কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
পনেরো.
বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা থামতে ছয় মাস লেগে গেল। উত্তেজনাটা আরো কিছুদিন গড়াত, যদি না ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ঢামাঢোল বেজে উঠত। নতুন ইস্যুর নিচে চাপা পড়ে গেল পুরনো ইস্যু। খসরু তালুকদারের মতো ডাকসাইটে প্রার্থীর সঙ্গে টেক্কা দিয়ে জয়ের মালা ছিনিয়ে নিল ছবেদালি মোড়ল, উত্তেজনার এও এক নতুন ইস্যু বটে।
একটা বড় ধাক্কা খেলেন খসরু তালুকদার। বাপের মৃত্যুর পর প্রথম যখন তিনি ইলেকশনে দাঁড়ালেন তার বয়স তখন বত্রিশের বেশি নয়। বয়সে কি যায়-আসে, আজহার তালুকদারের ছেলে বলে কথা―নাবালকও হলেও মানুষ ঠিকই তাকে ভোট দিত। সে কেন, আজহার তালুকদারের পক্ষে একটা তালগাছকে দাঁড় করিয়ে দিলেও মানুষ ওই গাছটাকেই ভোট দেবে। সেবার সত্যি সত্যি ভোটের বন্যা বয়ে গেল। হিন্দু, মুসলমান, মুণ্ডা, বাগ্দি, কাদিয়ানি সবাই গণহারে তার হরিণ মার্কায় সিল মারল। প্রতিদ্বন্দ্বী মোক্তার চৌধুরী পেলেন মাত্র সাত শ চুয়াত্তর ভোট। দ্বিতীয়বারের ইলেকশনের আগে চৌধুরী মারা গেলেন। খসরু তালুকদারের দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, কিন্তু প্রার্থী হিসেবে তারা ছিল দুর্বল। দুজনে মিলে হাজারখানেক ভোট হয়ত পেত। খসরু তালুকদার বললেন, ‘খামোখা টাকাপয়সা নষ্ট কইরে কী লাভ? তার চে আমি কিছু টাকা দিচ্চি, তোমরা বরং আমারে সমর্থনডা দিয়ে দ্যাও।’ সমর্থন তারা দিয়ে দিল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি চেয়ারম্যান।
তৃতীয়বারের ইলেকশনেও বড় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকার কথা ছিল না, যদিও বেশ কিছুদিন ধরে প্রার্থী হিসেবে ছবেদালি মোড়লের নাম শোনা যাচ্ছিল। তেমন পাত্তা দেননি তিনি। উল্টো হাসাহাসি করেছেন, ‘দেশ স্বাধীনির পর পাঁচ বছর পলিয়ে থাকা শান্তিকমিটির পাণ্ডা কিনা আমার বিরুদ্ধে লড়বে? ডেয়ারিং ছবু কদিন হলো ছবেদালি মোড়ল হইচে? কেডা তারে ভোট দ্যাবে? মানুষ কি এত তাড়াতাড়ি তার কুকর্মের কতা ভুলে গেচে?’
তার হাসিটা থেমে গেল নমিনেশন পেপার জমা দেয়ার দিন। মুন্সিগঞ্জ থেকে বাস রিজার্ভ করে পাঁচ শ লোক নিয়ে ছবেদালি নমিনেশন পেপার জমা দিতে গেল। সে কী কাণ্ড! উপজেলা পরিষদের মাঠে তিল ঠাঁই নেই, শুধু মানুষ আর মানুষ। হেদায়াতে ইসলামি শ্যামনগর উপজেলা শাখার নেতা-কর্মীরাও তার মিছিলে যোগ দিল। এত মানুষ দেখে ইউএনও অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পর্যন্ত ভড়কে গেল – ওরেব্বাপ, এত জনপ্রিয়তা ছবেদালির!
ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল পরিস্থিতি ততই পাল্টে যেতে লাগল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চায় ছবেদালি। যাওয়ার সময় খালি হাতে যায় না। এক সের জিলাপি, এক প্যাকেট বিস্কিট, নিতান্ত এক বিড়া পান তো সঙ্গে নেবেই। কিছু নিতে না পারলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার কড়কড়ে একটা নোট বের করে হাতে গুঁজে দেবে, ‘কিছু মনে কইরবেন না, আমি তো আপনাগো ছাওয়ালের মতোন। চা-নাশতা খাওয়ার জন্যি টাকাডা দেলাম, রাখলি খুশি হব।’
নিজের গাঁটের টাকা অন্যকে দিয়ে খুশি হয় এমন জনদরদি নেতা কটা আছে! এ যুগে কে কাকে টাকা দেয়? দু-এক টাকা নয়, পাঁচ-দশ টাকাও নয়, নগদে পঞ্চাশ টাকা। প্রায় আট সের চালের দাম। দু-তিন দিন আর রোজগারের চিন্তা থাকে না। এমন নেতাকে খুশি করতে ভোটাররা তো তার পা ছুঁয়েও সালাম করতে রাজি। কিন্তু ছবেদালি কি সেই সুযোগ দেয়? ময়মুুরব্বি দেখলেই সে মুখে সালাম দেয়ার আগে পায়ে গিয়ে পড়ে। কামলা-কিশেনদের হাজাধরা পায়ের উৎকট গন্ধ সারাদিন তার হাতের আঙুলগুলোতে লেগে থাকে, কসকো সাবানে ধুয়েও তাড়াতে পারে না। কদমবুচি করতে করতে মাজায় ব্যথা ধরে যায়। ব্যথা তাড়াতে রোজ রাতে মাজায় রসুন-তেল মালিশ করতে হয়।
গ্রামে গ্রামে তার নির্বাচনী অফিস উঠেছে। রোজ কত লোক সেসব অফিসে চা-নাশতা খায় তার তো শুমার থাকে না। গোনের দিঘির পাড়ে প্রসূন মাইতির ছাড়াভিটায় টিনের ছাওড়া তুলে একটা অফিস বসানো হয়েছে। ফেলুর দোকানে দুন্ধুমার বেচাকেনা। অফিসে চা পাঠাও, বিস্কিট পাঠাও, পান পাঠাও, বিড়ি-সিগারেট পাঠাও। বাড়তি দুজন লোক রেখেও ফেলু কুলিয়ে উঠতে পারে না। ছবেদালি মোড়ল এলে তো আর কথা নেই, তার পিছে পুরো গ্রাম ভেঙে পড়বে। তখন বেচার মতো দোকানে আর এক প্যাকেট বিস্কুটও থাকে না।
প্রসূন মাইতির ভিটায় ছাওড়াটা তোলার সময় জাবেদ খান বাধা দিয়েছিল, কিন্তু পাত্তা পায়নি। হেদায়াতে ইসলামির নেতা-কর্মীরা হৈহৈ করে উঠল, ‘সরকার জাগাডা ইস্কুলির জন্যি একোয়ার কুরেচে নাকি? ভালো কতা ইস্কুল হবে, ছবেদালি ভাই তো আর জাগাডা গিলে ফেলাচ্চে না। ভোট শেষ হলি কেউ তো মুত্তিও এখানে আসপে না। প্রথমবারের মতোন হরিনগরের ছাওয়াল চ্যারমেন প্রার্থী হুয়েচে, ভোটে জিতলি এট্টা ক্যানো, দরকার হলি দশটা ইস্কুল হবে।’
জাবেদ খান অনেকটা অপমানিত হয়ে ফিরে এলো। ছেলেপেলেরা আঙুল নাড়িয়ে যেভাবে কথা বলল তা অপমান বৈকি। গরানপুর-হরিনগরের কেউ কোনোদিন তার সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলেনি, বলার মতো সাহস পায়নি। মেজাজ চড়ে গিয়েছিল তার, বহু কষ্টে রাশ টেনে ধরেছিল। নইলে হয়ত লাঞ্ছিত হতো। বুড়োরা যেমন তেমন, ছেলেপেলেদের সঙ্গে তো কথাই বলা যায় না। ভালো কথা বললে উল্টোটা বুঝে বসে থাকে, মুখের ওপর মন্দশক্ত বলে বসে। মহব্বত সাজুনি বলল, ‘বুঝলে কাকা, টাকার গরম বুলে কতা! কারো পকেট তো এখন খালি না, দশ বছরের পুঁচকে ছ্যামড়াডার পকেটেও দশ টাকার কড়কড়ে নোট পাবা।’
এলাকার লোক চেয়ারম্যান প্রার্থী, যত যাই হোক জাবেদ খানও হয়ত ছবেদালির পক্ষে কাজ করত। কিন্তু হেদায়াতে ইসলামির কর্মীদের আচরণে মন খারাপ করে সে খসরু তালুকদারের পক্ষ নিল। ফেলুর দোকানের উল্টো দিকে তার জায়গার ওপর ভাঙাচোরা একটা দোকান ছিল। দোকানটা একসময় তার ছোট ভাই চালাত, সে বিদেশ চলে যাওয়ার পর থেকে বন্ধ। দোকানটা মেরামত করে খসরু তালুকদারের নির্বাচনী অফিস বানাল সে।
লোকজনের মতিগতি দেখে খসরু তালুকদারের অবাক লাগে। মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মানুষরা এত অল্প সময়ে বদলে গেল! যেসব মোড়ল-মাতবরকে এত দিন তিনি তার লোক বলে জানতেন তারাও এখন ছবেদালির পক্ষে একজোট। বহু মুক্তিযোদ্ধা, ছবেদালির নাম শুনলে যারা একসময় থুথু ফেলত, তলে তলে তারাও এখন তার পক্ষে কাজ করছে, ভোটারদের কাছে ছবেদালির জন্য ভোট চাইছে। খসরুর মিছিলে একশ লোক হলে ছবেদালির মিছিলে হয় দুইশ। হাঁটে-বাজারে ছবেদালিকে নিয়ে যত আলাপ-আলোচনা, তার যত সুনাম। খসরুকে নিয়ে আলোচনার চেয়ে সমালোচনা বেশি, সুনামের চেয়ে দুর্নাম বেশি। আড়ালে-আবড়ালে কেউ কেউ তাকে গোফরান মৌলানার শিখিয়ে দেয়া গালিটা দেয় – হিন্দুদের দালাল। মুন্সিগঞ্জ স্কুলের মাঠে ছবেদালির জনসভায় গোফরান মৌলানা তো প্রকাশ্যেই বলল, ‘দ্বীন-এসলাম হেফাজত কত্তি হলি লোক বুঝে ভোট দিতি হবে ভাইসকল। মুসলমান হইয়ে যারা কাফের-মুশরিকগো দালালি করে তাগো ব্যাপারে হুঁশিয়ার থাইকবে। কাল হাশরের মাটে আল্লাপাক তোমার ভোটেরও কিন্তু হিসাব ন্যাবে। তখন কী জবাব দ্যাবা?’
মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে হিন্দু ভোটারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। হিসাব করলে মোট ভোটারের তিন ভাগের এক ভাগ। মুণ্ডারা তো আছেই। ছবেদালি অনেকটা নিশ্চিত হিন্দু ও মুন্ডাদের সিলটা ভুল করেও তার চাকা মার্কায় পড়বে না। তারা যদি একতরফা আনারস মার্কায় ভোট দেয়, খসরু তালুকদার তাহলে এবারও নিশ্চিত চেয়ারম্যান। এ চিন্তায় রাতে তার ঘুম হয় না। হিন্দুদের ঠেকাতে তার লোকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে, ‘এখন আর আগের সেই দিন নি, ভালো থাকতি চালি সিলডা য্যানো চাকা মার্কায় পড়ে। নালি পরে পাছার কাপড় চেষ্টা কুরে পাওয়া যাবে না, হুঁ। মন্দির তো এখনো দু-চারটে আচে, তখন এট্টাও থাকপে না কিন্তু।’
জগতী বেওয়াকে কথাটা কে শিখিয়ে দিল কে জানে, মোল্লেপাড়ার ঘরে ঘরে গিয়ে সে বলে বেড়াতে লাগল, ‘ভোট দিতি আমি যাব না বাপু। শুনিচি মারামারি হবে। খুনোখুনিও হতি পারে। এমনিতেই আমাগো ওপর মুসলমানরা খ্যাপা। ইন্ডিয়ায় হিন্দুরা মসজিদ ভাইঙেচে। সাবধান বাপু, তোমরা কেউ ভোট দিতি যাবা না। লাশ হুয়ে ফিত্তি হবে।’
মোল্লেপাড়া থেকে কথাটা গরানপুরে ছড়ায়, গরানপুর থেকে হুমাগুড়ি দিতে দিতে হরিনগর যায়। হরিনগরের হিন্দুদের ঘরে ঘরে কথাটা ঘুরপাক খেয়ে উত্তরে মুন্সিগঞ্জের পথ ধরে। এভাবে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে কথাটা। পুরনো আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে না পারা হিন্দুসমাজে নতুন আতঙ্ক দেখা দেয়।
হিন্দুদের আতঙ্কিত হওয়ার আরো কারণ আছে। হেদায়াতে ইসলামির কর্মীরা নানা ছুতানাতায় হিন্দুদের ওপর চড়াও হচ্ছে। লাশ ফেলে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে, বাড়ি থেকে উচ্ছেদের হুমকি দিচ্ছে। মুন্সিগঞ্জ বাজারে হেদায়াতের লোকেরা সামান্য কথাকাটাকাটির জের ধরে ভক্তদাসের ওপর চড়াও হয়েছে। তার ক্র্যাচটা কেড়ে নিয়ে ওই ক্র্যাচ দিয়ে তার পিঠে আঘাত করেছে। এ ছাড়া গরানপুরে চুনকুড়ির আড়ায় নিবারণ সাধককে গামছায় মুখ বাঁধা চারটা লোক ডেগার দেখিয়ে হুমকি দিয়েছে, ‘ভোট দিতি গিলি কিন্তু ভুঁড়ি ফিলে দ্যাবো শালা।’
নিবারণ চিরকালের ঠোঁটকাটা লোক। জেদিও। পেটে কোনো কথা হজম হয় না তার। হুমকিটা সে আর হজম করবে! পরদিন বিকেলে ফেলুর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হৈচৈ শুরু করে দিল, ‘কই শালারা, আয় দেকি, আমার ভুঁড়ি ফেলতি আয়। আমারে কি তোরা পুসুন মাইতি পাইছিস? আমারে কোবাদ মাঝির মতোন লাগে? আয় না শালারা, চোদ্দগুষ্টির পাছায় বাদার ভূত লেলিয়ে দ্যাবো। ভূতির ঠাপ খাইয়ে পাছা সোজা কত্তি পারবিনে শালারা। আমি ভোট দিতি যাব, সাতে একশটা জেন-পরি নে যাবো। দেখি কোন শালা আমারে ঠ্যাকায়।’
সে অনর্গল বকে গেল, কেউ তার সামনে এলো না। ঘটনা আসলে কী, তাও কেউ জিজ্ঞেস করল না। যে যা বুঝেছে নিজ নিজ বুঝ নিয়ে চুপ থেকেছে। শুধু ফেলু হাঁক দিয়ে বলেছে, ‘থামো তো নিবারণদা। ছাইলেপিলেরা তোমারে খ্যাপানের জন্যি এসব কতা বুলেচে। বাদ দ্যাও ওসব।’
দুদিন বকেঝকে নিবারণ হয়ত কথাটা ভুলে গেছে, কিন্তু গ্রামের হিন্দুরা কি সহজে এত বড় একটা কথা ভুলতে পারে? নিবারণের মতো লোককে, যে বাদায় ঢুকলে দক্ষিণরায় উত্তরের সব বাঘ খেদিয়ে দক্ষিণে নিয়ে যায়, ভুঁড়ি ফেলে দেয়ার হুমকি দিল! শুদ্দুর-ডোম-মুচি-মেথররা তো সমাজের তলানির মানুষ, বামুন-কায়েতরাও যদি ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আনে, তাদের লাশ খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
ছবেদালির লোকেরা এমন হুমকি-ধমকি হয়ত অন্য হিন্দুদেরও দিয়েছে। কিন্তু তাদের বুকে তো নিবারণ সাধকের মতো এমন সাহস নেই যে, প্রকাশ্যে তারা ছবেদালির লোকদের শালা-সমুন্দি বলে গালাগালি করবে। হুমকিটা তারা বুকে চেপে রেখে মুখটাতে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। কেউ জিজ্ঞেস করলেও তালাটা খোলে না। কথাটা বের করে বিপদ ডেকে আনবে কোন দুঃখে। কেবল তো হুমকি-ধমকি দিচ্ছে না, হিন্দুদের কাছ থেকে ছবেদালির লোকেরা চাঁদাও আদায় করছে। হরিনগর বাজারের রাখাল ময়রার কাছ থেকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছে। রাখাল কথাটা বুকে চাপা দিল। কিন্তু এসব কথা তো আর গোপন থাকে না, বাজারে ঠিকই কানাঘুষা শুরু হলো। লোকজন তার কাছে কথাটা সত্যি কিনা জানতে চাইল। সে তো মুখই খোলে না। বেশি জোরাজুরি করলে বলে, ‘প্রশ্নই আসে না। ভোটে দাঁড়িয়েচে ছবু ভাই, আমি ক্যানো টাকা দ্যাবো? টাকা তো উল্টো সে আমারে দ্যাবে।’
একদিন গরানপুর বাজারে তাকে একা পেয়ে জাবেদ খান ধরে বসল। সে একগাল হেসে বলল, ‘তোমার সাতে মিত্যে বলবো না খান শায়েপ। ছবুদা এই এলাকার মানুষ। হরিনগরের মানুষ চেয়ারম্যান হবে এটা তো আমাগো সৌভাগ্য। ভোটের সময় দু-চার টাকা খরচ তো আমাগোই কত্তি হবে। না হলি সে জেতপে কেরাম কুরে? ইলেকশান করা কি কম খচ্চাপাতির ব্যাপার!’
খসরু তালুকদার তাকে বাড়ি ডেকে নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘টাকা আসলেই তুমি দেচো রাখাল?’
রাখাল জবাব দেয় না, মুখ নিচু করে রাখে।
: কাজটা তুমি ঠিক কল্লে না রাখাল। টাকা দেবার আগে এট্টাবার আমারে জিজ্ঞেস করতি পাত্তে।
হাত দুটো জোড় করে রাখাল হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, ‘আমি এই দেশে থাকতি চাই চ্যারমেন শায়েপ। বাপ-ঠাকুদ্দার ভিটেমাটি ছাইড়ে আমি কোনো জাগায় যাতি পারব না। টাকা গেচে আমার কোনো দুঃখ নি, আম্নি আমারে মাফ কুরে দেবেন।’
ওদিকে মুন্সিগঞ্জের গৌরাঙ্গ বস্ত্রালয় থেকে চল্লিশটা পাঞ্চাবি আর চল্লিশটা লুঙ্গি এনেছে আলাউদ্দিন। দোকানের মালিক গৌরাঙ্গ ভৌমিক টাকা দাবি করলে আলাউদ্দিন চোখ রাঙিয়ে বলেছে, ‘আমার কাচে টাকা চাও ক্যান? টাকা তো দ্যাবে ছবেদালি মোড়ল।’ ছবেদালির কাছে গিয়ে গৌরাঙ্গ উল্টো ঝাড়ি খেল, ‘পাঞ্জাবি তো আমি আনিনি বাপু, আমার কাচে টাকা চাওয়া হচ্ছে ক্যানো?’
আলাউদ্দিনের এমন ব্যস্ততার সময় গৌরাঙ্গের কি আর সাহস হয় টাকার জন্য তাকে বিরক্ত করে? একে তো ছবেদালি প্রার্থী, তার ওপর সে নিজেও প্রার্থী – ব্যস্ততার কি তার সীমা আছে? ঠিকমতো নাওয়া-খাওয়ার সময় পর্যন্ত পাচ্ছে না। মেম্বার পদে সে আগেও দুবার প্রার্থী হয়েছিল। প্রথমবার জামানত বাজেয়াপ্ত হলো, দ্বিতীয়বার পেল মোটে ছাব্বিশ ভোট। তবে এবার লক্ষণ ভালো, গ্রামবাসী এবার বেঈমানি করবে বলে মনে হচ্ছে না তার। মহসিন খানের জামানতও মিলবে না এবার, সে অনেকটা নিশ্চিত। হাটে-বাজারে সে মহসিন খানের সমালোচনায় মুখর, ‘মহাসিনির কী ভূমিকা আচে সমাজে? কী ঘোড়ার ডিমডা কুরেচে সে এলাকার জন্যি? বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে সব মুসলমান রাস্তায় নামল, তাকে কি কোনো মিছিল-মিটিংয়ে দ্যাখা গেচে? এট্টাবার প্রতিবাদ কুরেচে সে?’
লোকজন তার কথা শুনে মুণ্ডু দোলায়, হুঁ-হ্যাঁ করে সাঁয় দেয়। তাদের মুণ্ডু দোলানো দেখে সে ভাবে, তার যুক্তিপূর্ণ কথাগুলো নিশ্চয়ই তাদের মনে ধরেছে। সত্যি সত্যি তারা এবার মহসিন খানকে কলা দেখিয়ে ছাড়বে। তা ছাড়া খোদ ছবেদালি মোড়ল তার পক্ষে ভোট চাইছে। যখন যেখানে যাকে পাচ্ছে বলছে, ‘চাকা মার্কায় সিলডা মারার সমায় মাছ মার্কার দিকি নজরডা দেবেন ভাই।’ আলাউদ্দিন অন্তত পনেরো-কুড়ি বার কথাটা ছবেদালির মুখে শুনেছে। নমিনেশন পেপার জমা দেয়ার দিন উপজেলা পরিষদের মাঠে ছবেদালি তার পিঠ চাপড়ে বলেছে, ‘জয় তোমার এবার নিচ্চিত আলাউদ্দিন। গরু-খাসি কিনে রাখ, জিতলি পরে বাড়িতি কিন্তু বড় এট্টা খানা দিতি হবে।’
খুশিদে গদগদ হয়ে আলাউদ্দিন বলল, ‘এট্টা ক্যানো ছবু ভাই, জিতে গিলি পরে দরকার হলি দশটা খানা দ্যাবো। আগে জিতে নেই, তারপর দ্যাখ্পে এই আলাউদ্দিন গরানপুর-হরিনগরবাসীর জন্যি কী কত্তি পারে।’
ছবেদালিকে খুশি করতে আলাউদ্দিন হরিনগর বাজারের উত্তর মাথায় রাস্তার ওপর বিশাল সাইজের গরুর গাড়ির একটা চাকা বানিয়ে মোটা কাছি দিয়ে টাঙিয়ে দিয়েছে। চাকাটার নিচে বড় একটা ব্যানারে লেখা –
ছবেদালির ভাইয়ের সালাম নিন
চাকা মার্কায় ভোট দিন।
৩ নং গরানপুর-হরিনগর এলাকাবাসীর পক্ষে মোঃ আলাউদ্দিন।
তা ভোট মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই হলো। দু-একটা কেন্দ্রে হেদায়াতে ইসলামির কর্মীরা গণ্ডগোল করেছে, খসরু তালুকদারের এজেন্টদের মারধর করেছে। কদমতলা কেন্দ্রে দুটি ককটেল ফাটিয়েছে। এক ঘণ্টা ভোট নেয়া বন্ধ ছিল। মুন্সিগঞ্জ কেন্দ্রে চাকা মার্কা ও আনারস মার্কার সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়েছে। তাতে ভোট দেয়া-নেয়ায় তেমন বিঘ্ন ঘটেনি, ভোটররা মনের সুখেই ভোট দিয়েছে। হিন্দুরাও ঘরে বসে থাকল না। মুণ্ডারাও না। কোথাও কোথাও বাধা যে পায়নি তা নয়। সব বাধা ডিঙিয়ে তারা কেন্দ্রে কেন্দ্র গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে।
বিকেল চারটার দিকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ছবেদালির বিজয় সংবাদ। বিপুল ভোটের ব্যবধানে ছবেদালি মোড়ল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে যাচ্ছে – হেদায়াতে ইসলামির লোকেরা গুজবটা ছড়িয়ে দিল। হরিনগর বাজারে স্লোগান উঠল, ‘জিতেছে রে জিতেছে, ছবেদালি ভাই জিতেছে।’
উইনার স্লিপ আনতে মুন্সিগঞ্জ থেকে বাস রিজার্ভ করে সদলবলে ছবেদালি ইউএনও অফিসে গেল সন্ধ্যায়। খসরু তালুকদারও তার লোকজন নিয়ে হাজির হলেন। উপজেলা পরিষদ মাঠের দুই প্রান্তে দু-পক্ষের লোকদের জটলা। দু-পক্ষেই তুমুল উত্তেজনা, যেকোনো মুহূর্তে মারামারি লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠের মাঝখানে পুলিশ সতর্ক পাহারায়।
রাত আটটার দিকে ইউএনও অফিসের পিয়নের মারফত খারাপ সংবাদটা পেল ছবেদালি, চাকা মার্কার চেয়ে আনারস মার্কা প্রায় সাড়ে চার শ ভোটে এগিয়ে।
ছবেদালির মাথায় তো ঠাটা পড়ল। অসম্ভব! হতেই পারে না। এত টাকাপয়সা নষ্ট করেছে সে কিসের জন্য? উইনার স্লিপ না নিয়ে এই ছবেদালি ঘরে ফিরবে না। তার লোকজন হৈ-হাঙ্গামা শুরু করে দিল, কেউ কেউ উপজেলা নির্বাচন অফিসারকে শালা-সমুন্দি বলে গালি দিতে লাগল। দুন্ধুমার ককটেল ফাটতে লাগল পরিষদের মাঠে। মুহূর্তে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হলো দুই পক্ষে। খসরু তালুকদারের লোকজন মেইন রোডে গিয়ে উঠল। লাটিসোঁটা নিয়ে তারাও প্রস্তুত। ককটেল তারাও ফাটাচ্ছে। প্রয়োজনে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে, তবু ফলাফল এধার-ওধার হতে দেবে না।
ধমাধম দোকানপাটের ঝাঁপ পড়তে লাগল। মানুষজন যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। থানার ওসি তার কনস্টেবলদের নিয়ে ইউএনও অফিসের নিচে অবস্থান নিয়েছেন। ছবেদালির লোকেরা নির্বাচন অফিস লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়ছে। একটা ইটের টুকরো এসে এক কনস্টেবলের গায়ে পড়ল। কনস্টেবল বন্দুক উঁচিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়তে গেলে ওসি ধমক লাগালেন, ‘খবরদার, গুলির অর্ডার নাই। জানো না এরা কার লোক?’
পরিস্থিতি সামাল দিতে জিয়ারত আলী পুলিশ পাহারায় ইউএনও অফিসে এলেন। ইউএনওর সঙ্গে তার রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলল আধা ঘণ্টা। বৈঠকে কী কথা হলো কে জানে, রাত পৌনে দশটার দিকে অফিসের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন নির্বাচন অফিসার। তার ডান পাশে ইউএনও এবং বাঁ পাশে জিয়ারত আলী। হাতমাইকে তিনি সংক্ষিপ্ত একটা বক্তব্য রাখলেন, ‘দেখুন, ভোটে হার-জিত আছে। কেউ হারবে কেউ জিতবে এটাই স্বাভাবিক। আশা করি আপনারা জনগণের রায় মেনে নেবেন।’
সারা মাঠ নিস্তব্ধ। উত্তেজনা চেপে রেখেছে দু-পক্ষই। চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার আগে কেউ মুখ খুলতে চাচ্ছে না। হট্টগোলের মধ্যে আখেরে বিজয়ীর নামটা না চাপা পড়ে যায়!
টাইপ করা একটা কাগজ হাতে নিলেন নির্বাচন অফিসার। বিজয়ীর নামটা ঘোষণা করতে যাবেন, ঠিক তখনই আবার হট্টগোল শুরু হলো। আলাউদ্দিনের হাতে একটা বাঁশের লাঠি। লাঠিটা উঁচিয়ে সে বলল, ‘গুষ্টি মারি জনগণের রায়ের! এই রায় আমরা মানি নে। ষড়যন্ত্র কুরে আমাগো বিজয় ছিনিয়ে নেবা হচ্ছে। কিচুতেই আমরা এটা হতি দ্যাবো না।’
জিয়ারত আলী ধমকে উঠলেন, ‘চুপ কর মিয়া! এত চিল্লাচ্চ ক্যানো? পাইয়েচ তো মোটে দেড় শ ভোট। জনগণ তোমারে ভোট না দিলি কার কী করার আচে?’
আলাউদ্দিন চুপ মেরে যায়। ভেতরে বাতাস ঢুকলে হারিকেন যেমন ধপ করে নিভে যায় তেমনি সেও নিভে গেল। মাথা নুইয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। সবার চোখ তখন নির্বাচন অফিসারের দিকে, আলাউদ্দিনকে কেউ আলাদা করে নজরে রাখে না। সবার হৃৎপিণ্ডে দ্বিগুণ ধুকফুকানি। কে জিতল? অফিসার কার নাম ঘোষণা করবেন?
ভিড়ের মধ্য থেকে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালেন খসরু তালুকদার। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, পাঞ্জাবিটা ঘামে ভেজা, নিচের দিকটা বাতাসে উড়ছে। তার ডান পাশে ছবেদালি। মুচকি হেসে তিনি তার দিকে তাকালেন। মাথার টুপিটা হাতে নিয়ে ছবেদালির কাঁধ চাপড়ে বললেন, ‘বুঝতি পারিছি, চেয়ারম্যান হওয়ার খুব শখ তোমার। যাও, তোমারে ছাইড়ে দেলাম।’
খসরুর লোকজন তো হাঁ! ঘটনার আগামাথা কিছু তারা বুঝতে পারে না। ছবেদালির গা ঘেঁষে দাঁড়ানো এক যুবক খেঁকিয়ে উঠল, ‘এ্যাঁহ, ছাইড়ে দেলাম! আপনি ছাইড়ে দেবার কেডা? ভোট দেচে জনগণ, আপনি মাঝখানে আইসে বাহাদুরি কত্তিচেন ক্যান?’
খসরু তালুকদার হেসে উঠলেন। হাসিটা বেজায় মলিন। আর একটা কথাও না বলে উপজেলা রোড ধরে মেইন রোডের দিকে হাঁটা ধরলেন তিনি। হাঁটতে হাঁটতে নির্বাচন অফিসারের গলা শুনতে পান, ৭২১ ভোট বেশি পেয়ে চাকা মার্কার প্রার্থী মো. ছবেদালি ওরফে ছবেদালি মোড়ল বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন।
অসংখ্য মানুষের করতালিতে, স্লোগানে স্লোগানে নির্বাচন অফিসারের কণ্ঠ চাপা পড়ে গেল।