কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
সাত.
চিঠিখানা পাওয়ার প্রায় দু-মাস পর মাস্টারের ধর্মান্তরের কথাটা প্রকাশ পায়। পুরো ব্যাপারটাই রহস্যঘেরা। যে মানুষ হিন্দু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, রামায়ণ-মহাভারত আর উপনিষদের শত শত শ্লোক যার মুখস্থ, যার বাবা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও ধর্ম ত্যাগ করতে রাজি হয়নি, দুই মেয়ে মুসলমান হয়ে যাওয়ায় যিনি তাদের মেয়ে বলে স্বীকার করতে রাজি নন, তার হঠাৎ মুসলমান হয়ে যাওয়াটা রহস্যের বৈকি। কে জানে, হয়ত তিনি সত্যি সত্যি মুন্সিগঞ্জের আতা মৌলবির কাছে গিয়ে কলমা পড়ে মুসলমান হয়েছেন। ধর্ম নিয়ে তো কেউ আর মিথ্যে বলে না। ধর্ম এক সর্বনাশা আগুন, একবার জ্বলে উঠলে তার ধ্বংসকাণ্ড থেকে কেউ রেহাই পায় না – মাস্টার কি এ কথা জানেন না? নিশ্চয়ই জানেন। জেনেও কেন তিনি চোঙায় ফুঁ দিয়ে ধর্মকুণ্ডের আগুন উস্কে দেবেন? তা ছাড়া আতা মৌলবিও তো বলেনি কেশব মাস্টার মুসলমান হননি।
কেশব মাস্টারের ধর্মান্তরের সঙ্গে চিঠিখানার যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে। হয়ত তাকে হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম কবুল করার জন্য হেদায়াতে ইসলামির পক্ষ থেকে চিঠির মাধ্যমে চাপ দেয়া হয়েছিল। হেদায়াতে ইসলামির চাপে পড়ে ধর্মান্তরের ঘটনা তো নতুন নয়। কাশিমারি, নূরনগর, ভুরুরিয়া বা মুন্সিগঞ্জে এই রাজনৈতিক সংগঠনটির চাপে কত হিন্দু মুসলমান হয়ে গেছে তার তো শুমার নেই। আল-কোরানের আলো ঘরে ঘরে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য পার্টির নেতা-কর্মীরা হামেশা তৎপর। কেউ যদি একজন হিন্দুকে মুসলমান বানাতে পারে, যত পাপই করুক, বেহেশত তার জন্য নিশ্চিত। সেখানে তার জন্য হুর ও গেলমানের সংখ্যা বাড়ে। বেহেশতের অনন্ত সুখ-শান্তির কাছে দুদিনের দুনিয়া তাদের কাছে তুচ্ছ। এতই তুচ্ছ, যে কোনো সময় জীবনটা উৎসর্গ করতেও তাদের কোনো আপত্তি নেই।
শ্যামনগরে এককালে হেদায়াতে ইসলামির অস্তিত্ব ছিল না, কেউ কোনোদিন পার্টিটার নামও শোনেনি। সারা উপজেলা ঘুরেও একজন সমর্থক খুঁজে পাওয়া যেত না। যুদ্ধের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধাওয়া খেয়ে সেই যে দেশ ছাড়লেন জিয়ারত আলী, সাত বছর তার আর পাত্তা নেই। তারপর এক রোজার ঈদে তাকে ঈদগাহের প্রথম কাতারে দেখা গেল। মাথা নিচু করে বসে ইমামের বয়ান শুনছেন। সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা, মুখে চাপদাড়ি, গায়ে দরবার আতরের খশবু। মোনাজাতের সময় হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে দাড়ি-গোঁফ ভিজিয়ে ফেললেন। নামাজ শেষে ছোট-বড় সবার সঙ্গে কোলাকুলি করলেন। দেখতে এমন আল্লাওয়ালা লোকটা হাত দুটো বাড়িয়ে দিলে উপেক্ষা কি করা যায়!
একদিন শোনা গেল তিনি নাকি হেদায়াতে ইসলামি বাংলাদেশ পার্টির নেতা। তার বাড়িতে কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা, যশোর এমনকি খুলনা থেকেও পার্টির বড় বড় নেতারা আসে। তাদের নিয়ে তিনি মসজিদে মিটিং করেন। একদিন মিছিলও বের করলেন একটা। ‘কাদিয়ানিদের আস্তানা জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান উঠল মিছিল থেকে। কাফের কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে মিছিল দেখে সুন্নি মুসলমানরা তো মহা খুশি। খুশি হবে না? কাদিয়ানি কাফেরদের বিরুদ্ধে এই প্রথম শ্যামনগরে মিছিল হলো। চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে জিয়ারত আলী সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিলেন, ‘আন্দোলন শুরু হইছে। এই আন্দোলন চালিয়ে যাতি হবে ভাইসব। সরকার যতক্ষণ পয্যন্ত কাদিয়ানিদের কাফের ঘোষণা না করবে ততক্ষণ আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব এনশাল্লাহ।’
তার বক্তব্য শেষ হলে শ্রোতাদের কেউ কেউ হাততালি দিল। হাত দুটো উঁচিয়ে তিনি তালি থামাতে বললেন। তালি থামলে পরে বললেন, ‘ইসলামে হাততালি না-জায়েয। নবীজির বয়ান শুনে সাহাবিরা কখনো তালি মারেনি, নবীর উম্মত হয়ে আপনারা কীভাবে তালি বাজাচ্ছেন? নাউযুবিল্লাহ!’
জটলার মাঝখান থেকে একজন ‘নারায়ে তকবির’ বলে হাঁক দিলে অন্যরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে পাল্টা হাঁক মারল। তারপর স্লোগান উঠল, ‘জিয়ারত ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে।’
জিয়ারত ভাই এগিয়ে চলেন। তার পিছে চলে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের সাবেক সদস্যরা। এগোতে এগোতে তার খাটো হাত লম্বা হতে থাকে, চারদিকে তার নাম ছড়াতে থাকে, গ্রামে গ্রামে তার কর্মী-সমর্থকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আজ এই গ্রামে তো কাল ওই গ্রামে তিনি মিছিল-মিটিং করে বেড়ান। ঈদে-চান্দে তার বাড়িতে ফকির-মিসকিনদের লম্বা লাইন পড়ে। উঠোনে গদিওয়ালা চেয়ারে বসে তিনি ফিতরার টাকা ও জাকাতের কাপড় বিলান। শুধু ফকির-মিসকিন কেন, বিপদে-আপদে তিনি কার পাশে না দাঁড়ান? এমন জনদরদী মানুষটাকে মাথায় নেবে না তো লোকে পায়ে ঠেলবে?
এখন তো ঘরে ঘরে তার দলের কর্মী-সমর্থক। চারজন চা দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে, দেখা যাবে সেখানে দুজনই হেদায়াতে ইসলামির লোক। গ্রামের মোড়ল-মাতবররা তো বটেই, উপজেলা সদরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও তাকে গুনে চলে। না গুনে উপায় কী? তিনি এখন পার্টির বড় নেতা, তামাম শ্যামনগরে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ, যেমন প্রতাপ ছিল একাত্তর সালে। মানুষ ভুলে গেছে যুদ্ধের সময় তিনি শান্তিকমিটির লিডার ছিলেন। কেশব মাস্টার, জাবেদ খান বা ভক্তদাসের মতো অনেকে হয়ত ভোলেনি। তাতে কি, তারা কি তার পশমটা ছুঁতে পারবে? দাঙ্গা লেগে যাবে না! শ্যামনগরের ঘরে ঘরে তার দলের কর্মী-সমর্থকরা তার জন্য জান কোরবান দিতে প্রস্তুত। ছবেদালি মোড়ল তো উপজেলা কমিটির সদস্য, তার সুবাদে আলাউদ্দিনও ইউনিয়ন কমিটিতে নিজের নামটা যুক্ত করতে পেরেছে। তাদের মতো শত শত কর্মী-সমর্থক দেশে ইসলামি হুকুমত কায়েমের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বোঝাচ্ছে, এই জমিন আল্লাহর। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোনো আইন চলতে পারে না। জিয়ারত আলী বিভিন্ন জনসভা ও ওয়াজ মাহফিলে কোরান-হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে মানুষকে বারবার হুঁশিয়ার করেন, ‘আল্লার জমিনে কোনো তাগুতি আইন চলতি পারে না। কাফের মুশরেকরা এই দেশে তাগুতি আইন চালু করেছে। এই আইনের বিরুদ্ধে মুসলমান ভাইদের রুখে দাঁড়াতি হবে। দ্বীন-এসলামের দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতি হবে ভাইসব।’
দলের কর্মী-সমর্থকরা ‘নারায়ে তাকবির’ বলে তার কথার সমর্থন দেয়, ‘সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে আল-কোরান’ স্লোগানে সারা মাঠ কাঁপিয়ে দেয়।
মুসলমান অধ্যুষিত এই গরানপুরের সবাইকে চাপিয়ে কেশব মাস্টারের মতো একজন পৌত্তলিক হিন্দুর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়াটা হেদায়াতে ইসলামির নেতা-কর্মীদের জন্য বিরাট সমস্যা। সুনাম ছড়াক, তাদের কোনো আপত্তি নেই, আপত্তি শুধু তার ধর্মে। তিনি মুসলমান হয়ে গেলে তার যশখ্যাতি নিয়ে কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করবে না। আর যাই হোক, মুসলমানের দেশে অমুসলিমের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠাটা বরদাস্ত করা যায় না।
অথবা এও হতে পারে, চিঠিতে তার মুসলমান হওয়া-না-হওয়া নিয়ে কোনো কথা লেখা ছিল না, এমন চিঠি লেখার মূল কারণ প্রসূন মাইতির পরিত্যক্ত ভিটা। কেউ হয়ত ভিটাটা দখল করতে চাইছে। সে হয়ত হেদায়াতে ইসলামির বড় কোনো নেতা অথবা পার্টির নেতাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। টাকাপয়সা দিয়ে সে মাস্টারের পেছনে পার্টির কর্মীদের লেলিয়ে দিয়েছে। তারা মাস্টারকে এই বলে গোপনে হুমকি দিয়েছে, দেশান্তরী হিন্দুদের ফেলে যাওয়া সম্পদ মুসলমানদের গনিমতের মাল। মুসলমানরাই এই সম্পদের মালিক। একজন হিন্দু হয়ে কোন সাহসে তুমি প্রসূন মাইতির ছাড়াভিটায় স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছ? এ হুমকিতেই হয়ত তিনি উল্টে গেছেন, বাপ-দাদার ধর্মবিশ্বাসকে অস্বীকার করে রাতারাতি মুসলমান হয়ে গেছেন।
অথবা চিঠিও নয়, হুমকি-ধমকিও নয় – ধর্মান্তরের আসল কারণ তার দুই মেয়ে। যত যাই হোক, তিনি তো জন্মদাতা। সন্তান বেঁচে আছে, অথচ বছরের পর বছর তাদের মুখ না দেখার কষ্ট কোন বাপ সইতে পারে? মেয়েদের জন্য বুকের ভেতর বয়ে বেড়ানো কষ্টের ভারটা হয়ত তিনি আর বইতে পারছিলেন না। একটিবার মেয়েদের দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু যখন জানলেন হিন্দু বলে তাকে শ্বশুর হিসেবে স্বীকার করে না হালিম এবং নমিতাকেও কোনোদিন সে হিন্দু বাবার বাড়িতে আসতে দেবে না, তখন হিন্দু ধর্ম তার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে। প্রশ্ন জাগে, এই ধর্ম কি তবে এতই অসার, যার কারণে তার বাবাকে গুলি করে মারা হলো? দুই মেয়ে বাবা-মায়ের আদর-স্নেহের কথা ভুলে মুসলমান হয়ে গেল? শত্রুরা চিঠি লিখে তাকে কাফের-বেদ্বীন বলে গালাগাল করল?
অথবা এই তিন কারণের একটিও নয়। অন্য কারণ, যা গরানপুরের কেউ জানে না। প্রাণের ভয়ে মাস্টার কাউকে জানাতে সাহস করেননি। এই দেশে কে আছে তার? থাকার মধ্যে আছে কেবল তার দুই শ্যালক। তাও তারা কাশিমারিতে। এত দূর থেকে কী সাহায্য করবে তারা। কাছে থাকলেই-বা কী করত? তার মতো তারাও তো হিন্দু, সংখ্যাগুরু মুসলমানের দেশে সংখ্যালঘু। মুসলমানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো তাদের শক্তি কোথায়?
মাস্টারের ধর্মান্তরের কারণ সম্পর্কে গ্রামের মানুষ নিশ্চিত হতে পারে না। তাই বলে তারা মুখে কলা গুঁজে চুপ করে বসে থাকবে? কথাটা চাউর হলে সারা গ্রামে রৈরৈ পড়ে গেল। কেন মুসলমান হয়ে গেল ম-লের বেটা, যেমন করে হোক এই গোপন কথাটা জানা চাই। কথাটা মাটির অতল-বিতলে চাপা থাকলে প্রয়োজেন মাটি খুঁড়ে লেজ ধরে টেনে বের করে আনবে। কথাটা কারো মুখ থেকে পড়ে না। নানাজন নানা কথা বলে। ছবেদালি মোড়ল বলে, ‘মাস্টার লেকাপড়া জানা মানুষ বুলেই সত্যিটা বাইচে নেচে।’ মুন্সিগঞ্জ জামে মসজিদের ইমাম গোফরান মৌলানা বলল, ‘লেখাপড়া কিচু না, সবই খোদার ইশারা। তিনি যারে ইচ্চা হেদায়েত নসিব করেন, যারে ইচ্চা গোমরাহির পতে রাখেন।’ জাবেদ খান বলে, ‘মাস্টার জ্ঞানী-গুণী মানুষ, যা ভালো মনে হইচে কইরেচেন!’
মাস্টার আসলেই মুসলমান হয়েছেন কি না, আতা মৌলবির কাছে লোকে জানতে চাইলে সে মুচকি মুচকি হাসে, খোলাসা করে কিছু বলে না। নেহাত এড়াতে না পারলে বলে, ‘সবাই মিলে দোয়া করেন আল্লাপাক যেন তারে সহি-সালামতে রাখেন।’
ওদিকে ছিঃ ছিঃ করতে করতে গ্রামের হিন্দুদের মুখে ব্যথা ধরে যায়, থুথু ফেলতে ফেলতে জিবটা পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। কত শতবার তারা দেব-দেবীর নামে শপথ করল, বেঁচে থাকতে কেউ কোনো দিন আর ম-লবাড়িতে যাবে না। মাস্টার মরে গেলে তার মরা মুখটাও কেউ দেখতে যাবে না।
একমাত্র ব্যতিক্রম চারুবালা। সে কোনো কারণ খুঁজল না। কে জানে, হয়ত খুঁজেছে। কিন্তু বাইরে কারো কাছে প্রকাশ করেনি, স্বামীকেও এই ব্যাপারে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বেশ কিছুদিন ধরে শোয়ামির মতিগতি কেমন যেন লাগছিল তার। ধর্মান্তরের ঘটনা প্রকাশ হওয়ার প্রায় পনেরো দিন আগে একদিন ওষুদ রাখার আলমিরাটায় মসজিদের মিনারওয়ালা নীল মলাটের একটা বই দেখে তার খটকা লেগেছিল। বইটা হাতে নিয়ে সে পৃষ্ঠা ওল্টায়। বাংলার ফাঁকে ফাঁকে দুর্বোধ্য এক ভাষা। নিরক্ষর চারুবালা কিছু বুঝতে পারে না। তবে তার বুঝতে অসুবিধা হয় না এটি মুসলমানদের ধর্মীয় বই। তবু তাপসীকে ডাকে, ‘তপু, দ্যাক দিনি এটা কের বই?’
তাপসী উল্টেপাল্টে দেখে বলল, ‘মকসুদুল মোমেনীন। এ তো মা মোছলমানের বই।’
: এ রাম! মোছলমানের বই? বলতিচিস কী!
: হ্যাঁ, দেখচ না আরবি লেখা। কোন্তে আইলো বইডা?
চারুবালা উল্টেপাল্টে আবার দেখে। দেখে কী হবে, অন্ধের কাছে তো সবই সমান। কোনটা আরবি আর কোনটা বাংলা তার কী বোঝে সে? সবই তার কাছে একরকম লাগে। বোঝে শুধু মসজিদের মিনারটা দেখে।
দুপুরে মাস্টার ক্ষেত থেকে ফিরলে বইটার কথা জিজ্ঞেস করল সে। মাস্টারের সরল জবাব, ‘মুন্সিগঞ্জের এক ফেরিওয়ালার কাছেত্থে কিনিচি।’ চারুবালা কিছু বলল না, খানিকক্ষণ শুধু শোয়ামির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পরে ঘোলা মনটা তার পরিষ্কার হয়ে যায়। শোয়ামি তার পণ্ডিত মানুষ, কত শাস্ত্রই তো তাকে পড়তে-জানতে হয়। না পড়লে ছাত্রদের শেখাবেন কী? তার আলমিরায় কত রকমের বই। এত বইয়ের মধ্যে মুসলমানদের দু-একটা বই তো থাকতেই পারে।
কিন্তু পনেরো দিন পর, রাতের বেলায়, সত্যি সত্যি বুঝি তার মাথায় ঠাঠা পড়ল। বউয়ের মুখোমুখি বসে নিস্তেজ কণ্ঠে মাস্টার যখন বললেন, ‘তোমারে কথাডা বলা দরকার চারু’, কেন যেন তখন নীল মলাটের বইটার কথা মনে পড়ল তার। চোখেমুখে গভীর জিজ্ঞাসা নিয়ে শোয়ামির মলিন মুখের দিকে তাকাল, ‘কী হুয়েচে তোমার?’
: কিছু না। কথাডা তোমারে বলা হয়নি।
: কোন কতা?
: কীভাবে যে বলি! কিন্তু তোমাকে বলা দরকার। তোমার মেয়েদের মতো আমিও মুসলমান হইচি।
চারুবালা হাসে, ‘নরেন মোল্লের নাতি মুসলমান হুয়েচে! ধর্ম নে তুমি ঠাট্টা কুত্তেচ?’
: ঠাট্টা না চারু, আমি সত্যি বলতিচি। আমি নতুন নাম নিচি কিশোয়ার ম-ল।
: এ রাম! এসব কতা ভগবান স’বে!
মাস্টার মুঠোয় ধরা একটি কাগজ খুলে ধরলেন, ‘বিশ্বাস না হলি তোমার মাইয়েরে ডাকো। কাগজটায় কী লেখা আচে সে পড়ে শোনাক।’
চারুবালা কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখে। কিছু বোঝে না। তার চোখ যায় আলমিরাটার দিকে। মসজিদের মিনারওয়ালা নীল মলাটের বইটা থেকে একটা তেলাপোকা দ্রুত হেঁটে দেবমূর্তি আঁকা বইটার ওপর বসে শুঁড় নাড়ছে। চারুবালার বিস্মিত চোখ মাস্টারের মুখের দিকে ফেরে। প্রায় তিরিশ বছরের চেনা মুখটা দেখে সত্যি-মিথ্যা বুঝতে দেরি হলো না তার।
: তুমি পাগল হুয়ে গিলে?
: পাগল হইনি চারু, মুসলমান হইচি। চাইলে তুমিও হতি পারো।
চারুবালার মুখটা মরা মাছের মতো হাঁ হয়ে যায়। পান খাওয়া লাল দাঁতের ভেতরের পাটি দুটি দেখা যায়। মাথার তালু বরাবর একটা কঠিন বাজ পড়ে তাকে বুঝি স্তব্ধ করে দিল! হাঁ মুখে শোয়ামির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্বাক, পলকটি পর্যন্ত পড়ে না। শিরার উষ্ণ রক্ত হিম হতে থাকে তার। হিম হতে হতে সারা শরীর অবশ হতে থাকে। মুখটা নাড়াতে পারে না, ঘাড়টা ঘোরাতে পারে না, বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু পর্যন্ত পায় না। এক বসাতেই রাত পোহায়।
শেষরাত। বাদা-আবাদ জেগে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তন্দ্রার ঘোরে চারুবালা শুনতে পায় বৈঠকখানায় মুসলমান পীর-দরবেশের মতো কে যেন জিকির করছে―আল্লাহু আল্লাহু। শরীরে নিদ্রাহীনতার ক্লান্তি আর মনে জগতের সমস্ত বিস্ময় নিয়ে বৈঠকখানার দরজায় গিয়ে দেখে একধ্যানে মুণ্ডু দোলাচ্ছে তার শোয়ামি। মসজিদ বা মাজারের মুসল্লিদের মতো টেনে টেনে সুর করে জিকির করছে – ইল্লাল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…। তার সামনে নীল মলাটের বইটি রাখা।
এই শেষবারের মতো শোয়ামির মুখ দেখা। সারাদিন তার আর খোঁজ নেই। গোপেশ ও তাপসী মাকে মোল্লেপাড়ার বাড়ি বাড়ি খুঁজল। কোথাও নেই। মুকনোলির প্রান্তর পেরিয়ে ভক্তদাসের বাড়ি খুঁজে এলো গোপেশ। সেখানেও নেই। পুবের সুরুজ পশ্চিমে গেল, তার ঘরে ফেরার নাম নেই। কোথায় গেল মা? মনের দুঃখে বনবাস নিল, নাকি চুনকুড়ির জোয়ারে ডুবে আত্মহত্যা করল, ভেবে কূল পায় না তারা। নিশিরাতে ঠাকুরঘরে কাশির শব্দ শুনে তাপসী দৌড়ে গিয়ে দেখে, মা তার দু-হাত জোড় করে দেবীর পায়ের কাছে পড়ে আছে।
মুসলমান শোয়ামির সঙ্গে চারুবালা এক ঘরে আর থাকে কী করে। যে মন্ত্র পড়ে দুজন যৌথ জীবন শুরু করেছিল, সেই মন্ত্র থেকে একজন তো সরে গেছে। অতএব কাঁথা বালিশ ঘটি বাটি নিয়ে সে বৈঠকখানায় উঠল। চাইলে বাপের বাড়ি চলে যেতে পারত। বাপ-মা বেঁচে নেই তাতে কি, ভাইরা তো আছে। অর্থ-সম্পদও কম নয় তাদের। বোনকে তারা নিশ্চয়ই ঠাঁই দেবে। ঠাঁই না দিলেই-বা কি, চলার মতো সম্বল তো তার আছে। মরার আগে তার বাবা তার নামে দশ কাঠা জমি লিখে দিয়েছিল। ভাইরা ভোগ করছে, সে কোনোদিন খোঁজ নেয়নি। খোঁজ নিত, যদি শোয়ামির জমিজিরাত কিছু না থাকত। দশ কাঠা জমির দাম তো কম নয়। ওটুকু জমি দিয়ে অনায়াসে বাকি জীবনটা পার করে দিতে পারবে। কিন্তু সে চিন্তা তাকে বাদ দিতে হয় সন্তানদের কথা ভেবে। বড় দুই মেয়ে নরকে যাক, তার কোনো আফসোস থাকবে না। তার যত চিন্তা গোপেশ আর তাপসীকে নিয়ে। তাদের ফেলে এই বয়সে স্বামীর ভিটা সে ছাড়ে কী করে।
বৈঠকখানায় তার চার দিন কাটল। চার দিনে একবারও সে বাশঘরের দিকে ফিরে তাকায়নি, রান্নাবান্না গরু-গোয়াল ঝাড়মোছ কোনো কিছুরই ধার ধারেনি। চানের সময় গোয়ালঘরের পেছন দিয়ে কুয়োয় গিয়ে দুটো ডুব মেরে এসেছে। তাপসী এসে তিন বেলা ভাত দিয়ে গেছে, প্রথম দিন সে থালার দিকে চোখ তুলেও তাকায়নি। মেয়ের জোরাজুরিতে পরে এক বেলা খেয়েছে তো অন্য বেলা থালার ভাত থালায় পড়ে থেকেছে। কুকুর ঢুকে একবার চেটেপুটে খেয়ে গেছে, সে হাতটি পর্যন্ত নাড়িয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করেনি। শরীরের হিম হয়ে যাওয়া রক্ত তার চার দিনেও উষ্ণ হয়নি। সীমাহীন মনোদৈহিক অবসাদ নিয়ে মড়ার মতো বিছানায় পড়ে থাকল।
সাংসারিক এই গলযোগে দিশা খুঁজে পান না মাস্টার। সারাদিন গুম মেরে বসে থাকেন, রাতে ঘরের দরজাটা খুলে রেখে গভীর রাত পর্যন্ত চুপচাপ বিছানায় বসে বউয়ের অপেক্ষা করেন। কেবলই মনে হয় এই বুঝি বৈঠকখানা ছেড়ে বউ তার বিছানায় এসে শুবে। বসে থাকতে থাকতে হাতে-পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে, চরাচর ঘুমের অতলে ডুবতে থাকে, টেমির তেল পুরিয়ে আলো ক্ষীণ হয়ে আসে, অথচ চারুবালা আসে না। ধৈর্যে আর কুলোয় না তার, ধীর পায়ে বৈঠকখানার দরজার সামনে এসে দাঁড়ান। ভেতর থেকে দরজা ছিটকিনি দেয়া। কপাটে টোকা দিতে হাত বাড়ালে কেউ যেন তার কব্জিটা খপ করে চেপে ধরে। খানিকক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে এসে শুয়ে পড়েন। আধো-ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে রাত পুইয়ে ভোর হয়।
চার দিন পর একটা দিশা তিনি খুঁজে পেলেন। একঘরে থাকতে বউয়ের যখন এতই আপত্তি, তবে তিনি বেরিয়ে গেলেই তো ঝামেলা চুকায়। কিছু বইপুস্তক আর কিছু দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে তিনি বাশ্ঘর ছেড়ে বৈঠকখানায় উঠলেন। চারুবালা কি আর তার আগের ঠিকানায় না ফিরে পারে? সেই যে বৈঠকখানায় উঠলেন মাস্টার, গুম হওয়ার আগ পর্যন্ত একটিবারও আর বাশ্ঘরে ঢুকলেন না।
তাও মাস দেড়েক পর, ধবধবে জোছনার রাতে মুন্সিগঞ্জ থেকে ফেরার পথে গুম হন তিনি। জাবেদ খানসহ মুন্সিগঞ্জে গিয়েছিলেন স্কুলের জন্য ঢেউটিনের দর জানতে। বোর্ড অফিসের সামনের রাস্তায় খসরু চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে চেয়ারম্যান তার অফিসে নিয়ে গেলেন। সুযোগ বুঝে মাস্টার গরানপুরে একটা সরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কথা উঠালেন। চেয়ারম্যান কথা দিলেন, শিগগির তিনি এ ব্যাপারে এসডিও বরাবরে দরখাস্ত করবেন। প্রয়োজনে ডিসির সঙ্গে দেখা করে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করবেন।
ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। খানবাড়ির চৌরাস্তার মোড়ে জাবেদ খানকে বিদায় দিয়ে একা বাড়ি ফিরছিলেন মাস্টার। ওখান থেকে মোল্লেপাড়া প্রায় আধমাইলের পথ। গভীর রাত। দিকচিহ্নহীন বাদাবন সিথানে রেখে গরানপুরের মানুষেরা নিশাঘুমে। পুবের নৈঃশব্দ হামাগুড়ি দিচ্ছে পশ্চিমে। জলে-স্থলে ধবধবে জোছনা। চুনকুড়িতে জোগার গোন। দক্ষিণের জঙ্গলে ক্ষণে ক্ষণে সঙ্গমকাতর বাঘের গর্জন। শেয়ালের হাঁক শোনা যাচ্ছে পুবের জঙ্গলে। রাস্তায় জনমানুষের চিহ্নও নেই। বাড়িঘরগুলোও নৈঃশব্দের কব্জায়।
জামে মসজিদ পার হয়ে মাস্টার যখন চুনকুড়ির আড়ায় উঠলেন ঠিক তখনই দক্ষিণে মাথাভাঙার মোহনার দিক থেকে শব্দটি ভেসে এলো – কুউ। পাখির নয়, মানুষের গলা। পশ্চিমে গরানপুর বাজারে রাতজাগা একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ ডেকে উঠল ভয়ার্ত গলায়। ঘাড় বাঁকিয়ে একবার পেছনে তাকালেন তিনি। না, কোথাও কেউ নেই। সামনে নজর ফেলে দেখলেন রাস্তার ওপর কাদের যেন আবছায়া। জেলে-মাঝিরা বাড়ি ফিরছে বুঝি, ভাবলেন তিনি। এমন চান্নিরাতে অথবা গভীর অন্ধকার রাতে কত হাজার বার তিনি এই পথে হেঁটেছেন, কখনো তার ভয় করেনি, অথচ এখন কেন যেন তার ভয় লাগছে খুব।
তিনি আরো সামনে এগিয়ে গেলেন। লোকগুলোকে এবার আরো স্পষ্ট দেখা যায়। খানিকের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে কী বুঝে আবার হাঁটা ধরলেন। কাছাকাছি গিয়ে গলাখাকারি দিলেন একবার। লোকগুলো সরল না, গোটা পথ আগলে ধাতব মূর্তির মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। মাস্টার নিচুস্বরে বললেন – কে? উত্তর মিলল না। চাঁদের আলোয় লোকগুলো আরো স্পষ্ট হয়। মহাভারতের পাতায় আঁকা তীর-ধনুকধারী দুর্যোধনের নিশিজাগা সৈনিকের মতো মনে হয় তাদের। কারো মুখে গালপাট্টা, কারো মুখে লম্বা দাড়ি, কারো মাথা গামছায় বাঁধা। চেনার উপায় নেই। কারো হাতে গুলালবাঁশ, করো হাতে রামদা, আর কারো হাতে বল্লম। বন্দুকও আছে বুঝি একজনের হাতে।
মাস্টারের সারা গা শিউরে ওঠে। ডাকাতের কবলে পড়েছেন, বুঝতে দেরি হলো না তার। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। চিঠিটার কথা মনে পড়ল। আর মনে পড়ল প্রসূন মাইতি ও চৈতনদাশের কথা। দারুণ অসহায় বোধ করেন তিনি। চিৎকার দিতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই মুখোশপরা লোকটা হাতের রামদাটা আরেকজনের হাতে দিয়ে তার মুখটা গামছায় পেঁচিয়ে ফেলল। বাধা দিলেন না তিনি, মৃদুস্বরে একবার কঁকিয়ে উঠলেন শুধু। তিনি জানেন, বাধা দিতে গেলে ধারালো রামদার আঘাতে তার মুণ্ডু গড়াগড়ি খাবে চৈত্রের ধুলায়। একজন তার পাঞ্জাবির কলারটা খামচে ধরল, লম্বা দাড়িওয়ালা লোকটা পেছন থেকে জোরসে এক ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘হাঁট শালা।’
ধাক্কাটা সামাল নিতে কষ্ট হলো মাস্টারের। পড়ি পড়ি করে টাল সামলিয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকালেন একবার। আলো-অন্ধকারে তার মুখটা বুনো দাঁতালের মতো দেখাল। লোকটা খেঁকিয়ে ওঠে, ‘হাঁট শোরের বাচ্চা।’ বাধ্য হয়ে তিনি হাঁটা ধরেন। গামছাটা কষে বাঁধায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। এক হাতে গামছাটা টেনে নাকের নিচে নামিয়ে আনলেন। তাতে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হলো।
কুকুরটা তখনো অবিরাম ডাকছে। ঘেউ ঘেউ শব্দ ইথারে প্রতিধ্বনি তুলছে। জামে মসজিদের পুবে নদীর আঘাটে একটা গয়না নৌকায় মাস্টারকে তুলে দ্রুত নোঙর তুলল ডাকুদল। গালপাট্টা পরা লোকটা গামছা দিয়ে তার চোখ দুটো বেঁধে ফেলল। দু-চোখে অমাবস্যার অন্ধকার নামল। তবু তিনি আন্দাজ করতে পারলেন নৌকাটা ঠিক দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ দিকটা আন্দাজে রাখতে পারলেন, তারপর নৌকাটা পুবে গেল নাকি পশ্চিমে, ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না।
গভীর রাত। টানা ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ভাটার স্রোতে নৌকা চলছে। নদীর দুই তীরে ঝিঝিপোকাদের অবিরাম ডাক। নৌকায় যাত্রী মোট পাঁচজন। একজন বৈঠা বাইছে, আরেকজন ডেগার হাতে বাতায় হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছে। বাকিরা উদোম গায়ে পাটার ওপর শুয়ে নাক ডাকছে। মাস্টারের শরীরে খিদাজনিত ক্লান্তি। দুপুরে ভাত খাননি, গঞ্জের এক হোটেল থেকে জাবেদ খানসহ মাত্র একটা রুটি আর এক বাটি ডাল খেয়েছিলেন। সারা বিকেল পেটে আর কিছু পড়েনি। খিদায় পেট জ্বলছে এখন। ক্লান্ত শরীরটাকে বাতার সঙ্গে ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। দু-হাত দড়িতে বাঁধা, নড়াচড়ার উপায় নেই। কত মিনতি করলেন, ‘আমি পালাবো না ভাই, হাতেপায়ে খিল ধরে গেচে, বাঁধনটা খুলে দাও।’
ডেগারধারী দাড়িওয়ালা লোকটা খেঁকিয়ে উঠল, ‘চুপ শালা। এ্যাঁহ! শ্বশুরবাড়ির জামাই! তুই না ইস্কুল বানাবি শালা? হাতেপায়ে খিল ধল্লি ইস্কুল বানাবি কেরাম কুরে, এ্যাঁ? খুব পণ্ডিত হইচিস, না? তোর পণ্ডিতি পোঁদের মদ্দি দ্যাবো মালাউনের বাচ্চা। শালা তুই ইস্কুল মারাস! ইস্কুল তোর বাপের পোঙ্গা দে ঢোকাবো বাইনচোত।’
রহস্যভেদী দৃষ্টিতে অন্ধকারে লোকটার মুখের দিকে তাকালেন মাস্টার। বনের গাছগাছালি চাঁদের আলো আড়াল করে রাখায় লোকটার মুখ স্পষ্ট ঠাওর করা যায় না। যে রহস্যটা এত দিন মাস্টারের মাথায় মণ মণ বোঝা হয়ে চেপে বসেছিল, লোকটার খিস্তিখেউড় শুনে মুহূর্তে নেমে গেল। গরু চুরি, গাদায় আগুন, ঘরে ঢিল এবং সর্বশেষ চিঠি লিখে হুমকির পেছনে আসল কারণ বুঝি তার জানা হয়ে গেল। বাঁকা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে নিষ্পলক তিনি চির রহস্যময় বনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। জল কেটে কেটে নৌকা চলছে, চাঁদের আলোয় চিকিয়ে উঠছে ভাঙা ঢেউগুলো। পাটাতনের নিচে শিঁশিঁ আওয়াজ, বাদায় বনমোরগের কোঁকর কোঁ বাঁক। নৌকার দুলুনিতে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে তার। এখন আর কোনো অস্থিরতা নেই তার ভেতর। থানাহাজতের আসামির মতো মাথা ঝুঁকিয়ে থুতনিটা বুকের সঙ্গে ঠেকিয়ে বগলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে তিনি ঘুমের পাতালে ডুব দেন।