কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
চৌদ্দ.
কে জানে চারুবালাকে কী কথা বলতে চেয়েছিল আতা মৌলবি। মৃতুপথযাত্রী একজন মানুষের, যে কিনা আবার মৌলবি, কী এমন কথা থাকতে পারে একজন বেগানা মহিলার সঙ্গে! যে কিনা আবার বিধর্মী। আজরাইলের মুখোমুখি বসে কিশোয়ার মোহাম্মদকে জোর দিয়ে কেশবচন্দ্র বলায় গোফরান মৌলানা একটা ধাঁধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। কথাটা বেশ কদিন তার মাথা থেকে পড়ল না। নানা সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল তার মনে। কী বোঝাতে চাইল আতা মৌলবি? মৃত্যুর সময় তো মানুষ মিথ্যা বলে না। কেশব মাস্টার কি তবে তার কাছে কলমা পড়ে মুসলমান হয়নি? মিথ্যা বলে সে মুসলমানদের ধোঁকা দিল? নাকি মুসলমান হয়েও হিন্দু নারীর সঙ্গে ঘরসংসার করায় আতা মৌলবি তাকে মুসলমান বলে স্বীকৃতি দিতে চায়নি? চলে গেল আতা মৌলবি, রেখে গেল একটা গূঢ় রহস্য।
আতা মৌলবির রহস্যপূর্ণ এই শেষ কথাটা হয়ত শুক্রবারে মসজিদে উঠাত গোফরান মৌলানা। মসজিদে না ওঠালেও তার খায়খাতিরদাদের কানে অন্তত তুলত। কিন্তু আতা মৌলবির মৃত্যুর দুদিন পর ভারতের কোথায় কোন অযোধ্যা শহরে হিন্দুরা সম্রাট বাবরের তৈরি শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল। ভারত তো বটেই, গোটা বাংলাদেশটাও চৈত্র মাসের প্রান্তরের মতো তেঁতে উঠল। মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। ভারতে মুসলমান ভাইদের ওপর, ইসলামি ঐতিহ্যের ওপর এত বড় একটা আঘাত আসার পর বাংলাদেশের মুসলমান ভাইরা কি হাত-ঠ্যাং গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? তারা ওখানে মসজিদ ভেঙেছে, অতএব এখানে তাদের যত মন্দির আছে সব গুঁড়িয়ে দাও। তারা ওখানে মুসলমানদের খুন করছে, বাড়িঘর দখল করছে, অতএব এখানে হিন্দুদের ধরে ধরে কতল করো, পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দাও। তারা ওখানকার পর্দানশীন মুসলমান মহিলাদের ইজ্জত লুটছে, অতএব এখানকার বেপর্দা হিন্দুনারীদের নেংটো করে গণধর্ষণ কর। শিয়া, সুন্নি, ওয়াহাবি, মাযহাবি, লা-মাযহাবি সবাই এক হও। কাদিয়ানিরাও আর আলাদা থাকবে কেন, তোমরাও ‘নারায়ে তাকবির’ হেঁকে জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়।
গোফরান মৌলানা জুমার খুতবার আগে মসজিদের মিম্বারে বসে তর্জনী উঁচিয়ে হুঙ্কার ছাড়ল, ‘ইসলাম জেন্দা হোতা হ্যায় হার করবালা কি বাদ। দরকার হলি আরেকবার কারবালার যুদ্ধ বাইদে যাবে। মুসলিম উম্মাহ অজুদের শেষ রক্তবিন্দু দে কাফের-মুশরিকিগো বিরুদ্ধে লড়ার জন্যি রেডি।’
সামনের কাতারে বসা খসরু চেয়ারম্যান গলাখাকারি দিয়ে বললেন, ‘হুজুর, এক দেশের ঝামেলা আরেক দেশে টাইনে আনে নিজিগো মদ্দি গোলমাল বাদিয়ে লাভ কী? ইন্ডিয়ার ঝামেলা ইন্ডিয়ার মুসলমানরা সমাধা করুক।’
গালে গালে তওবা পড়ল গোফরান মৌলানা, ‘নাউযুবিল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ! এইরাম কতা কোনো মুসলমানের মুখি মানায় না চেয়ারম্যান শায়েপ। আপনি তো একজন মুসলমান। ইন্ডিয়ার মুসলমান ভাইরা বিপদে পইড়েচে, তাগো পাশে দাঁড়ানো মুসলমান হিসেবে আমাগো উপর ফরজ।’
অশান্তির কালো বয়াল ঘনিয়ে এলো সারা বাংলার আকাশে। হিন্দুরা গোপনে দেশ ছাড়তে শুরু করল। কখনো একা, কখনো দলে দলে – বুকে পাথর বেঁধে। শ্যামনগরের বহু হিন্দু পালিয়ে গেল কালিন্দীর ওপারে। পালাবেই তো। হেদায়াতে ইসলামির মজবুত ঘাঁটি। দ্বীনের ঘাঁটিতে বেদ্বীন হিন্দুরা থাকে কীভাবে? জিয়ারত আলী হেদায়াতে ইসলামির বড়মাপের নেতা, ঢাকার বড় বড় নেতাদের সঙ্গে তার খায়খাতির। শ্যামনগরের চাষাভুষা কামলা কিশেন মৌয়াল বাওয়ালিরা তো আদনা মানুষ, বড় বড় সরকারি অফিসাররাও তাকে মেনেগুনে চলে। হিন্দুদের মন্দির ভাঙতে হবে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে হবে – প্রকাশ্যে না বললেও জিয়ারত আলীর কথাবার্তায় এমনই ইঙ্গিত। জিয়ারত আলী ওপর দরজার জ্ঞানীগুণী মানুষ, সব কথা কি তাকে খুলে বলতে হবে? খুলে বলা কি শোভা পায়? হাজারো কথার ঘূর্ণিপাকে ফেলে তাকে আসল কথাটা বলতে হয়। ওই ঘূর্ণিপাক থেকেই আসল কথাটা উদ্ধার করে নিতে হবে।
তারই-বা বলা লাগবে কেন? মুসলমানদের কি বোধবুদ্ধি নেই? তারা কি ন্যায়-অন্যায় বোঝে না? জাতভাইদের বেদ্বীন হিন্দুরা কচুকাটা করলে তারা কি বসে বসে আঙুল চুষবে? বাবরি মসজিদ তো অনেক বিখ্যাত মসজিদ, শ্যামনগরের কোনো মুসলমানের বাড়ির ঘাটায় গোলপাতার ছানির ভাঙাচোরা অখ্যাত কোনো পাঞ্জেগানা মসজিদের একটা পাতায়ও যদি হিন্দুরা হাত দেয়, পরিণামে তাদের একশ’টা মন্দির ভাঙা হবে।
কাশিমারি, ভুরুরিয়া, রতনপুরের বিভিন্ন মন্দিরে হামলা হলো, প্রতিমা ভাঙচুর হলো। মুন্সিগঞ্জ, কদমতলা, হরিনগর, সিংহড়তলি, ভেটখালী ও গরানপুরের মন্দিরগুলোও বাদ গেল না। কোনোটাতে আগুন দিল, কোনোটার প্রতিমা ভাঙচুর হলো। মোল্লেপাড়া মা রক্ষাকালী মন্দিরের ঢুকে কালীমূর্তির একটা হাত ভেঙে পায়ের কাছে হেগে দিয়ে গেল। হামলাকারীদের পাত্তা পাওয়া যায় না। কাউকে চেনা গেলেও হিন্দুরা ভয়ে তার নাম উচ্চারণ করে না। এই দুষ্কালে মুসলমানের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনা যায়! হোক সে চোর-ডাকাত-লম্পট অথবা খুনি। সব মুসলমান একাট্টা।
যশোরেশ্বরী মন্দিরের দরজা ভেঙে কালীমূর্তিটার একটা পা ভেঙে দিল। গোটা মূর্তিটাই হয়ত ভেঙেচুরে নদীতে ভাসিয়ে দিত, পারেনি পুলিশের কারণে। পুলিশের একটি দল তখন টহলে বেরিয়েছিল। মন্দির ভাঙা মানে আইন ভাঙা। আইন রক্ষার দায়িত্ব তো পুলিশের। অন্ধকারে চুপিচুপি মন্দিরে এসে দু-একজন হামলাকারীকে পুলিশ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করতে পারত। কিন্তু পুলিশও তো মানুষ, তাদেরও তো জীবনের মায়া আছে। অন্ধকার রাতে বিক্ষুব্ধ মুসলমানরা যদি তাদের ওপর হামলা করে বসে তখন কী উপায়। আচ্ছা, হামলা হয়ত করত না। কিন্তু পুলিশেরও তো ধর্ম আছে। আগে তো সে মুসলমান, তারপর পুলিশ। ইন্ডিয়ার মুসলমানরা ব্যথা পেলে তারও তো ব্যথা পাওয়ার কারণ আছে। কেননা মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে-কারণেই হয়ত তারা মন্দিরে যাওয়া থেকে বিরত থাকল।
কে জানে, ওই টহলদলে হয়ত কোনো হিন্দু কনস্টেবল ছিল অথবা কোনো দারোগা। আনারি ব্রাহ্মণের গড়া হাজার দুয়ারি ঐতিহ্যবাহী যশোরেশ্বরী মন্দিরের কোনো ক্ষতি হয়ত সে মেনে নিতে পারছিল না, তাই সে জোরশব্দে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে থাকবে। পুলিশের বাঁশির শব্দ আলাদা করে বোঝা যায়। হামলাকারীরা বুঝতে পারল বিপদ তাদের ঘাড়ের কাছে। বিপদ এড়াতে চটজলদি তারা অন্ধকারে গা ঢাকা দিল।
একই রাতে মুন্সিগঞ্জ বাজারের শত বছরের পুরনো সর্বজনীন দুর্গামন্দিরের প্রতিমা নিজ হাতে ভাঙল গোফরান মৌলানা। সারা জীবন বনবিবির মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সে কত ওয়াজ-নসিহত করল, অথচ একটা মানুষকেও মূর্তিপূজা থেকে ফেরাতে পারল না। তাই মূর্তির ওপর তার বেজায় ক্ষোভ। মূর্তির কথা শুনলেই তার মাথার তালু গরম হয়ে ওঠে, চোখে রক্ত জমে যায়। মক্তবের উঠতি বয়সের ছেলেপেলেদের নিয়ে সে মাঝরাতে মসজিদের বারান্দায় মিটিং করল। তারপর দা-বটি খুন্তি-কুড়াল নিয়ে সদলবলে দুর্গামন্দিরে হামলা চালাল। দুর্গার প্রতিমাটি সিমেন্ট-বালিতে গড়া। এমনই পাষাণ প্রতিমা, কুড়ালের কোপেও টলানো গেল না। দু-তিন দফা কুড়াল চালিয়েও মূর্তিটাকে টলাতে না পেরে বুড়ো গোফরান মৌলানার রাগ খাই খাই করে ওঠে। তার মতো একজন পাক্কা ইমানদার মর্দে মুজাহিদ কিনা কাফের-মুশরিকদের একটা পাষাণ মূর্তি ভাঙতে পারছে না! লজ্জা, বড় লজ্জার ব্যাপার। ছাত্রদের সামনে সে বেজায় লজ্জিত বোধ করে। লজ্জা ঢাকতে ‘ইয়া আলী’ বলে শরীর সব শক্তি খাটিয়ে কুড়োলের উল্টো পিঠে দুর্গামূর্তির ধনুকধরা হাতটাতে আঘাত হানল। শেরে আলী বুঝি তার পাশে দাঁড়াল, এক আঘাতেই হাতটা চুরমার। ধুলোবালিতে সাদা হয়ে উঠল হাতের নিচে অসুরমূর্তির মুণ্ডুটা।
চাদরটা কোমরে বেঁধে গোফরান মৌলানা তিন ব্যাটারি টর্চের আলো ফেলল দুর্গামূর্তির মুখের ওপর। হেঁচকা টানে পরনের লালপাড়ের জরিওয়ালা সাদা শাড়িটা খুলে ফেলল। তার চোখ গেল দুর্গামূর্তির সুঢৌল স্তনের দিকে। মৌলানা চমকে ওঠে। কী উন্নত স্তন! সুন্দরের কী ভয়ংকর বহিঃপ্রকাশ! সবই খোদার লীলাখেলা। নইলে মাটির মূর্তি এমন সুন্দর হয় কেমন করে! লীলার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গোফরান মৌলানার চোখেও লীলা শুরু হয়। মুখে কোনো ভাষা ফোটে না, বুকের মধ্যে তোলপাড় ওঠে। সম্মোহিতের মতো সে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ তার মনে পড়ে, প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে দুজন ফেরেশতা থাকে, আর থাকে একজন শয়তান। তার সঙ্গী শয়তানটা বুঝি এখন তাকে ওয়াসওয়াসা দিচ্ছে। নইলে তার মাথায় কুচিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে কেন। বিড়বিড় করে সে তওবা-এস্তেগফার পড়ে। তারপর কুড়োলটা মাথার ওপর তুলে দুর্গামূর্তির ডান স্তন বরাবর প্রচণ্ড আঘাত হানল। কিন্তু শয়তান তো সব মন্দ জায়গায় থাকে। তার সঙ্গী শয়তানটা অথবা যেসব শয়তান এই পাষাণ মূর্তিটা পাহারা দিচ্ছে, তাদের কেউ বুঝি তার অদৃশ্য হাত দিয়ে মূর্তির স্তনটাকে আগলে রাখল। কুড়োলটা পিছলে অসুরমূর্তির ডান হাতে গিয়ে পড়ল। দেবীর হাত থেকে ছুটে গেল অসুরের হাতটা।
: আস্তে হুজুর আস্তে, সাবধানে কাজ করেন। ব্যথা পাবেন শেষে।
মাফলারে মুখ ঢাকা এক তরুণ গোফরান মৌলানাকে সতর্ক করল। কিন্তু মৌলানার কানে ঢুকল না তার কথা। দুর্গামূতির স্তন দুটো তার লক্ষ্য। এই স্তন তার অজুদের লহু গরম করে দিয়েছে। এগানা-বেগানা জ্যান্ত কোনো নারী নয়, নারীর আদলে সিমেন্ট-বালিতে গড়া একটা মূর্তি মাত্র। অথচ এ মূর্তিই কিনা তার ভেতরটা নাড়িয়ে দিল। নিশ্চয়ই খান্নাস শয়তানের কাজ। মূর্তির কোনো শক্তি নেই জ্যান্ত মানুষের মন আন্দোলিত করে। নিশ্চয়ই অদৃশ্য শয়তানরা এখন মূর্তিটার যুগল স্তন আগলে রেখেছে। নইলে ধারালো কুড়োলের কোপ বারবার ফিরে ফিরে আসবে কেন!
গোফরান মৌলানা কোপের পর কোপ হানতে থাকে। স্তন দুটি ভেঙে চুরমার না করা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। মাঝরাতে ভাঙচুরের শব্দ হয়ত মন্দিরের আশপাশের হিন্দুরা শুনতে পাচ্ছে। পেলে কি হবে, ঘর থেকে বেরিয়ে বাধা দেয়ার সাহস কার? কল্লার জায়গায় কল্লা থাকবে? জেহাদি জোশে উন্মত্ত গোফরান মৌলানার গরম রক্তের তরুণ ছাত্ররা ধারালো ছেনির এক কোপে ধড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে দিলে কোনো সাক্ষী-প্রমাণ তো থাকবে না।
একই রাতে মুন্সিগঞ্জের রাধাগোবিন্দ মন্দিরে হামলা হলো, পশ্চিমধলের সর্বজনীন হরিমন্দিরে আগুন দেয়া হলো। সৎসঙ্গ মন্দিরের বুড়ো ঠাকুরকে পিটিয়ে বাঁ হাতটা ভেঙে দিল। হামলাকারীদের পা ধরে কতবার বাবা বাবা বলে মিনতি করল ঠাকুর, তবু রেহাই পেল না। ঠাকুরের নাতির বয়সী এক তরুণ তার টিকলি ধরে খেঁকিয়ে উঠল, ‘শালা মালাউন, আমি তোর বাপ হই কেরাম কুরে? তোর মারে বে দিলি না আমার সাতে?’
পরদিন দুপুরে জিপ হাঁকিয়ে পুলিশ এলো। কারা হামলা করেছে মন্দিরে তদন্ত করে বের করতেই হবে – ওপরের নির্দেশ। গোফরান মৌলানা শামুকের মতো গুটিয়ে গেল। আসরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে আর বেরোয় না, মিম্বারের কাছে বসে তসবির দানা গোনে। পুলিশ গেল খসরু চেয়ারম্যানের বাড়ি। চেয়ারম্যান উঠোনে চেয়ার পেতে শেষ বিকেলের রোদে গা-টা সেঁকছিলেন। আরেকটা চেয়ার আনিয়ে দারোগাকে বসতে দিলেন। জালিবেতটা নাড়াতে নাড়াতে দারোগা বললেন, ‘আপনার ইশারা ছাড়া মুন্সিগঞ্জের কোনো মন্দির কেউ ভাঙার সাহস করবে না। নিশ্চয়ই আপনার হাত আছে। আপনার লোকজনই মন্দিরে হামলা করেছে। তাদের নাম বলুন।’
চেয়ারম্যান অবাক হলেন না। শলা দিয়ে দাঁত খিলাল করতে করতে, ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি ঝুলিয়ে দারোগার মুখের দিকে কঠিনচোখে তাকিয়ে রইলেন। নির্বাচন হয়েছে গেল বছর। সরকার পাল্টেছে, থানার দারোগা-পুলিশও পাল্টেছে। নতুন কনস্টেবল, নতুন দারোগা – কারো সঙ্গে এখনো ঠিকমতো পরিচয়ও হয়ে ওঠেনি। চাইলেই তিনি সবকিছু করতে পারেন না, সব কথা বলতে পারেন না। আগপিছ দেখে চলতে হয়, লোক বুঝে কথা বলতে হয়।
তাই বলে পুলিশ একটা মিথ্যা অভিযোগ তার ওপর চাপিয়ে দেবে, আর তিনি নির্বিবাদে মেনে নেবেন – এমন ভালো মানুষ তিনি কোনোকালেই ছিলেন না, এখনো নন। মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের দু-দুবারের চেয়ারম্যান তিনি। অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তিও কম নয় তার। একনাগাড়ে তিন দফায় মোট উনিশ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন তার বাপ আজহার উদ্দিন তালুকদার। সালিশ-দরবারে তার হুঙ্কারে বাদী-বিবাদী সমানে কাঁপত। ঠিক বাপের মেজাজ পেয়েছেন তিনি। দারোগার কথা শুনে তার বনেদি মেজাজটা চাগা দিয়ে উঠল। মাথায় হাত বুলিয়ে মেজাজটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেন। গলাটাকে নরম করে বললেন, ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানো বইলে এট্টা কথা আচে না দারোগা শায়েপ, আপনি দেখতিচি সেটাই কত্তিচেন। আগে তদন্ত কইরে দ্যাখেন ঘটনার পেছনে কারা জড়িত। আমার লোক জড়িত প্রমাণ কত্তি পাল্লি আমি আপনার হাতে তাগোরে তুলে দ্যাবো। সাফ কতা আমার। সমাজে কোনো ধরনের অশান্তি আমি চাই নে।’
ভড়কে গেলেন দারোগা। চেয়ারম্যানের অটল ব্যক্তিত্বের কাছে তাকে নতি স্বীকার করতে হলো। হেসে উঠলেন তিনি। বেতটা কোলের ওপর রেখে বললেন, ‘দেখুন চেয়ারম্যান সায়েব, এই এলাকা আপনার। এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বও আপনার। দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলে আপনারই বদনাম। আপনি এদিকে একটু খেয়াল রাখবেন। তাহলে কষ্ট করে আমাদের এতদূর আসতে হয় না। থানা থেকে আপনার এলাকা কি কম দূর? সরকার তো তেলের খরচটাও ঠিকমতো দেবে না।’
দুদিন হামলা বন্ধ থাকে, তারপর আবার শুরু হয়। আশ্বিনী ঝড়ের মতো থেমে থেমে হামলা চলতে থাকে। আজ এই মন্দির তো কাল ওই মন্দির আক্রান্ত হয়। তবে দিনে নয়, রাতে। নিশাচর হায়েনার মতো সশস্ত্র মুসলমানরা মন্দিরে হামলা করে মাটির দেবতাদের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। রহমতের ফেরেশতা দিয়ে খোদা বুঝি তাদের সাহায্য করেন। নইলে একটা হিন্দুও বাধা দিতে আসবে না কেন? চুনকুড়ি-মাদার-কালিন্দী পারে রাত নামলে খোদার ইশারায় হিন্দুরা বুঝি বধির হয়ে যায়, অন্ধ হয়ে যায়। ঢোলের লহরীও তাদের কানে ঢোকে না, হ্যাজাক বাতি জ্বেলেও তারা অন্ধকার সরাতে পারে না। মন্দির তো মন্দির, কেউ যদি তাদের ঘরের দরজা ভেঙে সব লুটেপুটেও নিয়ে যায় তারা কিছুই টের পাবে না।
মুন্সিগঞ্জে পুলিশ আসার তিন দিন পর মুকনোলির প্রান্তরে কোবাদ মাঝির লাশ পাওয়া গেল। সারা শরীর রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত। ধড় একদিকে মুণ্ডু একদিকে। আগের দিন বিকেলে হরিনগর বাজারে রাখাল ময়রার শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে হিন্দুদের মা-মাসি ধরে সে গালাগালি করেছিল, ‘শালারা, ইন্ডিয়ায় তোরা মুসলমানগো ধুরে ধুরে কুকুর-বেড়ালের মতো মাত্তিচিস, আমরা তোগো ছাইড়ে দ্যাবো? এট্টারেও এদেশে থাকতি দ্যাবো না।’
রাখাল ময়রা হে হে করে হাসে। তার বিশ্বাস হয় না নেংটাকালের বন্ধু এই কোবাদ তার কোনো ক্ষতি করতে পারে। তার হাসি দেখে কোবাদ মাঝির পিত্তি জ্বলে। আরেকটু হলে সে হয়ত ময়রার ওপর চড়াও হতো। ছবেদালি মোড়ল তার হাত ধরে টানতে টানতে রাস্তার উল্টো দিকে একটা চা দোকানে নিয়ে বসাল, ‘মাতা গরম কইরো না ভাই। আল্লা সব দিক্তেচে। তার বিচার কঠিন বিচার। আল্লা তার রহমতের ফেরেশতা পাঠিয়ে ইন্ডিয়ার মুসলমানেগো হেফাজত করবে।’
মেলা দিন ধরে ছবেদালির সঙ্গে কোবাদ মাঝির কাথাবার্তা হয় না। আলাউদ্দিনকে যেদিন ছেরু কোরবানির গরু জবাইয়ের লম্বা ছুরি হাতে ধাওয়া করল সেদিন থেকেই সে আলাউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। লোকজন সেদিন আলাউদ্দিনকে বাঁচাতে ছেরুর হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে তাকে কয়েকটা কিল-ঘুষি দিয়েছিল। আলাউদ্দিনও নাকি একটা ভাঙা বৈঠা দিয়ে তাকে বেধড়ক পিটিয়েছিল। বাপের মন, হয়ত সে কারণেই আলাউদ্দিনের সঙ্গে সে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। ছেরু খুন হওয়ার পর ছবেদালিকে বলেছিল কোবাদ, ‘আমি থানায় গে মামলা করব ছবু ভাই। পুলিশির ইনকুয়্যারিতে আসল খুনি ঠিকই ধরা পড়বে।’
ছবেদালি বলল, ‘ধুর ভাই। তোমার ছাওয়ালরে মানষি মাইরেছে এডা শিওর হলে কী কুরে? ছেরুর সাতে তো জেন-পরি ছিল, মাল্লি তারে জেনেরাই মাইরেচে। আহারে, কতো আলাভোলা ছাবালডা, গ্রামে তো তার কোনো শত্রু ছেলো না। তুমি জেন-পরির বিরুদ্ধে মামলা কইরবে?’
পাল্টা জবাব দিতে পারল না কোবাদ। তবু সে থানায় একটা জিডি করতে চেয়েছিল। আজ ছেলেকে মেরেছে, কাল ছেলের বাপকে মারবে না তার কী নিশ্চয়তা? কিন্তু অজানা কারণে পুলিশ জিডিটা এন্ট্রি করল না। না করার পেছনেও নাকি ছবেদালির হাত ছিল – কোবাদ পরে থানার এক দালালের মাধ্যমে জানতে পারে। সেই থেকে ছবেদালিকে সে এড়িয়ে চলতে লাগল। রাস্তাঘাটে দেখা-সাক্ষাৎ হলেও কথা বলত না।
রাত প্রায় আটটা পর্যন্ত কোবাদ মাঝি সেদিন ছবেদালির সঙ্গে চা-দোকানটায় বসে আড্ডা দিল। সন্ধ্যা সাতটায় রেডিওতে বিবিসির সংবাদ শুনল। বেশিরভাগই দেশব্যাপী মন্দির ভাঙার সংবাদ। কোথায় কোথায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে, আগুন দেয়া হচ্ছে। ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হামালা চালিয়ে আগুন দেয়া হয়েছে। নোয়াখালীর কোথায় কোন হিন্দুবাড়িতে মুসলমানরা আগুন দিলে দুধের বাচ্চাসহ এক হিন্দু মেয়েলোক পুড়ে মরেছে। হিন্দুরা মামলা করতে থানায় গেলে পুলিশের সামনে মুসলমানরা তাদের ওপর হামলা করেছে।
দোকানভর্তি শ্রোতারা হাততালি দেয়, ‘ঠিক করেছে পুড়িয়ে মেরে। সাহস কত! থানায় আবার মামলাও করতে যায়। হামলা করবে না তো আদাব-নমস্কার দেবে? শালারা!’ কেউ কেউ ‘নারায়ে তাকবির’ বলে হাঁক মারে। একদল তরুণ স্লোগান ধরল, ‘নরসিমা রাওয়ের গালে গালে, জুতা মারো তালে তালে।’
শেষরাতে প্রচণ্ড পায়খানার বেগ পেল ছেরুর বাপের। বাইরে বেরোনোর সময় দরজার কপাটের ক্যাঁ-কু্যঁ শব্দে তার বউয়ের ঘুম ভেঙে যায়। খানিক পর সে কলতলায় চাপাকলের শব্দও শুনতে পায়। তারপর আবার সে ঘুমে তলিয়ে যায়। শোয়ামি তার ফিরে এসে পাশে শুয়েছিল কিনা টের পায়নি।
হরিনগর ও গরানপুরে মুসলমানদের উত্তেজনা এত দিন চাপা ছিল। মন্দির-মণ্ডপ ভাঙলেও রাতে ভাঙত। কোবাদ মাঝি খুনের ঘটনায় উত্তেজনা এবার প্রকাশ্যে রূপ নিল। এই সময় তাকে কারা খুন করতে পারে তা তো আর কাউকে খুলে বলে দিতে হবে না। অতএব সবার আগে শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে হামলা কর। রাখাল ময়রাকে বেঁধে গণধোলাই দাও। দেখবে, খুনির নাম সে ঠিকঠিক বলে দিচ্ছে।
দিনেদুপুরে একদল মুসলমান শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে হামলা চালাল। মিষ্টির হাঁড়িকুড়ি জগ-গ্লাস চেয়ার-টেবিল টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলল। বেগতিক বুঝে রাখাল ময়রা পেছনের দরজা দিয়ে মুকনোলির প্রান্তর হয়ে পশ্চিমে সীমান্তের দিকে দৌড় লাগাল। উত্তেজিত মুসলমানরা হয়ত দোকানটাতেও আগুন ধরিয়ে দিত, যদি না খসরু চেয়ারম্যান এসে পরিস্থিতি সামাল দিতেন। সবাইকে তিনি কড়া হুঁশিয়ার করে দিলেন, ‘কেউ যদি ফের এইরাম সন্ত্রাসী কাণ্ড ঘটায় তার বিরুদ্ধে সরকারবাদী মামলা হবে। তার জন্যি এই খসরু চেয়ারম্যান ভুলেও সুপারিশ কত্তি যাবে না দারোগার কাচে। কী পাইয়েছ তোমরা? বাড়াবাড়িরও তো এট্টা সীমা আচে।’
খসরু চেয়ারম্যানের ওসব ঝাড়িঝুড়িতে কি কেউ ভয় পায়? বাঘের বলও তো বারো বছর, চেয়ারম্যানের আর কদিন? ছবেদালি তো রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে মিনমিনে গলায় বলেই বসল, ‘তুমি তো হিন্দুগো দালাল, তাগো পক্ষিই তো বইলবে।’
ভাগ্যিস, কথাটা চেয়ারম্যানের কানে যায়নি। গেলে হয়ত চড়িয়ে ছবেদালির দাঁতের পাটি তুলে ফেলতেন। ছবেদালিও ইচ্ছে করে কথাটা জোর গলায় বলেনি। চেয়ারম্যানের মেজাজ সম্পর্কে তার ধারণা আছে। মেজাজ চড়লে তার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না।
সে-রাতে গোনের দিঘির পাড়ে প্রসূন মাইতির পরিত্যক্ত ভিটায় একদল মানুষ জমায়েত হয়। অন্ধকারে কেউ কারো মুখ দেখতে পায় না। কে ছবেদালি মোড়ল, কে আলাউদ্দিন আর কে মাজেদ গাইন ঠাওর করা যায় না। কে জানে, মহব্বত সাজুনিও থাকতে পারে, আজিবর বাওয়ালিও থাকতে পারে। মোবারক বা মহসিন মেম্বারের থাকাটাও বিচিত্র কিছু নয়। সবাই তো এখন হিন্দুদের বিরুদ্ধে একজোট। সিংহড়তলির পেশাধারী লেঠেলরাও থাকতে পারে। গভীর জাড়ের রাত। সবার মাথা কানটুপিতে, মাপলারে বা চাদরে ঢাকা। চেনার কোনো উপায় নেই।
গরানপুরের রাতজাগা কুকুরগুলোর ডাক থামে না। ডাক নয়, বিলাপ। কোন শোকে দীর্ঘস্বরে তারা বিলাপ করছে কে জানে। জাবেদ খানের শরীর খারাপ, হাঁস-মুরগির সঙ্গেই সে বাড়ি ফিরেছে। গরানপুর বাজার উত্তপ্ত। সবার মুখে কোবাদ মাঝির কথা। ফেলুর দোকানে আলাউদ্দিন পায়ের ওপর পা তুলে বসে হিন্দুদের চৌদ্দগোষ্ঠী ধরে গালিগালাজ করেছে। সার্বিক পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধার মনে হলো না জাবেদ খানের। এশার নামাজটা পড়ে অজানা আশঙ্কা মাথায় নিয়ে সে শুয়ে পড়ল। কুকুরের ডাক তার আশঙ্কাটা আরো বাড়িয়ে দিল। কুকুরগুলোর স্বর খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। যে রাতে কেশব মাস্টার গুম হয়েছিলেন কুকুরগুলো ঠিক এমনিভাবে ডেকেছিল – মনে পড়ে তার।
তখন মাঝরাত। তীব্র শীতে জবুথবু মানুষেরা নিশাঘুমে। মাঝ আকাশে জ্বলজ্বল করছে আদম সুরত। প্রসূন মাইতির পরিত্যক্ত ভিটায় জড়ো হওয়া মানুষগুলো বড় রাস্তাটা ধরে দক্ষিণে হাঁটা ধরল। হাতে হাতে লাঠিসোঁটা, দা-কুড়াল। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর মতো মার্চ করতে করতে তারা রাধামাধবদের বাড়ির উঠোনে এসে থামল। বউ-বাচ্চা নিয়ে রাধামাধব গভীর ঘুমে। মহেশ্বর বনে গেছে দিন পনেরো আগে, ছেলেমেয়েদের নিয়ে তার বউ ঘরে একা। দুঃস্বপ্ন দেখে রাধামাধবের ঘুম ভেঙে যায়। সে দেখছিল, ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে চুনকুড়ির বাঁধ ভেঙে গেছে। পাহাড়সমান ঢেউ মুকনোলির প্রান্তরে। বাদাবন ডুবে গেছে অথৈ জলে। তার আট বছরের ছেলেটা লোনাজলে হাবুডুবু খাচ্ছে। বাঁচানোর জন্য ঢেউয়ের সঙ্গে লড়ে সে ছেলের দিকে আগানোর ছেষ্টা করছে। হঠাৎ একটা ঢেউ এসে ছেলেটাকে চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে গেল।
শোয়া থেকে উঠে বসল রাধামাধব। বুকটা ধুকপুক করছে ভীষণ। চকির নিচে মাটির কলসি থেকে এক মগ জল ঢেলে এক টানে খেয়ে নিল। মগটা চকির তলায় রাখতে গিয়ে বাইরে হঠাৎ মানুষের গলা শুনতে পেল। চমকে উঠল সে। বাড়িতে এত রাতে মানুষের আনাগোনা! বুকের ধুকপুকানি দ্বিগুণ বেড়ে গেল। বিপদের গন্ধ ঝাপটা দিল নাকে। বহু বছর আগে গ্রামের দাসবাড়ি পোড়ার ঘটনাটা মনে পড়ল তার। কেশব মাস্টার নিখোঁজ হওয়ার পর ভক্তদাসের ঘর পোড়ার দৃশ্যটাও চোখের সামনে ভেসে উঠল। আগুনের লেলিহান শিখার আঁচ লাগছে যেন তার গায়ে।
শিরদাঁড়ায় তার কাঁপুনি ধরে। বুঝতে কিছু বাকি থাকল না আর। অন্ধকারে কাঁথা সরিয়ে বউকে টেনে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। বউ তার ভাবল অন্য কিছু। প্রায়ই তো মাঝরাতে রাধামাধব তার গরম শরীরটাকে আরো গরম করতে বউকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। বউকে কোলে করে হেঁশেলে নিয়ে খড়পাতার ওপর শুইয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে, বুকের সঙ্গে বুক মিলিয়ে ওম দেয়। বউ তার কিছু বলতে যাচ্ছিল বুঝি, রাধামাধব মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘সাবধান, কোনো কতা বলবা না। বাইরি মানুষ, মাইরে গাঙে ভাসিয়ে দ্যাবে।’
বেচারি আঁতকে ওঠে। চোখের পাতায় ঝুলে থাকা ঘুম মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। রাধামাধব সন্তর্পণে পা পেলে পেছনের দরজাটা খুলল। ফিরে এসে ছেলেটাকে বুকে তুলে নিল। তার বউ তিন বছরের মেয়েটাকে নিল কোলে। ধীর পায়ে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে শীতের শুকনো মাঠে নামল। রাধামাধব চাপা গলায় বলে, ‘জোরে হাঁটো বউ, আরো জোরে।’ বউ তার রীতিমতো দৌড়ায়, তবু সে ধমক লাগায়, ‘আরো জোরে, আরো…।’ বাবার আতঙ্কিত গলা শুনে অথবা গায়ে হুল ফোটানো শীতে মেয়েটা কঁকিয়ে উঠল। বাবার কোলে ছেলেটাও জেগে উঠেছে। ঘুম জড়ানো গলায় সে বলল, ‘কোনে যাচ্চো বাবা?’ রাধামাধব বলল, ‘জান্নে রে বাবা, চোক যেদিকি যায়। কতা বলিস নে, চুপ কর।’
রাধামাধবের বাড়ি তখন কুরুক্ষেত্র। দরজা ভেঙে একদল লোক তার ঘরে ঢুকল। ঘর খালি দেখে তারা তো অবাক। ওদিকে দরজা ভাঙার শব্দে মহেশ্বরের বউ কাঞ্চির ঘুম ভেঙে গেল। টেমিটা জ্বালিয়ে সে দরজা খুলে ডবায় এসে দাঁড়াল। আচমকা একজন তার হাত থেকে টেমিটা কেড়ে নিল। টেমিটা নিভে যায়। একজন তার শাড়ির আঁচল ধরে টান মারল, পেছন থেকে তার মুখটা চেপে ধরল আরেকজন। বেচারি চিৎকারও দিতে পারছে না। ধস্তাধস্তিতে তার শাড়িটা খুলে গেল। গায়ে ব্লাউজ নেই, পরনে সায়া নেই – লজ্জা নিবারণের জন্য সে মাটিতে বসে পড়ে। কঠিন দুটি হাত চিপে ধরল তার ঝুলন্ত দুটি স্তন। কাঞ্চি গোঙায়। তার গোঙানির স্বর বাড়ির সীমানা ছাড়ায় না। দুজন লোক তাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের পেছনে নিয়ে যায়। কাঞ্চি তাদের চিনতে পারে না। একজন তার বুকের ওপর উঠে বসল। মুহূর্তে কামারশালার তপ্ত লৌহদণ্ডের মতো একটা মাংসদণ্ড ঢুকে পড়ল তার তলপেটে। কাঞ্চি আর্তনাদ করে। লোকটা তার মুখ চেপে ধরে আছে। ব্যথার তীব্রতায় কাঞ্চি চটপট করে।
তারপর আরেকজন। তারপর আরেকজন। আরেকজনের পর আরেকজন। কেউ বুড়ো, কেউ জোয়ান। কারো গায়ে ঘামের গন্ধ, কারো মুখে বিড়ির গন্ধ, কারো মুখে তরকারির ঝোলের গন্ধ। কাঞ্চি তাদের চিনে উঠতে পারে না। ধুলোবালিতে হাত ছড়িয়ে সে মৃদুস্বরে কোঁকায়। তার শরীরের ওপর দিয়ে দুর্যোধনের শত শত সৈন্য যুদ্ধের মাঠের দিকে ছুটছে। কাঞ্চি মূর্ছা খেতে খেতে ছুটন্ত সৈন্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে কৃষ্ণনাম শিবনাম জপে।
তারপর আসুরিক শক্তি নিয়ে কোনো এক সৈন্য তার তলপেটে ধারালো তরবারি ঢুকিয়ে দেয়। সে আর কোঁকাতে পারে না। নড়চড়ও করতে পারে না। হুঁশ আছে কি নেই তাও বুঝতে পারে না। তার চোখ দুটো আকাশের দিকে স্থির। তারকারাজি জ্বলজ্বল করছে আকাশে। এক ঝাঁক তারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বীরবাহু এক যোদ্ধাকে আবিষ্কার করে সে। তার এক হাতে লম্বা তলোয়ার, অন্য হাতে ঢাল। যশোরেশ্বরী মন্দিরের ঠাকুরের মুখে সে মহাভারতের অর্জুনের কথা শুনেছিল, শ্রীকেষ্টর ভেতরে যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেখেছিল। যোদ্ধাটাকে তার অর্জুনের মতো মনে হয়। ঢাল হাতে, তলোয়ার হাতে সে যেন তাকে উদ্ধার করতে আকাশ থেকে একটু একটু করে মাটিতে নেমে আসছে।
না, অর্জুন আসে না। তারাগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে সমস্ত আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। চোখ দুটো আর খোলা রাখতে পারে না কাঞ্চি, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে চোখ বুজে। সে হয়ত মরে গেছে। চিতায় তোলা হচ্ছে তাকে। তার ছেলেমেয়েদের কান্না ভেসে আসছে। পাঁচ বছরের মেয়েটা মা মা বলে চিৎকার করছে। কে জানে, তার সঙ্গে তার ছেলেমেয়েদেরও হয়ত চিতায় তোলা হচ্ছে। তার মতো তারাও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে ছাইয়ের সঙ্গে মিশে যাবে।
প্রান্তরের পথে কালিন্দীর দিকে ছুটতে ছুটতে রাধামাধব পেছনে ফিরে দেখে গরানপুরের আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা। তার বুকটা ফেটে যেতে চায়। তার বউ কপালে হাত দিয়ে প্রান্তরের শিশিরসিক্ত মাটিতে বসে পড়ে। বুকের গভীর থেকে কণ্ঠনালি ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসে, ‘আমার সোনার সংসার!’