অন্য আলো
কামাল রাহমান
৭
এতো সাধ করে বাসাটায় নতুন রূপ দিয়েছি, নতুন একটা জীবন শুরু করবো বলে, মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েছি, তা যে বিধাতার ইচ্ছা ছিল না, আগে বুঝবো কি করে? অক্সফোর্ডের চাকরিটা হতে পারতো যদি অগ্রাধিকার তালিকায় প্রথম দিকে আমার অবস্থান হতো, এদের অগ্রাধিকার তালিকা মোটামুটি এরকম: স্থানীয় ইংরেজ>ইংরেজ>স্থানীয় ব্রিটিশ>ব্রিটিশ>স্থানীয় সাদা>সাদা>স্থানীয় অন্যসব>অন্যসব। যদিও এরা বলে ডিসক্রিমিনেশানের বিপক্ষে এদের অবস্থান, কিন্তু এতো সূক্ষ্মভাবে কাজটা করে যে ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যেরা বুঝতে পারে না, ম্যাগডালেন কলেজের যে চাকরিটা আশা করেছিলাম, তা আমার থেকে অনেক কম ক্যালিবারের ইংরেজের হাতে চলে যায়, সে হয়তো এটা করবেও না বেশি দিন।
কিচ্ছু করার নেই, সবই পরম করুণাময়ের ইচ্ছা, এজগতের সবকিছুই তো তাঁর ইচ্ছাধীন, তুচ্ছ এই মানবের কি করার আছে! এতো বড় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন তিনি, এই পৃথিবী যেখানে ধূলিসমও না, হয়তো এক পরমাণু পরিমাণ, আর একজন মানুষ পৃথিবীর কতটুকু, এবং মহাবিশ্বের সময়ের হিসেবে একটা মানুষের জীবন তো কোনো হিসেবে আসে না, সবাই জানে এসব, এই মানুষকেই কিনা তিনি গ্রহণ করেছেন নিজ পুত্ররূপে, ও অন্যান্য সম্পর্কে, কী অসীম করুণা তাঁর। অবশ্য ঐ মহাপ্রভুর কোটি কোটি নক্ষত্রের এক সামান্য নক্ষত্র সূর্য বিষয়ে হয়তো ভুলেই গেছিলেন মানুষকে জ্ঞানদানের সময়, নাহয় মানুষ কখনোই বলতো না যে সূর্য ঘোরে পৃথিবীর চারদিকে! মহাপ্রভুর ইচ্ছায় এবার্ডিনে যেতে হচ্ছে আমাকে, আমার কোনো ইচ্ছে তো নেইই, এমনকি আমার শুভাকাঙ্খীদের কারোও নেই।
অক্সফোর্ড থেকে এবার্ডিন বাসে দশ বারো ঘণ্টার জার্নি, আসতে ও যেতে রাস্তায়ই কেটে যায় উইকেন্ড, প্রথম কয়েক হপ্তা আমিই আসি, পরের দিকে পালা করে দু জনে আসা যাওয়া করি, আমার অবস্থা হয়েছে গোগোলের ‘নতুন জামাই’এর মতো। মাঝে মাঝে বিমানের সস্তা টিকেট পেয়ে যাই, ইউরোপের পার্টনারদের জীবন এভাবে চলে না, ভেঙ্গে যায়, কেরোল অনেক সহিষ্ণু, সম্পর্কটা টিকে থাকে। এই অসহনীয় ছোটাছুটির অবসানের কথা ভাবতে থাকি মনেপ্রাণে, এবার্ডিনে শীত এতো বেশি যে অসুস্থ হয়ে পড়ি, সর্দি ভালো হতে চায়ই না, খুব বেশি এলকোহোল নিতে হয় শরীর চাঙ্গা রাখার জন্য।
জীবনের এক সন্ধিক্ষণে এলিনা এসেছিল সাইক্লোনের মতো, ঐ ঘূর্ণাবর্তে আমিও ঘুরেছি এক সঙ্গে, সাইক্লোন সরে যাওয়ার পর সব শান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। নতুন করে আবার জীবন শুরু করেছি। তুচ্ছ এই জীবনে বহতা নদীর চঞ্চলতা এনেছে কেরোল, ওর গতি, ঢেউ, স্বচ্ছতা সবই উপভোগ করি, গ্রহণ করি মন-প্রাণ দিয়ে, ওর উষ্ণ জলে অবগাহন করে প্রাণ জুড়াই, ওর অনুপস্থিতি আমাকে মরুজীবনের যন্ত্রণা দেয়, প্রতিটা রাত বড় দীর্ঘ মনে হয়, দিনগুলো কাটে অস্থিরতায়। প্রকৃত ভালোবাসা এসেছে আমাদের মধ্যে, পরিপূর্ণ প্রেম! হয়তো একেই বলে প্রকৃত প্রেম, উজ্জ্বল, হিরন্ময়, নিকষিত হেম, কোনো উদ্দামতা নেই, রয়েছে গভীরতা, প্রশান্ত আবেগ, তীব্র তৃষ্ণা!
আমার অস্থিরতা মাঝে মাঝে ঠেলে দেয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে অক্সফোর্ডে চলে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছেটার প্রতি পরাভূত হতে, বাধ সাধে কেরোল, ভালো চাকরি নিয়েই ফিরতে হবে, আমার সিভিতে কোনো বাজে আইটেম ঢোকাতে চায় না সে, মেনে নেই।
যেদিন কোনো ক্লাশ থাকে না, সিটি সেন্টারে ঘুরে বেড়াই অকারণে, দুপুরের খাবার হয়তো ওখানেই খেয়ে নেই। বাজার-চত্বরের কাচে ঢাকা অংশের কোনো একটা বেঞ্চে বসে মানুষজনের আসা যাওয়া দেখি। দু পাশে দু সারি দোকানের মাঝখানের জায়গাটা কাচ-ঢাকা, সারি সারি বেঞ্চ বসানো, মাঝে মাঝে জ্যামিতিক নির্মাণ, ফোয়ারা, ভেন্ডিংমেশিন, এসব বসিয়ে সৌন্দর্য বাড়িয়েছে চত্বরটার। আমার সামনে এখন হেইচএন্ডএম-এর বিশাল দোকান, শপিংয়ে ব্যস্ত মানুষের ভিড়ে এক তরুণ-যুগল দৃষ্টি কাড়ে, এটা-সেটা দেখছে মেয়েটা, একটু পরপর হাত বাড়িয়ে ওর ডান নিতম্ব টিপে দেয় সঙ্গী ছেলেটা। আশ্চর্য হই, মেয়েটা একেবারে ভ্রƒক্ষেপহীন, নির্বিকার! স্কার্টের নিচে ওর জঙ্ঘায় চোখ আটকে যায়, দারুণ সম্বৃদ্ধ গড়ন! একটু পরে ঐ নিতম্ব ও জঙ্ঘা, দুটো নিয়েই উধাও হয়ে যায় ওরা, জায়গাটা যেন ফাঁকা হয়ে যায়। দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে কাচের ভেতর দিয়ে এটা-ওটা দেখে এক তরুণ, মাথার চুলগুলো ওর হেলমেটের মতো করে ছাঁটা, কুচকুচে কালো, নিশ্চিতভাবেই রং করা। একবার চোখ ফেরায় এদিকে, ওদুটো দেখি গাঢ় নীল, চুলগুলোও নীল রং করালে দেখাতো কেমন, ভাবি। একটু পরে এক বুড়ো এসে পাশে বসে, শরীরে চাপানো দামি কোট, পায়ে চকচকে জুতো, অথচ গা থেকে এমন বদ গন্ধ বেরোয়, ভেতর থেকে উগলে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে উঠে যাওয়ার অভদ্রতা দেখাতে না পেরে দম বন্ধ করে বসে থাকি যতক্ষণ পারা যায়, দম ফুরোলে উঠে যাই, হে ভগবান! বুড়োর যে বুড়ি নেই এটা যে-কেউ নিশ্চিত বলে দিতে পারে।
ইচ্ছে ছিল বসবো কিছুক্ষণ, উঠে পড়েছি যখন, অন্য কোথাও আর বসতে ইচ্ছে হয় না, বাসায় ফিরে এক মগ কালো কফি নিয়ে জানালার ধারে বসি। বাসা থেকে দূরের সমুদ্র দেখা যায়, কিছুটা দামাল, ঝড়ো বাতাস, মাঝে মাঝে বৃষ্টি, সমুদ্রের ধূসর ঢেউ তীরে এসে এসবের প্রতিবাদ জানায়, জানালার শার্সিতে, ছাদের কার্ণিশে বাতাস আটকে পড়ে শিস দিয়ে যায়। নিচের তলায় মিস কোরবিন খুব হালকা সুরে পিয়ানো বাজায়, যখন ঘরে থাকি ওর সুর কখনোই উচ্চগ্রামে পৌঁছে না, তারপরেও বলে রাখে, যদি পিয়ানোর সুর কখনো উপরে উঠে যায়, তোমাকে বিরক্ত করে, মেঝেতে গোড়ালি দিয়ে দুটো টোকা দিও, সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দেবো। অনেক আস্বস্ত করেও উঁচু কোনো সুর ওকে দিয়ে বাজাতে পারি নি। বাখ বাজাতে বলেছি একদিন, খুব খুশি হয় নি, শুনিয়েছে কিছুটা, ওর প্রিয় শিল্পী হোল্ডার্লিন, আমার আগ্রহের চাপে মাঝে-মধ্যে বাজিয়ে শোনায়, যখন বাজায় মনে হয় ভুলে যায় অন্য কেউ শুনছে, বাজানো শেষ হলে আমাকে দেখে চমকে ওঠে মাঝে মাঝে, হয়তো সত্যিই ভুলে যায়। শুধু নিজের জন্য বাজানোর ভেতর গূঢ় কোনো রহস্য হয়তো আছে, ব্যক্তিগত এসব কিছু তো জিজ্ঞেস করা যায় না। বয়েস হলেও এখনো সুন্দরী, বয়সকালে কেমন ছিল আন্দাজ করা যায়, চুল প্রায় সবই সাদা, দু একটা সোনালি চুলের উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয় এক সময় মাথা ভরা সোনালি চুল ছিল, হয়তো অনেক ধরনের হেয়ার স্টাইলও করতো। একটা বেণি গেঁথে ঘাড়ের পেছনে ঝুলিয়ে রাখে এখন। এলিনার কথা মনে পড়ে ওকে দেখে, সেও মাঝে মাঝে লম্বা বেণি করতো, বেণির সঙ্গে আরো কি কি যেনো ঝুলিয়ে রাখতো। ফুল ও লতাপাতার কাজ করা উলের একটা সোয়েটার গায়ে জড়িয়ে আছে মিস কোরবিন, লম্বা ঝুলের স্কার্টের রং গাঢ় নীল, নিচের দিকে ড্যামসন রঙের কোনাকুনি দুটো স্ট্রাইপ, বেশ স্মার্ট দেখায় ওকে। আমার আগ্রহ দেখে বলে এক দিন, তোমাদের সংগীতের কোনো নোটেশান থাকলে দিতে পারো, বাজিয়ে শোনাতে চেষ্টা করবো। বেশ কষ্ট হয়েছে ওকে বোঝাতে যে আমাদের সংগীত সারেগামাপাধানি এই সাতটা সুরে বাঁধা। অবাক হয়েছে, বুঝিয়ে বলেছি এই সাতটারও আবার উঁচু ও নিচু ধাপ রয়েছে, মোট একুশটার পারমুটেশান কম্বিনেশান করে ক’হাজার বিভিন্ন মাত্রার স্বর তৈরি করা যায় কল্পনা করা কঠিন। বুঝতে পারে নি। বলে, খুব জটিল তোমাদের সংগীত, হয়তো চিনা ভাষার মতো। আমি বলি, মোটেও না, বরং তোমাদের তুলনায় অনেক সহজ, তবে সাধনার ধন। আমার একটা মিউজিক প্লেয়ার আছে, স্পুল, ওখানে কিছু উচ্চাঙ্গের বাদন রয়েছে, ওটা ওকে শুনিয়েছি, মুগ্ধ হয়ে শুনেছে, বারবার বাজিয়ে নোটেশান তৈরি করে নিয়েছে, তারপর পিয়ানোয় তুলেছে, আমার কাছে ভালোই লেগেছে, ওর পছন্দ হয় নি, ঐ সুরে ওর আঙ্গুলগুলো নাকি পিয়ানোর রিডের সঙ্গে নাচে না। এতো নিচু স্বরে এখন বাজায় সে, দু একটা টুংটাং শব্দ ছাড়া আর কিছুই উপরে পৌঁছায় না, অথচ এখন আমার কান প্রস্তুত হয়ে আছে কোনো একটা সংগীতের জন্য। সমস্যা হলো, কোনো কিছুর জন্যই ওকে অনুরোধ করা যায় না।
একদিন ঘরে ঢুকে দেয়ালে ঝোলানো জাহাজের একটা ডেকহুইলের দিকে আগ্রহভরে তাকাই, সঙ্গে সঙ্গে বলে, দয়া করে ওটার বিষয়ে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করো না, কেমন চুপসে যাই। নিশ্চয় না, বলে বেরিয়ে আসি।
যে রুমটা ভাড়া নিয়েছি তা ভালোভাবে দেখেশুনে নেয়ার সুযোগ হয় নি, ফোন করে যখন জানি, সেদিনই খালি হয় রুমটা, আগের ভাড়াটে না-নেয়ার মতো টুকটাক কিছু ছেড়ে গেছে। আমাকে বসার ঘরে বসিয়ে কোরবিন বলে, আধঘণ্টা অপেক্ষা করো, রুমটা পরিষ্কার করে দেই। বলি, কোনো দরকার নেই, সব আমি করে নেবো, তুমি বিশ্রাম নাও। দু বার জিজ্ঞেস করে আমি নিশ্চিত কিনা। ওকে নিশ্চয়তা দিয়ে উপরে এসে বেডকভার পেতে দুবে নিয়ে সোজা ঘুমিয়ে পড়ি, খুব ক্লান্ত ছিলাম সেদিন, ঘুম ভাঙ্গে ওর পিয়ানোর টুংটাং শব্দে। এখনও ওরকমই দু একটা শব্দ পাচ্ছি। দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবি ছিল, পেন্সিল স্কেচ, অনেক পুরোনো কোনো শিল্পীর হবে, নামটা চেনা নয়, ঐ ছবির কুকুরটার দিকে যখনই চোখ পড়ে, মনে হয়, একটু নড়াচড়া করলেই, ঘেউ করে ডেকে উঠবে কুকুরটা! টেবিলের ড্রয়ারে মেয়েদের চুলের বড় একটা ক্লিপ, হয়তো ওর কোনো বান্ধবীর, অথবা, জানি না। শার্টের হাতার একজোড়া দামি কাপলিং, চিঠি লেখার দুটো প্যাড, আরো কয়েকটা জিনিস ফেলে দেই নি, পরের ভাড়াটের জন্য আমিও হয়তো রেখে যাবো এসব, সে যদি হয় আমার মতো কেউ, একই রকম বা অন্য কিছু ভাববে, নয়তো ফেলে দেবে ময়লার ঝুড়িতে, এটারই সম্ভাবনা বেশি। কোনো কিছুই ফেলে দিতে ইচ্ছে হয় না আমার, মনে হয় সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে কিছু স্মৃতি, কিছু অতীত!
ফাইনাল থিসিস সাবমিট করার জন্য এক বছর সময় পাবো, অবসর সময়ে কাজগুলো করতে হবে, কিন্তু কাজে মন বসে না, কাজ বলতে যা বোঝায় তা হয়তো আমার জন্য না, আমার জন্য শুধু কল্পনা। কাজ করা আসলে অনেক বড় বিষয়, কাজের মানুষেরা কাজ করে, প্রতিভা দিয়ে করতে হয় কাজ, পরিশ্রম দিয়ে গড়ে তুলতে হয় নিজেকে, এ বিষয়টাই মনোপুত নয় আমার, এ পর্যন্ত যাহোক, উতরে এসেছি, শেষটায় কি হবে ঐ মহাপ্রভু জানেন, আমি জানি না। রেডিওলোজির উপর বইপত্র যা আনা সম্ভব নিয়ে এসেছি, মাঝে মাঝে কেরোল লাইব্রেরি থেকে তুলে রাখে, আমি নিয়ে আসি, কখনো সে। আর কিছু না হোক, পড়াশোনাটা অবশ্যই শেষ করতে হবে, এবং ভালোভাবে, এমএস-এর রেজাল্ট যেহেতু ভালো হয়েছে, আশা করি পিএইচডিরটাও ভালো হবে।
পাতা-ঝরা গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে মন আরো বিষণœ হয়ে যায়, একটা গাছে দেখি সুন্দর একটা পাখি এসে বসেছে, নাম জানি না পাখিটার, প্রথমে যে ডালে বসে, পাতা না থাকায় ওর ভারে নুয়ে পড়ে, লাফিয়ে অন্যটায় যায়, ওটাও দুলে ওঠে, তৃতীয়টায় যেয়ে ঠিকভাবে বসতে পারে, পাখিটার নাম জানতে হবে, ওয়ান ফর সোরো, ওটার জুটি খুঁজি, কোথাও নেই। পাশের বিল্ডিংএর জানালার পর্দার বাইরে বসে আছে একটা বেড়াল, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে, ওটা আসল না নকল বোঝা যায় না, একটুও নড়াচড়া নেই, আগামীকাল দেখতে হবে একই জায়গায় রয়েছে কিনা।
কোনো একটা উইকেন্ড হয়তো কেটে যায় এভাবে, যে-কোনো কারণে দু জনেই আটকে থাকি দু প্রান্তে, হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া মাঝখানে অন্য কিছু থাকে না। দীর্ঘ সময় ধরে পান করার জন্য হালকা বিয়ার নিয়ে জানালার ধারে বসি গান শোনার জন্য, পড়াশোনার কাজটাও চালিয়ে যাই। একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে দরোজায় মৃদু টোকার শব্দ শুনি, নিশ্চিত হতে পারি না আমার দরোজায়ই কিনা, দ্বিতীয়বার টোকা শুনে দরোজা খুলে এতোটাই অবাক হই যে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি কয়েক মুহূর্ত, অবশেষে বলি –
ভাবতেই পারি না!
ভেতরে আসবো?
নিশ্চয়।
সোফায় বসতে বলি ওকে।
এখানে আছি জানলে কীভাবে হেইনে?
ইচ্ছে থাকলে এটা কোনো বিষয়?
তা ঠিক, কেমন আছো?
ভালো, তুমি?
এই তো, চলে যাচ্ছে।
কেরোলের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছি, ও জানালো এ হপ্তায় তোমরা কেউ কোথাও যাচ্ছো না, ভাবলাম এ সুযোগটা নেয়া যায়, কিছুটা সময় বের করে নেই তোমার কাছ থেকে।
ভালোই হয়েছে, খুশি হয়েছি।
সত্যি?
হ্যাঁ।
সন্ধ্যাটা ফ্রি আছো তো?
কেন, কোথাও যেতে হবে?
না, এখানেও কিছুক্ষণ বসতে পারি, অথবা আমার ওখানেও যেতে পারো। জানালা দিয়েই দেখতে পাবে আমার হোটেল রুমটা, ঐ বাঁকে, দু মিনিটের হাটা-পথ।
ঠিক আছে, তোমার ওখানেই যাবো, বাড়িওয়ালির একটা মৌখিক শর্ত আছে, নিঃশব্দ জীবন যাপন করতে হবে, ওটা মেনে চলি, একটু জোরে গানও বাজাই না।
আরে, ঠিকই তো, কোথাও একটা গান বাজছে মনে হয়, আমি ভেবেছি নিচে কোথাও, তুমি শুনতে পাও ওটা?
হ্যাঁ, অভ্যাস হয়ে গেছে, এখন বরং নিচু স্বরই ভালো লাগে।
এটা ভালোই।
তাহলে আসো আমার ওখানে, রুম নাম্বার এক শ এগারো।
ঠিক আছে, আধ ঘণ্টা সময় দাও।
কোনো সমস্যা নেই, দেখা হবে শীঘ্র।
অ’রাইট।
একটু খটকায় পড়ি, হেইনের সঙ্গে যেভাবে সম্পর্ক-বিচ্ছেদ হয়েছে, আশা করি নি আর কখনো এক টেবিলে বসা হবে, আবার কি ওর রহস্যজালে জড়াতে চায় আমাকে, ওর ঐসব হেঁয়ালি আর ভালো লাগে না, ওকে দেখে মধুকবির বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসনটার কথাই মনে পড়ে কেবল। যৌবন পুরোপুরি খুঁইয়েছে সে, এটা বোঝা যায়, এবং অপরিমিত অযাচারে যে নষ্ট করেছে, তাও অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, যতোই সে নাৎসি ক্যাম্পের অত্যাচারের সাফাই গা’ক না কেন! এলিনার মতো দগদগে আগুন কীভাবে সামলেছিল কিছুদিন, ওটাই এক রহস্য! এলিনা হয়তো আমার প্রতি ওর ক্রোধ, বিতৃষ্ণা, ধিক্কার প্রভৃতির প্রতিশোধ নিতে যেয়ে নিজেকে নিক্ষেপ করেছিল হেইনের মতো একটা অন্ধকূপের ভেতর। শীঘ্রই যে ওটা কেটে যাবে তখনই বুঝতে পারি, এবং গেছেও, স্বাভাবিক অবস্থায় হেইনের সঙ্গে এক মুহূর্তও কাটানোর কথা না এলিনার। ওর উত্তুঙ্গ, অস্বাভাবিক সময়টা কেটে যাওয়ার পর নোংরা অন্তর্বাসের মতোই ছুঁড়ে ফেলেছে হেইনেকে। একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে, হেইনে প্রতারক নয়, এক রহস্য! ভগ্নাবস্থা থেকে উঠে আসতে সাহায্য করেছে এলিনাকে, অকুণ্ঠচিত্তে, অকৃত্রিমতার সঙ্গে, এখানে প্রশংসা করি হেইনের।
আধ ঘণ্টা পর হোটেলের রিসিপশনের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখি দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে হেইনে, হয়তো জানালা দিয়ে আমার রাস্তার দিকে চোখ রেখেছিল। হাত বাড়িয়ে দেয়, সেই পুরোনো হেইনে, আমাদের ভেতর যে এতো কিছু ঘটে গেছে যেনো মনেই নেই, লাউঞ্জে নিয়ে বসায়। রাতের খাবারের জন্য ডাইনিংএ যাবো, না বারে, জিজ্ঞেস করে। বারে যেতে চাই, মন ঢাকা পড়ে আছে তুষারে, একটু আলো চাই, রোদ চাই, বরফ গলা রোদ।
তোমার থিসিসের কি অবস্থা ডাউ?
এগোচ্ছে ভালোই, সমস্যা হবে না আশা করি, ধন্যবাদ তোমাকে।
অক্সফোর্ড মিস করছে তোমাকে।
হা হা হা, ভালোই বলেছো।
ড্রিঙ্কসটা ঠিক আছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই, আজ ব্র্যান্ডির রাত, আকাশে অনেক তারা জ্বলছে।
মনে মনে বলি, আসল কথা বলছো না কেন ভায়া! নীরবে পান করি কিছুক্ষণ, অথবা পান করি নীরবতা। অন্ত্রে এলকোহোলের বুদবুদ, চুপ করে তো থাকা যায় না, বলি –
কিছু বলবে হেইনে?
তেমন কিছু না ডাউ। এলিনা কেমন আছে?
জবাব দেয় না। আবার বলে, ওর সঙ্গে এ রকম সমাপ্তি না ঘটলেও পারতো, ভালোভাবে সরে যেতে পারতো আমার কাছ থেকে, চরম শত্র“কেও হাসিমুখে বিদায় জানানোর মধ্যে একটা আর্ট রয়েছে, মানবিক শিল্প এটা, বিবাদ করে পৃথক হয় ইতর শ্রেণির মানুষেরা, আমি ঘৃণা করি এটা।
ওর কথায় যুক্তি আছে, আপত্তি জানাই না, মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাই।
তাছাড়া ওখানে আমাদের দু’জনের কারোই দোষ নেই, বেজন্মা ঐ সংস্থার লোকগুলোই এলিনাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
এবার টোকা লাগে মাথায়, একটু ঝাঁঝের সঙ্গে বলি –
দেখো হেইনে, তোমার ঐ গোপন সংস্থার প্যাচাল অনেক শুনিয়েছো, ওটায় ক্ষান্ত দেয়ার সময় এসেছে, এখন থামো প্লীজ, একটা শব্দও শুনতে চাই না আর ও বিষয়ে।
রাগ করো না ডাউ, আমি যে নাচার, আমার জীবনের সঙ্গে মিশে আছে ওটা, আমার শরীরে চামড়া যেমন টেনে তুলে ফেলে দিতে পারি না, ওটাকেও ছাড়াতে পারি না তেমনি। বিশ্বাস করো, ওটা এমনকি পোশাকের মতোও যদি হতো, ছুঁড়ে ফেলে দিতাম। পাগল হওয়ার ভান করে ন্যাংটো ঘুরে বেড়াতাম।
আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি তোমাকে, রহস্যটা খুলে বলছোও না।
বলবো একদিন নিশ্চয়, সময় পেতে হবে তো।
বলো, এক্ষুণি বলো।
সে সময় তো আসে নি ডাউ।
হ্যাঁ, আসবে, যখন হয় তুমি, নাহয় আমি আর এ জগতে থাকবো না।
এ রকমও হতে পারে।
ঐ গোপন সংস্থা যেহেতু তোমার পিছ ছাড়ছে না এখানে, দেশে চলে যাও না কেন?
তোমাকে তো বলেছি যে দেশে আমার ভাই, বন্ধু, স্বজন কেউ বেঁচে নেই। এতো সব মৃত আত্মার ভেতর একমাত্র জীবিত হিসেবে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব, নিশ্চিত আত্মহত্যা করতে হবে আমাকে।
স্বজাতির ভেতর বেঁচে থাকতে পারো, নতুন নতুন বান্ধবী পেতে পারো, পরিবার গড়ে তুলতে পারো, বন্ধুজগত গড়ে তুলতে পারো, কত কিছুই তো পারো। কিছু মনে করো না, আমার মনে হয় তুমি মানসিকভাবে অসুস্থ।
তা বলতে পারো তুমি।
এদেশে থেকেই বা কি হচ্ছে তোমার! সারাক্ষণ বলছো গুপ্ত সংস্থা তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, দেশে গেলে নাহয় স্বজনদের মৃত আত্মারা তাড়া করে বেড়াবে, ওরা তো কোনো ক্ষতি করতে পারবে না তোমার।
তোমার কথায় পুরোপুরি যুক্তি আছে, সবই মেনে নিচ্ছি ডাউ।
আমার সন্দেহ হয়, তুমি হেইনে লিস্টেনবর্গ নও, কোনো গুপ্ত সংস্থাই নেই তোমার পেছনে, তুমিও গেস্টাপো বাহিনীর কেউ, ছদ্মনামে এদেশে পালিয়ে আছো।
ওর চোখে কি বিদ্যুৎ খেলে গেলো! আমার চোখেও ঘোর থাকায় বিষয়টা বুঝতে পারি নি। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। বলি –
বলো, কি বলতে এসেছো।
তুমি জানো ডাউ, বিলেতে একমাত্র তোমাকেই বন্ধু হিসেবে পেয়েছি, তোমার সঙ্গে দু চারটা কথা বলি, কিছুটা সময় কাটাই, আমি বিশ্বাস করি বন্ধুত্বের মধ্যে অবিশ্বাস থাকতে নেই, সন্দেহ থাকতে নেই।
বুঝতে পারি যথেষ্ট আহত হয়েছে হেইনে। বলি –
বিশ্বস্ত থাকার জন্যই সন্দেহটা মনের ভেতর না রেখে প্রকাশ করে ফেলেছি।
ভালোই করেছো।
এক প্যাকেট সিগারেট বের করে দেয়, হেইনে অধূমপায়ী, আমার জন্য প্যাকেটটা কিনেছে, একটা সিগারেট বের করে পাফ নিতে থাকি। প্যাকেটটা আবার ওর পকেটেই ঢুকিয়ে রাখে। একটা রহস্যই রয়ে গেল সে, বুঝতে পারি না কি করি ওকে নিয়ে, ওর বন্ধুত্বে কোনো খাদ নেই, মনে হয় সত্যিই বন্ধু হিসেবে নিয়েছে, প্রায় সবকিছুই খোলাখুলি বলে আমাকে, কিন্তু এই গুপ্ত সংস্থার রহস্যের জট খুলছে না, অথচ সব সময়ই বলে এ প্রসঙ্গে কথা বলতে হবে আমার সঙ্গে, আশ্চর্য!
আসলে ডাউ, এলিনার বিষয়ে কথা বলতে আসি নি তোমার সঙ্গে, আমার জীবনে একটা ঝড়ের মতো এসেছিল সে, ঝড়ের মতোই মিলিয়ে গেছে। রেখে গেছে অনেক ঝরা-পাতা, ভাঙ্গা ডাল-পালা, দুঃখ ও আনন্দ-দেয়া কিছু সংহার-চিহ্ণ।
একটু অবাক হই, একই রকমভাবে আমার জীবনেও এসেছিল এলিনা, একটা সাইক্লোন, হ্যারিক্যান, টর্পেডো, একটা ঝড়ের নাম এলিনা!
আমি এসেছি ডাউ, নীৎসে প্রসঙ্গে একটু আলোচনা করতে, একা একা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম অক্সফোর্ডে।
এক পাগল আরেক পাগলের জন্য দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
এবার ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে, কেন জানি না ওকে পাগল বলে ডাকলে খুব খুশি হয়, সব পাগলের ডাক্তারই হয় কিনা জানি না। ওর হাসিটা সত্যি অকৃত্রিম, শব্দ করে হাসতে জানে না মনে হয় হেইনে, কখনো শুনি নি, কিন্তু যখন হাসে, ওর চোখ-মুখ শরীর সবই হাসে। ওর ঐ পুরোনো হাসি দেখে আমিও হেসে ওঠি হো হো করে। আবার সেই পুরোনো দিন, পুরোনো অন্তরঙ্গতা ফিরে আসে। দু পেগ হয়ে গেছে আমার, হেইনের প্রথম পেগের অর্ধেকও শেষ হয় নি, ব্র্যান্ডিতে এক ফোঁটা জলও মেশায় না হেইনে, গুনে গুনে তিনটা আইসকিউব, চুমুক দেয় কিনা তাও বোঝা যায় না, ঠোঁটে ছোঁয়ায় শুধু, এভাবে সারারাত চলবে, সাকুল্যে হয়তো তিন পেগে পৌঁছাবে, বোতলের বাকিটা আমার, মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি আমার জন্য রেখে দিচ্ছো? তখন আরেকটা বোতল আনিয়ে নেয়, পারা যায় না ওর সঙ্গে। গ্লাসটা একটু নাড়াচাড়া করে ঠোঁটে ছুঁইয়ে নামিয়ে রাখে টেবিলে, তাকিয়ে দেখি, একটু কমেছে! আরেকটা সিগারেট বাড়িয়ে দেয়, সিগারেটের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে বলেÑ
প্রতিভাবানেরাও এক ধরনের পাগল, অথবা পাগলেরাও এক ধরনের প্রতিভাবান।
পাগলের ডাক্তারেরা ওরকমই বলে। যাকগে, নীৎসে বিষয়ে কি যেন বলতে চাইছিলে?
হ্যাঁ, নীৎসের অতিমানব দর্শনের সঙ্গে আশ্চর্য এক মিল খুঁজে পেলাম তোমার দেশের এক দার্শনিকের।
উৎসুক হয়ে উঠি, আমার দেশের দার্শনিক!
আগ্রহ নিয়ে তাকাই, বুঝতে পেরে বলে –
হ্যাঁ, তোমার দেশের দার্শনিক, আল্লামা ইকবালের কথা বলছি।
বরফ-ঠাণ্ডা এক বালতি জল যেন কেউ ঢেলে দেয় আমার গায়, আবার ঐ … ! বলি –
ঐ দার্শনিক আমার দেশের না, আমার এক সময়ের দেশের অন্য একটা অংশের, ওদের সঙ্গে ভয়ানক বিবাদ হয়েছে আমাদের, পৃথক হয়ে গেছি আমরা, দু যুগ আগে দু শিংওয়ালা এক দৈত্যের স্বপ্ন নাকি দেখেছিলেন তিনি, যার ফলশ্রুতিতে ভারত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি আমরা, ঐ দৈত্যদানোর শিং হয়ে থাকা আমাদের মতো নিরীহ জনগোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব হয় নি, যুদ্ধ করে নিজেদের জন্য নতুন দেশের জন্ম দিয়েছি। একটু উত্তেজনা নিয়ে কথা ক’টা বলি। তাড়াতাড়ি আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে দেয় হেইনে।
ক্ষমা করো ডাউ, এ ব্যপারটা সম্পূর্ণ ভুলেই গেছিলাম। হ্যাঁ, সে এখন আর তোমার দেশের কেউ না। না বুঝে হয়তো ভুল জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছি, কিছু মনে করো না, আমি সত্যিই দুঃখিত। যাহোক, প্রাচ্যের একজন দার্শনিক হিসেবে ওকে দেখায় কোনো আপত্তি আছে তোমার?
মোটেও না হেইনে, ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে অশ্রদ্ধা করি না, ওর আসরার-ই-খুদি ও জাভেদনামার অনেক কবিতা আমার মুখস্ত, নিঃসন্দেহে একজন উঁচু মাপের পণ্ডিত ও ইসলামী চিন্তাবিদ। ঐ ধর্মটা কোনো দেশ-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না।
হ্যাঁ, প্রায় ও-কথাটাই বলতে চেয়েছি, ধর্মজ্ঞান ঐ ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, মানবজাতির জ্ঞান তো ঐ পরিসরে সীমিত না, তাছাড়া যে-অর্থে জ্ঞান, ধর্মের ভেতর কতটুকু রয়েছে তা?
ধর্মের বিষয়টা আলোচনার বাইরে থাক হেইনে, তুমি ইহুদি, আইনস্টাইন সহ পৃথিবীর অসংখ্য বিজ্ঞানী ইহুদি, ওদের তত্ত্ব, আবিষ্কার, জ্ঞানের ফসল, অনুদান, সবই মুসলমান হিসেবে গ্রহণ করতে অসুবিধা হচ্ছে না, শুধু ওদের ধর্মবিশ্বাসকে স্বীকৃতি দিতে চূড়ান্ত অনীহা আমার, এই বৈপরীত্য নিয়ে কথা বলতে গেলে বরং সমস্যা এসে দাঁড়াবে।
হ্যাঁ, ঐ বইটার কথা বলতে চেয়েছিলাম, প্রথমে যেটার উল্লেখ করেছো, ওখানে আল্লামা যে মর্দে মোমিনের ধারণা দিয়েছে, ওটা তো নীৎসে থেকে নেয়া, যদিও সে অস্বীকার করে।
হ্যাঁ, এই অস্বীকার করাটা আমাদের মজ্জাগত, পূর্বের সবকিছুকে অস্বীকার করি আমরা, অন্ধ-কাল বলি। আমাদের সবকিছুই মৌলিক, অন্য সবকিছু ভুয়া।
এটার ক্ষতিকর দিকটা ভেবে দেখেছো?
ভেবে দেখার প্রয়োজন নেই। এজন্যই হিউম্যান রেইসে পিছিয়ে আছি আমরা।
হয়তো এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এক সময় কেটে যাবে।
লক্ষণ দেখি না, এক সময় একটা সম্প্রদায় দাঁড়িয়েছিল যারা মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ধর্ম-চর্চা শুরু করেছিল, মেরে-কেটে শেষ করে ফেলা হয়েছে ওদের, এরপর থেকে আর কেউ সাহস করে না।
কিছুটা পড়েছি ওদের সম্পর্কে, মোতাজিলা সম্প্রদায় সম্ভবত।
হ্যাঁ, কথা তো আবার ধর্মের দিকেই চলে যাচ্ছে।
সমস্যা হচ্ছে, নীৎসে আলোচনা করতে গেলে ধর্ম এসেই যায়, কারণ তিনিই বলেছিলেন ‘ঈশ্বর মৃত’। তাছাড়া জীবনে ধর্ম তো আছেই, ওটা বাদ দিয়ে তো জীবন না।
হ্যাঁ, জীবনযাপনে, জ্ঞানবিজ্ঞানে যতই উন্নত হও না কেন ধর্মীয় উন্মাদনা যাবে না তোমার। কি নেই তোমাদের? অথচ তোমাদের ধুরন্ধর মানুষগুলো আমেরিকা ইউরোপ প্রভৃতি জায়গায় স্বর্গ উপভোগ করছে, আর এক শ্রেণির ধর্মোন্মাদ মানুষ পাঠিয়ে ইস্রায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, কয়েক লক্ষ মানুষকে তাদের পিতৃপুরুষের মাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে, যারা ওখানে বাস করছে ওরাও চারদিকের মুসলমানদের ঘৃণা, অবিশ্বাস ও হিংস্র হুমকির মধ্যে জীবন যাপন করছে। এটা তো চিরস্থায়ী হবে না, কোনো না কোনো দিন অযৌক্তিক শক্তির পতন হবেই, রোমান সাম্রাজ্য নেই, বলকানদের সাম্রাজ্য নেই, সেখানে তুচ্ছ একটা রাষ্ট্র টিকে থাকবে কীভাবে, শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন হলেই ওটা ধ্বংস হয়ে যাবে।
তোমার কথার পেছনে যুক্তি আছে, ধর্মীয়ভাবে আমরা এখনো সবচেয়ে বেশি গোঁড়া, খ্রীস্টানরা উদার হওয়ায় এগিয়ে যেতে পারছে, তোমাদের গোঁড়ামির অবসান হবে বলে আমার বিশ্বাস, যখন এটার উৎপত্তি হয়েছিল তখন যথেষ্ট প্রগতিশীল ও সহনশীল ছিল, যাহোক, আমরা নীৎসে নিয়ে কথা বলছি।
বাদ দাও বরং, ওটা নিয়ে কথা বলতে গেলে ধর্ম এসেই যাচ্ছে। ধর্ম, রাজনীতি ও যৌনতা, এই তিনটে বিষয় নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না আমি।
আমার ভুল হয়েছে আল্লামাকে টেনে এনে।
এবার একটা কাজের কথা বলেছো, খুশি হয়েছি, ওগুলোকে টেবিলে না আনাই ভালো।
কথা বলতে চেয়েছিলাম জারাথুস্ট্রাকে নিয়ে।
আবার তো সেই নবী আর ধর্মই এসে যাচ্ছে।
আসুক না ডাউ, আমাদের দু জনের কেউই তো কট্টর নই, অসহিষ্ণু নই, অসুবিধা কি?
তা বলতে পারো না, ধর্মের দিক থেকে কতোটা খোলামেলা আমি, তা তো বোঝোই। ধরো, কোনো কারণে যদি আরেকটা ক্রুসেড শুরু হয়ে যায়, ডেফিনিটলি আমি ঐ ধর্মযুদ্ধে যোগ দেবো, যত ঘৃণাই করি না কেন, মানবচরিত্রের এক রহস্য এটা।
রহস্যও ঠিক না, একটা বিশেষত্ব ।
হয়তো।
জানোই তো, যদিও আমরা জানি ক্রুসেড শুধুই মুসলমান ও খ্রীস্টানদের ধর্মযুদ্ধ, আসলে তো তা না, ঐ কয়েক শ বছরের অধিকাংশ সময় খ্রীস্টানরাই যুদ্ধ করেছে খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে। মুসলমানেরা ক্রুসেড শুরু করে নি, বরং ওদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, মুসলমানেরা তখন ছিল অপরাজেয়, খ্রীস্টানদের কাছে ওটা ছিল অসহনীয়।
হ্যাঁ হেইনে, এ সবই ইতিহাসের সত্য। তুমি যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছো এক সময় মুসলমানেরা সংকীর্ণতা ছেড়ে প্রগতির পথে আসবে তার সব চেয়ে বড় বাধা হচ্ছে মুসলমান-বিশ্বের প্রায় সবটাই দারিদ্র ও অশিক্ষার নিগড়ে বাধা। রোমের সম্রাট খ্রীস্ট ধর্মটাকে ব্যবহার করেছিল হাতিয়ার হিসেবে, পালিত যাজক সম্প্রদায় তৈরি করে নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বানিয়ে দুর্ধর্ষ ইউরোপীয়দের, কিছু মনে করো না এ রকম একটা শব্দ ব্যবহার করায়, অনুগত খ্রীস্টান প্রজা হিসেবে তৈরি করে নিয়েছে। অপর দিকে মুসলমান সেনাপতিরা অধিকাংশ দরিদ্র বিশ্বের দুর্বল ও আত্মকলহে লিপ্ত রাজা উজিরদের পরাজিত করে ঐসব ভুখণ্ডের মানুষদের ধর্মান্তরিত করেছে, উত্তরাধিকার সূত্রেই ওরা বঞ্চিতদের দলে, ওদের উঠে আসা একটু কঠিন বৈকি।
যথেষ্ট যুক্তি আছে তোমার কথায়। ভেবো না, খ্রীস্টানেরাও এক সময় খুব কট্টর ছিল, ব্লাসফেমি আইনটাও ওদেরই করা। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে জানে ওরা, ইচ্ছে করেই অচল করে রেখেছে ওটাকে। মনে হয় একটা পেগ অতিরিক্ত নিতে হবে আমাকে, তোমার সঙ্গে কথা বলে কী যে ভালো লাগছে ডাউ।
নাও, কিচ্ছু হবে না, নির্জলা ব্র্যান্ডিই নেবে, না অন্য কিছু মেশাবে?
না, তা পারি না কেন যে!
ঠিক আছে নাও, আরেকবার ধূমপান করতে পারি?
নিশ্চয়।
বার বন্ধ করে ক’টায় ওরা?
সম্ভবত বারোটায়, জিজ্ঞেস করে আসি।
হেইনে উঠে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ একা একা ভাবি, আসলে কি কথা বলতে এসেছে সে, একেবারে অকারণে নিশ্চয় খুঁজে বের করে নি আমাকে। টয়লেট থেকে ঘুরে আসি এই ফাঁকে। এসে দেখি দু প্লেইট ফ্রায়েড চিকেন উইংস ও ক্রিসপি নাগেট নিয়ে এসেছে হেইনে, মুখে দিয়ে দেখি বেশ মজা। ফাইভ স্টার হেটেলের খাবার, মজা না হওয়ার কোনো কারণ নেই, বারটাও বেশ বড়, হলের দু পাশে সারি দেয়া ছোট ছোট রুম, একান্তে বসে কথা বলতে চাইলে ওখানে বসা যায়, সামারে নিশ্চয় গমগম করে এ জায়গাটা, নাটমঞ্চটাও বেশ বড়, শহরের সেরা বার-ড্যান্সররা নাচতে-গাইতে আসে নিশ্চয়। আসবাবপত্র বেশ দামি, অনেক ফাইভ স্টার হোটেলও আজকাল দেখতে জমকালো আধুনিক সস্তা ফার্নিচার দিয়ে সাজিয়ে রাখে। ওদের সব ফার্নিচার ও কাঠের ডেকোরেশান জর্জিয়ান রীতির। অনেক পুরোনো হোটেল হবে হয়তো, আভিজাত্য ধরে রেখেছে। কার্পেটের রং, নক্সা ও চাকচিক্য দেখে মনে হয় ইরানি, ছাদের কারুকাজ ও ঝাড়বাতি ভিক্টোরিয়ান, দেয়ালে বসানো হালকা আলোর বাতিগুলো আধুনিক ডিজাইনের হলেও সবকিছুর সঙ্গে মিল রয়েছে। বিলেতের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশানে ডিগ্রি কৌর্স করানো হয়, আর্কিটেকচারের মতোই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় এটাকে। ভাবা যায়, চার্চ ও ক্যাথেড্রালের মতো বড় বড় স্থাপনাসমূহের আভ্যন্তরীন অঙ্গসজ্জা করেছে, ছাদের ও খিলানের চিত্র, দেয়ালের ফ্রেস্কো প্রভৃতি এঁকেছে মাইকেলেঞ্জেলোর মতো বিখ্যাত সব শিল্পীরা!
আড্ডা দিতে এতো ভালোবাসি, অথচ এই কথা বলায়ও অনেক সময় ক্লান্তি এসে যায়, বিশেষ করে শুধু দু জনে হলে, পালা করে কারো না কারো কথা বলতেই হয়, সেক্ষেত্রে মেয়েবন্ধু অনেক ভালো, কিছু না বললেও চলে, শুনে যাওয়ার সময়ও পাওয়া যায় না মাঝে মাঝে, বিতর্কে যেতে হয় না, বা যাওয়া বিপদজনক, সবকিছুতে সায় দিয়ে গেলেই হান্ড্রেড পার্সেন্ট! হেইনের সঙ্গে এখন আর কথা বলতে ইচ্ছে হয় না, একটু বিরতি নেই, চুপচাপ সিগারেট টানি, চেয়ারে বসি অলস ভঙ্গিতে। হেইনের সঙ্গে কথা বলার মজা হচ্ছে, প্রকৃতই একজন ভালো সাইকোলোজিস্ট সে, মনের কথা আঁচ করতে পারে, চুপচাপ বসে ছাদের কারুকাজ দেখে, কার্পেটের নক্সা দেখে। ওর বিষয়টা অনেক ভেবেও বের করতে পারি নি। ও বলে, সব সময় এক অদৃশ্য গোয়েন্দা সংস্থা পেছনে লেগে আছে ওর। কেন? জানতে চাইলে বলে সময় নিয়ে বলবে, সেই সময়টাও গত তিন বছরে আসে নি, আমার ধারণা কখনোই আসবে না। যথেষ্ট সুপুরুষ সে, আমার চেয়েও দু ইঞ্চি লম্বা, প্রায় সোয়া ছ’ফুট, একহারা গড়ন, না বললে বুঝতামই না যে আমার চেয়ে বয়সে বড় সে। সুন্দর চেহারা, স্মার্ট, ভালো চাকরি করে, মেয়েদের চাওয়ার সবই রয়েছে ওর আয়ত্বে, অথচ এক রহস্যময় জীবন যাপন করছে। কোন দেশি গোয়েন্দা সংস্থা ওকে ফলো করছে তাও বলে না, জার্মানির যদি হয় তাহলে সে ওদেশে যেতে ভয় পায় কেন, আর এদেশি হলে তো এতো কিছু করার দরকার নেই ওদের, অবাঞ্চিত ঘোষণা করে দেশ থেকে বের করে দিতে পারে যে-কোনো সময়। তাছাড়া, অন্য কিছুতেই বাধা দিচ্ছে না ওরা, শুধু ওর মেয়েমানুষগুলোকে সরিয়ে নিচ্ছে ওর কাছ থেকে!
টয়লেট থেকে ঘুরে এসে জিজ্ঞেস করে –
ঘুমোবে? বলি –
আরো কিছুক্ষণ বসি?
ঠিক আছে, আমার বকবক শোনো তাহলে।
বিলেতে প্রথম আসি অক্সফোর্ডে নয়, এই এবার্ডিনে। ঐ সময়টায় এমন এক আচ্ছন্নতার ভেতর ছিলাম, মনে হয় না বাস্তবে এসেছিলাম, একটা স্বপ্নের ঘোরের ভেতর কেটে গেছে কিছুদিন, প্রকৃতই একটা স্বপ্ন দেখতাম যে তুষারের মধ্যে পাহাড়ে চড়ছি, বারবার পা পিছলে যাওয়ার আতঙ্কের মধ্য দিয়ে উপরের দিকটা মনে হতো দুরতিক্রম্য, আর নিচে তাকালে আত্মা শুকিয়ে যেতো ভয়ে, কৈশোরকালের যে-সব স্বপ্নে সঙ্গিনী থাকে না, মনে থাকে না সেগুলো, ঐ সব স্বপ্নের ভেতর সে থাকতো ওর সোনালি চুল ও নীল চোখ নিয়ে, আধফোটা ক্যামেলিয়া কুঁড়ির মতো ওর কমনীয় শরীর নিয়ে, ও ভাবতো দারুণ সাহসী আমি, অথচ ভেতরে ভেতরে নিশ্চয় ভীতু ছিলাম। এবার্ডিনে কাটানো প্রথম শীত ঋতুতে এতো বেশি পুরোনো দিনের কথা মনে পড়েছে, অথচ সেসব পুরোনো দিনের ছিল না, সদ্য অতীতের, দু জনেই ভালোবাসতাম বাইরে কাটাতে, ঘরের ভেতর কখনো মন বসতো না, রকসাইক্লিং ভালো লাগতো আমাদের, বিশেষ করে ঢালু পথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে নেমে যাওয়ার মধ্যে আত্মহারা হওয়ার মতো আনন্দ পাওয়া যেতো। কোনো কোনো দিন সৈকতের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটা দিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে সমুদ্রের অসীম সৌন্দর্য দেখতাম মুগ্ধ চোখে, মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো কোনো একটা গান গেয়ে শোনাই ওকে, অথচ কোনো গানই শেখা ছিল না আমার, হয়তো একটা সুর ভাঁজতাম শুধু ড ধ্বনি দিয়ে, ডুডল ডুর মতো, ওতেই সে হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিতো, অনেক সময় আঙ্গুর খেতের ভেতর ঢুকে পড়তাম, একেবারে ভিন্ন একটা গন্ধ ভেসে বেড়াতো আঙ্গুর বাগানে, কখনো বলেছি ওকে –
পাকা আঙ্গুরের গন্ধ তোমার শরীরের গন্ধের মতো অনেকটা!
কিছুটা বিস্ময় মিশিয়ে নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছে –
টক টক?
না, মিষ্টি মিষ্টি।
হেসে জড়িয়ে ধরেছে, এক থোকা আঙ্গুরের মতো ওর বেগুনি ঠোঁটে যেনো কোনো ত্বক ছিল না। তুষারে জমে যাওয়া কিছু আঙ্গুর ওরা সংগ্রহ করতো বিশেষ ধরনের মদ বানানোর জন্য, আরেকটা মদ বানাতো আঙ্গুরের ত্বক থেকে, মাত্র কয়েক বোতল মদ তৈরি করা যেতো গোটা বাগান থেকে, খুব দামি ঐ মদ।
পৃথিবীর সব চেয়ে দামি মদ ভগবান জমিয়ে রেখেছেন এইখানে – ওর ঠোঁটে আঙ্গুল ছুঁইয়ে বলেছি।
শেষ করে ফেলছো তো সব!
কখনোই না, অফুরন্ত এটা।
এখন বুঝি, কী এক প্রহসন ছিল ওটা, ঐ বাগানের আঙ্গুর শেষ হওয়ার আগেই ফুরিয়ে গেছে ওটা!
মেয়েদের, না নীৎসে নিয়ে কথা বলছি, ড. হেই-হেই!
হেইনে!
ঠিক আছে, হেইনে।
সুনির্দিষ্ট কিছু তো নেই, কোনো এজেন্ডা অনুসরণ করে কথা বলছি না, ভালো লাগছে তোমার সঙ্গে কথা বলতে, উপভোগ করছি এটা ডাউ।
আমিও উপভোগ করছি। রাত অনেক হয়েছে হেইনে, বলবে কি, যা বলতে এসেছো?
নিশ্চয়।
তোমার গোয়েন্দা সংস্থার বিষয়টার মতো?
চুপ করে থাকে হেইনে। মাথা কিছুটা ঝিমঝিম করছে। একটা সিগারেট এগিয়ে দেয় হেইনে। একটা পরীক্ষা হয়ে যাক, এক পর্তুগীজ বন্ধু, ওস্তাদ ড্রিঙ্কার, একটা কায়দা শিখিয়েছিল, স্টেপ বাই স্টেপ সেটা ফলো করতে হয় নিজের বশ্যতা পরীক্ষা করার জন্য।
যদি সন্দেহ হয়, বেশি পান করে ফেলেছো, তাহলে সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটারের জন্য পকেটে হাত দেবে, যদি ঠিকঠাক মতো পেয়ে যাও, ঠিক আছে, না পেলে দেখো দুটোই একসঙ্গে বের করতে পারছো কিনা, না পারলে, থামো, আর পান করো না, কথা বলা চালিয়ে যাও, খোঁয়ারি কেটে যাবে। কিছুক্ষণ পর সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার টেবিলের উপর রাখো, দেখো হাত কাঁপে কিনা, কাঁপলে থামো, কিছুটা সময় নাও, এবার সিগারেটের প্যাকেটের উপর লাইটার রাখো, নামিয়ে একবার বামে, আবার উপরে, এরপর ডানে রাখো, হাত না কাঁপলে লাইটারের উপর প্যাকেটটা বসাও, না পারলে থামো, আর এক ঢোকও না। সিগারেট ধরানোর আগে ঠোঁট থেকে ফিরিয়ে আনো ওটা, দেখো ফিল্টারের দিকটাই ঠোঁটে নিয়েছো কিনা। ভুল হলে থামো আবার, সময় নাও।
বাইরে বেরোনোর জন্য ঠিক আছো কিনা বোঝার জন্য একবার টয়লেট থেকে ঘুরে আসতে হবে। তার আগে দেখে নাও গ্লাসের উপর দিয়ে ওপাশের ছাইদানে ঠিকমতো সিগারেটের ছাই ঝারতে পারছো কিনা, এটা করতে যেয়ে অনেকে গ্লাস উল্টে দেয়, সাবধানে থেকো, যদি পারো ঠিকভাবে, চেয়ার থেকে ওঠার আগে একটু ভাবো, উরু দিয়ে ধাক্কা দিয়ে টেবিলের গ্লাস উল্টে দেয় অনেকে, নয়তো পেছনের চেয়ারটা ফেলে দেয়। ওঠার আগে সামান্য উঁচু হয়ে দেখো ঠিক আছো কিনা, তারপর চেয়ারটা সামান্য পেছনে ঠেলে দাও, ফেলে দিও না। পিছিয়ে আসো কিছুটা, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াও, টেবিলের কোনা ছাড়বে না, দাঁড়াতে অসুবিধা না হলে, মাথায় চক্কর না দিলে পোশাক ঠিক করার ভান করে মিনিটখানেক দাঁড়াও, চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে টেবিলের অন্যান্যদের সঙ্গে এক দু মিনিট কথা বলো, যদি বুঝতে পারো ঠিক আছো, এক দু’টা পা ফেলে দেখো পদক্ষেপগুলো ঠিক আছে কিনা, না থাকলে ফিরে আসো, হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে ভান করে হাসির কোনো কথা বলো, যখন বুঝতে পারবে না টলে টয়লেট পর্যন্ত যেতে পারবে, এগিয়ে যাও, দরজা বন্ধ করার কথা ভুলবে না, অনেকেই ভুলে যায়, কিছুটা সময় নাও এখানে, প্রথমেই জিপার ধরে টানাটানি শুরু করবে না, আহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, ভুল করে ও কাজটা বেসিনে শুরু করো না, এটা একটা সাধারণ ভুল। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেকেই চোখ টেপো, একটু আড়মোড়া ভাঙতে পারো, সত্যিই যদি বেশি নিয়ে থাকো, গলায় আঙ্গুল দিয়ে বেসিনে বের করে দাও, তার আগে বেসিনের দুটো কলই সাবধানে খুলে দেবে, পুরো খুলবে না, শরীরে যেনো পানি না ছিটায়, গলায় শব্দ করবে না, চশমা খুলে রাখো, খুব ভালোভাবে মুখ ধোয়ার পর বেসিন পরিষ্কার করো, এয়ার ফ্রেশনার ছড়িয়ে দাও, এরপর কমোডে যেতে পারো, জিপার টানতে ভুলো না, বেরোনোর আগে অবশ্যই দেখে নাও নেক্সট ইউজারের জন্য টয়লেট প্রপার্লি ক্লিন করেছো কিনা। সাবধানে এসে চেয়ারে বসো।
যদি সত্যিই বেশি পান করে থাকো, তাহলে টয়লেটে যাওয়ার আগেই তোমার বন্ধুকে অনুরোধ জানাও একটা লেমনেড উইথ স্ট্রং লাইম এনে দেয়ার জন্য, পান করে অপেক্ষা করো আগের স্টেপগুলো নেয়ার উপযোগী হওয়ার জন্য। যদি ঠিকঠাক মতো হয়, বিল দিয়ে দিতে পারো, অবশ্যই কার্ডে দেবে, বিল নিতে ভুলবে না। বেরোনোর সময় সিঁড়ির প্রতিটা ধাপ ভালোভাবে লক্ষ করবে, যদি দরোজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারো ঠিকভাবে, ঘরে ফিরে যাও। না পারলে, কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করো, কথা বলো, ডেফিনিটলি ঘোর কেটে যাবে।
সিগারেটটা ধরিয়ে দিতে গেলে লাইটারটা নিয়ে নেই ওর হাত থেকে, সিগারেটটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে দেখি কোন দিকটা ঠোঁটে গুজেছি। লাইটার ও সিগারেট প্যাকেটের গেইমটা খেলতে যেয়ে লাইটারের উপর প্যাকেটটা বসাতে পারি না। ও হেসে বলে –
এটা তোমার দোষ না, লাইটারের শরীরটা উপরের দিকে কিছুটা বাঁকানো।
কিছুটা অবাক হয়ে বলি –
তুমিও জানো ট্রিকটা?
ইউরোপের সবাই জানে।
তা তো জানতাম না।
তুমি বোধ হয় বেরোতে চাচ্ছো। যাও, টয়লেটে যাও, তুমি ঠিক আছো, ভাবতে হবে না।
সত্যি সত্যি ঘুরে আসি টয়লেট থেকে, কোনো অসাধন না ঘটিয়েই। বিলে সই করে বাইরে বেরোনোর জন্য হাত দেখায় হেইনে, বাইরে এসে মনে হয় বাতাসও জমাট বাধা, রক্তের ভেতর এতোটা এলকোহোল, তারপরও সহ্য করা কঠিন, তাড়াতাড়ি টুপি ও হাত-মোজা পড়ে নেই। ওকে বলি –
অনেক হয়েছে হেইনে, সবকিছুর জন্য অনেক ধন্যবাদ, তোমার রুমে যাও এবার।
কী যে বলো, তোমাকে না পৌঁছে দিয়ে ফিরি কীভাবে?
তাহলে যে তোমাকে পৌঁছে দিতে আবার ফিরে আসতে হবে আমাকে।
না, হবে না।
বুঝতে পারি, ওর কাছে হার মানতে হবে, তুষার জমে কোথাও কোথাও এতো পিচ্ছিল হয়ে আছে যে ভয়ে ভয়ে রাস্তা পেরোই। ঘরের দোরগোড়ায় এসে বলি –
বিদায় হেইনে, শুভরাত্রি।
শুভরাত্রি ডাউ, দেখা হবে।
ঘরে এসে দ্রুত কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়াই। পর্দা সরিয়ে কিছুটা অবাক হই, রাস্তাটা ক্রস করে সমুদ্রের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে হেইনে, হাড়-কাঁপানো এই শীতের রাতে সমুদ্রের কোনো সৌন্দর্য আছে কিনা জানি না, সত্যিই উদভ্রান্ত মনে হয় ওকে, ভালো এক রহস্য! গায়ে ওভারকোট চাপিয়ে নিচে নেমে দরজা খুলে ভুত দেখার মতো চমকে উঠি!
হেইনে! কোনো সমস্যা?
মোটেও না।
তাহলে?
জানালার পর্দা সরিয়ে অবাক হবে তুমি, এটা জানতাম।
শুধু একথাটা বলার জন্যই এসেছো?
সত্যিই তাই।
পাগল?
শুভরাত্রি আবার।
শুভরাত্রি।
গটগটিয়ে হাঁটা দেয় উল্টো দিকে, একবারও পেছনে ফিরে না তাকিয়ে হোটেলের চৌকাঠ পেরিয়ে যায়। উপরে উঠে বিছানায় ছুঁড়ে দেই নিজেকে। নরকে যাক, দুনিয়ার যতো পাগল!
রাতে বেশ ভালো ঘুম হয়, মদ্যপান কিছুটা বেশি হলে যা হয়, দুঃস্বপ্ন দেখা, তা হয় নি। প্রথম ঘুম ভাঙ্গার পর কম করে হলেও ডজনখানেক ছোটো ঘুম দিয়ে যখন দেখি শরীরে কুলোয় না আর, উঠে পড়ি। বড় একটা ব্রেকফাস্ট নেই লাঞ্চের সঙ্গে যোগ করে, ক্যারিবিয়ান কালো কফির সঙ্গে আধপেগ ব্র্যান্ডি মিশিয়ে ডাবল-সুগার দিয়ে এক মগ কফি পান করে শরীরটাকে ঝরঝরে করে নেই। হেইনের হোটেলে না গেলে সেই এসে হাজির হবে ভেবে প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। দরোজা খুলেই অবাক আরো একবার!
সামনে দাঁড়িয়ে হেইনে।
রাতে ঘরে ফিরো নি হেইনে?
সে তো তুমিই দেখেছো ওখানে দাঁড়িয়ে।
তুমি তো কেবল মনস্তত্ত্ববিদই নও, অতিরিক্ত আরো অনেক কিছু!
সামান্য এক বৈদ্য আমি ডাউ, দয়া করে ভুল বুঝো না।
তুমি কি সত্যিই ডাক্তারি পাশ করেছো হেইনে? চিকিৎসাশাস্ত্রের ঐ ডিগ্রি আসলেই কি দেয়া হয়েছিল তোমাকে?
ওটা তো আমার নিয়োগকর্তাদের বলেছি। আমার সব রেকর্ড জার্মানিতে ধ্বংস করে ফেলেছে ওরা। তোমাকে দেখাবো কীভাবে, প্রয়োজনই বা কি?
ওটা তো একটা চাকরি পাওয়ার জন্য ব্যাখ্যা দিয়েছিলে তোমার নিয়োগকর্তাদের, আমি জিজ্ঞেস করছি তোমার বন্ধু হিসেবে।
যারা চাকরির সাক্ষাৎকার নিয়েছিল ওদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে আটকায় নি আমার, বরং কায়দা করে দু একটা প্রশ্ন করে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিলাম ওদের, আমার কাছ থেকে ওসবের ব্যাখ্যা শুনে অভিভূত হয়ে পড়ে ওরা, আমার চেহারা দেখে চাকরি দেয় নি নিশ্চয়। তাহলে তো কারখানার শ্রমিকের চাকরিতে যেতে হতো আমাকে।
তোমাকে বোঝা আমার জন্য একটু কষ্টকর হেইনে।
না ডাউ, আমি জানি এদেশে একমাত্র তুমিই কিছুটা বুঝতে পারো আমাকে। তোমার মনের সন্দেহ দূর করার স্বপক্ষে এটুকু বলতে পারি, ইংরেজদের মতো একটা রক্ষণশীল জাতি আমার মতো এক জার্মানকে, যাদের ওরা এক চোখেও দেখতে পারে না, ড. লিস্টেনবর্গ বলে সম্বোধন করে, এবং আমার যোগ্যতাকে স্বীকার করে নিয়েছে, সেক্ষেত্রে তুমি ইচ্ছা করলে দুর্ভাবনা না করলেও পারো, ইংল্যান্ডের মধ্যে তুমি, হ্যাঁ, একমাত্র তুমিই আমাকে হেইনে, ড. হেইহেই নামে ডাকতে পারো, আর কাউকে শুনেছো ওনামে ডাকতে?
না তো হেইনে, শুনি নি। আমি দুঃখিত, তোমার মনে যদি কষ্ট দিয়ে থাকি, তাহলে সত্যিই দুঃখিত।
কোনো অসুবিধা নেই, আমি বুঝতে পারি তোমাকে।
জানি হেইনে, আমিও চেষ্টা করবো তোমাকে বুঝতে।
আমরা কি সমুদ্রের আরো একটু কাছে যাবো?
শীতের সমুদ্র খুব বেশি আনন্দ দেয় না আমাকে, তুমি যদি যেতে চাও, যেতে পারি।
তাহলে চলো একটু হাঁটি, ওদিকটায় একটা লোকালয়ের মতো আছে, হারবার আছে, সীফুড রেস্টুরেন্ট আছে বেশ ক’টা, তাজা মাছ খাওয়া যাবে, ওখান থেকে সমুদ্রটাকে ভালো লাগতেও পারে তোমার।
বেশ ঝলমলে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকি, দোতলায় উঠে যাই, ডানে সমুদ্র রেখে বসি, মনে হয় সমুদ্রে মাছের জো এসেছে, এক ঝাঁক মাছ ধরার নৌকো সারি বেধে গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়, কিছুক্ষণ পর একটা মাদার ভেসেল পোতাশ্রয় ছেড়ে যায়, সমুদ্রে থাকবে ওটা কয়েক হপ্তা, মাছ ধরার নৌকোগুলো মাছ ধরে ওটায় খালাস করবে। ফ্রিজিং, প্রসেসিং, প্যাকেজিং প্ল্যান্ট সবই আছে ওটার ভেতর। ওটা বোঝাই হয়ে গেলে সরাসরি ফ্রিজিং ভ্যানে ট্রান্সফার করবে, তারপর সেইলস সেন্টারে। সব ব্যবস্থাই স্বয়ংসম্পূর্ণ।
বিলেতের সীফুড আইটেমগুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা হয় নি এখনো, দু একটা গ্রীল চেখে দেখেছি, সস দিয়ে চালিয়ে দেয়া যায়, মেনু দেখি মন দিয়ে, বুঝতে না পেরে ছেড়ে দেই হেইনের হাতে, খাবার-দাবারের দিক থেকে আমার অন্য প্রান্তে হেইনে, যে-কোনো কিছু মুখে দিয়েই বলে ওয়াও, অথচ আমার জিভ গ্রহণ না করলে কোনো খাবার পেট পর্যন্ত খুশি মনে পৌঁছে দিতে পারি না।
অক্টোপাস ও স্কুইডের একটা সালাদ নেয় শুরুতে, সীউইড মিশিয়ে পরিবেশন করেছে, উপরে ওয়েস্টার সস ছড়ানো, সঙ্গে আরো কয়েকটা ছোটো ছোটো বোতল, বিভিন্ন স্বাদের সস। ওসব মিশিয়ে অক্টোপাসের একটা টুকরো চিবিয়ে গেলা যায়, কিন্তু স্কুইডটাকে কায়দা করতে পারি না, মুখ থেকে বের করে টিস্যু জড়িয়ে প্লেইটের কোনায় রেখে দেই, সীউইডগুলো ভালোই লাগে। বুঝতে পারে হেইনে, ফ্রায়েড প্ল্যাইসের অর্ডার দেয় দুটো, টেবিলে আসতেই মজার গন্ধ, আমাদের পমফ্রেটের চেয়েও বেশি সুস্বাদু। সমুদ্রের তলায় বালু ও নুড়ির সঙ্গে মিশে থাকে, ফ্ল্যাট-ফিশ গোত্রের মাছ, রূপচাঁদা মাছের মতো একটা দিক চকচকে সাদা, অন্য দিকটা বিচিত্র রঙের, বালুকণা ও লাল নুড়ির সঙ্গে এটার পার্থক্য ধরা যায় না, শত্র“-মাছের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রাকৃতিক কৌশল। হেইনের মনে হয় স্কুইড খাওয়ার ইচ্ছে, উঠে যেয়ে কাউন্টারে বলে আসে এক প্লেইট ওয়েল-ডান স্কুইড পাঠাতে। এক ইঞ্চি পুরু একটা পাউরুটি টোস্ট এতো মজা করে ভেজেছে কীভাবে বুঝতে পারি না, ভেতরটা নরোম, বাইরে মুচমুচে, ফ্লেভারটা ধরতে পারি না। একটু পড়ে গার্লিক সস দিয়ে রান্না করা অক্টোপাস ও স্কুইড নিয়ে আসে টেবিলে, স্কুইডটা সত্যিই মজা হয়েছে এবার। অক্টোপাস, যথারীতি ভালো লাগে নি। এর থেকে বরং কক্সবাজারের রাখ্যাইনদের রান্না করা অক্টোপাস অথবা স্কুইডের স্বাদ অনেক ভালো। রে ফিস ফিন গ্রীল করে নিয়ে আসে দুটো, শালুকপাতা বা গোলমাছের মতো স্বাদ অনেকটা। কাঁটাগুলোও ওরকম মুচমুচে, ট্যাবাস্কো সসের সঙ্গে ভালোই লাগে। স্কটল্যান্ডের সমুদ্র তীরে বসে স্কচ না নেয়া তো ওদের প্রতি অবিচার, কাল রাতের কথা ভেবে ওটা বাদ দেই। হেইনে বলে, তা কেনো, দু হপ্তা নাহয় ড্রাই উইকস পালন করো। ঠিক আছে। স্কচ না নিয়ে লোকাল বিয়ার নেই? তাই সই। সবশেষে এলো আমাদের চ্যালা মাছের মতো দেখতে, একটু বড় হয়তো, সার্ডিন ফিসের বাচ্চা, ক্রিসপি ফ্রাই, দারুণ! যার শেষ ভালো তার সব ভালো, আমার মাথা দোলানো দেখে হেইনে বলে, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ‘লাস্ট আইটেম ফার্স্ট’ হলে ভালো হতো, তাই করো নাকি তোমরা? গলা ফাটিয়ে হেসে উঠতে যেয়ে আবার থেমে যাই। হেইনে বলে, হাসো, হাসো, কেউ কিছু মনে করবে না এখানে, সবাই সি-ম্যান, নট এ-ম্যান! আটকে রাখা হাসিটা ছেড়ে দেই। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বলে হেইনে –
চলো হাঁটি। মন্দ লাগছে না, জড়তা কেটে যাচ্ছে।
প্রকৃতিই অভিজ্ঞ করে তোলে মানুষকে, পোতাশ্রয়ে পৌঁছেই অন্য আবহাওয়ায় এসে পড়ি, অনেক শান্ত সমুদ্র, ছোটো ছোটো ঢেউ, অনেক বেশি উষ্ণ, তুমুল মাতাল বাতাস নেই, ঝাঁকে ঝাঁকে সীগাল উড়ে বেড়ায় অবাধে, মাছের আঁষটে গন্ধ, পোতাশ্রয় জুড়ে শত শত মাছ-ধরা নৌকো, উদ্ধারকারী জাহাজ, তেল মোবিলের গন্ধ, সমুদ্রের জেলে পাড়ার একেবারে ভিন্ন পরিবেশ, মানুষগুলোও মনে হয় বিশালদেহী। ওপাশের পাহাড়ের গায়ে তিন চারতলা বাড়িগুলোর সবগুলোই পাহাড়ের মতো ঢালু, বাড়ির প্রতিটা তলা পাহাড়ের গায়ে পিছিয়ে যাওয়ায় প্রত্যেকটার সামনে রয়েছে সুন্দর ঝুল-বারান্দা, ওগুলোর সামনে বর্ণিল টবে বিচিত্র রঙের ফুল ফুটে আছে। বাড়িগুলোর বেশির ভাগই হোটেল। মাছ-ধরার বিরতিতে, অথবা সমুদ্র অশান্ত থাকলে এখানেই কাটিয়ে দেয় জেলেরা। প্রমোদ যাপনেরও ব্যবস্থা আছে অনেক, পাব, ক্যাসিনো, কন্যা সবই আছে। পোতাশ্রয়ের কাছাকাছি ব্যাংক, পোস্ট অফিস প্রভৃতিও রয়েছে। যে-কোনো পর্যটকও সমুদ্রের স্বাদ পেতে কয়েকদিন কাটিয়ে যেতে পারে এখানে।
প্রায় মাইলখানেক লম্বা সেতুর মতো একটা রাস্তা পোতাশ্রয় থেকে সমুদ্রের ভেতর ঢুকে গেছে, শত শত খুঁটির উপর বসানো কঙ্ক্রিটের এই রাস্তাটা কেন বানানো হয়েছে বুঝতে পারি না, হেঁটে সমুদ্রের ভেতর ঢুকে পড়ি, ধারণা ছিল শেষ প্রান্তে হয়তো জেটির মতো কিছু আছে যেখানে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে। হেইনেকে জিজ্ঞেস করি। ও বলে –
কোনো কারণ নেই, স্রেফ তোমার আমার হাঁটার জন্য।
কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে এজন্য, ভালোই বলেছো।
ক্লান্ত হয়ে সীগালেরা যখন কূল পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে না তখন যেনো এখানে বিশ্রাম নিতে পারে, সে-জন্য আসলে।
কাল রাতে যে ব্র্যান্ডি নিয়েছিলে, ওগুলো বোধ হয় ঢোক গেলো নি হেইনে, কণ্ঠে জমা রেখেছিলে, এখন গিলছো।
সেই ব্র্যান্ড হাসি!
জিজ্ঞেস করি –
শব্দ করে হাসতে পারো না হেইনে? সীগালেরা শুনুক অন্তত।
নিশ্চয় হাসবো একদিন ডাউ, সীগালদের জন্য নয়, কারো জন্যই নয়, শুধু তোমার জন্য।
হায়! ড. হেইনের ঐ হাসি আর শোনা হয় নি এ জীবনে। রহস্যই রয়ে গেছে সে!