কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
এগারো.
শেষরাতে মুন্সিগঞ্জের হাজীবাড়ি ডাকাতি করে ভোরের টকটকে লাল সূর্যকে সামনে রেখে পুষ্পকাটির জঙ্গলে মোছলেম তালুকদারের আস্তানায় ফিরে যাবার সময় চুনকুড়ির একটা খালে পুলিশের হাতে আটক হয় কালুবাবুসহ আরো দুই বনদস্যু। পরে বাঁ-উরুতে শনাক্তকরণ চিহ্ন দেখে পুলিশ নিশ্চিত হতে পারে কালুবাবু তার ছদ্মনাম, তার আসল নাম খালেক বেপারি, বিলকিস হত্যা মামলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। পুলিশ ধারণা করেছিল জামিনে মুক্তি পেয়ে মামলার আরেক আসামি এনায়েতের সঙ্গে সে হয়ত ভারতে পালিয়ে গেছে। অথচ সে দুর্ধর্ষ বনদস্যু মোছলেম তালুকদারের গ্যাংয়ে যোগ দিয়েছে, পুলিশ তো দূরে থাক, তার আত্মীয়-স্বজনরাও ভাবতে পারেনি।
শ্যামনগর থেকে দুবলার চর, হরিনগর থেকে শরণখোলা পর্যন্ত মোছলেম তালুকদারের নাম মানুষের মুখে মুখে। তার ভয়ে গ্রামের পুঁচকে মাস্তান তো কোন ছার, সরকারি দলের বড় বড় নেতাদেরও হাঁটু কাঁপে। অথচ কেউ তাকে কোনোদিন দেখেনি। হয়ত দেখেছে। হাটে-বাজারে শহরে-বন্দরে তো সে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু তাকে কি, থানার দারোগা-সেপাইর মতো তার বুকে তো আর নাম লেখা থাকে না। গেরস্তবাড়ি ডাকাতির সময় সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে হয়ত সেও যায়। কিন্তু তখন তো তার সাঙ্গপাঙ্গদের কেউ ভুলেও তার নাম উচ্চারণ করে না। সেও তো কাউকে নিজের পরিচয় দেয় না। বনবিবি, শাজঙ্গলী বা দক্ষিণরায়কে মানুষ দেখে না, অথচ ভক্তিশ্রদ্ধা করে। মোছলেম তালুকদারকেও মানুষ দেখে না, অথচ তার ভয়ে সবার বুক কাঁপে।
কুখ্যাত বনদস্যু বাছের ঢালী গ্রেপ্তার হওয়ার পর মানুষ ভেবেছিল সুন্দরবনে ডাকাতের উৎপাত বুঝি চিরদিনের জন্য বন্ধ হলো। তার সাঙ্গপাঙ্গ যারা তখনো গুম-খুন-ডাকাতি সমানে চালিয়ে যাচ্ছিল তাদের কেউ বন্দি হলো, বন্দুকযুদ্ধে কেউ পুলিশের গুলিতে মারা পড়ল, কেউ পালিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় বিএসএফের হাতে ধরা পড়ল। তারপরও দু-একজন যে ছিল না তা নয়। নইলে হঠাৎ হঠাৎ এখানে-ওখানে ডাকাতি করত কে? বিচ্ছিন্ন দু-একটা ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও দশ-বারো বছর দাগি কোনো দস্যু-ডাকাতের নাম শোনা যায়নি।
হঠাৎ একদিন পুবের বাদায় মোছলেম ডাকুর নাম শোনা গেল। মহিষকুরের মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস তালুকদারের ছেলে জোড়া খুনের আসামি মোছলেম তালুকদার। তুচ্ছ কারণে হেদায়াতে ইসলামি কালীগঞ্জ উপজেলা শাখার দুই শীর্ষ নেতাকে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা শান্তি কমিটির মেম্বার ছিল, কুপিয়ে খুন করে ভারতের পালিয়ে যাওয়ার সময় মাথুরেশপুর সীমান্তে বিডিআরের হাতে ধরা পড়ে। বিডিআর তাকে থানায় সোপর্দ করলে মধ্যরাতে ডিউটিরত পুলিশ কনস্টেবলের কাছ থেকে বন্দুক ছিনিয়ে থানা থেকে পালিয়ে বাদায় আত্মগোপন করে। অল্পদিনের মধ্যেই সে শক্তিশালী গ্যাং গড়ে তুলল – মোছলেম বাহিনী। পুলিশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার পাত্তা পায় না। পাবে কীভাবে? পুলিশ, কোস্টগার্ড বা বনপ্রহরীদের মধ্যেও তো তার লোক আছে, গ্রামে গ্রামে তার খোজারু আছে – পুলিশ তার বিরুদ্ধে অভিযানে নামার আগেই তো খবরটা তার কাছে চলে যায়। তখন সে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেলে পুলিশ তার নাগাল পাবে কীভাবে?
আর নাগাল পেলেই-বা কী। পুলিশের কাছে ক’টা বন্দুক? বাদায় যেসব মৌয়াল-বাওয়ালি যায় তারা খবর আনে, তালুকদার বাহিনীর কাছে ডজন ডজন পিস্তল-বন্দুক। আর ডেগার যে ক’খানা আছে তার তো গোনগুনতি নেই। তার সাঙ্গপাঙ্গের সংখ্যা কম করে হলেও পঞ্চাশ জন। শ্যামনগর, আশাশুনি, পাইকগাছা, রামপাল ও মোরেলগঞ্জের দাগি দাগি সব আসামি তার গ্যাংয়ে যোগ দিয়েছে। কুড়ি-পঁচিশটা পুলিশ সামাল দেয়া তাদের কাছে তুচ্ছ ব্যাপার।
কয়েক বছরের মধ্যে বাছের ঢালীর মতো মোছলেম ডাকুর নামও উত্তর থেকে দক্ষিণে, পুব থেকে পশ্চিমের বাদায় ছড়িয়ে পড়ল। সুন্দরবনের আশপাশে ডাকাতি বা খুনখারাবির যত ঘটনা ঘটে সব ঘটনার পেছনেই মোছলেম ডাকুর নাম। রাজু বাহিনী, হারেছ বাহিনী, ইলিয়াস বাহিনীর মতো বনদস্যুদের আরো কত গ্যাং আছে। ডাকাতিটা হয়ত রাজু বাহিনী করেছে, খুনটা হয়ত হারেছ বাহিনী করেছে, অথচ দায়টা পড়ে মোছলেম বাহিনীর ঘাড়ে। থানায় থানায় মোছলেমের নামে মামলার সংখ্যা বাড়ে, মাসে মাসে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি হয়।
খালেক বেপারি অনেকটা নিশ্চিত ছিল বিলকিস হত্যা মামলা থেকে তার বাঁচার কোনো পথ নেই। ফাঁসি না হলেও যাবজ্জীবন কারাদ- তো নিশ্চিত। মামলা খেয়ে তার ব্যবসাপাতিও লাটে উঠল। জামিনে মুক্তি পাওয়া ডাকাতি মামলার এক আসামির মাধ্যমে দোকানের সব জিনিসপত্র বেচে দিয়ে বড় বড় উকিল ধরে জামিনে ছাড়া পায়। জেল থেকে বাড়ি ফিরলে বউ খ্যাংরা ঝাঁটা নিয়ে তাড়া করল, ‘শালা নুচ্চোর ঘরের নুচ্চে, আমার বাপের বাড়ি তোর জাগা নি। তোর বাপের বাড়ি গে গরু-মোষ বে কুরে সংসার কর বেজন্মার বাচ্চা।’
বউয়ের তাড়া খেয়ে সে শ্বশুরের পায়ের ওপর গিয়ে পড়ল, ‘এবারের মতো মাফ কুরে দ্যান বাপজান, জীবনে আর এরাম খারাপ কাজ করব না।’
শ্বশুর মাফ করলে কী হবে, মেয়ের তো এক কথা – এমন লুচ্চা-বদমাশ ভাতারের ঘর সে করবে না। গ্রামের মোড়ল-মাতবররা বুঝিয়েও তাকে টলাতে পারল না। কী আর করে খালেক, মনের দুঃখে তাকে বনবাস নিতে হয়। মোছলেম তালুকদারকে বাপ ডেকে তার পা ধরে পড়ে থাকল, ‘আপনি আমার ধর্মবাপ। আপনি ছাড়া দুনিয়ার বুকি আমার আর গতি নি।’
মোছলেম ডাকু কি আর মিষ্টি কথায় মজে? হাজারবার বাপ ডাকলেও অত সহজে কাউকে সে দলে ভেড়ায় না। তার ওপর খালেক বেপারি হেদায়াতে ইসলামির মাঝারি নেতা। ছদ্মবেশে সে মোছলেম তালুকদারের ক্ষতি করতে আসেনি তার কী নিশ্চয়তা? বিশ্বস্ততা পরীক্ষা করতে মোছলেমের সাগরেদরা তাকে দোবেকির গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে এলো – যা শালা, জ্যান্ত ফিরে আসতে পারলে বড়বাবুর পায়ে ঠাঁই পাবি।
বেপারির কলিজা বটে একখানা, পরীক্ষায় সে উতরে গেল। জঙ্গলে দু-দুবার বাঘের তাড়া খেয়ে নদী-খাল সাঁতরে পরদিন তালুকদারের আস্তানায় হাজির। তাকে দেখে তালুকদার মুচকি মুচকি হাসে। পিঠ চাপড়ে বলল, ‘যা বেটা, পারবি তুই। বুকি তো দেখতিছি ম্যালা সাহস।’
পেরেছে বটে খালেক। অল্প দিনেই তালুকদারের অন্য সাগরেদদের পেছনে ফেলে ডাকাতি খুনখারাবিতে ওস্তাদ হয়ে উঠল। লম্বা ডেগারটা জ্যান্ত মানুষের পেটে ঢুকিয়ে দিতে একবারও হাত কাঁপে না তার। গায়ের রং কুচকুচে কালো, তাই তার নাম ফাটল কালুবাবু।
পুলিশকে দেয়া জবানবন্দিতে কালু স্বীকার করল, মোছলেম তালুকদারের প্রধান সাগরেদ গোলাপ গাজী দলবল নিয়ে সেই রাতে কেশব মাস্টারকে অপহরণ করে। অপহরণের কারণ কিছু জানে না সে। পুষ্পকাটির জঙ্গলে তালুকদারের আস্তানায় মাস্টারকে দেখে সে চিনতে পারে। কোর্টে একবার মাত্র দেখেছিল। দিদারের সঙ্গে বেপারি সেদিন আসামির কাঠগড়ায় ছিল, আর মাস্টার ছিলেন সাক্ষীর কাঠগড়ায়। মাঝে আট বছর কেটে গেছে, কিন্তু মাস্টারের চেহারাটা সে ভোলেনি।
মাস্টারকে যেদিন মোছলেম ডাকুর আস্তানায় তুলে আনা হয় তার পরদিন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কালু বুড়িগোয়ালিনির এক গেরস্তবাড়ি ডাকাতি করতে চলে যায়। তিন দিন পর ফিরে জানতে পারে মাস্টারকে সেদিন ভোরেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মোছলেম ডাকুর হুকুমে মাস্টারকে একটা নৌকায় তুলে আরো চার দস্যুসহ গোলাপ গাজী গরানপুরের উদ্দেশে রওনা করেছে।
কালুর কাছে ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকল। খুনের ঠিকা নিয়ে গোলাপ গাজী কাউকে তুলে আনল অথচ বড়বাবু তাকে ছেড়ে দিল – এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেছে কিনা সে মনে করতে পারে না। সে তো এসেছে সেদিন, যারা শুরু থেকেই মোছলেমের সঙ্গে, এমন ঘটনার কথা তাদেরও মনে পড়ে না। কালু পরে জানতে পারে, মাস্টারকে আস্তানায় আনার পরদিনই গলা কেটে দোবেকি গরানকূপে লাশ ভাসিয়ে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু গোলাপ গাজী মাস্টারের পরিবারের কাছ থেকে কিছু টাকাপয়সা খসানোর ধান্ধায় মাস্টারকে কদিন বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তাতে মোছলেম গেল খেপে, ‘ঠিকা নেচো খুনের, এখন আবার গুমের কতা বইলে টাকা খসানোর ধান্ধা কুত্তছ কেন?’
গোলাপ গাজী উত্তর দিতে পারে না। ডাকাত হলেও মোছলেম কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলে। যার ঘরে দশ হাজার টাকার বেশি নেই তার ঘরে সে কোনোদিন ডাকাতি করতে যাবে না, ডাকাতিতে আধা ঘণ্টার বেশি সময় নেবে না এবং খুনের ঠিকা নিয়ে গুমের কথা বলে পরিবারের কাছ থেকে টাকাপয়সা নেবে না। সাঙ্গপাঙ্গদের কেউ নীতির ব্যত্যয় ঘটালে তার আর রেহাই নেই, নিজ হাতে গুলি করে মারবে তাকে।
অগত্যা মাস্টারের গলা কাটতে ছুরি শান দেয় গোলাপ গাজী। মাস্টারকে দোবেকি গরানকূপে নেয়ার জন্য নৌকায় তোলার সময় মোছলেম তাকে কাছে ডাকে। মাস্টারের দু-হাত পিছমোড়া বাঁধা। মোছলেম নৌকার গলুইতে বসে পা দোলাচ্ছে। মাস্টার ধীর পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
: কিচু বইলবে বাবু?
মোছলেম মাথা দোলায়, ‘হুঁ। হিন্দু না মুসলমান?’
: হিন্দু আগে ছেলাম বাবু, এখন মুসলমান।
: ও, নওমুসলিম?
: আজ্ঞে।
: আজ্ঞে? মুসলমানরা তো আজ্ঞে বলে না।
: আজ্ঞে আমার বাপ-ঠাকুদ্দার ভাষা। ভাষার মদ্দি আবার হিন্দু-মুসলমানের কি আচে বাবু?
মোছলেমের পা দোলানি থেমে যায়। ডান হাতের আঙুলে লম্বা গোঁফে তা দিতে দিতে মাস্টারের ঘামেভেজা মুখটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
: কথা তো ভালোই বলতি পার। পড়ালেখা করিছ কদ্দূর?
: আজ্ঞে ম্যাট্টিক পাস।
মোছলেম গোঁপে তা দিয়ে যায়।
: কপালে ওটা কিসের দাগ?
: আজ্ঞে গুলির।
: গুলির! যৌবনকালে চুরি-ডাকাতি কত্তে নাকি?
: আজ্ঞে না। কাশিমারির যুদ্ধে পাক সেনাদের এট্টা গুলি আইসে এই জাগায় লাগে। অল্পের জন্যি মাথাটা বাঁইচে গেচে।
: ও, ফ্রিডম ফাইটার?
চোখ নামিয়ে নিলেন মাস্টার। তার ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল। কপালের ভাঁজ দেখে মোছলেম বুঝতে পারে মাস্টারের বুকের ভেতর হঠাৎ কোনো এক বেদনা হানা দিয়েছে। মোছলেম তখনো গোঁপে তা দিচ্ছে। তার চোখ মাস্টারের মুখের ওপর স্থির। অপলক। তা দিতে দিতে মোছলেম দুই গোঁপকে তলোয়ারের মতো বাঁকা করে তোলে। তখন শেষ বিকেল। গাছগাছালির আড়ালে ঢাকা পড়েছে সূর্য। পুষ্পকাটির জঙ্গলে আলো-অন্ধকারের লুকোচুরি খেলা চলছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত মাস্টার মাথা নুইয়ে একঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলেন। নদীতে ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাঙল, মোছলেম তার লম্বা গোঁপে তায়ের পর তা দিয়ে গেল।
সারা রাত কাটল, মোছলেম একবারও তার নৌকা থেকে বেরোল না। তার হাঁছি-কাশির শব্দটি পর্যন্ত শোনা গেল না। গোলাপ গাজী শেষরাতে পেশাব করতে উঠে সর্দারের নৌকায় উঁকি মেরে বিড়ির আগুন দেখতে পায়। বাতায় হেলান দিয়ে কে যেন বিড়ি টানছে। আগুনটা একবার ওপরে উঠছে তো ফের নিচে নামছে। গোলাপ গাজীর খটকা লাগল। সর্দার তো এত রাত জাগার কথা নয়।
: গোলাপ!
গোলাপ গাজী চমকে ওঠে। চাপাগলায় জবাব দেয়, ‘জে বড়বাবু।’
: লোকটা কোন জাগায়?
: জে, আমার নৌকোয়।
: তুই এক্ষুনি গরানপুর রওনা কর।
: জে আচ্ছা। কার বাড়ি ঢুকতি হবে?
: কারো বাড়িতি না শালা। লোকটারে যেখানেত্তে তুলে নে আসছিলি ঠিক সেখানে রাইখে আস্পি। গায় য্যান এট্টা কাঁটার ঘাও না লাগে, হুঁশিয়ার।
: জে?
: জে জে মারাস না নাড়ের ছাবাল। এখনই রওনা হ।
গোলাপ গাজী আরো দুই দস্যুকে নিয়ে রওনা হয়। কিন্তু আদৌ সে মাস্টারকে গরানপুর পৌঁছে দিল, নাকি জঙ্গলে ছেড়ে দিল, পরে আর খোঁজ নিতে পারেনি কালু।
পরদিন গোলাপ গাজী আস্তানায় ফিরে আসে। তখন দুপুর। কালু নৌকায় বসে ভাত খাচ্ছিল। ছাপ্পরের ফাঁক দিয়ে তার চোখ যায় মোছলেমের নৌকায়। সেদিনের মতো নৌকার গলুইতে বসে মোছলেম, গোলাপ গাজী হাতজোড় করে তার সামনে দাঁড়িয়ে। কালুর খটকা লাগে। মোছলেমের ডান হাত গোলাপ গাজী, তার তো এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়!
এক হাতে থালাটা ধরে অন্য হাতে এক লোকমা ভাত মুখে পুরল কালু। মোছলেম তার বন্দুকটা গোলাপ গাজীর বুক বরাবর তাক করল। আঁতকে উঠল কালু। চোখের পলকে গোলাপ গাজী শিকারি বাঘের মতো এক লাফে মোছলেমের হাতটা চেপে ধরল। ট্রিগার থেকে মোছলেমের আঙুলটা ফস্কে গেল। দুজনের ধস্তাধস্তি শুরু হলো। আচমকা গোলাপ গাজীর লাথি খেয়ে গাঙের হাঁটুজলে গিয়ে পড়ল মোছলেম, বন্দুকটাও ছিটকে পড়ল গাঙে। গোলাপ গাজী একটানে নৌকার লগিটা টেনে তুলে তালুকদারের ঘাড়ে প্রচণ্ড আঘাত করল, ‘বাইনচোত! আমারে তুই মারতি চাস। তোর পোঙ্গার মদ্দি বন্দুক ঢুকিই দ্যাবো খানকির ছাবাল।’
ভেজা বাঘের মতো মোছলেম একলাফে নৌকায় উঠে তার সাদা চকচকে ডেগারটা হাতে নিয়ে রুখে দাঁড়াল। গোলাপ গাজী নিরস্ত্র। বেগতিক বুঝে বাঘের তাড়া খাওয়া শেয়ালের মতো লেজ তুলে নদীর চর ধরে পুবে দৌড় দিল। ডেগারটা উঁচিয়ে তাকে ধাওয়া করতে লাগল মোছলেম। পাতের ভাত পাতে রেখে কোনো রকম হাতটা ধুয়ে মোছলেমের পিছু ছুটল কালু।
গোলাপ গাজী হয়ত এ যাত্রায় বেঁচে যেতে পারত, যদি না কালু তাকে ধরে ফেলত। দু-হাতে গলাটা এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরল কালু, গোলাপ গাজীর দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো। মোছলেমের হাত থেকে বাঁচার শেষ চেষ্টা করল গোলাপ, আচমকা কালুর গোপনাঙ্গটা ধরে দিল প্রচণ্ড জোরে টান। মাগো বলে চিৎকার দিয়ে কালু তাকে ছেড়ে দিল। আর তখনই গোলাপ গাজীর শার্টের কলার চেপে ধরে গর্জে উঠল মোছলেম, ‘তোরে আমি বিশ্বেস কুরেলাম শোরের বাচ্চা।’
ততক্ষণে কালু গোলাপ গাজীকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে, আর মোছলেম তার চকচকে ডেগারটা গাজীর তলপেটে ঢুকিয়ে দেয়। ভুঁড়িটা নেমে যায়। আর্তনাদ করে গোলাপ গাজী চরের বালিতে গড়াগড়ি খায়। তারপরও রাগ দমল না মোছলেমের, কালুর বন্দুকটা নিয়ে গোলাপ গাজীর খুলি বরাবর তাক করে ট্রিগার চাপল। নিশানা অব্যর্থ, মাথাটা আর টেনে তুলতে পারল না গোলাপ। গুলির শব্দে দূরে কোথায় একটা বাঘ হুঙ্কার ছাড়ল, পশুপাখিদের ছোটাছুটিতে জঙ্গলে হুলস্থুল কাণ্ড শুরু হলো।
কিন্তু গোলাপ গাজীর অপরাধটা কী, কে জিজ্ঞেস করবে মোছলেমকে? দুদিন তো তার ধারেকাছেও ঘেঁষার সাহস পায়নি কেউ। কালুও না। তিন দিন পর মোছলেমের কথামতো দলবল নিয়ে হাজীবাড়ি ডাকাতির উদ্দেশে রওনা করে কালু।
কালুর জবানবন্দি মোতাবেক পুলিশ নিশ্চিত হতে পারে কেশব মাস্টার গুম হয়েছেন। গরানপুর বা হরিনগরের কেউ শত্রুতা করে গোলাপ গাজীকে টাকা দিয়ে মাস্টারকে হত্যার পাঁয়তারা করে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ কারণ হিসেবে মাস্টারের ধর্মান্তর ছাড়া অন্য কোনো কারণ খুঁজে পেল না। কালুর জবানবন্দির পর এটিকে অপহরণের অন্যতম কারণ বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাস্টার খুন হলেন, না এখনো বেঁচে আছেন, এ বিষয়ে পুলিশ অন্ধকারে।
ভক্তদাসের কাছে খবর এলো কেশব মাস্টার অপহরণ মামলায় সে ১ নম্বর আসামি। অন্য আসামিদের মধ্যে রাধামধব, বিপিন আর মহেশ্বরের নামও আছে। সেদিন সন্ধ্যায় পুলিশ ভক্তদাসের বাড়ি ঘেরাও করল। গ্রামে পুলিশ আসার খবর সে পেয়েছিল, ইচ্ছে করলে ক্রাচে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও পালিয়ে যেতে পারত। কিন্তু না, পালানোর কোনো চেষ্টাই করল না সে। চৈতনদাস খুন হওয়ার পর যেভাবে তার হাতে হাতকড়া পরানো হয়েছিল একইভাবে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে গেল। বিপিন তো আগেই পালিয়েছে, ভক্তদাস গ্রেপ্তারের খবর শুনে রাধামাধব আর মহেশ্বরও গা ঢাকা দেয়।
মানুষের মনে আর কোনো সন্দেহ থাকল না, হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়ার কারণেই হিন্দুরা দস্যু-ডাকাতকে টাকা দিয়ে কিশোয়ার মাস্টারকে খুন করিয়েছে। গরানপুর-হরিনগরের বাতাস উত্তপ্ত হয়ে উঠল। ওয়াহাবি, সুন্নি, মাযহাবি, লা-মাযহাবি সব এক হও। বেদ্বীন হিন্দুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও। মুসলমানরা দলে দলে হরিনগর বাজারে জড়ো হতে লাগল। এত বড় ঘটনার পর হেদায়াতে ইসলামির একজন নেতা হিসেবে ছবেদালি মোড়লের তো আর চুপ করে থাকা চলে না। মাঝবাজারে বটগাছটার মোটা শেকড়ের ওপর দাঁড়িয়ে সে বক্তৃতা শুরু করল, ‘মুসলমানের দেশে হিন্দুগো এমন দৌরাত্ম্য বরদাস্ত করা যায় না। এর এট্টা ফয়সালা করতিই হবে ভাইসব। লাই দে দে হারামজাদারা এখন আমাগো মাথায় মুতে দেচ্চে।’
আলাউদ্দিন তার পাশে দাঁড়িয়ে ‘নারায়ে তকবির’ বলে জোরসে হাঁক মারলে উপস্থিত মুসলমানরা ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে বাজার কাঁপিয়ে দেয়। কোনো কোনো দোকানের কপাট পড়তে থাকে। হিন্দু দোকানিরা তো অনেক আগেই দোকান বন্ধ করে বাজার ছেড়েছে। ছবেদালি মোড়লের গলার জোর আরো বাড়ে, ‘বিধর্মীরা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করলি সকল মুসলমানের জন্যি জেহাদ ফরজ। কেশব মাস্টারের পরিবার হিন্দু ঠিক আচে, কিন্তু সে আতা মৌলবির কাচে কলমা পইড়ে মুসলমান হইচে। তার বিপদে পাশে দাঁড়ানোর দায় এখন সব মুসলমানের।’
মুসলমানদের উস্কে ওঠা জেহাদি জোশ কে আর দমিয়ে রাখে! লাটিসোঁটা নিয়ে দলে দলে মুসলমান খেপে ওঠা বুনো গয়ালের পালের মতো রাস্তার ধুলো উড়িয়ে স্লোগান দিতে দিতে ভক্তদাসের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলো। হরিনগরের হিন্দুরা ঘরের দরজা-জানালায় খিল দিয়ে শিবের নাম জপতে লাগল―রক্ষা করো হে ধ্বংসের দেবতা। ভক্তদাসের বউ-ঝি ঘরে তালা দিয়ে যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল। মুসলমানরা বাড়ির উঠোনে এসে জড়ো হলো। ছবেদালির ইশারা পেয়ে একদল লোক মস্ত একটা গাছের গুঁড়ির আঘাতে ঘরের দরজাটা ভেঙে ফেলল। তারপর যে যেভাবে পারল গণহারে লুটপাট চালাল। হরিনগর বাজার থেকে এক টিন কেরসিন এনে ঘরের চালে ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুনের সর্বনাশা তা-ব থেকে ভক্তদাসের বাশ্ঘর, হেঁশেল, ঠাকুরঘর, গোয়ালঘর বা খড়ের গাদা কিছুই রক্ষা পেল না। রক্ষা পেল না বাড়ির গাছাগাছালিও।
হিংসায় উন্মত্ত মুসলমানরা স্লোগান দিতে দিতে এবার গরানপুরের দিকে রওনা হলো। রাধামাধব, বিপিন ও মহেশ্বরের ঘর একই বাড়িতে – এক উঠোনে তিন ঘর। একটা ঘরে আগুন দিলে বাকি দুটি আর আস্ত থাকবে না। মুসলমানরা খানবাড়ির চৌরাস্তার মোড়ে এলে পথ আগলে দাঁড়াল জাবেদ খান, ‘খবদ্দার, এডা হরিনগর না, এডা গরানপুর। কেউ অপরাধ করলি কোর্ট-কাচারি আচে। দরকার হলি বিপিন-মহেশ্বরকে ধইরে আমরা পুলিশের হাতে তুইলে দ্যাবো। বিচারে তারা দোষী সাব্যস্ত হলি শাস্তি পাবে। কিন্তু বিচারের আগে তাগো বাড়িঘরে আগুন দেয়া কেন?’
হাঙ্গামাটা এখানে চুকে যেতে পারত, কিন্তু ছবেদালি মোড়লের আচরণে গরম তেলে নুনের ছিটা পড়ল। পায়ের একটা সেন্ডেল হাতে নিয়ে সে বলে বসল, ‘গরানপুর হুয়েচে তো কী হুয়েছে? গরানপুর কোন জমিদারের জাগা, এ্যাঁ? শালাদের শায়েস্তা না কুরে আমি হরিনগর ফিরতিচি নে।’
কথাটা গরানপুরবাসীর গায়ে লাগল। লাগারই কথা। গরানপুরের মানুষরা কি মানুষ নয়? ছবেদালি মোড়ল কোন জমিদারের বেটা গরানপুর নিয়ে এমন বাজে মন্তব্য করবে? ভিড় ঠেলে আজিবর বাওয়ালি ছবেদালির সামনে এসে তর্জনিটা নাচাতে নাচাতে বলল, ‘কথা ঠিক কুরে বল ছবু ভাই। গরানপুরির মানুষ তোমার খায় না, পরেও না। হাতেত্তে জুতো নামাও।’
ছবেদালি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, বলেছিলও হয়ত, কিন্তু হৈ-হট্টগোলে তার কথাটা চাপা পড়ে গেল। নিজের ছোঁড়া ঢিল আবার নিজের দিকে ফিরে আসবে ভাবতে পারেনি সে। যে মানুষগুলো এতক্ষণ ঐক্যবদ্ধ ছিল, তার একটি মাত্র কথায় তাদের মধ্যে বর্ষার চুনকুড়ির বাঁধের মতো ফাটল ধরল। গরানপুর ও হরিনগরবাসী দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল। চারদিকে নজর করে পরিস্থিতি সুবিধার ঠেকল না তার। আজিবর বাওয়ালির কথার পিঠে সে কথা আবার বলে কী করে!