কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
নয়.
বাবার নিখোঁজ সংবাদ শুনে বিয়ের পর প্রথমবারের মতো বাবার বাড়ি এলো নমিতা। বাড়ি আসতে বাবার কড়া বারণ ছিল। বেঁচে থাকতে কোনোদিন তিনি অবাধ্য মেয়ের মুখ দেখতে চান না। চারুবালাও মাতৃবন্ধনের রশিটাকে ছিঁড়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মায়ের মন, নাড়িছেঁড়া ধন যত যা-ই করুক, তার জন্য তো কাঁদবেই। গোপেশকে সে যশোর পাঠাতে চেয়েছিল, কিন্তু মাস্টার বউকে হুঁশিয়ার করে দিলেন, ‘গোপেশকে তুমি রতনপুর পাঠিয়ে দেচ আমি কিচু বলিনি। বলতিও চাইনে। কিন্তু সাবধান, কখনো তারে যশোর পাঠাবা না। নমিতা নামে আমার কোনো মাইয়ে নি। তার জন্যি আজ আমার সংসারে এত অশান্তি।’
বাড়ি আসতে না পারলে কী হবে, বাড়ির সব খবরই রাখত নমিতা। মহব্বত সাজুনি বছরে দুবার যশোরে মধু বেচতে যায়। যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহের ওদিকে সুন্দরবনের মধুর মেলা কদর। দামও পায় বেশি। যতবারই যায় নমিতার বাসায় একবার ঢুঁ মেরে আসে। নমিতাও আপ্যায়নে কমতি রাখে না। বাবার দেশের মানুষটাকে দেখলে তার মনে কিছুটা হলেও শান্তি মেলে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কথা জানতে চায়। মহব্বতও কিছু বাদ রাখে না, মণ্ডলবাড়ির ভালো-মন্দ সব খবর বলে। একদিন বলল, ‘আমার সাথে তুই বাড়ি চল নমি। বাবুরে আমি বুঝিয়ে বলব। বাবা কি মাইয়ের উপর রাগ করে থাকতি পারে? যতই বারণ করুক, তোরে দেখলি পরে ঠিকই বুকে টাইনে ন্যাবে দেখিস।’
অন্তত বাবার পা দুটো ধরে ক্ষমা চাইতে নমিতা আসতে চেয়েছিল, কিন্তু হালিম তাকে আসতে দেয়নি। কেন দেবে? ঈমান-আক্বিদায় সে এখন পাক্কা মুসলমান, বউকে সে হিন্দুবাড়িতে যেতে দেয় কী করে! সে তো এখন হালিম মাস্টার নয়, হালিম সাহেব। মাস্টার ও সাহেবের মধ্যে ফারাক বিস্তর। যখন সে মাস্টার ছিল ধর্মীয় ব্যাপারে এত কট্টর ছিল না। মন চাইলে কখনো মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজটা পড়ত, পাঞ্জেগানা তো ভুলেও না। বিয়ের পরও ধর্মকর্ম নিয়ে অত মাথা ঘামাত না। বিয়ের বছর দেড়েক পর, ছেলে সাইফুরের বয়স যখন পাঁচ মাস, হঠাৎ সে নোয়াখালী বদলি হলো। তবে বেশিদিন থাকতে হলো না সেখানে, ওপরের মহলে তদবির করে ঘুষটুষ দিয়ে এক বছরের মধ্যে ফরিদপুর বদলি হলো। ফরিদপুরে দু-বছর কাটিয়ে আবার যশোরে।
নোয়াখালী থাকতেই সে ধর্মকর্মে ঝুঁকে পড়ে। বদলির তিন মাসের মাথায় কঠিন জ্বরে পড়ে টানা দশ দিন বিছানায় পড়ে থাকল। তারপর জ্বর নামল, কিন্তু তার পাকস্থলীটা দুর্বল করে দিয়ে গেল। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করতে পারে না, যা-ই খায় বুকের কাছে আটকে থাকে। বুকে সারাক্ষণ জ্বালাপোড়া। ডাক্তার বলল অম্লরোগ। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী এক মাস ওষুধ খেল, তবু রোগ সারল না। ডাক্তার বলল, খেয়ে যান। সে খেয়ে গেল। টানা দুই মাস ওষুদ খাওয়ার পরও অবস্থার উন্নতি হলো না। তার মায়ের আশঙ্কা, ছেলের অনিষ্টের জন্য দুশমন তাবিজ করেছে। তার সন্দেহ বেয়াই-বেয়াইনকে। মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে তারা ছেলেকে বাণ মেরেছে। গুনিনের কাছ থেকে ডাবপড়া এনে ছেলেকে খাওয়াল, তাবিজ এনে গলায় বাঁধল, তবু কাজের কাজ কিছু হলো না, দিন দিন পেটের ব্যারাম বরং আরো বাড়তে লাগল।
অফিসের এক সহকর্মীর পরামর্শে মাইজদী শহরের এক হোমিও ডাক্তারের কাছে গেল হালিম। ডাক্তার স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম, পাশাপাশি হোমিপ্যাথির ডাক্তার। শহরে তার দোকান আছে―শেফা হোমিও হল। আসরের নামাজের পর থেকে এশার আজান পর্যন্ত রোগী দেখে। ডাক্তার বলল, ‘রোগ-বিমার সব আল্লার হুকুম ভাই। আগে আল্লারে খুশি করেন, দেইখবেন রোগ-বিমার বেক বালা অই গেছে। পাশাপাশি আমার দাওয়াই তো আছেই।’
ডাক্তারের কথামতো হালিম হোমিওপ্যাথির ডোজ খাওয়ার পাশাপাশি আল্লাকে খুশি করতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ধরল। ডাক্তার আবার বরিশালের পীরজাদা পীরের খাস মুরিদ। মেঘনা পাড়ি দিয়ে তিন মাস পরপর সে বরিশাল ছোটে। হুজুরকে বেশি দিন না দেখলে তার মনটা ছটপট করে। এ ছাড়া মাসে তিন দিন এবং বছরে চল্লিশ দিন তাবলিগ জামাতের সঙ্গে মসজিদে মসজিদে ঘুরে দ্বীনের দাওয়াত প্রচার করে।
পীরজাদা পীরের কোনো কেরামতি কিনা কে জানে, তাকে কোনোদিন না দেখেই, কেবল ডাক্তারের কাছে তার নানা কেরামতির কথা শুনে তার ভক্ত হয়ে গেল হালিম। ডাক্তারের সঙ্গে একবার বরিশাল গিয়ে পীরের সঙ্গে মোলাকাতও করে এলো। ফিরে এসে কাঁথা-বালিশ নিয়ে শহরের বাইরে এক মসজিদে তিন দিনের জন্য তাবলিগে চলে গেল। ওই তিনটা দিনই তাকে বদলে দিল। অথবা পীরজাদা পীরের কেরামতিও হতে পারে, সে আর দাঁড়িতে ক্ষুর ছোঁয়াল না। ডাক্তারের হোমিওপ্যাথির ডোজ খেয়ে পেটের ব্যারাম অনেকটা কমেছে, ডাক্তার বলেছে দাড়ি রাখতে, সে না রেখে পারে? অল্পদিনের মধ্যে তার কুচকালো দাঁড়ি লম্বা হতে হতে বুক পর্যন্ত নামল।
ধর্মকর্মে উদাসীন স্বামীর হঠাৎ এমন ধর্মভীরু হয়ে যাওয়ার হেতু খুঁজে পায় না নমিতা। তার অবাক লাগে। কলমা পড়ে সে মুসলমান হলেও নামাজ-রোজার ধার ধারত না। বিয়ের পর শাশুড়ি তাকে নামাজ পড়ার কায়দা-কানুন শিখিয়েছে। তার ইচ্ছে ছিল না, শাশুড়ির চাপে শিখতে বাধ্য হয়েছে। ঘরের বউ নামাজ না পড়লে ঘরে কি আল্লার রহমত আসবে? শাশুড়ির চাপে পড়ে ঘরে আল্লার রহমত নামিয়ে আনতে বেশ কদিন নামাজ পড়েছেও। রমজান মাসে রোজাও রেখেছে, কোনো কোনোদিন তারাবিও পড়েছে। সাইফুরের জন্মের আগে, সে যখন ছয় মাসের পোয়াতি, সেই যে নামাজ-রোজা ছাড়ল, পরে আর ধরল না।
একদিন হালিম তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি নামাজ ছাইড়ে দিলে কেন নওশেবা?’
নমিতা বলল, ‘ছাড়ব কেন? সময় পাইনে বইলে পড়া হয় না।’
: না না, এডা কোনো অজুহাত না। এভাবে চলতি পারে না। পাঁচ অক্ত নামাজ তোমারে পড়তিই হবে, এক অক্তও ক্বাজা করা যাবে না।
স্বামীর কথা তেমন আমলে নিল না নমিতা। মাঝেমধ্যে নামাজের কথা জিজ্ঞেস করলে হাসতে হাসতে উড়িয়ে দিত, বেশি জোরাজুরি করলে মিথ্যা বলে এড়িয়ে যেত। কিন্তু সমস্যা বাঁধল ফজরের নামাজ নিয়ে। এত ভোরে ঘুম থেকে ওঠা তার অভ্যাসে নেই। এর চেয়ে বরং সারা রাত জেগে থাকাটা সহজ।
ফরিদপুরে বদলি হয়ে আসার পর হালিম ছুটি নিয়ে ফের তাবলিগ জামাতে চলে গেল। গোয়ালন্দের এক মসজিদে সাত দিন কাটিয়ে ফিরল আগের চেয়ে দ্বিগুণ ধার্মিক হয়ে। আগে তো ফজরের নামাজটা বাসায় পড়ত, এবার মসজিদে যেতে শুরু করল, এমনকি শেষরাতে উঠে নফল নামাজও পড়া ধরল।
একদিন ভোরে মসজিদ থেকে ফিরে নমিতাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, ‘কই, তুমি তো ফজরের নামাজ পড়লে না!’
: পড়িচি তো! ঘুমজড়ানো চোখে বলল নমিতা।
: পড়েচ! নাপাক শরীরে তুমি নামাজ পড়েচ?
আচমকা বউয়ের গালে কষে একটা চড় কষিয়ে দিল হালিম। নমিতা গালে হাত দিয়ে খাটের একপাশে সরে বসে অবাক চোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকাল। কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই হালিম তর্জনী উঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘খবরদার, ভবিষ্যতে এমন মিথ্যা কথা আমি বরদাস্ত করব না।’
নীরবে চড়টা হজম করে নিতে হলো নমিতাকে। এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। কার কাছে বিচার দেবে সে? কে আছে তার? বিচার চাইলেও তো পেত না। নামাজ পড়েনি বলে স্বামী মেরেছে উচিত কাজটি করেছে, বিচার আবার কী?
হালিমের এমন আচরণে সে হোঁচট খায়। একটা ঠুনকো ব্যাপার নিয়ে কিনা তার গায়ে হাত তুলল হালিম! স্বামীর প্রতি তার আস্থার খুঁটিটা নড়বড়ে হয়ে যায়।
সেদিনের পর থেকে পৌষের বেজায় হিমভোরেও তাকে গোসল করতে হয়, ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নামাজ পড়তে হয়। দেখে শুকরিয়া আদায় করে হালিম। বউকে কাছে টেনে আদর করতে করতে নামাজের গুরুত্ব বোঝায়, ‘নামাজ হইল গিয়ে বেহেশতের চাবি। আসসালাতু মেফতাহুল জান্নাহ। চাবি ছাড়া কেউ তালা খুলতি পারে বলো? ধরো, কালহাশরে আল্লাপাক তোমার সব গুনাখাতা মাফ কইরে তোমারে বেহেশতে যাওয়ার হুকুম দিল, অথচ তোমার হাতে বেহেশতের চাবি নেই, তুমি ঢোকবা কেরাম করে? চাবির অভাবে তুমি দোযখের আগুনে জ্বলবা। ইসলামের পাঁচ খুঁটির মধ্যি নামাজ দ্বিতীয়। এক অক্ত নামাজ ক্বাজা করলি দুই কোটি আটাশি লক্ষ বছর জাহান্নামের আগুনে জ্বলতি হবে। বেনামাজির এস্থান জাহান্নামে সিজ্জিন। বড় ভয়ানক দোযখ।’
দু-হাতে চোখ ঢেকে নমিতা ফোঁপায়। তার কান্না দেখে আবারো শুকরিয়া আদায় করে হালিম। নিশ্চয়ই পরকালের ভয়ে কাঁদছে তার বউ। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘বান্দার চোখের পানি আল্লার কাছে অতি পবিত্র। চোখের পানিতে আল্লার গজবের আগুন পানি হয়।’
নমিতা মাথা তুলে অবাকচোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকায়। মুখে কিছু বলে না। বলতে পারে না। তার কণ্ঠনালি যেন কেউ চেপে ধরে রাখে। হালিমের মুখে মুচকি হাসি। হাসিটা বিদঘুটে লাগে নমিতার। ভাবে, এমন নির্বোধ তো ছিল না তার স্বামী!
রোজ ভোরে গোসল করতে গিয়ে কদিন পর সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হলো নমিতা। সংক্রমিত হলো দুধের শিশুটাতেও। মায়ের চেয়ে শিশুর অবস্থা খারাপ। সর্দি জমে নাকের ফুটো বন্ধ হওয়ার জোগাড়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ডাক্তার বলল, গোসল করা তো যাবেই না, ঠা-া পানিও খাওয়া বারণ। ফলে ইচ্ছে থাকলেও ভোরে আর গোসল করতে পারে না নমিতা। হালিম মুখে কিছু না বললেও যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ মুখ ভার করে থাকে, বউকে এড়িয়ে চলে। নমিতা বুঝতে পারে তার মনোভাব, কিন্তু কিছু বলে না। বলে কী লাভ? ইহকালের চেয়ে এখন তার কাছে পরকাল বড়। অবিনশ্বর পরকালের সুখ-শান্তির জন্য নশ্বর জীবনের সবকিছু ত্যাগ করতেও তার আপত্তি নেই। নমিতা তো ঘরের বউ, কবর থেকে তার বাপ উঠেও যদি বলে, ‘দুই দিনের জীবন, পরকালের কথা ভেবে জীবনের সুখ-শান্তি নষ্ট করছ কেন?’ – উল্টো সে বাপের সঙ্গে তর্ক-বাহাস শুরু করে দেবে। প্রয়োজনে বাপকে কাফের-বেদ্বীন আখ্যা দিয়ে হেনস্তা করে ছাড়বে।
ফরিদপুর থেকে ফের যশোরে বদলি হয়ে আসার পর একদিন মহব্বত সাজুনি খবর নিয়ে এলো, দশ দিন ধরে কেশব মাস্টার শয্যাশায়ী। পায়খানা-পেচ্ছাব বন্ধ ছিল দুদিন, মুন্সিগঞ্জ থেকে ডাক্তার গিয়ে ঠিক করেছে। শরীরের অবস্থা ভালো না, কখন কী হয়ে যায় বলা যায় না।
বাবাকে একটিবার দেখে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল নমিতা। কেঁদেকেটে হালিমকে বলল, ‘এট্টাবার আমারে যাতি দ্যাও। দরকার হলি সকালে গে বিকেলে ফিরে আস্পো।’
মেয়েলোকের কান্নায় কি হালিমের মন গলে! যতই কাঁদুক, বউকে সে হিন্দুবাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলে তার ঈমান থাকবে?
নমিতা বলল, ‘হিন্দু হলিও তিনি আমার বাবা, তোমার শ্বশুর।’
: প্রশ্নই আসে না, খেপে উঠল হালিম। কোনো কাফের-বেদ্বীন আমার শ্বশুর হতি পারে না।
: কী বুলতোছ তুমি! তোমার মাথা ঠিক আচে হালিম?
: চুপ কর কমবখ্ত মাইয়েলোক। স্বীমার নাম মুখি আনতি লজ্জা করে না! আমার মাথা বিলকুল ঠিক। কোনো অবস্থাতেই তুই ওই বাড়িতি যাতি পারবি না। তুই আমার নিকে করা বউ। আমার হুকুম মানা তোর ফরজ।
বিস্ময়ে নমিতা মুখে হাত দেয়, ‘তাই বলে আমি অসুস্থ বাবাকে দেক্তি যাব না?’
হালিম গলা নামায়, ‘কেন যাবা না, নিশ্চয়ই যাবা। তার আগে তুমি তোমার বাবা মা ভাইবোন সবাইকে ইসলামের দাওয়াত দ্যাও। শেরেকি ধর্ম ছাইড়ে তারা পবিত্র ইসলাম কবুল করুক, তারপর তুমি ওই বাড়িতে যাবা। তোমার সঙ্গে আমিও যাব। তা না হলি ওই বাড়ি তোমার জন্যি হারাম।’
নমিতার মুখ হাঁ হয়ে যায়, এক জনমের বিস্ময় তাকে আঁকড়ে ধরে। কথাগুলো তার বিশ্বাস হয় না। মনে হয় না এসব কথা তার স্বামীর, ভালোবেসে একদিন যাকে সব কিছুর ওপরে স্থান দিয়েছিল। যেন অন্য কারো, যাকে সে চেনে না, যার কথা কোনোদিন শোনেনি। অচেনা মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে নিজেকে প্রশ্ন করে, তবে কি আমি ভুল মানুষের পাল্লায় পড়ে ভুল পথে হাঁটছি?
নিদারুণ হতাশা গ্রাস করে তাকে, মনটা সারাক্ষণ বিষিয়ে থাকে। কিন্তু মনের কথা কোনোভাবে স্বামীকে বুঝতে দেয় না, স্বামী যেভাবে চায় ঠিক সেভাবেই চলে। মাতা-পিতার পদতলে তো বটেই, স্বামীর পদতলেও স্ত্রীর বেহেশ্ত – হাদিসের ফরমান। এই ফরমানের বিরুদ্ধে সে যায় কী করে। সুতরাং স্বামীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাকে এবাদত-বন্দেগি চালিয়ে যেতে হয়।
শ্বশুরের নিখোঁজ সংবাদ শুনেও হয়ত নমিতাকে গরানপুর আসতে দিত না হালিম, যদি না শ্বশুরের মুসলমান হওয়ার সংবাদটা দিত মহব্বত সাজুনি। শুনে তো মনে তার আনন্দ ধরে না। আল্লার কাছে বারবার শুকরিয়া আদায় করতে থাকে। আল্লার দরবারে সে কত ফরিয়াদ করেছে, আল্লা তুমি আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে সিরাতাল মুস্তাকিমে এনে দাও। আল্লা তার দোয়া কবুল করেছে। বউকে জড়িয়ে ধরে জোর বিশ্বাসে বলল, ‘সুবহানাল্লাহ! বাবার কিচ্ছু হবে না, আল্লা তারে হেদায়েত নসিব করেছেন, তিনিই তারে হেফাজত করবেন।’
ওদিকে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে দীপিকা এসেছে আরো দুদিন আগে। সঙ্গে দিদারও। চাইলে দীপিকা বহু আগেই আসতে পারত, আসেনি বাবার ভয়ে। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সে বাবার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে, মেয়ে হয়ে বাবার সম্মানহানি করেছে – কোন মুখে সে বাবার সামনে দাঁড়াত! দিদার তাকে কতদিন বলেছে, ‘চলো, আমরা বাবার পা ধুরে পুড়ে থাকপো। দ্যাখ্পা তিনি মাফ না কুরে পারবেন না।’ দীপিকা বলেছে, ‘থাক, তাতে দুঃখ আরো বাড়বে তার। নিজিত্তে কোনোদিন যাতি বললি যাব।’
বহুদিন পর দুই মেয়েকে কাছে পেয়ে বুকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখে যত জল ছিল, বুকে যত দীর্ঘশ্বাস ছিল সব ছেড়ে দিল চারুবালা। তার কান্নায় মণ্ডলবাড়ির গাছবিরিক্ষিরাও কাঁদল। কেঁদেকেটে হয়রান হয়ে সেই যে তার কামরায় চিলা নিল, মেয়েজামাইরা শ্বশুরবাড়ি তিন দিন থাকল, অথচ একবারও শাশুড়ির ছায়াটি পর্যন্ত দেখল না। দেখা সে দেয় কেমন করে? মেয়েরা মুসলমান হলেও তাদের জন্ম হিন্দুর ঘরে। তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী হিন্দু, তাদের শরীরে হিন্দুর রক্ত। যত যা-ই হোক পেটের সন্তানের মুখ সে না দেখে পারে না। কিন্তু মেয়েজামাইরা তো গরুখোর জাতমুসলমান। মুসলমান হওয়ার কারণে তিরিশ বছর একসঙ্গে ঘর করা শোয়ামির মুখ দেখা পর্যন্ত সে বন্ধ করে দিয়েছিল, মেয়েজামাইদের মুখ সে দেখে কেমন করে? তা ছাড়া এমনিতেই সে ভয়ে আছে। মণ্ডলবাড়িতে যা কিছু ঘটেছে, যা কিছু ঘটছে সবই অনন্ত মণ্ডলের অতৃপ্ত আত্মার কাণ্ড। গভীর রাতে তার প্রেতাত্মা ছেলের ওপর ভর করে ছেলেকে পথ ভুলিয়ে জঙ্গলে নিয়ে বেঁহুশ করে ফেলে রেখেছে। দশ দিনের মধ্যে যদি হুঁশ না পেরে, তবে শোয়ামি তার কোনোদিন আর জ্যান্ত বাড়ি ফিরতে পারবে না। তার প্রেতাত্মা বাবার প্রেতাত্মার সঙ্গে বাদা-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবে অনন্তকাল। সবে সাত দিন গেছে, আরো তিন দিন বাকি। চারুবালা এখন মুসলমান মেয়েজামাইদের সঙ্গে দেখা দিয়ে তাদের যত্নখাতির শুরু করলে তার শ্বশুরমশাইর আত্মা আরো খেপে ওঠাটা স্বাভাবিক। শোয়ামি ফিরে আসার শেষ আশাটুকুও তখন বৃথা যাবে। নিবারণ সাধকের কথা কেউ বিশ্বাস না করুক, সে মনেপ্রাণে করে।
শাশুড়ির এই আত্মগোপনে হালিম মনে মনে খুশিই হয়। যাক, হিন্দু মেয়েলোককে অন্তত মা বলে ডাকতে হচ্ছে না। বৈঠকখানা থেকে সে বাশ্ঘরে আসে না, তাপসী বারবার চেষ্টা করেও তাকে আনতে পারে না। নমিতার কথা তো সে পাত্তাই দেয় না। বেশি জোরাজুরি করলে চোখ রাঙায়। দিদারের আবার অতশত বাচবিচার নেই, বাশ্ঘর হেঁশেল উঠোনবাড়ি কুয়োতলা কলতলা সব চষে বেড়াচ্ছে সে। ভেতরের কামরায় গিয়ে একবার শাশুড়ির সঙ্গে দেখাও করতে চেয়েছিল, দীপিকা যেতে দেয়নি। বলেছে, ‘দিদির বরেরে রাইখে তোমার একা যাবা ঠিক হবে না।’
শ্বশুরবাড়িতে হালিমের তিন দিন কাটল। সারাদিন গোপেশের সঙ্গে নৌকায় চড়ে খাল-জঙ্গলে ঘুরে, বিকেলে ভায়রার সঙ্গে গরানপুর বাজারে আড্ডা দিয়ে, রাতে শ্বশুরের জন্য শোক-তাপ করে ভালোই কাটল তার। আরো দুদিন হয়ত থাকত, নমিতাকে সেরকম ইঙ্গিতই দিয়েছিল, কিন্তু পারল না ভায়রার কারণে।
সেদিন সন্ধ্যায় গরানপুরের রাধামাধব ও মহেশ্বর এসে কান্নাকাটি শুরু করল। তারা খবর পেয়েছে হরিনগরের ভক্তদাসকে নাকি মুন্সিগঞ্জ বাজারে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কেশব মাস্টার নিখোঁজের ঘটনায় পুলিশের সন্দেহের তালিকায় তার নাম ১ নম্বরে। রাধামাধব, বিপিন আর মহেশ্বরের নামও নাকি আছে পুলিশের তালিকায়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে মাস্টারের ধর্মান্তরের ঘটনায় হিন্দুসমাজ তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। ভক্তদাস নাকি একদিন গরানপুর বাজারে তাকে কটুকথাও বলেছে।
বেচারা রাধামধব ঘাবড়ে গেছে, মহেশ্বরের তো জবানই বন্ধ, আর বিপিন ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে রাধামাধব বলল, ‘মাস্টারবাবুকে চিরকাল আমরা ভক্তিশ্রদ্ধা করিচি, কোনোদিন চোক তুলে কতা বলিনি, অথচ এখন কিনা আমরাই ফাঁইসে যাচ্ছি! এটা কেরাম বিচার বৌদি?’
কী বলবে চারুবালা, শুনে তো সেও অবাক। মাস্টার সত্যি সত্যি গুম হলে ভক্তদাসকে না হয় সন্দেহের তালিকায় রাখা যায়। সে হরিনগর মন্দির কমিটির সেক্রেটারি, দুই গ্রামের হিন্দুরা বিপদে-আপদে তার ধন্না ধরে। মাস্টারের ধর্মান্তরের ঘটনায় তার নাখোশ হওয়াটা স্বাভাবিক, মাস্টারকে কটুকথা বলটাও স্বাভাকি। দুজন সমবয়সী, একসঙ্গে স্কুলে পড়েছে, যুদ্ধও করেছে একসঙ্গে―কটুকথা বলার অধিকার তার আছে। হিন্দুসমাজের নেতা হিসেবে ধর্মচ্যুত মাস্টারের ক্ষতি সে করলেও করতে পারে। কিন্তু রাধামাধব, বিপিন বা মহেশ্বর তার ক্ষতি করতে যাবে কোন দুঃখে? কারো আগেও নেই, পিছেও নেই তারা। দিনে এনে দিনে খায়, আনতে না পারলে উপোস থাকে – পুলিশ তাদের সন্দেহ করবে কী কারণে? চারুবালা খেপে ওঠে, ‘নিরপরাধ মানষিরি পুলিশ কী জন্যি ফাঁসাবে? সব আন্দাজে ঢ্যালা মারা, না? দরকার হলি আমি থানায় গে দারোগার সাথে কতা বলবো।’
চারুবালার আশ্বাস পেয়ে ফিরে গেল তারা। নতুন গজানো গুজবটা নিয়ে বাড়ির সবাই বৈঠকখানায় বসল। হালিম বলল, ‘ঘটনা ভালোভাবে তদন্ত কইরে দ্যাখা দরকার, গুজব বলে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না। কথায় আছে না, যা কিছু রটে কিছু না কিছু বটে। হিন্দুদের তো বিশ্বাস নি। গ-গোলের বছর তারা এ দেশের কত মুসলমান মাইরেচে তার কোনো শুমার আচে?’
চোখ বড় বড় করে জামাইবাবুর দিকে তাকাল তাপসী। শেষের কথাটা তার গায়ে লেগেছে। গ-গোল বলতে তার জামাইবাবু কী বোঝাতে চায়? হাসতে হাসতে বলল, ‘জামাই অকারণে হিন্দু সমাজের দুন্নাম কইরতেচে। হিন্দুরা তাগো কী ক্ষতি কুরেচে শুনি?’
হালিম বলল, ‘আমার ক্ষতির কথা বলিনি। কিন্তু ক্ষতি করতি কতক্ষণ?’
থুতুর সঙ্গে মুখে চলে আসা কথাটা তাপসী না ছেড়ে পারল না, ‘শোনো জামাই, হিন্দুরা মোসলমানেগো কোনো ক্ষতি করিনি, মোসলমানেরাই হিন্দুগো বিরাট ক্ষতি কুরেচে।’
ভুরু দুটো কপালে তুলে তাপসীর মুখের দিকে তাকাল হালিম। তাপসী ইঙ্গিতটা কোনদিকে করেছে বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। একবার বলতে ইচ্ছে হলো, ক্ষতি আমরা করিনি বরং উপকার করেছি। হিন্দু থেকে তোমার বোনকে মুসলমান বানিয়ে পরকালে তার মুক্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কিন্তু কী বুঝে কথাটা গিলে ফেলল। তার চেহারা দেখে ভেতরের অবস্থা বুঝতে পারল নমিতা, রান্নাবাড়া দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে তাপসীকে নিয়ে সে বেরিয়ে গেল। বাশ্ঘরে ছেলের কান্না শুনে দীপিকাও উঠল।
দিদার এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথা শুনছিল, এবার সে মুখ খুলল, ‘দোষ শুদু হিন্দুগো না ভাই, মুসলমানরাও কি কম যায়? মোহাম্মদী জামাতের মুসলমানরা কি ইসলামের সঠিক পথে আচে? ইসলাম কি বলিচে অন্যের ক্ষতি করতি? এই যে আহমদিয়া মুসলিম জামাতের লোকেগো ধুরে ধুরে এরমভাবে নির্যাতন করা হচ্চে, এডা কোন ইসলামের নীতি? কেয়ামতের আগে ইমাম মাহদী দুনিয়ায় আসার কথা কি নবীজি বলেনি? আহমদিয়ারা তো খারাপ কিছু বলতেচে না, মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানিরে তারা ইমাম মাহদি মানচে। অথচ এইটে নে দ্যাখেন মোহাম্মদি জামাতের মুসলমানেগো কত হৈচৈ। পাকিস্তান সরকার তো সেই কবে আহমদিয়াগো অমুসলিম ঘোষণা কুরে দ্যালো। বাংলাদেশেও আহমদিয়াগো ধুরে ধুরে মারা হচ্চে, তাগোরে অমুসলিম ঘোষণার জন্যি আন্দোলন হচ্চে। ক্যানো রে ভাই, আহমদিয়ারা মুসলমান না এইটা কোন কেতাবে লেখা আচে?’
এই তো সেরেছে! ঘা-টা একেবারে হালিমের আঁতে গিয়ে লাগল। আহমদিয়া মুসলিম জামাত নিয়ে দুই ভায়রার তর্ক-বাহাস আর থামায় কে! তর্ক করার মতো একটা ভালো ইস্যু খুঁজে পেল বটে হালিম। আহমদিয়ারা তার চোখের শূল, তাদের নাম শুনলেই তার চান্দি গরম হয়ে যায়। তার মতে আহমদিয়ারা কাদিয়ানি কাফের, ইহুদি খ্রিস্টানও তাদের চেয়ে ভালো। আর দিদার তো সুযোগ পেলেই আহমদিয়া মতবাদ নিয়ে যার-তার সঙ্গে বাহাস শুরু করে দেয়। কত জায়গায় কত অপমান-অপদস্ত হলো, গ্রামবাসী তাকে এসব কুফুরি ফেরকা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কত হুমকি-ধমকি দিল, সে গায়েই মাখল না। তার বিশ্বাসেই সে অটল। হেদায়াতে ইসলামির আদর্শ এখন তার কাছে অসার। পার্টির ওপর সে যারপরনাই বিরক্ত। বিলকিস হত্যা মামলায় জড়িয়ে জেল খেটে বেরোবার পর পার্টির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বিপদে সহযোগিতা না পেয়ে জিয়ারত আলীর ওপর সে বেজায় ক্ষুব্ধ, সেদিনের পর আর কোনোদিন তার মুখোমুখি হয়নি। পার্টির নেতা-কর্মীরাও তাকে আর মিটিং-মিছিলে ডাকে না।
হেদায়াতে ইসলামির কট্টর সমর্থক, মনেপ্রাণে সুন্নি তরিকায় বিশ্বাসী দিদার হঠাৎ করে আহমদিয়া মুসলিম জামাতের অনুসারী হয়ে যায় জেলে গিয়ে। সম্প্রদায়টির আদর্শ-উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রথম সে বিস্তারিত জানতে পারে যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত আসামি জালালুদ্দিনের কাছে। আগেও বহুবার সম্প্রদায়টির কথা শুনেছে, কিন্তু কোনোদিন তাদের নিয়ে মাথা ঘামায়নি, তাদের ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে জানার আগ্রহ হয়নি। শ্যামনগরের বহু গ্রামে আহমদিয়া জামাতের অনুসারীরা আছে। রতনপুর, মুন্সিগঞ্জ আর হরিনগরেও কয়েক গিরি আহমদিয়া মতাবলম্বী আছে। হাটে-বাজারে তাদের সঙ্গে বহুবার দেখাও হয়েছে, কিন্তু কোনোদিন কারো সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়নি।
শ্যামনগরে আহমদিয়া মুসলিম জামাতের বিস্তার ঘটে বহু বছর আগে। দিদারের তখন জন্ম হয়েছে কি হয়নি, হলেও সে মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে। নূরনগরের জালালুদ্দিন তখন টগবগে তরুণ। মংলা বন্দরের এক সারেঙের সঙ্গে খাতির জমিয়ে তার জাহাজে চড়ে সে পাকিস্তান চলে যায়। বহু বছর করাচি শহরে চাকরি-বাকরি করে মাঝবয়সে দেশে ফিরল। দেশে সে খালি হাতে ফিরল বটে, কিন্তু মগজে করে নিয়ে এলো আহমদিয়া মতবাদ। পাকিস্তান থেকে সে হয়ত কোনোদিন ফিরত না, যদি না চুয়াত্তর সালে, বাংলাদেশে যে বছর আকাল হলো, পাকিস্তান সরকার আহমদিয়া মুসলিম জামাতকে অমুসলিম ঘোষণা করত। সরকারি হুকুম জারি হওয়ার পর আহমদিয়া মতাবলম্বীদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে ধরপাকড় শুরু করল পুলিশ। সুন্নি মুসলমানদের হাতে বহু আহমদিয়া মতাবলম্বী মারা পড়ল। জালালুদ্দিন দেশে আকালের কথা শুনেছিল। দেশে ফিরে না খেয়ে মরার চেয়ে করাচি শহরের গলিঘুপচিতে গা ঢাকা দিয়ে থেকে যেতে চেয়েছিল। পারল না। যেখানেই যায় লোকে তাকে আহমদিয়া বলে সন্দেহ করে। সন্দেহ হয়ত করে না। কারো গায়ে তো আর ওয়াহাবি-সুন্নি বা কাদিয়ানি কথাটি লেখা থাকে না। বিশ্বাস তো থাকে মনে। কার মনে কী আছে কে অত খবর রাখে। কিন্তু জালালুদ্দিনের কেবলই মনে হয় করাচি শহরের সব লোক তার পিছে লেগেছে। যে কোনো সময় পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে পেটে লম্বা ডেগারটা ঢুকিয়ে একটানে ভুঁড়িটা নামিয়ে দেবে। প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে দেশে ফিরতে হলো।
দেশে ফিরে সে নিজেকে আহমদিয়া মতাবলম্বী বলে কারো কাছে প্রচার করেনি। কিন্তু আকাশে মেঘ জমলে কি চালার বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখা যায়? দু-বছর বাদে পাকিস্তান থেকে নূরনগরের আরো চারজন দেশে ফিরল। তাদের কে একজন একদিন প্রকাশ্যে নিজেকে আহমদিয়া বলে ঘোষণা করল। গ্রামের মসজিদের ইমাম কি আর চুপ করে বসে থাকতে পারে? দ্বীন-ইসলামের হেফাজত করা তার ইমানি দায়িত্ব। লোকটাকে পাকড়াও করে এনে মসজিদের বারান্দায় বসিয়ে তওবা পড়তে বলল। তওবা সে পড়ল বটে, কিন্তু তার বিশ্বাস থেকে একচুলও নড়ল না। ইমামের সামনে সে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করল, মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানি একজন মুজাদ্দেদ। নবীজি যে ইমাম মাহদির কথা বলেছেন মির্জা হচ্ছেন সেই মাহদি, নবীজির আদর্শের অনুসারী ফিরে আসা ঈসা নবী।
এরপর কি তাকে কেউ আর আস্ত রাখে? শরীয়তে মানুষের গোশত খাওয়ার হুকুম থাকলে তো তাকে রোস্ট বানিয়ে খেত। মোড়ল-মাতবরদের হুকুমে গ্রামের ছেলে-বুড়োরা মিলে তার হাত-ঠ্যাং রশি দিয়ে বেঁধে ইচ্ছেমতো মেরে ডাকাত সাব্যস্ত করে পুলিশের হাতে তুলে দিল। পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, বল, তোর দলে আর কে কে আছে? সে ভাবল পুলিশ বুঝি তার কাছে জানতে চাইছে নূরনগরে আহমদিয়া মতাবলম্বী আর কে কে আছে। সরল মনে সে জালালুদ্দিনসহ আরো চারজনের নাম বলল। পরদিন পুলিশ জালালুদ্দিনকে থানায় ধরে এনে একটা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলে চালান করে দিল। জালালুদ্দিন আর মুক্তি পেল না। তার জামিনের জন্য বাড়ি থেকে কেউ চেষ্টাও করল না। মামলাটা প্রায় আট বছর গড়ানোর পর রায় হলো। রায়ে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো।
জালালুদ্দিনের সঙ্গে জেলের একই ওয়ার্ডে থাকত দিদার। তার কাছে পাকিস্তানের কাদিয়ান গ্রামের মির্জা গোলাম আহমেদের কিচ্ছা-কাহিনি শুনতে শুনতে মির্জার প্রতি তার মনেও ভক্তিশ্রদ্ধার একটা বীজ বপিত হয়। বীজটা ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হতে থাকে। একটা সময় তারও বিশ্বাস হয় ঈসা নবীকে খোদা সশরীরে জ্যান্ত বেহেস্তে তুলে নেননি, তিনি এই পৃথিবীতেই স্বাভাবিকভাবে এন্তেকাল করেছেন। কাশ্মীর দেশে আর সবার মতো তারও দাফন হয়েছে এবং যথারীতি তিনি বেহেস্তবাসী হয়েছেন। নবীজি বলেছেন বেহেস্ত থেকে নয়, তার জীবিত উম্মতদের মধ্য থেকেই ঈসা নবী আবার দুনিয়ার বুকে আসবেন মানুষকে হেদায়েত নসিব করতে। সত্যি সত্যি ঈসা নবী আবার ফিরে এসেছেন এবং তার নাম মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানি। তিনি একজন মুজাদ্দেদ, ইমাম মাহাদি এবং ফিরে আসা ঈসা। নতুন কোনো মতবাদ নয়, তিনি নবী মোহাম্মদের মতেরই অনুসারী একজন নবী।
দিদার তার ভায়রাকে মির্জা গোলাম আহমেদের জন্ম ও বংশ পরিচয় এবং তার মতবাদ সম্পর্কে একপ্রস্ত শুনিয়ে দিল। হালিম আহমদিয়াদের সম্পর্কে কমবেশি জানে। যতটা জানে, ঘৃণা করে তার চেয়ে বেশি। আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করে দেশ থেকে খেদানোর জন্য পীরজাদা পীরের মুরিদদের সঙ্গে মিলে বহু মিছিল-মিটিংও করেছে। ভায়রার মুখে আহমদিয়াদের এত প্রশংসা শুনে চোখ বড় বড় করে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তা ভাই তুমি কাদিয়ানি নাকি?’
দিদার বলল, ‘কাদিয়ানি বললি তো ভাই গায় লাগে। আমরা তো কাদিয়ানি না, বললি আহমদিয়া বলুন।’
ঘৃণায় থুতু ফেলার জায়গা পায় না হালিম। মাথা থেকে তার পায়ের তালু পর্যন্ত গরম হওয়া ধরল। মুসলমানের সঙ্গে শালীর বিয়ের খবর শুনে সে কত না খুশি হয়েছিল। ভেবেছিল ভায়রাকেও বুঝিয়ে-শুনিয়ে পীরজাদা পীরের মুরিদ বানিয়ে নেবে, অথচ ভায়রা কিনা সাক্ষাৎ কাদিয়ানি কাফের!
উপায় থাকলে সে-রাতেই হালিম বউকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছাড়ত। কিন্তু রাত তখন প্রায় এগারোটা। বাইরে অন্ধকারের গলাগলি। এত রাতে সে যাবে কোথায়? বৈঠকখানার চকির ওপর দুই ভায়রার জন্য খানা তৈরি। হালিম চুপচাপ দু-গ্রাস ভাত খেয়েই শুয়ে পড়ল।
ভোরে মসজিদ থেকে ফিরেই নমিতাকে বলল, চল।
নমিতা বলল, কোনে যাব?
: কোনে যাবা জানো না? ধমকে উঠল হালিম। এ বাড়ি কোনো ইমানদার থাকতি পারে? তোমার বোনজামাই একটা কাট্টা কাফের। ইহুদি-নাসারাকে আত্মীয় বলে মাইনে নেয়া যায়, কিন্তু কোনো কাদিয়ানি কাফেরকে নয়। এ বাড়ি আর এক মুহূর্ত থাকলি পরে আমার ভাত তোমার জন্যি হারাম।