কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
আট.
অনন্ত মণ্ডলের গুলিবিদ্ধ লাশ বাঘে, না কামোট-কুমিরে টেনে নিয়েছিল, নাকি জোয়ারের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল গরানপুরের কেউ দেখেনি। কিন্তু তার পুত্র কেশব মণ্ডল ওরপে কেশব মাস্টার ওরপে কিশোয়ার, কিশোর বা কেশু মাস্টার অপহরণের ঘটনা দেখেছে একজন – হরিনগরের কোবাদ মাঝির ছেলে ছেরু।
তখন চৈত্র প্রায় শেষের দিকে। কুষ্ণচূড়া-রাধাচূড়ায় আগুন লেগেছে। ছেরুর পাগলামি থেমে গেছে মাঘেই। মাঘের শীতে মানুষ তো মানুষ, বাদার বাঘও কাবু হয়। কিন্তু সে-বার প্রকৃতির কী খেয়াল হলো, মাঘের প্রথম সপ্তায় কদিন হিম হাওয়া বইল, মানুষ ও মানবেতর প্রাণীদের রক্ত-মাংস বরফ করে দিয়ে দ্বিতীয় সপ্তায় শীত উধাও। সবাই ভাবল শীত বুঝি দম নিচ্ছে, কদিন পর ঠিকই আবার দুর্দান্ত দাপটে হাজির হবে। অথচ কী অবাক কাণ্ড, ভরা মাঘে কিনা শীত উধাও! দক্ষিণমুখী হাওয়া উত্তরমুখী বাঁক নিল, গাছে গাছে কোকিলের ডাকাডাকি শুরু হলো। ছেরু পাগলাকে তখন আর পাগল বলে কে? দিব্যি সে খায়-দায়-ঘুমায়, পুকুরে গিয়ে গোসল করে, মসজিদে গিয়ে নামাজও পড়ে, মাকে মা ডাকে, বাপকে বাপ। তাকে দেখলে কে বলবে অতীতে সে পাগল ছিল অথবা ভবিষ্যতে সে পাগল হবে? চান্নিরাতে নিশিপাওয়া মানুষের মতো ঘর ছেড়ে পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোকে তো আর পাগলামি বলা চলে না। শীত-গ্রীষ্ম যাই থাকুক, আকাশে ভরাট চাঁদ দেখা দিলে তার মনে জোগার গোনের চুনকুড়ির মতো উথালি-পাতালি শুরু হয়। মনের ভেতর ঢেউ ভাঙে। তখন তাকে দড়িতে বেঁধেও ঘরে আটকে রাখা দায়। কী যে হয় তার, জিনটা তার ওপর ভর করে বুঝি, মালকোচা মেরে উদোম গায়ে পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় আর গান গায়। গাঁয়ের মানুষের কাছে তো অমাবস্যা-পূর্ণিমা সমান। ঘুটঘুটে অমাবস্যা হোক অথবা ফকফকে পূর্ণিমা, রাত আটটার পর কে আর জেগে থাকে? ঘুমের ভেতর তো আর অমাবস্যা-পূর্ণিমার কথা খেয়ালে থাকে না। রাত এগারোটা বা বারোটায়, অথবা তিনটায়ও হতে পারে, যখন বাদার নৈঃশব্দ চারদিক ছেয়ে ফেলে, ছেরুর গান শুনে তাদের মনে পড়ে আজ চান্নিরাত। চান্নিরাতে ছেরু গলা ছেড়ে গায়। উত্তরে কে গায়? কে আবার, ছেরু পাগলা। দক্ষিণে কে গায়? ছেরু পাগলা ছাড়া আর কে! পুবে-পশ্চিমে কার গলা শোনা যায়? ছেরুর, কোবাদ মাঝির বেটা ছেরু পাগলার।
গান গাইতে গাইতে পথ ঘাট প্রান্তর ঘুরে বেড়ায় ছেরু। এখন মুকনোলির প্রান্তরে তো তখন গোনের দিঘির পাড়ে। খানিক পর আবার চুনকুড়ির তীরে। তার গান শুনে কেউ হাসে, ‘ওই ছেরু পাগলা গায়।’ কেউ মন খারাপ করে, ‘আহ্ রে বেচারা! কত যে দুঃখ তার মনে!’
কে জানে কী দুঃখ ছেরুর মনে। কাউকে তো কোনোদিন তার দুঃখের কথা বলেনি। মনের দুঃখ মনে চেপে রেখে পথে-প্রান্তরে ঘোরে। অর্থবিত্ত কম নয় তার বাপের। এককালে মাঝি ছিল, পরে বিদেশ গিয়ে টাকাপয়সা কামায়। ছেরু বাপের খায় আর সৌখিনতা করে বেড়ায়। হাতে সিকোফাইভ ঘড়ি, গলায় সোনার চেইন, পায়ে চামড়ার জুতো। প্যান্টও পরে মাঝেমধ্যে। শহুরে সাজার অবিরাম কসরত। কিন্তু যতই চেষ্টা করুক গেঁয়ো ভাবটা তার চেহারা থেকে যায় না। তবু তার জন্য গরানপুর-হরিনগরের কত মেয়ে একপায়ে খাড়া! অথচ সে কাউকে পাত্তাই দেয় না। খানবাড়ির মহসিন খানের মেয়ে সুরাইয়া তো বেশরমের মতো একবার তাকে বলেই বসল, ‘আমারে তুমি বে করবা ছেরু ভাই?’ ছেরু তো মহা খাপ্পা, ‘এক থাপ্পড়ে দাঁত ফিলে দ্যাবো বেশরম কোথাকার। দাঁড়া, তোর বাপের কাচে আমি যদি নালিশ না করিচি!’
নালিশ সে করেনি, এমন তুচ্ছ বিষয়ে নালিশ সে করতও না―নালিশ করার কথা বলে নিজের দেমাগটা ঝেড়েছে মাত্র। তার ওপর শোধ নিতেই হয়ত সুরাইয়া লজিং মাস্টারের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে যায়। পরে যখন শোয়ামিকে নিয়ে সুরাইয়া বাপের বাড়ি বেড়াতে আসে, একদিন খানবাড়ির চৌরাস্তার মোড়ে ছেরুর পথ আগলে কী অপমানটাই না করল, ‘দেমাগ তো খুব দ্যাখাইচ ছেরু ভাই। এখন দ্যাখো, আমার বিএ পাস বর তোমার মতন মূর্খের সঙ্গে কথাও বলবে না।’
অপমান গায়ে মাখল না ছেরু, হাসতে হাসতে বলল, ‘তুই যে আমারে ভালোবাসতিস সে-কথা যদি তোর বরকে বইলে দেই?’
সে বছর, ছেরুর বয়স তখন একুশ কি বাইশ, চুনকুড়ির চর দখলকে কেন্দ্র করে তুমুল লাঠালাঠি হলো। একপক্ষে ছবেদালি মোড়লের ফুফাতো ভাই মোবারক, অন্যপক্ষে খানবাড়ির জাবেদ খানের চাচাতো ভাই মহসিন খান। বুকে-পিঠে প্রতিপক্ষের ধারালো ছেনির পাঁচ পাঁচটা কোপ খেল মোবারক, ভাগ্য ভালো, তবু বেঁচে গেল। শোধ নিতে গরানপুর-হরিনগরের পঞ্চাশজনকে আসামি করে থানায় সে হাফ-মার্ডার মামলা দায়ের করল। ছেরু ঘটনার আগে-পিছে ছিল না, অথচ এজাহারে কিনা তার নাম ১৩ নম্বরে!
গ্রেফতার এড়াতে ছেরু আশ্রয় নিল গরানপুরে। গরানপুরে পুলিশ আসে না তা নয়, আসে। তবে হরিনগর থেকে ভাঙাচোরা রাস্তার পাঁক-কাদা মাড়িয়ে আসতে আসতে সারা গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ে। ততক্ষণে আসামিরা ডিঙিতে চড়ে চুনকুড়ি পার হয়ে খুব সহজেই জঙ্গলে ঢুকে পড়তে পারে। নদীপথেও পুলিশ আসে বটে, তবে কালে-ভদ্রে। ফলে আত্মগোপনের জন্য গরানপুর মোটামুটি নিরাপদ।
মণ্ডলবাড়ির বৈঠকখানাটা মেলা দিন ধরে খালি। একসময় বিপিন থাকত। মণ্ডলবাড়ির মাহিন্দার ছিল সে। বিয়ে করার পর পোষাচ্ছিল না বলে বাওয়ালির পেশা ধরেছে। কেশব মাস্টারকে অনুরোধ করল ছেরুর বাপ, ‘ঝামেলাডা মিটতি বেশি সময় লাগবে না মাস্টার, কটা দিন ছাইলেডারে তোমার বোঠেকখানায় থাকতি দ্যাও।’
মাস্টার তো দয়ার সাগর, অনুরোধ তিনি ফেলেন কী করে। থাকতে তো দিলেনই, কাঁথা-বালিশ আর একটা টেমিও দিলেন। সারাদিন ছেরু যেখানেই থাকুক, রাতে কেউ না দেখে মতো টুপ করে মণ্ডলবাড়ির বৈঠকখানার দরজাটা খুলে চুপচাপ শুয়ে পড়ে। আটটা-নয়টার আগে তো তার ভোর হয় না। বিছানা ছেড়ে কুয়োতলায় গিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে চুনকুড়ির আড়ায় উঠে এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে কাউকে না দেখলে সোজা উত্তরে অথবা দক্ষিণে হাঁটা ধরে। তখন তাকে দেখে কে বলবে রাতটা সে মণ্ডলবাড়ির বৈঠকখানায় কাটিয়েছে?
আত্মগোপনের সাত মাসে নমিতার সঙ্গে তার বেশ ক’বার দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে দু-চারবার। প্রথম দেখাতেই নমিতার সৌন্দর্যের প্রতি সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তারপর যতবারই দেখা হয়েছে সামনে দাঁড়িয়ে একবারও ঠিকমতো কথা বলতে পারেনি। প্রতিবারই একটা আড়ষ্টতা তাকে জড়িয়ে ধরেছে। সবসময় নমিতার কথা ভাবত বলেই হয়ত রাতে প্রায়ই তার ঘুম ভাঙত অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে। কোনো কোনো স্বপ্ন ছিল এমন – নমিতার বাঁহাতের কব্জিটা তার মুঠোয় ধরে দুজন খাল-জঙ্গল পেরিয়ে এক অচেনা গাঁয়ের উদ্দেশে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের সীমানা শেষ হয়ে শুরু হয় অকূল সাগর। অথবা দেখত, গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে বাদা থেকে হেঁসো হাতে বেরিয়ে অনন্ত মণ্ডল তাকে ধাওয়া করছে। প্রাণভয়ে সে ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে পেছনে ফিরে দেখে চুনকুড়ির আড়ায় দাঁড়িয়ে নমিতা হাসতে হাসতে কুটিপাটি খাচ্ছে।
কত দিন ভেবেছে এসব স্বপ্নের কথা নমিতাকে বলবে। কিন্তু বলা কি এত সহজ! নমিতাকে একা পাবে কোথায়? পেলেও এসব কথা কি মুখে বলে দেয়ার মতো? বলতে হয় পত্র লিখে, মনের মাধুরী মিশিয়ে। ছেরু তো নিরক্ষর, পত্র সে লিখবে কেমন করে। অতএব মনের কথা মনে চাপা দিয়ে রাখা ছাড়া উপায় কী।
সে-রাতে পূর্ণিমার মায়াবী চাঁদ আসমান জমিন ধুয়ে দিচ্ছে। রাত তখন আট কি সাড়ে আটটা। ছেরু একাকী চুনকুড়ির তীরে গোলপাতার মুড়াটার কাছে বসে গান ধরেছে, ‘প্রেম করেছেন আইয়ুব নবী…তার প্রেমে রহিমা বিবি গো…।’ গানের অন্য কথাগুলো যেমন তেমন, ‘নবী’ আর ‘গো’ বলে যখন সে টান মারে, মোল্লেপাড়া তো বটেই, গরানপুরের শেষ সীমানায় গিয়ে পৌঁছায় তার সুর। আইয়ুব নবী আর রহিমা বিবির প্রেমকাহিনির মিষ্টিমধুর সুর শুনে বুঝি নমিতার মনটা আনচান করে ওঠে। দীপিকাকে বলে, ‘যাবি দীপু গাঙের চরে?’ দীপিকা তো এমনিতেই নাচুনে বুড়ি, সে কি আর দেরি করে! বই-খাতা ফেলে বড়দির আগেই সে গোলপাতার মুড়টার কাছে হাজির। ছেরুর মন তো তখন চান্নির সঙ্গে আসমান জমিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মনে হতেই পারে তার গান শুনতেই হয়ত বাদা থেকে নিবারণ সাধকের পোষা কোনো পরি এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। গান থামিয়ে সে নামিতার মুখের দিকে তাকায়। সত্যি তাকে পরির মতোই লাগে। সে হাসে। দুধসাদা চাঁদের আলোয় তার দাঁতগুলো আরো সাদা দেখায়। সে বলে, ‘গাও না ছেরুদা, তোমার গলা তো ভারি সুন্দর।’
কী বলতে কী বলে বসল ছেরু, ‘তুমি বল্লি তো আমি এই ভরা গাঙ সাঁতরে বাদায় উঠতি পারি।’
নমিতার হাসি থামে না, ‘সত্যি? তা দেখি কেরাম তোমার বাহাদুরি।’
সত্যি সত্যি বুঝি জিন ভর করল ছেরুর ওপর, গেঞ্জিটা খুলে উদোম হয়ে মালকোচা মেরে সে জোগার গোনের ভরা গাঙে ঝাঁপ দিল। নমিতা আঁতকে ওঠে জিবে কামড় দিল, ‘হায় হায় ছেরুদা, তুমি পাগল হুয়ে গিলে নাকি?’
আবেগের উচ্ছ্বাসে আসলেই বুঝি পাগল হয়ে গেল ছেরু। এই পাগলামি তাকে বিপদের মুখে নিয়ে গেল। নমিতা দেখল ছেরু আর সাঁতরাতে পারছে না, উল্টো সাঁতার কেটে কূলে ভেড়ার চেষ্টা করছে। কয়েক মুহূর্ত। হঠাৎ তার আর্তনাদ শোনা গেল – নিল রে…!
সাপিনীর মতো এই চুনকুড়ির জলে মানুষকে কে নেয়, বুঝতে দেরি হয় না নমিতার। দীপিকা ভয়ে বড়দিকে জড়িয়ে ধরে, আর নমিতা বিড়বিড় করে বনদুর্গার নাম জপে। ভরা গাঙে খলবলানি শুরু হয়। ছেরুর বুকে দুরন্ত সাহস। যে কথা সে নমিতাকে দিয়েছে, আজরাইলকে হারিয়ে তা পালন করবেই। গাজী পীরের নাম স্মরণ করে শুরু করল সে মরণপণ লড়াই। বুভুক্ষু কামোটের মুখ থেকে ডান পা-টা একটানে ছাড়িয়ে আবার উল্টো সাঁতার দিল। কিন্তু একবার ধরলে কামোট কি এত সহজে ছাড়ে? মুহূর্তে ছেরুর বাঁহাতের কব্জিটা কামড়ে ধরল। ছেরু আবার আর্তনাদ করে উঠল। তার মনে হলো, অনন্ত মণ্ডল যেন কামোটের রূপ ধরে তার ধারালো হেঁসোর কোপ মারল কব্জিটায়। শরীর সব শক্তি বাঁহাতে জড়ো করে জোরসে টান মারল ছেরু। জয় তার হলো বটে, কামোট তাকে ছেড়ে দিল, কিন্তু তার কব্জিটা থেকে গেল দাঁতাল কামোটের ভয়ংকর মুখে।
নিশ্চয়ই সে-রাতে তার ওপর বাদার কোনো জিন-পরি ভর করেছিল। নইলে কেউ এভাবে ভরা গাঙে ঝাঁপ দেয়! কামোটের কবল থেকে সে বেঁচে গেল, কিন্তু জিনের আসর তাকে ছাড়ল না। মাঝে ক’মাস জিনটা তাকে ছেড়ে গিয়েছিল। মুসলমানের সঙ্গে নমিতার বিয়ে হওয়ার খবরটা যেদিন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল তার কদিন পরই জিনটা আবার তার ওপর সওয়ার হলো। শীত এলে জিনটা তাকে ক্ষেপিয়ে তোলে, প্রতি জ্যোৎস্নার রাতে ঘর থেকে তাকে পথে-প্রান্তরে টেনে আনে। গান তো সে গায় না, গায় জিনটা। নইলে ছেরু পাগলার গলা এত মধুর হয় কী করে!
মাঝেমধ্যে, ছেরুর মাথা বেশি খারাপ থাকলে, দা-বটি নিয়ে সামনে যাকে পায় তাকে তাড়া করে। একবার মাজেদ গাইনকে তাড়া করেছিল। অজানা কারণে এই লোকটাকে সে সহ্য করতে পারে না। দেখামাত্র গালাগাল শুরু করে দেবে, অথবা হাতের কাছে যা পাবে তা নিয়ে ধাওয়া দেবে। সেদিন হরিনগর বাজার থেকে ধাওয়া দিল। মাজেদ হাসে আর ধায়, ধায় আর হাসে। সে বুঝি মজাই পায়। গরানপুর বাজারে ফেলুর দোকানের সামনে এসে মাজেদ থামে। ছেরুও আর আগায় না, বকাবকি করতে করতে প্রান্তরের পথ ধরে আবার হরিনগরের দিকে হাঁটা ধরে।
সে-রাতে, কেশব মাস্টার যে-রাতে গুম হলেন, সাঁঝের পরপরই ছেরু ঘর ছাড়ল। মুকনোলির প্রান্তরের অন্ধকার ধুয়ে দিচ্ছে চাঁদের আলো। প্রান্তরজুড়ে অপার্থিব মায়া খেলা করছে। প্রান্তরের পথ ধরে চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে গান গায়। সে হাঁটলে চাঁদটাও হাঁটে, সে থমকে দাঁড়ালে চাঁদটাও থমকে দাঁড়ায়, সে দৌড়ালে চাঁদটাও দৌড়ায়। ভারি তো অবাক কা-! চাঁদটাকে পেছনে ফেলতে সে উত্তরে হাঁটা ধরল, অথচ চাঁদটাও কিনা তার পাছে পাছে হাঁটা ধরল! আবার সে দক্ষিণে হাঁটা ধরে, তবু চাঁদ তার সঙ্গ ছাড়ে না।
চাঁদটাকে ধরতে সে পুবদিকে হাঁটা ধরল, অমনি চাঁদটা টুপ করে তার মাথার ওপর উঠে বসল। দক্ষিণে আলাউদ্দিনের টিনের চালে চাঁদের আলো ঝলসে পড়ছে। ছেরু সেদিকে হাঁটা ধরল। চাঁদটাও গড়াতে লাগল সেদিকে। কিছুদূর গেলে চুনকুড়ি থেকে অজগরের মতো উঠে আসা খালটা তার পথ আগলে দাঁড়াল। অগত্যা বাঁয়ে ঘুরে সে পুবে মাজেদ গাইনের বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল।
চাঁদটা তখন আকাশের গায়ে সেঁটে আছে। মাজেদ গাইনের বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল ছেরু। গাছগাছড়ার কারণে চাঁদটা আর দেখা যায় না। মাজেদের ঘরে মানুষের ফিসফাস আওয়াজ শোনা যায়। মাজেদ বুঝি তার বউয়ের সঙ্গে সুখবিছানায়! কিন্তু সারা বাড়িতে বিড়ির গন্ধ কেন? মাজেদকে তো ছেরু কোনোদিন বিড়ি টানতে দেখেনি। বিড়ির বদলে সে দাঁতে গুল মাজে। কে জানে, আত্মীয়-স্বজন কেউ হয়ত বেড়াতে এসেছে – ছেরু ভাবে।
চুনকুড়ির আড়ায় উঠে এলো ছেরু। চাঁদটা আবার স্পষ্ট হলো। চাঁদের আলো গায়ে মাখতে মাখতে উত্তরে গিয়ে ছেরু চুনকুড়ির চরে নামল। গোলপাতার মুড়াটার কাছে এসে একবার ম-লবাড়ির দিকে তাকাল। সারা বাড়ি নীরব, গাছবিরিক্ষির পাতটি পর্যন্ত নড়ছে না। রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত বাবার অপেক্ষায় জেগে ছিল তাপসী। চারুবালা সন্ধ্যার পর এক দফা ঘুমিয়ে নিয়েছে, নয়টার দিকে উঠে খেয়েদেয়ে আবার শুয়ে পড়েছে। মায়ের সঙ্গে গোপেশও ঘুমায়। তাপসী জানালার কাছে বসে হারিকেনের আলোয় ‘শ্রীশ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু’ বইটার পাতা ওল্টায়। বাবার আলমিরা থেকে কদিন আগে বইটি নামিয়েছে। তিরিশ পাতা পর্যন্ত পড়ে ফেলেছে এরই মধ্যে। টানছেও বটে বইটা তাকে। কী সুন্দর লেখা, ‘দর্পহারী ঈশ্বর সর্বদাই অহংকারীকে সমুচিত শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কলাবর্তী বৃক্ষ আর মানুষ সর্বদা নত হয়ে থাকে। বাণ, বেণ, হৈহয়, নহুষ, রাবণ, কংস এরা নিজেদের মহাশক্তিশালী বলে অহংকার করত বলেই ঈশ্বর কেমন করে তাদের অহংকার চূর্ণ করেছেন?’
পড়তে পড়তে চোখের সামনে তার বাবার মুখটা ভেসে ওঠে। পণ্ডিত বাবা তার, কত কিছু জানেন, জীবনভর কত বই পড়েছেন, অথচ কত বিনয়ী, কত নরম। সহজে কারো সঙ্গে বিবাদে জড়ান না, বড়জোর তর্ক-বাহাস। কেউ তাকে গালি দিলেও এক নিমেষে তা হজম করে ফেলেন। বাবাকে সে এমনই দেখেছে সারাজীবন। কিন্তু তার কষ্ট লাগে শেষ বয়সে বাবার ধর্মান্তরে। কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল বাবা? এ কারণে মাঝেমধ্যে রাগ ওঠে তার। তবে বেশিক্ষণ থাকে না, বাবার সরল মুখটা দেখলে রাগ-ক্ষোভ সব উবে যায়।
সে পড়ছে, কিন্তু তার কান দুটো খাড়া। বাতাসে একবার পাতা নড়লে সচকিত হয়ে ওঠে। এই বুঝি বাবা এলো! বৈঠকখানার দিকে কান পেতে রাখে। না, বৈঠকখানার দরজার খোলার শব্দ শোনা যায় না। একবার সে বৈঠকখানা ঘুরে এলো। বাইরে থেকে দরজার শিকল টানা দেখে আড়ায় গিয়ে দাঁড়াল। হাঁটু মুড়ে বসে দূরে নজর ফেলে দেখল কারো পা দেখা যায় কিনা। চাঁদের আলোয় দক্ষিণে যতদূর চোখ গেল, মনে হলো, একটা পোয়াতি দুধরাজ চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। গায়ে শিউরানি উঠল তার, দ্রুত ঘরে ফিরে দরজায় ছিটকিনি দিল। বাইরে একটা কাক ডেকে উঠল কয়েকবার। সন্ধ্যায় ঠাকুরঘরের চালে বসে যে কাকটা কা-কা করছিল সেটা হবে বুঝি। ঢিল মেরে কাকটাকে তখন সে তাড়িয়ে দিয়েছিল। খানিক পর আবার এসে ডাকতে শুরু করল। তখন থেকেই কী এক উদ্বেগ তাকে ঘিরে ধরে। উদ্বেগটা এখনো গলার কাছে আটকে আছে। বাবার অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে তার চোখ ভারী হয়ে আসে, বালিশটা টেনে মায়ের গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে।
খানিকক্ষণ গোলপাতার মুড়াটার কাছে বসে থেকে ফের আড়ায় উঠে দক্ষিণে হাঁটা ধরল ছেরু। গরানপুর জামে মসজিদের পুবে নদীর আঘাটে, দেখতে পেল সে, গাছগাছড়ার আড়ালে নোঙর করা নৌকার গলুইর ওপর মানুষের আবছায়া। চমকে উঠল সে। এত রাতে কোনো মানুষ তো পাহারাদারের মতো এমন সতর্ক ভঙ্গিতে নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। পুলিশ-বিডিআর কি না! কে জানে, হয়ত পিটেলবাবু তার দলবল নিয়ে টহলে বেরিয়েছে। নাকি মোছলেম তালুকদারের গ্যাং গ্রামে হানা দিল! খটকা লাগে তার। তালুকদারের গ্যাং হলে তো আর রক্ষা নেই, এত রাতে তাকে একা পেলে ধরে নিয়ে যাবে নিশ্চিত। বৈঠা বাওয়ার জন্য তো তাদের লোক দরকার। তাকে ধরে নিয়ে বৈঠা হাতে গলুইতে বসিয়ে দিলে তার তো কিছু করার থাকবে না। সে বৈঠা বাইবে না বলে গোঁ ধরবে? তাহলে তো এক লহমায় তার মুণ্ডুটা কামোট-কুমিরের পেটে গিয়ে পড়বে।
জোর কদমে মসজিদের খোলা বারান্দায় ঢুকে পাকা মেঝেয় বসে পড়ল ছেরু। বারান্দার চারদিকে হাঁটুসমান উঁচু পাকা বাউন্ডারির কারণে তাকে রাস্তা থেকে সহজে ঠাওর করা মুশকিল। তার বুকে ধপধপ শব্দ ওঠে। বাদার বাঘ যেন তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। শিকারির মতো সে চুপ করে বসে থাকে। একটা হেঁসোর অভাববোধ করে খুব। একটা হেঁসো থাকলে খুব ভালো হতো। সামনে যে আসত এক কোপে তার মুণ্ডুটা নামিয়ে দিত।
রাস্তায় পায়ের আওয়াজ পেয়ে সে মাথা উঁচিয়ে কেশব মাস্টারকে দেখতে পায়। গায়ে খদ্দেরের পাঞ্জাবি, পরনে ঢোলা পায়জামা, বগলে চাতা আর কাঁধে ঝোলানো পাটের ব্যাগটা দেখে সহজেই তাকে চেনা যায়। মসজিদ পেরিয়ে মাস্টার আড়ায় উঠলে পরে দক্ষিণে ‘কুউ’ শব্দটি শোনা যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে কুকুর ডেকে ওঠে। তারপরের ঘটনা তো তার চোখের সামনেই ঘটতে থাকে, চাঁদের আলোয় সে সবকিছু ঠাওর করতে পারে।
পরদিন ঠিক দুপুরে জিনটা বুঝি সওয়ার হলো তার ঘাড়ে, কোরবানির গরু জবাইয়ের একটা লম্বা ছুরি হাতে সে আলাউদ্দিনকে ধাওয়া করল। ধাওয়া করতে করতে গরানপুরের সীমানা ছাড়িয়ে মীরগাঙের চরে তুলল। ভাগ্য ভালো আলাউদ্দিনের, লোকজন এসে ছেরুকে পাকড়াও করেছিল, নইলে লম্বা ছুরিটা তার পেটে না ঢুকিয়ে ছেরু ক্ষ্যান্ত হতো কিনা সন্দেহ।
মণ্ডলবাড়িতে তখন কান্নাকাটি, আহাজারি, বিলাপ। দুপুর নাগাদ কেশব মাস্টারের নিখোঁজ সংবাদ গ্রামে চাউড় হয়ে পড়ল। সমস্ত জনপদ নড়েচড়ে উঠল, মানুষের স্রোত নামল মণ্ডলবাড়িতে। হরিনগর থেকে মানুষ আসে; দাঁতিনাখালী, টেংরাখালী, সিংহড়তলি থেকে মানুষ আসে; মানুষ আসে মুন্সিগঞ্জ থেকেও। মাস্টার মুসলমান হওয়ায় মোল্লেপাড়া, গরানপুর বা হরিনগরের যেসব হিন্দু নরনারী বেঁচে থাকতে কোনোদিন মণ্ডলবাড়ি আসবে না বলে শপথ করেছিল তারাও না এসে পারল না। সবার ভেতর উদ্বেগ উৎকণ্ঠা – কোথায় গেলেন মাস্টার? কে গুম করল তাকে? কেনই-বা গুম করল? গুম হলেন, না খুন?
উঠোনের কোণে বসে চারুবালা মাটি চাপড়ে বিলাপ করছে, তাপসী আর গোপেশ মায়ের পাশে বসে কাঁদছে। যেন একটা মড়াবাড়ি। জাবেদ খান চারুবালাকে সান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু তার ভেতরটাও অজানা শঙ্কায় কাঁপছে। মাস্টার গুম হলেন, না খুন – সেও কিছু বুঝতে পারছে না। খুন হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। এই গরানপুরে কে তার শত্রু? মানুষের সেবায় যে অকাতরে এত শ্রম দিচ্ছেন তার তো কোনো শত্রু থাকার কথা নয়। তাহলে কি তাকে বাঘে নিল? কিন্তু রাতে বাঘ লোকালয়ে হানা দিলে কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই খোচ দেখা যেত। জলজ্যান্ত মানুষটা তবে কোথায় গেল? ভেবে কূল পায় না জাবেদ খান। নানা দুশ্চিন্তা হানা দেয় তার মাথায়। আখেরে না সে ফেঁসে যায়! মুন্সিগঞ্জে তো তার সঙ্গেই গিয়েছিলেন মাস্টার। খসরু চেয়ারম্যান সাক্ষী, হরিনগর আর মুন্সিগঞ্জের হাটুরেরা সাক্ষী।
ঘোলা চোখে উঠোনে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। নানাজন নানা কথা বলছে। কেউ বলছে মোছলেম তালুকদারের গ্যাং মাস্টারকে ধরে নিয়ে খুন করে গোনের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছে। কেউ বলছে গুম করলেও খুন এখনো করেনি, টাকাপয়সা পেলে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবে। আবার কেউ জোর দিয়ে বলছে গুম খুন কিছু নয়, মাস্টারকে বাঘে নিয়েছে। নিবারণ সাধক অপরাধীর মুখ নিয়ে গালে হাত দিয়ে ঠাকুরঘরের কোণায় বসে বসে হা-হুতাশ করছে, ‘আহা, শেষকালে বাবার হাতে কিনা জান দিতি হুলো! তাবিজ তো আমি ঠিকমতোই গাইড়েলাম, কিন্তু অনন্ত মোড়লের প্রেতাত্মা শেয়ালের রূপ ধুরে মাটি খুঁড়ে তাবিজটা তুলে নিলি আমার কী করার আচে?’
গুজবের পর গুজব ছড়ায়। গুজব তার অস্বাভাবিক গতিতে ডালপালা গজাতে গজাতে গরানপুর-হরিনগরের সীমানা ছাড়িয়ে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। হয়ত শ্যামনগরেও পৌঁছে যায় গরানপুরের কোনো এক মাস্টারের নিখোঁজ সংবাদ। দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে মণ্ডলবাড়িতে লোকজন আসছে, হা-হুতাশ করছে, মাস্টারের গুণগান গাইছে, কান্নাকাটিও করছে।
দুদিন কেটে যায়, তবু বাড়ি ফেরার নাম নেই মাস্টারের। তিন দিনের দিন ভোরে টেংরাখালীর বাগ্দিরা সংবাদ নিয়ে এলো কালিন্দীর মোহনায় কোন এক চরে নাকি কার ছেঁড়াখোঁড়া একটা লাশ পাওয়া গেছে। লাশ তারা দেখেনি, শুনেছে। মাস্টারের লাশ কিনা কে জানে।
রাধামাধব ও বিপিনকে নিয়ে কালিন্দীর মোহনার উদ্দেশে রওনা হলো মহব্বত সাজুনি। রাতের জোয়ারে লাশ নিয়ে তাদের নৌকা গরানপুর ঘাটে ভিড়ল। তবে লাশটা কেশব মাস্টারের নয়, ছেরু পাগলার। শরীরের কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। আহারে বেচারা! কে মারল পাগল ছেলেটাকে? কে আবার, তার ওপর ভর করা জিনটা ছাড়া আর কে? মানুষের মনেও তো দয়ামায়া নেই, আর জিন তো জিন, কাফের মরদুদ। এত দিন তার ওপর ভর করে তাকে দেখেশুনে রেখেছে তাতে কি, নিশ্চয়ই কোনো কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে মেরে গাঙে ভাসিয়ে দিয়েছে। মানুষে মারলে আঘাতের চিহ্ন থাকত না?