, ভাবতেও পারি নি এতো স্বাদ, পানীয়ের সঙ্গে যখন আস্ত মাছ ও সব ঘিমা শাক শেষ হয়ে যায়, জিজ্ঞেস করে সোয়েÑ
কম্বিনেশানটা ঠিক ছিল?
বিশ্বাস করতে পারি না সোয়ে! আসল জহুরী তুই।
আমার কোনোটাই নকল নেই রে দাউদ। বছর চারেক আগে একটা দাঁত ফেলে দেয়ার পর নকল লাগাতে চেয়েছিল, দেই নি।
হো হো হো!
কথা প্রসঙ্গে সোয়ে প্রস্তাব দেয় ময়মনসিংহ গীতিকার পালাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করে ইউরোপে অপেরার মতো করে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। পঞ্চাশ ষাট বছর আগে এগুলোর ইংরেজি অনুবাদ হওয়ার পর ইউরোপের মনীষীরা লোকসাহিত্যের রতœভাণ্ডার বলে প্রশংসা করেছিল এগুলোর, অথচ এসব রতœ আমরা চেয়েও দেখি না, রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব চিন্তা করার যোগ্যতা পোষা ভৃত্যদের নেই, গবেষণার নামে দরিদ্র জনগণের কোটি কোটি টাকা লোপাটই করবে শুধু এরা।
কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগে, এখন ভাবতে কষ্ট হয়, একসময় এতো ভালো কবিতা লিখতাম, কতো জায়গায় ছাপা হয়েছে সেসব, এতো এতো প্রশংসা শুনেছি, অথচ এখন শুধু পাঠের মধ্যেই সীমিত সাহিত্য, নির্মাণের প্রশ্ন মাথায়ই আসে না। স্বাধীনতা যুদ্ধে কত জনে কত কিছু হারিয়েছে, কত আপনজন, প্রিয় বস্তু! আমার গেছে সব চেয়ে প্রিয় কবিতার খাতাগুলো, ওসব থাকলে হয়তো আবার প্রেরণা পাওয়া যেতো, সূত্র অনুসরণ করা যেতো।
সোয়ের প্রস্তাবটা মাথার ভেতর খেলা করে, পালাগুলোর ইংরেজি অনুবাদ হয়তো করতে পারবো, কিন্তু সুরগুলোর নোটেশান তো ইউরোপীয় কোনো সঙ্গীতজ্ঞকে দিয়ে করাতে হবে, তারপরে হয়তো ভালো একটা দল দিয়ে উপস্থাপন করতে হবে, নোটেশান তৈরি করাটা বোধ হয় মূল কাজ হবে, মিস কোরবিনের কথা মনে পড়ে, সে কি করবে এটা? বাংলার সুরটা শুনে শুনে যদি কম্পেজিশানটা করতে পারে তাহলে অনুবাদটাকে আবার সেভাবে বদলে নেয়া যাবে। চুপ করে থাকতে দেখে সোয়ে জিজ্ঞেস করেÑ
ঝামেলায় ফেললাম?
আরে না না, বরং অসাধারণ প্রস্তাব দিয়েছিস একটা, ওটা নিয়েই ভাবছি।
রাত দশটা পেরিয়েছে, প্রায় নীরব হয়ে গেছে শৈল-শহর কক্সবাজার। চমৎকার একটা চাঁদ আকাশে, ইচ্ছে করে সৈকতে যেয়ে একটু ঘুরে বেড়াই, এ সমুদ্রটা এতো আপন, সসাগরা পৃথিবীর সব ক’টা মহাসমুদ্রই দেখা হয়েছে, অসংখ্য সাগর উপসাগর দেখেছি, অথচ এটার স্বরই যেনো আলাদা। এটার তাপমাত্রা, শব্দ, ঘ্রাণ, সবই যেনো বাংলার। ইউরোপ আমেরিকার সমুদ্রের ধারে হালকা পোশাকে বেশি সময় কাটাতে পারি না, আরবদের সমুদ্র কখনোই আকর্ষণ করে নি আমাকে, অথচ এখানে মনে হয় সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। সোয়ে জিজ্ঞেস করে, এসব মিস করি কিনা! মনে মনে ভাবি, মিস করি না কোনটা? ঘর থেকে বাইরে বেরোলে মিস করি ঘর, বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এলে ওখানটা, এখন বিলেতের সবকিছু, বিলেতে থাকলে দেশের সবকিছু, এভাবে ভাবলে তো অসুস্থ হয়ে যেতে হবে। এভাবেই জীবন চলে, সবকিছুই হারাই আমরা, কোনোটা ক্ষণিকের জন্য, কোনোটা চিরতরে। যা ফিরে ফিরে পাই অনেকবার, অন্তরে গেঁথে যায় ওটার স্মৃতি, সেজন্য অনুভবটাও অনেক বেশি তার।
ঘণ্টাখানেক সাগরপাড়ে থেকে ক্ষুধা লেগে যায়, জিজ্ঞেস করিÑ
নিরিবিলি খোলা?
হ্যাঁ, অনেক দেরিতে বন্ধ করে ওরা। আর বন্ধ করে দিলেই বা কি, আমার জন্য সারা রাত খোলা রাখবে ওরা।
খুব জনপ্রিয় তুই!
জনপ্রিয়তা না, ভালোবাসা।
নিরিবিলিতে তখনো বেশ কাস্টমার। কোনার একটা টেবিল খালি হলে বসি ওখানে যেয়ে। আমার প্রিয় খাবারগুলো আনাতে বলে সোয়ে। বলিÑ
একবারে সব আনতে নিষেধ কর, এক দু’টা আইটেম করে যেনো আনে। দারুণ স্বাদের করলাভাজি করেছে একটা, ওটা দিয়েই পেট ভরে খেয়ে ওঠা যায়। খেতে বসে আমার সজনির কথা মনে পড়ে।
ওকে একটা টেলিফোন করা যায়? জিজ্ঞেস করি সোয়েকে। একটু একলা কথা বলতে চাই, কেউ কান পেতে রাখুক, এটা চাই না।
তাহলে তো বাসায় যেতে হবে।
তাই সই।
খাওয়া-দাওয়া সেরে গেলে হয় না?
আবার এসে খাবো, ক্ষতি কি?
পাগলামো পেয়ে বসেছে। বেয়ারাকে বুঝিয়ে বলে সোয়ে। খুশি মনে সম্মতি জানায়। রিক্সা নিয়ে চলে আসি সোয়ের বাসায়।
সজনি?
কোথায়?
খুব কাছে তোমার।
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, একেবারে কোলের কাছে।
খেয়েছো?
না।
খাবার নিয়ে আসবো?
না, আসতে হবে না। সত্যিই ঘুমাবো আমি।
তাহলে খাবার পাঠিয়ে দেই?
দিতে পারো।
ঠিক আছে, পঠিয়ে দিচ্ছি।
ইচ্ছে করলে পুরোনো বান্ধবীদের সঙ্গেও কাটাতে পারো আজ।
না সজনি, ঐ বয়সটা নেই। বলেছি তো তোমাকে এলিনার কথা, ঐ উত্তাল সময় আর কখনো আসবে না এ জীবনে।
দু এক রাতের জন্য এলে ক্ষতি কি?
না সজনি, সোয়ের সঙ্গে আড্ডায় মেতেছি।
ঠিক আছে, অসুবিধা নেই।
সজনির সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটা এতো ভালো যে পারস্পরিক শারীরিক প্রয়োজনের বাইরে তৃতীয়জন যে কারো জন্যই এসে যেতে পারে, দু জনের কেউই এতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করি না। হোটেলে ফিরে এসে আবার খেতে বসি, সজনির জন্য খাবার পাঠিয়ে ওর হোটেলে ফোন করে দেয় সোয়ে, যেনো রুমে পৌঁছে দেয়। খেয়ে-দেয়ে ফিরে আসি সোয়ের বাসায়, মাথার ভেতর ময়মনসিংহ গীতিকা, অনেকগুলো পালা-গান বাজিয়ে শোনায় সোয়ে। এতো বাজে রেকর্ডিং! যন্ত্র বাজানো একেবারে যা-তা, অথচ সুর ও বাণী হৃদয় স্পর্শ করে গভীরভাবে, এসব যদি আধুনিক যন্ত্রে উপস্থাপন করে অপেরা নির্মাণ করা যায়, আমার ধারণা, বিশ্বে আলোড়ন তুলবে, সখিনা বিবির পালা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি।