অন্য আলো
কামাল রাহমান
২
অক্সফোর্ডের দিনগুলো আমার চৈনিক ড্রাগন উৎসবের মতো বর্ণাঢ্য ও বিপুল, আনন্দ-উচ্ছল, কলরবময়, বিহ্বলপুলকিত ও উপভোগ্য! যেনো এক ড্রাগনের ভেতর প্রবেশ করে আমার আত্মা, ওখানে দগ্ধ হয়, জারিত হয়, এবং বেরিয়ে আসে এক ড্রাগনশিশু হয়ে, জিহ্বা যার এখনো আগুনের। আরো পরে বুঝতে পারি, ঐ আগুন নবলব্ধ জ্ঞানের গরিমায় উজ্জ্বল, বাইরে আসার জন্য যা উৎসাহ দেয় প্রতি মুহূর্তে, এবং ওটা প্রশমিত হয় প্রকৃত জ্ঞানের দ্বারপ্রান্তে এসে নিজের তুচ্ছতা আবিষ্কার করতে পেরে, যখন ঐ উপলব্ধিটা হয় যে ‘জ্ঞানসমুদ্রের তীরে এক বালুকণা মাত্র’ আমি!
পনেরো জুন, কীভাবে মিলে যায় ইতিহাসের ঐসব তারিখের সঙ্গে যে-কিনা এখন কোনো-কেউ-না পৃথিবীর এই জটিল ইতিহাসের! কি ঘটেছিল সেদিন পলাশীর আমবাগানে? আমার ক্ষেত্রজীবী পূর্বপুরুষেরা লাঙল চালানো ক্ষণিকের জন্য থামিয়ে বিস্ময় চোখে শুধু দেখেই শান্ত ছিল দীর্ঘকাল!
হতদরিদ্র আজকের বাংলাদেশ তখন ছিল সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে সব চেয়ে বেশি সম্পদশালী। যে ভারতবর্ষ অন্বেষণে সারা পৃথিবী হন্যে হয়ে ঢুঁড়েছিল ইউরোপীয় নাবিকেরা, ওটার সেরা অংশটা কী করে ছোবড়ায় পরিণত হয়েছিল, তা গবেষণার বিষয়। ইংরেজদের আর্কাইভের তথ্য বলে, পলাশীর পরাজয়ের পর কম করে হলেও বছরে পাঁচ কোটি টাকা বাংলা থেকে পাচার হতো, আড়াই শ বছর পর এটার অর্থমূল্য এখন কত হতে পারে হিসেব করলে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে হবে। দশ বছরে যে অর্থ বাংলা থেকে বিলেতে এসেছে হাজার বছরেও বাঙালি তা বিলেত থেকে বাংলায় পাঠাতে পারবে না। কেন ঘটেছিল এটা? বাণিজ্য, সবই বাণিজ্য রে ভাই। ধর্ম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, ঘৃণা, এ সবই পরের বিষয়। দেশপ্রেম? ওটা যে কী বস্তু ঐ কৃষক ভাইয়েরা তখন বুঝতেই পারে নি। কি এমন বাণিজ্য ছিল বাংলার যে পৃথিবীর একটা সমৃদ্ধতম অঞ্চল হয়ে উঠেছিল? মিহিবস্ত্র, রেশম, মসলা, আফিম, এসব রপ্তানি করে যে পরিমাণ অর্থ আসতো বাংলায় তা দিয়ে মূল্যবান পাথর, হিরে-জহরত, সোনাদানার পাহাড় বানানো সম্ভব হয়েছিল। তখনকার জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, ওয়াজিদদের সম্পদ হিসাব করলে মূর্ছা যেতে হবে, থাক ওসব।
নবাবী আমলে বাংলা স্বাধীন ছিল। দিল্লির তোয়াক্কা করতো না বাংলার স্বাধীন নবাবেরা। ব্যবসায়ীরা স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারতো, উৎপাদকেরা পণ্যের মূল্য নিজেরা নির্ধারণ করতে পারতো, প্রচুর উদ্বৃত্ত জমতো ওদের ভাণ্ডারে। কিন্তু ইংরেজ শাসনে উৎপাদনের স্বাধীনতা পুরোপুরি খর্ব হয়ে পড়ে। ওদের ইচ্ছানুসারে পণ্য উৎপাদন করতে হতো, এমনকি মূল্যও নির্ধারণ করে দিতো ওরা। ফলে বিলুপ্ত হয়ে যায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী সব শিল্প। চিরকালীন উদ্বৃত্ত শস্যের দেশ এই বাংলায় জবরদস্তি করে নীল চাষ করিয়ে কৃষক সম্প্রদায়ের মেরুদণ্ড পুরোপুরি ভেঙ্গে দেয়া হয়, যা এখনো সেরে ওঠে নি, হয়তো উঠবেও না কোনোদিন।
উনিশ শ সাতচল্লিশের পনেরো জুনের সূর্য ওঠার আগেই ভূমিষ্ট হওয়ায় বলা যেতে পারে এক প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে জন্ম আমার, ফলে আলোর প্রতি এতো তৃষ্ণা, সব রকম, সর্বার্থে। অক্সফোর্ডে নেমেই এক আশ্চর্য পরিবর্তন অনুভব করি, দেহে ও মনে। একটা ভূমিকম্পের মতো দুলে ওঠে শরীর, অতিকাঙ্খিত অবস্থানে পৌঁছে সাফল্যের আনন্দে যেনো শিথিল, অবশ অনুভূতি, মঞ্জিলে-মকসুদে পৌঁছার লক্ষ্য অর্জনে চিত্ত নির্ভার, বিহ্বল। এখানে আসার জন্যই কি প্রথম জীবনের বাইশটি বছর অক্লান্ত সাধনা করেছি!
লন্ডনের চমকলাগা দিনগুলোর মতো উচ্ছ্বাস নেই শান্ত ও নিরিবিলি অক্সফোর্ড শহরে, ঘর থেকে বের হয়ে গ্রীষ্মের প্রকৃতি দেখারও ইচ্ছে হয় না, পরপর তিনদিন ঘুম ও আলস্যের কাছে পুরোপুরি সমর্পণ করি নিজেকে। এক ঘুমের পর দুই ঘুম, এমনকি দুই ঘুমের পর তিন ঘুমও সেরে নেই কোনো স্বপ্ন না দেখেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ শুরু হওয়ার এক হপ্তার মধ্যেই আমার শিবনেত্র ফুটতে থাকে। অর্থ ও ঈশ্বরের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য যে সম্পর্ক তার বিপরীতে আবিষ্কার করি শ্রম ও জ্ঞানের সম্পর্ক। যত বেশি ঈশ্বর তত কম অর্থ, দরিদ্র বিশ্বে ঈশ্বর অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত, বিত্তবানের কাছে ঈশ্বর তেমন কোনো মূল্য বহন করে না। একটা আরেকটার বিনিময়ও বটে, পরস্পর বিপরীতমুখী সম্পর্কিত দুটো সত্তা, যে কারণে ধর্মান্তরিতকরণের ঘটনাগুলো ঘটেছে, নতুন নতুন ঈশ্বর এসেছে। পুরাতন ঈশ্বর পরিত্যাগ করেছে মানুষ, আস্থা হারিয়ে নয়, অধিকতর অর্থ প্রাপ্তির প্রত্যাশায়, অর্থ এখানে ব্যাপকার্থ প্রকাশ করে। যেমন ফ্রয়েড লিবিডো শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন মানুষের অদস ও অহংএর কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে। সার্বিক প্রত্যাশাপূরণের বহুমুখী এ অর্থ বিভিন্ন সময়ে মানুষকে নতুন নতুন ধর্ম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু শ্রম ও জ্ঞান সরাসরি সম্পর্কিত, একটা বাড়লে অন্যটা কমে না, জ্ঞানার্জনের জন্য শ্রমের বিকল্প নেই, যত শ্রম দেয়া যায় তত জ্ঞানার্জন করা যায়। বলবো না শ্রমবিমুখ ছিলাম কখনো, কিন্তু এখন, পরিস্থিতি সামলাতে যেয়ে এটার মাত্রা এতোটাই বাড়িয়ে দিতে হয় যে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, অথচ এই জ্ঞানটুকু, জানি না এর প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহার কতটা, অর্জনের জন্য আমার স্কুলশিক্ষক পিতা নিজের জীবন তুচ্ছ করেছেন, জাগতিক সব প্রাপ্তি নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিয়েছেন।
অক্সফোর্ডের শিক্ষা জীবনের শুরুতে প্রাজ্ঞ এক টিউটর পেয়ে যাই, ভারতীয় আশ্রমগুরুদের বিষয়ে পড়েছি, কবিগুরুর শান্তিনিকেতনের পাঠদান পদ্ধতি বিষয়ে জেনেছি, এখানে এসে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একটা বিদ্যাপীঠের পাঠদান পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে শুধু শিহরিতই হই নি, অনেক বিষয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি আমূল বদলেও গেছে, নিজেদের সংকীর্ণতা ও অসামর্থ বিষয়ে প্রচণ্ড বিষাদাক্রান্ত হই, নালন্দা নামে সুপ্রাচীন একটা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরও ছিল, যার নামই এখন আমাদের প্রায় কেউই জানে না!
প্রথমে আমার পাঠক্রম ও শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয় আমার টিউটর পল ব্রাইডাল, এবং প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই আস্বস্ত করে, ভেবো না, সবকিছুতে অভ্যস্ত হয়ে যাবো আমরা। যখন বলি এভাবে এটা করতে চাই, ওটা ওভাবে লিখতে চাই, জবাবে বলে, হ্যাঁ ওটা করবো আমি, ওটা লিখবো আমি! একটু খটকায় পড়ি, আমার ওসবকিছু টিউটর কেন করে দেবে? পরে বুঝতে পারি, ঠিক আছে, তুমি করবে ওটা, বলে না ওরা! সংস্কৃতির পার্থক্য ভাষার ভেতরও যে কত জটিল ও ভিন্ন, একটু একটু করে বুঝতে শুরু করি।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে উপমহাদেশের ক’জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে ওঠে, একটা বিষয় বুঝতে পারি, দেশের ভেতর যত রেষারেষি ও সংকীর্ণতা থাকুক না কেন, অক্সফোর্ডের পরিবেশ ওগুলো ধুয়ে-মুছে দেয়। দু জন ভারতীয় ও একজন দক্ষিণ আফ্রিকান সঙ্গে নিয়ে একটা ভাড়া বাসায় উঠে যাই দু মাস পর। কিছু স্বস্তি পাই মনে, দাঁত দেখিয়ে জোরে হাসা যায়, পেঁয়াজ কাচামরিচ দিয়ে ঝাল-মুড়ি খাওয়া যায়। যদিও ঘরের পাশের বাঙালি রেস্টুরেন্টে প্রতিদিনের কাস্টমার আমি, মাঝে মাঝে রান্নার চেষ্টাও করি। শুক্র ও শনিবার সন্ধ্যায়, বিশেষ করে, রেস্টুরেন্ট এড়িয়ে চলি ভিড়ের জন্য। অন্য সন্ধ্যাগুলোয় বেশ আড্ডা জমে উপমহাদেশের বাঙালিদের। কয়েকমাসের মধ্যে আড্ডাকুলশিরোমণি খেতাব জুটে যায়। আড্ডাগুরু মুজতবা আলীর জার্মানির দিনগুলো স্মরণ করি। এর মধ্যে আবার মোড়লগিরি মনোভাব জেগে ওঠায় দেশীয় একটা সংগঠন গড়ে তুলি, এটার সভাপতির পদ গ্রহণ করতে হওয়ায় বেশ কিছু চমৎকার সুযোগ সুবিধা পেয়ে যাই। আমাদের গ্রাজুয়েশান কৌর্সের ফর্মাল ইনডাকশান উৎসবে অতিথি হয়ে আসেন মহামান্য রানি ভিক্টোরিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক ডাইনিং হলে রানির সঙ্গে ডিনারের একটা আমন্ত্রণ পেয়ে যাই এসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে। পোশাক অবশ্যই ফর্মাল, বলার অপেক্ষা রাখে না। সাধারণ স্যূটই নেই, সেখানে ফর্মাল ডাইনিং স্যূট পাবো কোথায়। পাঞ্জাবি এক বন্ধু, নেসার আমেদ, বুদ্ধি দেয় ভাড়া নিতে। এতোগুলো টাকা এক সন্ধ্যার জন্য, মন খচখচ করে। সে প্রস্তাব দেয় এসোসিয়েশন খরচ দেবে, নয়তো আমরা কয়েকজনে চাঁদা তুলে দেবো। পোশাক ভাড়া করে নিয়ে আসি, কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। ফর্মাল স্যূটের বিকল্প ছিল, জাতীয় পোশাক, কিন্তু ঐ জ্বেনা টুপি তো মাথায় চড়াবো না, শেষ পর্যন্ত পাজামা-পাঞ্জাবীর উপর প্রিন্স-কোট চাপিয়ে কারুকাজ করা নেপালি-মরোক্কান মিশেল এক ধরনের গোল টুপি মাথায় চাপিয়ে ডিনার হলে ঢুকি। সব ফর্মাল পোশাকের মধ্যে ঐ রাতে এক গোঁয়ার-গোবিন্দ বাঙালিই ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। ভালো কি মন্দ বুঝি নি, আড়-চোখে এক ঝলক দেখে নিলেন রানি-মা, তখনকার মতো মনে হলো, ধন্য হলাম মা গো! খাবার কি খেয়েছিলাম মনে নেই, রেড ওয়াইনটা কোন বাগানের আঙুর থেকে বানিয়েছে জানি না। তবে, এ দুনিয়া ফানা হইবের পর স্বর্গের সুরা ওখান থেকেই যাইবে।
বিলেতে এসে অনেকে নামের ঝামেলায় পড়ে, প্রথম নাম, মধ্য নাম, শেষ নাম, এ রকম ভাগাভাগিতে অভ্যস্ত নই, নাম বলতে এক ভালো নাম। ডাক নাম সীমিত থাকে পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে, এখানের শেষ নামটা পারিবারিক নাম, বলার সময় সামনে একটা মিস্টার লাগায়। আমাদের অনেকের প্রথম নামটা হয়ে যায় নামগুলো, আকম, আসম, আ ং ঁ ঃ ম এ রকম আদ্যক্ষর সবগুলোকে ভাঙ্গাতে হয়, ফলে ঝামেলাটা বোঝে, যার আছে ওসব। আমার নামের আগে একটা শেখ কিভাবে জুড়ে বসেছিল জানি না, ওটাই কিছুটা গোপন আনন্দ দেয়। শেখ বলতে ওরা বোঝে আরবের শেখের জ্ঞাতিকুল, কুটুম্ব। ধরে নেয় আমিও এক বিশাল ধনীর দুলাল, সখ করে পড়তে এসেছি বিলেতে। সুবিধে হয় যেটা, দেশে যে নিজেকে বিক্রি করে এসেছি তা ভুলে একের পর এক কিছু বান্ধবী পেয়ে যাই, ভালোই যায় আমার দিনকাল।
অক্সফোর্ডের পাঁচটা বছর যে কীভাবে কাটিয়েছি! এখন মনে হয় স্বপ্নের ঘোরে কেটে গেছে সেসব দিন, মানুষের সেরা দিনগুলো কেটে যায় ঘোরের ভেতর, তখন বুঝতেই পারে না যে জীবনের মধুরতম দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে, জীবনের এতো মধু কখনোই আর আহরিত হবে না। ছোট্ট আইসিস নদীতে বান্ধবী নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্যানু চালানো, নদীতীরে চোখজুড়ানো প্রাচীন গাছের সারি, গ্রীষ্মের বাতাসে সবুজ ঘাসের গালিচায় শুয়ে ধূমপান, বিয়ারের শীতল প্রশান্তি, নদীতে ভেসে থাকা রাজহাঁস, অসংখ্য ফুলের চেনা অচেনা সৌরভ, সবই আছে তেমনি এখনো, শুধু আমার সেসময়টা নেই, কেটে গেছে!
মাঝে মাঝে ছোটোখাটো উত্তেজনাও তৈরি হয়েছে, অক্সফোর্ডের দ্বিতীয় বছরে বাসা বদলে আরেকটা ভালো জায়গায় উঠে যাই, বাসা ছেড়ে দেয়ার কথা ছিল দুপুর দুটোয়। বন্ধু আবীরকে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে ধীরে সুস্থে সাড়ে তিনটায় ঘরে পৌঁছে দেখি মালপত্র সব রাস্তায়! কাছে যেতেই দরজা খুলে আগুনচোখে ঘড়ি দেখায় বাড়িওয়ালি। একটু থতমত খেয়ে যাই, এ রকম তো ভাবি নি। গজগজ করে ওঠে আবীর, জিজ্ঞেস কর, একটু দেরি হওয়ায় মালামাল রাস্তায় ফেলে দেবে নাকি! না-হয় আরেক দিনের ভাড়া নিতো। থামাই ওকে। মুখ কাঁচুমাচু করে বলি –
দুঃখিত, একটু ঝামেলায় পড়ে দেরি হয়ে গেছে।
ঠিক আছে, দেখো তোমার জিনিসপত্র ঠিক আছে কিনা।
ওসবের দিকে না তাকিয়ে বলি –
সব ঠিক আছে, কিছু ভেবো না তুমি। একটু থেমে বলি –
কিছু মনে করো না, তোমার নতুন ভাড়াটে কি এসে গেছে?
না, কাল আসবে।
যদি অনুমতি দাও তাহলে হুভার করে ঘরটা ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করে দেই।
কিছুটা শিথিল হয় ওর মুখের পেশি।
ঠিক আছে, ধন্যবাদ তোমাকে। ওটা আমি করে নেবো।
ওকে, ভালো থেকো, তোমার এতোদিনের আতিথেয়তার জন্য অনেক ধন্যবাদ, বাই।
বাই।
দরোজা বন্ধ করার পর বলি আবীরকে –
ওদের সঙ্গে পারবি? শুধু শুধু ঝামেলায় জড়ানো, কথার বরখেলাপ তো আমিই করেছি, দোষটা তো ওর না।
রাগ তখনো থামে নি আবীরের, জিজ্ঞেস করি –
এখন এগুলো নিবি কীভাবে?
কীভাবে আবার, মাথায় করে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে মন ভালো হয়ে যায় আমার, একটা সিগারেট ধরিয়ে ওর ঠোঁটে গুঁজে দেই, প্লাম গাছের ছায়ায় বসি, হিন্দি গানের একটা কলি গাইতে থাকি গুনগুনিয়ে, ওকে ফর্মে আনার জন্য কি করা যায় ভাবি। সিগারেট শেষ হলে বলি –
চল স্যূটকেইস দু’টা আগে রেখে আসি, তারপর টুকটাক।
কয়েক খেপ লেগে যাবে যে?
যাবে, অসুবিধা কি?
খেপ মারামারি ভাল্লাগে না আমার, টেক্সি ডাকি, কয় শিলিং আর নেবে।
ডাকো, তোমার আছে যখন।
মালামাল সব তোলার পর টেক্সিতে দু জনের বসার জায়গা থাকে না। চাবিটা ওর হাতে দিয়ে হাঁটা দেই। ভালোই হলো, হাঁটতে ভালো লাগছে বরং। ‘ব্রিটিশ টাইম’ বিষয়টা ভুলি নি এখনো, এটার কোনো খারাপ দিক নেই, সবই ভালো!
রুমে ঢুকে দেখি মালপত্র সব দোতলায় ওঠাতে যেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আবীর, বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। ভেবে পাই না ওর রাগ থামানোর জন্য কি করা যায় এখন, বাসাটার দেয়ালের রং এতো ক্যাটকেটে যে চোখে লাগে, ক্যালেন্ডার, ছবি ও ওয়াল হ্যাঙ্গার লাগিয়ে ঢেকে দিতে হবে। দেয়ালে চোখ রেখে বলি –
একা একা সব উপরে তুলতে গেলি কেন? জবাব দেয় না।
আবার বলি, বইগুলো যা ভারি।
ভারি বিদ্যের বই তো ভারি হবেই।
যা বলেছিস, ওঠ, বালিশ দিয়ে দেই, আরাম করে শো।
থাক, চল বেরোই, একটু ঘুরে আসি।
চল তাহলে।
বুঝতে পারি মন খারাপ হয়েছে ওর। এটা না করলেও পারতো ভদ্রমহিলা। সংস্কৃতির পার্থক্য প্রতি পদক্ষেপে বুঝে যাই। হাজার হলেও আমরা তো বিদেশি, আমাদের ওখানে বিদেশি কেন, কারো প্রতিই কি এটা করি আমরা? ম্যানার এটিকেটে নাকি ওরা পৃথিবী-সেরা, কথায় কথায় দুঃখিত আর ধন্যবাদ!
মনের গুমোট কাটাতে শহর ছাড়িয়ে কাউন্টির সীমানায় এসে পড়ি দোতলা এক বাসে চড়ে। নেমেই হালকা হয়ে যায় মন, প্রকৃতির বুনো গন্ধ, বহুবর্ণিল সাজ, আকাশে অবাধ আলো, সবই যেনো অফুরন্ত! ঝোপালো গোলাপের ঝাড় কম করে হলেও বিশ ফুট উঁচু হয়ে লতিয়ে ওঠেছে একটা পাহাড়ের গা বেয়ে, বিভিন্ন রঙের গোলাপে ছেয়ে আছে পুরো পাহাড়, নিরিবিলি রাস্তা ধরে এগোলে দূরে দেখা যায় অপূর্ব এক গ্রাম, মনে হয় না ওখানে কেউ বাস করে। ছবি তোলার জন্য গড়া হয়েছে। একটা খামারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই। এতো সুন্দর একটা ঘোড়া ওখানে ঘাস খায় না! মহিনের ঘোড়াটা কি এতো সুন্দর ছিল? জীবনের একটা বড় সখ ছিল, বাড়ি না, গাড়ি না, ঘোড়ায় চড়া, ভগবান মহাশয় সাফ জানিয়ে দিয়েছেন: হবে না।
সামনের রাস্তা ডানে বাঁক নিয়ে কোন দিকে গেছে বোঝা যায় না, কিছুটা চড়াই, একটু ইতস্তত করে এগিয়ে যাই, যেতে যেতে মনে হয় বেশ বড় বাঁক, শেষ প্রান্ত নেমে গেছে অনেক নিচে, তারপর আবার উঠে গেছে অনেক উঁচু পাহাড়ে, বিশাল এক সাদা ঘোড়ার ছবি ওখানে, হর্স ট্রেইল। মোটর গাড়ি মানুষকে গতি দেয়ার আগে ঝড়োগতি ঘোড়ার গাড়ি চলতো ঐ পথ ধরে, পায়ে হেঁটে এখন ওখানে পৌঁছানো যাবে না। যে খামারটা ছিল হাতের বাঁদিকে ওটা এখন ডানে। খামারবাড়ির পেছনে ডাঁই করে রাখা টুকরো কাঠের বিশাল এক স্তূপ, এখনো ভিজে, মাসখানেকের মধ্যে শুকিয়ে এলে গোলা-ঘরে উঠে যাবে, তারপর গ্রামের বাড়িঘরের চিমনি দিয়ে বেরিয়ে যাবে ধোঁয়া হয়ে। ছোট্ট একটা স্প্যানিয়েল বিশালদেহী এক শেফার্ডের সঙ্গে বাপ-বেটার মতো খেলছে, কোনো একটা কাঠের টুকরো স্প্যানিয়েলটা কামড়ে ধরলে ছিনিয়ে নেয় শেফার্ডটা, দৌড়ে রেখে আসে কিছুটা দূরে, আবার ছুটে যায় স্প্যানিয়ালটা, আবার ছুটে যেয়ে অন্যত্র সরিয়ে রাখে শেফার্ডটা, কাঠগুলো ছড়িয়ে যেতে থাকে, কোথা থেকে মনিবের হাঁক শুনে ওসব ফেলে দৌড়ে যায় দু’জনেই। খামারের পেছনে ছোট্ট একটা ঝরনা, পাহাড়ের চূড়ায় কোটি কোটি বছর আগের ছোট্ট একটা পাললিক বুদবুদ ফেটে গিয়ে গড়ে দিয়েছিল ছোট্ট এই জলাধার, খামারের এই জায়গাটা। কয়েকটা গাছ বেড়ে ওঠার পর কিছুটা সরে আসে ঝরনাটা, বাঁকা হয়েও বেঁচে আছে একটা গাছ। ওটার এক পাশের শেকড় জলে ডোবানো। দু জনেরই ইচ্ছে হয় ঝরনাটা কোন দিকে নেমে গেছে তা দেখতে। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে যাই, দূরে যেতে হয় না, দুটো পাহাড়ি ভাঁজের ভেতর দিয়ে শীর্ণ একটা নদীর মতো ডান দিকে বয়ে চলেছে। যাওয়ার পথে কোনো শিলাখণ্ড, ধারালো ম্যালাকাইট, অথবা অন্য কোনো আগ্নেয় শিলা পেলে ধুয়ে ঝকঝকে করে রেখেছে।
এটা মিশেছে আইসিসে।
কীভাবে বুঝলি?
অক্সফোর্ডের এদিকটায় আর কোনো নদী নেই।
কেন, চেরওয়েল ঘুরে এদিকে আসতে পারে না?
চুপ করে থাকে আবীর।
যে গাছটার অর্ধেক শেকড় ছিন্ন হয়ে বাঁকা অবস্থায় আবার দাঁড়িয়েছে মাথা উঁচু করে সেটাকে মনে হয় উদ্বাস্তু মানুষের প্রতীক। গাছের নিচ থেকে কয়েকটা ফল কুড়িয়ে নেই, চেস্টনাট। বাংলাদেশে এ গাছটা ছিল, এখনো আছে বলা যায় না, হাই-ঈল্ড ভ্যারাইটি হয়তো বিলোপ করে দিয়েছে। ভেষজ অনেক গুণ এই চেস্টনাটের, এর কাঠে আসবাব বানানো হয়, চেস্টনাটের খোসায় অসংখ্য নরম কাঁটা, তিনটা চেস্টনাট হাতে নিয়ে লোফালুফি করে আবীর, বেশ ভালো জাগলারই সে, একটাও মাটিতে পড়ে না, একবারের জন্য হলেও! গাছের গুচ্ছটা যেখানে শেষ হয়েছে তার আশেপাশে বুনো ফুলের ঝাড়, অনেক ল্যাভেন্ডার ফুটেছে, ট্যালকম পাউডার ও মেয়েদের শরীরের গন্ধ মিশে যা হয় তা থেকে ভিন্ন ও তীক্ষ্ণ এই ল্যাভেন্ডারের সৌরভ। ফুলের একটা মঞ্জরি তুলতে যেয়ে দেখি ঝোপের ভেতর একটা হ্যাজহগের কঙ্কাল, অনেক বছরের পুরোনো। বুনো ফুলের বাগানে কোমল এক প্রাণের অবসান! একটা কবিতাবোধ কাজ করে। প্রাণীটা মরে গেছে ওসব না জেনে, না বুঝে!
এটা বলতে পারো না, ওর বোঝার ও প্রকাশ করার মাধ্যম হয়তো ভিন্ন। তা ছাড়া, বিশ ডেসিবেলের নিচের কোনো শব্দতরঙ্গ বোঝার ক্ষমতা তোমার কানের নেই। আর এখানে কবিতা আসে কীভাবে? আমার ভেতর দুঃখবোধ কাজ করে।
ওখানেই তো কবিতা আরো বেশি ক্রিয়াশীল, তীব্র পুত্রশোকের মাঝে প্রাণভরে হাস্নাহেনার সৌরভ নেন কবি নজরুল, রচনা করেন অপূর্ব সংগীত, আঘাতে আঘাতে জীর্ণ রবিঠাকুরের অন্তর থেকে বেরিয়ে আসে রক্তরং গোলাপের মতো অসাধারণ সব কবিতা।
এখন কাব্য না হলেও চলবে।
ঠিক আছে।
কথা বাড়াই না আর। আকাশে রা দেব আগুনের গোলাটা মাথা থেকে কাঁধে নামিয়েছে, ওটার আঁচ কমে এসেছে, ওজনেও হয়েছে হালকা, খুব দ্রুত এখন পশ্চিমে নেমে যেতে পারবে দেবজী, অথচ এ সময়টাই দীর্ঘ চাই আমাদের! ঝোপের পাশে শুয়ে পড়ি দু জনে। ডান দিকের পাহাড় পেঁচিয়ে যে রাস্তাটা নিচে নেমে গেছে অনন্তের পথে, ওটার সামান্যই দেখা যায় এখন। চুপচাপ শুয়ে দাঁতে ঘাস কাটে আবীর, হালকা হতে দেই ওকে, অল্পেই আপ্লুত হয়ে পড়ে সে।
একটা কালো মাইনর গুবরে পোকার মতো ধীরে ধীরে বেয়ে ওঠে পাহাড়টা, থাকে কোথায় ওটা? প্রায় চূড়ায় উঠে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়, যাক যেদিকে খুশি। কিছুক্ষণ পড়ে ওটার গোঙানি শুনি আবার, আস্তে আস্তে কাছে আসে, আবীরও কান পেতে রাখে, স্পষ্ট শুনতে পাই ওটার ইঞ্জিনের ঘড়র-ঘর শব্দ, একটু দূরে মিলিয়ে যেয়ে আবার একেবারে কানের কাছে এসে থেমে যায়, দু জনেই ঘুরে যাই, ঝোপের বিপরীত দিকে থেমে গেছে ওটা, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। কীরে বাবা, এখানে রাস্তা এলো কোথা থেকে? তার মানে ঝোপের ওপাশ দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে কোথাও।
আরোহীদের কথা শুনতে পাই, দু জনের হাসি ও জোরে জোরে কথা বলা নীরব প্রকৃতিতে আলোড়ন তোলে। চলে যাবো কিনা ভাবছি, ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে ইঙ্গিতে আবীর বলে চুপচাপ শুয়ে থাক। ওদের খুনসুটি শুনি, একটু পড়ে বুঝতে পারি অন্তরঙ্গ হয়েছে ওরা, কান পেতে ঘাসের গুঞ্জন শুনি অগত্যা। কিছুক্ষণ পড়ে দেখি পুরোপুরি নগ্ন হয়ে ঝরনার ভেতর লাফিয়ে পড়ে ওরা। ওখানে একটা জলাধারও আছে নিশ্চয়, এখান থেকে বোঝা যায় না। সাধারণত বাইরে øান করে না এরা, তবে এটা বোধ হয় অনেক পরিচিত ওদের। ঘাড় ঘুরিয়ে উপরে তাকালে আমাদের দেখতে পাবে কিনা বুঝতে পারি না, নাও পেতে পারে, কারণ ঝোপটার সঙ্গে মিশে আছি দু জনেই, পেলেও বা কি, আমরা তো আর লুকিয়ে দেখতে আসি নি, আগে থেকেই এখানে আছি, অবশ্য কেউ দেখতে পেলো কিনা এর খুব একটা পরোয়াও করে না এরা। গ্রীষ্ম হলেও ঝরনার জল ঠাণ্ডা থাকে, একটু পরে উঠে যায়। ফিরে যেতে থাকে ওরা, যে পথে এসেছিল ও পথেই আবার গুবরে হয়ে যেতে দেখি গাড়িটাকে। আবীর জিজ্ঞেস করে –
ঝরনায় স্নান করবি?
হুঁ, বান্ধবী থাকলে চেষ্টা করা যেতো।
ওরকম জায়গাই বটে।
চিনে রাখলাম।
কিছুটা হালকা হতে শুরু করেছে আবীর। আকাশ এতো নীল হয় কি করে! কেউ যেনো কানের ভেতর ফুঁ দিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে দেয়, সুরসুরি লাগে, ঘুরে বসি। বাংলাদেশের শরতের মতো প্রকৃতি এখন, মনে মনে ভাবি কোন ঋতুটাকে ভালোবাসি বেশি, ছোট্ট শরত যে কোন দিক দিয়ে আসে যায় মনে রাখা দায়। ভালোবাসি বর্ষা, যখন সংক্ষিপ্ত। গ্রীষ্ম ভালোবাসি না নিশ্চয়। আবীরের বোধ হয় কথা বলতে ইচ্ছে হয় এখন। আবার জিজ্ঞেস করেÑ
আসবি নাকি একদিন?
আসতেও পারি।
জানাস।
কেন, লুকিয়ে দেখার জন্য?
আমার তো ইংলিশ বান্ধবী নেই, দেখাই সব।
বাধা কোথায়?
একটু যেনো বিষণ্ন আবীর। সূর্যের সোনালি আলো পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সবুজের বিভিন্ন মাত্রা সৃষ্টি করে, চোখে নেশা ধরে, ঘুমের মতো হালকা এক আবেশ জড়িয়ে ধরে জাগতিক সব কিছু ম্লান করে দেয়। এক পাইন্ট বিয়ারের জন্য গলা শুকিয়ে ওঠে। কাত হয়ে শোয় আবীর, গালিচার মতো ঘাসে চোখ রেখে বলে –
বুঝতি, যদি বাবার সংসারে থাকতি, আর সিলেটি হতি।
আমিও রক্ষণশীল পরিবার থেকেই এসেছি।
পার্থক্য আছে।
থাক, চল উঠি।
গত তিন মাসে একটা চিঠিও লেখা হয় নি আমার দেশের সাদা মেঘেদের কাছে, বুকের ভেতর মেঘ গুরগুর করে, ব্যাঙের করতলের মতো ফুলে ওঠেছে হাতের তালু দুটো, হালকা করার কোনো সুযোগই হয়ে ওঠে নি।
অক্সফোর্ডের সিটি সেন্টারের একটা বেঞ্চে বসে দেখি বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষজনের বিচিত্র চালচলন। সিটি সেন্টারটা তুলনামূলকভাবে খুব ছোটো। কারফ্যাক্স টাওয়ার ঘিরে বড় একটা চত্বর, কর্ণমার্কেট স্ট্রীট ও কুইন স্ট্রীটের একটা জাংশানের মধ্যে সীমিত। সিগারেট শেষ করে ব্ল্যাকওয়েলস বুকসপে ঢুকি, কোনো একটা কক্ষের ভেতর ইউরোপের সব চেয়ে বড় বইয়ের দোকান এটা, দশ হাজার বর্গফুট আয়তন। বইয়ের গন্ধে মন ভরে যায়। অনেক সময় দ্বিধায় পড়ে নিজেকে শুধাই, কোন গন্ধটা বেশি প্রিয় আমার, বই, না ফুলের? বই কিনি না, ঘুরে ঘুরে দেখি, পছন্দ করে রাখি, লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়া যাবে সময় মতো।
দারুণ সবুজ এই অক্সফোর্ড শহরটা, অনেকগুলো পার্ক আছে এ শহরে। সিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাউথ পার্কে এসে বসি, এতো সুন্দর একটা পার্ক, অথচ হাতে-গোনা ক’জন মানুষ! ঢাকা শহরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য একটু খোলা জায়গা পাওয়া যায় না, অথচ এদের প্রতিটা পাড়ায় একটা পার্ক আছে। বড় একটা সবুজ চত্বর দেখে ফুলের মেলায় বসে পড়ি কোমল মখমলের মতো ঘাসের উপর। কথা বলার কেউ নেই, বাদাম চিবুতে পারি না, খুব কষ্ট পাই মনে মনে!
এ হপ্তাহান্তটা পুরোপুরি ভবঘুরে হয়ে কাটাবো ভাবছি। বইয়ের পাতা ওল্টাবো না, কারো সঙ্গে আড্ডা না, নো রান্নাবান্না, নো টাইডি-আপ। পার্কে বসে থেকে ঝিমুনি আসে। ঘুমিয়ে পড়ার মতো জায়গাই বটে। কোনো এক কালে বাংলাদেশের অনেক গ্রামে বটের ছায়ায় দড়ির খাটিয়া পেতে গ্রীষ্মের দুপুরে অলস সময় কাটাতে পারতো সাধারণ মানুষজন। এখন কারো কারো স্মৃতিতে হয়তো রয়ে গেছে সেসব। বট গাছের ইংরেজি নাম কেন বেনিয়ান ট্রী হয়েছিল বুঝতে পারি না, এখানে বেনিয়ান নামে কোনো গাছ নেই। এই বেনিয়ান শব্দটার অর্থই বা কি? আসলে বাংলার বটবৃক্ষতুল্য কোনো গাছই এদেশে নেই।
পতিতা ও পুলিশের আনাগোনা নেই এসব দেশের পার্কে, বুড়োবুড়িরা সময় কাটায় এখানে, তরুণতরুণীরা খুব একটা আসে না। ঘাস থেকে উঠে একটা বেঞ্চে শুয়ে পড়ি। ঢাকার রমনা পার্কের একটা স্মৃতি মনে পড়ে। ক্লাশ নাইনে পড়ার সময় অভিমান করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম একবার, সঙ্গে ছিল আরেক বন্ধু। পালিয়ে তো এলাম ঢাকায়, কিন্তু কি করবো, কোথায় থাকবো কিছুই জানি না। কোনো পরিকল্পনা তো ছিল না। সারাদিন রমনা পার্কে কাটাই আর ভাবি। বাদাম আর ঝালমুড়ি কিনে খাই। মসজিদটা বানিয়ে পার্কের কান কাটে নি তখনো, নাহলে হয়তো মসজিদে যেয়ে ঘুমাতে পারতাম। নিরিবিলি একটা ঘুুপচি দেখে ঘুমিয়ে পড়ি পার্কের ভেতর। ঘুম যে কত গভীর হতে পারে এখন মনে পড়ে হাসি পায়। আজকালের মতো এতো কায়দা-কানুন আমাদের জানা ছিল না তখন। টাকা পয়সা লুকিয়ে রাখার গোপন জায়গার মধ্যে নিরাপদ ছিল প্যান্টের ফ্লাই। পকেটমারের জন্য তখনই বিখ্যাত ঢাকা শহর, খুচরো-টুচরো সব বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলাম। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দু বন্ধুর কেউই বুঝতে পারি না কোথায় আছি। পায়ের স্যান্ডেল তো নিয়ে গেছেই, গায়ের শার্ট কীভাবে খুলেছে ভেবেই পাই না। প্যান্টের ফ্লাইয়ের ভেতর থেকে রোল করা পাঁচ টাকার নোটটা বের করে নিয়ে গেছে একটুও টের পাই নি। দু জনেরই প্রায় একই দশা। তখন ওরা বেশ রসিকও ছিল, পকেটে রুমাল রাখার প্রচলন ছিল সেসব দিনে, দু জনের জন্য আট আনা পয়সা আমার রুমালে গিঁট দিয়ে বেঁধে রেখে গেছিল। ঐ অবস্থায় কীভাবে বাড়ি ফিরে আসি, মনে হলে এখনো আতঙ্কিত হই!
পার্কের একাকীত্ব¡ ছেড়ে আবার সিটি সেন্টারের জনসমাগমে আসি। একটা নাচের দল হুট করে আসে কোত্থেকে, চৌরাস্তার ক্রসিঙে ওদের দলনেতা দাঁড়িয়ে উঁচুগলায় দলের সদস্যদের পরিচয় দেয়, দশ মিনিটের একটা নাচ দেখাবে ওরা। অক্সফোর্ডশায়ারের বিখ্যাত লোকনৃত্য, ওটার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও দলের কার্যক্রম ব্যাখ্যা করে। ওর কথা বলার ফাঁকে গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়েছে দর্শক-শ্রোতা, আমিও মিশে যাই ওদের সঙ্গে। ড্রাম বাজতে শুরু করে, দর্শকেরাও পা দিয়ে তাল ঠোকে নাচের ছন্দে। আমাদের লাঠি খেলার মতো অনেকটা, তবে মেয়ে-নাচিয়েও আছে এদের দলে। সবার মুখ থেকে গলা পর্যন্ত সাদা ও কালো রঙে রং করা, পোশাকও সাদা ও কালো, লাল রঙের ক্রসবেল্ট পড়নে সবার। অসাধারণ একটা নাচ দেখালো, হাততালি দিয়ে ওদের অভিবাদন জানায় সবাই। অনেকে ছবি ওঠায় ওদের সঙ্গে। গ্রীষ্মের এ সময়টায় প্রতি হপ্তাহান্তেই নাচের অনুষ্ঠান করে ওরা। অক্সফোর্ডশায়ার কাউন্সিল থেকে অর্থায়ন করা হয় ওদের। ঐতিহ্য ধরে রাখার চমৎকার উদাহরণ।
পৃথিবীর অনেক দেশের খাবারের স্বাদ নেয়া যায় অক্সফোর্ডে বসে। ইটালিয়ান একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকি দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য, ‘লা ডোলচে ভিটা’, এ রেস্টুরেন্টের শাখা বিলেতের প্রায় সব বড় শহরে আছে।
চেরওয়েল ও আইসিস নদী দুটো অক্সফোর্ডের দুই ধমনি, অক্সফোর্ডশায়ারের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া টেমসের অংশটাকে ওরা আইসিস নামে ডাকে। শস্য ও প্রকৃতির দেবী আইসিস। অক্সফোর্ডশায়ারের প্রকৃতি সত্যিই অনন্য সুন্দর, এতো সবুজ, এতো শ্যামল, চোখ জুড়িয়ে যায়। টেমসের এই আইসিস অংশটার সঙ্গে লন্ডনের টেমসকে কোনোভাবে মিলানো যায় না। ঐতিহাসিকভাবে অক্সফোর্ড শহর বিখ্যাত টেমসের এ অংশের নদী বন্দরের জন্য। শহরের দুই প্রান্তে আইফলি ও ওসনি লক নির্মাণ করে নদীর নাব্যতা রক্ষা করা হয়েছে। অক্সফোর্ড ক্যানাল তৈরি করে বিলেতের মধ্যাঞ্চলের সঙ্গে এর সংযোগ দেয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই সব নদী ও ক্যানালে চলাচলকারী অনেক প্রমোদতরী রয়েছে। তিন ঘণ্টার একটা রিভার ক্রুইজিংএ উঠি বিলেতের বিখ্যাত ‘সল্টার্স স্টীমার্স’এর একটা সুন্দর জাহাজে। অপূর্ব এই নৌ-ভ্রমণ মনে থাকবে আজীবন।
প্রকৃতির দেবী আইসিস অক্সফোর্ডশায়ারকে দিয়েছে অঢেল প্রাচুর্য। গমের ফলন হয় এখানে খুব ভালো, অনেকগুলো ব্রুয়ারি গড়ে ওঠেছে। বিখ্যাত মোরেলস ব্রুয়ারি দেখতে আসি রোববার সকালে। পারিবারিক এ ব্যবসাটা হাতবদল হয়ে শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয় পরের শতকে এসে।
অনেকটা পথ হেঁটে দশ ডিগ্রির কম কৌণিক ঢালের একটা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে অনেক বড় একটা প্রায় সমতল পেয়ে যাই, উত্তল লেন্সের পিঠের মতো অনেকটা। এক বেচারা চাষা, এ শব্দটা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হতদরিদ্র নিরক্ষর ভাঙ্গাচোরা মানুষের মুখ মনে পড়ে। এর বিপরীতে ট্রাক্টরের ড্রাইভিং সীটে বসা লালমুখ বিশাল এই মানুষটা মনের ভেতর ছোট্ট একটা আঁচড় কাটে। শিল্পী সুলতান ইউরোপে থাকার সময় পাহাড়ি জমিতে এমন কোনো চাষার হাল দেয়ার দৃশ্য দেখেছিলেন হয়তো, কল্পনায় আমাদের চাষীদেরও ওরকমভাবে এঁকেছেন। গগার নিসর্গের ছবির মধ্যে কৌণিক স্ট্রোকের একটা বিশেষত্ব যেমন নিশ্চিতভাবে বলে দেয় এগুলো গগার ছবি, তেমনি সুলতানের সার্কুলার স্ট্রোকের বিশেষত্ব বিশেষভাবে চিনিয়ে দেয় এগুলো সুলতানের। একজন শিল্পীর মেধার পাশাপাশি তার পৃষ্ঠপোষকতাও জরুরী। না ব্যক্তি, না সমাজ, না রাষ্ট্র, বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর পৃষ্ঠপোষকতা করে। অথচ এসব ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের তুলনা নেই, এজন্যই এগিয়ে গেছে ওরা, আর আমরা ঐ তিমিরেই, এখনো মধ্যযুগীয় কীর্তন গাইছি। ছবি আঁকা পাপ বলে এক সময় প্রচার করেছে যারা, তারাই এখন নিজেদের মেহেদিরাঙানো কুৎসিত ছবি ফেরি করে দরিদ্র ও নিরক্ষর মানুষের কাছে।
রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে জমিটার শুরু সেখান থেকে, এক টুকরো ঘাসের আচ্ছাদন দেখে বসে পড়ি, বুঝতে পারি হেঁটে কেউ আসে না এখানে। এত বিশাল একটা জমি, কয় শ একর হবে কে জানে, একা একা চাষ করছে লোকটা। ফসল বুনবে একা, কাটবে একা, গোলা ঘরে তুলবে একা, শুধু একটা যন্ত্র সহায়, যন্ত্র তো নয় দানব, আমাদের কয়েক শ চাষীর প্রয়োজন এমন একটা প্রান্তর আবাদ করতে। অবশ্য এতো বড় শস্যক্ষেত আমাদের দেশে তো নেইই।
চাষীভাইয়ের বোধ হয় ব্রেকটাইম, ট্রাক্টরটা নিয়ে এদিকে আসে। ঘাসের এদিকটায় আরেকটু সরে বসি, আরো কিছু সময় কাটাতে ইচ্ছে হয়। রাস্তার মাথায় এসে থেমে যায়, কিছুটা অবাক হয় আমাকে দেখে।
হাই আ?
অ’রাই মী।
আ’ ইউ ওয়চিং মি? আমুদে চোখে তাকায় লোকটা।
ইয়া ইয়া, আ’এম ওয়চিং ইউ। ইউ আ’ ডুয়িং ভেরি ফাইন।
দেন ইউ হ্যাভ টু অফার মি আ সিগারেট। বলে পকেট থেকে একটা সিগারেট নিজেই বের করে দেয়। বুঝতে পারি ভাগ্য আজ ভালো, মজার এক মানুষের সঙ্গ পেয়ে গেছি। ইংরেজরা সাধারণত মিশুক না, যদি কেউ মিশে, তাহলে আবার খোলাখুলি।
আমি ব্রেকে যাচ্ছি, ততক্ষণ ট্রাক্টরটা চালাবে নাকি?
হেসে উঠি আমি।
সাইকেলই চালাতে জানি না।
বলে কি! তোমাকে ইংল্যান্ডে ঢুকতে দিয়েছে কে?
দেয় নি কেউ, নিজেই ঢুকেছি।
বাহ্, তাহলে তো তুমি এক হিরো। এখানে একা বসে কি করবে। নিচে যাবে নাকি, বিয়ার টানতে পারবে এক পাইন্ট।
কেন, ভয়ে হচ্ছে, তোমার ট্রাক্টর নিয়ে পালাবো?
এই তো ধরে ফেলেছো, বেশ বুদ্ধিমানও বটে, কোন দেশের লোক হে তুমি?
চলো, নিচেই যাই, তোমাকে দুঃশ্চিন্তায় রেখে লাভ নেই, আর দেশ-টেশ ঘেঁটেও বিশেষ কিছু হবে না।
সাড়ে ছ’ফুট তো হবেই বেটা, বুকের ছাতি কম করে হলেও বাষট্টি, লম্বা বেশি হওয়ার কারণে এতো যে মোটা বোঝা যায় না তেমন, মধ্যযুগীয় কোনো নাইটের বংশধরের পোলাটোলা হবে হয়তো। রোদে পুড়ে চামড়া টকটকে লাল, গায়ের আসল রং বোঝা যায় চামড়ার ভাঁজে, মুখের বলিরেখায়। রোদে কাজ করে যারা, প্রায় সারাক্ষণ চোখ কুঁচকে থাকতে হয় বলে চোখের কোনায় গভীর ভাঁজ পড়ে। ভাঁজের ভেতর রোদ ঢুকতে না পারায় ধবধবে সাদা থাকে ওখানটা। সাধারণ আলোয় আসে যখন, মনে হয় চোখের দু পাশে সাদা রঙের দাগ টানা। চোখের বলিরেখা বোঝা যায় স্পষ্ট।
নিচে নেমে দু মিনিট হাঁটার পরই দেখি যেদিক থেকে এসেছি তার উল্টোদিকে সুন্দর একটা গ্রাম, রাস্তার ওদিক থেকে বোঝাই যায় নি, কোথায় লুকিয়ে ছিল এটা! ওর সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারি নদীর ওপারের কাউলিতে কাজ করে এখানের অনেকে। নদীর অপর তীরে গড়ে উঠেছে বিখ্যাত শিল্প এলাকা কাউলি। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত মোটরগাড়ি নির্মাতা কোম্পানি মোরিসের অবস্থান এখানে, অসংখ্য ভারি শিল্প কারখানা, প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি প্রভৃতি গড়ে ওঠে এখানে। স্পষ্ট দু ভাগে ভাগ করা যায় অক্সফোর্ড শহরটাকে, চেরওয়েল নদীর উপর বানানো ম্যাগডালেন ব্রীজের পশ্চিমে বিশ্ববিদ্যালয় শহর, ও পুবে শিল্প শহর কাউলি। এখানের অধিবাসীরা কৌতুক করে বলে, কাউলির বাম তীর হচ্ছে অক্সফোর্ড। বাংলাদেশের রাস্তার রাজা ছিল এক সময় লেইল্যান্ড ট্রাক, বিখ্যাত এই লেইল্যান্ড কোম্পানির গাড়ি বানানো হয় এখানে, এক দিন ঘুরে ঘুরে দেখে এসেছিলাম কোম্পানিটা। লেইল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশে ছিল বেডফোর্ড ট্রাক, এখন ঐসব বিখ্যাত কোম্পানির জায়গা দখল করেছে ভারতের লক্কর-ঝক্কর সব কোম্পানি, পাঁচ ছয় বছর পর যেগুলোকে স্ক্র্যাপ করতে হয়, অথচ ঐসব লেইল্যান্ড অথবা বেডফোর্ড বিশ ত্রিশ বছর বেশ ভালোভাবে চালানো যেতো। জাপানি গাড়ির জোয়ারে লেইল্যান্ড কোম্পানিও একসময় বন্ধ হয়ে যায়। কাউলি শহরটাই প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
এক পাইন্ট বিয়ারের সঙ্গে এক প্লেইট ফ্রাই ও মীট-বল-অন-সস নিয়ে বসি। ইংলিশ খাবার কোথায় যে স্বাদ আর কোথায় বিস্বাদ বুঝে উঠতে পারি নি এখনো। মীটবলগুলো এতো সুস্বাদু যে আবার খেতে ইচ্ছে করে।
খাবার দোকান থেকে বেরোনোর সময় ও বলে –
যাবে নাকি ট্রাক্টর চালাতে? আমার নাম নিকোল।
আমি ডেয়ুড। সত্যি বলছো?
চোখ কুঁচকে তাকায়। গোঁফ-জোড়া ওর দেখার মতো, দাঁতগুলো বিশ্রি, হলদে। অবশ্য এটাই এদের আসল রং।
নাহ্, জৌক করলাম, আজকের কাজ শেষ আমার। বাসায় যেয়ে শাওয়ার নেবো, তারপর বিশ্রাম।
ঠিক আছে, ভালো থেকো।
একটা সিগ্রেট এগিয়ে দেই, একগাল হেসে ধন্যবাদ জানায়।
সি ইউ, বাই।
বাআই।
ভালোভাবেই জানি জীবনে হয়তো আর কোনোদিনই দেখা হবে না ওর সঙ্গে। আজকের দিনটা কোনো এক রোববারের স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে আমার সঙ্গে। নিকোলের হয়তো মনেই থাকবে না ডেয়ুড নামের কোনো মানুষের সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল। জীবন এমনই!
রাতে বাসায় ফিরে চুপচাপ শুয়ে থাকি বিছানায়, আর ভাবি এখানের সাধারণ মানুষগুলো তো আমাদের সাধারণ মানুষজনের চেয়ে বেশি চালাক-চতুর না, এদের ভেতর থেকে কীভাবে এতো ভালো নেতৃত্ব গড়ে ওঠে যে পুরো জাতিকে টেনে এতোদূর নিয়ে যেতে পারে! কীভাবে এতো ভালো থাকে এরা আর আমরা এতো অধোপাতে! ভাবনাটা ঝেড়ে ফেলি মাথা থেকে, আমি তো আর রাজনীতি করতে যাচ্ছি না।
অক্সফোর্ড শহরই নয় শুধু, পুরো অক্সফোর্ডশায়ার কাউন্টিটাই আমার হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে। এর গ্রামগুলো অসাধারণ সুন্দর, ইংল্যান্ডের সৌন্দর্য বোঝাতে এর গ্রামগুলোই বোঝায়, এতো সুন্দর সাজানো-গোছানো গ্রাম পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। গ্রামগুলো বলতে বিচ্ছিন্নভাবে থাকা গ্রামের সমষ্টি বোঝায়। প্রতিটা গ্রাম পৃথক, কোনোটার গায়ে কোনোটা লেগে নেই। উঁচু জায়গা থেকে, অথবা কিছুটা দূরে থেকে পুরো একটা গ্রাম বিচ্ছিন্নভাবে চোখে পড়ে। বাংলাদেশের কোনো গ্রাম অন্য গ্রাম থেকে পৃথক করা যায় না, হাজার হাজার গ্রাম মিশে রয়েছে এক সঙ্গে, বড় একটা গ্রামের মতো। অসংখ্য নদী ও খাল বিল যদি না থাকতো, তাহলে পুরো বাংলাদেশটাকেই বড় একটা গ্রাম বা বস্তি বলা যেতো। বাংলাদেশে কোনো একটা গ্রামের ছবি কখনোই দৃষ্টির ভেতর ধরা যায় না, গ্রামের ভেতরে থেকে না, বাইরে থেকেও না। বড় কোনো বিল বা হাওরের মাঝখান থেকেও গ্রামগুলোকে চেনা যায় না। চারদিকে দেখা যায় সবুজ গাছপালার বিস্তার, কোথাও বিচ্ছিন্নতা নেই। ঐসব গাছপালার ফাঁকে ঘরবাড়িও চোখে পড়ে না। এক সময় কিছুকিছু মঠ ও মন্দিরের চূড়া দেখা যেতো দূরে থেকে, ওসব দেখে বোঝা যেতো কোনো লোকালয়ের অবস্থান, এখন সেগুলোও সব ভেঙ্গে ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
সৌন্দর্যপিপাসু মানুষেরা দেশে দেশে আর্টগ্যালারি, মিউজিয়াম, থিয়েটার হল এসব ঘুরে বেড়ায়। মহাজনদের অনুসরণ করে আমিও যাই, কিন্তু সব চেয়ে বেশি ভালো লাগে আমার নদী। আইসিস ও চেরওয়ালের তীরে ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেই। নদী দুটোর নৈসর্গিক দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দেয়, পুরোপুরি মন ভরিয়ে দেয়, খুব ইচ্ছে নদীতে নেমে সাঁতার কাটি, কিন্তু এখানে এটা হবার নয়। বাংলাদেশের নদীগুলোর কাকচক্ষু জলে সাঁতার কাটায় কী যে আনন্দ, স্রোতের ভেতর গা ভাসিয়ে ভাটিতে নেমে যাওয়া, আবার স্রোতের বিপরীতে উজানে সাঁতরে আসা, মনে হলে শিহরণ জাগে। সব চেয়ে মজা হতো, শীতকালে পানিতে নামার আগের মানসিক প্রস্তুতি ও আয়োজন, পানিতে নামার পর এতো ঠাণ্ডা লাগতো না, পানির উপরের স্তরের এক দু হাত নিচেই ছিল গরম পানি। স্পষ্ট বোঝা যেতো দু স্তরের তাপমাত্রার পার্থক্য, অনেকক্ষণ ডুব দিয়ে থাকলে অন্যরকম এক আনন্দ পাওয়া যেতো। সকালের দিকে নদীর উপর থেকে সাদা ধোঁয়ার মতো বাষ্প উঠতো, নদীর তীরে খুঁটিতে বাঁধা রশিতে এক থোকা ডালপালার ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা চিংড়ি মাছ ধরার এটাই ছিল ভালো সময়। মাছ ধরার উত্তেজনায় ঠাণ্ডা যেনো লাগতোই না, সাবধানে পানিতে নেমে ঝটিতি টানে পুরো ডালপালার ঝাড়টাকে ডাঙ্গায় উঠানোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যেতো চিংড়িদের লাফানো, দু একটা সাপও নেমে যেতো দৌড়ে। বড় চিংড়িগুলো রেখে ছোটোগুলো আবার পানি ছিটিয়ে নদীতে ছেড়ে দেয়া, চমৎকার একটা স্পোর্টসের আনন্দ পাওয়া যেতো।
মাঝে মাঝে দেখা যায় নৌকো থেকে আইসিস অথবা চেরওয়েলে বড়শি ফেলে কেউ কেউ বসে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মাছ ওঠাতে ওদের দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। হাউসবোটে বাস করে অনেকে, দু চারটা ধনী পরিবার সখ করে কাটায় কিছুদিন, অনেকে আবার ভবঘুরে, কাউন্সিল ট্যাক্স নেই, ঘরভাড়া দিতে হয় না, নৌকোর ও নিজেদের পেটের জ্বালানি কোনোভাবে সংগ্রহ করতে পারলেই হয়। মনের ভেতর একটা আশা রয়েছে বাংলাদেশে একটা হাউসবোট বানিয়ে নদীগুলোয় ভেসে বেড়াবো কয়েক বছর। নিরাপত্তার কথা ভেবে পিছিয়ে যেতে হয়।
সেদিনের ট্রাক্টর চালানো দেখার পর নিকোলের সঙ্গে দেখা হয়েছে আরো অনেকবার, আশাই করতে পারি নি! এক ধরনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে ওর সাথে। নিয়মভঙ্গ করে, ইংরেজরা সাধারণত যা করে না, ট্রাক্টর চালানো শিখিয়েছে আমাকে। রক্তে আমার চাষারু জিন, আমার ভালো লাগে চাষবাস, অথচ পড়তে হচ্ছে রেডিওলোজি নিয়ে পিএইচডি! খুব ইচ্ছে, ইংল্যান্ডে একটা খামার কিনে চাষা হই। নিকোলরা দু ভাই, গ্রীষ্মকালটা চাষাবাদ করে নিকোল, ফসল উঠিয়ে গোলা ভরে ছোটো ভাইয়ের হাতে চাবিটা দিয়ে পাড়ি দেয় অস্ট্রেলিয়া। প্রায় পুরো শীতকাল কাটায় ওখানে, অস্ট্রেলিয়ায় তখন গ্রীষ্ম। সেকেন্ড হোম ধারণাটা ওর কাছ থেকে ধার করি। অস্ট্রেলিয়া নাকি ওর সেকেন্ড হোম, স্ত্রী ও দু কন্যা থাকে ওখানে। অস্ট্রেলিয়ার শীতের ছুটিতে ইংল্যান্ডের গ্রীষ্ম কাটায় ওরা, ভৌগোলিক এ সুবিধেটা কীভাবে উপভোগ করে ভেবে চমৎকৃত হই। মনের ভেতর সেকেন্ড হোম ধারণাটা জেঁকে বসায় এমন একটা খামারের স্বপ্ন দেখি। পিএইচডি শেষ করার পর হয়তো কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে ও ছাত্র পড়াতে হবে। বইয়ের পাতায় চোখ রেখে জীবন কাটানো, ভাবতে ভালো লাগে না, মাঝে মাঝে মনে হয়, ভুল একটা জীবনের দিকে এগিয়ে চলেছি নাকি?
গ্রামের কৃষকদের ছবি যখন স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, শিহরিত হই। প্রচণ্ড শীতের রাতে শেষ প্রহরে উঠে হুক্কা টানতে টানতে দিনের প্রস্তুতি নেয়। খালি পায়ে, শরীরে একটা পাতলা কাঁথা জড়িয়ে হাল নিয়ে বেরিয়ে যায়। জমিতে লাঙল চালাতে যেয়ে শীতের মধ্যেও ঘেমে ভিজে ঐ কাঁথাটাও জমির আলে রেখে দেয়। বাইরে থেকে যেমনই লাগুক, ভিতর থেকে দেখলে বোঝা যায় কত কষ্টের ঐ জীবন। এখানেও হয়তো প্রকৃত চাষাবাদের কাজ শুরু করার পর বোঝা যাবে বিষয়টা আসলে কেমন। কল্পনায় তো অনেক কিছুই করা যায়, রক ক্লাইম্বিং বা তুষারাবৃত পর্বতারোহণ, স্কাই ডাইভিং, অথবা স্টান্টম্যানের দুঃসাহসী কোনো কাজের ফুটেজ টিভি পর্দায় দেখে শিহরণ পাওয়া যায়, নিজে কখনো ওটার ভেতর প্রবেশ করলে বোঝা যায় শিহরণটা কোথায়, আর কাজটা কত পরিশ্রমসাপেক্ষ।
চাষবাসের জন্য না হলেও সেকেন্ড হোম হিসেবে আমার মনের গভীরে প্রবেশ করে ইংল্যান্ড।
অচিরেই বুঝে যাই যে নিকোলের খামারটার মতো একটা খামার কোনো দিনই হবে না আমার, এমন একটা স্বপ্ন মনের ভেতর ধরে রাখাও অর্থহীন। এটার প্রভাব কাটাতে যেয়ে নিকোলের সঙ্গে বন্ধুত্বটাই বরং গাঢ় হয়ে ওঠে। যে-কোনো অবসরের দিন ওর সঙ্গে কাটাতে পারি বলে জানায় সে। খুব বেশি বন্ধুবান্ধব নেই নিকোলের, ফলে প্রায় প্রতি হপ্তাহান্তে সঙ্গ পাওয়া যায় ওর। এখানের চাষাবাদ ও ফসল সম্পর্কে অনেক কিছু জানায় সে। অনেক গাছপালা, বুনো ফুল ও ফলের নাম জেনে নেই। নিকোল বলে, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে তোমাকে, নাহলে কখনোই চাষী হতে পারবে না। অনেক কিছু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসে এখন প্রায় এদেশেরই হয়ে গেছে। ওদের প্রধান খাবার যে আলু, ওটাই এসেছে আমেরিকা থেকে। একদিন জিজ্ঞেস করি ওকে, তাহলে নিজের কি ছিল তোমাদের? হেসে বলে, তোমাদেরই বা কি ছিল? পৃথিবীর সবকিছু ভাগাভাগি করে নিয়েছি আমরা, তোমাদের ওখানেও অনেক গাছপালা, প্রাণী, এসবের অনেক কিছু বাইরে থেকে গেছে। চা না-হলে যে এক বেলাও চলে না তোমার, ঐ গাছটা কোথা থেকে গেছে বল তো? ইংল্যান্ডকে এক সময় বলা হতো কান্ট্রি অব মিল্ক এন্ড হানি। আমাদের পশুপালন ছিল খুব উন্নত, অনেক মাছ ছিল উত্তর সাগরে, আটলান্টিক উপকূলে, উন্নত জাতের সরিষার ফলন হতো প্রচুর, যেখানে মৌমাছির আবাস ছিল, অঢেল মধু উৎপাদিত হতো। আপেল, প্লাম, স্ট্রবেরি থেকে শুরু করে অনেক ফলমূল প্রচুর পরিমাণে জন্মাতো। রোমানরা তো এমনিতেই বারবার আক্রমণ চালায় নি এ-দেশটায়। সারা পৃথিবী থেকে এখনো হাজার হাজার মানুষ এখানে আসছে, কেন বল তো?
ওর কথায় যুক্তি আছে নিশ্চয়।
নিকোলের সঙ্গে সময় কাটিয়ে একজন প্রকৃত ইংরেজ কৃষকের সঙ্গে কথা বলার আনন্দ পেয়েছি। ওর বিশাল দেহ, থুতনি পর্যন্ত নামানো গোঁফ, আর একটু নামলে খসে পড়ে যাবে এমন এক ভাব, কিছুটা বেরিয়ে থাকা নীল চোখ, ও প্রাণখোলা হাসি আমাকে আকৃষ্ট করেছে ওর প্রতি। ওর বাড়িতে নিয়ে গেছে আমাকে অনেক দিন। গ্রামের এসব বাড়িঘর দেখে বোঝা যায় ওদের পূর্বপুরুষদের মেধা ও পরিশ্রমের সমন্বয় কীভাবে ঘটেছিল। ওরা যে বলে ‘ঈগেলেটেরিয়ান সমাজ’, সেটা কীভাবে বিকশিত হয়েছিল বুঝতে পারি কিছুটা। একই গ্রামে বিশাল এক সাতমহলা জমিদারবাড়ি ঘিরে শত শত দরিদ্রবস্তি গড়ে ওঠে নি। গ্রামের প্রায় সব ঘরবাড়ি একই রকম। কাঠ ও পাথরে তৈরি, এসবের নির্মাণও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করতে হয়েছিল, কোনো কোনো বাড়ি গ্রামের সমান বয়সের, পাঁচ ছয় শ বছর আগে এসব জনপদ গড়ে ওঠে। পাথর গেঁথে, কাঠের কড়িবর্গা বসিয়ে বেশ বড় আকারের দ্বিতল এসব বাড়িগুলোর ভেতর অদ্ভুত এক প্রাচীনত্ব লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটা বাড়িতে ঘোড়ার জন্য আস্তাবল, গোলাঘর, খোঁয়াড় প্রভৃতি রয়েছে। অনেক গ্রামে এখনো কয়েক শ বছর আগে বানানো হাওয়াকল রেখে দিয়েছে স্মৃতি হিসেবে। বাড়ির সামনে ও পেছনে ফুলের বাগান, খোলা জায়গা, আপেল ও অন্যান্য ফলমূলের গাছ, সবুজ চত্বর, সবই রয়েছে। কোনো কোনো বাড়িতে কৃত্রিম ঝরনা ও নালা আছে, সেখানে ছোটো ছোটো কয়েক প্রজাতির মাছ ও ব্যাঙ রয়েছে। বেশির ভাগ বাড়ির ছাদে টালি-বসানো, দু একটা বাড়ির ছাদ দেখা যায় এক ধরনের শনে ছাওয়া, এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ আজকাল খুব ব্যয়সাপেক্ষ, রক্ষণশীল ও বিত্তশালী কোনো পরিবার ঐতিহ্য হিসেবে এখনো রেখে দিয়েছে ওরকম দু একটা ছাদ। খুব ধনবান মানুষদের বাড়ি থাকে গ্রামের বাইরে, মধ্য-যুগের নাইটদের এবি, অথবা ছোটোখাটো সামন্তদের একটা বাড়ি ও আশেপাশের জায়গা মিলিয়ে বাংলাদেশের কয়েকটা বড় গ্রামের সমান। ওগুলোর বেশির ভাগই এখন ন্যাশনাল হ্যারিট্যাজ। যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, এবং দর্শনীর বিনিময়ে ওসব দেখা যায়। পুরোনো দিনের এসব নাইটরা বাংলাদেশের জমিদারদের মতো অত্যাচারী ছিল না। বরং গ্রামগুলোর রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করতো এবং সবার সুখদুঃখের ভাগী হতো। নিজেদের বাহিনীর জন্য সৈন্য সংগ্রহ করতো এসব গ্রাম থেকে। এরাই রাজার বাহিনী হয়ে যুদ্ধে যেতো। ওদের মধ্যে ব্যতিক্রম যে ছিল না, তাও না, বাংলাদেশের এক-দু জন প্রজাদরদী জমিদারের মতো বিপরীত স্রোতে ছিল ওদের অবস্থান। সে-সবের বিরুদ্ধেও রবিনহুডের মতো দল গড়ে উঠতো।
ইংল্যান্ডের গ্রামীণ এই জনপদের ভেতর, নিকোলের মতো মানুষের মাঝে এদেশের প্রকৃত সংস্কৃতির সন্ধান পাই। অথচ নটরড্যাম কলেজে পড়াকালীন সময়ে যে ইংরেজদের সঙ্গে সামান্য মেশার সুযোগ হয়েছিল ওদের অতি-ফর্মাল আচরণ যে কত বেশি কৃত্রিম ছিল, এখন বুঝতে পারি। ওসব মেকি আচরণের স্মৃতি ধরে কল্পনায় বিভ্রান্ত হয়েছি ওদের নিয়ে। এখন বুঝি আমাদের কবির ঐ বাণী, ‘নানা রঙের গাভীরে ভাই একই রঙের দুধ, সারা জগৎ ভ্রমিয়া দেখি সব একই মায়ের পুত!’