অন্য আলো
কামাল রাহমান
৮
বাড়িঘরের ছাদের চিমনিতে পায়রারা আসতে শুরু করেছে, গাছের কালো কঙ্কালে সবুজের ছোঁয়া, এতো দ্রুত আসে বসন্ত যে পরিবর্তনটা চোখে পড়ে খুব, দু হপ্তার মধ্যে সব কিছু সবুজ, তারপর বিচিত্র রঙে সেজে ওঠে প্রকৃতি। শীতবস্ত্র সেইলের ধুম লেগেছে দোকানগুলোয়, ক’দিন পর দোকানের খালি জায়গাটা ভরে উঠবে আউটিংএর টেন্ট, প্যারাসল, গ্যাজেবো, বাইক প্রভৃতিতে। খাবার-দাবারের ওদিকটায় যোগ হবে রেডি-গ্রীল ফুড, চারকোল, চুল্লি এসব।
গ্রীষ্ম আসার আগেই আসে একটা সুসংবাদ, যে চাকরিটা পাই নি, তার চেয়েও ভালো একটা চাকরি পেয়েছি অক্সফোর্ডে, আরো একটা শীত-ঋতু এবার্ডিনের বরফের নিচে কাটাতে হবে না ভেবে উষ্ণ হয়ে উঠি সঙ্গে সঙ্গে, বলার অপেক্ষা রাখে না, কেরোলের খুশির পরিমাণ কতটা। ছোট্ট একটা টেলিচিঠি পাঠিয়েছে হেইনে, ‘অক্সফোর্ড ইজ ঈগার্লি ওয়েইটিং ফ’ হা’ বেস্ট ফরেইন ফ্রেইন্ড!’
মনে মনে হাসি, পাগল কত প্রকার!
কোরবিনকে বলি বাসা ছেড়ে দেয়ার কথা –
আশা করি আমার চেয়ে ভালো শ্রবণশক্তি-সম্পন্ন ভাড়াটে পাবে তুমি।
বিষয়টা উল্টো বোঝে, একটু অবাক হয়ে বলে –
কখনো কি জোরে বাজিয়েছি মি. এব্রাম?
ফার্স্ট নেইমে কোনোদিনও ডাকে নি সে আমাকে, আমিও মিস কোরবিন নামেই সম্বোধন করেছি সব সময়।
না না, উল্টোটাই বলতে চেয়েছি বরং, কখনোই তোমার বাদন শুনি নি।
তাই বলো।
মনে মনে বলি, অনেক দিন কান পেতে রেখেছি কি বাজাও শোনার জন্য। কিছুটা যেনো ভেবে বলে –
তোমার আগ্রহ থাকলে একদিন বসতে পারি।
নিশ্চয় আছে মিস কোরবিন।
তোমার যদি আপত্তি না থাকে যাওয়ার আগের দিন ডিনার নিতে পারো এখানে, তখন একটা সোনাটা বাজিয়ে শোনাবো নাহয়।
কোনো আপত্তি নেই, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। ঠিক আছে মিস কোরবিন।
মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না আমি কি! এত ক’টা মাস কাটিয়েছি এবার্ডিনে, অথচ এর কিছুই দেখা হয় নি, সপ্তাহ কেটেছে চাকরি ও থিসিস নিয়ে, সপ্তাহান্ত কেরোলে। যাওয়ার আগে ঘুরে-ফিরে দেখে যাবো পুরো শহরটা। চাকরি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছি, যাওয়ার আগে পুরো দুটো দিন হাতে রেখে। অক্সফোর্ড ফেরার পর আরো এক হপ্তা পাওয়া যাবে কেরোলকে দেয়ার জন্য, সেও ছুটি বুক করেছে। আনন্দ! আহা একী আনন্দ! অনন্তকাল বেঁচে থাকো গুরু, আমাদের আবেগে উল্লাসে, সুখে দুঃখে, বীরত্বে নিবীর্যে, নিত্য-অনিত্যে!
স্কুলপাঠ্য কবিতায় পড়া বিখ্যাত ডী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে নতুন এবার্ডিন (বিটউইন ডী এন্ড ডন), শহরের পুরোনো অংশ ডন নদীর তীরে মানব-বসতি শুরু হয়েছিল কম করে হলেও আট হাজার বছর আগে। প্রাচীন এই জনপদের ইতিহাস এই নদী দুটো ঘিরে পত্র-পল্লবিত ও মুকুলিত হয়েছে। বিখ্যাত বীর-যোদ্ধা রবার্ট দ্য ব্র“সের এই শহরের রয়েছে অন্য আরো অনেক নাম। স্কটিশ ও ইংলিশদের মধ্যে অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে এ শহরের কর্তৃত্ব নিয়ে। এখানের গ্রানাইট পাথর খুব উঁচু মানের, এসব পাথরের সঙ্গে মাইকা-চূর্ণ মেশানো থাকায় পাথরগুলো মসৃণ করার পর রূপোর মতো চকচকে দেখায়। শহরের অনেক ভবন এসব গ্রানাইট পাথরে তৈরি হওয়ায় শহরটাকে সিলভার সিটি অথবা গ্রে সিটি নামে ডাকা হয়। সোনালি বালুর অপরূপ সমুদ্র সৈকতের তীরে গড়ে ওঠা এই শহরের মাটির নিচে রয়েছে তরল সোনার বিশাল মওজুদ, এজন্য এটাকে ইউরোপের অয়েল ক্যাপিটাল, অথবা কখনো এনার্জি ক্যাপিটাল নামেও ডাকা হয়। এখানের হেলিপোর্ট পৃথিবীর অনেক ব্যস্ততম হেলিপোর্টের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, এর সমুদ্র-বন্দর উত্তর-পূর্ব স্কটল্যান্ডের সব চেয়ে বড় ও বিখ্যাত বন্দর। পাঁচ শ বছরেরও বেশি পুরোনো এবার্ডিন বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যাশিক্ষায় জড়িতদের জন্য এক পূণ্যভূমি, এখানে ঘুরে ঘুরে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ি, দুপুরের খাবার খেয়ে নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্টিনে বসে। এর পর ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ঘুরে দেখি রবার্ট গর্ডন বিশ্ববিদ্যালয়, এই প্রথম এলাম এখানে, এর ভবনগুলো ও পরিবেশ চমৎকার। ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরি, ছোট্ট একটা ঘুম দেই।
হাফ ক্যাজুয়্যাল, প্রায় ফর্মাল একটা পোশাক পরে নিচে নেমে আসি কোরবিনকে দেয়া সময় ঠিক চারটায়, অক্সফোর্ডের প্রথম বাড়িওয়ালির বিষয়টা মনে রেখে মনে মনে ভয় ছিল দেরিতে গেলে যদি কিছু খেতে না দেয়, কাল চলে যাবো বলে ঘরের খাবার দাবার সব শেষ করে ফেলেছি। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে দেখি ডাইনিং টেবিলের কোনা ধরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কোরবিন।
হ্যালো, মিস কোরবিন, কেমন আছো?
ভালো, খুব ভালো, ধন্যবাদ তোমাকে, তুমি কেমন আছো?
আমিও ভালো, তোমাকেও ধন্যবাদ।
আসো, বসো এখানটায়।
ঠিক আছে, ধন্যবাদ।
ফুলের তোড়াটা ওর হাতে দেই, চকোলেট বা ওয়াইন কিছুই আনি নি, কি খায়, তাই তো জানি না, কখনো টেবিলে দেখি নি ওকে। ধন্যবাদ, বলে ভেতরে যায়, বড় একটা ফুলদানী সাজিয়ে টেবিলে রাখে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে ওগুলো। বলে, খুব সুন্দর ফুলগুলো।
তেত্রিশ আরপিএমের একটা যন্ত্রসংগীতের রেকর্ড এনেছিলাম, রবীন্দ্রসংগীতের, বিশেষ করে ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথে’ গানের সুরটার জন্য, ডিস্কটা ওর হাতে দিয়ে বলি, কিছুক্ষণের জন্য এটা বাজানো যায়?
নিশ্চয়, বলে রেকর্ড-প্লেয়ারে চাপিয়ে দেয়।
এতো মুগ্ধ হয়ে শুনবে এটা বুঝতে পারি নি, ওর সবটুকু মনোযোগ হয়তো এখন ঐ সুরের উৎস খোঁজায় নিয়োজিত।
এরকম সুর শুনেছি নিশ্চয়, কার বল তো?
আমার গুরুর।
তোমার গুরু? গানও শিখেছো, বাহ্, শোনাবে নাকি একটা?
আমার গুরু মানে, আমাদের বাঙালি জাতির কবিগুরু, তোমাদের যেমন শেক্সপীয়র, জার্মানদের গ্যেটে, রাশানদের পুশকিন, ইরানিদের ফেরদৌসি, এরকম।
বাহ্, কি যেনো নাম?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ট্যাগোর বলো তোমরা।
হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনেছি। তোমাদের একজন বড় কবি।
শুধু আমাদেরই নয়, বিশ্বেরই একজন বড় কবি।
হ্যাঁ, নিশ্চয়, তিনি একজন বিশ্বমানের কবি, তাঁর দু একটা অর্কেস্ট্রা শুনেছি মনে হয়।
সুরায় মাতাল হয় কেউ, আবার অনেকে সুরে, অথবা সংগীতে। কোরবিনের ঘোর লেগেছে সুরে, গত ক’মাসেও এতো কথা বলে নি, আজ বিকেলে সব শোধ করে দিচ্ছে। সেজেছে দারুণ, মনেই হয় না বয়স ওর চল্লিশ ছুঁয়েছে, কোনাকুনি সাজানো ব্ল্যুবেল ফুলের ছাপ দেয়া কাপড়ের গাউন, প্রিমরোজ রঙের হাফ-হাতা সার্টের বুকের কাছটায় ছোট ছোট পুুঁতির নক্সা, অনেকটা গহনার মতো, গোলাপি মুক্তো রঙের লিপস্টিক, সাদায় সোনালি মেশানো চুলগুলো কানের দু পাশ থেকে চিকন দুটো বেণি গেঁথে পেছনে বাঁধা, এতো সাধারণ, অথচ অপরূপ, মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকার মতো।
দ্রুত লয়ের ‘সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি’ গানের বাজনা শুরু হলে লাফিয়ে ওঠে –
আমার তো নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে, এটা কি কোনো নাচের সুর?
টেগোরের প্রায় সব গানের সঙ্গেই নাচা যায়। এটা একটা অসাধারণ গান।
বাহ্, আরো শুনবো টেগোরের মিউজিক, খুব ভালো লাগছে। এখানে কোথায় পাওয়া যায় জানো?
জানা উচিত ছিল। এই রেকর্ডটা দেশ থেকে নিয়ে এসেছি, রেখে দিতে পারো। স্পুলে অনেক রবীন্দ্রসংগীত আছে আমার।
না না, আমি সংগ্রহ করে নেবো, তোমাকে ধন্যবাদ।
এখানকার হেইচএমবিতে খোঁজ করতে পারো, স্টকে না থাকলেও সংগ্রহ করে দিতে পারবে আশা করি।
ভালো বলেছো, তাই করবো।
প্লেয়ারে ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ শুরু হলে বলে –
ঠিকই তো বলেছো, এটার সঙ্গেও নাচা যায়, সালসা ড্যান্সের অনেক সুর আছে এটার মতো! বাহ্!
ঘড়িতে পাঁচটা বাজতেই জিজ্ঞেস করে –
খাবার নেবো?
নিতে পারো।
ড্রিঙ্কস কি নেবো, তুমি নিশ্চয় এলকোহোলিক কিছু নেবে না।
নেবো, নেবো।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে –
তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ না এটা, তুমি নাও?
অনেকেই নেয়।
তা জানি। আমি ভেবেছি তুমি নাও না, কোনো ড্রিঙ্কস আনি নি, ক্রিসমাসে পাওয়া কয়েক বোতল ওয়াইন আছে, নেবে কোনোটা?
নিতে পারি।
তাহলে একটু কষ্ট করো, এখানে আসো, তোমার পছন্দ মতো বেছে নাও।
ওয়াইন- তাক দেখে রীতিমতো অবাক হই! জিজ্ঞেস করি –
এতো ওয়াইন!
আর বলো না, গিফট হিসাবে যত পাই, সবই রেখে দেই, পুরোনো হলে দামি হয় কিনা . . . কেমন ব্যতিক্রম, তাই না?
হ্যাঁ তাই … ব্যতিক্রম তো আছে সবকিছুতেই। তা এতো ওয়াইন জমাচ্ছো কার জন্য!
কারো জন্যই না। তোমার মতো কেউ যদি হঠাৎ এসে যায়, দু একটা কাজে লাগে।
ফাইভ ঔকসের একটা রেড ওয়াইন নেই, ক্যালিফোর্নিয়ান। বোতল ঝেড়ে-মুছে টেবিলে রাখি। সোনালি কাচের দুটো বড় ওয়াইন গ্লাস নামিয়ে আনে কোরবিন। বলে –
থ্রী কৌর্স ডিনার, তোমার কি পছন্দ জানি না, তাই খুব কমন ক’টা আইটেম, খুব সাদামাটা। কিছু মনে করো না।
বলো কি? টু কৌর্সই সামলাতে পারি না!
মাঝখানে একটা করে গ্যাপ রেখো, ইন বিটুইন টু কৌর্স – বলে হাসে মিটিমিটি।
ইঙ্গিতটা বুঝতে পারি নি প্রথমে, বোঝার পর হেসে উঠি। জিজ্ঞেস করি –
কি জন্য …
স্টার্টার নিয়ে আসে। মধু, আদা ও থাইম দিয়ে গ্রীল্ড ডাক-ব্রেস্ট, প্লেইটের পাশে রকেট মেশানো গ্রীন সালাদ। এক টুকরো মাংস মুখে দিয়ে দেখি চমৎকার স্বাদ।
বেশ ভালো রান্না করো তুমি মিস কোরবিন।
মনে হয় না।
গুরুঠাকুরের সুরের ইন্দ্রজাল ঘরটাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছে, একটা জীবন তো এই মধুর হাওয়ায় ভেসেই কাটিয়ে দেয়া যায়! ওয়াইনটা দারুণ, বোতলটা হাতে নিয়ে ইয়ার অব প্রোডাকশান দেখি, খুব বেশি পুরোনো না, আমার কিশোর কালের, তবে ক্যালিফোর্নিয়ার ঔক গাছগুলো যে আমাদের চন্দন থেকে মিষ্টি সুবাস নিয়েছে বোঝা যায়, ফ্লেবারটা চমৎকার, ওয়াইনের সঙ্গে এর গন্ধটাও নিতে হয়, তাহলে পুরো স্বাদ পাওয়া যায়, গ্লাসটা ঠোঁটে না নিয়ে কয়েকবার গন্ধ শোঁকায় কোরবিন বলে –
কি হে, গন্ধে মাতাল?
বলো না, মাতাল হওয়ার জন্য আমার নির্দিষ্ট কিছু দরকার পড়ে না। আমার একটা গল্প বলি শোনো, তখন হাই স্কুলে উঠেছি মাত্র, আমাদের দেশে মৌসুমি একটা ফল জন্মায়, এই এতো বড়, তোমার এই টেবিল পুরোটাই জুড়ে যাবে, সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফল ওটা, গাছ থেকে একটা কাঁঠাল নামিয়েছি, খাজা কাঁঠাল, খাওয়া শুরু করেছি তো আর শেষ করি না দেখে বাবা বলে, পেটে অসুখ করবে, শেষে কাঁঠালের একটা বিচি জোর করে খাইয়ে দেয়, পুরো ঐ মৌসুমটা মাতালের মতো কাঁঠাল খেয়েই কাটিয়েছি, এর পরের বছর থেকে কাঁঠালের গন্ধটাই তেমন ভালো লাগে নি আর, এখনো খাই মাঝে মাঝে, ভালো ফ্লেবার হলে, তবে খুব কম।
আমার মনে হয় ফাইভ ঔকসের বোতল আর ঘরে নেই, তোমাকে যোগান দেয়া যাবে না।
জোরে হাসতে যেয়ে সামলে নেই, সে তো মিস কোরবিন!
রেকর্ডের দুটো পিঠ বাজানো শেষ হলে জিজ্ঞেস করি –
ভারতীয় সংগীত কেমন লাগে তোমার?
খুব বেশি শুনি নি।
বেশ ক’জন উচ্চাঙ্গের শিল্পী আছেন আমাদের, শুনবে?
শোনা যায়।
দৌড়ে উপরে উঠে যাই, ওস্তাদ আয়েত আলী ও পণ্ডিত রবিশঙ্করের দুটো রেকর্ড নিয়ে নেমে আসি। রবিশঙ্করের সেতার শুরু হলে একেবারে স্তব্ধ হয়ে থাকে কোরবিন, সুরের ইন্দ্রজালে জড়িয়ে হারিয়ে যায়, বাজানো শেষ হওয়ার পরও কথা বলতে পারে না অনেকক্ষণ, সত্যিই এক সংগীত-রসিক, ওকে এটা শোনাতে পেরে খুব আনন্দ পাই। মেইন কৌর্স ডিনারের পর বলি –
এবার শোনো ওস্তাদের বাজনা।
পুরো রেকর্ডটা বাজানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত মনে হয় না একবারও চোখ খুলেছে সে। এসব সুর মানুষকে প্রকৃত অর্থেই অন্য জগতে নিয়ে যায়। প্রকৃতিস্থ হয়ে বলে –
কেন এসব শুনি নি আগে! এসব কি ওদেরই কম্পোজিশান?
নিশ্চয়।
এঁদের অবস্থান তো মোজার্ট, বাখ, বিটোফেনের পাশে হওয়া উচিত।
হয়তো, এঁরা ইউরোপীয় হলে ব্যাপক পরিচিতি পেতেন নিঃসন্দেহে, তবে গুণীজনেরা জানেন এঁদের।
শিল্প তো শুধু গুণীজনদের জন্যই না, সবারই অধিকার রয়েছে এতে।
দরিদ্রের শিল্প হচ্ছে, কুটির শিল্প, মিস কোরবিন!
হো হো!
অনগ্রসর সমাজে জন্মানো শিল্পীদের এটা একটা বড় সমস্যা কোরবিন। যাহোক, এবার তোমার বাজানো শুনবো?
বলো কি মি. এব্রা’ম, এসব শোনার পর বাজানোর সাহস নেই আমার।
না কোরবিন, তোমারটা তোমারই।
ঠিক আছে, ডেজার্টের পর বাজাবো, সব শেষে। যেনো দৌড়ে পালাতে পারো তুমি।
হো হো হো।
আর সামলাতে পারলাম না হাসিটা। কোরবিনকেও এই প্রথম দেখলাম গলা ছেড়ে হাসতে, বড়ো ভালো লাগে, ভেতরের টুকরো পাথরগুলো ছুটে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
ডেজার্ট ওয়াইনে ডোবানো রঙবেরঙের ফলের টুকরোগুলো অসাধারণ, চোখ-জুড়ানো, মুখে তুলতে ইচ্ছে হয় না। তাকিয়ে আছি দেখে বলে –
নেবে না? আইসক্রিম দেই তাহলে…
আরে না না, এটার সৌন্দর্যে মুগ্ধ আমি, খাবো কি!
তাহলে তো সত্যিই পিয়ানোয় বসতে হচ্ছে আমাকে।
হা হা, বসো বসো, বলে একটা স্ট্রবেরির টুকরো মুখে দেই।
বাজানো শুরু করে এডোয়ার্ড গ্রেইগের ইংলিশ স্ট্রিং অর্কেষ্ট্রার একটা সুর। শেষ হলে বলি, হাত তালি দিয়ে সুরের আবেশটা নষ্ট করতে চাই না, অসাধারণ বাজিয়েছো। একটু হাসে। কিছুটা দ্রুতলয়ের একটা সোনাটা বাজায়, ব্যাখ্যা করার পরও সুরটা ধরতে পারি না। এরপর বি ফ্ল্যাট ম্যাজর স্কেইলে হ্যান্ডেলের ভায়োলিন কনসার্টোর সুর বাজিয়ে শেষ করে দেয় কোরবিন। বলি –
আর হয়তো কোনোদিন এখানে শোনা হবে না তোমাকে। বাজাও না আর কিছু।
আর কিছু বাজাতে বলো না আমাকে, প্লীজ।
কবিগুরুর ‘আমায় বলো না গাহিতে বলো না’ গানটা মনে পড়ে। চাপাচাপি করতে সাহস হয় না, গভীর গোপন দুঃখ সবারই থাকে। ডেজার্টের পেয়ালা শেষ করি। যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে বলি –
আমি বাজাতে জানি না কোরবিন, না হলে কিছু একটা বাজিয়ে শোনাতাম নিশ্চয়। দু কলি গান শোনাতে পারি, শুনবে?
সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ প্রকাশ করে –
নিশ্চয়, নিশ্চয়।
যদিও ওর উদ্দেশ্যে নয়, এবং বুঝবেও না সে এ গানের সুগভীর বাণী, শোনাই ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা’ গানটি। শেষ হওয়ার পর বলে –
অসাধারণ তোমার গলা মি. এব্রাম, খুব ভালো লাগলো।
গলা অসাধারণ নয়, গানটার সুর অসাধারণ।
কি জানি কি মনে করে নিজেই উঠে যেয়ে বসে পিয়ানোয়। এটা বাজানো শেষ হলে চলে যেও।
ঠিক আছে।
মুগ্ধ হয়ে যাই, তন্ময় হয়ে থাকি, শিশু হয়ে যাই, বুঝতে পারি না কার রচনা এটা, মনে হয় অনেক দূরে, সুদূর আকাশের কোনো নক্ষত্র কাঁদছে ডুকরে ডুকরে। এতো দুঃখ, এতো দুঃখ! সুরের ভেতর কীকরে জমানো যায় চোখের এতো জল, বুকের এতো যন্ত্রণা, ভেবে পাই না। বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারি না, পাশ থেকে দেখি কেরোলের চোখ দুটো জলে-ভরা। সকল সৌষ্ঠব ভুলে ওর কাছে যাই, মানবিক আবেদনের কাছে কোনো বাধাই বাধা নয়। বলে –
তোমাকে চলে যেতে বলেছিলাম।
দুঃখিত, ক্ষমা চাইছি এ জন্য কোরবিন।
ঠিক আছে।
আবারো ক্ষমা চাইছি, তোমার হাত দুটো ধরতে অনুমতি দেবে, একবার?
পালকহীন এক পাখি-ছানার মতো আমার করতলের ভেতর কাঁপে ওদুটো, আমি সত্যিই দুঃখিত কোরবিন। তোমাকে দুঃখ দেয়ার কোনো ইচ্ছে সত্যিই ছিল না আমার, বুঝতে পারি নি, সত্যিই বুঝতে পারি নি, তোমাকে শেষবার বাজাতে অনুরোধ করা উচিত হয় নি আমার।
একটু সংযত হয় কোরবিন।
মাপ করো ডেয়ুড, আবেগ সামলাতে পারি নি, ওকে ছাড়া এ সুরটা অন্য কারো জন্য আর বাজাই নি, ভুলেই গেছিলাম যে অন্য সময়ে বাস করছি এখন!
এই প্রথম আমার প্রথম নাম ধরে ডাকে কোরবিন, একটু অবাক হই। না বুঝে ভুল জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছি, এখন ওর কষ্টটা ঘুচাই কীভাবে বুঝতে পারি না। বলি –
এখন ঘুমোতে যাও কোরবিন, অনেক রাত হয়েছে, ভোরে আবার এয়ারপোর্টে যেতে হবে আমাকে, আমার গার্লফ্রেইন্ড আসবে, রিসিভ করতে হবে ওকে।
আকস্মিক একটা কালো ছায়া বাদুড়পাখার মতো বয়ে যায় যেনো ওর সুন্দর মুখের উপর দিয়ে, মনের ভেতরটা বোঝা যায় না। স্বাভাবিক হয়ে বলে –
তাহলে কালই চলে যাচ্ছো কেন? পুরো হপ্তার ভাড়াই তো দিয়েছো, আরো দুটো রাত কাটিয়ে যাও এখানে।
দেখা যাক। কেরোলের সঙ্গে কথা বলে দেখি, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে লিজ, ওর প্রথম নামটাই ব্যবহার করি।
ঠিক আছে ডেয়ুড, শুভরাত্রি।
শুভরাত্রি …।
ঘরে এসে ঘুমোতে চেষ্টা করি, কোনোভাবেই ঘুম আসে না। ‘আমায় বলো না গাহিতে বলো না’ গানটা শুনি আবার, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, গান শোনানোর জন্য অথবা কোনো সুর বাজানোর জন্য কখনোই চাপ দেবো না আর কাউকে।
সকালে কেরোলকে নিয়ে ঘরে ফিরে দেখি নিচে বসে আছে কোরবিন।
সুপ্রভাত।
সুপ্রভাত মিস কোরবিন। ও কেরোল।
হ্যাঁ বলেছো, ও আসবে আজ, আসো কেরোল, বসো এখানে।
ঠিক আছে, ধন্যবাদ মিস কোরবিন।
কোরবিনকে দেখে রীতিমতো অবাক হই! দু চার না, মনে হয় দশ বছর বয়স বেড়ে গেছে এক রাতে। একটুও প্রসাধন নেই মুখে, বলিরেখা স্পষ্ট, হালকা নীল রঙের একটা সাদামাটা পোশাক, এতোদিন বুঝতেই পারি নি বয়স ওর চল্লিশ প্রায় পেরিয়েছে, মোটা ফ্রেমের একটা চশমা পরেছে চোখে, আরো বয়স্ক দেখায় এতে। বিস্মিত হয়ে মনে মনে ভাবি, মেয়েরা বোধ হয় ভালোভাবেই জানে কার কাছে কীভাবে উপস্থাপন করতে হবে নিজেকে। কেরোলের মনে যেনো সামান্য ভাবনারও উদয় না হয় সেজন্যই হয়তো বুড়িয়ে যাওয়া এই রূপ! যাকগে, কিছু করার নেই, কাল রাতে দেয়া কষ্টের বিপরীতে সুযোগ পেলে একদিন এসে নাহয় কিছুটা আনন্দ দিয়ে যাবো।
আমার লাগেজ অতিরিক্ত হয়ে যাবে বলে একেবারে খালি হাতে এসেছে কেরোল, ফেরার টিকিটও করে এসেছে, থাকা আর হচ্ছে না, রাতেই ফিরবো, স্যূটকেইসগুলো গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ি কেরোলকে নিয়ে, নতুনরূপে দেখি এবার্ডিন। কোথায় ছিল এ নগরের লুকিয়ে রাখা এই সৌন্দর্য এতদিন! কালরাতের হঠাৎ ঝড়ে পাওয়া ছোট্ট একটা ছন্দপতনের পর নতুনভাবে ফিরে আসে পুরোনো আনন্দনৃত্যের দোলা, মুক্ত বিহঙ্গের মতো ভেসে যাই অবাধ আলোর ‘মেঘবিহীন আমাদের উজ্জ্বল আকাশে’।
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসি, বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি শেষ করে কেরোলকে বলি –
একটা মিনিট বসো প্লীজ, মিস কোরবিনের কাছ থেকে ফর্মালি বিদায় নিয়ে আসি।
নিশ্চয়।
নিচে এসে দেখি বসে আছে কোরবিন। বলি –
একটু পরেই বেরিয়ে যাবো আমরা, তোমার সৌহার্দের জন্য অনেক ধন্যবাদ, লিজেট। অনেক সুখে ছিলাম তোমার এখানে।
ধন্যবাদ মি. এব্রাম, নিশ্চয় বলতে পারি আপনিও কোনো অসুখের কারণ ঘটান নি আমার, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, আপনার শুভ কামনা করবো সব সময়।
সেই পুরোনো মিস কোরবিন!
ঠিক আছে মিস কোরবিন, একটা ছোট্ট অনুরোধ জানাতে এসেছি, অনুমতি দিন তো …
নিশ্চয়।
যদি কখনো আপনার বাজনা শোনাতে ইচ্ছে হয় কাউকে, নিশ্চিন্তে স্মরণ করতে পারেন, এখানে ঠিকানা লেখা আছে আমার।
ভাঁজ করা কাগজের টুকরোটা হাতে নিয়ে বলে –
অনেক ধন্যবাদ মি. এব্রাম, আপনি অনেক উদার ও চিত্তবান।
ভালো থাকবেন মিস কোরবিন।
উপরে উঠে কেরোল সহ ধরাধরি করে বইপত্র, ব্যাগ, স্যূটকেইস নামিয়ে আনি, টেক্সিও এসে দাঁড়িয়েছে।
শুভরাত্রি মিস কোরবিন।
শুভরাত্রি, বাই।
বাই।
বাসে উঠে ঘুমিয়ে পড়ি দু জনেই, গভীর ঘুম, মনে হয় একটু পরেই পৌঁছে গেছি অক্সফোর্ড। অনেকটা বাড়ি ফেরার আনন্দ যেনো, চেনা পথ ঘাট, দোকানপাট, ছোট বড় সব ভবন, গাছপালা সবকিছুই অতি-চেনা। হেইনে যে এমন নাটক করবে ভাবতেই পারি নি, এই সাত সকালে ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে বাস স্টেশানে এসেছে অভ্যর্থনা জানাতে! ধন্যবাদ কি আর দেবো ওকে, বলিÑ
এসব কি হেইনে?
অক্সফোর্ডের ছেলে ফিরে এসেছে, স্বাগত জানাতে হবে না?
কি আর বলি, ধন্যবাদ জানিয়ে ফুলের তোড়াটা নিয়ে কেরোলের হাতে দেই। টেক্সির জন্য ফোন করতে হয় না, রেডি রেখেছে হেইনে। ঘরে ফিরে আরো এক চমক, হয়তো চমকের বদলে চমক! ঘরের দরোজা জানালার পর্দা, বিছানার চাদর বালিশ সব নতুন, বাথরুম, কিচেনে নতুন নতুন গেজেট, ঢাউস একটা গানের যন্ত্র কিনেছে, সব মিলিয়ে দেখি জীবনের বিচিত্র সব আয়োজন! ভালোই, এভাবেই যেনো ঢেউয়ের দোলায় এগিয়ে যায় জীবন-তরী।
ছুটির প্রথম দু’টা দিন পুরো অবসরে কাটাই, গান শুনে, পান-ভোজন করে, এবং কেরোলের মধু-সঙ্গ যাপন করে। তৃতীয় রাতে একটা আড্ডার আয়োজন করে হেইনে, দীর্ঘ আড্ডার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে সে, এদের আড্ডা আবার বাসায় জমে না, পাবে বা রেস্টুরেন্টে, আমার ভালো লাগে ঘরের ভেতর, ঢিলেঢালা পোশাকে, সহজ চলাফেরার ভেতর, ইচ্ছে মতো খাওয়া দাওয়া, ওঠা বসার ভেতর আড্ডা চালিয়ে যাওয়া, মেনে নেয় হেইনে, বাইরে থেকে খাবার ও ড্রিঙ্কস নিয়ে আসবে সে, রাজি হয়ে যাই।
ঘরে এসেই বলে –
গান শুনবো আজ। তোমাদের জন্য একটা ডিস্ক কিনেছি।
রেকর্ডটা কেরোলের হাতে দিয়ে বাজাতে বলে। আলেকজান্ডার জেমলিন্সকির কম্পোজ করা লিরিক সিম্ফনি, রবীন্দ্রনাথের কবিতার সুর করা অসাধারণ অর্কেষ্ট্রা, এত জীবন্ত কম্পোজিশান, নতুন যন্ত্রটাও এত পাওয়ারফুল, মনে হয় ঘরের ভেতরই যেন গোটা একটা দল ঢুকে পড়েছে। মুগ্ধ হয়ে শোনে কেরোল, বলে –
আমি জানতামই না এটা সম্পর্কে ডাউ, বলো নি কেন আগে?
টেগোরের নিজের গাওয়া গান শুনিয়েছি তোমাকে, এর চেয়ে বেশি কি আর পারতাম?
মিটি মিটি হাসে হেইনে।
বুঝেছো কেরোল, তোমাকে এটা দেয়ায় ঈর্ষা হচ্ছে ডেয়ুডের।
মোটেও না কেরোল। আর, আমি না দিলেও আমারি এক বন্ধুই তো দিয়েছে এটা।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, বন্ধুর সাফাই গাইতে হবে না, বাজনাটা শোনো মন দিয়ে।
রেকর্ডের এক পিঠ শেষ হলে ঘুরিয়ে অন্য পিঠ চাপিয়ে দেয় কেরোল। এই ফাঁকে হেইনের আনা খাবার-দাবার সামনে এনে রাখে, সব চেয়ে বড়, দেড় লিটারের এক বোতল জার্মান ভোদকা এনেছে, বেশ কয়েক রকম জ্যুস ও আইস-কিউব সাজিয়ে রাখে, মনে হচ্ছে রাতটা জমবে বেশ। এক ঢোক প্লেইন ভোদকা গলায় ঢেলে বলে হেইনে –
সেদিন নীৎসে নিয়ে কথা বলা শুরু করেছিলাম, শেষ করতে পারি নি, অন্য দিকে ঘুরে যায় সব।
আবার নীৎসে! মেজাজটা একটু বিগড়ে যায়, বলি –
তোমার সমস্যাটা কি হেইনে? নীৎসে বিষয়ে আলোচনা করার কি আছে? ওর বইগুলো পড়ে নাও, ওর সম্পর্কে যদি এতোই আগ্রহ থাকে তোমার।
ওর সব বইই পড়েছি।
তাহলে ওর বিষয়ে যেসব আলোচনা আছে সেগুলো পড়ো, নীৎসে যা লিখেছে তার চেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশি লেখালেখি আছে ওর বিষয়ে।
একটু যেনো দমে যায় হেইনে। কেরোল বলে –
সেদিন বাসে যেতে যেতে দ্য হোলি ব্লাড এন্ড দ্য হোলি গ্রেইল সম্পর্কে পড়ছিলাম, বেশ ইন্টারেস্টিং, তোমাদের আগ্রহ থাকলে এটা নিয়ে কথা বলতে পারো, হয়তো যোগ দিতে পারবো আমিও।
আমার নেই, বলি আমি।
আমার আছে, প্লেইটে একটা চিকেনের টুকরো রাখতে যেয়ে বলে হেইনে।
হ্যাঁ, তা তো থাকবেই তোমার, যেহেতু আমার নেই।
ঝগড়া না করে থাকতে পারো না তোমরা?
ঝগড়া আমি করি না, বলে হেইনে।
আসলে হোলি গ্রেইল বিষয়টাতে প্রায় কিছুই জানি না আমি।
তাহলে তোমার ভালোই লাগবে ডাউ।
ঠিক আছে, বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলো দেখি কেরোল।
এটা অনেকটা কিংবদন্তীর মতো। কিং ডেইভিডের উত্তরসূরি, যেসাসের পরিবার, তাঁর ক্রুসিফিকেশান হওয়া-না-হওয়া, কিং আর্থারের পরিবারচক্র, এসবের এক জটিল ও আশ্চর্য মিশেল, বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছে বিভিন্নজনে, এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে অথবা কথা বলে কিছু একটা ধারণা করা যায় হয়তো, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। তবে বিষয়টা ইন্টারেস্টিং, নবীদের ধারণা গড়ে ওঠার সময়টাকে কিছুটা ধরা যায়।
গ্রেইল জিনিসটা কি?
কারো কারো বর্ণনায় এটা একটা পাত্র, যেখানে ক্রুসিফাইড যীশুর রক্ত ধারণ করা হয়েছিল, কারো ব্যাখ্যায় এটা লাস্ট সাপারের পাত্র, হতে পারে কোনো ডিস, প্লেইট বা বাটি। ধরে নেয়া হয় অলৌকিক ক্ষমতা আছে এটার, বারো শতকে হোলি গ্রেইল বিষয়টার উৎপত্তি ধরা হয়, হোলি চেলিসের সঙ্গেও এই কিংবদন্তী যুক্ত হয়েছে।
হোলি চেলিস?
হ্যাঁ, মহামান্য পোপ এটার রক্ষাকর্তা এখন, খুব দামী পাথরে তৈরি। যাহোক, রোমান সম্রাট যখন খ্রীস্ট ধর্ম গ্রহণ করে অনুসারীদের নিয়ে, প্রজাদেরও তা করতে হয়। রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম! হো হো হো। রোমান সম্রাট খুব ভালোভাবে বুঝতে পারেন যে সাম্রাজ্যের সাধারণ ঐক্যের জন্য ধর্মটাকে খুব ভালো হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করা যায়। ওদের সামনে ছিল তখন মুসলমানদের ধর্মীয় ঐক্যের বলিষ্ঠ উদাহরণ, ইসলামের পতাকাতলে প্রায় পুরো বিশ্ব পদানত করতে যাচ্ছে ওরা! রোমানদের নতুন করে পাওয়া এই খ্রীস্ট-ধর্ম ছড়িয়ে দেয়ার কাজে হাজার হাজার নাইট টেম্পলার্স জড়িত ছিল, এদের সঙ্গে সম্রাটের একটা ভারসাম্য অবস্থা বজায় ছিল।
হ্যাঁ, মাঝখানে ওটা আবার নষ্টও হয়ে যায়, কর্তৃত্বের প্রশ্নে।
ঠিকই বলেছো হেইনে, ধর্মীয় গোপনতা জনগণের কাছে ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেয় নাইট টেম্পলার্সরা। বারো শতকে নাইট টেম্পলার্সদের নিশ্চিহ্ন করা শুরু হলে ওদের অনেকে পালিয়ে এবার্ডিনে এসে সেইন্ট মেরিস চ্যাপেল প্রতিষ্ঠা করে, ওখানে স্থাপন করে হোলি গ্রেইল। এটা জানতে পেরে স্কটল্যান্ডের পথে বিশাল এক বহর পাঠনো হয়। খবর পেয়ে নাইট টেম্পলার্সরা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে কানাডার নোভা স্কোশিয়ায় গোপন করে ওটা। তুষার-জমা এমন এক জায়গায় লুকিয়ে রাখে ওটা যে ওখানটা যদি কেউ খনন করতে যায় তাহলে যারা খনন করবে ওরা আটলান্টিকে ভেসে যাবে, ওভাবেই ওটা নির্মাণ করা হয়েছে।
আর ঐ হোলি চেলিস?
মুসলমানদের আগ্রাসী আক্রমণ থেকে হোলি চেলিস নিয়ে খ্রীস্টান যাজকেরা পালিয়ে বেরিয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দেশে। কোনো এক গির্জায় আছে এখন এটা, পোপ বেনিডিক্ট জানেন। এ সম্পর্কে আমাকে এখনো কিছু জানান নি তিনি। যাহোক, রহস্যটার নিষ্পত্তি হয় নি ডাউ, আমিও ঠিক বলতে পারছি না, আর এ পর্যন্ত যা বলেছি তাও ঠিক কিনা আমিও জানি না। হো হো হো। এর সবই গুজব, বিশ্বাস করা যায় না, আবার ঠিক হতেও পারে কোনো কোনোটা। অনেক বই লেখা হয়েছে এ নিয়ে, চলচ্চিত্র হচ্ছে, রহস্য অনুসন্ধানীরা হোলি গ্রেইল খুঁজে বেরাচ্ছে!
তুমি লুকিয়ে রাখো নি তো ডাউ?
তোমার মতো ইহুদি গোয়েন্দা রয়েছে যেখানে, আমার সাধ্য কি?
ঝগড়া করে না, বাচ্চারা।
হো হো হো।
অনেক ধন্যবাদ কেরোল কিছুটা ধারণা পেলাম।
যদি ইন্টারেস্টেড হও ড্যান ব্রাউনের দ্য দা ভিঞ্চি কৌড বইটা পড়তে পারো।
কি আছে ওখানে?
হোলি গ্রেইলটা কোনো পাত্র নয়, বরং মেরি ম্যাগডালেনের (যেশাসের স্ত্রী?) গর্ভ! বেশ কিছু ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে যীশু ছিলেন অনেক উচ্চ-ধারণাসম্পন্ন একজন সাধারণ মানুষ। যীশুর শিক্ষা, তাঁর জীবন ও প্রজন্ম সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। স্কটল্যান্ডের রোসলিন চ্যাপেলের নিচে হোলি গ্রেইল সমাধিস্ত রয়েছে। সম্প্রতি আবার বলা হচ্ছে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামের কাছে নির্মিত ইনভার্টেড পিরামিডের নিচে কোথাও লুকানো আছে হোলি গ্রেইল।
পড়তে হবে তো বইটা।
হোলি গ্রেইল নিয়ে অনেক রকম কথা প্রচলিত আছে।
ঠিক আছে, থাক এখন।
বজ্জাত হেইনেটা জিজ্ঞেস করে –
আচ্ছা কেরোল, ডেয়ুডের সঙ্গে তোমার ইয়েটা গড়ে উঠলো কীভাবে?
এ রকম একটা প্রশ্ন কোনো ভদ্রলোকে করে?
কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করি।
আমি হয়তো ভদ্রলোক না।
তোমরা দু জনেই অতি-ভদ্রলোক, থামো এবার… এটার জবাব দিতে কোনো অসুবিধাই নেই আমার। শুরুটা ছিল নিতান্তই কৌতূহল।
একটু অবাক হই, জিজ্ঞেস করি –
কৌতূহল?
তাহলে আমার শৈশবের একটা কথা বলি?
বলো, বলো। উৎসাহ দেয় হেইনে, খুব খুশিতে আজ সে। তৃতীয় পেগ নেয়ার আগে সাধারণত ভাবে কিছুক্ষণ, আজ দ্বিতীয়টা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঢেলে নিয়েছে।
জিজ্ঞেস করি –
ঠিক আছো হেইনে?
ভেবো না, তুমি ঠিক আছো তো?
আমি না থাকলেও তুমি আছো না, ঠিক রাখার জন্য।
কেরোলই যথেষ্ট।
ও কি বলতে যাচ্ছে শুনবে, না প্যাচাল চালাবে?
আমি প্যাচাল চালাই?
টেবিলের উপর টোকা দেয় কেরোল –
অর্ডার, অর্ডার।
হেসে উঠি দু জনেই।
শোনো, সেবার হাইস্কুলে উঠেছি মাত্র, আমাদের প্রতিবেশী হিসেবে আসে এক মুসলিম পরিবার। বাবা-মায়ের কাছ থেকে তেমন কিছুই জানতে পারি না, ওদের ফিসফাস শুনি শুধু। বিকেলে যখন খেলতে বেরোই, অপেক্ষা করে থাকি লুকিয়ে ওদের দেখার জন্য, সামনে যেতে সাহস পাই না। শুনেছি ওরা নাকি ছুরি দিয়ে প্রাণী কেটে হত্যা করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে দান করে নিজেরাই খেয়ে ফেলে ওগুলো। আমরা বলাবলি করি আমাদের জঙ্গলের খরগোশগুলো ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলিদান করে খেয়ে ফেলবে না তো ওরা, কিংবা আমাদের পোষা প্রাণীগুলো। আমাদের দোকানগুলোয় কেনাকাটা করতে যায় ওরাও, কখনও মাংস কিনে না, এতে আমাদের সন্দেহটা আরো বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে আমাদের দেখে হাসে, কালো কালো চোখ দিয়ে সরাসরি তাকায়, আমরাও বোকার মতো হেসে ফেলি কখনো কখনো, আর পালিয়ে যাই। আমাদের এক বন্ধু দেখেছে ওদের ছেলেরা ঘরের ভেতর মেয়েদের মতো গাউন পড়ে থাকে। কেমন এক অদ্ভুত, গা-গুলানো গন্ধ নাকি ওদের ঘরের ভেতর! কুকুর বা বেড়াল পোষে না ওরা।
হাসতে থাকে হেইনে।
এসব ধারণা কি এখনো আছে তোমার?
আরে না।
আমার দিকে তাকিয়ে বলেÑ
ডাউকে আমার অন্য রকম মনেই হয় নি।
কোন অর্থে?
এটাও থাক।
তাহলে গান হোক।
কে গাইবে?
টেগোর।
টেগোরের নিজের গাওয়া ‘তবু মনে রেখো…’ গানের রেকর্ডটা বাজাই।
এতো নিস্তব্ধ হয়ে যায় সবকিছু, কারো কথা বলতে ইচ্ছে হয় না, সুরের এই যাদুর রেশ ধরে রেখে প্রায় ঘুমিয়ে পড়ি আচ্ছন্নতার ভেতর। শেষ রাতের দিকে আড্ডা ভাঙলে ঘরে ফিরে যায় হেইনে। ক্লান্ত হয়ে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙ্গে। সকালটা মঙ্গলময় হয়ে ওঠে! গ্রাম সম্পর্কে এক চাচা এসেছেন বিলেতে সেনাবাহিনীর একটা ট্রেইনিং কৌর্সে, যাওয়ার আগে বেড়াতে আসেন আমার এখানে, কেরোল ও আমি মিলে বেশ যত্ন-আত্তি করি।
এর মাসখানেক পর চাচার চিঠি পেয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যাই, বাবার অসুখ, সঙ্গে সঙ্গে টিকিট কাটি, বাড়িতে পৌঁছে দেখি বাবার শরীর ভালো, মন খারাপ। বুঝতে পারি, ঐ চাচা কিছু লাগিয়েছে নিশ্চয়। বাবার পরিষ্কার কথা: দেশে ফিরে আসতে না চাও, এসো না, কিন্তু বিয়ে করে বউ নিয়ে যাও, আর বিলেতেই যদি বিয়ে করতে চাও, তাহলে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসো এখানে, সামাজিক একটা অনুষ্ঠান করে বিষয়টা মিটিয়ে ফেলি। ঐ চাচামিয়া বোধ হয় কেরোলের সঙ্গে বসবাসের কথা রং চড়িয়ে বলে বেড়াচ্ছে, বাবার আত্মসম্মানে আঘাত করেছে তা। খুবই স্বাভাবিক।
বাবাকে আস্বস্ত করে তাড়াতাড়ি ফিরে আসি, কেরোলকে বিয়ের কথা জানাই, কোনো আপত্তি নেই, ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। ভালোভাবে বুঝিয়ে বলি ওকে, ধর্ম বিষয়ে আমার অবস্থান সে তো জানেই, কিন্তু আনুষ্ঠানিকতা যেহেতু ধর্মগুরুদের দিয়েই করাতে হবে, নামমাত্র হলেও ওকে মুসলমানদের ধর্মটাকে গ্রহণ করতে হবে, বিয়েটা সেভাবেই হবে, ওতেও কোনো আপত্তি নেই ওদের কারো। গ্রীষ্মের ছুটিতে একটা তারিখ ঠিক করি। সবকিছু সুন্দরভাবে এগিয়ে যায়।
আকাশে উড়তে থাকা একটা পাখি যেমন অকস্মাৎ গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আমার অবস্থা হয়েছে ঠিক তাই। খুব চেষ্টা করেও বিষণœতা ঢেকে রাখতে পারে না কেরোল, বলেÑ
তোমাকে একটা কথা ক’দিন থেকেই বলবো ভাবছিলাম ডাউ, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, কিছু পরীক্ষা-টরীক্ষা করলো ডাক্তারেরা, আজ রিপোর্ট দিয়েছে, ক্যামো দিতে হবে কয়েকটা, কিছু ভেবো না তুমি, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ওর হাত ধরে বসে পড়ি, অনেক অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারি না, এ রকম হলো কেন!
প্রথম ক্যামো দেয়ার পরই চামড়া পুরো কালো হয়ে যায়, চুল ঝরে যায় সব। সারাক্ষণ হাসপাতালের কাছেই ঘোরাফেরা করি, ভেতরে তো ঢুকতে দেয় না, ওদের কেন্টিনে বসে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বই পড়তে ইচ্ছে হয় না, টিভি দেখতে ইচ্ছে হয় না, এত প্রিয় আমার রবীন্দ্রসংগীত, তাও শোনা হয় না। অপ্রকৃতিস্থ, অসুস্থ একটা জীবনের ভেতর ছিটকে পড়ি, কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছি। খারাপের দিকে যেতে থাকে কেরোলের অবস্থা, অপারেশন করে বুকের একটা দিক ফেলে দিতে হয়, কেরোলের কষ্ট আর সহ্য হয় না, ওকে বলি –
কিছুই চাই না তোমার, শুধু শরীরের ভেতর মানুষটা টিকে থাকো, ওতেই চলবে আমার, তাও যদি না পারো, অশরীরী হয়েও বেঁচে থাকো আমার বুকের ভেতর, তবু বেঁচে থাকো। বুঝতে পারি শরীরের থেকেও মনের কষ্টই হচ্ছে ওর বেশি।
শেষ পর্যন্ত সকল কষ্টেরই অবসান হয়। প্রায় আট মাস পর ওর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয় ওর কফিন, শেষকৃত্যের আগেই বিলেতের পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে আসি।
অক্সফোর্ডের শেষ ক’টা দিন এক অবর্ণনীয় অবস্থার ভেতর কাটিয়েছি, ভালোলাগা কোনো কিছুই আর ভালো লাগে নি, জীবনের প্রতি সব ধরনের আকর্ষণ ও মোহ হারিয়ে ফেলি, অর্থহীন মনে হয় সব কিছু। স্পেইস সাইন্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। বিশ্বজগতের সময়ের হিসেবে পৃথিবীর জন্ম ও মৃত্যুর সময়টাই তো একটা বুদবুদের জন্ম-মৃত্যুর সমান, আর একটা মানুষের জীবন মুহূর্ত দিয়েও পরিমাপ করা যায় না, এতো কিছু কেন এ জীবনে? পৃথিবীর এই অনিত্যতার ভেতর নিত্যদিনের কোনো কিছুই যেন আর নির্দিষ্ট থাকে না। কোনো কোনো রাতে ঘুম হয় না, আবার কখনো দেখি দুপুর থেকেই ঘুমোনো শুরু করেছি। কখন কি খাই তাও মনে থাকে না, ডিমেনশিয়া রোগীর মতো হয়ে পড়ি অনেকটা। পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যায় জীবন!
আমার এই ভগ্নাবস্থা দেখে মুষড়ে পড়ে বাবা, প্রায় দু মাস গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে দেই, কোনো কিছুই ভালো লাগে না, জীবনের সকল অর্থ যেনো হারিয়ে ফেলি। বিলেতে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, দেশের ভেতরই ঘুরতে থাকি, পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করি, জীবনে কিছুটা গতি আনার চেষ্টা করি, যুদ্ধের ন’মাসে রাজাকারেরা কী অবস্থা করেছে দেশটার বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় নি, সর্বত্রই নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ, চেনা-জানা আত্মীয়-স্বজন অনেকেই নেই, অনেকের প্রায় পুরো পরিবারই শেষ করে ফেলেছে, কী নিষ্ঠুরতা! এর মধ্যে আবার নতুন করে শুরু হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা নামধারী ছদ্ম-শয়তানদের লুটতরাজ, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি, এমন একটা অরাজক অবস্থা দেশ-জুড়ে, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতির পক্ষেও এমন একটা দেশ স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ঠিক করে ফেলা পুরোপুরি অসম্ভব, অন্তর দিয়ে চেষ্টা করছেন বঙ্গবন্ধু, অসৎ রাজনীতিবিদরা প্রকৃত দেশপ্রেমীদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে, মানুষের প্রত্যাশা ধূসর হতে শুরু করেছে, খুব দ্রুত নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নিচ্ছে বিরুদ্ধবাদীরা, এতো দিন যারা স্রোতে গা ভাসিয়ে ছিল, সুযোগ বুঝে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে। এসব দেখেশুনে মন আরো ভেঙ্গে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত গ্রামের পাট চুকিয়ে ঢাকায় চলে আসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির চেষ্টা করি, প্রোফেসর হিসেবে যারা আছে ওদের সঙ্গে কথা বলতে যেয়ে বুঝতে পারি আমার পিএইচডি ডিগ্রি এদেশে কাজে লাগানো যাবে না, পদার্থবিদ্যায় কোনো গবেষণা করা দূরে থাক, বিলেতে এ লেভেলেও এসব জিনিস পড়ানো হয় না, নতুন জ্ঞান দূরে থাক পুরোনো বিদ্যাই নেই এদের, বুঝতে পারি না, এসব বিশ্ববিদ্যালয় কেন! পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স করার পর যদি ব্যাংকের কেরানি বা পুলিস পরিদর্শকের চাকরিতে যেতে হয় তাহলে রাষ্ট্র কেন এই অপচয় করছে, এমন চাকরির জন্য এ লেভেল পড়াশোনারও দরকার নেই, ও লেভেলই যথেষ্ট। ওদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি তথাকথিত প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে চাকরি হবে না আমার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রকৃত পদার্থবিজ্ঞানীর সন্ধান পাই, তরুণ ও খুব আন্তরিক ভদ্রলোক, ওর সঙ্গে দেখা করি, ওখানে ঢুকতে পারলে সে খুশি হবে, সব দিক দিয়ে সহায়তা দেন আমাকে, ওখানেও হয় না আমার, পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামে হলে হতো নিশ্চয়, এরা এতো বেশি আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট, জানা ছিল না।
আণবিক শক্তি কমিশন থেকে একটা অফার পাই, কিন্তু আমার স্বভাব যা দাঁড়িয়েছে, শিক্ষকতার বাইরে ঐ দশটা পাঁচটার জ্বীহুজুর চাকরি আমাকে দিয়ে সম্ভব হবে না। ঘুরে ফিরে একটা বছর কাটিয়ে দেই।
বিয়ে করানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে বাবা-মা। বুঝতে পারি, এ দেশটাকে হারিয়ে ফেলেছি আমার কাছ থেকে, এক বিগত আত্মা এখন আমি, কিছু করার নেই। জীবন থেকে প্রায় একটা বছর খুঁইয়ে লন্ডনের বিমানে উঠি, অনিশ্চয়তার পথে আবার ভাসিয়ে দেই জীবনের আগামী দিনগুলো।