কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
উনিশ.
সাক্ষী-সাবুদ রাখেনি মহব্বত তাতে কি, আলাউদ্দিন হত্যার সাক্ষীর অভাব হবে? গরানপুরের কেউ সাক্ষী না দিলে হরিনগরের মানুষ দেবে। হরিনগরের কেউ না দিলে দাঁতিনাখালীর মানুষ দেবে। সারা মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কেউ যদি সাক্ষী না দেয়, ছবেদালি প্রয়োজনে শ্যামনগর থেকে হেদায়াতে ইসলামির কয়েক ডজন নেতা-কর্মী সাক্ষী হিসেবে আদালতে হাজির করবে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কোরান শপথ করে তারা সাক্ষী দেবে, শহীদ আলাউদ্দিন ছিল দ্বীন-এসলামের সেবায় নিয়োজিত আল্লার একজন পেয়ারে বান্দা। এলাকার মানুষ ভালোবেসে তাকে গরানপুর ইসলামিয়া মাদ্রাসার সহসভাপতি করেছিল। যারা গোনের দিঘির পাড়ে নবীর ঘর মাদ্রাসার বদলে স্কুল করতে চেয়েছিল, আর কেউ নয়, এই হত্যার পেছনে তারাই জড়িত। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী। মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খসরু তালুকদারের হুকুমে গরানপুরের হিন্দুরা আলাউদ্দিনকে খুন করে ভাঙা কবরে মাটি চাপা দিয়ে রাখে।
আলাউদ্দিনের বউ রেশমা বাদী হয়ে থানায় মামলা করল। দায়ের মানে, এজাহারে শুধু সে স্বাক্ষরটা করেছে, বাকি সবই করেছে ছবেদালি। আসামি করা হলো পনেরোজনকে। তিনজন ছাড়া বাকি সবাই হিন্দু। এজাহারের সারসংক্ষেপ এই – রাত আনুমানিক তিনটায় জাবেদ খানের নেতৃত্বে গ্রামের একদল হিন্দু অস্ত্রের মুখে আলাউদ্দিনকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ঘটনার সময় মহেশ্বর ও মহসিন মেম্বারও উপস্থিত ছিল। একজনের হাতে ছিল ডেগার, অন্যজনের হাতে বটি। আলাউদ্দিনের ছোট ভাই মহব্বত হোসেন এবং মণ্ডলবাড়ির গোপেশচন্দ্র মণ্ডল মিলে শাড়ির আঁচলে রেশমার মুখ বেঁধে ঘরের খুঁটির সঙ্গে তাকে পিছমোড়া বেঁধে রাখে। পরদিন ভোরে মাজেদ গাইন এসে রেশমার হাল দেখে ছবেদালি চেয়ারম্যানকে খবরটা দেয়। চেয়ারম্যান রাখাল ময়রাকে মাজেদ গাইনের সঙ্গে পাঠায়। তারা এসে রেশমাকে উদ্ধার করে। তিন দিন পর গোনের দিঘির পাড়ের গোরস্তানে ভাঙা কবর থেকে আলাউদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়।
মানুষের তো প্রশ্নের শেষ নেই। ঘটনা যদি এই হয়, তবে আলাউদ্দিনের লাশ পাওয়ার আগ পর্যন্ত মুখ কেন খুলল না রেশমা? এত বড় ঘটনা, গ্রামের দ্বিতীয় কেউ টের পেল না! মাজেদ গাইন গ্রামবাসীকে ডাকতে পারত না? গরানপুর-হরিনগরে এত লোক থাকতে চেয়ারম্যানই-বা কেন রাখাল ময়রাকে মাজেদের সঙ্গে পাঠাল?
রেশমা তো শোকের সাগরে ভাসছে। থানা থেকে ফিরে সাদা শাড়ি পরে সে ঘরের কোণে চিলা নিয়েছে, উত্তর সে দেবে কেমন করে? তার হয়ে উত্তর দেয় মাজেদ গাইন, ‘মুখ সে খোলবে ক্যানো, নিজির জানডা হারাতি? এই গ্রামে আপন কেডা আচে তার? কেডা আগিয়ে আইস্তো বাঁচাতি? আমারে বা রাখালরে মাইরে ফেললিই-বা কী কত্তি পাত্তাম আমরা? চ্যারমেন বুলেচে মামলা হবার আগ পোয্যন্ত ঘটনা গোপন রাখতি, আমরা গোপন রাকিচি।’
লোকে হয়ত তার কথাগুলো বিশ্বাস করে। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে খসরু তালুকদার জড়িত, ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না কেউ। খসরু তালুকদারের শত্রুতা ছবেদালির সঙ্গে। নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সে। আলাউদ্দিনের সঙ্গে তার কী শত্রুতা কারো বুঝে আসে না।
মাজেদ গাইন বলে, ‘বুঝে না আসার কী আচে? আলাউদ্দিনরে মারা মানেই তো ছবেদালির এট্টা হাত ভাইঙে দেবা…এডা তো খুব সহজ কতা।’
নির্বাচনে হারার পর তিনটা মামলার আসামি হতে হয়েছে খসরু তালুকদারকে। এক মামলায় জেলও খেটেছেন এক মাস। একটা ঘটনার সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা ছিল না। মামলার বাদীরা ছবেদালির লোক। ছবেদালি উঠতে বললে ওঠে, বসতে বললে বসে, গু খেতে বললে তাও খাবে – খসরুর বিরুদ্ধে মামলা তো নস্যি ব্যাপার। তবে তিনটির একটিও হত্যামামলা ছিল না। একটি ঘর পোড়ানোর, দুটি মারামারির। জীবনে প্রথম হত্যামামলার আসামি হয়ে তিনি একটু বেকায়দাতেই পড়ে গেলেন। তবে সাহস হারালেন না। একটিবার কারো কাছে এর প্রতিবাদও করলেন না। রাখাল ময়রাকে বাড়িতে ডেকে শুধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘটনা তুমি সত্যি দিকেচ রাখাল?’
রাখালের সেই একই জবাব, ‘আমি এই দেশডায় থাকতি চাই চ্যারমেন শায়েপ। বাপ-ঠাকুদ্দার ভিটা ছাইড়ে আমি কোনো জাগায়ও যাতি পারব না।’
মাথায় বুঝি রক্ত চড়ে গেল খসরুর, কষে একটা লাথি মারলেন রাখালের পাছায়। গাছের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে নাক ফেটে রক্ত বেরোল রাখালের। ঘুরে দাঁড়িয়ে রাখাল চিৎকার করল, ‘আম্নি আমারে মাইল্লেন ক্যানো?’
খসরু তালুকদার দ্বিগুণ চিৎকার করে বললেন, ‘কারণ তুই এট্টা জোঁক। তোর মেরুদ- নি। জোঁক দেকলি মানুষ আদর করে না, মারে।’
শুক্রবার ছিল পরদিন। ছবেদালি বাড়িতেই ছিল। বেলা দশটার দিকে মাজেদ গিয়েছিল তার সঙ্গে দেখা করতে। দলিজে চেয়ারম্যানের উঁচু গলা শুনে সে পুকুরঘাটে দাঁড়াল। উঁচু গলা সে আরো একজনের শুনতে পায়। কানখাড়া করে কথাগুলো বুঝে গলাটা চেনার চেষ্টা করে। আন্দাজ করতে পারে গলাটা রাখাল ময়রার। জোর কদমে সে দলিজের দিকে আগায়। দরজার সামনে গিয়ে দেখে হনহন করে রাখাল ময়রা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। তাকে দেখে একবার থমকে দাঁড়াল। ভুরু কুঁচকিয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে একদলা থুতু ফেলে ফের হাঁটা ধরল। মাজেদ বেকুবের মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ওদিকে গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা দিলেন খসরু তালুকদার। সাতক্ষীরা বা খুলনায় তার কত আত্মীয়-স্বজন, মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন ঢাকায় – তার তো থাকার জায়গার অভাব নেই। মহেশ্বর তার ছাগলটা জগতী বেওয়াকে দিয়ে রাতারাতি হাওয়া। কখন গেল, কোন পথে গেল সন্দেশখালী, কেউ জানল না, কেউ দেখল না। মহব্বত সাজুনি তার দলের বাওয়ালিদের নিয়ে কাঠ কাটতে বাদায় চলে গেল। কিন্তু জাবেদ খান কোথায় যাবে? বয়স হয়েছে তার, রোগ-ব্যারাম বাসা বেঁধেছে শরীরে। দুদিন সুস্থ থাকলে পাঁচ দিন অসুস্থ। মহসিন মেম্বার বা গোপেশেরও তো যাওয়ার মতো জায়গা নেই। সবার তো পথ একটাই, আদালতে আত্মসমর্পণ। কিন্তু চাঞ্চল্যকর এ হত্যামামলার, যে মামলার এজাহার লেখা হয়েছে খোদ জিয়ারত আলীর কথামতো, জামিন পাওয়া কি এত সহজ?
ভাইয়ের জামিনের জন্য জমি বেচা অর্ধেক টাকা উকিল-মুহুরির পেছনে ঢালল তাপসী, অথচ ফলাফল শূন্য। কারো বুদ্ধি-পরামর্শ নেবে তেমন লোকও খুঁজে পায় না। বন্ধু তো সে কাউকে দেখে না, গরানপুরের সবার শত্রু এই মণ্ডলবাড়ি। বাড়িটার চারদিকে বিষধর কেউটের মতো শত্রুরা কিলবিল করছে। বন্ধু কেউ থাকলেও তাদের মুখে তালা। হেদায়াতে ইসলামির নেতা শহীদ হয়েছে, আসামিদের পক্ষে কথা বলবে সাহস কার! পার্টির লোকেরা তার মাজা আস্ত রাখবে! বললে দু-চার কথা বলে এক নিবারণ সাধক। তার ভেতর ডর-ভয় বলতে কিছু নেই। ফেলুর দোকানভর্তি মানুষের সামনে সে বলে বসল, ‘যে যতো জলে নাব্বে তার ততো কাপড় ভেজবে। যেরাম কর্ম সেরাম তার ফল। হিন্দুর জাগা দখল কুরে ভোগ কুরেচ, এট্টার পর এট্টা খুন কুরেচ, ভগবান কি দেকিনি? তার কি চোক নি? তার বিচার আসল বিচার।’
কথাটা হয়ত ছবেদালির কানেও গেছে। গেলে কি হবে, সে কি আর নিবারণকে ঘাঁটাতে যাবে? নিবারণ গুনিন মানুষ, জিন-পরিরা তার হুকুমের গোলাম, তার কথা লোকে কমবেশি বিশ্বাস করে―তাকে ঘাঁটাতে গেলে সে এসব কথা আরো বেশি করে ছড়াবে। তখন নিহত আলাউদ্দিনের ‘শহীদ’ খেতাবটা ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়বে। কিংবা ছবেদালিকে নিয়েও তো উল্টাপাল্টা কিছু বলে বসতে পারে। তার যেসব বদনাম কালের তলানিতে পড়ে গেছে সেসব যদি আবার খুঁড়ে তুলে আনে নিবারণ, তখন মানুষ তাকে আবার ডেয়ারিং ছবু নামে ডাকতে শুরু করবে। ঐ নাম আর সারা জীবনেও মুছতে পারবে না।
নিবারণের সাহায্য চাইল তাপসী। নিবারণ বলল, ‘আমি মুরখ্য মানুষ, মামলা-মোকদ্দমার কি বুঝি? পুলিশরে টাকাপয়সা দে দ্যাকো লিস্টিত্তে নামডা বাদ দিতি পারো কিনা।’
টাকা তো দিতে চায় তাপসী, কিন্তু নেবেটা কে? পুলিশ তো বাড়ি এসে টাকা নিয়ে যাবে না। সে মেয়েমানুষ, তার পক্ষে তো একা থানায় যাওয়া সম্ভব নয়। শৈলেনকে নিয়ে গেলই না হয়, পুলিশকে টাকাও দিয়ে এলো। কিন্তু চার্জশিট থেকে নামটা আদৌ বাদ যাবে কিনা তার কী নিশ্চয়তা? টাকাটা পুলিশ মেরে দিলে আবার জমি বেচা ছাড়া তো আর কোনো উপায় থাকবে না।
তবু সে দাঁতিনাখালীর মোতালেবকে ধরে টাকা দিল। মোতালেবের সঙ্গে পুলিশের খাতির ভালো। মোছলেম ডাকু আটক হওয়ার পর থানা-পুলিশের সঙ্গে তার একটা খাতির গড়ে ওঠে। এদিকে কখনো পুলিশ এলে তার ডাক পড়ে। ছোটখাটো মামলা-মোকদ্দমার তদবির করতে লোকে তার ধন্না ধরে। মোতালেব কথা দিয়েছিল চার্জশিট থেকে গোপেশের নামটা সে বাদ দেয়াতে পারবে। টাকা লাগবে দশ হাজার।
চার্জশিট থেকে নামটা হয়ত বাদ দেয়াতে পারত মোতালেব। মামলার আয়ুর সঙ্গে সে কথাও বলে রেখেছিল। কিন্তু যেদিন সে তাপসীর কাছ থেকে টাকাটা নিল সেদিন রাতে খুন হলো রাখাল ময়রা। দোকানের ভেতর আটা-ময়দার বস্তা রাখার ছোট চকিটার নিচে তার লাশ পাওয়া গেল। ধড়-মুণ্ডু আলাদা। কানাই দোকানে ছিল না, মাকে দেখতে বাড়ি এসেছিল। কানাই বাড়ি এলে রাখাল নিজেই দোকানে থাকে। দোকানটা তো আর খালি রাখা যায় না। কথা ছিল পরদিন ভোরে ভোরে কানাই ফিরে যাবে। ফিরে গেল বটে কানাই। বাইরে থেকে ‘রাখাল কাকা…রাখাল কাকা’ বলে সে ডাক পাড়ে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পায় না। হঠাৎ তার চোখ যায় দোকানের কোণার দিকে। একটা রক্তধারা ভেতর থেকে ডবা বেয়ে রাস্তার দিকে গড়াচ্ছে।
এখন কে আর বিশ্বাস করবে না আলাউদ্দিন হত্যার সঙ্গে খসরু তালুকদার জড়িত নয়? আলাউদ্দিন হত্যামামলার আসামিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র বাইরে। মামলার প্রধান দুই সাক্ষীর একজন রাখাল ময়রা। খুন তাকে কে করতে পারে সে-কথা কি মাইকে প্রচার করে দিতে হবে?
খসরু তালুকদারের বিরুদ্ধে হরিনগরে মিছিল হলো। মিছিল নিয়ে লোকজন তার বাড়িতে হামলা করতে গেল। ভাঙচুর করে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিত, যদি না পুলিশ ঠেকাত। ছবেদালির গলার জোর বেড়ে গেল দ্বিগুণ, ‘এট্টার পর এট্টা খুন হুয়েই যাচ্চে, অথচ খুনিডারে ধত্তি পাত্তেচেনা না পুলিশ। কদিন পর তো দেখতিচি আমিও খুন হুয়ে যাব।’
এমন একটা হত্যাকাণ্ডের পর গোপেশের পক্ষে তদবির করতে মোতালেব কি আর থানার কাছে-কিনারে ঘেঁষতে সাহস পায়? দুদিনের মধ্যে মামলার চার্জশিট চলে গেল। ভাইকে ছাড়িয়ে আনার শেষ চেষ্টাটাও ব্যর্থ হলো তাপসীর। ভাই তার কোনোদিন ছাড়া পাবে, আশাও ছেড়ে দিল সে।
শৈলেনটা এবার সত্যি সত্যি চলে যাবে। এ বাড়ির প্রতি মায়া-টায়া সব উড়ে গেছে তার। একটা ভয় তাকে হামেশা তাড়িয়ে বেড়ায়। কখন আবার তাকেও মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়! পুলিশ এসে যদি বলে, ‘তুমি তো এ দেশের নাগরিক নও’, তখন কী জবাব দেবে সে? একবার জেলে গেলে জীবনে তো কোনোদিন ছাড়া পাবে না।
গোপেশ যেদিন জেলে গেল সেদিনই সে চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তার পথ আগলে দাঁড়াল জগতী বেওয়া। যতবারই সে চলে যাওয়ার কথা বলেছে ততবারই জগতী সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বুকটা উঁচিয়ে, পিঠটা উদোম করে, কোমরে আঁচলটা পেঁচিয়ে ভুরু নাচাতে নাচাতে বলেছে, ‘কোনে যাবা?’
জগতীর উঁচানো বুকের দিকে তাকিয়ে শৈলেনের কেমন যেন লাগে। চোখের মণি দুটো চিকচিক করে। তখন বুঝি তার ওপর মরে ভূত হয়ে যাওয়া পরিতোষের আত্মা এসে ভর করে। গলার কাছে চলে আসা কথাটা বলে দিতে ইচ্ছে করে, ‘আমারে তোমার বাড়ি ঠাঁই দেবা জগতী?’
তার মনের কথাটা জগতীও বুঝি টের পায়। তার ঠোঁট দুটো কাঁপতে শুরু করে। ওই ঠোঁটের কাঁপুনি থামাতে শৈলেন যে কোনোদিন তার ঠোঁট দুটি জগতীর ঠোঁটের ওপর ঠেকায়নি সে-কথা নিশ্চিত করে কে বলবে। কেউ কি তাদের পাহারা দিয়ে রেখেছে?
কিন্তু এবার যখন চলে যাওয়ার জন্য শৈলেন গাঁট্টি-বোঁচকা গোছাতে লাগল, তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর মতো কেউ থাকল না। কে দাঁড়াবে? জগতী তো ব্যস্ত তার ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটা বেকার হয়ে গেল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা দোকান তাকে ধরিয়ে দিতে হবে। গরানপুর বাজারে একটা ছাওড়া তোলার জন্য কার কার পিছে ছুটে বেড়াচ্ছে সে।
রাতে গাঁট্টি-বোঁচকা সব বেঁধে রাখল শৈলেন। ভোরে, বিডিআর-বিএসএফ জাগার আগে সে সীমান্ত পাড়ি দেবে। এক মাঝির সঙ্গে কথা বলে রেখেছে। তাপসীর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্য রাতে একবার বাশঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু কী মনে করে আবার ফিরে এসেছে। রাতটা তো সে আছে, ভোরে ভোরেই তো তাপসীর ঘুম ভাঙে, বিদায়টা না হয় তখনই নেবে।
কিন্তু ভোর তো হয় না। রাত এত দীর্ঘ হয়! এমন দীর্ঘ রাত কখনো দেখেনি সে। সারা রাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেছে – কোনোভাবেই চোখে ঘুম আনতে পারল না। কেবলই তার মনে হচ্ছিল এই রাত কখনো আর শেষ হবে না। অকূল সমুদ্রের মতো রাত। তার ভয় ভয় করে। একজন সঙ্গী থাকলে বিভীষিকাময় রাতটা পার করে দেয়া যেত।
বাদার পাখপাখালিরা কলরব তুলে পৃথিবীতে ভোর নামায়। শান্ত-স্নিগ্ধ ভোর। গাঁট্টি-বোঁচকা হাতে শৈলেন উঠোনে গিয়ে দেখে দরজা খোলা, কপাট ধরে তাপসী দাঁড়িয়ে। চেহারায় অনিদ্রার ছাপ। তার চোখের দিকে তাকিয়ে শৈলেনের ছিঁড়ে যাওয়া মায়ার সুতোটায় বুঝি ফের গিঁট লাগে। সে মাথা নোয়ালে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে তার পায়ের কাছে। যেন বহু দূর থেকে তাপসীর কণ্ঠ শুনতে পেল, ‘চুলে যাচ্চ শৈলেনদা?’
কে জানে কী হলো শৈলেনের, কী বলতে সে কী বলে বসল, ‘সন্দেশখালীতে কদিন পর শিবমেলা শুরু হবে। যাবা দেকতি?’
মলিন মুখে হাসি ফুটল তাপসীর। আর তখন ঠাকুরঘরের চাল থেকে একটা প্রজাপতি উড়ে এসে তার সিঁথিতে বসল। ধীর পায়ে সে উঠোনে নেমে বলল, ‘দরজাডা খোলাই থাক, গোপেশ যদি কখনো ফেরে…।
আমরা জানি না তাপসী আর কোনোদিন গরানপুরে ফিরবে কি না। গোপেশ ফিরবে কি না তারও কিছু জানি না। অথবা মহব্বত সাজুনি, ডিঙা সাজিয়ে দলবল নিয়ে যে বাদায় গেছে, সে কি চিরজীবনের জন্য গেল, নাকি আবার ফিরে আসবে – তারও কিছু জানি না।
জানার মধ্যে জানি শুধু এটুকু, চুনকুড়িতে জোয়ার আসবে, ভাটা পড়বে। প্রতি জ্যোৎস্নার রাতে মুকনোলির প্রান্তরে এক অপার্থিব মায়া খেলা করবে। আর অনুমান করতে পারি, তখন, সেই মায়াবী জ্যোৎস্নার রাতে অনন্ত মণ্ডল ও কেশব মণ্ডল ওরফে কিশোয়ার মাস্টারের অশরীরী আত্মা চুনকুড়ির আড়ায় দাঁড়িয়ে বিরান মণ্ডলবাড়ি অথবা বেদখল মণ্ডলবাড়ির দিকে তাকিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদবে।
২৬.১১.২০১৪