অন্য আলো
কামাল রাহমান
৬
মনে মনে ভেবেছি তাড়াতাড়ি বিছানায় শুতে যাবো আজ, রাতে ঘুম হবে কিনা ভাবছি, গত কয়েকটা রাত ভালো ঘুম হয় নি। গত হপ্তায় আয়ারল্যান্ডে গেছে কেরোল, ওর মায়ের অসুখ, উচিত ছিল আমারও সঙ্গে যাওয়া, ছুটি নেয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম, কেরোল বললো, দরকার নেই। সন্ধ্যার পর এখন অখণ্ড অবসর, এতো অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি ওর সঙ্গে, এখন একা একা লাগে। সন্ধ্যার পর হোয়াইট রাম নিয়ে টেলিভিশন দেখতে বসি, বই পড়তে ইচ্ছে হয় না, রান্না করতেও ইচ্ছে হয় না, ড্রিঙ্কসের সঙ্গে টুকটাক যা খাই ওতেই হয়ে যায়। সন্ধ্যা সাতটার দিকে দরোজায় টোকা শুনে একটু অবাক হই। খুলে দেখি, আবীর।
আরে তুই?
হ্যাঁ, কেমন আছিস?
ভালো, কোনো খবর, বা সমস্যা?
না না, আগে জানাতে পারি নি যে আসবো। এমনি চলে এলাম, মনটা একটু উতাল।
কেন রে?
না, তেমন কিছু না।
ভালোই করেছিস এসে, চল একটু হোক।
না, বাসায় ফিরে যেতে হবে।
থেকে যা না রাতটা, মজা হবে অনেকদিন পর।
তার চেয়ে বরং আমার ওখানে চল, রাতে থেকে আসবি।
আমি তো কিছুটা নিয়ে ফেলেছি, মুখে গন্ধ নিয়ে তোদের ওখানে যাবো?
যাবি কিনা বল, গেলে আমারও একটা কাজ হয়।
কাজটা কি হয়, বরং ওটাই আগে বল।
আর বলিস না, দেশ থেকে আমার এক কাজিন আমদানি করেছে বাবা। এখন বলে ওটার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে।
হায় আল্লা, তোরও সেই কাজিনের ফের?
সিলেটিদের এটা খুব কমন। তোরটা হয়তো একটু অন্য রকম ছিল। কাজিন থাকলে সিলেটিরা অন্য কোথাও যায় না।
কি করবি এখন?
বাবাকে একটু বোঝাতে পারবি? সময় বদলে গেছে, বিয়ের জন্য মনের মিলটা এখন গুরুত্বপূর্ণ, মনোজগত যদি ভিন্ন স্তরের হয় সঙ্গতি হবে কীভাবে?
কথা বলে দেখেছিস তুই?
সম্ভব না।
চল যাই তাহলে। মুখের গন্ধটার কি করবো?
রান্না করা মুরগির মাংস আছে ঘরে?
আছে।
ভালো করে দাঁত মেজে ভিনেগার দিয়ে কুলি করে দু টুকরো মুরগির মাংস খেয়ে নে, পানি খাবি না।
ভালো বুদ্ধি তো, কাজ হয়?
চেষ্টা করে দেখ।
ঘর থেকে বোঝা যায় নি বাইরে তুষারপাত শুরু হয়েছে। দরজা খুলতেই ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে কিছু তুষারকণা। আবীরের গাড়িটা তুষারে ঢেকে সাদা হয়ে পড়েছে এই অল্প একটু সময়ের মধ্যে। গাড়ির ভেতরটা জমে বরফ হয়ে আছে, গাড়ির বাইরে এতো ঠাণ্ডা লাগে নি, হিটার চালিয়ে ভেতরটা গরম করতে পাঁচ সাত মিনিট লেগে যায়। অক্টোবরের শেষে তুষার ঝরতে শুরু করেছে এবার, শীতটা বেশ জাঁকালো হবে বোঝা যায়। অক্সফোর্ডের যেদিকে আমি থাকি তার উল্টো দিকে আবীরদের বাসা। পুরো শহর পেরিয়ে সিটি সেন্টারের পাশ দিয়ে যেতে হবে, কালো রাস্তাটার এক দিকের ঢাল ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেছে, সামান্য বাঁক নিয়ে একটু একটু করে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে গাড়িটা। সড়কবাতির কমলা রঙের আলোয় রাস্তার ঐ অংশের তুষারগুলোকে মনে হয় অনেক উঁচু থেকে ঝরছে আর নেমে যাচ্ছে অনেক নিচে। ঢালের শেষ দিকে ঘন ঝোপ থাকায় সমানভাবে তুষার জমতে পারে নি ওখানে, অন্ধকারে ওজায়গাটা কালো সাদায় ছোপ দেয়া চিতা বাঘের মতো দেখায়। যে বাঁকটা ফেলে এসেছি, সেখান দিয়ে একটা গাড়ি অতিক্রম করায় ওটার আলো সার্চলাইটের মতো দূরের পাহাড়ের শরীর ছুঁয়ে যায়। ঝরা তুষারে একটা সাদা তুলির ক্ষণিক ছোঁয়া পাহাড়ের শরীর থেকে সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়, আবার প্রাচীন পৃথিবীর পবিত্র অন্ধকারের ভেতর ডুব দেয় রাতের ব্যথা-জাগানো প্রকৃতি।
আইসিস নদীর সেতু পেরিয়ে এগ্রৌভ পার্কের পাশ দিয়ে যখন এগোতে থাকে গাড়িটা, আবীরকে বলি সামান্য একটু সময়ের জন্য থামাতে। রাস্তার পাশের ফাঁকা জায়গায় পার্ক করে আলো নিভিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য বসতে বলি। ডানদিকের প্রকৃতি এখন রেমিংটনের আঁকা ছবির মতো, প্রায় পুরোটা কালো, স্ট্রিট লাইটের বাতি ঘিরে সাদা মুক্তোর মালার মতো পেঁচিয়ে থাকা শুভ্রতার একটা আঁকাবাঁকা আলোর সারি। শূন্যের নিচে নেমে আসা তাপমাত্রায় রাতের প্রকৃতি এতো ভাবগম্ভীর, কল্পনা করা কঠিন। তীব্র সুন্দর বলার সুযোগ নেই এটাকে, সবই তো কালোর ভেতর আরো কালো কিছু ছায়া, কোনো কিছুরই আকৃতি দাঁড় করানো যায় না, কল্পনায় নির্মাণ করতে হয় ঐ কালো জমাট বাধা অংশটা খাদ, ওটা গাছের সারি, ওটা গির্জার ডানের অংশ, কালো আকাশেও গির্জার চূড়া পৃথক করা যায়, স্কাইলাইন বোঝা যায়। গাড়ির ইঞ্জিনের সামান্য শব্দও প্রকৃতির এই নীরবতায় বিঘœ ঘটায়, ইঞ্জিন বন্ধ করে আর ক’মিনিট বসতে বলি, যেটুকু উষ্ণতা আছে ভেতরে, থাকা যাবে কিছু সময়। খুব ইচ্ছে হয় একটু হুইস্কি পান করি এখন, ধীরে ধীরে অন্ধকার সয়ে আসে চোখ, গাছপালা ও বাড়িঘরের আকৃতি বোঝা যায়, শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আলোর আভা এখন স্পষ্ট। পুরোনো পৃথিবী আবার জেগে ওঠার আগে আবীরকে বলি, চল যাই। গাড়ি চলা শুরু করলে ফিরে আসি আবার নিরেট বাস্তবতার ভেতর, যা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো পথ জানা নেই, এবং খুব যে আকাঙ্খিত এটা, তাও না। জীবন সুন্দর, পুনর্জন্মে প্রত্যাশী মানুষ, কিন্তু সত্যিই যদি এ জীবনে আবার ফিরে পাঠানোর ইচ্ছা বা ক্ষমতা ঈশ্বরের থাকতো, মনে হয় না মানুষ ফিরে আসতো, জানা হয়ে যাওয়ার পর জীবনের অবশিষ্ট থাকে কি আর, মৃত্যুতে তো পূর্ণতা এ জীবনের, তামাম শুদ!
সিটি সেন্টারে গাড়ি ঢুকতেই আবীর জিজ্ঞেস করে রাতের খাবার ওদের রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে যাবো কিনা। ভেবে দেখি, ভালোই হয়, ওখানেই ওর বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। ভেতরে ঢুকে একটু অবাক হই, এই বরফের ভেতর এতো কাস্টমার এলো কোথা থেকে। আমাকে দেখে এগিয়ে আসে আবীরের বাবা, খুশি হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেÑ কিতা বা, অতদিন বাদে, ইয়াল্লা, বুড়া মাইনষরে কিতা ইয়াদ অয় নানি বা। অয় খালুজান, অয়। বউক্যা বাবা, বউক্যা। আবীর বলে, আপনে গরো যাও গি আব্বা, আমি বন্দ করি আইরাম। হাছানি, তারে লইয়া আইবি ত? আইরাম। ইনো ভাতউত খাওয়াইছ না, গরো খাইমুনে একলগে। আইচ্ছা। বাপ-বেটার কথার মাঝখানে আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো বিষয় নেই, মিটিমিটি হাসি। এরা এতো আন্তরিক, আপন মানুষদের খুব বেশি আপন ভাবে, ফাঁক নেই কোনো।
ওর বাবা চলে যাওয়ায় পর কিছুক্ষণ রেস্টুরেন্ট সামলায় আবীর, একটা পার্টি বুকিং ছিল, এজন্য একটু ভিড় দেখা গেছে, ওরা চলে যাওয়ায় প্রায় ফাঁকা হয়ে যায় রেস্টুরেন্টটা, মনে হয় না গাড়ি থেকে তুষার সরিয়ে আর কোনো কাস্টমার আসবে আজ রাতে।
প্লেইন রাইসের সঙ্গে ল্যাম্ব-কারি ও ডাল-মাখানা দিয়ে ভাত খেতে বসে খুব ইচ্ছে হয় একটু ড্রিঙ্কস নেই। আবীরকে বলায় বলে, দেখি আব্বার সঙ্গে কথা বলে। চমকে ওঠি, মানে? রাতে যদি এখানে থাকা যায়। কাজের ছেলে আবীর, ব্যবস্থা করে ফেলে। যে হুইস্কিটা গাড়িতে বসে পান করতে চেয়েছিলাম, উপরওয়ালার কাছ থেকে ওটার অনুমোদন আসতে দু ঘণ্টা লেগে যায়, আমার উপরওয়ালা বোধ হয় একটু বেশি উপরে থাকেন! রাতের এই পরিবেশটা বেশ ভালো লাগে, কাস্টমার নেই, ফাঁকা একটা জায়গায় বসে প্রাণ-ভরে জীবনের মধু পান করি। কখনো কখনো এতো সুন্দর হয়ে ধরা দেয় জীবন! চাইতে হয় না, আর চাইলে বোধ হয় কখনোই পাওয়া যায় না।
রেস্টুরেন্টের লোফ্ট কনভার্ট করে স্টাফদের থাকার জায়গা বাড়ানো হয়েছে। কুক মবিন ভাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করে আবীর যে ডে-অফে কেউ বাইরে গেছে কিনা। গেছইন তিনজন, থাকতায় না কিতা? দুইজনর লাগি একটা রুম খালি করতায় পারবায় নি। আমার রুমো এক সিট আর নজিরর রুমো এক সিট খালি আছে, নজিররে কউখ্যা আইজ রাইত আমার রুমোত আইতো। তুমিই কও না কেনে মবিনবাই। আইচ্ছা, অইবো নে।
রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে সবাই খেতে বসে, অনেকখন চলে গল্পগুজব, স্টাফ কারির বাচা মাছ খাই আমি আর আবীর। দারুণ মজা। কায়দা করে আমার জন্য হুইস্কি নিয়ে আসে কয়েকবার, বেশ নেশা ধরেছে, কথা একটু বেশি বলা হয়ে যায়। রাত একটার দিকে সবাই উপরে উঠে যায়। আমার ইচ্ছে হয় না, আবীর বলে, ঠিক আছে থাক, উঠে যেয়ে লাইম মিশিয়ে এক পেগ জিন নিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করি, ওটা কেন রে? বলে, আমার জন্য এটাই নিরাপদ, হঠাৎ কেউ চলে এলে বুঝবে না, কোক ¯প্রাইট বা লেমনেড ভাববে, মুখেও গন্ধ হয় না। ভালো ভালো, চালিয়ে যা। আমি পছন্দ করি এজন্য আবীরের ছোট ভাইকে দিয়ে একবাটি হাঁসের মাংস পাঠিয়েছে ওর বাবা, সাতকড়া দিয়ে রান্না-করা মাংসটার স্বাদ অপূর্ব, হুইস্কির সঙ্গে খুব ভালো জমেছে ওটা। বেশ আনন্দের একটা রাত, অনেকদিন স্মৃতি হয়ে থাকার মতো একটা রাত, তুষারপাত বন্ধ হয়েছিল অনেকক্ষণ আগে, আবার হালকাভাবে ঝরা শুরু করেছে, আবীরকে বলি, তুই তো ড্রিঙ্ক নেয়া শুরু করেছিস, না হয় গাড়িটা নিয়ে আবার বেরোতাম। এটা কোনো বিষয় হলো, ক’টা টেক্সি চাই। আউয়ালকে ফোন করে আবীর, ও এখন আমারও ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে, স্টেইজকৌচের ড্রাইভার ছিল, চাকরি ছেড়ে এখন দামি ব্ল্যাকক্যাব চালায়। দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছাবে বলে আউয়াল, আসে পয়তাল্লিশ মিনিট পর। ইয়াল্লা, দাউদবাই নি, কিতা বুলি গেছনগই! না আউয়াল, ভুলি নি, আপনাকে কি ভোলা যায়, কেমন আছেন আপনি? আবীর বলে, চল বেরোই, আর এক পেগ নিবি দাউদ? ওরে বাবা, কি বলিস, গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারবো কিনা ভাবছি। আমার এক পেগ লাগবে, বলে আউয়াল। চমকে উঠি, ড্রিঙ্ক-ড্রাইভ করবেন কীভাবে আউয়াল? ভাববেন না, ওটা আমরা পারি, বাঙালি না! উঠে যেয়ে দুটো পাতা দিয়ে বানানো কড়া চায়ের একটা গ্লাস আউয়ালের সামনে এনে রাখে আবীর। এই নিন স্যার, আপনার ড্রিঙ্কস, ডাবল ব্র্যান্ডি। এক চুমুক দিয়ে বলে, দারুণ! ওর এই দারুণ চা খেতে আরো দশ মিনিট যায়। আবার তুষার ঝরতে শুরু করেছে। গাড়িতে উঠে জিজ্ঞেস করে আউয়ালÑ কোথায় যাবো এখন আমার সখের গোয়েন্দারা? বাহ্ ভালোই বলেছো তো আউয়াল! খুব অন্ধকার কোথাও যাওয়া যায়? যাবে না কেন, কি দেখতে চান, তুষারের অন্ধকার, না অন্ধকারের তুষার? ড্রাইভার না হয়ে কবি হওয়া উচিত ছিল তোমার। আমি তো কবিই দাউদ ভাই। তাই নাকি, শোনাও না একটা কবিতা। ঠিক আছে শুনুন: ভুল করে এসেছিনু সখা, ফিরে যাই ভুল পথে। বাহ্, তার পর? তার আর পর নেই দাউদ ভাই, আমার সব কবিতা এক লাইনের। বেশি লেখো না কেন? বেশি লেখলে বেশি দুঃখ লাগে। হো হো হো। তাছাড়া কবিতা লেখতে গেলে গাড়ি চালাবে কে? তুমি বুঝি খুব রবীন্দ্রভক্ত? একমাত্র ঐ কবিতাগুলোই কিছুটা বুঝি। বোঝো!
গাড়ি যেখানে এসে থামে সত্যিই অন্ধকার। আলো নিভিয়ে দেয়ায় ও ইঞ্জিন বন্ধ করায় মনে হয় অন্য এক জগতে চলে এসেছি। নামবো একটু? নিশ্চয়, কিন্তু হাঁটাহাঁটি করতে যাবেন না, একটু পড়েই ঢাল। আদিম যুগের অন্ধকার রাতে গুহামানবের মতো মনে হয় নিজেদের। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বুঝতে পারি অন্ধকারের তুষার বলে কি বোঝাতে চেয়েছে আউয়াল। তুষার ঢাকা সামনের দিকটা হালকা নীল, পাহাড়ের যে সব জায়গায় তুষার জমতে পারে নি সেগুলো কুচকুচে কালো, উপরের আকাশ কালচে নীল, কিছু অংশে ধূসর কালো, উত্তর গোলার্ধের শীতের রাতের এক অসাধারণ নিসর্গ! এখানে কেউ আসে আউয়াল? আসে সামারে, খুব সুন্দর দেখায় তখন, শীতে দু একজন পাগল আসলে আসতেও পারে, একটু পরে অন্য রকম কিছু দেখতে পাবেন, যাবো এখন? শীতে জমে যাচ্ছি। হ্যাঁ, চলো। পৃথিবীর এই ভীষণ কালো রাতের অপূর্ব অন্ধকার রূপ আজীবন মনে থাকবে আমার। গাড়িতে বসে কিছুক্ষণ গরম হয়ে নেই, গাড়িটা ঘুরিয়েই আবার উল্টোদিকে থামায় এক মিনিটের মধ্যে, কেন থামালো প্রথমে বুঝতে পারি নি। নামেন দাউদ ভাই। নেমে দেখি নিচে বাঁদিকে আলো ঝলমল অক্সফোর্ড নগরী! শহরটাকে এতো সুন্দর দেখায় এখান থেকে! ওকে বলি, তুমি সত্যিই কবি আউয়াল। এ দুটো স্পট থেকে ছবি তোলে অক্সফোর্ড নগরের, ভিউকার্ড বানায় ওরা, বলে সে। সত্যিই অসাধারণ, আউয়াল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। জীবনে ভোলার নয় এ দৃশ্য। পৃথিবীটাকে অনেক সুন্দর করে তোলার চেষ্টাও করে মানুষেরা। কিছু মানুষেরা যেমন ধ্বংস করে প্রাচীন জনপদ, নগর সভ্যতা, প্রতিমা, চিত্রশালা, গ্রন্থাগার, তেমনি অনেক মানুষেরা আবার গড়েও তোলে। চলো ফিরে যাই। চলেন।
গাড়িতে উঠে কথা বলি আউয়ালের সঙ্গে। এখানে কেমন লাগে তোমার, আউয়াল, কেমন আছো? সত্যি বলবো? ভালো লাগে না দাউদ ভাই, কেন জানি ঠিক ফিট হতে পারছি না। ফকির আলমগীরের গান আছে না একটা, আমি অধম রিক্সা চালাই ডাহা শহরে, আমারও তাই মনে হয়, মাঝে মাঝে…, বেশির ভাগ উইকেন্ডে টেক্সি চালাই অক্সফোর্ডে, প্রায় প্রতি হপ্তায় ট্রিপ নিয়ে যাই লন্ডন শহরে। কেন এমন হয় বল তো, এদেশে আছো অনেক অল্প বয়স থেকে, বাংলাদেশের জন্য তো কোনো পিছুটান নেই তোমার, কোনো স্মৃতি নেই। হ্যাঁ, জন্মের পর থেকেই আছি, কিন্তু দেশটাকে আপন করতে পারছি না কেন আমিও ভাবি, পড়াশোনা করানোর জন্য বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেছেন। হলো না তো ভাই, আব্বার রেস্টুরেন্টে কাজ করলাম অনেক দিন, তাও মন বসে না, এই টেক্সিটা তবু কিছুটা স্বাধীন মনে হয়, মনে হলে চালাই, না হলে না। হ্যাঁ, তা করতে পারো তুমি, টাকা পয়সার খুব একটা প্রয়োজন তো নেই। না দাউদ ভাই, টাকার প্রয়োজন সবারই আছে, আমারটাকে সীমিত রাখি। ওটাই বুদ্ধিমানের কাজ আউয়াল। কি জানি ভাই, ভালো লাগে না আমার, আম্মাও আজকাল দেশে কাটান মাসের পর মাস। আমিও যেয়ে থাকি মাঝে মাঝে, ওখানেও মানাতে পারি না, ওখানের মানুষগুলো স্বার্থ ছাড়া যেনো কিছুই বোঝে না আর। সবাই না আউয়াল। হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তো তাই মনে হয়। হয়তো আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কাটাও বেশি সময়, ওরা একটু স্বার্থপরই হয় আমাদের সমাজে। কিছু ভালো বন্ধু জোগাড় করে নিলে পারো, তাহলে দেখবে দেশেও ভালো সময় কাটাতে পারবে। ভালো বন্ধু পাওয়া তো খুব কঠিন দাউদ ভাই, আর এক জীবনে একজনের বেশি ভালো বন্ধু পাওয়ার প্রয়োজন নেই। ওটাই জোটে না অনেকের ভাগ্যে। হ্যাঁ, তাই।
রেস্টুরেন্টে ফিরে আসি যখন পা টলছে তখনো, অতিরিক্ত এলকোহোল নেয়া হয়ে গেছে, উপরে উঠে শুয়ে পড়ি। আউয়ালের বিষয়টা মনের ভেতর খচখচ করে। সারা জীবন সাধনা করে বাবা আমাকে বিলেত পাঠিয়েছে পড়াশোনা করতে, বাবার ধারণা স্বর্গ পেয়ে গেছি। সত্যি বলতে কি খুব অসুখে নেই, আমার চাহিদা তো মেটাতে পারছি অন্তত, দেশের আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজনদেরও খুশি করতে পারছি, আর কি চাই? অথচ পড়াশোনা থেকে শুরু করে ভালো পেশা গ্রহণ, বিত্ত প্রতিপত্তি অর্জন, সব কিছুর সুযোগ ছিল আউয়ালের আয়ত্বে, কিছুই ভালো লাগে নি কেন ওর? ব্যর্থতাটা কার?
আবীর বলে, এটা প্রজন্মের ব্যর্থতা, আমাদের ভেতর কোনো উচ্চাশা সৃষ্টি করতে পারি নি। আমাদের পূর্বসূরিরা কি আমাদেরকে কোনো স্বপ্ন দেখাতে পেরেছে? ওরা যে চেষ্টা করে নি, তা না, আউয়ালের কথা তো শুনেছিস, ওর বাবা-মা যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। তাহলে আমাদের সমস্যাটা কোথায়? আমার মনে হয় আমাদের সংকীর্ণ ধর্মপ্রধান সমাজে। এক কথায় বিষয়টা উড়িয়ে দিলি এভাবে? হ্যাঁ, কারণ ওটা আমাদের চোখ ফুটতে দেয় না। তোমার অন্তরের চোখ যদি না খোলে মানুষ হবে কীভাবে তুমি? তাহলে, জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর কোথায় কোথায় যাও, প্রভৃতি যে বলে! ওসব কথার কথা, ফাঁকা বুলি। ভারতবর্ষে কোন জ্ঞানটা নিয়ে গেছিল ওরা? ফতোয়া? তুমিই বা তাহলে জ্ঞানার্জনের জন্য ঐসব দেশে না যেয়ে বিলেত এসেছো কেন, যদি ওরা জ্ঞানেরই পূজারী হয়? ধর্ম ও জ্ঞানকে এক সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছিস না তো? না, সমস্যাটা ওখানেই, কিছু কিছু অতি উৎসাহী ব্যাখ্যা দেয় যে একটা গ্রন্থই সকল জ্ঞানের আধার, সবকিছুর সূত্র ওখানে আছে, বল এটা কি সম্ভব? এই সংকীর্ণতার জন্যই আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি, জ্ঞান ও ধর্মকে পৃথকভাবে দেখতে পারছি না। তোর কাছে সাহস করে কথাগুলো বলতে পারছি। আমাদের কেউ, মানে সিলেটি কারো কাছে যদি বলি তাহলে এক্ষুণি মুরতাদ ঘোষণা করে দেবে আমাকে, তুই তো জানিস, তা নই আমি। আসলে এদের লোভ খুব বেশি, যা কিছু করছে, সব লোভের বশবর্তী হয়ে। আমি হতাশ নই, আগামী প্রজন্মেই হয়তো দেখবি, জগতটাকে বুঝতে পারবে ওরা, আমাদের যে হতাশ প্রজন্মটা দেখছিস, এরা আরেকটা হতাশ প্রজন্মের জন্ম দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি না, কারণ, ঐ অর্থে লোভ ওদের নেই, আউয়ালকে দিয়ে বুঝে নে। তোকে নিয়েও বুঝতে পারি আবীর। তোর কথায় যুক্তি আছে, চল এখন ঘুমোই।
পরদিন বিকেলে ওদের বাসায় যাওয়ার প্রোগ্রাম করি ওর বাবার সঙ্গে কথা বলে। খাবারের প্রতি আমার প্রেমের বিষয়টা চেনাজানা সবাই জেনে গেছে। আয়োজন করেছে সেভাবে। একথা সেকথার পর আবীরের বিয়ের প্রসঙ্গ ওঠায় ওর বাবা –
পুয়ার বিয়া ঠিক করি লাইলাম, হুনছো নি বা?
বাধা দিয়ে ওঠে আবীর –
আব্বা সিলটি মাতরায় কেনে, তাইনো সিলটি নায়?
আমি বলি –
না না খালু, আপনি সিলেটিই বলেন, আমি সব বুঝি, বলতে না পারলেও। যতটুকু পারি আমিও একটু আধটু বলবো। আমার দেশের মানুষেরা বাঙলার সঙ্গে ইংরেজি মিশেল দিতে খুব পছন্দ করে, কিন্তু কোনো আঞ্চলিক ভাষা, মোটেও না, আমি একটু চেষ্টা করে দেখি না কেন?
আবীর বলে –
হ্যাঁ, ঢাকাইয়া সিলেটি।
আমার সায় পেয়ে আবীরের আব্বা বলেন –
সিলটি না মাতলে মনো অয় না আপন কেউর লগে মাতরাম, বুজজোনি বা, পুয়া ইতা বুজতায় না।
না না টিক আছে খালু, আপনে মাতইন।
হেসে ওঠে ওরা। যাক পরিবেশটা একটু হালকার দিকে এগিয়েছে।
পুয়ার বিয়ার কতা মাতছিলাম। বুজজোনি, মেয়ে আমরার গরোর, আমার বাইর পুরি, বাক্কা সুন্দর। আবীর ফটো আইন্না দেখা।
বসা থেকে আর ওঠে না আবীর। খালু আবার বলা শুরু করে –
ভিসা করি মেয়ে আনি লাইছি এই দেশো, দেখতায় নি, গরোই আছে।
আমি বলি –
বিয়ের বিষয়ে আবীরের মত জেনেছেন খালু?
ইয়াল্লা, ইতা কি কও, আমরার খান্দানো ইতার চল নাই। হুনতায়নি পুয়ার বাপোর বিয়ার কিচ্ছা?
কইন খালু।
তহন বয়স কত আমার জানো নি?
না খালু।
পনরো পরছে খালি, হুনি আমার বুলে বিয়া, কইন্যা আমার মুইয়ের গরর বইন লাগে। বিত্রে আমার কিলা জানি লাগে খালি, কইতাম পারি না কেউরে, বিয়ার দিন গেলাম বাগি, হারা গেরাম খুইজ্জা গাছের খোড়োলর বিতর থাকি দরি আনি আমারে কলমা পরাইয়া দিলা। তুমার খালার কিচ্ছা হুনতায় নি, ইয়াল্লা, কিতা কয়, রাইতে তানোর গরো আমারে পাডাইলে চিল্লাইয়া কাইন্দা ফিট। আমি তো অহন কি করি, কি করি, ও আল্লা মাবুদ! আমারে কয়, আম্মার কাছে পাডাইয়া দেন, আমার ডর লাগে!
পর্দার আড়াল থেকে খালা বলে, আপনের কিলা ছদবুদ গেছেইগি নি, পুয়া অগলতের লগে ইতা মাতরাইন। ঠা ঠা করে হেসে ওঠে খালু, আইও তুমি এই গরো, তুমার পুয়ার বিয়ার মাত মাতরাম।
খালা যে খুব পর্দা করে তা না, কিন্তু এটা বোধ হয় অভ্যাস হয়ে গেছে, দর্জায় ঝোলানো পর্দার ওপাশে বসে সবার সঙ্গে কথা বলে, পানের খিলি তৈরি করে, জাতি দিয়ে কুটুস কুটুস করে সুপারি কাটে, কিছুক্ষণ পর পর বাটায় করে পান সাজিয়ে পাঠায়, চা-নাস্তা পাঠায়, কথাবার্তায়ও অংশ নেয়, এ রকমই বোধ হয় নিয়মে দাঁড়িয়েছে। আবীরের বিষয়ে ফিরে আসি –
এখন যুগ পাল্টেছে খালু, বিয়ে-শাদির বিষয়ে ছেলেমেয়েদের মতামত নিতে হয়।
হাছা নি? পুয়া তো কুনতা মাতে না।
হয়তো ভয়ে কিছু বলছে না।
ইয়াল্লা, ও আবীরর মা, হুনছো নি মাত?
তাইন ঠিকই মাতরা, ওলা দিন আছে নি, দরি-বান্দি বিয়া দিলাইলা, আর হারা জীবন গর করলায়। বালা অইলে বালা, কালা অইলে কালা।
একটু দমে যান খালু, কিছুটা চিন্তিত দেখায়, বিষয়টা ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য বলি –
আসলে খালু আপনাদের সময়ে মানুষদের মধ্যে যতটা ঘনিষ্টতা ছিল, সম্পর্কগুলো যত সহজ ছিল, এখন কিন্তু তা না, মানুষ জটিল হয়ে গেছে। আপনারা বিয়ের আগে থেকেই দু জনে দু জনকে চিনতেন, তা ছাড়া মেনে নেয়ার ব্যাপারটা ছিল। আজকালের ছেলে মেয়ে, দু জনের সঙ্গেই কথা বলা ভালো।
ঠিক আছে বা, কতা কইমুনে, আমার পুয়ার লাগিও কইন্যা আছে, আমার বাইওর গরর পুরির লাগিও দামাদ আছে। আল্লার হুকুম তাকলে অইবো, না অইলে না।
ঠিকই খালু, আল্লার হুকুম থাকলে এটা হবে, না হলে না।
এই সুযোগে বিষয়টা আল্লার উপরে চাপিয়ে দিলাম। আল্লা থাকার কত বড় সুবিধে, মস্ত জটিল কিছুও খুব সহজে তাঁর উপর চাপিয়ে দেয়া যায়।
খালুর দাঁড়িয়ে থাকা সিদ্ধান্তটা যে এত সহজে কাত করে ফেলা যাবে কল্পনাও করতে পারি নি। আশা করি আর দু এক বৈঠকে একেবারে শুইয়ে ফেলা যাবে। খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরে আসি। আবীর তো দারুণ খুশি, একটা কাজের মতো কাজ করেছিস দোস্ত। তুই না হয়ে আমাদের সিলেটি কেউ হলে ওকে সুদ্ধ মার লাগাতো আব্বা, তুই থাকাতে রাগ করতে পারে নি, বিষয়টা ভেবে দেখতে পেরেছে। কোনো বিষয়ে রক্ত যদি আগেই মাথায় চড়ে যায় তাহলে সিদ্ধান্ত নেবে কীভাবে, তখন চায় সিদ্ধান্তটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে, ওটার ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতাই তখন থাকে না। এখন হয়তো ঠিকই ভাববে এ নিয়ে।
আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ফিরে যায় আবীর। ভাবছি কেরোল এলে একটা গাড়ি কিনে নেবো, লিফট নেয়ার জন্য খামোকা অন্যকে কষ্ট দেয়া, টেক্সি ডাকতে চাইলেও নিতে দেয় না। দু দিন পর টেলি আসে কেরোলের, মায়ের শরীর ভালোর দিকে যাচ্ছে না, আরো কিছুদিন পরে আসবে। একা একা ভালো লাগে না, ভালো একটা চাকরির সুযোগ পেয়েছি এবার্ডিনে, কিন্তু কেরোলকে অক্সফোর্ডে ফেলে যাবো কি করে, একটু ভাবনায় পড়ে যাই। আবীরের বিষয়টা আরো দু বার আলাপ করে মিটিয়ে ফেলি। আবীরের বাবা বুঝতে পেরেছে যে ইংল্যান্ডে বেড়ে ওঠা একজন ছেলের মানসিক স্তর ও বিশ্বনাথে বড় হওয়া একটা মেয়ের মানসিক স্তর কোনোভাবেই একই তলে না, এটার ব্যবধান কমিয়ে কোনোদিনই সমতলে পৌঁছাতে পারবে না ওরা, এ জন্যই আজকাল অনেক বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে, আগে যা ছিল বিরল।
এক সন্ধ্যায় আবীরের বাবা বাসায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, আবীরের পছন্দমতো অথবা আমাদের খোঁজে কোনো ভালো মেয়ে আছে কিনা। দুটো প্রশ্নের জবাবেই না জানাই, জানি যে আবীরের কোনো প্রেম নেই। তবে আমিও খুঁজে দেখবো বলে জানাই। বাইরে এসে বলি এখন থেকে তো তোর গার্জিয়ান হয়ে গেলাম রে, সালাম-টালাম দিস দেখা হলে।
কেরোল না থাকায় উইকেন্ডগুলো এত ফাঁকা লাগে আবীরকে বলি রাতে এসে থাকতে। বাসায় এসে বলে চল এক কাজ করি, দু দিনে তোর বাসাটা টাইডি-আপ করে ফেলি। ঠিক আছে, ভালোই হয় তাহলে, কেরোল এসে খুশি হবে। ফার্নিচারগুলো বদলাবি নাকি? যদি এবার্ডিনে যেতে হয়? আমার মনে হয়, যাস নে, এখানেই ওর চেয়ে ভালো না হলেও একই রকম একটা চাকরি পেয়ে যাবি, দু দিন আগে বা পরে। বলছিস? হ্যাঁ, বলছি। তাহলে চল কাল টাইডি-আপ করে পরশু ফার্নিচারের সঙ্গে কার্পেটটাও বদলে ফেলি, কিন্তু এ সবই তো মালকিনের। তোরা কি বাসা বদলাবি? বদলানোই তো উচিত, ছাত্রাবস্থায় নিয়েছিলাম এটা, এখন দু জনেই চাকরি করি, আরেকটু ভালো একটা বাসা নেয়া উচিত না। হ্যাঁ, তাই করা উচিত। কিন্তু বাসাটার প্রেমে পড়ে গেছি। তোর প্রেম নেই কিসের সঙ্গে, বিশ্বপ্রেমিক আছে জানি, তুই সর্বপ্রেমিক। আসলেই রে, কেন যে সবকিছুরই প্রেমে পড়ে যাই! কোনো একটা হোটেলে যদি এক হপ্তাও থাকি, হোটেলের ঐ রুমটার প্রেমে পড়ে যাই, ছেড়ে আসতে কষ্ট হয়। দেশটাই যে ছেড়ে এসেছিস, ঐ প্রেমটা ছাড়লি কীভাবে? সবকিছুই যে মেনে নিতে হয়, এই পৃথিবীটার প্রতি কারো প্রেমের কমতি আছে, ছেড়ে যেতে হবে না সবাইকে! হ্যাঁ, কথার পিঠে কথা দাঁড় করানোই যায়।
আবীরকে সঙ্গ দেয়ার জন্য এক বোতল গর্ডন জিন নিয়ে আসি, টনিক ওয়াটার ও লাইম মিশিয়ে পান করি। সাতকড়া দিয়ে হাসের মাংস ভুনা খেয়ে অভ্যস্ত ওরা, মেথি দিয়ে রান্না করি আমি, চুলোয় থাকতেই দেখি অর্ধেকটা সাবাড়, ভাত না খেলেও চলবে মনে হয়, সিমারে বসিয়ে রাখি, রাত প্রায় পুরোটা পার করে দেয় জিনের সঙ্গে ঐ মাংস। সকালে ভাড়া নিতে আসে মালকিন। বলি – তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে, ভেতরে এসো। বল কি বলবি, সোফায় বসে বলে। পরিকল্পনাটা জানাই ওকে। আমি তো ভাবলাম বাসা ছেড়ে দিবি, বিয়ে টিয়ে করবি না ছোঁড়া, এভাবে আর ক দিন আলাদা বিছানায় শুবি। আবীরও হেসে ওঠে। পুরোনো এসব রাখবি কোথায়, আর বাসা ছেড়ে দেয়ার সময় নিয়ে যাবি না নতুনগুলো? না, নিয়ে যাবো না। তাহলে একেবারে একই সাইজের নিবি, এখানের সব ফার্নিচারই ঘরের মাপমতো, আর বেশি দামি নিবি না, ঘরের সঙ্গে মানানসই যেন হয়। তাই সই, আমার সই। ওটা আবার কি? বুঝবে না। না বুঝলে বলিস কেন বাঁদর। আর এক কাজ করবি তাহলে, ফার্নিচারের বিল অর্ধেকটা আমার নামে দিয়ে দিস, এ ফার্নিচারগুলো আসলেও অনেক পুরোনো হয়ে গেছে, ওগুলো কি চ্যারিটিতে দিবি? আবীর বলে – পুরোনো দোকানেও দেয়া যায়, একই কথা, যারা কিনে, চ্যারিটি সপ থেকে তো বেশি সস্তা পায় না। তা ঠিক, কিছুটা টাকাও যদি তোদের উঠে আসে। আবীর বলে, ঘরটা রং করবে না? তাও তো করানো দরকার। এক কাজ করি, ফার্নিচার ও কার্পেটের দাম পুরোটাই তুমি দাও, ঘরটা আমরা মুফতে রং করে দেই। ওসব হিসেবনিকেশের দরকার নেই, দু মাসের ভাড়া দিস না। ওয়াও, গ্রেট, আওয়ার লেইডি মালকিন, আসো এক পাক নাচি তোমার সঙ্গে। সাগ্রহে বলি আমি, চা কফি কিছু খাবে মালকিন? খাওয়াবি? তিনজনে বসে কফি খাই, আর মজার সব গল্প শোনায় আওয়ার লেইডি মালকিন।
কফি খেয়েই বেরিয়ে যাই, পুরানো ফার্নিচারগুলোর ব্যবস্থা করে ফেলি, রং রোলার সব কিনে দু দিনের মধ্যে রঙের কাজ শেষ করি। ভালো একটা বুদ্ধিই দিয়েছে আবীর। নতুন কিছু ক্রোকারিজ ও টুকটাক কিনে একেবারে নতুন করে সাজাই সব কিছু। চমৎকার একটা সারপ্রাইজ দেয়া যাবে কেরোলকে, রোববারে আসবে ও।
বিকেলে বাসায় থাকবো না জানিয়ে আবীরকে পাঠাই এয়ারপোর্ট থেকে পিক করার জন্য। বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় আবীর। ঘর অন্ধকার করে ডাইনিং টেবিলে বসে অপেক্ষা করি কেরোলের জন্য। টেবিলের উপর নতুন একটা ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা তাজা ফুল। ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে চমকে ওঠে কেরোল, আবার বেরিয়ে যেয়ে দেখে ঠিক ফ্ল্যাটেই ঢুকেছে কিনা, মাথায়ও ঢোকে নি যে ওর চাবি দিয়ে অন্য ফ্ল্যাটের তালা খুলবে না, তখনো দেখে নি আমাকে, লাগেজগুলো টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে দরোজা বন্ধ করে। বেডরুমের দিকে যাওয়ার জন্য চোখ তুলতেই আমাকে দেখে, প্রথমে চমকে ওঠে, তারপর চিৎকার দিয়ে দৌড়ে আসে, এসব কি, বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেকখন ধরে রাখি বুকের ভেতর। তারপর বলি, তোমার মা আজ কেমন আছে কেরোল? অনেক ভালো। আগের থেকে অনেক ভালো, বারবার বলছিল তোমার কথা। ঠিক আছে, ফ্রেশ হও।