কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
দশ.
মা রক্ষাকালী মন্দিরে নতুন প্রতিমা স্থাপন উপলক্ষে মোল্লেপাড়ায় সাজ সাজ রব। কেশব মাস্টার নিখোঁজের ঘটনায় যে গুমোট পরিবেশটা তৈরি হয়েছিল, নতুন প্রতিমা স্থাপনকে কেন্দ্র করে তা অনেকটা কেটে যেতে লাগল। নিবারণ সাধকের একক প্রচেষ্টায় মন্দিরে নতুন প্রতিমা বসছে। চুনকুড়ির আড়ার ধারে মন্দিরের জায়গাটার মালিকও সে। তার দাদার আমলে মন্দিরটা উঠেছিল। তার দাদা দিয়েছিল জায়গা, ঘর তোলা ও প্রতিমা গড়ার খরচ দিয়েছিল নরেন মণ্ডল। মাটির গুদাম, বাঁশের চালের ওপর গোলপাতার ছানি। নিত্যপূজা দেওয়ার মতো সেবক ছিল না, এখনো নেই – যার যার খেয়াল খুশিমতো পূজা দেয়, ভোগ দেয়। আশ্বিন মাসের দেয়ালি পূজার সময় মুন্সিগঞ্জ সর্বজনীন দুর্গামন্দির থেকে ঠাকুর এসে চণ্ডীপাঠ, ভগবত গীতাপাঠ এবং পাড়ার সবাইকে নিয়ে একটা রাত মায়ের আরাধনা করে যায়। মাঘ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে রটন্তীপূজা এবং ফলহারিণী পূজার সময় পাড়ার নারী-পুরুষ মিলে পূজা করে। ঠাকুর-পুরুতের দরকার হয় না। প্রতি শনি-মঙ্গলবার সন্ধ্যাবেলায় নিবারণের মা লাঠি ঠুকে ঠুকে দরজার সামনে একটা কুপি জ্বালিয়ে যায়। জ্বলতে জ্বলতে কুপিটার তেল ফুরিয়ে বা বাতাসের ঝাপটায় কখন নিভে যায় কারো খেয়াল থাকে না। কেউ খেয়াল রাখার দরকারও মনে করে না। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত, খেয়াল রাখার মতো সময় কোথায়।
নিবারণের বাবা যতদিন বেঁচে ছিল মন্দিরটা দেখেশুনে রেখেছে। বছরে একবার ছানি বদল করেছে। তার অকাল মৃত্যুর পর বহু বছর মন্দিরটা অযত্ন-অবহেলায় পড়েছিল, টানা সাত বছর ছানিটা পর্যন্ত পাল্টানো হয়নি। নিবারণ বাঁশের ছালের ওপর লতাপাতা আর ছেঁড়াখোড়া একটা তেরপল দিয়ে রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে কোনোরকম মায়ের মূর্তিটা রক্ষা করেছে। আয়-রোজগার বাড়লে পরে মন্দির সংস্কারের একটা উদ্যোগ নিল সে। মায়ের নামে এর-ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে এবং নিজে কিছু দিয়ে টিনের ছানি দিয়ে দিল। কিন্তু মায়ের মূর্তিটার মলিন দশা ঘোচানো গেল না। হাতের খড়গগুলোর, মাথার কালো কেশগুলোর রং মুছে গেছে। সেই কবেকার মূর্তি, মুছবেই তো। প্রতিবছর পূজার সময় ঝাড়মোছ দেয় বটে নিবারণ। কিন্তু ঝাড়মোছে তো আর মায়ের রূপ বহাল থাকে না। রূপটা ঠিকঠাক রাখতে হলে মাঝেমধ্যে রংয়ের আচড় আর সাজসজ্জারও দরকার হয়। কিন্তু তার জন্য তো টাকা লাগে। নিবারণ টাকা কোথায় পাবে? পাড়া-পড়শিদের কাছে চাইবে? টাকার অভাবে তারা ভালো একটা ধুতি দিয়ে পাছাটা ঠিকমতো ঢাকতে পারে না, মায়ের মূর্তি সংস্কারের টাকা কোত্থেকে দেবে! বছরে একবার ইউনিয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন মন্দিরের নামে টাকাপয়সা কিছু বরাদ্দ হয় বটে। কিন্তু সেই টাকা কি আর মোল্লেপাড়ার এই অখ্যাত মন্দির পর্যন্ত পৌঁছায়?
নতুন প্রতিমা স্থাপনের চিন্তাটা নিবারণের মাথায় আসে যেদিন মণ্ডলবাড়ি বন্ধন করে এলো সেদিন। আজ মণ্ডলবাড়িতে ঢিল পড়ছে, কাল যে তার বাড়িতে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কী? তার মনে প্রশ্ন জাগে, মণ্ডলবাড়িতে ঢিল পড়ার নেপথ্য কারণ মা কালীর অসন্তোষ নয় তো? হতেও তো পারে। বছরের পর বছর মন্দিরটা অরক্ষিত হালে পড়ে আছে। মায়ের সেবাযতœ না করলে মা তার ভক্তদের রক্ষা করবে কেন? জায়গা না হয় দিয়েছিল নিবারণের দাদা, কিন্তু প্রতিমা গড়ার খরচ তো দিয়েছিল নরেন মণ্ডল। মণ্ডলবাড়ির দুই পুরুষ স্বর্গে গেল, তৃতীয় পুরুষও যাওয়ার পথে, অথচ মায়ের একটা নতুন মূর্তি স্থাপনের কথা কেউ ভাবল না – রুষ্ট হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ তো আছে।
নতুন প্রতিমা গড়ার ব্যাপারে মুন্সিগঞ্জের এক কারিগরের সঙ্গে কথা বলল নিবারণ। টাকা যা চাইল কারিগর তাতে চিন্তায় পড়ে গেল সে। এত টাকা সে পাবে কোথায়! মেয়ের বিয়ের জন্য জমা টাকা কিছু আছে। টাকাগুলো খরচ করে ফেললে পরে কী উপায় হবে তার? ধারও তো পাবে না কারো কাছে। এই পোড়া গাঁয়ে কাউকে কেউ ১০০ টাকার বেশি ধারও তো দেয় না। দিলে এক আলাউদ্দিন দেয়। কিন্তু চক্রবৃদ্ধি সুদে। এই ভয়ে তার কাছ থেকে সহজে কেউ ধার করতে যায় না। ধারের টাকা শোধ করতে না পারলে কোনোদিন সে লেঠেল লাগিয়ে বসতভিটাটা দখল করে নেবে তার কি ঠিক আছে!
কিন্তু দেবীর মূর্তিও গড়া দরকার। মেয়ের বিয়ের চেয়েও কাজটা জরুরি। মাকে খুশি করা গেলে টাকাপয়সার কি সমস্যা হবে? দশ দেবীর এক দেবী মা কালী, ভক্তের বিপদে কি পাশে দাঁড়াবে না? দেবীর সুদৃষ্টি থাকলে, এমনও তো হতে পারে, যৌতুক ছাড়াই মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে।
মাসখানেক ভেবে কারিগরের সঙ্গে কথা পাকাপাকি করে ফেলল নিবারণ। কারিগর বলল, সময় লাগবে। পুরোপুরি কাজ শেষ হতে চৈত্র মাস গড়াবে।
চৈত্র সংক্রান্তিতে নতুন প্রতিমা স্থাপনের দিন ধার্য করল নিবারণ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবার পরামর্শ চাইল। দেবীর অধিষ্ঠান উপলক্ষে একটা পূজা-উৎসবের আয়োজন তো করতে হয়। কেউ অমত করল না। খুশিমনে পরিবার প্রতি দশ-বিশ টাকা করে চাঁদাও দিল।
চৈত্র মাসের মাঝামাঝি নিবারণ চলে গেল ঈশ্বরীপুর। যশোরেশ্বরী মন্দিরের প্রধান সেবাইত নিত্যানন্দগিরি গোস্বামীর সঙ্গে দেখা করে তাকে গরানপুরে আমন্ত্রণ জানাল। কিন্তু গোস্বামীর শরীর ভালো নয়, অত দূরের পথ পাড়ি দেওয়াটা তার পক্ষে কষ্টকর। গোস্বামী বলল, ‘আমার শরীলডা তো সেরাম ভালো না, যাতি পারবো বলে মনে হয় না। তার চাইতে বরং মন্দিরির একজন ঠাকুর পাঠিয়ে দ্যাবোখন। সে-ই সব ঠিকঠাক মতো করে দে আসপেনে।’
নিবারণ ফিরে এলো। যশোরেশ্বরী মন্দিরের ঠাকুর আসছে গরানপুরে, চারদিকে একটা হৈরৈ পড়ে গেল। পাড়ার সবাইকে নিয়ে বৈঠক করল নিবারণ। সবার সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো পূজা চলবে চার দিন – শনিবার থেকে মঙ্গলবার। চণ্ডীপাঠ ও ভগবত গীতাপাঠ হবে। শনিবার রাতে নতুন মূর্তিটা মন্দিরে বসানো হলে পরে রবিবার ভোরে পুরনো মূর্তিটা চুনকুড়ির জলে বিসর্জন দেওয়া হবে। মন্দিরের মাঠে একটা অস্থায়ী দোকান বসাতে ফেলুকে অনুরোধ করল সবাই। ফেলু রাজি হয়ে গেল। খবরটা চলে গেল হরিনগরের রাখাল ময়রার কাছে। সেও কি আর বসে থাকে? এমন একটা উৎসবে তার গরম গরম জিলাপি না হলে কি উৎসবটা জমবে? তাদের দেখাদেখি গরানপুর-হরিনগরের আরো কজন দোকানিও দোকান বসাতে রাজি হয়ে গেল।
মোল্লেপাড়ার আনন্দের ঢেউ সারা গরানপুরে আছড়ে পড়ল। নিবারণকে ডেকে নগদ এক হাজার টাকা দিয়ে চারুবালা বলল, ‘মায়ের সেবায় খরচ করবা টাকাডা। থাকলি আরো দেতাম। ঠাকুররে বুলো তোমার দাদার জন্যি যেন এট্টু প্রার্থনা করে।’
ম-লবাড়িতে তো তখন শোকের কালো মেঘ জমে আছে। ওই মেঘ আর সরছেই না। দীপিকাও চলে গেলে বাড়িটা একেবারে শ্মশানের পরিণতি পেত। নমিতাকে নিয়ে হালিম হঠাৎ কেন এভাবে চলে গেল কেউ কিছু বুঝতে পারল না। নমিতাও কাউকে কিছু বলল না, কিছু বুঝতেও দিল না। শুধু বলেছে অফিসে জরুরি কাজ রেখে এসেছে হালিম, আজকের মধ্যে না ফিরলে খুব ঝামেলায় পড়ে যাবে। চারুবালা বলল, ‘তাই বলে এমন হুট কুরে?’ নমিতা কিছু বলল না, মাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদল শুধু। সেই কান্না কতটা বুকভাঙা, চারুবালার বুঝতে অসুবিধা হয় না। দুই ঠোঁটে কাঁপুনি তুলে, দুই চোখে জল ভরিয়ে বলল, ‘নিজির কপাল নিজি খাইচিস, কার কী করার আচে। আমি মরার পর পাল্লি এট্টাবার আইসে দিকে যাস।’
দিদার তো তখনো ঘুমে। ডেকে তুলে একবার তাকে বলার প্রয়োজনও মনে করল না হালিম। স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ হলো দিদারের। ভায়রা তার এতটা অসহিষ্ণু জানলে পরে কে বিতর্ক করত তার সঙ্গে! দীপিকাকে বলল, ‘আমাগো আর থাইকে কী লাভ, হাঁটো বাড়ি যাই।’ দীপিকা রাজি হলো না। বাবার খবরবার্তা এখনো কিছু পাওয়া যায়নি, এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে লোকে কী ভাববে। তা ছাড়া এত বছর পর সে বাবাবাড়ি এসেছে, তার ছেলেমেয়েরাও জন্মের পর নানাবাড়ি দেখেনি – একটা মাস বেড়িয়ে না গেলে কি মনটা জুড়াবে? সামনে পরব, গেলে না হয় পরবটা শেষ করেই যাবে।
কিন্তু বাবাবাড়িতে দীপিকা বেকায়দায় পড়ল নামাজ পড়া নিয়ে। নামাজের জন্য পাক-পবিত্র জায়গার দরকার, হিন্দুবাড়ি তো কখনো পাক হয় না। লেপেমুছে বাঁশঘরের একটা জায়গা পাক না হয় করে নিল। কিন্তু ঘরের পশ্চিমে যে ঠাকুরঘর! ওটা সামনে রেখে নামাজ পড়লে তো নামাজটা সহি হবে না। উল্টো বরং গুনাহ হবে। জেনেশুনে সে গুনাহ করবে কেন? তা ছাড়া ঘরে তার মা আছে, ভাইবোন আছে। তাকে নামাজ পড়তে দেখলে নিশ্চয়ই তারা মনে দুঃখ পাবে। দুঃখ তো তাদের কম দেয়নি সে, নতুন করে আর কোনো দুঃখ দেবে না। তাই নামাজটা পড়ে গোপনে, মাজেদ গাইনের বাড়ি গিয়ে। মাজেদ গাইন দু-ঈদে দু-বার ঈদগাহে গিয়ে দুই করে চার রাকাত নামাজ পড়া ছাড়া সারা বছর আর নামাজ-কলমার ধার ধারে না। তার বউ পশ্চিম দিকে ফিরে সেজদা দেওয়া তো দূরে থাক, পা পিছলে বেমওকা কোনোদিন একটা আছাড়ও খায় না। তার বাপ দাদা এবং দাদার দাদা মুসলমান, সেই হিসেবে সেও মুসলমান। নামাজের আর দরকার কী। তবু দীপিকার জন্য কোত্থেকে একটা নামাজের পাটি জোগাড় করে দিয়েছে।
কিন্তু রোজ পাঁচ বেলা অন্যের বাড়ি নামাজ পড়তে যেতে বিরক্তি লাগে দীপিকার। আবার না গিয়ে উপায়ও নেই। যত যাই হোক নামাজ তো সে ক্বাজা করতে পারে না। দিদারের পক্ষ থেকে নামাজ-রোজার ব্যাপারে অত জোরজবরদস্তি নেই। সেও ঠিকমতো নামাজ পড়ে না। ধর্মকর্ম বা আহমদিয়া মতবাদ বিষয়ে বউয়ের সঙ্গে আলাপ করতে যায় না। কিন্তু তার মা একেবারে নাছোড়। পাক্কা নামাজি। নিয়ম করে সকালে কোরান তেলাওয়াত করে। শ্বশুর বাড়িতে ওঠার প্রথম মাসেই দীপিকাকে সাফ বলে দিয়েছে তার শাশুড়ি, ‘এ বাড়ি থাকতি হলি বাপু ঠিকমতো নামাজ পড়তি হবে। ছেলে আমার হিন্দুগা মাইয়ে ঘরে আইনেচে, আমি কিচ্ছু বলিনি। কোনোদিন বলতিও চাইনে। তাই বুলে নিজির ইচ্ছেমতো কিন্তু চলা যাবে না।’
খেয়ালখুশিমতো চলেনি দীপিকা, সবসময় শাশুড়ির মন জুগিয়েই চলেছে। অন্তত ধর্মকর্মের ব্যাপারে তার কথার বরখেলাপ কোনোদিন করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। কেন করবে? কলমা পড়ে সে মুসলমান হয়েছে, নামাজ তো তাকে পড়তেই হবে। নামাজ না পড়লে মুসলমান হয়েছে কিসের জন্য? একান্ত কোনো সমস্যা না থাকলে নিয়মিতই সে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে। ফজরের নামাজের পর শাশুড়ির পাশে বসে মাথায় ঘোমটা দিয়ে কোরান তেলাওয়াত শোনে। সে তো আর পড়তে পারে না। শাশুড়ি তাকে শেখানোর চেষ্টা করেছিল, সংসারের ঝক্কি-ঝামেলায় শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। শাশুড়ির কাছ থেকে শুধু নামাজের সূরাগুলো ভালো করে শিখে নিয়েছে। তাও সাকুল্যে আটটা। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রতি অক্তে ওগুলো দিয়েই চালিয়ে যায়।
বাবাবাড়ি আসার পর নামাজের প্রতি আরো বেশি জোর দিয়েছে। তার বিশ্বাস বাবা একদিন ফিরে আসবেই। প্রতি অক্ত নামাজ পড়ে মোনাজাত ধরে আল্লার দরবারে প্রার্থনা করে, ‘আল্লা তুমি আমার বাবারে ফিরিয়ে দ্যাও। তার কোনো ক্ষতি তুমি কুরো না। তোমার হুকুম ছাড়া একটা ধুলোও ওড়ে না। বাবা আমার কোনে আচে কেরাম আচে তুমি সবই জানো, সবই দিকতেচ। সবই তোমার কুদরত। রহম করো মাবুদ, সহি-সালামতে আমার বাবারে তুমি বাড়ি ফিরিয়ে নে আইসো।’
মোনাজাতে বাবার কথা বলতে বলতে কোনো কোনোদিন কাঁদেও। একবার শুরু হলে কান্নাটা আর থামতে চায় না। কখনো কখনো রাও ধরে কাঁদে। মাজেদের বউ অবাক হয়। কার মেয়ে কী হয়ে গেল! সবই খোদার ইশারা। তা নইলে কেউ কোনোদিন কল্পনা করেছিল ম-লবাড়ির মেয়ে মুসলমান হবে!
সেদিন শেষবিকেলে মুন্সিগঞ্জ থেকে প্রতিমা নিয়ে মুকনোলির প্রান্তরের পথ ধরে রওনা হলো মোল্লেপাড়ার হিন্দুরা। একটা বাঁশের মাচায় মূর্তিটা বসিয়ে চার কোণায় চারজন মাচাটা কাঁধে নিয়েছে। পেছনে গরানপুর-হরিনগরের সারে সারে মানুষ। নারী-পুরুষ শিশু-কিশোর জোয়ান-বুড়ো সবাই। উৎসুক মুসলমানের সংখ্যাও কম নয়। ছেলেরা নাচছে, ধুলো ওড়াচ্ছে, আনন্দে তালি বাজাচ্ছে। নারীরা উলুধ্বনি দিচ্ছে, পুরুষরা মন্ত্র জপছে। ঢাক-ঢোলের শব্দে সারা প্রান্তর মুখর। যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরের ঠাকুর দুপুরেই মুন্সিগঞ্জ পৌঁছেছে, প্রতিমা নিয়ে সবার সঙ্গে আসছে।
মণ্ডলবাড়ির দক্ষিণের ভিটায় দাঁড়িয়ে দীপিকা দেখতে পায় মুকনোলির প্রান্তরে মানুষের বিশাল মিছিল। তার মনটা কেমন আনচান করে উঠল। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল খুব। চৈত্রসংক্রান্তির এমন দিনে তখন মোল্লেপাড়ার ঘরে ঘরে উৎসব। স্নান, দান, ব্রত, উপবাস – কত রকমের শাস্ত্রাচার। ঘরে-বাইরে কত রকমের খাবার-দাবার। শেষবিকেলে মুকনোলির প্রান্তরের পথ ধরে গাজন উৎসবের মিছিল আসত ঢাক-ঢোল বাজাতে বাজাতে। হরিনগর শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়ে গরানপুর শিবতলায় এসে থামত। একজনকে সাজানো হতো শিব, অন্যজনকে গৌরী। শোভাযাত্রার সামনে শিব-গৌরী কত না ভঙ্গিমায় নাচত। নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত ও দৈত্যদানো সেজে অন্যরা নেচে চলত তাদের পেছনে। একবার তাকেও গৌরী সাজানো হয়েছিল। তার বয়স তখন বারো-তেরো হবে বুঝি। কী যে হয়েছিল চেহারাটা তখন! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সত্যিকারের দেবীর মতো লাগছিল। এখন তার ইচ্ছে করছে আগের মতো আবার এই শোভাযাত্রায় যোগ দিতে।
গরানপুর মসজিদে আজান পড়ল। মাথায় ঘোমটা টেনে দীপিকা মাজেদ গাইনের বাড়ির পথ ধরল। কলতলায় গিয়ে অজু করে পাটিটা বিছিয়ে নামাজে দাঁড়াল। ঢাক-ঢোলের শব্দে নামাজে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারছে না, সূরার আয়াতগুলো বারবার ভুল করে ফেলছে।
প্রথম রাকাত শেষ করে দ্বিতীয় রাকাতের সূরা পড়ছে দীপিকা, দরজার ফাঁকে হঠাৎ তার চোখ গেল উঠোনের পশ্চিমে। মা কালীর প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রাটা চুনকুড়ির আড়ায় উঠছে। দেবী রক্ষাকালীর লকলকে জিবটা নজরে এলো তার। দ্রুত সে চোখ ফিরিয়ে নিলো। সূরাটা শেষ করে সে তকবির বলে রুকুতে গেল, আর তখনই কৈশোরের স্মৃতিটা মাথায় পাক খেয়ে গেল। নিজেরই অজান্তে হাত দুটো জোড় করে প্রণামের ভঙ্গিতে দাঁড়াল। আশ্বিনে অমাবস্যা তিথিতে দেয়ালি উৎসবের সময় মোল্লেপাড়া মা রক্ষাকালী মন্দিরে গিয়ে ঠাকুরের মুখে যে মন্ত্রটা সে বহুবার শুনেছিল, এত বছর ধরে সুপ্ত মন্ত্রটা জেগে উঠল হঠাৎ। বিড়বিড় করে সে উচ্চারণ করতে লাগল – ওঁ জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী, দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্ত তে।
উঠোনে মাজেদের বউয়ের গলার আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে দীপিকা। দরজার ফাঁকে মাজেদের বউ দেখে, জিবে কামড় দিয়ে, অনেকটা কালীদেবীর মতো, দীপিকা ঠায় দাঁড়িয়ে। তার চোখ দুটি বিস্ফারিত। মাজেদের বউ বিস্ময়ে মাথায় হাত দিয়ে চোখ দুটি বড় বড় করে জিবে কামড় দিয়ে থমকে দাঁড়ায়। দীপিকার চোখে তাকেও তখন অনেকটা কালীদেবীর মতো দেখায়।