কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
ষোলো.
চারুবালা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে পারে, থালা থেকে ভাতের গ্রাসটা মুখে নিতে পারে, একা একা পায়খানা-পেচ্ছাবখানায় যেতে পারে। চানটা শুধু করিয়ে দিতে হয় জগতী বেওয়াকে। চারুবালা কুয়োর ঘাটে নামতে পারে না। কুয়োটাও গভীর, ঘাটটাও বেশ খাড়া – জোয়ান মানুষকেও সাবধানে নামতে হয়। পা একবার পিছলালে মাজাখানা আর আস্ত থাকবে না। কুয়োর জল ছাড়া আবার চানও করে না চারুবালা। কলের জল মাথায় পড়লে সর্দি লেগে যায় তার। জগতী বেওয়া বালতি ভরে কুয়ো থেকে জল তুলে আনে, কলতলায় বসিয়ে গা-টা সাবান-জালি দিয়ে ডলে দেয়।
মাঝেমধ্যে কুয়ো থেকে জল তুলতে জগতীকে সহযোগিতা করে শৈলেন। মণ্ডলবাড়ির মাহিন্দার হিসেবে শৈলেন পাঁচ মাস হলো কাজ নিয়েছে। বাড়ি সন্দেশখালী, গোপেশের পিসির বাড়ির কাছে। ভক্তদাসের সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে বছর দুই আগে হরিনগর আসে, এ-বাড়ি ও-বাড়ি জোন খেটে শেষে ম-লবাড়িতে ঠাঁই পায়। চাষাবাদের কাজে গোপেশের সহযোগী হিসেবে লোক তো একজন লাগে। মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে কিছু জমি বেচে দিয়েছে। বাকি জমির কিছু বর্গা দিয়েছে, কিছু সে নিজে চাষ করছে। সংসারের জুয়াল পুরোপুরিই এখন তার কাঁধে। সাধ্যমতো সে টানছে। বয়স কম, অনেক কিছুই বোঝে না। জাবেদ খান পাশে না দাঁড়ালে তালগোল পাকিয়ে ফেলত। এত দিনে সংসারটার অস্তিত্ব থাকত কি না সন্দেহ। বেশ ক’বার জমি বেচতে চেয়েছে। জাবেদ খান বলেছে, ‘আর যা-ই করো, এই কাজটা অন্তত কুরো না বাপু। কাঁচা টাকা একবার হাতে আসলি লোভ আর সামলাতি পারবা না, আবার জমি বেচতি চা’বা। বেচতি বেচতি একদিন ভিখিরি হুয়ে পতে পতে ঘুত্তি হবে। তোমার পুরো জীবনডাই তো পুড়ে আচে, এখনই জমি বেচা ধল্লি ভবিষ্যতে সংসারডা চালাবা কিরম কুরে?’
শৈলেনকে পেয়ে কিছুটা চাপ কমেছে গোপেশের। সাতাশ-আটাশ হবে শৈলেনের বয়স, তবে খানিকটা হাঁদারাম কিসিমের। মাঝেমধ্যে উত্তর বললে দক্ষিণ বোঝে, পুব বললে পশ্চিম। তবে খাটে আবার গাধার মতো। মাটিকাটা, হালচাষ, রোয়া লাগানো, ধান কাটা, আঁটি বেঁধে মালিকের বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত হেন কাজ নেই পারে না। গোপেশ বলেছে, ‘খাওয়া থাকা ছাড়া টাকাপয়সা কিচু দিতি পারব না বাপু, পোষালি থাকতি পারো।’ শৈলেন মাথা নেড়ে সাঁয় দিয়েছে, আর বলেছে, ‘বছর শেষে না’ই কিচু দেবে।’ গোপেশ বলেছে, ‘বছর শেষ হলি তা দ্যাকা যাবে।’
সূর্য জাগার আগে জাগে শৈলেন। দিনভর কাজ করে, সন্ধ্যার পর বৈঠকখানায় শুয়ে শুয়ে বিড়ি ফুঁকে। বৈঠকখানায় তাকে তিনবেলা খাবার দিয়ে আসে জগতী। বাশঘরে গিয়ে খাওয়ার মতো অধিকার এখনো অর্জন করতে পারেনি। সবে তো চার মাস, বছর ঘুরলে হয়ত রান্নাঘরেও যাবে। খায় বলদের মতো। থালায় হয় না, ভাত দিতে হয় বাসনে। বাসনটা তার নিজের। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কিনে জগতী বেওয়াকে দিয়ে বলেছে, ‘ভাত-তরকারি সব একসাতে দিলি হবেনে। আমি বাপু থালায় খাতি পান্নে।’
সকালে ক্ষেতে যাওয়ার আগে এক বাসন নিয়ে বসে। একটু তরকারি বা আলুভর্তা হলে তো কথা নেই, না থাকলে দুটো পোড়া লঙ্কাতেই চলে। দুপুরে খিদেটা একটু বেশিই লাগে, দুই বাসন না হলে পেট ভরে না। জগতী বেওয়া গোঁৎ গোঁৎ করে, ‘মানষি কেরাম কুরে এ্যাতোগুনো ভাত খায়! পেট না নাদা!’
শৈলেন পাঁঠার মতো হাসে, ‘আমার মতোন গতরে খাইটে দ্যাকো না, তিন গামলাও কুলোবে না, হুঁ।’
জগতী বলে, ‘উঁ, আমি তো খাটি নে, সারাদিন বুসে বুসে কেবল আঙুল চুষি।’
বেহায়ার মতো শৈলেন হে হে করে হাসে। হাসিটা কানের লতি পর্যন্ত ছড়ায়। ওই হাসি দেখে জগতীর কেমন শরম করে। মৃত শোয়ামির কথা মনে পড়ে যায় বুঝি। মৃত্যুর আগে পরিতোষের বয়সও ঠিক এমন ছিল। গায়ের রংও ছিল এমন শ্যামলা, লম্বাও ঠিক এমন। হাসিটা শুধু এমন কুৎসিত ছিল না।
বারো বছর বয়সে পরিতোষের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল জগতীর। চৌদ্দ বছর বয়সে ছেলে কানাই জন্মায়। কানাইর বয়স যখন ছয়, বাদায় গিয়ে পরিতোষ বাঘের কবলে পড়ল। আটজন বাওয়ালির সঙ্গে মাথাভাঙার উজানে কাঠ কাটতে গিয়েছিল। একটা খালে নৌকা ভিড়িয়ে সবাই বাদায় উঠল। সবার হাতে হাতে দা-কুড়াল। কেউ শুকনো, কেউ কাঁচা ডাল কাটছে। একটা গেউয়ার ডাল কাটছিল পরিতোষ। হঠাৎ তার চোখ গেল অদূরের হেতালবনে। ডোরাকাটা জন্তুটা হেতালঝোঁপ থেকে বেরিয়ে গরমে ক্লান্ত কুকুরের মতো জিব বের করে ছুটে আসছে তার দিকে। পরিতোষ তো থ, বাকরুদ্ধ। চিৎকার দিতেও ভুলে যায়।
পলকের মধ্যে বাঘটা লাফিয়ে পড়ল তার ঘাড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ঘাড়টা মটকে দিল। পরিতোষ পড়ে যায়। কিন্তু কুড়ালটা হাতে ধরা। বাঘ কামড় বসায় তার ডান উরুতে, গলায় নখ মারে। পরিতোষের সঙ্গীরা দৌড়ঝাঁপ মেরে নৌকায় উঠে পড়ল। তাকে বুকের মধ্যে পুরে নিল বাঘটা। পরিতোষ বুঝতে পারে যম তাকে জনমের মতো টেনে নিচ্ছে। বাঘের গরম নিঃশ্বাস পড়ছে তার গলায়, মুখে। রামনাম জপতে থাকে সে, মা বনচণ্ডীর নামও বুঝি মনে এলো একবার। তার চোখে ভেসে উঠল বউ-বাচ্চার মুখ।
বাঁচার শেষ চেষ্টাটা করল পরিতোষ, কুড়ালটা ফেলে বাঘের গলা টিপে ধরল। বাঘে-মানুষে শুরু হলো দুন্ধুমার লড়াই। শরীরের সবটুকু শক্তি খাটিয়ে গলাটা আরো জোরে টিপে ধরে পরিতোষ। গোংরাতে গোংরাতে বেচারা বাঘ জিবটা বের করে দেয়। কিন্তু এমন শক্তিশালী জানোয়ারের সঙ্গে, দক্ষিণরায় ছাড়া আর কারো সামনে যে মাথায় নোয়ায় না, পরিতোষের মতো মানুষ কতক্ষণ টিকতে পারে! হঠাৎ বাঘটা হুঙ্কার ছেড়ে তার শিকারকে মারল আছাড়। পরিতোষ উপুড় হয়ে পড়ে গেল। না, আর দাঁড়াতে পারল না বেচারা। বাঘ তাকে টানতে টানতে হেতালবনে নিয়ে গেল।
জীবনের সঙ্গে পরিতোষের লড়াই থামল। মরণের সঙ্গেও। লড়াই শুরু হলো জগতীর। তার নামের শেষে যুক্ত হলো ‘বেওয়া’। ভাগ্য ভালো, কেশব মাস্টারের মতো দয়ালু একজন মানুষ ছিলেন গ্রামে, নইলে তাকে হয়ত না খেয়েই মরতে হতো। পনেরোটা বছর সে মণ্ডলবাড়ির সুখে-দুঃখে আছে। চারুবালা রোগে পড়ার পর থেকে সংসারটা দেখেশুনে রাখছে। নিজের বাড়িঘরে যাওয়ার সময়টুকুও পায় না এখন। যেতে অবশ্য চায়ও না সে। গিয়ে কী করবে? বাড়িতে কে আছে তার? কানাইটা রাখাল ময়রার দোকানে মেসিয়ারি করছে। থাকে-খায় ওখানেই। সপ্তা-দশ দিনে একবার মন চাইলে বাড়ি আসে। গাইগরু একটা ছিল জগতীর, কোরবানির হাঁটে বেচে দিয়েছে। আর ছিল কয়েকটা হাঁস-মুরগি। সেগুলোও রাখেনি। হাজার দশেক টাকা জমেছে তার হাতে, আরো দশ হাজার জমাতে পারলে সে মোটামুটি চিন্তামুক্ত। শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে কাজ করতে করতে তার কানাই মিষ্টির কারবারে রাখাল ময়রার মতো দক্ষ হয়ে উঠছে। আর কটা দিন গেলে সে ময়রাকেও ছাড়িয়ে যাবে। তখন গরানপুর বাজারে ছেলেকে একটা দোকান ধরিয়ে দেবে। দেখেশুনে একটা বিয়েও করিয়ে দেবে। তখন তার মতো সুখে আর কে থাকবে গ্রামে।
মাঝেমধ্যে জগতীর মনে হয়, তার সুখটা আরো বেড়ে যেত শৈলেনের মতো একটা মানুষ যদি থাকত তার সংসারে। শৈলেনকে ওভাবে হাসতে দেখলেই কথাটা তার মাথায় চাগা দিয়ে ওঠে। তখন নিজেই নিজের কাছে লজ্জা পায়। ধুর ছাই! কানাই বড় হয়েছে না। ফের ভাতার ধরলে কোন মুখে সে ছেলের সামনে দাঁড়াবে। ভাতারের হাত ধরে না হয় সে নিরুদ্দেশে চলে গেল, কিন্তু শাস্ত্র কি তাকে ছাড়বে?
চারুবালা সুস্থ হয়ে ওঠায় মণ্ডলবাড়ি যেন খানিকটা প্রাণ ফিরে পেল। সুস্থ অবশ্য এমনি এমনি হয়নি। খুলনায় নিয়ে বিস্তর টাকাপয়সা খরচা করে ভালো ডাক্তার দেখাতে হয়েছে। খবর পেয়ে অতুলচন্দ্রই বলেছিল খুলনায় নিয়ে যেতে। জমি বেচে মাকে খুলনায় নিয়ে গেল গোপেশ। অনেক সহযোগিতা করেছে অতুলচন্দ্র। নিজ বাড়িতে রেখেছে টানা পনেরো দিন, ভালো ডাক্তারের খোঁজ-খবর করে দিয়েছে। জগতী বেওয়া না থাকলে ঘরে তালা লাগিয়ে মা-ভাইয়ের সঙ্গে তাপসীকেও যেতে হতো। এমন যৌবন নিয়ে তো একা বাড়ি একা ঘরে থাকা যায় না। কে তাকে পাহারা দিত? বিপদে পড়লে কাকেই-বা ডাকত? মা-ভাই ছাড়া আর আছেই-বা কে তার? সেই যে গেল হালিম, দ্বিতীয়বার আর গরানপুরে এলো না। নমিতাকেও আসতে দেয়নি। নমিতাও বাবাবাড়ির কথা ভুলেটুলে গেছে হয়ত। মানুষের মনটা তো নদীর মতো। জোয়ার আসে, ভাটা পড়ে। কখনো সমান্তরাল, কখনো আঁকাবাঁকা। নমিতার মনটাও হয়ত বাঁক নিয়েছে। গরানপুরের দিকে তার মন হয়ত আর কোনোদিন ফিরবে না। মহব্বত সাজুনি একবার খবর এনেছিল হালিম নাকি এখন আর যশোরে নেই, বদলি হয়ে রংপুরে চলে গেছে। কে জানে, হয়ত এখন তারা রংপুরেই আছে। রাজশাহী বা দিনাজপুরেও থাকতে পারে। সরকারি চাকরি, বদলি হয়ে সারা দেশে ঘুরতে হয়।
মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে দীপিকা একবার এসেছিল। দিন দুই ছিল। ওই একবারই আসা। অসুস্থ মা-টা বেঁচে আছে না মরে গেছে, তারপর আর খোঁজও নেয়নি। কে জানে, নমিতার মতো তার মনও হয়ত বাঁক নিয়েছে। হয়ত খোঁজ নেয়ার মতো সময় নেই তার। সংসার তো তারও আছে। পাঁচ ছেলেমেয়ে আর গোটা সংসারটা সামলাতে তার দিন কোথায় যায়, রাত কোথায় যায় কিছুই তো টের পায় না। দিদারের তো ব্যস্ততার সীমা নেই। সে এখন পাকা কিশেন। এক মরশুম গেলে আরেক মরশুম এসে দরজায় কড়া নাড়ে। বলদের হালটা তো তাকেই ধরতে হয়, মইটাও তাকে দিতে হয়, ধানটাও তাকে কাটতে হয়, আঁটি বেঁধে তাকেই বাড়ি তুলতে হয়। কত কাজ তার। মাটিতে ফসল ফলাতে হলে কাজ তো করতেই হবে। এক মনে এক ধ্যানে চাষাবাদটা চালিয়ে গেলে তবেই না সোনার ফসল ঘরে উঠবে। অসুস্থ শাশুড়ির সেবা-যত্ন করতে গেলে তো জমিনে গরু-ছাগল চরবে।
তাছাড়া শ্বশুরবাড়ির প্রতি তার আগ্রহও কমে গেছে। তার মা চায় না ছেলে হিন্দুবাড়িতে যাক। সেবার বউকে নিয়ে অসুস্থ শাশুড়িকে দেখে ফিরলে পরে তার মা কেঁদেকেটে তার হাত চেপে ধরে বলল, ‘বে করিচিস বাপ ভালো কথা। বউরে আমি কোনোদিন হ্যালা করিনি, হিঁদুর ঘরের মাইয়ে বুলে খারাপ চোখি দেখিনি। তোর খোদার দোহাই, ওই হিঁদুবাড়িতি যাস নে তুই। কাল হাশরে খোদার কাচে কী জবাব দিবি বাপ?’
মায়ের মন রক্ষা করতে অথবা কাল হাশরে কাহ্হার খোদার কঠিন প্রশ্নের কথা ভেবে গরানপুর যাওয়া ছেড়ে দিল দিদার। ছেড়ে দেয়ার কারণ অবশ্য আরো আছে। ইউপি ইলেকশনের পরের বছর মাকে না বলে একবার গরানপুর গিয়েছিল। চারুবালা তখন সুস্থ হয়ে উঠছে। এবার আর মেয়েজামাইয়ের আড়ালে থাকল না সে। শাশুড়িকে কদমবুচি করেছে দিদার। তার মাথায় হাত বুলিয়ে শাশুড়ি বলেছে, ‘ভগবান মঙ্গল করুক।’ দুজন অনেকক্ষণ সুখ-দুঃখের আলাপও করেছে।
বিকেলে গোপেশসহ গরানপুর বাজারে ফেলুর দোকানে বসে চা-পেঁয়াজু খাচ্ছিল দিদার। মানুষজন বাজারে আসতে শুরু করেছে। ফেলুর দোকানের ক্যাসেটপ্লেয়ারে পাকিস্তানি শিল্পী সালমা আগার গান বাজছে, ‘দিল কি আরমা আঁখোও সে বেহে গেয়ি।’ দোকানের বাইরে রাস্তার ওপর জাবেদ খানের সঙ্গে আলাউদ্দিনের কথাকাটাকাটি চলছে। ইলেকশনের সময় প্রসূন মাইতির ভিটায় তোলা ছাওড়াটা সরিয়ে ফেলতে বলেছিল জাবেদ খান। তাতেই ক্ষেপে গেল আলাউদ্দিন, ‘সরাতি হবে কেন? তুমি সরাতি বলার কেডা? তোমার বাপের জাগা? প্রসূন মাইতি কি তোমার বাপ হয়?’
জাবেদ খানের মেজাজ কি আর ঠিক থাকে? বাটা কোম্পানির চামড়ার স্যান্ডেলটা খুলে ঠাস ঠাস করে আলাউদ্দিনের গালে দুটো বাড়ি বসিয়ে দিল। আলাউদ্দিন তো প্রথমে হতভম্ব। তারপর তাকে আর কে রোখে। জাবেদ খানের পাঞ্জাবির কলারটা চেপে ধরল সে, ‘তোরে এত সাহস দিচে কেডা খানকির ছাবাল। কোন সাহসে তুই আমার গায় হাত দিলি? তুই আমারে চিনিস না বাইন্চোত?’
এক দৌড়ে গোপেশ দোকান থেকে বেরিয়ে আলাউদ্দিনের বুকে জোরসে মারল এক ধাক্কা। রাস্তার কাদায় পিছলে পড়ল আলাউদ্দিন। জামা-কাপড়ে কাদা নিয়ে উঠে এবার সে গোপেশের ওপর চড়াও হলো। আচমকা একটা ঘুষি মেরে বসল তার নাক বরাবর। নাক ফেটে রক্ত বেরোতে লাগল গোপেশের। দিদার কি আর বসে থাকতে পারে? দু-হাতে আলাউদ্দিনকে জড়িয়ে ধরে টানতে টানতে বাজারের বাইরে নিয়ে যেতে লাগল। দুজনে শুরু হলো ধস্তাধস্তি। দু-চারটা কিল-ঘুষিও পড়ল আলাউদ্দিনের গায়ে। দিদারও বাদ গেল না। তার শার্টটা টান মেরে ছিঁড়ে ফেলল আলাউদ্দিন। গলাটা এমনভাবে চেপে ধরল, দিদারের দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো। লোকজন এসে তাদের না থামালে দুজনের যে কোনো একজনের অঘটন কিছু একটা ঘটে যেতে পারত।
ক্লান্ত আলাউদ্দিন হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘শালা কাদিয়ানি কাফের, আমার নুন খাইয়ে আজ তুই আমার গা’য় হাত তুল্লি!’ তারপর আঙুল নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘আর যদি কোনোদিন তোরে এই গ্রামে দেখি, তা’লি শালা জ্যান্ত কবর দ্যাবো।’
ঐ ছেঁড়া শার্টটা নিয়েই বাড়ি ফিরে গেল দিদার। তারপর আর গরানপুর আসেনি। এই গ্রামটার প্রতি তার দুর্বলতা ছিল। আলাউদ্দিনের বাড়ির নির্জন পুকুরঘাট, দক্ষিণের বিস্তীর্ণ প্রান্তর, মায়াবী জোছনার রাতে ছেরু পাগলার গান, চুনকুড়ির জোয়ার-ভাটা, মণ্ডলবাড়ি, দীপিকার সঙ্গে প্রথম দেখা, আলাপ-পরিচয়, প্রেম, ভাড়া নৌকায় চড়ে একদিন তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া – এসব কিছু তার স্মৃতিতে ভাসত সবসময়। রোজ রাতে বিছানায় শুয়ে চোখ বুজলে স্মৃতিগুলো ভেসে উঠত। আলাউদ্দিনের সঙ্গে মারামারির ঘটনাটার পর গরানপুর থেকে তার মন উঠে যায়। গ্রামটার কথা ভুলে থাকতে চায়। আলাউদ্দিনের হুমকিতে ভয়ও পেয়েছে কিছুটা। পাওয়াটা স্বাভাবিক। সে আহমদিয়া জামায়াতের অনুসারী, আর আলাউদ্দিন মোহাম্মদী জামায়াতের। তার ওপর সে হেদায়াতে ইসলামির নেতা। আহমদিয়ারা তো হেদায়াতের জানের দুষমন। আহমদিয়া বলে কখন আবার তার পিছে হেদায়াতের গুণ্ডা-মাস্তান লেলিয়ে দেয় আলাউদ্দিন, বলা তো যায় না।
সে যাই হোক, দু-বোনের একজনেরও খোঁজ নেয়ার দরকার মনে করেনি তাপসী। গোপেশও না। দিদিদের কথা, বোনপো-বোনঝিদের কথা হয়ত মাঝেমধ্যে মনে পড়ে তাপসীর। তখন মন খারাপ হয়। গোপেশ কিন্তু কঠিন, অনেকটা বাবার মতো, সে ওসব মনে পড়াপড়ির মধ্যে নেই। তার হিসাব সোজা, ‘তারা যদি আমাগো খোঁজখবর না নেয় আমরা ন্যাবো কোন দুক্ষি?’
চারুবালার কি মনে পড়ে? হয়ত পড়ে। হয়ত সে আগের মতো কাঁদে। কিন্তু সেই কান্না কেউ দেখে না, কাউকে সে দেখায় না। কে জানে, হয়ত কাঁদেই না। এক জীবনে কত আর কাঁদা যায়? চোখে আর কত জল থাকে? তার মস্তিষ্কের কোষে গত জীবনের সব স্মৃতি যে আগের মতো এখনো বহাল আছে তাও তো বলা যায় না। যে রোগে সে পড়েছে, স্মৃতি তো মুছেও যেতে পারে। শীতের পাখির মতো স্মৃতিরা হয়ত মাঝেমধ্যে উড়ে আসে তার মাথায়। তখন তার কেমন যেন লাগে। ঘরে আর তিষ্ঠোতে পারে না, দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে।
দূরে কোথাও চলে যাওয়ার জন্যই বুঝি লাঠি ভর দিয়ে সেদিন চুনকুড়ির আড়ায় এসে দাঁড়াল সে। তখন চৈত্রভোর। আড়ার দুটি কৃষ্ণচূড়া আগুন ছড়াচ্ছে। পুবের বাদায় গাছগাছালির ফাঁকে লাল সূর্যের আলাঝিলা দেখা যায়। চুনকুড়িতে ভরা জোয়ার। গোলপাতার মুড়াটির কাছে ভেসে আসা বুনোফল ও পাতার স্তূপ। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে চারুবালা মাজেদ গাইনের বাড়ির কাছাকাছি চলে এলো। নির্মল ভোর তাকে স্মৃতিকাতর করে তুলল দারুণ।
ওদিকে সারা বাড়িতে তখন হুলুস্থুল পড়ে যায়। জগতী বেওয়া এদিক খোঁজে, তাপসী ওদিক। না আছে বাশ্ঘরে, না আছে হেঁশেলে। ঠাকুরঘরে বা বৈঠকখানাও খুঁজে দেখল, পেচ্ছাব-পায়খানায়ও বাদ দিল না। নেই। কোথায় গেল তবে চারুবালা?
গোপেশ আড়ায় উঠে দেখে, পাখপাখালির ডাকে মুখর বাদার দিকে তাকিয়ে মা তার চোখের সব জল ছেড়ে দিয়েছে। নিঃশব্দে সে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মায়ের কান্না তার মধ্যেও সংক্রমিত হয়। অশ্রু ঠেকাতে সে চোখ বন্ধ করে। বন্ধ চোখে বুঝি দেখতে পায় চুনকুড়ির জলে তার গুলিবিদ্ধ দাদা হাবুডুবু খাচ্ছে। ওপারের সুন্দরী গাছের আড়ালে কারা যেন তার বাবার চোখমুখ বেঁধে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ছেলের মুখের দিকে তাকায় চারুবালা। গোপেশ বাদার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। দাঁতে দাঁত পিষছে, ক্রোধের ঢেউ ভাঙছে চেহারায়, চোখ দুটো থেকে যেন আগুনের হলকা বেরোচ্ছে।
চারুবালা চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘হাঁট গপু, আমারে ঘরে নে হাঁট।’
গোপেশ ধমকে ওঠে, ‘কারো না বুলে তুমি ইকেনে আইলে ক্যানো?’
: এমনি বাবা। এট্টু হাঁটতি আলাম। হাঁট, বাড়ি যাই।
সেদিন, কে জানে কী মনে এলো চারুবালার, লাঠি ঠুকে ঠুকে গোনের দিঘির দক্ষিণ পাড়ে এসে দাঁড়াল। পথ বেশি নয়, কিন্তু তার জন্য অনেক। এতটা পথ হেঁটে সে হাঁপিয়ে ওঠে। দিঘির পাড়ে প্রাচীন বকুলগাছটার শিকড়ে হেলান দিয়ে চিমসে দূর্বাঘাসের ওপর বসল। ফুল ঝরে সাদা হয়ে আছে গাছতলা। উদ্ভ্রান্ত ভ্রমরেরা উড়ে বেড়াচ্ছে। একটা চন্দ্রবোড়া ফুলের গালিচার ওপর দিয়ে দিঘির পশ্চিম পাড়ে গোরস্তানের দিকে চলে যায়। চারুবালা ঠাওর করতে পারে না। তার দৃষ্টি উত্তর পাড়ে প্রসূন মাইতির ভিটায়। সেখানে এখন মাদ্রাসা উঠেছে – গরানপুর ইসলামিয়া মাদ্রাসা। ছবেদালি চেয়ারম্যানের মহত্তম অবদান। সে এখন মুন্সিগঞ্জের সবচেয়ে সুখী মানুষ। সবচেয়ে দামী মটরসাইকেলটা তার, সবচেয়ে দামী ঘড়িটা তার হাতে। মাসে মাসে নতুন নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি ওঠে তার গায়ে। সুখ রাখার মতো জায়গা নেই তার। নির্বাচিত হওয়ার দু-বছর বাদে গরানপুরের মুসলমানদের সুখী করতে মাদ্রাসার কাজে হাত দিয়েছে। সে-বছর গরানপুর-হরিনগরের মসজিদ, মন্দির ও রাস্তাঘাট উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ সব টি.আর মাদ্রাসার নামে বরাদ্দ দিল। দু-মাসের মধ্যেই মাটির গুদামের ওপর টিনের চাল উঠে গেল। জিয়ারত আলী এসে মাদ্রাসা উদ্বোধন করে গেলেন। মাদ্রাসার মাঠে সেদিনের বক্তৃতায় ছবেদালি বলল, ‘এই গ্রামে এট্টা ইস্কুল হবার কতা ছেলো। হয়নি তাতে কি, মাদ্রাসা তো হুয়েছে। মাদ্রাসা হুয়ে বরং ভালোই হইচে। মসজিদ আল্লার ঘর, আর মাদ্রাসা নবীর। আপনারা চালি এই গ্রামে স্কুলও হবে এনশাল্লা।’
উপস্থিত জনতা মুহুর্মুহু হাততালি দেয়। গোফরান মৌলানা তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলল, ‘আপনারা চ্যারমেন শায়েপের জন্যি দোয়া করবেন। তিনি এলাকার চ্যারমেন না হলি কোনোদিন এই গরানপুরি মাদ্রাসা বানানো হুতো না।’
জনতা মাথা নাড়িয়ে তার কথার সমর্থন জানায়। ঠিকই তো। কে উঠাত মাদ্রাসা? আলেম-উলামা কে আছে এই গ্রামে? মাদ্রাসার খেদমতে গোফরান মৌলানা যে রোজ এত দূরের পথ ডিঙিয়ে আসছে, তাও তো চেয়ারম্যানের অনুরোধেই। সেই সকালে সাইকেল হাঁকিয়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে আসে। ফেরে বিকেলে, আসরের নামাজের পর। তার কী এমন ঠেকা? জমিজিরাত আছে, মুন্সিগঞ্জ জামে মসজিদের ইমামতি আছে, এত পরিশ্রমের তো দরকার ছিল না তার। যা কিছু করছে সবই তো ছবেদালি চেয়ারম্যানের অনুরোধে।
গোফরান মৌলানার স্বপ্ন, এই মাদ্রাসা একদিন অনেক বড় হবে। দূরদূরান্ত থেকে শত শত তালেবুল এলেম আসবে এলেম তলব করতে। আপাতত হেফজখানা ও এতিমখানা চালু হয়েছে। বারোজন এতিম ছেলে আবাসিকভাবে থেকে কোরান হেফ্জ করছে। দেড় হাজার টাকা বেতনে হাফেজ রাখা হয়েছে একজন। সমাজসেবা অফিসে চারজন ছাত্রের ক্যাপিটেশন গ্রান্ডের জন্য দরখাস্ত করা হয়েছে। বছর ঘুরলে দরখাস্তটা মঞ্জুর হয়ে যেতে পারে। জিয়ারত আলী তদবির করছেন, না হয়ে যাবে কোথায়! আগামী বছর থেকে আপাতত এবতেদায়ি চালু করা হবে। জিয়ারত আলীর মতো মানুষের নেকনজর থাকলে এবতেদায়ি মঞ্জুরি পাওয়াটা কোনো ব্যাপারই না। গোফরান মৌলানার বিশ্বাস, দ্বীনের কাজে টাকাপয়সা কোনো সমস্যা নয়। টাকার ব্যবস্থা আল্লাই করে। এই যে গোনের দিঘিটা, কেউ কোনোদিন ভেবেছিল এ দিঘির পাড়ে একদিন মাদ্রাসা উঠবে? দিঘিটা মাদ্রাসার দখলে আসবে? সবই আল্লাপাকের ইশারা। মাদ্রাসা কমিটির কাছ থেকে দিঘিটা ইজারা নিয়েছে আলাউদ্দিন। গলদা চিংড়ির পোনা ছাড়ার কথা ভাবছে সে। মাছ বড় হলে অর্ধেক তার, অর্ধেক মাদ্রাসার। গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনির ওদিকে গলদা-বাগদার চাষ ভালোই জমেছে। মুন্সিগঞ্জের অনেক গ্রামেও শুরু হয়েছে। দিঘিটায় ঠিকমতো যদি গলদা চাষ করা যায়, তখন তো আর টাকাপয়সার অভাব থাকবে না। মাছ বেচা টাকাতেই মাদ্রাসাটা চালিয়ে নেয়া যাবে।
চারুবালা মাথা তুলে গাছটার দিকে তাকায়। অসংখ্য ফুল ফুটে আছে নক্ষত্রের মতো। মনে কী যেন ভাবনা তার। পুরনো কোনো স্মৃতি বুঝি! সেই কতদিন আগে, সবে বিয়ে হয়েছে তার, ওপরের মাড়ির পোকায় খাওয়া একটা দাঁত নড়ে গিয়েছিল। অনন্ত মণ্ডল একদিন গাছটার এক টুকরো বাকল এনে তার হাতে দিয়ে বলল, ‘দিনি তিনবেলা কুরে চাবাতি হবে। দ্যাখপা দাঁতডা বুসে যাবে।’
খাঁখাঁ দুপুর। মাদ্রাসার মাঠে কানে হাত দিয়ে পশ্চিমমুখী দাঁড়িয়ে একটা ছেলে আজান হাঁকছে। ছেলেপেলেরা অজু-গোসল করতে ঘাটে নেমেছে। তাদের উচ্ছল কলকণ্ঠ ভেসে আসছে। সেদিকে খেয়াল নেই চারুবালার। তার দৃষ্টি গাছের নিচু ডালটায়, যেখানে পাপড়ি ও পরাগচক্রের বিচিত্র ভঙ্গি নিয়ে পাংশু-সাদা অজস্র ফুল ফুটে আছে। তার ঠোঁটজোড়া কাঁপছে, ভুরুজোড়া বেঁকে কপালে উঠে গেছে। কাঁদছে বুঝি? কাঁদছেই তো। এই যে চোখের দু-কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে!
মাথা নামিয়ে রাস্তার দিকে তাকায় চারুবালা। ঝাপসা চোখে দেখে গরানপুর জামে মসজিদ পেরিয়ে জোর পায়ে কে যেন বকুলতলার দিকে ছুটে আসছে। গোপেশ? ঠিক ঠাওরে উঠতে পারে না। হ্যাঁ, গোপেশই তো। না, গোপেশ নয়। কেশব মাস্টার? হারিয়ে যাওয়া তার জন্ম-জন্মান্তরের সঙ্গী? না, তাও নয়। লোকটাকে অনন্ত মণ্ডলের মতো মনে হয় তার। তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তার শ্বশুরমশাই, ‘আইস বউমা, চুলে আইস। ওকানে তুমি কী কুত্তচ একা একা? চুলে আইস…চুলে আইস।’
চারুবালার মুখে হাসি ফোটে, দু-গালের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে। ভাঁজপড়া চামড়া গড়িয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গলার দিকে নামতে থাকে। লাঠিতে ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। কি যে হলো, মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠল। চরকির মতো ঘুরতে থাকে চারপাশ। শরীরের ভারটা ধরে রাখতে পারল না লাঠি, হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল চারুবালা। লাঠিটা চাপা পড়ল পিঠের নিচে। চোখে আর কিছু ঠাওরে আসে না তার। থোকা থোকা সাদা ফুলগুলো কালো হয়ে ধরা দেয় তার চোখে। ফুল কালো, গাছ কালো, প্রান্তর কালো, আকাশ কালো – পৃথিবীর সমস্ত কিছু কালো আর কালো। নিকষ কালো অন্ধকার।
দক্ষিণা বাতাসের ঝাপটায় বকুলগাছটায় শোঁ শোঁ শব্দ ওঠে। অসংখ্য ফুল ঝরে পড়তে থাকে চারুবালার মুখে, বুকে, পেটে, মাথার কাছে ও পায়ের কাছে।