কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
সতেরো.
দোবেকি গরানকূপের ডোরায় ডাকাতের গুলিতে নাজমুল দারোগা নিহত হওয়ার ঘটনাটা কাল হলো মোছলেম ডাকুর। সেই ডাকাতদলে সে ছিল কিনা, কিংবা হন্তারক ডাকতরা তার সাগরেদ কিনা, পুলিশ নিশ্চিত ছিল না। তবু মামলাটা হলো তার বিরুদ্ধেই। একটা ডাকাত পুরো পুলিশ বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলল। পত্রপত্রিকায় ওসি-এসপির সঙ্গে তার গোপন আঁতাতের কথা লেখালেখি হতে লাগল। বাধ্য হয়ে জিরো টলারেন্সে চলে গেল পুলিশ, তাকে গ্রপ্তারে জোর তৎপরতা শুরু করল। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার সব কটি থানায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি হলো। এমনকি দেখামাত্র গুলির নির্দেশও।
কিন্তু তিরাশিটা মামলা যার বিরুদ্ধে, প্রতিটি এজাহারে যার নামের আগে পুলিশ ‘দুর্ধর্ষ’ শব্দটি জুড়ে দেয়, তাকে গ্রেপ্তার করা কি এত সহজ? গ্রামে গ্রামে তার কত খোজারু, কত থানার কত দারোগা কত কনস্টেবল তার কাছ থেকে মাসোয়ারা পায় – বিপদে কি তারা পাশে দাঁড়াবে না তার? গোপন সংবাদটা কি পৌঁছে দেবে না? দাঁতিনাখালী থেকে মোতালেব ঠিকই খবরটা নিয়ে এলো, ‘গোলমালডা ভালোই লাইগেচে বড়বাবু। এট্টা পুলিশও আর আপনার পক্ষি কাজ কুত্তেচ্ না। যত জলদি পারেন পচ্চিমির বাদায় চুলে যান। পুলিশির মতিগতি ভালো ঠিক্তেচে না।’
মোছলেম তখন কাঠেশ্বর জঙ্গলে। সে-রাতেই তিন সাগরেদসহ মাদারবাড়িয়ার উদ্দেশে রওনা হলো। সেখান থেকে ভারতে চলে গেল, নাকি মাদারবাড়িয়ার চরে কোথাও ক্যাম্প গেড়ে লুকিয়ে থাকল, তার সাগরেদরাও কিছু জানল না। সমস্ত জঙ্গল তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পুলিশ তার খোঁজ পেল না। তার সাগরেদদের কেউ ভারতে চলে গেল, কেউ পুলিশ-কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়ল, আর কেউ কোর্টে গিয়ে আত্মসমর্পণ করল। মোতালেবও আর খোঁজ নিল না তার।
তিন বছর তার আর পাত্তা নেই। বাদায়-আবাদে ডাকাতির ঘটনা কমে এলো। সবাই ভাবল, মাথা ভেঙে গেছে মোছলেম ডাকুর, কোনোদিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। পুলিশও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
হঠাৎ একদিন, এক ঘোর বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায়, এক সাগরেদের সঙ্গে মোতালেবের বাড়িতে হাজির। মোতালেব তো প্রথমে চিনতেই পারল না। চিনবে কী করে? বসে যাওয়া চোপায় লম্বা দাঁড়ি-গোঁফ, মাথায় বাবরি চুল, কালিময়লা জামা-কাপড়। যেন মৌয়াল-বাওয়ালি। মোতালেবের বউ তো ভাবল দরগার কোনো খাদেম-টাদেম হবে বুঝি।
হালহকিকত শুনে মোতালেব বলল, ‘যদ্দিন ইচ্চে আমার ইকেনে থাকেন বড়বাবু। এই গ্রামের কেউ আম্নারে চেনে না। কেউ জিজ্ঞেস কল্লি বলবো আম্নি আমার মামাতো ভাই।’
বলল বটে, কিন্তু ভেতরে তার অস্বস্তি তৈরি হলো। মোছলেম ডাকু তার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে, টের পেলে পুলিশ কি তাকে ছাড়বে? আগের মামলাটা এখনো চলছে, মাসে মাসে কোর্টে হাজিরা দিতে গিয়ে মেলা টাকা খসে যাচ্ছে। আবার যদি মামলা খায়, ভিটা বেচা ছাড়া উপায় থাকবে না। আবার, মোছলেমকে তো সে খেদিয়েও দিতে পারে না। বলতে পারে না, আমাকে বিপদে ফেলবেন না বড়বাবু, আপনি অন্য কোথাও চলে যান। বললে যে তার কল্লা চুনকুড়ির জলে ভাসবে না তার কী নিশ্চয়তা?
ঘাড়ে চেপে বসা এই আপদ কীভাবে বিদায় করবে ভেবে পায় না মোতালেব। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না, দিনে মেজাজ খিঁচড়ে থাকে, কাজকর্মে মন বসাতে পারে না। একটা আতঙ্ক সারাক্ষণ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়: এই বুঝি পুলিশ এলো, এই বুঝি বাড়িটা ঘেরাও করল, এই বুঝি কোমরে রশি লাগিয়ে মোছলেম ডাকুর সঙ্গে তাকেও থানায় নিয়ে চলল।
একেকবার মনস্থির করে যেভাবেই হোক মোছলেমকে সে চলে যেতে বলবে। কথাটা কীভাবে বলবে একাকী তার একটা মহড়াও দেয়, ‘আমার সংসারডা ছারখার হুয়ে যাবে বড়বাবু। আম্নারে আমি বড়ভাইর মতোন জানি, দয়া কুরে ছোট ভাইডারে বিপদে ফ্যালাবেন না।’ কখনো আবার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, ‘ক্যানো, এ্যাতো কাকুতি-মিনতি ক্যানো? বাড়ি আমার ঘর আমার। কারে রাখপো কারে বাইর কুরে দ্যাবো সে আমার ব্যাপার। খানকির ছাবাল, তুই আমার বাড়িত্তে এক্ষুনি বাইর হ। নালি পুলিশ ডাইকে তোর বাবুগিরি পোঙার খোলে ঢোকাবো হারামজাদা।’
কিন্তু না, কোনোভাবেই কথাটা সে বলতে পারে না। তার সামনে দাঁড়ালে জবানটা বন্ধ হয়ে যায়। কেউ যেন হলকুমটা টিপে ধরে রাখে। আবার মানুষটার জন্য তার মায়াও হয়। কত না ক্ষমতা ছিল তার! মুখে বলতে হতো না তাকে, চোখের ভাষা বুঝে নিত সাগরেদরা। কাকে খুন করতে হবে, কাকে তুলে আনতে হবে, কার লাশ গুম করে ফেলতে হবে, কার বাড়ি ডাকাতি করতে হবে – ইশারাতেই সব বুঝে নিত। অথচ এখন, খোদার কী লীলাখেলা, কেমন দমে গেছে মানুষটা। চোখে আগের সেই তেজ নেই। চোখ দুটো সারাক্ষণ নামিয়ে রাখে। কথা তো সে চিরকালই কম বলত, এখন আরো কমিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু যত মায়াই হোক, নিজের ক্ষতি তো মোতালেব করতে পারে না। কে জানে সে কোন গুঁটি চালল, যে মোছলেম তালুকদারের ভয়ে চুনকুড়ি তীরের মানুষরা তটস্থ থাকত, তারাই কিনা তাকে ধরে পুলিশে দিল!
বিষ্যুদবার ছিল সেদিন। মুন্সিগঞ্জের সাপ্তাহিক হাঁটবার। রাত তখন প্রায় আট-সাড়ে আট হবে বুঝি, উঠোনে চাটাই পেতে মোছলেমের সঙ্গে গল্প করছে মোতালেব। তার বউ হেঁশেলে ভাত ছড়িয়েছে। মাছের তরকারি রান্না হচ্ছে। ঘ্রাণে সারা বাড়ি মৌ মৌ। খিদেটা চাগিয়ে ওঠে মোছলেমের। দুপুরে লাউয়ের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েছে। সন্ধ্যায় খিদে পেল প্রচণ্ড। একবার ভেবেছিল দোকানে গিয়ে মুড়িটুড়ি কিছু খেয়ে নেবে। কিন্তু নতুন জায়গা, পথঘাট কিছু চেনাজানা নেই, অন্ধকারে কোথায় গিয়ে আবার পথ হারিয়ে ফেলে! দশ দিনে মাত্র দুবার বাড়ির বাইরে গেছে। তাও রাতের বেলায়। যতই বলুক মোতালেব, একবার কারো মনে সন্দেহ ঢুকলে সন্দেহটা সারা গ্রামে না ছড়িয়ে সে থামবে না। তখন কেউ না কেউ ঠিকই তাকে চিনে ফেলবে। মোতালেব থাকলে না হয় কথা ছিল। দুপুরে সে মুন্সিগঞ্জ গিয়েছিল, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
কথায় কথায় ছবেদালি চেয়ারম্যানের প্রসঙ্গ উঠল। মোতালেব বলল, ‘জানেন বড়বাবু, ছবেদালি চ্যারমেন হুয়ে ভালোই হুয়েচে। তার মতোন এমন দ্বীনদরদি লোক দ্বিতীয়টি হয় না। মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোর ম্যালা উন্নয়ন কুরেচে সে। তার চেষ্টায় গরানপুরির মতোন জাগায় মাদ্রাসা উটেচে। খসরু তালুকদারের সব জারিজুরি শেষ। হিন্দুগো বাড়াবাড়িও কুমে গেচে।’
দু-হাতে ঠেস দিয়ে দু-পা ছড়িয়ে বসা মোছলেম। সোজা হয়ে বসে বলল, ‘হিন্দুগো বাড়াবাড়ি কবে ছেলো মোতালেব?’
সঠিক জবাবটি দিতে পারে না মোতালেব, থতোমতো খায়। মোছলেম আবার আগের মতো দু-হাতে ঠেঁস দিয়ে বসে। তার দৃষ্টি ভাদ্রের আকাশের দিকে। পূর্ণিমা গেছে কদিন আগে। আকাশে এখনো চাঁদ ওঠেনি। সময় হয়েছে বুঝি। পুবের আকাশটা উজ্জ্বল। খড়ের গাদার মতো মেঘের গাদা ভাসছে সারি সারি। সন্ধ্যাতারাটা একবার ঢাকা পড়ে তো ফের ভেসে ওঠে। দূরে মুকনোলির প্রান্তরে মাছমারাদের কুপির বিন্দু বিন্দু আলো দেখা যায়। দূরে কোথায় কুকুর ডাকছে।
: মোতালেব! আকাশের দিকে চোখ রেখে বলল মোছলেম।
: জে বড়বাবু! মোতালেব সাঁয় দেয়।
: চলো যাই।
: কোন জাগায়?
: দক্ষিণির কোনো এট্টা চরে-টরে গে ঘর বাঁধি।
: হে হে হে।
: হাসতেছ ক্যানো? সত্যি বলতিচি। তোমার মতোন এট্টা সংসার পাতার খুব সাদ জাইগেচে।
: হে হে হে…। সংসার তো পাতিলেন, টেকাতি তো পাল্লেন না। এই জীবনে সাদডা আর পূরণ হবে না বড়বাবু।
মোতালেব হাসে। হেঁশেলের আলোয় তার সারা মুখে ছড়ানো হাসিটা স্পষ্ট দেখা যায়। তার মুখের দিকে তাকায় মোছলেম। হাসিটা কেমন যেন লাগে তার। হাসির আড়ালে মোতালেব যেন অন্য কিছু বলতে চাচ্ছে। আবার মনে হয়, যেন মোতালেব নয়, হাসিটা অন্য কারো। গা-টা কেমন চমচম করে ওঠে মোছলেমের, রোমকূপে শিউরানি জাগে। আবার সে আকাশের দিকে চোখ ফেরায়। মাঝ আকাশ থেকে একটা উল্কাপি- ঝোড়োবেগে পুবের আকাশে ছুট দেয়। চোখের পলকে মিলিয়ে যায়। মোছলেমের চোখ এড়ায় না। মোতালেবেরও না। সে বলে, ‘শয়তানডারে আগুনির তীর মাইরেচে ফেরেশতারা। হে হে হে…হারামজাদা আসমানে উটতি চায়।’
কুকুরের ডাক আরো স্পষ্ট হয়। দু-তিনটা কুকুর থেমে থেমে ডাকছে। অস্বস্তি তৈরি হয় মোছলেমের ভেতর। গ্রামে পুলিশ ঢুকল কি না!
তার মনের কথা বুঝি বুঝতে পারে মোতালেব। বলে, ‘হাটবার তো, হাটুরেরা ফিত্তেচে।’
মোছলেম আস্বস্ত হয়।
হঠাৎ বাড়ির ঘাটায় পায়ের আওয়াজ শোনা যায়।
মোছলেম সোজা হয়ে বসে। তিন-ব্যাটারি টর্চলাইটের সুইচটা টিপে সে চমকে ওঠে। এক লাফে উঠে দাঁড়ায়। অসংখ্য টর্চের চোখধাঁধানো আলো পড়ল তার মুখে। সঙ্গে সঙ্গে বেশুমার কণ্ঠের হৈহৈ রৈরৈ হাঁকডাক। শত শত মানুষ। হাতে হাতে লাঠিসোঁটা দা-কুড়াল। গরানপুরের আলাউদ্দিনকে দেখা যায়, তার পেছনে ছবেদালি চেয়ারম্যান। মহসিন মেম্বারও আছে। মোটাসোঁটা একটা লাঠি হাতে গোফরান মৌলানাকেও দেখা যায়। মোছলেমের মুখ হাঁ। ফাঁদে পড়া বাঘের মতো তার হাল। পালানোর কথা বুঝি ভুলে যায়। অথবা পালানোর চেষ্টা সে করে না। এত এত মানুষ ডিঙিয়ে পালাবেই-বা কোথায়।
চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে মোতালেবের বউ টেমি হাতে উঠোনে নামে। মোতালেব হাত দুটো জোড় করে ছবেদালির সামনে দাঁড়ায়, ‘আমার ভুল হুয়ে গেচে চ্যারমেন শায়েপ, আমারে মাফ কুরে দেন। আমি তারে ঠাঁই দিতি চাইনি। কী করব বলেন, দুটো দিন থাকতি চাইয়েচে, না কত্তি পারিনি।’
আলাউদ্দিন তাকে মারতে তেড়ে আসে, ছবেদালি থামায়। মোছলেমের মুখে চোরা চাউনি ফেলল মোতালেব। ঠোঁটে বিদ্রƒপের হাসি ঝুলিয়ে মাথাটা ওপর-নিচ দোলাতে দোলাতে মোছলেম বলল, ‘আমি তোরে বিশ্বেস কুরেলাম মোতালেব! শেষ পর্যন্ত তুইও বেঈমানি কল্লি?’
মোতালেব মাথা নোয়ায়। মোছলেমের মুণ্ডু দোলানি তখনো থামেনি, আচমকা তার ঘাড় ধরে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল আলাউদ্দিন। লাথিও বুঝি মারল একটা। উঠোনের ঠনঠনে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে গেল মোছলেম। ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হতে লাগল। হাতের তেলোয় ঠোঁট মুছে রক্তমাখা হাতটা চোখের সামনে ধরল সে। কাঁচা রক্তের গন্ধ লাগল তার নাকে।
তারপর ঠোঁট থেকে, মুখ থেকে, মাথা থেকে, বুক থেকে, পেট থেকে, পিঠ থেকে, উরু ও পা থেকে কত রক্ত বেরোলো – দেখার ফুরসত পেল না একবারও। লুঙ্গিটা, জামাটা এবং সারা শরীরটা রক্তে লাল হয়ে গেল। রক্তাক্ত শরীরটা নিয়ে সারা রাত মুন্সিগঞ্জ ইউপি অফিসের বারান্দায় বসে থাকল। খিদার কথা ভুলে গেল, পায়খানা-পেশাবের কথা ভুলে গেল, এমনকি বেঁচে থাকার কথাও। শেষরাতে পুলিশ এসে তাকে গাড়িতে তুলল, সে টের পেল না। কোথা থেকে কোথায় নিল কিছুই বুঝতে পারল না। গাড়িটা যখন মাদার গাঙের বাঁধ ধরে শ্যামনগরের দিকে ছুটছিল, খানিকের জন্য তার হুঁশ ফিরেছিল। চোখ খুলতে পারেনি। বন্ধ চোখে মোতালেবের হাসিমাখা মুখটা ভেসে উঠল। আর কণ্ঠটা – ‘শয়তানডারে আগুনির তীর মাইরেচে ফেরেশতারা। হে হে হে…।’
হাতে-পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে তাকে কোর্টে তোলা হলো। শত শত মানুষ তাকে দেখতে এলো। সদলবলে খোদ জিয়ারত আলীও। যারা তাকে আগে দেখেনি তারা তো অবাক। এর নাম মোছলেম ডাকু? ফুহ্! হতেই পারে না! দেখতে কামলা-কিশেনের মতো মানুষটা মোছলেম ডাকু হয় কী করে? তলোয়ারের মতো বাঁকা গোঁফ কোথায়? রবিনহুডের মতো লম্বা চুল কোথায়? বাঘের মতো তামা তামা চোখ কোথায়? তার অস্ত্রশস্ত্রই-বা কোথায়? এ নিশ্চয়ই জাল মোছলেম। আসল মোছলেমকে ধরা কি এত সোজা? পাঁচ থানার পুলিশের সঙ্গে মোছলেম কম করে হলেও পাঁচ মিনিট লড়ার ক্ষমতা রাখে। দাঁতিনাখালীর মানুষরা কোথাকার কোন হাঁদাগোবিন্দকে ধরে মোছলেম ডাকু বলে চালিয়ে দিল, আর পুলিশও বিশ্বাস করে বসল!
দশ দিনের রিমান্ডে মোছলেমকে থানায় আনা হলো। ব্যক্তিগত প্রয়োজনের কথা ছাড়া দশ দিনে বাড়তি একটা কথাও তার মুখ দিয়ে বেরোল না। খাওয়ার সময় খেয়েছে, ঘুমানোর সময় ঘুমিয়েছে, সময়মতো পেচ্ছাব-পায়খানা করেছে। বাকি সময় হাঁটু-মাথা একত্র করে থানাহাজতের দেয়ালে ঠেস দিয়ে চুপ মেরে বসে থেকেছে। কত চেষ্টা করল পুলিশ, একটা অপরাধের কথাও স্বীকার করাতে পারল না। মারের ওপর মার দিল, পিঠটা আবার রক্তাক্ত করে দিল, নির্যাতনের যত ধরন আছে কিছুই বাদ রাখল না। কী আজব কা-, কিছুতেই কিছু হলো না, নোয়ানো মুখটা সে একবারও তুলল না। একবারও বলল না, উহ্। দ্বন্ধে পড়ে গেল পুলিশ। পাবলিকের গণধোলাই খেয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল না তো আসামি! বিচিত্র কিছু নয়। এমন তো হতেই পারে।
চতুর্থ দিন এসপি এলেন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। নরমে গরমে তার কাছ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু না, কিছুতেই তার মুখের তালাটা খুলতে পারলেন না। মেজাজ কি আর ঠিক থাকে এসপির? সজোরে বুট জুতোর লাথি মারলেন তার বুকে। একটা গোঙানির শব্দ ছাড়া আর কিছুই বেরোল না তার মুখ দিয়ে। এসপি তার চৌদ্দগোষ্ঠী ধরে গালাগালি শুরু করলেন। মোছলেমের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। হাসি দেখে এসপির মেজাজ যায় আরো চড়ে। লম্বা চুলগুলো মুঠোয় ধরে মাথাটা দেয়ালের সঙ্গে সজোরে ঠুকে দিলেন, ‘কথা বল হারামজাদা।’ মোছলেম নিরুত্তর। খুলির পেছনটা ফেটে রক্ত বেরোতে লাগল, তবু তার মুখের তালাটা খুলল না। তার সহ্যক্ষমতা দেখে এসপিও অবাক মানলেন। শেষ পর্যন্ত তাকেও সিদ্ধান্তে আসতে হলো, সত্যি সত্যি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে মোছলেম ডাকু। অতএব জবানবন্দিতেও তাই লিখে দেয়া হলো।
দশ দিন পর আবার তাকে আদালতে তোলা হলো। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নির্বাক মোছলেম সবাক হয়ে উঠল। মাথা উঁচিয়ে, ছিনা ফুলিয়ে, হাকিমের চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট ভাষায় বলল, ‘নাজমুল দারোগারে আমিই খুন করিচি, কেশব মাস্টাররে আমিই গুম করিচি। এই সুন্দরবনে গ্যালো পোনোরো বছরে যত গুম-খুন আর ডাকাতি হুয়েচে সব দায় আমার। আমি আমার সব অপরাধ স্বীকার কুরে নেলাম। কোনো সাক্ষী-প্রমাণের দরকার নি হুজুর। আপনি আমারে ফাঁসিতি ঝোলানোর রায় দেন।’
যেন মৃত মানুষ হঠাৎ কথা বলে উঠল। নড়েচড়ে উঠল পুরো এজলাস। উকিলরা নিজ নিজ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। দরজার সামনে পাহারারত বন্দুকধারী পুলিশরা কাঠগড়ার কাছে এগিয়ে এলো। যুবক ম্যাজিস্ট্রেট শিরদাঁড়া সোজা করে অবাক চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একজন উকিলও নেই তার পক্ষে কথা বলার। সরকারি কৌঁসলী বললেন, ‘মাননীয় আদালত, তার মতো এমন দাগি আসামি এভাবে অপরাধ স্বীকার করার কথা নয়। মনে হচ্ছে সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
সত্যি সত্যি হয়ত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল মোছলেম। জেলের বাইরে থাকলে হয়ত সে আত্মহত্যাই করে বসত। জেলে তো সেই সুযোগ নেই। সে তখন সাতক্ষীরা কারাগারের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। সারাক্ষণ তার ভেতরে অস্থিরতা। দিনের বেলায় সিঁড়ি বেয়ে একবার নিচে নামে, দুটো চক্কর দিয়ে ফের তিনতলায় ওঠে। আবার নামে, আবার ওঠে। দিনে কতবার যে ওঠানামা করে শুমার থাকে না। রাতেও সেই একই অস্থিরতা। রাত তিনটার আগে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের পাতা এক করতে পারে না। তখন তো আর নিচে নামতে পারে না, ওয়ার্ডের ভেতরেই বন্দি সিংহের মতো চক্কর দিতে থাকে। মধ্যরাতে, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে দু-হাতে লুঙ্গির কাছা দুটো ধরে ওয়ার্ডের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় চক্কর দেয়া শুরু করে। মাথাটা ঝুঁকিয়ে হাঁটছে তো হাঁটছেই। ক্লান্তি এলে জানালার রড ধরে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর আবার হাঁটতে শুরু করে। দেড়টা-দুটো বেজে যায়, তবু তার শোয়ার নাম নেই। তার হাঁটাচলায় কয়েদি-হাজতিদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না। মোছলেম ডাকুকে কে কী বলবে! ওয়ার্ডের মেডও তো তাকে তোয়াজ করে চলে। মেডের বিছানার পাশে তার বিছানা। তিনটা বাজলে পরে সে শুতে যায়। ঘণ্টা দেড়েক ঘুমায়, তারপর তো ভোর।
ভোরে ওয়ার্ডের দরজার খুললে পরে তিনতলা থেকে সে নিচে নামে। উত্তরের পাচীরের ছায়ায়, যেখানটায় কখনো রোদ পড়ে না, গামছাটা বিছিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে। খানাপিনার খবর থাকে না। দুপুর পর্যন্ত নাক ডেকে ঘুমায়। কেউ তাকে বিরক্ত করে না। বিরক্ত করার মতো কেউ তো আসেও না এদিকটায়। আসতে চাইলে পাচীরের দু-মাথায় পাহারারত দুই কারারক্ষী বাধা দেয়। হয়ত ভয়ে অথবা তার কাছ থেকে দশ-বিশ টাকা বখশিশ পেয়ে। অথবা তার প্রতি তারা কোনো কারণে সহানুভূতিশীল। বাধা ডিঙিয়ে কেউ এসে পড়লে বেশিক্ষণ তাকে দাঁড়াতে দেয় না তারা। যত দাগি কয়েদিই হোক, মোছলেম তালুকদারকে কেউ ঘাঁটাতে যায় না। আজ মোছলেম খাঁচায় বন্দি, কাল যে ছাড়া পাবে না তার কি নিশ্চয়তা? তুমি যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত কয়েদি, তোমার কথায় কয়েদি-হাজতিরা ওঠবোস করে, বাইরে গিয়ে তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না মোছলেম। কিন্তু তোমার আত্মীয়-স্বজনরা তো বাইরে। তাদের কাউকে যদি তার সাগরেদরা হজম করে ফেলে তখন তোমার কী করার থাকবে?
পাচীরটার দু-মাথায় সেদিন প্রহরারত দুই কারারক্ষী ছিল নতুন। মোছলেমের সঙ্গে তাদের পরিচয় নেই। সে কারণেই হয়ত ছেলেটি পাচীরের ছায়ায় শোয়ার সুযোগ পায়। বিশ-একুশের মতো বয়স। চেহারায় একটা নিষ্পাপ ভাব, পার্থিব কাঠিন্যের ছাপ এখনো পড়েনি। যেদিন সন্ধ্যায় তাকে ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ঢোকানো হয়, দেখতে খুনির মতো এক কয়েদি চোখ বড় বড় করে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কের মামলা?’
: মিত্যে মামলা ভাই। ভয়ার্ত গলায় ছেলেটা উত্তর দিল।
: আরে শালা সবই তো মিত্যে মামলা। মামলাটা খুন না ডাকাতির সেডা বল।
চোখ নামিয়ে নিল ছেলেটা। নিচু গলায় জবাব দিল, ‘সেরাম কিচু না ভাই, মদ খাইয়েলাম, তাই…।’
: ওরেব্বাপ! তালি শালা তিন রাত তোর ঘুম হারাম। সারা রাত কান ধুরে এক পায় দাঁড়িয়ে থাকপি।
ছেলেটা ভাবল এই বুঝি জেলের নিয়ম। সে কান ধরে এক পায়ে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে থাকল মিনিট দশেক। তারপর ওয়ার্ডের মেড এসে তাকে কয়েদিটার হাত থেকে রক্ষা করল। ওয়ার্ডটায় যে ঠাসাঠাসি অবস্থা, কোনো হাজতি এসে প্রথম রাতে ঘুমানোর মতো জায়গা পায় না। কিন্তু ছেলেটা পেল। ঘুমানোর মতো একটা জায়গার ব্যবস্থা করে দিল মেড। জেলের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে আগাম ধারণা দিল। খাওয়ার সময় ডেকে নিল, গোসলের সময় গোসলখানাটা দেখিয়ে দিল।
দুদিন আর ছেলেটার দেখা পেল না মোছলেম। পেলেও চিনতে পারেনি। দুদিন পর ছেলেটাকে পাচীরের ছায়ায় দেখতে পেয়ে চিনতে পারল। তখন বেলা প্রায় এগারোটা। তার পায়ের কাছে বিড়ালের মতো পেট-হাঁটু একত্র করে শুয়ে আছে ছেলেটা। দু-হাত জোড় করে তার ওপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। মুখটা হাঁ। হাতের আঙুলে লালা গড়াচ্ছে। গায়ে টেট্টনের শার্ট, পেছনটা কুঁচকানো। পরনে চেক লুঙ্গির ছেঁড়া কাছাটায় গেরো দেয়া। পিঠে রোদ পড়ে শার্টটা ঘামে ভিজে উঠেছে।
কিছু বলল না মোছলেম, গামছাটা ঝেড়ে সে গোসলখানার দিকে চলে গেল। সারাদিন আর ছেলেটার দেখা পেল না। রাতেও না। তার পরদিনও না। তৃতীয় দিন ছেলেটাকে আবার দেখতে পেল একই জায়গায়। দুজনই শোয়া। মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে পা দোলাচ্ছে আর বিড়ি ফুঁকছে মোছলেম। ছেলেটার পা তার পা থেকে দু-হাত দূরে। ছেলেটা মুখের ওপর গামছা দিয়ে রেখেছে। গামছাটা সরাতেই মোছলেমের চোখে চোখ পড়ল তার। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মোছলেম জিজ্ঞেস করল, ‘বাড়ি কোআনে?’
: গরানপুর। উত্তরে বলল ছেলেটা। বলেই শোয়া থেকে উঠে বসল, ‘না না, খালিশপুর।’
মোছলেমও উঠে বসল। ছেলেটার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘একবার গরানপুর, একবার খালিশপুর…ঘটনা কী? মিত্যে বুলতোচ্ ক্যানো ?’
ছেলেটার চেহারায় বিব্রতভাব। বলল, ‘আসলে আমার বাড়ি গরানপুর। খালিশপুর আমার পিসির বাড়ি।’
: গরানপুরির কোন জাগায়?
: মোল্লেপাড়া।
: বাবার নাম?
: স্বর্গত কেশবচন্দ্র মণ্ডল।
: কেশব মাস্টার?
: আজ্ঞে।
চমকে উঠল মোছলেম। খানিকক্ষণ ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়ির গোড়ালিটা ছুঁড়ে ফেলে গামছায় মুখ মুছল। সামনে দাঁড়ানো কারারক্ষীর দিকে তাকাল একবার। তারপর দেয়ালে ঠেস দিয়ে উঠে দাঁড়াল, মাথাটা নুইয়ে ধীর কদমে তার ওয়ার্ডের দিকে হাঁটা ধরল।
সেদিনই তাকে খুলনা কারাগারে স্থানান্তর করা হলো।