শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
প্রায় দেড় মাস ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসায় নোমান। অনেকগুলো দিন মৃত্যুর সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ চলেছে। দিনরাত জেগে আফিয়া বেগম ছেলের বেডের পাশে বসে থাকতেন। হু-হু করে কেঁদে উঠতেন। গত দেড়মাস ধরেই তার নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই। নোমানের মামা-মামীরা নিয়মিত এসে বসে থাকতেন। নোমানের মা-বাবার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে আসতেন। কিন্তু কিছুই তাদের মুখে রুচত না। প্রতিদিন বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য নোমানের মামী আফিয়া বেগমের হাতে পায়ে ধরত। আফিয়া রাজি হতেন না।
এরমধ্যে ইঞ্জিনিয়ার সাহিদ সাহেবের স্ত্রী রুবাইয়া এসে প্রায় পনেরো দিন ডিউটি করল। এই সময় আফিয়া বেগম কয়েকবার তার ভাইয়ের আজিমপুরের বাসায় যেতে বাধ্য হলেন। রুবাইয়া জোর করে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আফিয়া বেগম জানেন এই মেয়েটির কেন জানি জোর করার একটা অধিকার আছে।
দেখা গেল আফিয়া বেগম চলে গেলে রুবাইয়া নোমানের মাথার কাছে বসে থাকত। তার চোখ দিয়ে নি:শব্দে পানি গড়িয়ে পড়ত। হাসপাতালে অনেকদিন থাকা সব রোগীর আত্মীয়রা একে অপরের খোঁজখবর করে। দু-একজন রুবাইয়াকে এসে জিজ্ঞেস করত, ‘আপনের স্বোয়ামির এখন কী অবস্থা?’
রুবাইয়ার আরো জোরে কান্না পেতো। সে নিরুত্তর থাকত। কিছুই বলত না।
নোমান একেবারে চুপ হয়ে গেছে। কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। অধিকাংশ সময় চোখ বুজে থাকে। তাকিয়ে থাকলেও নিষ্পলক সবাইকে দ্যাখে। সবার কথা শুনে। আবার চোখ বুজে ফেলে।
মোয়াজ্জেম সাহেবের তিন লাখ টাকার অধিক ব্যয় হয়েছে। তা হোক, নোমানের জন্য সব খরচ হলেও, তিনি নিঃস্ব হয়ে গেলেও আপত্তি নেই। কিন্তু তারপরও দু-একটি খরচে তার আপত্তি ছিল। যেমন হাসপাতাল থেকে সার্টিফিকেট দেবে না। তিনি তিন হাজার টাকা ডাক্তারের হাতে তুলে দিয়ে সার্টিফিকেট নিয়েছেন।
তিনি ডাক্তারকে টাকা দিতে দিতে ভেবেছেন, ডাক্তার না, এগুলো পিশাচ। এবারই তাঁর প্রথম ধারণা হয়েছে, এই দেশ আর কোনোদিন ভাল হবে না। এদেশের মানুষ হিসাবে গর্ব করার সৌভাগ্য তার হবে না। তাঁর মৃত্যুর অনেক পর কোনো এক দূর ভবিষ্যতে যদি চেঞ্জ হয়। তিনি বিশ্বাস করেন, যে দেশের চিকিৎসক এবং বিচারকরা পচে যায় সে দেশের চেহারা হয় ভয়ানক কুৎসিত, কুষ্ঠ রোগীর মতো।
হাসপাতাল থেকে মাঝে মাঝে ড্রেসিং খোলা হয়। সেজন্যও অর্থ খরচ করতে হয়। আফিয়া বেগম চিৎকার করে কাঁদেন। ভয়ঙ্কর এক দৃশ্য। দুই হাতের দুই পাঞ্জা না থাকায় দেখলে মনে হয় যেন গাছের দু’টি ডাল। সেই ডালের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে দা দিয়ে কেটে দেয়া হয়েছে।
সকালেই ঠিক ড্রেসিংয়ের পরপরই রুবাইয়া এল।
নোমান তাকিয়ে দেখল। তারপর চোখ বুজে ফেলল।
আফিয়া বেগম রুবাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি উপজেলায় যাওনি?’
‘গিয়েছিলাম। ফিরে এসেছি।’
‘তোমার ঘর তো খালি, তোমার সাহেবকে দেখবে কে?’
রুবাইয়া একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, ‘জানি না। রান্নার লোক আছে।’
আফিয়া বেগম আর কিছু বললেন না। একটু পর বললেন, ‘আমি একটু ভাইয়ের বাসায় যাই। গোসল করে আসি?’
রুবাইয়া বলল, ‘কোনো অসুবিধা নাই, আপনি যান। আমি আছি।’
বেশ খানিকক্ষণ রুবাইয়া চুপচাপ বসে আছে।
হঠাৎ নোমান বলল, ‘রুবাইয়া।’
চমকে উঠল রুবাইয়া। তাকিয়ে দেখল নোমান চোখ বুজে আছে।
‘একটা কাজ করতে পারবি?’
‘কী বল, নিশ্চয়ই পারব।’
‘রোদনাকে একটা খবর দিবি?’
‘দিব।’
‘ওর মোবাইল নাম্বার আছে।’
‘আমি গতকাল একটি মোবাইল কিনেছি। তোকে বলা হয়নি।’
‘ভাল করেছিস।’
‘খালাম্মা এলেই আমি বের হবো।’
‘যাওয়ার দরকার নেই, ফোন কর।’
‘না, আমি নিজে যাব।’
আফিয়া বেগম ফিরে আসতেই রুবাইয়া হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এল। নোমানের দেওয়া নাম্বারে মোবাইল নাম্বারে ফোন করল। একটা সিএনজি ভাড়া করে বনানীর ১২ নম্বর রোডের বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বিশাল দোতালা বাড়ি। রোদনারা শুধু ধনী না, তারচেয়েও অনেক বেশিকিছু। রুবাইয়া একবার ভাবল, এমন ধনী লোকের মেয়ে হঠাৎ সাধারণ ঘরের ছেলের সঙ্গে প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু বন্ধুত্ব হয়না। কী সম্পর্ক রোদনার সঙ্গে নোমানের?
রোদনা বের হয়ে এসে রুবাইয়াকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ড্রইংরুমে নিয়ে এল। রোদনা বলল, ‘কী হন আপনি নোমানের।’
মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে রুবাইয়া বলল, ‘বন্ধু, আমরা একসঙ্গে পড়েছি।’
প্রায় দু’মাস হয়ে গেল ওর কোনো খোঁজ পাই না। মোবাইল ফোনও নেই যে খোঁজ নেব।
‘নোমান আপনার কেমন বন্ধু?’
রোদনা একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কেন বলুন তো?’
‘এমনিতেই জানতে চাচ্ছি। আপনার সঙ্গে কথা বলব, কী দিয়ে শুরু করব, তাই একটা কথার কথা।’
‘আচ্ছা, আমি একটা কথা জানতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘দু’মাস হল নোমানের দেখা নেই। এরপর আপনি ফোন করে জানালেন, নোমানের ব্যাপারে কিছু আলোচনা করতে চান। আমি একটা অস্বাভাবিকতার গন্ধ পাচ্ছি।’
‘অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে পারে না?’
‘নিশ্চয়ই পারে। মানুষের জীবনে প্রতি পদে পদেই অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে।’
রুবাইয়া বলল, ‘আপনি খুব ভাল একটি মেয়ে। দেখলেই বোঝা যায়।’
রোদনা হাসল। বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, আপনাকেও আমার পছন্দ হয়েছে।’
রুবাইয়া বলল, ‘নোমান কেমন ছেলে আপনার দৃষ্টিতে?’
‘আপনি কী জানতে চাচ্ছেন, নোমানকে আমি ভালবাসি কি না?’
‘এক্সাক্টলি।’
রোদনা একটু সময় নিল। তারপর বলল, ‘ঠিক তের বছর বয়সে আমি একজনের প্রেমে পড়ি। কী আবেগ কী উচ্ছ্বাস আমার তখন! সেই মানুষটিকে নিয়ে কল্পনায়, সেই মানুষটিকে নিয়ে চিন্তায় সারাক্ষণ বিভোর হয়ে থাকতাম। পড়তে ভাল লাগতো না। পড়ার টেবিলে বসলেই বইয়ের সামনে ওই মানুষটির ছবি ভেসে উঠতো। সংক্ষেপে বলি। একদিন হঠাৎ সেই মানুষটি উধাও হয়ে গেল। এত ছোট বয়স যে কারো কাছে তার খোঁজ খবরও করতে পারি না। মেট্রিকে করলাম খারাপ রেজাল্ট। অবশেষে জানতে পারলাম, মানুষটা কানাডা চলে গেছে। যাহোক, সেই প্রচণ্ড ধাক্কার উপর ধীরে ধীরে পলেস্তরা পড়তে থাকে। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। মানুষের যা ন্যাচার। হঠাৎ একদিন পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে আমি ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম! মনে হল সেই মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে, অথচ আমাকে চিনতে পারছে না। উপর দিয়ে বুঝতে দিলাম না, কিন্তু মনে মনে পাগল হয়ে গেলাম কথা বলার জন্য। দেখলাম, না, দেখতে এক রকম হলেও একই মানুষ না। এর নাম নোমান।’
‘অর্থাৎ নোমান আপনার প্রেমের ডামি?’
রোদনা একটু সময় নিল। তারপর বলল, ‘জগতের প্রতিটি মানুষের মধ্যে আলাদা আলাদা আকর্ষণ আছে। পরিচয়ের পর আমি নোমানকে দেখে বিস্মিত হয়েছি। অসাধারণ এক মানসিক গঠন। প্রায় সেই কিশোর বয়সের মতই আবার আমার মধ্যে প্রেমের জ্বর আসতে শুরু করেছিল। যদিও আমাদের মধ্যে পুরোপুরি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। নোমান গ্রামের বাড়িতে গেল সাতদিনের জন্য। মনের ভেতর কেমন এক নিঃসঙ্গতা উপলব্ধি করলাম। এই আরকি।
‘খোঁজ নেওয়ার ইচ্ছা হয়নি?’
‘না, সেটা আমার রুচিতে বেঁধেছে। মনে হয়েছে ও তো এলেই দেখা হবে। দ্বিতীয়ত আমি এখন আর ছোট নেই। ইচ্ছা করলেই তো খোঁজ নিতে পারি। একটি নির্দিষ্ট সময় পার হলেই খোঁজ নেব।’
‘যাকে অনুভব করতে শুরু করেছেন সে মানুষটার খোঁজ নেওয়ার সময় কি দু’মাসেও হয়নি?’
রোদনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘হতো, কিন্তু দেড় মাস আগে একটি নতুন নাটক ঘটে গেছে।’
‘কী সেটা?’
‘নোমান চলে গেল দেশের বাড়ি, ঠিক তার ১১ দিন পর আমার সেই কৈশোরের মানুষটিকে আবিস্কার করলাম গুলশানে! যদিও মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আবার দেখা না হলেই ভাল হতো।’
‘তাতে ক্ষতি কোথায়?’
‘নাটকের মত লাগছে। আমরা এরমধ্যে বিয়ে করেছি। এ সপ্তাহেই আমি কানাডা চলে যাচ্ছি। খুবই ভাল সময় আপনার সঙ্গে কথা হল। আমি জানি আপনি কী খবর নিয়ে এসেছেন।’
‘কী?’
‘নোমান বিয়ে করেছে, তাই না?’
রুবাইয়া কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘সেই বিবাহিত মেয়েটি কি আপনি?’
‘হ্যাঁ।’
‘অভিনন্দন আপনাকে। আপনি সৌভাগ্যবান। নোমান অদ্ভুত একটা মানুষ। আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি, সারা জীবনে একদিন জন্যও আপনার কাছে বোরিং লাগবে না। জগতে এরচেয়ে ভাল কিছু পাওয়ার নেই।’
‘ধন্যবাদ, আপনি নোমানকে বুঝতে পেরেছেন। আপনি কেন সে সুযোগ ছাড়লেন?’
রোদনা দুর্বল কণ্ঠে বলল, ‘এমন পরিস্থিতিতে জীবনের প্রথম প্রেম জয় লাভ করে বলে।’
একটু থেমে রোদনা বলল, ‘কিন্তু একটা বিষয় আমি বুঝতে পারিনি।’
‘কী সেটা, বলেন। আমার জানা থাকলে আপনাকে উত্তর দেব।’
‘আপনি আমার কাছে এসেছেন কেন?’
‘নোমান আপনাকে ভালবাসতো। তাই আপনাকে দেখার খুব শখ হয়েছিল। আমি আপনার কানাডার নতুন জীবন শুভ কামনা করি।’
বলেই রুবাইয়া আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দিল না। হনহন করে বের হয়ে চলে এল।
বাইরে এসে একটি ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করল। হাসপাতালের দিকে যেতে যেতে রুবাইয়া ট্যাক্সির মধ্যে হু হু করে কাঁদতে থাকল। কেন কাঁদছে সে জানে না, কার জন্য কাঁদছে সে জানে না। কেমন যেন সারা দুনিয়া ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তাই কান্না চেপে রাখতে পারছে না।
হাসপাতালে এসে দেখল নোমান অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঠিক ক্লান্ত মানুষ যেমন করে ঘুমায়।