অন্য আলো
কামাল রাহমান
৫
বিষয়টাকে কীভাবে ধরবো ঠিক বুঝতে পারি না, জীবনকে গভীরভাবে দেখার কোনো কারণ সৃষ্টি হয় নি তখন পর্যন্ত। হলে ভালো, না হলে হলো না, এভাবে দেখতে চেয়েছি সব, বুঝতে চেয়েছি। কোনো জটিলতার ভেতর জড়ানো আমার ধাতে নেই, অথচ পড়ে গেছি পারিবারিক এক টানাপোড়েনের ভেতর। ভালোবাসি ফুটবল, দৌড়ে যেয়ে এক লাথিতে বলটা ঢুকিয়ে দাও গোলের ভেতর, অথবা ক্রিকেট, মারো ছক্কা, নয়তো কট বা বোল্ড আউট, দাবা খেলার মতো জটিল অঙ্কের খেলা আমার ভালো লাগে না।
বিপন্ন আয়ারল্যান্ডের প্রত্যন্ত এক অঞ্চল থেকে আসা কেরোলাইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেছে গত চার বছরে। ভালোভাবেই মনে আছে আমার ‘চাচার মেয়ে আয়েশা’! ভবিষ্যতে ওর সঙ্গে কিছু একটা ঘটার বিষয়টা কখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নি, ওকে আমি চাচার মেয়ের বাইরে অন্য কোনো কিছু এখনো ভেবে উঠতে পারি নি, প্রেমিকা বা স্ত্রী তো নয়ই, এমনকি বোনও না। সত্যি কথা, আমার মনোজগতে ওর কোনো স্থানই নেই। অথচ পারিবারিক কি এক হিসাব-নিকাশের অঙ্কে বাঁধা পড়ে আছি। মাঝে মাঝে ওর ঐ বিশিষ্ট-নামটাও অন্যরকম কিছু একটা সৃষ্টি করে আমার ভেতর, ওটা মনে হলে আগে বিবি ও পরে সমীহ-জাগানো একটা বাক্য মনে এক পূণ্যভাব সৃষ্টি করে, কদমবুসি করার মতো অনেকটা। ওকে নিয়ে আস্ত একটা জীবন যাপন, শুধু জীবন যাপনই না, একটা পরিবার গড়ে তোলা, হে মহাকালের প্রভু, রক্ষা করো!
গত চার বছর ধরে আমার সহপাঠী কেরোল, আকস্মিকভাবে ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে দু বছর আগে। কিছুটা অর্থ জমিয়ে ছোট্ট একটা ক্রুইজিঙে যাই নর্থ পোলে। জাহাজেই জমে ওঠে বন্ধুত্ব, গ্রীষ্মে অপরূপ উত্তর মেরুর নিসর্গে পল্লবিত হয়ে ওঠে, মুকুলিত হয়, যদিও ফল ধরে না কোনো। সুন্দরীই বলা যায় ওকে, সাজলে তো বটেই, সোনালি চুল, নীল চোখ, নাকের ডগায় ছোট্ট একটা বল, রেড নোজ ডে’তে কৃত্রিম নাক লাগাতে হয় না ওকে, নাকের ডগাটা লাল রং করে নিলে একেবারে অরিজিনাল। শরীরের গড়ন ককেশিয়ান, মাঝারি, অথচ পেছনটা আফ্রিকান, আমার জন্য বরং ভালোই, ওকে বলি, এমন মেলানো-মেশানো শরীর আয়ারল্যান্ডে হলো কীভাবে? বলে পেছনটার কথা জানি না, কিন্তু নাকের ঐ গোল অংশটা আলপাইন গোত্রের মানুষের বিশেষত্ব, তোমাদের এশিয়ায় যেমন চায়নীজদের বোঁচা নাক, আর্যদের যেমন কাকাতুয়া পাখির মতো ধারালো নাক, এই আর কি। আমাদের বন্ধুতার দ্বিতীয় বছরে মনস্থির করি একত্রে থাকার, একটা স্টুডিও ফ্ল্যাট ভাড়া নেই, নিচের তলা, শীতে যদিও কিছুটা স্যাঁতসেঁতে, হিটার চালিয়ে গরম ও শুকনো রাখতে হয়, গ্রীষ্ম সেটা পুষিয়ে দেয়। পেছনের খোলা চত্বরে ফোল্ডিং চেয়ার মেলে সমুদ্র-সবুজ মখমল ঘাসের উপর শরীর মেলে দেয়া যায়। টবের ভেতর রকমারী ফুলের গাছ, টমেটো, রেডিশ, পয়েন্টেড ক্যাবেজ, ড্যানিশ লেটুস প্রভৃতি চাষ করা যায়। ভাড়া বাড়িটার মালিক ছিল না, ছিল এক মজার বুড়ি, ওর নাম ধরে ডাকা ছেড়ে দেই বাসাটা ভাড়া নেয়ার দ্বিতীয় হপ্তায়। আমার কিংবা কেরোলের কারোই পুরো নাম ধরে ডাকা বন্ধ না করায় আমরাও ওকে আওয়ার লেইডি মালকিন নামে ডাকা শুরু করি। বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে মালকিন মানে কীরে? বলি ঔনারের স্ত্রীলিঙ্গ। ওটার আবার স্ত্রীলিঙ্গ হয় নাকি! হয়, আমাদের ভাষায়। তোমাদের ভাষাটাই আমার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে কেন? বাহ্, প্রতি হপ্তায় আট পাউন্ড ভাড়া নিতে পারবে আর ছোট্ট একটা শব্দ নিতে পারবে না? তাহলে আরো এক পাউন্ড ভাড়া বাড়লো তোদের।
আমাদের ফ্ল্যাট বিল্ডিংটার পেছনের খোলা জায়গার পর এক সারি হোলি ট্রী, তারপর ছোট্ট একটা মাঠ, মাঠের পর এক সারি বাংলো। সাধারণত বুড়োবুড়িরা বাংলোয় থাকে, দোতলায় ওঠানামা করার সামর্থ নেই যাদের, অথবা এটাকে ঝক্কি মনে করে। বাংলোগুলোর একটায় থাকে আওয়ার লেইডি মালকিন। প্রতি সকালে কুকুর নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি, অথবা খেলাধুলা করে কাটায়, প্রতিটা হপ্তাহান্তে এসে জিজ্ঞেস করে কেমন আছে খোকাখুকুরা! বসার একটা আসন দেখিয়ে দেবে কেরোল। বাচ্চাদের একটু সময় হবে? হবে, ঘণ্টায় এক পাউন্ড। তাই সই, ঐ যে বিদঘুটে শব্দটা, মাঙ্কি না মিল্কি, ওটার জন্য ভাড়া যে এক পাউন্ড বেড়েছে, তা কাটাকুটি। তারপর শুরু হবে ওর মজার সব কাহানি। ভগবান, এতোও জানে বুড়িটা!
আমাদের ফ্ল্যাটের এক কোনায় একটা গ্যারেজ আছে, ওটার পাশেও খালি জায়গা অনেকটা, একটা ক্যারাভান পার্ক করা ওখানে, শেষ কবে ওটা চালানো হয়েছিল, ভগবানও ভুলে গেছেন, চাকার মেটালে একটু একটু মর্চে পড়া দাগ, জানালার কাচগুলো ধুলোয় ধূসর, ভেতরের স্ক্রিন যদিও দেখা যায়। ওর স্বামী বেঁচে থাকতে পুরো গ্রীষ্ম নাকি ওটার ভেতর কাটাতো। আমাদের ঘর থেকে বেরোনোর সময় প্রতিবারই একটা কথা বলতো মজার বুড়ি, ‘এই, রাতে কিন্তু এক বিছানায় শুবি না তোরা।’ প্রথমবার একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল কেরোল, ‘কেন?’ ‘তাহলে এ ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে তোদের, দু জনের বেশি এখানে থাকা চলবে না।’ আমরা তো হেসেই খুন। আর ওটাই এখন ওর সম্ভাষণ হয়ে ওঠেছে, আমরাও বলি, ‘আচ্ছা, আচ্ছা মালকিন, আওয়ার লেইডি মালকিন!’ তারপরই ঘরে ঢুকে দীর্ঘ চুমো খাই, উষ্ণতা নেই, পরস্পরে। কেরোলও বলে, ‘এই, রাতে কিন্তু এক বিছানায় শোবে না।’ মুখ কপট-কালো করে বলি, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে, মাই লেইডি!’
হাঁটতে বেরোই উইকেন্ডে। মাঠের পাশ দিয়ে রাস্তাটা নেমে গেছে ঢালুতে, ওখান থেকে বাঁদিকে বেরিয়ে গেছে একটা কাঁচা পথ, পাথর বিছানো ঐ পথ দিয়ে একটা ট্রাক্টর অথবা গাড়ি যেতে পারে, বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ি কখনোই ক্রস করতে হয় না বলে রাস্তার চওড়া এতো কম যে একটা ট্রাক্টর আসায় রাস্তার পাশে সরে দাঁড়াতে হয়। ওখানটা পেরিয়ে যেতে যেতে হাত নেড়ে ড্রাইভার জানায়, সামনে এগিয়ে যাও, অনেক মজার আবহাওয়া পাবে, ওর ঝোলানো গোঁফ-জোড়া ও অকৃত্রিম হাসি-চোখ মনে থাকে অনেকক্ষণ। দু পাশে হথর্নের সারি রেখে রাস্তাটা সোজা সমতলে এগিয়ে গেছে অনেকটা. তারপর বাঁয়ে বাঁক নিয়ে বিশাল একটা পাহাড়ের পায়ে শেষ হয়েছে, ওখান থেকে শুরু চষা জমি, পুরো পাহাড়টা ট্রাক্টর দিয়ে লাইন টেনে যেনো ছবি এঁকে রেখেছে। এটার কথাই সম্ভবত বলেছে গোঁফ-ড্রাইভারটা, শুকনো বাদামি রং মাটির নকশা ছুঁয়ে দৃষ্টি উঠে যায় সরাসরি আকাশে, চষা খেতও যে এতো সুন্দর হয় এই প্রথম বুঝতে পারি। ঐ খামারি নিশ্চয় একজন আদর্শ শিল্পী, মনে মনে প্রশংসা না করে পারা যায় না। বাসায় যেয়ে ক্যামেরা এনে ছবি তুলতে চায় কেরোল। এতোটা পথ আবার? কাল না হয়। বোঝানো যায় না ওকে, আমাকে রাস্তার পাশে শুইয়ে ফিরে যায়। একটা মানুষ নেই আশেপাশে, শুধু বাতাসের সামান্য দোলা, আকাশেও কোনো পাখি নেই, বাংলাদেশে এমন নীল আকাশে একটুও ফাঁক থাকে না যেখানে চক্কর কেটে ঘুরে না বেড়ায় কোনো-না-কোনো পাখির ঝাঁক! ইচ্ছে হয় পাহাড়টার চূড়ায় উঠি, কোনোভাবেই সম্ভব না, ফিরে এসে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে কেরোল। পাহাড়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই কিছু সময়, এবার সামনে পড়ে ছোট্ট আর একটা পাহাড়, ওটার একপাশে ছোট্ট একটা বন, বড় বড় গাছের সারি, কাছে যেতেই আবহাওয়া বদলে যায় হুট করে। শীতল, মাদকতাময়, বুনো শ্যাওলাটে একটা গন্ধ, গা ছম ছম করে ওঠে, হিংস্র কোনো প্রাণী নেই তো ওটার ভেতর। অভয় দেয় কেরোল, ইংরেজদের চেয়ে হিংস্র কেউ নেই, সব শেষ করে দিয়েছে ওরা। বনের ভেতর ঢুকি, ওখানে বাতাসের শব্দ শোনা যায়, অনেক গাছ জড়িয়ে আছে ঘন সবুজ লতা ও পাতায়, ঐসব গাছের কাণ্ড ও শাখা প্রায় সব ঢাকা পড়েছে, আর কোনো কোনো গাছের কাণ্ড একেবারে নেড়া, ওদের গায়ে কোনো লতার শেকড় ঢোকানো সাধ্য নেই, কি খেয়ে বেঁচে থাকবে! মানুষের মধ্যেও এমন কিছু মানুষ আছে যাদের ঘিরে থাকে সবুজ লতাপাতা, ওরা সক্রেটিসের মতো। বনের ভেতরটা এতো অন্ধকার, বোঝা যায় না বাইরে এতো অবাধ আলো! ছোট্ট ঐ বন পেরোলে একটা খোলা জায়গা সামনে আসে আবার, ওখানে ঘাস এতো বড় যে দিব্যি ঢেকে ফেলা যায় নিজেদের। হয়তো এটাও চাষের জমি ছিল, পতিত থাকায় ঘাস জমে জঙ্গল হয়ে উঠেছে। মানুষের সাড়া পেয়ে লাফাতে থাকে একপাল বুনো খরগোশ, কি সুন্দর ও নিরীহ প্রাণী এই খরগোশগুলো, একেবারে হাতের নাগালে এসেছে, শান্ত সুন্দর চোখ-জোড়া মেলে তাকায়, শুধু খেলার ছলে মানুষেরা কীভাবে শিকার করে শান্ত এই প্রাণীগুলো! কি বোকাই না বানায় বোকা এই প্রাণীদের, ধাওয়া করে বিপরীত দিকে ওৎ পেতে থাকা শিকারি বন্দুকের সামনে নিয়ে আসে। জীবন বাঁচাতে ছুটে আসে ওরা যেখানে অপেক্ষায় রয়েছে অবধারিত মৃত্যু, কী নিষ্ঠুরতা! আকাশের পাখি যেমন নির্বিবাদে শিকার করে মানুষেরা হাতের নিশানা ঠিক করতে, ঠিক তেমনি জলে স্থলে সর্বত্রই মানুষের চরম নির্মমতা! ঈশপের ব্যাঙ আজো একই সুরে বলে, তোমাদের জন্য যা খেলা, আমাদের জন্য তা মৃত্যু!
ঘাসের বন পেরিয়ে যাই, ছোট্ট একটা চারণভূমি, অনেকগুলো গাভী, অনেকের সঙ্গে রয়েছে বাছুর, একটু দূরে অলস পায়ে দাঁড়িয়ে তিনটে ঘোড়া, এখান থেকেও বোঝা যায় ওদের একটা অন্তত পুরুষ। চারণভূমির এক পাশে বেশ বড় একটা খাল, স্পষ্ট বোঝা যায় বৃষ্টির জল জমে ওখানে পুরো শীত জুড়ে, বরফ হয়ে থাকে কখনো কখনো, এক ধরনের শ্যাওলা শুকিয়ে আছে, বড় ঘাস বা ঝোপ নেই কাছাকাছি, এসব দেখে মনে হয় আদিম দিনের পৃথিবী, সব কিছু প্রাচীন ও পবিত্র, সভ্য বলে কথিত বিশ্বের মানুষেরা সবকিছু যে পাল্টে ফেলেছে তা ভুলে থাকা যায় কিছুক্ষণের জন্য। যদি কিছু পাখ-পাখালিও থাকতো! এসব বনের কোথাও ফিজেন্ট পাখিদের আবাস ছিল, তাও শিকার করে নিধন করা হয়েছে অনেক আগে, বাংলাদেশ থেকে যেমন হারিয়ে গেছে অনেক প্রজাতির ঘুঘু, ডাহুক, সারস প্রভৃতি পাখি। আদিম প্রকৃতির ছোট্ট একটা খণ্ড, বাংলাদেশে যা অভাবনীয়, পেরিয়ে এসে হঠাৎ একটা জাঁকালো খামারবাড়ি সামনে এসে পড়ে। সুন্দর সাজানো গোছানো গাছপালা, বহুবর্ণিল ফুলের বিলেতি বাগান, পাথরের বাড়ি, এক ধরনের ঘাসে ছাওয়া চাল, হোলি ট্রীর চিরসবুজ ও কণ্টকময় দেয়াল, ফণীমনসায় গড়া এরকম দেয়াল বাংলাদেশে দেখা যেতো এক সময়। ছোট্ট একটা সাইনবোর্ডে খামার-মালিকের নাম লেখা, চকিতে মনে পড়ে ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ মুভির খামার বাড়িটার স্মৃতি। এরকম খামারেরই রেপ্লিকা গড়ে তুলেছিল ওরা আটলান্টিকের ওপারে, যেসব হারিয়ে গেছে ঝঞ্ঝা বাতাসের সঙ্গে, অথচ এখনো রয়ে গেছে ওগুলো বিলেতের অনেক গ্রামের পাশে।
ট্রেইডমার্ক করে রাখার মতো গোঁফজোড়া না থাকলে বুঝতেই পারতাম না যে কয়েক ঘণ্টা আগে এ মানুষটাকেই দেখেছি ট্রাক্টর চালিয়ে আসতে, রাস্তাটা তাহলে ঘুরে এখানে এসেছে! ধবধবে সাদা গেঞ্জি ও ব্রাউন হাফপেন্টের ভেতর পরিচ্ছন্ন একটা মানুষ, চোখের উজ্জ্বলতা অসাধারণ, কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, ভালো লেগেছে? বহুত খুব। বলেছিলাম না? বামে ছোট্ট একটা জায়গা আছে, বিশ্রাম নিতে পারো। সামনে এগিয়ে দেখি ছোট্ট একটা কান্ট্রি পাব, বেশ কয়েকজন বাইরে বসে আছে বিয়ারের গ্লাস নিয়ে। দুটো বিয়ার নিয়ে বসি আমরাও, ভেতরে ঢুকে ভাজা মাংসের গন্ধে মনে হয় খিদেও পেয়েছে। সরাসরি স্লটার হাউস থেকে তাজা মাংস নাকি ওরা নিয়ে আসে উইকেন্ডে, স্লাইস করা পর্ক সোল্ডারের দুটো প্লেইট বাইরে নিয়ে আসি, হ্যান্ডমিল ঘুরিয়ে গোলমরিচ ও রকসল্ট গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দেই, সবুজ আপেলের আচার মেখে মজা করে খাই, দ্বিতীয়বার আনতে যায় কেরোল, শেয়ার করি ওটা। বিয়ারের আমেজ ও ক্লান্তি মিলেমিশে ইচ্ছে হয় ঘুমিয়ে পড়ি। আবার দেখি ঐ ট্রেইডগোঁফের ছায়া, মনে হয় এ খামারটার মালিক অথবা ম্যানেজার সে, আমার ঢুলো ঢুলো চোখ দেখে এগিয়ে আসে, অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছো, তোমরা বোধ হয় ওখানে থাকো, যৌবনের কাল তো, অনেককিছুই বোঝা যায় না, ইচ্ছে হলে বাস ধরে ফিরে যেতে পারো, বাঁয়ের রাস্তা ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলে একটা বাস-স্টপ পাবে, এই ধরো আর ঘণ্টাখানেক পর একটা বাস আসবে, ওটা একেবারে তোমাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, আসলেও টায়ার্ড আমরা। কোনো অসুবিধা নেই, চকচকে সবুজ বোতামের মতো ওর চোখজোড়া নাচিয়ে বলে, খুব আরামের একটা ঘুম দিতে পারবে ঘরে যেয়ে, ইশারায় কেরোলকে দেখিয়ে চোখ টিপে বলে, অবশ্য আরো আরামে রেখে তোমাকে যদি ঘুমাতে না দেয় ও। হেসে চোখ টিপি আমিও। কানে কানে বলে কেরোল, ভাগ্যিস এক বিছানায় শুতে মানা করে নি!
যদি কোনো শনিবার আওয়ার লেইডি মালকিন ভাড়া নিতে না আসতো আমরাই মাঠ পেরোতাম। এমন একদিন ওর ওখানে যেয়ে দেখি রোদে পিঠ রেখে উল বুনছে, আর মিটি মিটি হাসছে।
এই মজার বুড়ি, পেটে পেটে এতো! এই বয়সে কার জন্য সোয়েটার বুনছো শুনি?
ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকে, হাসিটা তখনো মুখ জুড়ে, বলি –
হাসছো কেনো? এবার যেনো সামনে দেখতে পেয়েছে আমাদের। বলে –
হাসছি নারে ছোঁড়া, ওটা একটা স্মৃতি, এই হাসিটা আজকের না, এমন কি ওটা হাসিও না। আমিও জেরা করা শুরু করি –
তাহলে উল বুনছো কার জন্য? এবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে মজার বুড়ি।
তোদের ভবিষ্যতের জন্য।
খলবলিয়ে হেসে ওঠে কেরোল।
এক বিছানায় শুতে মানা করে, আবার বলে কিনা …
আমি জানি তোরা আমার কথা শুনিস না।
জানো?
পকেট হাতড়ে আট পাউন্ড বের করে দেই ওর হাতে। ব্যাগ থেকে কারুকাজ করা কাপড়ের খতি বের করে এক দুই করে গুনে রাখে ওগুলো যত্ন করে। বাস-স্টপে পৌঁছে, ওটার ছোট্ট বেঞ্চে বসে মনে মনে হাসি মজার বুড়ির কথা মনে করে। অনেক পুরোনো মনে হয় বাস-স্টপটা, কাঠের ছোট্ট একটা দোচালা, যাত্রী যে কালেভদ্রে মাত্র দু একজন ওঠে এখান থেকে, বোঝা যায় এটার অবস্থা দেখে। বাস আসে একটা বেশ ঝকঝকে, এতো বড় বাস, পেছনে মাত্র দু জন যাত্রী। এর গতি দেখে বাংলাদেশের মুড়ির টিনের কথা মনে পড়ে, গড়িয়ে গড়িয়ে চলা ঐ মুড়ির টিনও ফাঁকা রাস্তা পেলে ঝড়ের গতিতে দৌড় দেয়, বাংলাদেশের কোনো ড্রাইভার এমন রাস্তা আর গাড়ি পেলে বাংলাদেশ বিমান নির্ঘাত ফেইল মেরে যেতো।
বাসটার এই ধীর গতিতে চলাটাই বরং এখন ভালো লাগছে, আসল বিলেত রয়েছে বিলেতের গ্রামগুলোয়, ওদের একথাটার মর্ম বুঝতে পারি, এতো সুন্দর প্রকৃতি ও জীবন সত্যিই বিরল। মুগ্ধ হয়ে গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে তন্দ্রা নেমে আসে দু চোখ ভরে। যেখানে নামিয়ে দেয় বাসটা, ঘরের সত্যিই খুব কাছে, ছোট্ট একটা শাওয়ার নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, সুদীর্ঘ স্মৃতিভরা একটা দিনের শেষে।
কোনো এক শনিবারে যেয়ে দেখি আওয়ার লেইডি মালকিন দু চোখে জল নিয়ে বাগানের কোণে একটা ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ। জিজ্ঞেস করি, কাঁদছো কেন মজার বুড়ি? বলে এ কান্নাটাও কান্না নয় রে, অন্য আরেক ধরনের স্মৃতি। কত রকম স্মৃতি আছে তোমার মালকিন? শুনবি? হ্যাঁ, শুনবো, মাত্র এক পাউন্ড ঘণ্টায়। এই ছোঁড়া, আর ক’বার বলবো, ঐ যে মাল্টি গিল্টি কি যে ডাকিস আমাকে ওতে এক পাউন্ড কাটাকাটি। আচ্ছা ঠিক আছে, শোনাও তাহলে। এভাবে আমরাও অভ্যস্ত হয়ে যাই, যে হপ্তায় মজার বুড়ি আসে না, ধরে নেই কোনো একটা স্মৃতির ভেতর রয়েছে সে।
অক্সফোর্ডের দিনগুলো আমার আইসিস নদী তীরের প্রাচীন মেপল গাছগুলোর মতো ঝড় ও ঝঞ্ঝা এড়িয়ে, ক্ষয় ও জীর্ণতা উপেক্ষা করে বেড়ে চলে, গ্রীষ্মের রৌদ্র-দিনে নিচের শীতল ঘাসে হয়তো একটু ছায়া ফেলে, কিন্তু সেসবের কোনো চিহ্ণ থাকে না ঘাসের বুকে। ওরাও নিজেদের মতো বেড়ে ওঠে, আবার শুকিয়ে যায়, আবার বেড়ে ওঠে একইভাবে, গাছগুলোর সঙ্গে সম্পর্কহীন ঐ বেড়ে ওঠা।
যতোটা জড়িয়েছি কেরোলের সঙ্গে, বলতেই পারি, প্রেমে পড়েছি, ওকে নিয়ে জীবন কাটানো যায়, একটা উদ্বাস্তু পরিবার গড়ে তোলা যায়। কিন্তু দেশে ফেলে আসা জীবনের ঐ গেরোটার বিষয়ে কি করবো ভেবে উঠতে পারি না। রশিটা বাঁধা যে খুঁটির সঙ্গে ওটা উপড়ে উঠিয়ে নিয়ে আসা যায় না, আর ঐ অসম্ভবকে কোনোভাবে সম্ভব করে ফেললেও দৌড়ে যে-কেউ আবার ধরে ফেলতে পারার সম্ভাবনা থেকে যায়, রশিটা ছেঁড়াও অসম্ভব, কোনোভাবে গেরোটা খুলে আসতে পারলে একটা কূল হয়তো হতে পারে, কিন্তু কীভাবে তা করা যেতে পারে মাথায় আসে না। চাচার মেয়েকে বিয়ে না করাটা পুরোপুরি অনৈতিক, বাবার দিকটাও অবশ্যই ভেবে দেখার মতো। চাচার অর্থ আছে, মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিতে পারবে, কিন্তু বাবার গলায় দড়ি দেয়ার দশা হবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। অকপটে সব খুলে বলি কেরোলকে।
মেয়েটার সঙ্গে তোমার কোনো কমিটমেন্ট আছে?
অবশ্যই না। যদি জিজ্ঞেস করো, ওর চেহারাটাও এখন বর্ণনা করতে পারবো না, সত্যি বলতে কি, ভালোভাবে কখনো দেখিই নি ওকে।
যদি কোনো কমিটমেন্টই না থাকে তোমার সঙ্গে তাহলে ইগনোর করতে সমস্যা কোথায়?
পারিবারিক কমিটমেন্টটা তো কোনোভাবে উপেক্ষা করার মতো না। ওদের অর্থে পড়াশোনা করেছি, এতোটুকু এসেছি, বেঈমানি করবো কীভাবে, বলো?
হ্যাঁ, অবশ্যই ওটা গুরুত্বপূর্ণ …।
চুপ করে থাকে কেরোল, কী যেনো ভাবে, কিছুক্ষণ পর বলে –
বুঝি না, কীভাবে একটা অজানা অচেনা মানুষের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধো তোমরা!
এভাবেই হয়ে এসেছে আমাদের সমাজে। খুব যে অসুবিধা হয়, তাও না।
ভবিষ্যত নিয়ে এক ধরনের জুয়া।
হয়তো। কিন্তু পাশ্চাত্যে যে এতো চেনা-জানার পর ঘটে এসব, তাতেও তো কম ভাঙ্গাভাঙ্গি হয় না।
সম্পর্কের এডজাস্টমেন্টটা আসলে খুব জটিল।
হ্যাঁ, জটিল।
তোমার ক্ষেত্রে অর্থই যদি মূল বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে কম্পেন্সেট করে সমস্যা সমাধানের দিকে এগোনো যায় না?
ভালো একটা ক্ল্যু বের করেছো, কেরোল।
কত টাকা লাগতে পারে?
অনেক, নিঃসন্দেহে অনেক।
এক কাজ করো, পড়াশোনাটা শেষ করে, চোখ বন্ধ করে চাকরি করতে থাকো, আর বাড়তি খরচ না করে টাকা জমাও।
তার আগে দেশে যেয়ে বিষয়টা মীমাংসা করে আসতে হবে।
তাই করো, আর দু বছরের জন্য সব আমোদফুর্তি বাদ দাও।
তোমার সঙ্গে শোয়াও!
ডাউ, তোমাকে আসলেও জরিমানা করা উচিত, এক পাউন্ড নয়, দু পাউন্ড করে।
তাই করো নাহয়, তবু ঐ মজার বুড়ির বুদ্ধিটা নিও না।
আর একটা কথা বলেছো তো তিন পাউন্ড করে জরিমানা।
অভাবনীয় একটা ঘটনা পালের রশি ছিঁড়ে, মাস্তুল ভেঙ্গে নৌকোটা ডোবানোর উপক্রম করে। অক্সফোর্ডের ঝড়োগতি জীবনে যা-কিছু করে থাকি না কেনো, পড়াশোনায় ঢিল দেই নি একটুও। কারণ, জানি যে এটা আমার অর্জনে তো নেইই, এমনকি বাবারও না। এ পর্যন্ত প্রতিটা টার্মে ও এসাইনমেন্টে এ গ্রেইড পেয়ে এসেছি, অথচ চূড়ান্তে এসে আমার থিসিসটা গ্রহণ করেন নি মহাত্মা প্রোফেসর! কারণ জিজ্ঞেস করি। বলে, সে তো রিফিউজাল লেটারে লেখাই আছে।
তাহলে এতো বছর এ গ্রেইড পেয়ে এসেছি কীভাবে?
ওসব ভিন্ন। থিসিসের সঙ্গে ওগুলোর সম্পর্ক নেই।
ভালো করছো ভালো করছো শুনে শুনে বোকার স্বর্গে বাস করে এসেছি দেখছি!
ওটা হয়তো তোমার ধারণা। বোকারা নিজেরাই ওটা রচনা করে।
হ্যাঁ, ভুলের জগতটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, আমাকেই!
মনটা আমার ছুতোরের, স্বর্ণকারের মতো ঠুকঠুক ভালো লাগে না, কামারের মতো এক ঘায়ে বসিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় সব কিছু। একই কাজ দ্বিতীয়বার করতে হবে ভেবে মন খারাপ হয়। একটা বছর যে পিছিয়ে গেলাম, তাই শুধু নয়, জীবনের হিসেবটাই বদলাতে হবে এখন। আমার অবস্থা দেখে এগিয়ে আসে কেরোল।
ভেঙ্গে পড়ার মতো কিছু হয় নি ডাউ। সব ঠিক হয়ে যাবে আবার।
বলছো?
হ্যাঁ, আমার এক বছরের সঞ্চয় ধার দেবো, বিষয়টা মিটিয়ে এসো, তারপর আর কি?
তাহলে শুধু ঋণ করেই জীবনটা গড়ে তুলতে হবে আমার!
ওভাবে দেখো না, আমারও ঋণ নিতে হতে পারে তোমার কাছ থেকে, বিষয়টা সামলানোই বড় কথা।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ঘন ঘন চিঠি আসতে থাকে দেশ থেকে। যাওয়ার উপায় নেই জানিয়ে লিখি যে পড়াশোনা শেষ করার জন্য ধার-দেনা হয়েছে, ওসব শোধ করতে আরো দু বছর লাগবে। একে তো আসা-যাওয়ার খরচ, তারপর পকেট ভর্তি না করে তো আর দেশে ফেরা যায় না। যুক্তিটা শাঁসালো বুঝতে পেরে ক্ষান্ত দেয় বাবা। দুদুটো বছর অন্তত হাতে পেয়েছি, দেখা যাক, ভবি কি বলে!
উইকেন্ডে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাসটা গড়ে ওঠেছে বিলেতে আসার পর। কেরোল বোঝে নি যে আমার ঘুম ভেঙ্গেছে, জানালার ধারে চেয়ার টেনে নিঃশব্দে কাঁদছে বসে! চোখ বন্ধ করে ফেলি সঙ্গে সঙ্গে, মনে মনে একটু অবাক হই। কোনো কারণে আঘাত দেয়ার মতো ঘটনা আমার দিক থেকে হয় নি তো? কিছুই ভেবে পাই না। দ্বিধা ঝেড়ে উঠে পড়ি, যেয়ে বসি ওর পাশে।
ইস্টার পর্বের আগে দোকানের অনেকগুলো তাক ইস্টার এগে ভরে যায়। ভাইবোনেরা, কাজিনেরা মিলে বড়দের সঙ্গে দোকানে যাই। সবরকম ডিম থেকে অন্তত এক বাক্স করে চাই আমাদের। বড় দিনের বিশাল আনন্দের পর ওটা একটা বড় উৎসব। সেবার মাটি হয়ে যায় ওটা পরিবারে ঘটে যাওয়া বড় এক দুর্ঘটনায়। জীবনে প্রথম মৃত মানুষ দেখি, তাও আমার সমবয়েসী, একটা বাচ্চা। সকালেও যে আনন্দে লাফিয়েছে, ইস্টার এগের সংগ্রহটা দেখিয়েছে, একটা বাক্সের মুখও খোলে নি ইস্টারের দিন খাবে বলে, বিকেলেই সে প্রাণহীন! মৃত্যুর মহিমা তখনো বুঝি নি ওভাবে। আমাদের গ্রামে তো গেছো তুমি, এখনই বা ক’টা মানুষ আছে সেখানে, আর এতো বছর আগে, ভাবতেই পারো। গ্রামের বড় রাস্তাটা দিয়ে কখনো একদু’টা গাড়ি চলাচল করতো, আমাদের ঘরের একেবারে সামনে, দু শ গজও হবে না, একটা বাঁকে যখন পৌঁছি, পেছনে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ শুনি, মাথা ঘোরাতেই দেখি আমাকে ধাক্কা মেরে নিজেও ছিটকে পড়েছে ও, লুটিয়ে পড়ি রাস্তার পাশে, কিছু হয় নি আমার, কিন্তু ও যে ধাক্কাটা খেয়েছিল, ওটা গাড়ির। একটা বাচ্চা শরীরের কতটুকুই বা আর ঝাঁকুনি খাওয়ার ক্ষমতা থাকে বলো? এর পরে আরো অনেক মৃত্যু দেখেছি, কিন্তু ওটা আজীবন রয়ে যাবে আমার সঙ্গে। আমাদের দু জনকেই এ্যাম্বুলেন্সে করে সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যায়, ওটাই ছিল সবচেয়ে কাছে, কোনো কাজে আসে নি, ওর আঘাতটা ছিল শরীরের ভেতরে। এখন মনে হয়, আমারটা ছিল অন্তরের ভেতর! ওর ঐ ছোট্ট কফিনটা সাদা একটা পাথরের মতো চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়, যেনো একটা জ্যান্ত অস্তিত্ব।
সেজন্যই বুঝি একা একা কাঁদছো এখন?
হ্যাঁ, ঐ যে, মজার বুড়ি বলে না, এ কান্নাটা এ কান্না না, অন্য কোনো কান্না।
আসলে যে কান্না আমরা দেখি তার কোনোটাই ঐ কান্না না, আসল কান্নাটা কেউ দেখতে পায় না।
সত্যি তাই, সত্যি। চলো উঠি। তোমার মন খারাপ করে দিলাম না তো?
কি যে বলো!
দেখো, কত দিনের পুরোনো কথা, সতেরো বছর আগে যখন আঘাতটা এসেছিল, চোখে এক ফোঁটা জলও আসে নি, কত বয়স তখন আমার, সাত বছর! আর এখন, এতো বছর পর কান্না পেয়েছে, হাসির মতো মনে হয় না?
না কেরোল, হাসির মতো মনে হয় না। ওর কোনো ছবি আছে তোমার কাছে?
আছে, বুকের ভেতর। বেঁচে থাকলে হয়তো ওর সঙ্গেই আমার ভালোবাসা হতো।
এবার হাসে কেরোল।
কি সব বলছি!
সেক্ষেত্রে তোমাকে পেতাম না আমি। তারপরেও ওর বেঁচে থাকাটাই কামনা করতাম।
যাকগে, যা নেই, তা নিয়ে কেঁদে কি লাভ বলো, শুধু শুধু মন খারাপ করা।
যা আছে তা নিয়ে এবার একটু হাসো না কেরোল।
ওহ, একটা অসহ্য তুমি, ডাউ!
যদি তোমার কাজিন হতাম, কেরোল!
দেখো দেখি, ব্যাপারটা কি মজার, কাজিন থেকে নিষ্কৃতি চাইছো তুমি, আর আমি কাঁদছি আমার কাজিনের জন্য!
এই, এক কাজ করা যায় না, মজার বুড়ির মতো কাটাকাটি?
না, যায় না, তাহলে তো তোমার কাজিন শুরুতেই বিধবা।
আরে, ওভাবে তো ভেবে দেখি নি। থাক কাটাকাটি না, জোড়-বাঁধা।
হ্যাঁ, জোড়-বাঁধা।
পাঞ্জা ওঠায় কেরোল, আমিও পাঞ্জা উঠিয়ে পট্টাস করি।
এক শনিবারে এক দুই করে পাউন্ডগুলো গুনে নেয়ার পর বলে মজার বুড়ি –
বিকেলে এক জায়গায় যাবি আমার সঙ্গে?
কেরোল বলে, হ্যাঁ যাবো।
না, তুই না, ঐ ছোঁড়া শুধু। আমার দিকে ফিরে চোখ ইশারা করে। বিকেলে এসে হাজির যখন, দু জনেই অবাক, নাচের কালো পোশাক, মাথায় টিউলিপ-গোঁজা বাহারি টুপি, ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিপস্টিক, সুগন্ধি ছড়ানো বাতাস!
কীরে, খুব যে অবাক দেখছি?
কেরোল বলে, না ভাবছি, আমরা কি পোশাক পড়বো, তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি না।
আবার বলছিস আমরা! একটা নাচের পার্টিতে নিমন্ত্রণ আছে আমার, ও যাবে নাচের সঙ্গী হয়ে, তুই যাবি কি করতে?
আহা, আসুক না মালকিন, বলি আমি।
কপট রাগ দেখিয়ে বলে কেরোল, আমার মানুষটাকে নিয়ে টানাটানি করছো কেন লেইডি? সামলাতে পারবে?
কেনো, খুব তেজ নাকি? কীভাবে বুঝলি, তোরা কি একসঙ্গে শোয়া…
ওকে থামিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বলি, না, না, মালকিন, কখনোই না, তবে এখন সঙ্গে আসতে পারে ও।
আমরা নাহয় নাচবো, ও কি করবে?
সে দেখা যাবে, নাচঘরে গেলে সঙ্গী একজন জুটিয়ে নিতে পারবে আশা করি।
সাহস তো মন্দ নয় তোর ছোঁড়া, ঐ ছেঁমড়ি যদি ওর সঙ্গে ঝুলে পড়ে?
তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে ঝুলে পড়বো।
ওও, গ্র্যান্ড! আয় তোকে একটা চুমো দেই।
তেড়ে আসে কেরোল, না, দিতে হবে না।
ওরে বাব্বা, ঠিক আছে, দেখা যাবে, কতো কঠিন গেরো। এখন কষ্ট করে মাঠটা পেরিয়ে আমার বাসার সামনে আয়, ওখানে গাড়ি আসবে চারটায়।
ঠিক আছে মজার বুড়ি, বলে হাত নাড়ি।
সাজগোজ ও পোশাক মনের উপর কতোটা প্রতিক্রিয়া করে বুঝতে পারি। গটগটিয়ে হেঁটে যায় বুড়ি, বয়স যেনো দশ বছর কমে গেছে, চপল ছন্দ এসেছে শরীরে।
গ্রীষ্মের শেষে, অথবা কোনো গ্রীষ্ম প্রলম্বিত হলে, গোলাপের একটা কি দুটা ডাল দু একটা অতিরিক্ত ফুল ফোটায়। মজার বুড়ির প্রতিবেশীকে দেখি খুব যতœ নিয়ে হলুদ গোলাপের একটা ডাল বাঁশের কঞ্চিতে বেঁধে দিচ্ছে। জানি না বাঁশের কঞ্চি এখানে আসে কোন দেশ থেকে, এদেশে তো কোথাও বাঁশ জন্মাতে দেখি নি! ভাগ্যিস! বিভিন্ন সাইজের কঞ্চির তোড়া কিনতে পাওয়া যায় ডিআইওয়াই সেন্টারে। হয়তো আগামীকাল অথবা পরশুই ঝরে যাবে ফুল দুটো, ওটা টিকিয়ে রাখতে কম করে হলেও এক ঘণ্টা ব্যয় করবে বুড়োবুড়ি। এজন্য আবার ঘরের পোশাকও পরিবর্তন করতে হয়েছে, পুরোনো দিনের ইংরেজরা এতো ফর্মাল, এক মিনিটের জন্যও ঘরের পোশাকে বাইরে বেরোয় না, অথচ এখনকার তরুণদের ঘরের ও বাইরের পোশাকের পার্থক্যই বোধ হয় উঠে গেছে। ট্রাউজার ও শার্টের উপর সোয়েট-শার্ট চাপানো বুড়োর, আর জুতো মোজা, বুড়ির পরনে ফুল-হাতা শার্ট ও লম্বা ঝুলের স্কার্ট। সামান্য এই কাজের জন্য হাতে গ্লাভস দু জনেরই, বুড়ির হাতে প্র“নার, দু একটা অতিরিক্ত ডাল ছেঁটে দেয়। চুপচাপ যার যার কাজ করে, বাংলোর সামনে এ রকম বুড়োবুড়ি প্রায়ই দেখা যায়, বাগানের কাজ করে, নয়তো দরোজা জানালার কাচ পরিষ্কার করে, সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাকালে অবশ্যই হ্যালো বলবে। জবাবে একটা কথা বেশি বললে, দুটো অতিরিক্ত কথা বলবে।
গুড ইভনিং।
গুড ইভনিং, গুড ইভনিং।
নাইস ওয়েদা’!
ও ইয়া, নাইস ওয়েদা’ ফ’ গার্ডেনিং।
ভেরি নাইস। হ্যাভ এ নাইস ডে।
থ্যাঙ্ক ইউ জেন্টলম্যান, বা-আই।
বা-আ-ই!
পথচারীর সঙ্গে এটুকু কথা বলায়ই যেনো টক-মেশিনটা স্টার্ট হয়ে যায়, শুরু করে নিজেদের মধ্যে কথা বলা, এতোক্ষণ কাজ করছিল চুপচাপ!
বাড়ির সামনে চকচকে কালো রঙের অনেক দামি ও বিশাল এক গাড়ি দেখে কেরোলের চোখ কপালে ওঠে। কাছে আসতেই মজার বুড়ি বেরিয়ে আসে গট গট করে। হ্যালো, আওয়ার লেইডি মালকিন। হ্যালো কিডস। বিলেতে আসার পর এই প্রথম, অথবা বিলেতে আসার পরই বা বলি কেন, জীবনে এই প্রথম এতো দামি গাড়িতে চড়েছি। যখন চলা শুরু করে, মনে হয় ভেতরে বসে চা ও কফি খাওয়া যাবে। তারপর সেই গাড়ি এলো তো এলো আবার ঐ এলোর ঘরে! কান্ট্রি পাবটার পাশ দিয়ে মূল বাড়ির ভেতরে যখন গাড়ি ঢোকে বুঝতে পারি বিলেতের বনেদি ধনীরা কত ধনী। নাইটদের ক্যাসল, এবি, এসবের পরই বিলেতের লর্ডদের আবাসগুলো, তারপরই এই ধনীক শ্রেণি।
এগিয়ে এসে মজার বুড়িকে চুমো খায় ঐ ট্রেইডমার্ক গোঁফ! আমাদের দিকে ফিরে বলে –
হ্যালো গাইজ।
আমরাও হ্যালো বলে হ্যান্ডসেইক করি।
অবাক হচ্ছো, না? ও আমার আন্টি। তোমাদের কথা প্রায়ই বলে, বেশ ভালো ভাড়াটে নাকি তোমরা, অনেক শর্তটর্ত মেনেও ওখানে রয়েছো কয়েক বছর ধরে, বলেই চোখ টিপে, আমার আন্টি কিন্তু খুব মজার মানুষ।
জানি, মাই ফ্রেইন্ড।
আমার নাম পিটার।
নাইস টু মিট ইউ পিটার, একটু থেমে বলি, পিটার দ্য গ্রেট!
গোঁফে ঝড় তুলে হাসে, না হে, পিটার দ্য গ্রেটদের ভগবান একটা করেই বানায়, এতো এতো গ্রেট বানালে পৃথিবীটাই তো গ্রেট হয়ে যেতো!
যা বলেছো। ও হ্যাঁ, আমার নাম ডেয়ুড, আমার বান্ধবী কেরোল।
হ্যালো কেরোল।
অক্সফোর্ডের কানের এতো কাছে গ্রামটা, মনে হয় ফিসফিসিয়ে কথা বলছে ওরা। পিটারদের মূল বাড়িটা পাহাড়ের চূড়ায়, আশেপাশের পাহাড়গুলোয় মনে হয় না কোনো বসতি আছে। ছক কাটা ফসল খেত, মাঝে মাঝে এক থোক বড় গাছের গলাগলি দাঁড়িয়ে থাকা, পাহাড়ের পর পাহাড়, দূর থেকে সবই ফাঁকা মনে হয়, হয়তো ফসল খেত ছিল এক সময়, বিলেতের অনেক খামার পতিত পড়ে রয়েছে এখন, চাষাবাদে লাভ নেই তেমন, খামারিদেরও আগ্রহ নেই। পাহাড়গুলো যদিও অনেক উঁচু, কিন্তু কোনোটাই খাড়া নয়, অনেক দূর পর্যন্ত বি¯তৃত, কোনো পাহাড়ের ঢালই দশ থেকে পনেরো ডিগ্রির বেশি না, ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া যায় যেদিকে খুশি। কোনো কোনো পাহাড় দু ভাগ করে ফেলেছে একটা পথ ও পথের দু পাশে যতেœ লাগানো হথর্নের ঝোপ। এখানে এতো সোজা উঠে গেছে ঝোপের সারি দুটো, আর যে-রকম সমান করে সুন্দরভাবে ছাঁটা, মনে হয় সবুজ একটা রেল লাইন উঠে গেছে পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত, মাঝখানের সরু পথটা এখান থেকে সরু মনে হলেও বড় একটা ট্রাক্টর অনায়াসে আসা যাওয়া করতে পারে। পাহাড়ের ঢালে, নিচের অংশে বলদের খামার একটা, হাতির মতো বিশাল ঐ বলদগুলো পাল্লা দিয়ে নিজেদের তাগড়া করে তোলে দ্রুত কসাইখানায় যাওয়ার জন্য। বাড়ির লাগোয়া একটা ঘোড়ার আস্তাবল, বোঝা যায় এক সময় অনেক ঘোড়া থাকতো ওখানে, পরিবারের সবারই কম করে একটা, এখন মাত্র এক, দু, তিনটা দেখি, যার একটা মনে হয় না কখনো ব্যবহার করা হয়। লেজ, ঘাড়ের না-ছাঁটা কেশর, ও শরীরের লোমে এখন আর ব্রাশ পড়ে বলে মনে হয় না। আস্তাবলের পাশে যেয়ে দাঁড়ালে পাহাড়সারিটা আড়াআড়ি দেখা যায়, ছক কাটা সবুজ, হলুদ, মেটে রং পাহাড়ের শরীর ছুঁয়ে দৃষ্টি উঠে যায় আকাশে, স্পষ্ট বোঝা যায় ‘স্কাই লাইন’ শব্দযুগলের অর্থ ও বিশেষত্ব। সবুজ ও নীলের পার্থক্য সূক্ষ্ণ একটা দাগের মধ্যে দিয়ে এতো স্পষ্ট যে ওখানে একটা মানুষ কেন, ইঁদুর উঁকি দিলেও বোঝা যাবে যে স্কাই লাইনটা ভাঙ্গা হয়েছে। কান্ট্রি পাবের পাশ দিয়ে হেঁটে একটু এগোলে স্ট্রবেরির আবাদ। মাটি থেকে ফুট দুয়েক উঁচুতে মাচা বেঁধে সারি সারি স্ট্রবেরি লাগানো। উইকেন্ডে স্ট্রবেরি পিকিং সেইলে দেয়া হয়। এসে যতো খুশি খেয়ে যাও, তুলে নাও নিজের হাতে, যাওয়ার সময় সেইলস কর্ণারে মেপে পয়সা দিয়ে যাও। রোদ পোহাতে ও তাজা স্ট্রবেরি খেতে আসে অনেকে। মাছের পুকুর আছে বেশ ক’টা, বড়শি ফেলে মাছ ধরে কিনে নেয়া যায় যতো খুশি। হাস মুরগির খামার থেকে বায়ো এগ ও চিকেন কিনে নেয়া যায়।
বনেদি বিলেতি পরিবারগুলো আর কয়েক দশক টিকে থাকবে কি না কে জানে, এই পরিবারে পিটারই বোধ হয় শেষ খামারি। ওর দু ছেলের একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখন অস্ট্রেলিয়ায় চাকরি করে, মনে হয় না ফিরে আসবে আর, দ্বিতীয়টা ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। খামার চালানোর জন্য, দেখভালের জন্য শ্রমিকও পাওয়া যায় না, শহরের কারখানায় অথবা ওয়্যারহাউসের কাজে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে এই জেনারেশন। বিলেতে প্রত্যন্ত অঞ্চল বলেও কিছু নেই যে পুরোনো দিনগুলো আরো কিছুদিন রয়ে যাবে, বিচ্ছিন্ন কোনো গ্রাম বা শহর নেই, প্রতিটাই অন্যান্য গ্রাম অথবা শহর ও নগরের সঙ্গে যুক্ত, এমনকি ছোট ছোট চ্যানেল আয়ল্যান্ডগুলোও এখন আর বিচ্ছিন্ন বলা যায় না, দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টাই কোনো না কোনোভাবে যাতায়াত করা যায় ওসবে।
কেন যে প্রকৃতি এভাবে আপ্লুত করে আমাকে! হোক না বিদেশ, তবুও মনে হয় না এ আমার পর, যেমন প্রকৃতি কাউকে পর মনে করে না। এখানে, এই স্ট্রবেরি বাগানের পাশে আমাদের ফুলবাড়ির সিমের গাছ লাগালে প্রকৃতি আমাকে নিষেধ করবে না, সাধ্য-মতো চেষ্টা করবে গাছে প্রাণ দিতে, সাদা ও বেগুনি ফুল ফোটাতে, আর রানিং বিনের মতো লম্বা লম্বা ঘিয়া-সিম জন্মাতে। অথবা এখানে ঘর বাঁধলে কি বলবে উঠিয়ে নাও, অথবা বেঁধো না। বলবে মানুষেরা, বাঁধা দেবে মানুষেরা, যারা সব কিছু নিজের করে পেতে চায়। সবুজ ঘাস, সবুজ ঝোপ ও সবুজ গাছপালা মন এতো সতেজ করে তোলে! পুরোনো দিনের বাতাসও জমে আছে বনের ভেতর, বুক ভরে নেয়া যায় আদিগন্ধ মেশানো সবুজ বাতাস, কেরোলকে বলি, এতো সবুজ, এতো সবুজ, কেরোল, সহ্য হয় না, নিজেরও ইচ্ছে হয় সবুজ হয়ে যেতে।
তোমাদের দেশটাও তো সবুজ।
হ্যাঁ, সবুজ, চির সবুজ। কখনো তুষারে ঢেকে সাদা হয় না।
আয়ারল্যান্ডে, আমাদের অংশের সবুজ বড় নিষ্ঠুর।
নিষ্ঠুর সবুজ? বুঝি নি কেরোল।
গ্রীষ্মের কয়েকটা মাস এতো সবুজ যে তার চেয়ে বেশি সবুজ আর পৃথিবীতেই নেই, চোখ জুড়াতে না জুড়াতে হলুদ লাল ধূসর, তারপর সব সাদা, সব সাদা।
ও, তাই বলো!
বাড়িটার ডান দিক থেকে অক্সফোর্ডের গির্জার চূড়োটাই শুধু দেখা যায়। বিলেতেই শুধু নয়, ইউরোপের কোনো শহর অথবা নগরের স্কাই-লাইনে গির্জার চূড়া নেই, এমনটা ভাবা যায় না। গির্জা ও পুরোনো ভবনগুলোর বাইরের ও ভেতরের দেয়াল, থাম ও খিলানে পাথরের যে কার্ভিং, কারুকাজ তাও থেমে গেছে অনেক বছর আগে। পাথর কুঁদে ভবনের সৌন্দর্য বাড়ানো মধ্যযুগের শিল্প, যুগ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ঐ শিল্পও শেষ হয়ে গেছে। চার তলা একটা ভবন নির্মাণ করতে এখন এক বছরও লাগে না, অথচ এসব অনেক গির্জা গড়ে ওঠেছে কয়েক প্রজন্মের পরিশ্রমের ফলে। যে টেরাস-ব্লকে আমরা থাকি, তা নতুনদিনের নির্মাণ, ওটার বাইরের দেয়াল দুটো করে। দুই দেয়ালের মাঝে ফাঁকা, ইনসুলেশান রয়েছে, বাইরে থেকে বোঝা যায় না যে দুটো দেয়াল, ছাদেও ইনসুলেশান রয়েছে, কোনো চিমনি নেই, সেন্ট্রাল হিটিং, দরজার পাল্লা ও জানালার শার্সির মাঝখানেও ফাঁকা, দুটো করে কাচের ডাবল গ্লেইজিং, ঘরের উষ্ণতা কোনো ফাঁক গলিয়ে যেনো বাইরে বেরোতে না পারে, এয়ার টাইট। এর ভেতরে অক্সিজেনের অভাব হয় না কেন বুঝি না, বাতাস চলাচল করে না এমন ঘরবাড়ির কথা মনে হলে বাংলাদেশে দমবন্ধ হয়ে মরে যাওয়ার কথা মনে হবে!
একেবারে নিভে যাওয়ার আগে সম্পন্ন এই গৃহস্থবাড়িটার ম্লান হয়ে আসা জৌলুস আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় অতীতে, আমার গ্রামের বাড়িতে, শৈশবের দিনগুলোয়। গ্রামের বাড়ি হিসেবে ওটাকে নি®প্রভ বলা যায় না কিছুতেই, গ্রামের সম্পন্ন পরিবারের মধ্যে গণ্য হতো আমাদের জ্ঞাতি-পরিবারকুল। কয়েক একর জমির উপর যে বাড়ি দাদার আমলে গড়া হয়েছিল শরিকদের মধ্যে ভাগ হয়ে তা এতোটুকু করে হয়ে যায় দ্বিতীয় প্রজন্মে এসেই, বিলেতে যা একই রকম থেকে যায় প্রজন্মান্তরে। সামনে ও পেছনে এজমালি পুকুর। সামনেরটা বিশাল, পাকা ঘাঁট বাঁধানো, আমাদের সময়ে এসে পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে লাল রঙের হয়ে পড়ে ওটা। বর্ষায় পানির নিচে তলিয়ে যায় ইটের গাঁথুনির যে সব অংশ ওগুলোর সুড়কি ধুয়ে প্রতিটা ইট পৃথক হয়ে পড়েছে, তেচোকো মাছেরা লুকিয়ে থাকে ঐ সব ফাঁদের ভেতর। খেলার ছলে গামছা দিয়ে ছেঁকে ঐসব মাছ ধরেছি কতো! তারপর পানি রাখার ঘটিতে জিইয়ে রেখেছি, অনেক সময় মাটিতে ছোট গর্ত করে পানি জমিয়ে মাছগুলো ছেড়ে রাখতাম, পরে হয়তো এসে দেখতাম মাটি পানি শুষে নেয়ায় মাছগুলো সব মরে গেছে। মানুষের খাওয়ার যোগ্য ছিল না তেচোকো মাছ, পুকুরের সৌন্দর্য, তেচোকো মাছ মনে হয় না বাংলাদেশে কোথাও আছে আর। পুকুরের চারটা পাড় জুড়ে ছিল বিভিন্ন রকম ফলের গাছ। আম, জাম, কাঁঠাল, খেজুর ও তাল গাছ। পুকুর ও বাড়ির মাঝখানের খোলা অংশে একটা বকুল গাছ ও দুটো গাব গাছ ছিল। যখন বকুল ফুল ফুটতো পুকুর পাড় থেকে অনেক রাতেও ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হতো না। পাকা লাল বকুলের কষটে স্বাদ মনে হয় কষ্ট করেই নিতে হতো, তারপরও কীসের আকর্ষণে যে অমৃতের মতো মনে করে ঐ স্বাদ নিতাম! পাকা গাবের স্বাদও ছিল কষটে, কখনোই ওটা খেতে পারতাম না। গাইলে ছেঁচে পাকা গাবের কষে ঘরে বোনা জালে রং করতো আমার বাবা-চাচারা, বর্ষাকালে ঐ সব জাল নিয়ে বিলে মাছ ধরতে যেতাম আমরাও। পুকুরের এক কোনায় একটা টাট্টি বানানো হয়েছিল যে কার খায়েসে, জানি না, আমার ইচ্ছে হতো ওটা ভেঙ্গে ফেলি। ওদিক থেকে বাতাস এলে পুকুর পাড়ে বসার আনন্দটাই মাটি হয়ে যেতো, অথচ অন্য কারো রুচিতে মনে হয় না এতোটা আঘাত করতো, নয়তো ভেঙ্গে ফেলা বা অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়ার কথা। জায়গার খুব একটা অভাব ছিল না আমাদের পুরোনো ঐ বাড়িটায়। পুকুরের পাশে একটা মসজিদ বানানোর জন্য কিছুটা জমি ওয়াকফ করে যান আমার দাদামশাই, আশা করি কব্বরে শুইয়া তিনি আজানের সুমধুর ঐ ধ্বনি শুনতে পান এখনো! বাড়ির পেছনের পুকুরটা ছিল শুধু মেয়েদের ব্যবহারের জন্য, ওটার চারধারেও অনেক গাছ ছিল। এজমালি পুকুর হওয়ায় সবার মুরোদ বা ইচ্ছে না থাকায় ওটার গভীরতা আর বাড়ানো হয় নি বছরের পর বছর, শীতকালে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠতো ওটা। পুকুরের মাঝখানে হয়তো এক বুক পানি থাকতো, কিন্তু কাদাপানি পেরিয়ে ওখানে যেয়ে গোছল করায় কোনো শান্তি ছিল না, সামনের পুকুর থেকে কলসি ভরে পানি এনে ঘাটে বসে গোছল করতো মেয়েরা। বর্ষায় মাছ, সাপ, ব্যাঙ সব এক সঙ্গে বাস করে, ভাবা যায় বিলেতে এমন একটা কাণ্ড!
এখন বুঝি আমাদের পরিবারটা, যে অর্থে ইউরোপে পরিবার বোঝায়, কোনো পরিবার ছিল না। জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কারো নামের শেষাংশ একই রকম ছিল না, শেষ নাম বা পারিবারিক নামের বিষয়টাই ছিল অজানা। আরব দেশের দু তিনটা নাম মিলিয়ে অশিক্ষিত মোল্লারা একটা নাম ঠিক করে দিতো যার আগা মাথা কিছুই নেই, এমনকি আবু জামাল বা জামালের উট নামে আমার এক কাজিনের নাম রাখা হয়েছিল, আমার নামের অর্থ আমি জানি না।
শরিকদের মধ্যে ভাগ হয়ে বড় বাড়িটা টুকরো টুকরো হয়ে গেলেও দেয়াল তুলে বা বেড়া দিয়ে পৃথক করা হয় নি কখনো, বাড়ির চারদিকের সীমানায় গাছ পুঁতে যদিও পৃথকীকরণের চিহ্ণ রাখা হয়েছিল, সেসব গাছও এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। টাকা পয়সার টানাটানি না থাকলেও কোনো উদ্বৃত্ত ছিল না আমার বাবার, ওসবের প্রয়োজনও বোধ করেননি কখনো। আঙিনায় একটা বেগুন খেত করে, কিংবা মাচায় কিছু পুঁইশাক, লাউ-কুমড়া ফলিয়ে, জাল ছুঁড়ে মাছ ধরে, দিনান্তের খাবারের পর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারতেন। তিনিই কিনা পরে স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাকে নিয়ে, যেনো একটা সুখী সংসার গড়ে তুলতে পারি। নিজের জন্য কোনো স্বপ্ন তাঁর ছিল না, সত্যি বলতে কি তথাকথিত ঐ সুখী হওয়ার স্বপ্ন আমিও দেখি না। এই সুখ মানে হয়তো বিত্তবান হওয়া, আমার ধাতে নেই ওটা, ইউরোপের যে পরিবার প্রথা, তা গড়ে ওঠার সুযোগও হয় নি আমাদের ওখানে। কৌম সমাজ বা সংস্কৃতি গড়ে ওঠার জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্থানে শত শত বছর অনেক ক’টা প্রজন্মের বাস করতে হয়, তা হয়ে ওঠে নি। অনবরত ঠাঁইনাড়া হতে হয়েছে মানুষগুলোকে, ফলে মানুষের প্রত্যাশা নিজের সন্তানের বাইরে যেতে পারে নি, কামনা করেছে, ‘আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে ভাতে’, ঐ পর্যন্তই! এর বাইরে দেখার মতো দূরদৃষ্টি গড়ে ওঠার সুযোগই আসে নি।
প্রাচীন একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গা ছম ছম করে, কয়েক শ বছরের পুরোনো তো হবেই গাছটা, এটার বেড় কতটুকু হবে, কীভাবে বোঝাই, বেড় না বলে ব্যাস বলি, দশ ফুট তো হবেই, উঁচু কত দেখতে হলে মাথা থেকে টুপি পড়ে যাবে, অথচ পুরোনো কোনো গাছই নেই এখন আমাদের বাড়িতে। বিশাল কড়ই গাছগুলো শৈশবেই দেখেছি কেটে বিক্রি করে দিয়েছে। পুকুর পাড়েও ওরকম পুরোনো গাছ নেই। প্রয়োজন কোনো কিছুরই ধার ধারে না, নিজে বাঁচলে বাপের নাম, তারপরে না নাতি পুতি।
পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যায়, এর মধ্যে ছোট্ট একটা অতীত-ভ্রমণও হয়ে গেছে। বাড়ির সামনে এসে দেখি চত্বরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিটার। জিজ্ঞেস করে –
কেমন লাগলো? দু জনেই একসঙ্গে বলি –
চমৎকার! নিজেদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে হেসে উঠি। পিটার বলে –
চলো বলরুমে যাই।
কোনো অনুষ্ঠান আছে নাকি?
তেমন কিছু নেই, নিজেরাই একসঙ্গে একটু গল্প-গুজব করা। আন্টির জন্মদিন আজ, আমন্ত্রিত শুধু তোমরাই। কেন, বলে নি তোমাদের?
দেখেছো মালকিনের কাণ্ড!
কি বললে? পিটারের দিকে ফিরে বলি –
না ওটা একটা কৌডওয়ার্ড।
ও আচ্ছা, বলে মিটিমিটি হাসে। কেরোল বলে –
মজার বুড়ি সব সময়ই ওরকম একটা করে কাণ্ড করে, দেখো তো, একটা গিফট কেনা দরকার ছিল না?
ও যে কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারি নি।
গিফট দিবি জানলে তো আগে জানাতাম। দু জনেই ঘুরে দাঁড়াই। চকচক করছে ওর চোখ দুটো।
দে, কি দিবি। দু জনে জড়িয়ে ধরে দু দিক থেকে দুটো চুমো দেই। চোখ মুদে থাকে মজার বুড়ি।
এর চেয়ে বড় আর কোনো গিফট হতে পারে না রে! আমি খুশি, খুব খুশি।
তাহলে আওয়ার লেইডি মালকিন, আজ থেকে একসঙ্গে…
তেড়ে ওঠে বুড়ি –
খবরদার, ও কথা মুখে আনবি না, আমার ভাড়ার শর্ত এক চুল এদিক সেদিক হবে না।
গলা ফাটিয়ে হেসে উঠি সবাই।
নাচঘরটা সাধারণ। সে-তুলনায় আমাদের পুরোনো জমিদার বাড়িগুলোর জলসাঘরে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসার জন্য সামান্য উঁচু মঞ্চ, প্রকাণ্ড সব ঝাড়বাতি, বহুবর্ণিল গালিচা, বাদকদলের সরোদ, এস্রাজ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র, ধূপ ধোঁয়া, সব মিলিয়ে যে মাদকতাময় পরিবেশ গড়ে তোলে, তা যেনো আসে না। ওদের বিশাল অর্গ্যানটা অবশ্য দেখার মতো, কেরোলের সঙ্গে নাচার আগে মজার বুড়ির সঙ্গে এক পাক ধীর লয়ের পোল্কা নেচে নেই। পরে যখন দ্রুত লয়ের ভাল্জ নাচার পালা আসে, কেরোলকে ছেড়ে দেই। দ্রুত লয়ের নাচ এখনো রপ্ত করতে পারি নি, কেরোলের সঙ্গে পা মেলাতে যেয়ে মাঝে মাঝে হোঁচট খাওয়ার অবস্থা হয়। পিটারের সঙ্গে বেশ ভালো নাচলো কেরোল।
নাচের এই সময়গুলোতে সংগীতের মানসিক ও শারীরিক প্রভাব মনকে ধুয়ে মুছে কলুষমুক্ত করে দেয়, স্নানে যেরকম দেহসুদ্ধি, সংগীত তেমনি মনের কালিমা মুছিয়ে দেয়, অনেক দুঃখভারও লাঘব হয়ে যায়, মনের পাষাণ সংগীতের তালে তালে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আমাদের সমাজেও এক সময় নাচ ও গান, বাদ্য ও সংগীত ছিল ধর্ম ও জীবনের সঙ্গে যুক্ত। মাঝখান থেকে তলোয়ার এসে আত্মার খণ্ডন ঘটিয়েছে, সেসব বাঁধা এখন অনেকটা শিথিল হয়ে আসছে অবশ্য। বাঙালির আত্মার প্রকৃত ধর্ম লৌকিক, মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম বাঙালির না, কৃপাণ অথবা তলোয়ার হাতে বাঙালির জন্ম হয় নি, বাধ্য করে যা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে একদিন মুক্ত হবেই মানুষ, এর নিষ্ঠুরতাগুলো ঝেড়ে ফেলে প্রকৃত সৌন্দর্যটুকুই রাখবে শুধু।
মাঝরাতে ঘরের দরোজায় যখন নামিয়ে দিয়ে যায় আওয়ার লেইডি মালকিন, দু জনের চোখে ক্লান্তির ঘুম। বিছানা পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ হয় না, বসার ঘরের কার্পেটে শুয়ে পড়ি দু জনে, কোরোলের চোখ তৃষ্ণার্ত হরিণীর। বলি, বিছানায় এক সঙ্গে শুতে মানা করেছে মালকিন। মেঝেতে তো না, মাদকতাময় দু চোখ দিয়ে, মারমেইডের দু ঠোঁট দিয়ে, দু বাহু দিয়ে, সমগ্র শরীর ও আত্মা দিয়ে জড়িয়ে ধরে, নিঃশেষ হয়ে যাই, মিলিয়ে যাই, শূন্য হয়ে যাই!
অক্সফোর্ডের মের্টোন কলেজে এসিসট্যান্ট টিচারের একটা চাকরি পেয়েছে কেরোল। থিসিসটা আবার লেখার ফাঁকে দুটো খণ্ডকালীন চাকরি করি, যা একটা ফুল টাইমের প্রায় সমান হয়ে যায়। বছর শেষে দেশে ফিরি। বিষয়টা মেটানোই যে শুধু, তা না, পাঁচ বছরে এতো কিছু মিস করেছি, ওসবের কোনো কিছুই যেনো ফিরে পাওয়ার নয়! দেশে পৌঁছে মনে হয় ধন্য হলাম মাগো তোমার কোলে এসে! বেরিয়েছিলাম পরাধীন দেশ থেকে, ফিরে এসেছি স্বাধীন দেশে, এর আনন্দ ও আবেদন কোনোভাবে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এতো বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি প্রথম ক’টা দিন শুধু কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছে। পাকি ও রাজাকারেরা মিলে কি ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে, কত মানুষ মেরে ফেলেছে, বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে।
জীবনের দাবির কাছে সবকিছুই হার মানে অবশেষে। মোটামুটি সহনীয় একটা অবস্থায় পৌঁছি আমার চাচার মেয়ে আয়েশাকে নিয়ে। আমারই এক স্কুলবন্ধু আইনে গ্রাজুয়েশান নিয়েছে গত বছর, ভালো ভালো অনেক উপঢৌকন সহ মহকুমা শহরে ওর জন্য একটা বাড়ি কিনে দেই। ওকালতি করার জন্য একটা চেম্বার বানিয়ে, আইনের সব দামি দামি বই কিনে, বুকে পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে, বিয়ের পিঁড়িতে বসাই ওকে। চাচাও ততোটা মনোক্ষুন্ন হয় নি, প্রায় তিন বিঘা পরিমাপের খুব ভালো একটা ধানি জমি কিনে দেই ওর নামে, একই দাগের বাকি চার বিঘা জমি বাবার নামে রেজিস্ট্রি করি। মনে হয় প্রায় সবাই খুশি। চাচার মেয়ে আয়েশার মনের খবর নেয়া অবশ্য সম্ভব হয় নি। এবারই প্রথম ভালোভাবে দেখি ওকে। বেশ ভর-বাড়ন্ত হয়েছে, গায়ের রং শ্যামল হলেও দারুণ সুন্দর শ্যামল। ধারালো চোখমুখ, দেখে মনে হয় নিজেকে ভালোভাবেই প্রস্তুত করেছে গেলো ক’বছর ধরে। শাড়ির অসাধারণ প্যাঁচে বাঙালি রমণী-শরীর যে কী মোহনীয় যাদু সৃষ্টি করে, অপরূপ হয়ে ফুটে ওঠে, বুঝেছিল কবি আল মাহমুদ, রাজাকারদের খপ্পরে পড়ার আগে। এ রকম একটা শরীরের জন্য গাঙের ঢেউয়ের লাহান মন ‘কবুল কবুল’ জপতেই পারে! আমার বন্ধুটিকে মনে হয় খুব ভাগ্যবান, আইনের প্যাঁচে পড়ে শাড়ির প্যাঁচ ভুলে না থাকলেই হয়!
ছুটির চারটা হপ্তা এতো দ্রুত শেষ হয়ে গেলো বুঝতেই পারি নি। প্রথমবার যখন বিলেতের উদ্দেশ্যে পা বাড়াই একটা এ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা ছিল, কিন্তু এবার মনে হয় শিকড় ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বেদনা। আমার মন বলে, এ দেশটা আর আমার, একান্তই আমার রইলো না। আসলেও থাকে নি আর!
ফিরে এসে ইউনিভার্সিটিতে যেতেই অভিনন্দন জানায় আমার প্রোফেসর। দুটো থিসিসের মধ্যে এতো পার্থক্য কীভাবে করেছিলে ডেয়ুড? অবাক হয় সে, বুঝতে পারি, খুব খুশি হয়েছে। ব্যাখ্যা করে বলি, দেখো, গেলো বছর আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিতে কী ছোটাছুটিই না করতে হয়েছে, পড়াশোনা অথবা থিসিস লেখার সময় ছিল কোথায়? ওটা ছিল আমাদের বাঁচা-মরার লড়াই, আমার জীবন থেকে শুধু একটা বছর কেটে গেছে, অথচ আমার দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, শত বছরের পুরোনো গ্রাম, সম্পন্ন সংসার জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছে, পরিবার ধ্বংস হয়েছে, জনপদ নিশ্চিহ্ণ হয়েছে, এসবের তুলনায় আমার একটা বছর কিছুই না, একেবারেই কিছু না, আর এটাকে কোনোভাবেই ক্ষতি হিসাবে দেখি না আমি, বরং জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন আমার, আমার সব চেয়ে বড় সুকৃতি, একটা গ্রাজুয়েশান ডিগ্রি কোনোভাবেই তুলনীয় হতে পারে না ওটার সঙ্গে।
ঠিকই বলেছো ডেয়ুড, একটা দেশের জন্ম নেয়ার সঙ্গে জড়িত হওয়া সত্যিই ভাগ্যবানের কাজ। পৃথিবীর সেরা যুদ্ধটা হচ্ছে নিজেদের স্বাধীনতা যুদ্ধ। ক্রুসেড বলো, ধর্মযুদ্ধ বলো, সবই সাম্প্রদায়িক চালিয়াতি।
এটাই হয়তো সত্যি। কিন্তু মুস্কিল হলো, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের এই উপলব্ধিটুকু পেতে দেয়া হচ্ছে না।